আর্কাইভভ্রমণ গদ্য

ভ্রমণ : মৃৎশিল্পীর কটেজ, বাজার ও লবণের উপত্যকা : মঈনুস সুলতান

ঘুম ভাঙ্গতেই কাচের জানালা দিয়ে দেখতে পাই, বাইরে গাঢ় কুয়াশায় নদীসংলগ্ন প্রান্তর ধূসর হয়ে আছে। শরীর থেকে জাদুবলে যেন উবে গেছে আলটিচিউড সিকনেস-সংক্রান্ত ক্লেশ ও ক্লান্তি। আমি এ মুহূর্তে যে কাঠের কটেজে দিন তিনেকের জন্য বসবাস করছি, তার স্বত্বাধিকারী হচ্ছেন পেরুর নামজাদা মৃৎশিল্পী আদিবাসী কেচোয়া গোত্রের সন্তান সিনিওর আকাপানা নায়ারাক। ঘুম থেকে এখনও উঠেননি তিনি। আমি আলগোছে দোতালা থেকে ক্যাঁচমেচানো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে যাই।

মাস্টার বেডরুমের দুয়ার খুলে নীলাভ নাইটিতে অগোছালোভাবে শরীর মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে আকাপানার নারীসঙ্গী সিনোরিতা উরপি। অষ্টাদশী এ মেয়েটি কথা বলতে অপারগ, তবে অত্যন্ত সংবেদনশীল। তার সঙ্গে আমি এ মুহূর্তে ইশারায় বাতচিত করতে চাই না। তাই চোখাচোখি অ্যাভোয়েড করে জোর কদমে বেরিয়ে আসি আঙিনায়।

খানিক দূরে, শিলাপাথর চুবিয়ে, খরস্রোতে ভেসে যাওয়া উরুবাম্বা নদীটি কম্পোজারের দক্ষতায় সৃজন করছে চলছে নিসর্গ-নিষিক্ত সিম্ফনি। হেঁটে যেতে যেতে চাক্ষুষ করি, নারীর গণ্ডদেশে প্রসাধনের মতো কুয়াশার পরতে পরতে লেপে যাচ্ছে ভোরের সূর্যচ্ছটা। নদী-পাড়ে এসে কিছুক্ষণ স্রোতের প্রবল তোড়ে জমে ওঠা শ্বেত-শুভ্র ফেনার দিকে মশগুল হয়ে তাকিয়ে থাকি। কোথাও কোথাও স্বচ্ছ বুদ্বুদগুলো সোনার টোপর পরে ভেসে যাচ্ছে, ভাসতে ভাসতে বিস্ফোরিত হচ্ছে, তাতে ছড়িয়ে পড়ছে রঙধনুর আভা। দিগন্তে ততক্ষণে দৃশ্যমান হচ্ছে, সাদা ও কালোয় মেশানো সহস্র ডলফিনের সমাহারে সৃষ্ট আশ্চর্য এক আকৃতি! অলীক এ দৃশ্যপটের দিকে আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। আইসক্রিম কোণের মতো তুষার-ধবল চূড়া নিয়ে ক্রমশ জেগে উঠছে আন্দিজ পর্বতমালা। ডলফিনের বিভ্রম ছড়ানো আকৃতিগুলো লোপ পেয়ে, তুষার ছড়ানো শিখর নিয়ে কালো কষ্টিপাথরের পর পর বেশ কতগুলো পাহাড় স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

আমি ইনকাদের সেক্রেড ভ্যালি নামে পরিচিত পবিত্র উপত্যকার ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে ভাবি। শুনেছি যে, উরুবাম্বা নদীতে নিশিরাতে প্রতিফলিত হয় সম্পূর্ণ ছায়াপথ। এছাড়া আন্দিজের বেশ কয়েকটি ফুটহিলসের আকার-আকৃতির সঙ্গে মহাকাশের একাধিক নক্ষত্র-মণ্ডলের ভিজ্যুয়েল সাযুজ্য আছে। সুতরাং ইনকারা ওই সব পাহাড় তথা ওলানতাইতামবো, পিসাক কিংবা মাচু পিচুতে নির্দিষ্ট নক্ষত্রমণ্ডলীর সমান্তরাল রেখায় গড়ে তুলেছিল সূর্য-চন্দ্রের যুগল-মন্দির এবং পাচামামা বা জননী-প্রতিম পৃথিবীর পূজাঅর্চনার নিরিবিলি থানও। আন্দিজ অঞ্চলের ইনকা সংস্কৃতিতে পবিত্র উপত্যকা বিবেচিত হয় মহাকাশের মাইক্রোজম বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুকৃতি হিসেবে।

কুয়াশা ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভোরের নওল আলো। তাতে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বুনো হানি-সাকোল ও বেগুনি রঙের ডেইজির ঝোপঝাড়। বোল্ডারগুলোর আশপাশে ঝেপে ফুটেছে সানবার্স্ট ক্যাকটাসের সোনালি ফুলদল। তাতে পালা করে মধু চুষছে জায়েন্ট সাইজের চার-চারটি হামিংবার্ড। এ পাখিগুলো আচরণে এমন এগ্রেসিভ যে―মাঝেমধ্যে সিনিওর আকাপানার স্টুডিওতে ঢুকে পড়ে এরা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখে, মৃৎপাত্রের নকশায় ফুটে ওঠা ফুলের বর্ণবিন্যাস। মৃৎশিল্পীর নারীসঙ্গী সিনোরিতা উরপি ফুলপাতার মোটিফ আঁকা বর্ণাঢ্য ব্লাউজ ও আন্দিয়ান কেতার স্কার্ট পরতে ভালোবাসে। তার শরীরের চারপাশেও হামিংবার্ডগুলো ওড়াউড়ি করে ‘বাঝিং-সাউন্ড’ ছড়াতে পছন্দ করে।

 মৃৎশিল্পী আকাপানা নায়ারাকের সংসারে পেয়িং গেস্ট হিসাবে আমার বসবাসের মেয়াদ আজ শেষ হয়ে এসেছে। মানুষটি নাওয়া-খাাওয়া ভুলে সারা দিনমান জল-কাদা ছেনে গড়েন নানাবিধ তৈজস ও মৃৎপাত্র। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর জীবন সম্পর্কে টুকটাক তথ্যও দেন। মাওবাদী ‘শাইনিং পাথ’ গেরিলাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে খোলাখুলি জানান যে, মাওবাদ প্রভৃতি তিনি তেমন বোঝেন না, তবে গুপ্ত এ রাজনৈতিক আন্দোলনের সদস্যরা ইনকা সাম্রাজ্যের এথনিক উত্তরসূরি আদিবাসী কেচোয়াদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সোচ্চার ছিল। শহর থেকে রসদ ও ওষুধপত্র কেনার প্রয়োজনে তারা আন্দিজ পাহাড় থেকে নেমে আসত মাঝেমধ্যে। এখন তাঁর কটেজ-স্টুডিওর যে দুটি কামরা তিনি পেয়িং গেস্ট গোছের পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেন, ওখানেই তারা রাত কাটাত। ওদের সঙ্গে মৃৎশিল্পী আকাপানার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল তাঁর তৎকালীন স্ত্রী সিনিওরা চাসকা। তারপর পারিবারিক দ্বন্দ্বের জের ধরে একদিন চাসকা তাঁকে ছেড়ে এক বিপ্লবীর বাহুলগ্না হয়ে চলে গিয়েছিল, আন্দিজ পাহাড়ে শাইনিং পাথের গোপন আস্তানায়। সে আর সংসারে ফিরে আসেনি। ওই ঘটনা জানাজানি হলে, সিকিউরিটি ফোর্স তাঁর কটেজে খানাতল্লাশি করে তাঁকে পুরেছিল কারাগারে। আড়াই বছরের মাথায় মাওবাদী বিপ্লবের তামাদি হয়। তখন তিনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা থেকেও কাকতালীয়ভাবে বেকসুর খালাস পান। স্ত্রী চাসকার খোঁজখবরও করেছিলেন, কিন্তু তার হোয়ার আবাউট সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু জানতে পারেননি।

প্রবল কিরণের উষ্ণতায় কুয়াশার ধূসরিমা উবে গেলে আমি ফিরে আসি কটেজে। আঙিনায় পর পর তিনটি ফিউশা গাছে ঝেপে এসেছে লালে গোলাপি মেশা ফুল। ঝারি হাতে কোমর বাঁকিয়ে তাতে জল দিচ্ছে সিনোরিতা উরপি। এথনিক মোটিফের টপ-স্কার্টে তাকে রোদ পড়া সিল্কের মতো উজ্জ্বল দেখায়। পদশব্দে গ্রীবা বাঁকিয়ে সে তাকায়। তারপর সোজা হয়ে ইশারায় কিচেন টেবিলে যে ব্রেকফার্স্ট রাখা আছে―তা জানিয়ে ঝারি হাতে চলে যায় অন্য একটি ফুলগাছের দিকে। মেয়েটির দু কানে গোঁজা দুটি ফুল ঘিরে স্বচ্ছ ডানার ঝি… ঝি… ঝি… ধ্বনিতে উড়ে বেড়ায় বড় দুটি হামিং বার্ড।

কিচেনে এসে আমি চুপচাপ ব্রেকফাস্ট ঘাঁটি। কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারি না সিনোরিতা উরপির একই সঙ্গে অন্তর্ভেদী ও অন্যমনস্ক দৃষ্টিপাত। আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রঙ বানানোর রসদপত্র কিনতে সিনিওর আকাপানা বেরিয়ে যান। আমি কফি পান করতে করতে কিচেনের উইন্ডোসিলে রাখা তৈসজপত্রের তিনটি নমুনা খুঁটিয়ে দেখি। সিনিওর আকাপানার হাতে গড়া এ মৃৎপাত্রগুলোর নকশা একেঁছে উরপি। সিনিওরের ভাষায়, মেয়েটির জন্ম হয়েছে মিডিয়াম বা আধ্যাত্মিক মাধ্যম হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে। উরপি অত্যন্ত সহজাতভাবে শনাক্ত করতে পারে আন্দিজ পর্বতমালার গুহাগহ্বরে লুকায়িত তৈজস নির্মাণের সঠিক মৃত্তিকা।

এ কটেজে বসবাসের দোসরা-দিন, সন্ধ্যাবেলা, মাটির বিরাট সানকি-ভরা ভেষজ আরক নিয়ে আমরা আঙিনায় দাঁড়িয়েছিলাম। হরেক রকমের শিকড়বাকড়ের নির্যাসে প্রস্তুত তরলটি নাকি ঋতুমতি উরপি তৈরি করে রেখেছে, শরীরে ভরা জ্যোৎস্না মেখে পূর্ণিমা রাতে। আন্দিজ পাহাড়ের তুষারাচ্ছন্ন চূড়ায় ফুটে উঠলে বৃহস্পতি, সিনিওর আকাপানা দারুণ কসরতে সানকিটি এমনভাবে তুলে ধরেন যে, তাতে প্রতিফলিত হয়েছিল সোনালি গ্রহের সম্পূর্ণ অবয়ব। তারপর তিনি চামচ দিয়ে উরপিকে খাওয়ান ভেষজ আরক। ততে মেয়েটি নেশাগ্রস্ত হয়েছিল কিনা আমি নিশ্চিত নই, তবে নক্ষত্রের আলোয় সে মাদুরে বসে স্কেচখাতায় এঁকেছিল বেশ কতগুলো নকশা ও মোটিফ।

এসব মোটিফ ব্যবহার করে তৈরি তিনটি তৈজসের নমুনার দিকে তাকিয়ে আমি সিনিওর আকাপানার দেওয়া একটি তথ্য নিয়ে ভাবি। ইনকা তথা কেচোয়া সম্প্রদায়ের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের আত্মা, তাদের সৃষ্টি তত্ত্বানুযায়ী, বসবাস করছে বৃহস্পতি গ্রহের বাতাবরণে। সে সূত্রে, তবে কি উরপি বৃহস্পতির প্রতিবিম্ব ছোঁয়া পানীয় পান করে সমর্থ হয়, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মৃৎপাত্রে আঁকাজোকার মোটিফ সংগ্রহ করতে ?

এখানে আমার বসবাসের প্রথম দিনে, সিনোরিতা উরপির পরিচয় দিতে গিয়ে আকাপানা জানিয়েছিলেন যে, ‘বেবে দে গোয়েররা’ বা ‘যুদ্ধশিশু’ নামে পরিচিত, গেরিলাদের পাহাড়ি ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া মেয়েটি পিতৃ-পরিচয়হীন। গুলিতে নিহত মায়ের লাশ জড়িয়ে আহাজারি করা নয় বছরের বালিকা উরপিকে সিকিউরিটি ফোর্স এনে জমা দিয়েছিল কুসকো কারাগারের কমপাউন্ডে জেলরক্ষীদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত শিশু-কিশোর- সংশোধনী এক এতিমখানায়। সিনিওর আকাপানার কারাবাসের দিনগুলিতে, তাঁকে এতিমখানায় শিশুদের মৃৎপাত্র নির্মাণের কলাকৌশল শেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। তখন পরিচয় হয় চৌদ্দ বছর কিশোরী উরপির সঙ্গে। কারামুক্ত হয়ে, উকিলমোক্তার ধরে, উৎকোচের তহবিলে প্রচুর টাকাপয়সা দিয়ে তিনি ষোড়শী উরপিকে এতিমখানার বাইরে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। সে থেকেই মেয়েটি তাঁর সংসারে আছে।

কারারুদ্ধ হওয়ার পয়লা মাসে পেরুর স্বনামধন্য এ মৃৎশিল্পী শিকার হয়েছিলেন দৈহিক নির্যাতনের। নখের নিচে সুচ ফোটানোর প্রতিক্রিয়ায় আঙ্গুলের ডগায় যুক্ত স্নায়ুতন্ত্রী ব্যাপকভাবে জখম হয়েছিল। তবে এখনও দু হাত ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করতে পারেন তৈজসপত্র, কিন্তু রঙতুলি দিয়ে নকশা আঁকতে কষ্ট হয়। মেয়েটি নকশায় রঙ করার কাজ শিখে নিয়ে তাঁর মুশকিল আসান করেছে।

তাঁদের অন্তরঙ্গতা দেখে বোধ করি আমার চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল কৌতূহল, সিনিওর আকাপানা কাষ্ঠহাসি হেসে নিজে থেকেই জানান যে, উরপির সঙ্গে বিবাহিত হওয়ার আগ্রহ তাঁর ছিল, কিন্তু মেয়েটি পিতৃপরিচয়হীন এবং জন্মের পরে সে খ্রিস্টীয় প্রথা মোতাবেক পরিশুদ্ধ হয়ে ধর্মও গ্রহণ করেনি, সুতরাং স্থানীয় চার্চ বিবাহে সম্মতি দেয়নি; উল্টা তাঁকে ব্যাভিচারের দায়ে সমাজচ্যুত করেছে। আমাদের কথাবার্তা চলাকালে, হাসিমুখে কফির সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকেছিল উরপি। সিনিওর আকাপানা সস্নেহে তার কটিদেশ জড়িয়ে কাছে টেনে নিয়ে বলেছিলেন, ‘মিরা, সু সনরিসা তিয়েনে ভেরদোদেরা মাহিয়া,’ বা ‘দ্যাখো, মেয়েটি হাসিতে কী রকম জাদু মাখানো,’ এ বক্তব্যের সঙ্গে নীরবে আমি সহমত পোষণ করেছিলাম।

সেলফোনে টেক্সট এলে আমার ভাবনা-চিন্তায় ছেদ পড়ে। আমাকে পিক করতে মিনিট দশেকের মধ্যে আসছে ট্যুর কোম্পানির গাড়ি। তো উঠে মালপত্তর গুছিয়ে ব্যকপ্যাক-বস্তনি প্রভৃতি নিয়ে ফের নেমে আসি নিচে। উরপি এসে নীরবে ঝাড়পোচ করতে শুরু করে শেল্ফে শেল্ফে সাজিয়ে রাখা তৈজসপত্র। আমার অবচেতনে কিছু একটা প্রত্যাশার অবসান হয়, অনুভব করি অব্যাখ্যাত আনন্দ। উরপি কাছে এসে, অ্যাপ্রোনের পকেট থেকে নোটবুক বের করে ধোঁয়া ওড়া পেয়ালা এঁকে জানতে চায় আরেক কাপ কফি চাই কি না ? আমি ব্যাকপ্যাক প্রভৃতি দেখিয়ে ইশারায় জানাই, মেয়াদ শেষ হয়েছে, অন্য কোথাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছি। কাঠপেন্সিলের নিপুণ আঁচড়ে মুখমণ্ডলে অশ্রুর বিরাট দুটি ফোঁটা সে আঁকে। দোরগোড়ার বাইরে শোনা যায় গাড়ির হর্ন।

গাড়িটি স্টার্ট দিলে, ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে, প্রায়-আড়াই দশক পর কাউকে ফের প্রত্যক্ষ করার প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে তাকাই। বিমুখ হতে হয় না। দোতালার জানালা জড়িয়ে বেয়ে ওঠা, পুষ্পিত মর্নিংগ্লোরির ঝাড়ের ছায়ায় উরপিকে পলকের জন্য ফের দেখতে পাই।

পেছনের সিট থেকে পাখির চিঁউ চিঁউ ডাকের সঙ্গে ভেসে আসে লুই পিয়ারের ভরাট কণ্ঠস্বর, ‘আর ইউ অ্যাভয়েডিং মি, সুলতান ?’ চমকে ওঠা চেপে গিয়ে সওয়াল করি, ‘মশিয়ো পিয়ারে, হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুয়িং হিয়ার ?’

কানাডার খেচর-প্রিয় নাগরিক লুই পিয়ারে ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রপ-ডাস্টার প্লেন উড়ানো সাবেক পাইলট মেরি-প্যাট মাগিংগার-এর সঙ্গে মিলেঝুলে, আমি একটি ল্যান্ডরোবার ভাড়া করে, পেরুর আয়াকুচা নামক একটি নগরী থেকে দিন চারেক আগে এসে পৌঁছেছিলাম ইনকা যুগের রাজকীয় রাজধানী কুসকোতে। ওখানে পৌঁছে আমি কুসকোর কাছাকাছি রেইন বো মাউন্টেনের পাদদেশে একটি লোকালয় দেখতে যাই। লুই পিয়ারে ও মেরি-প্যাট রওয়ানা হন চিনচিরো শহরের দিকে। তো লুই পিয়ারের সঙ্গে ফের দেখা হয়ে যাওয়াতে খুশি হই।

এ মুহূর্তে লুই পিয়ারে আমার প্রশ্নের জবাবে প্রচুর সময় নিয়ে আস্তে-ধীরে কথা বলেন। তার বিস্তারিত রেসপন্স থেকে জানতে পারি, আমার পাখি-প্রিয় সাঙ্গাত ও অবসরপ্রাপ্ত বৈমানিক, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অধিক উচ্চতার জন্য দুজনের কেউই চিনচিরো শহরে টিকতে পারেননি, প্রবল আলটিচিউড সিকনেস নিয়ে তারা অতঃপর নেমে এসেছেন পবিত্র উপত্যকার অপেক্ষাকৃত নিচু ঢালে। একই ট্যুর কোম্পানি যেহেতু এদেরও তদারকি করছে, সুতরাং তিনি আমার সঙ্গে  গাড়ি-চড়া শেয়ার করছেন। আমি আজ বিকালে যে গেস্ট-হাউসে উঠব, ওখানে মেরি-প্যাট আপাতত বিশ্রাম নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত তথ্য দিয়ে তিনি খাঁচা তুলে কাতরস্বরে চিঁউমিঁউ করা একটি পাখি দেখান। পিয়ারেকে অ্যাভয়েড করা দুঃসাধ্য বুঝতে পেরে কথাবার্তায় তার সঙ্গে এনগেজ হওয়ার চেষ্টা করি, জানতে চাই―চিড়িয়াটি জোগাড় করলেন কীভাবে ?

বুঝতে পারি, স্থানীয় বাজার থেকে পাখিটিকে কিনতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। না কিনলে এটি পর্যটকদের মাধ্যমে চালান হয়ে যেত আমেরিকা কিংবা কানাডায়। এ খেচরের হেবিটাট হচ্ছে লবণের উপত্যকা, ওখানেই তাকে অবমুক্ত করবেন। এ পর্যন্ত বলে, পাখি-বিক্রেতা আদিবাসী ও ক্রেতা পর্যটকদের চৌদ্দ-পুরুষ তুলে একাধিক ভাষায় গালিগালাজ করেন, সঙ্গে সঙ্গে ধারাবর্ণনা দেন―কীভাবে এটি লবণের প্রান্তরে উড়ে বেড়ায় এবং কী খেয়ে জীবন ধারণ করে। এসব তথ্য জেনে, ওষুধের রাসায়নিক প্রভাবে পড়ে যাওয়া আমার কেশগুচ্ছ ফের গজাবে না, তাই তার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের নোট নিতে বিরত থাকি। আমার অনাগ্রহ আমলে এনে পিয়ারে এবার আপন মনে গাইতে শুরু করেন ফরাসি ভাষায় সম্ভবত ওড়াউড়ি-সংক্রান্ত একটি সঙ্গীত।

গাড়ি আমাদের নামিয়ে দেয় পিসাক শহরের একটি সব্জিবাজারে। বাজারে ঢোকার মুখে পড়ে জননী-মরিয়মের বেদি। তাতে খ্রিস্টীয় ক্রুশের দুপাশে ইনকাদের সান অ্যান্ড মুন ডিস্ক নামে পরিচিত চন্দ্র-সূর্য উপাসনার যুগল প্রতীক। ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে পিয়ারে ছবি তোলেন, তারপর কপালে এক ফোঁটা প্রার্থনা-সলিল মেখে চোখ কটমট করে তাকান। বুঝতে পারি, আমার কাছ থেকে পজিটিভ রেসপন্স না পেয়ে তিনি রুষ্ট হয়েছেন, তাকে তুষ্ট করার আমার কোনও দায়িত্ব নেই। আমি অন্যদিকে মুখ ফেরাতেই তিনি জনান্তিকে বলেন, ‘যেহেতু আমাদের আগ্রহ ভিন্ন, সুতরাং এক সঙ্গে হাটবাজারে ঘোরাফেরাটা অর্থহীন।’ বলেই তিনি হন হন করে আগুয়ান হন। আমি পকেট ডিকশনারি বের করে কেচোয়া ভাষায় শোকরগুজারের প্রতিশব্দ খুঁজি।

কাঁচাবাজারে ঢুকে কপি, টমেটো, স্ট্রবেরি ও পেঁয়াজকলি বিক্রেতা মহিলাদের দিকে তাকাই, এবং তাৎক্ষণিকভাবে অনুভব করি, সত্যি সত্যিই চলে এসেছি স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত আদিবাসী কেচোয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব বলয়ে। মহিলারাও তাজ্জব হয়ে আমার দিকে তাকান! তরুণীদের কেউ কেউ হাসি চাপতে চাপতে, পরস্পরের গায়ে ঢলে পড়তে পড়তে ফিসফিসিয়ে সম্ভবত বলাবলি করছে, কোন মগের মুল্লুক থেকে এ হাগাডগা অপদার্থটা এসে হাজির হলো! সমবেত দৃষ্টিপাতের হুলে জর্জরিত হয়েও হিম্মতে বুক বেঁধে এগিয়ে যাই সামনে। যেতে যেতে গণনা করি, হরেক শেইপ ও বর্ণের তেইশটি ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির আলু। দেখা যায়, চাঙ্গারি ভর্তি হালফিল সুপারফুড হিসেবে বিবেচিত হওয়া কিনোয়া নামে এক ধরনের শস্য এবং কিউচা ও চিয়া নামে বেজায় স্বাস্থ্যকর বীজ ডিসপ্লে করা হয়েছে। জীবনে প্রথম―অনেকটা টমেটোর মতো দেখতে, কামু-কামু নামে একটি সব্জি দেখতে পেয়ে ভগ্ন দেবদেউলে কষ্টিপাথরের বিগ্রহ আবিষ্কারের মতো আনন্দ হয়।

বাজার থেকে বেরুনোর পথে খেয়াল করি, দেয়াল ঘেঁষে বসা হ্যাট-মাথায় তিন সব্জিবিক্রেতা। আমি তাকাচ্ছি দেখে ইনারা দ্রুত চোখ নামিয়ে শাকসব্জি ঘাঁটেন। সাহস করে আমি তাদের কেচোয়া ভাষায় ‘আলিয়ানচু’ বলে শুভেচ্ছা জানাই। বাঁকা হাসি হেসে এক মহিলা এসপানিওলে জবাব দেন, ‘আপরেনদে প্রুন্ত’, বা ‘খুব দ্রুত ভাষা শেখা হচ্ছে বুঝি,’ বাদবাকি দুজনের মধ্যেও বিস্তারিত হয় বিদ্রƒপ। ভাবি, দিস ইজ টাইম ফর মি টু রিট্রিট ফ্রম দ্যা মার্কেট।

গাড়ির বনেটে ঠেক দিয়ে দাঁড়িয়ে সেলফোন ঘাঁটছেন লুই পিয়ারে। তার গলায় হরেক রকমের রঙচঙে পালক-গাঁথা একটি মালা। জানতে বাসনা হয়, পাখিরা পালকগুলো স্বেচ্ছায় তাকে দান করেছে, নাকি এদের ঘেটি চেপে ধরে তিনি প্লাক করে নিয়েছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে পিয়ারে আর্তনাদ করে ওঠেন, ‘ম্যান, ইউ ক্যান্ট বিলিভ হাউ দে আর এক্সপ্লোয়িং দ্যা ন্যাচারেল রিসোর্স অব অ্যান্দিজ মাউন্টেন।’ প্রতিক্রিয়ায় কিছু না বলে শান্তভাবে উঠে বসি গাড়িতে। আমার দিকে তিনি বাড়িয়ে দেন সেফটিপিন লাগানো বাটন, তাতে আঁকা স্কেচে বিদ্রোহী গোছের এক খেচর ধনুকের জ্যা টেনে ধরে ছুড়ছে তির। ঠিক বুঝতে পারি না এটি জ্যাকেটে গাঁথলে আমার কিংবা ভিকটিম পক্ষীদের কী উপকার হবে ?

সামান্য সময়ের ড্রাইভে আমরা এসে পৌঁছি, ‘সালিনারেস দে মারাস’ বা লবণের উপত্যকায়। পার্কিং লট থেকে অকুস্থলে নেমে যাওয়ার ট্রেইলটি বেজায় ঢালু। কোনও ঝুঁকি না নিয়ে, জোড়া ট্র্যাকিং-স্টিকে ভর দিয়ে সাবধানে নামার উদ্যোগ নিচ্ছি। পাশ থেকে পিয়ারে চাপাস্বরে বলেন, ‘ইউ ডোন্ট রিয়েলি কেয়ার আবাউট বার্ডস্, ডু ইউ ?’ ভারসাম্য রক্ষা করতে করতে ফিরে তাকাই, পিয়ারে মুখখানা কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা রোগীর মতো কষাবিষা করে কিছু বলতে যান। তাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলি, ‘লুক, আই অ্যাম অ্যান ওল্ড গাই, জাস্ট ট্রায়িং টু টেক কেয়ার অব মাইসেল্ফ।’

কন্ঠস্বরে বিদ্রƒপ ও উষ্মা ছড়িয়ে তিনি মন্তব্য করেন, ‘আই নো ইউ আর অ্যা সেল্ফ-সেন্টারড টাইপ..।’ ঘুরে দাঁড়াই আমি, পিয়ারের দু কানে গাঁথা ইয়ারিংয়ে ঝুলন্ত রুপার দুটি খেচর প্রতীকে ঝলসে যাচ্ছে রোদ, ইচ্ছা হয় ‘গো স্টেইট্ টু হেল’ বলে দাবড়িয়ে দিতে, কিন্তু শিষ্টাচারের অন্তর্গত ইনস্টিংক্ট আমাকে সংযত হতে প্ররোচিত করে।

ট্রেইলের পাশে বেশ কতগুলো ছোট ছোট দোকান, ওগুলোতে জ্যাম্পেশ করে পর্যটকদের কাছে বিক্রি হচ্ছে কেচোয়া গোত্রের সাংস্কৃতিক মোটিফ আঁকা দ্রব্যাদি। একটি দোকান থেকে ভেসে আসে বাঁশরীর জাদুময় ধ্বনি। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনি, ‘কেনা’ নামে বিচিত্র এক বাঁশের বাঁশরীতে ঝংকৃত বিধুর মূর্ছনা। সুরধ্বনিতে প্রতিফলিত হয় পবিত্র উপত্যাকার অশেষ উদাসীনতা। একখানা সিডি কিনে নিয়ে ফের নামতে শুরু করি নিচের লেয়ারে।

চোখে সামনে ভেসে ওঠে ইনকা সম্রাটদের জামানায় বাঁধ দিয়ে তৈরি, বিভিন্ন শেইপের বর্গক্ষেত্রে খনিজ-জল জারিত লবণ। নোনা পরিসরের তুমুল শুভ্রতায় রোদ ঝলসে গিয়ে তৈরি করছে সবুজাভ ছায়াচিত্র। আকাশেও ওড়াউড়ি করছে আন্দিয়ান কনডর বা শকুনের স্বগোত্রীয় পাখি, ফুটে উঠছে সোনালি-সবুজ প্রেক্ষাপটে বিশাল ডানার উড্ডীন প্রতিবিম্ব। পর্যটনী-পুস্তক ঘাঁটাঘাঁটির কল্যাণে আমি অবগত যে, এখানকার ভূতল থেকে বলকে উঠছে প্রায় তিন হাজার আলাদা আলাদা নোনাজলের ঝরণা। যুগল-পাহাড়ের সংকীর্ণ গিরিখাত ধরে উঠে যেতে পারলে, আরও হাজার দুয়েক ফুট উঁচু প্লাটোতে তালাশ পাওয়া যাবে, আরও বেশ কয়েকটি লবণবাহী জলের আদি প্রস্রবণ। হাজার বছর ধরে, আদিবাসীরা বেহদ মেহনতে পাহাড় ভেঙ্গে এখান থেকে কলসি ভরে সংগ্রহ করত নোনাজল। ইনকারা ওই জলকে নিয়ে এসেছে বাঁধের আওতায়, এবং এ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে রীতিমতো লবণ ফলানো এক প্রান্তর।

চেষ্টা করি নানা এঙ্গেল থেকে কয়েকটি আলোকচিত্র তুলতে। কিন্তু হাত কাঁপে। কাছ থেকে খানিক অনুনাসিক উচ্চারণে কে যেন বলে ওঠে, ‘মশিয়ো সুলতান, ইউ লুকড্ ট্রাবোলড অ্যান্ড স্ট্রেসড।’ ঘাড় ঘোরাতেই দেখি, আমার দিকে এগিয়ে আসছে ফরাসি তরুণী জেনাভিব। ফসিল সংগ্রহে আগ্রহী এ মেয়েটির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল লিমা শহরে। জানতে চাই, ‘এনি লাক জেনাভিব।’ লাজুকভাবে হেসে সে জবাব দেয়, ‘নট রিয়েলি, নট ইয়েট.., কিন্তু আমার ধারণা, এ লবণ খেতের তলায় লুকায়িত আছে লক্ষ বছরের পুরানো জীবাশ্ম, রিয়েল ট্রেজার।’ জানতে পারি যে, সে ট্র্যাক করে গিরিখাত ধরে উঠে যাবে লবণের উৎসমুখে উছলে ওঠা প্রস্রবণে, যদি-বা কপালগুণে ওদিকে কোন জীবাশ্ম পাওয়া যায়।

টুকটাক কথাবার্তা বলে আমি জেনাভিবের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই, সে পোলাইটভাবে জিজ্ঞেস করে, ‘ডু ইউ মাইন্ড ইফ আই টেক ইয়োর পিকচার ?’ সম্মত হয়ে আমি রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াই। স্ন্যাপশট নিয়ে বিদায় নিতে নিতে সে বলে, ‘চেক ইয়োর ইনবক্স, ছবির একটি কপি আমি পাঠিয়ে দেব।’

গিরিখাতের পথে হেঁটে যাওয়া জেনাভিবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আমি গাড়ির দিকে রওয়ানা হই। উপরে উঠতে উঠতে ফের শুনি, আন্দিয়ান বাঁশরীতে ক্রমাগত বেজে যাওয়া বিরহ-নিবিড় সুরধ্বনি।

 লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button