আর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বিশ্বসাহিত্য : নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা তত্ত্বের আলোকে শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের মূল্যায়ন : মোহীত উল আলম

পূর্বকথা : এই প্রবন্ধটি যদিও অধ্যয়নিকভাবে গবেষণাধর্মী, তারপরও সাধারণ পাঠকদের কথা চিন্তা করে আমি ফর্ম্যাটটি একাডেমিক না রেখে সাধারণধর্মী রেখেছি। সে জন্য ফুটনোট, টীকা, বিবলিওগ্রাফি দিয়ে প্রবন্ধটিকে আকীর্ণ না করে একটানা বর্ণনা করে গেছি, এবং সঙ্গে সঙ্গে জোড়া-বন্ধনীর ভিতরে বিবলিওগ্রাফি সরবরাহ করেছি। আর শেক্সপিয়ারের নাটক ও সনেট থেকে উদ্ধৃতিগুলো গাণিতিক সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করেছি, যেমন ৩. ১. ৪৪, অর্থাৎ তৃতীয় অংকের প্রথম দৃশ্যের চুয়াল্লিশ নম্বর লাইন। আর সমস্ত ইংরেজি উদ্ধৃতি বাংলায় করেছি। এবং  শেক্সপিয়ারের রচনাসমগ্র বলতে এটি ব্যবহার করেছি : দ্য আর্ডেন শেক্সপিয়ার: কমপ্লিট ওয়ার্কস, রিভাইজড এডিশন, সম্পাদক : রিচার্ড প্রাউডফুট, অ্যান টমসন, এবং ডেভিড স্কট কাস্টান; কনসালটেন্ট এডিটর: হ্যারল্ড জেনকিনস (লন্ডন, মেথুয়েন, ১৯৯৮, ২০০১।

প্রস্তাবনা : হ্যামলেটের প্রেয়সী ওফেলিয়া মারা গেছে। তার সমাধি হবে। রাজপ্রাসাদের বাইরে এজন্য কবর খোঁড়া হয়েছে। ওফেলিয়ার মৃতদেহ যখন কবরে নামানো হলো তার ভাই লেয়ার্টিস শোকে কাতর হয়ে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল কবরে। বলল, আমাকেও মাটি চাপা দাও। হ্যামলেট তার বন্ধু হোরাশিওসহ তখন কবরের পাশে দাঁড়ানো। দুজনই ছদ্মবেশ পরা, কালো গাউনে আবৃত। তাদেরকে উপস্থিত রাজন্যবর্গের কেউ চিনতে পারেনি। হঠাৎ হ্যামলেট তার গাউন উন্মোচন করে কবরের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। লেয়ার্টিসকে উদ্দেশ করে বলল, চল্লিশ হাজার ভাইয়ের ভালোবাসা একত্র করলেও ওফেলিয়ার প্রতি আমার ভালোবাসার সমান হবে না : ‘আই লাভড ওফেলিয়া। ফোর্টি থাউজ্যান্ড ব্রাদার্স / কুড নট উইথ অল দেয়ার কোয়ান্টিটি অব লাভ / মেইক আপ মাই সাম।’ (৫.২.২৬৯-২৭১)।  

হ্যামলেটের এই উক্তিটি যুগে যুগে আদৃত হয়ে আসছে একজন প্রেমিকের তার মৃত প্রেয়সীর প্রতি সর্বশ্রেষ্ঠ উক্তি হিসেবে। কিন্তু এখন আর নয়। কেন নয়, সেটির একটি ব্যাখ্যা দিচ্ছি। বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে শেক্সপিয়ারের সাহিত্য সমালোচনায় যে দিকটি গুরুত্ব পাচ্ছে, সেটি হচ্ছে শেক্সপিয়ারের রচনার সঙ্গে অর্থনৈতিক জীবনের সম্পৃক্তি। এই সমালোচনা-সাহিত্যতত্ত্বের নাম হচ্ছে, নিউ ইকোনোমিক ক্রিটিসিজম। এটি শেক্সপিয়ারের রচনায় ব্যবহৃত অর্থনৈতিক শব্দ, শব্দগুচ্ছ, বাক্য, বাক্যাংশ এবং থিম পাঠে আগ্রহী একটি সমালোচনা-শৃঙ্খলা। এটিও মূলত ইতিহাসভিত্তিক পাঠ, কেননা এটি সাহিত্যকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রেখে আলোচনা করে। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে রচিত গ্রন্থাবলি এখন শেক্সপিয়ারের সাহিত্য নিয়ে গবেষণা করার অন্যতম প্রণোদনা।

গ্রন্থপাঠের বিবরণ : নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা ঘরানার এখানে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের নাম দেওয়া হলো, যেগুলি সম্প্রতি আমি পাঠ করেছি, যদিও এই তালিকার বাইরেও আরও বহু প্রকাশনা আছে। এই ঘরানার প্রথম উল্লেখযোগ্য পণ্ডিত হচ্ছেন মার্ক শেল, যিনি মানি, ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড থট শিরোনামে ১৯৮২ সালে তাঁর গ্রন্থটি প্রকাশ করে শেক্সপিয়ার পাঠে একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছেন বলা যায়। এই গ্রন্থটিতে শেলের দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস নিয়ে একটি চমকপ্রদ প্রবন্ধ আছে, সে প্রসঙ্গে আমি পরে আসব। ডগলাস ব্রুস্টার ১৯৯২ সালে ক্যামম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস থেকে প্রকাশ করলেন ড্রামা অ্যান্ড দ্য মার্কেট ইন দ্য এইজ অব শেক্সপিয়ার শীর্ষক গ্রন্থটি, যেটির মধ্যে ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিদা নাটকটিতে বাণিজ্যিক ভাষা কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে তার বিশ্লেষণ আছে। এর পরের যে বইটি আমি পড়েছি, সেটি হচ্ছে ক্রেইগ মালড্রু রচিত, ১৯৯৮ সালে প্যালগ্রেইভ থেকে প্রকাশিত, দ্য ইকোনোমি অব অব্লিগেশন শীর্ষক গ্রন্থটি। যদিও গ্রন্থটির কোথাও শেক্সপিয়ারের কোনও নাটক তো দূরের কথা, শেক্সপিয়ারের নামটিও উল্লেখ নাই, কিন্তু ঋণ প্রদান, ঋণ শোধ, বন্ধকী দেওয়া-নেওয়া, চুক্তিনামা (বন্ড) সই ইত্যাদি অর্থনৈতিক বিনিময় প্রথার এত সবিস্তারে অনুসন্ধানমূলক আলোচনা আছে যে, তাঁর ব্যাখ্যার আলোকে বলতে হয় মধ্যযুগ থেকে শুরু করে শেক্সপিয়ারের পরবর্তী সময় পর্যন্ত ইংল্যান্ডে বকেয়াতে মালামাল লেনদেন করাসহ সকল রকম চুক্তি সম্পন্ন হতো মৌখিকভাবে। বিভিন্ন পরিবারের মধ্যে কর্জ নেওয়া বা কর্জ শোধ করা এগুলির সঙ্গে পরিবারের সুনাম জড়িত থাকত। ফলে ধার শোধ করার ব্যর্থতা একটি পরিবারের সামাজিক অবস্থানের জন্য অবমাননাকর ছিল। এবং ধার-দেনা, বকেয়া-নগদ আদান-প্রদান এগুলি চলত চেনাজানা পরিবারগুলোর মধ্যে। তাই লেনদেনের মধ্যে অর্থের পরিমাণ নয়, আস্থাটাই ছিল মুখ্য। কিন্তু ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে লেনদেনের পরিমাণ, ধারদেনার ব্যাপ্তি বহু বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে অদেয় অর্থ আদায় করার নিমিত্তে আদালতে মামলার সংখ্যাও বেড়ে যেতে থাকে। তখন লিখিত চুক্তিনামার প্রয়োজন হয়। শেক্সপিয়ার নিজের জীবনে কখনও কারুর কাছে ঋণগ্রস্ত ছিলেন এমনটি জানা যায় না, কিন্তু তিনি ফিলিপ রোজার্স নামক একজন ঋণগ্রহীতার বিরুদ্ধে ১৬০৪ সালে মামলা করেছিলেন। বলা বাহুল্য, ব্যর্থ দেনাদারদের জেলখানায় বা স্যাংচুয়ারিতে ঢুকিয়ে দেবার প্রচলন চালু ছিল। মালড্রুর বইটা পাঠ করার পর শাইলকের অ্যান্টোনিওর বিরুদ্ধে চুক্তিভঙ্গের জন্য মামলা করার প্রেক্ষাপটটি বোঝা যায়। মালড্রুর আরেকটি কথা গ্রহণযোগ্য। তিনি চতুর্থ অধ্যায়, ‘দ্য স্ট্রাকচার অব ক্রেডিট নেটওয়ার্কস’-এ বলছেন, যে কোনও লেনদেনে শেষ পর্যন্ত ক্রেডিট বা বকেয়ার একটি ব্যাপার থেকেই যায়। এদিক থেকে আমরা যদি হ্যামলেট নাটকের পোলোনিয়াসের তাঁর পুত্র লেয়ার্টিসকে দেয়া সে বিখ্যাত উপদেশবাণীর কথা স্মরণ করি, ‘নাইদার আ বরোয়ার নর আ লেন্ডার বি,’ (কাউকে টাকা ধার দিও না, কারুর কাছ থেকে টাকা ধার নিও না) আমরা বুঝব যে মাল্ড্রু যখন ইংল্যান্ডের শেক্সপিয়ারকালীন সময়ে বকেয়ার চিরকালীন স্থায়িত্বের কথা গবেষণা করে প্রমাণ করেছেন, সেটির বিপক্ষে পোলোনিয়াসের উপদেশবাণীটি নিতান্তই পোলোনিয়াসের মতো কেজো লোকের জন্যই প্রাসঙ্গিক, কিন্তু সর্বোতভাবে এটি ইংল্যান্ডের তৎকালীন লেনদেনের চেহারা প্রকাশ করে না। বরঞ্চ ১৫৭৩ সালে টমাস টুসারের বাণী যেটি মাল্ড্রু উদ্ধৃতি হিসেবে ব্যবহার করেছেন, সেটিই বেশি প্রাসঙ্গিক। টুসার বলছেন, ‘ধার করা ছাড়া কে বাঁচতে পারে, আর ধার দেওয়া ছাড়া কে বাঁচতে পারে।’ মাল্ড্রুর পুরো বইটি এই কথা বলতে চাইছে যে তখনকার দিনে, ব্যাংকিং ব্যবস্থা আধুনিক হবার আগে (ব্যংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৯৫ সালে।) সমাজের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে লেনদেন হতো আস্থা এবং দায় প্রয়োগের মধ্যে। এর পরের বইটি থিওডোর বি লেইনওয়ান্ডের, ‘থিয়েটার, ফিন্যান্স অ্যান্ড সোসাইটি ইন আর্লি মডার্ন ইংল্যান্ড,’ যেটি ১৯৯৯ সালে ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। লেইনওয়ান্ড জোর দিচ্ছেন অর্থনৈতিক লেনদেনের মধ্যে যে দেওয়া-নেওয়ার হিসাব থাকে শুধু তা নয়, এটির মধ্যে মানুষের (ঋণগ্রহণকারী ও ঋণপ্রদানকারী) প্রবল পারস্পরিক অনুভূতির ব্যাপারও জড়িত থাকে। লেনওয়ান্ড এটিকে ইংরেজি পরিভাষায় ‘এফেক্ট’ বা আবেগ বলছেন। তাঁর গ্রন্থে বিশদভাবে আলোচনা আছে দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস-এর। রাটলেজ, টেইলর অ্যান্ড ফ্রান্সিস গ্রুপ থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত পিটার এফ. গ্র্যাভ-এর বই, শেক্সপিয়ার অ্যান্ড দ্য ইকোনোমিক ইম্পের‌্যাটিভ : ‘ওয়াট ইজ অট বাট অ্যাজ ইঁটস ভ্যালুড’ অত্যন্ত সুখপাঠ্য একটি গ্রন্থ। তিনি শেক্সপিয়ারের চারটি কমেডি এবং একটি ট্র্যাজেডির বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। কমেডিগুলো হলো কমেডি অব এররস, দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস, এবং মেজার ফর মেজার। আর ট্র্যাজেডিটা হলো টাইমন অব এথেন্স। গ্রাভ বলতে চেয়েছেন যে শেক্সপিয়ার তাঁর নাট্যজীবনের শুরুতে প্রাক-পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাবকে তেমন সমালোচনা করেননি, যার একটি ইতিবাচক প্রক্ষেপণ পাওয়া যায় ১৫৯২ সালে রচিত দ্য কমেডি অব এররস নাটকে। কিন্তু এর পনের বছর পরে রচিত ট্র্যাজেডি দ্য টাইমন অব এথেন্স-এ শেক্সপিয়ার অর্থনৈতিক-মগ্ন সমাজের অন্ধকার দিকগুলো প্রকাশ করতে সচেষ্ট হন। এ দুটো নাটকের মধ্যবর্তী সময়ে রচিত কমেডি দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর, দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস এবং মেজার ফর মেজার নাটকত্রয়ীতে তিনি অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট জীবনাচারণের মন্দ দিকগুলো উন্মোচিত করেন। মোদ্দা কথা, নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা তত্ত্বের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রবক্তা হয়েও গ্রাভ এই প্রবণতার ক্ষতিকর দিকটি তুলে ধরেন, যেটি এর আগে লেইনওয়ান্ডও খানিকটা করেছিলেন। পরবর্তী বইটা হলো ডেভিড ল্যান্ড্রেথ-এর দ্য ফেইস অব মেমন। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত এই বইটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো সাহিত্য মাত্রই মেমন-স্পৃষ্ট। মেমনটা কে ? মেমন হচ্ছে পবিত্র বাইবেলে উল্লিখিত বৈভব বা সম্পদের ধারণায় সৃষ্ট একটি চরিত্র। অর্থাৎ, খ্রিশ্চানদের প্রভু যীশু, লুক ১৬: ৯, বলছেন, ধনসম্পদ বা মেমনের যথোচিত ব্যবহার করলে পরজীবনে স্বর্গ লাভ হবে। কিন্তু রেনেসাঁ ইংল্যান্ডে মেমনকে অর্থের দানব হিসেবে অংকিত করা হয়, যেমন এডমান্ড স্পেনসার তাঁর ফেয়ারি কুইন মহাকাব্যে মেমনকে ‘গড অব দ্য ওয়ালর্ড অব ওয়ালর্ডলিংস’ হিসেবে কথিত করেছেন। তবে ল্যান্ড্রেথের আলোচনা মূলত মুদ্রার অস্তিত্ব নিয়ে। মুদ্রার অবয়ব, মুদ্রার বস্তুগুণ ও মুদ্রার প্রচলন কীভাবে ইংরেজি রেনেসাঁ সাহিত্যের সর্বত্র খুঁজে পাওয়া যায়, তারই একটি দীর্ঘ সমীক্ষা। মুদ্রার এই অসামান্য সর্বত্র গমনের ক্ষমতা বা ইউবিকুইটি কী করে সাহিত্যের সর্বত্র প্রচ্ছন্নভাবে উপস্থিত আছে তারই বর্ণনা ল্যান্ড্রেথ করেছেন। দ্বিতীয়ত, মুদ্রামাত্রই সর্বত্র সীমানা অতিক্রম করে এরকম একটি পদার্থ। রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম সর্বত্র মুদ্রার গমনাগমন অবাধ। তৃতীয়ত, মুদ্রার বস্তুগত অস্তিত্ব, যেমন এটার স্বর্ণমুদ্রা কিংবা রৌপ্যমুদ্রা হিসেবে যেমন একটি মূল্য আছে, তেমনি এটির মান যেটি নির্ধারিত হয় তারও একটি মূল্য আছে। মুদ্রার বস্তুগত দিক যেমন একটি থাকলো, তেমনি এর মানগত দিক বা সামাজিক দিকও মেমনের চরিত্র নির্ধারিত করে। মুদ্রার এই সম্মিলিত আকর-এর বস্তুগত অস্তিত্ব, স্বর্ণ কি রৌপ্য এবং এর সামাজিক অবস্থান নির্ধারিত করছে সাহিত্যে এর প্রয়োগ কীভাবে হয়েছে। ল্যান্ড্রেথ শুরুর অধ্যায়ে বিশেষভাবে আলাপ করছেন এডমান্ড স্পেন্সারের দ্য ফেয়ারি কুইন মহাকাব্যটি এবং ক্রিস্টোফার মার্লোর দ্য জিউ অব মাল্টা নাটকটি। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে আলাপ করছেন শেক্সপিয়ারের ঐতিহাসিক নাটক কিং জন এবং মেজার ফর মেজার, তৃতীয় অধ্যায়ে দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস, এবং শেষ অধ্যায়ে আলাপ করছেন ডান এবং ন্যাশের কবিতা। ল্যান্ড্রেথের আলোচনায় রাজা প্রথম জেইমসের সময় যে জাল মুদ্রার প্রচলন বেড়ে গেছিল সেটি নিয়েও আলাপ আছে। শেক্সপিয়ারের ওপর নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনার পর্যালোচনার এই পর্যায়ে আমি ব্লুমসবারি আর্ডেন শেক্সপিয়ার ২০১৫ সালে প্রকাশিত ডেভিড হক্সের শেক্সপিয়ার অ্যান্ড ইকোনোমিক থিওরি গ্রন্থটির কথা উল্লেখ করব, যেটি অত্যন্ত স্বল্প পরিসরে সবিস্তারে টাকার গল্প, এবং টাকার সঙ্গে শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের সম্পর্ক অত্যন্ত বোধগম্য ভাষায় আনুপূর্বিক বর্ণনা করেছে। ‘ইকোনোমি’ শব্দটার গ্রিক উৎপত্তি ‘ঐকস’ থেকে শুরু করে সক্রেটিস এবং অ্যারিস্টেটলের ‘টেলোস’ বা উদ্দেশ্যনিবদ্ধ জীবনের সঙ্গে ক্রিম্যাটিস্টিক্স বা টাকার বিনিময়-নির্ভর ব্যবহারের ব্যবধান আলোচনা করতে করতে তিনি তৃতীয় অধ্যায়ের শুরুতে বলছেন, ‘কার্ল মার্ক্স লাভড উইলিয়াম শেক্সপিয়ার’। হকস মূলত দ্রব্যের মূল উপোযোগিতা (ইউজ ভ্যালু) এবং বিনিময় মূল্যের (এক্সচেইঞ্জড ভ্যালু) মধ্যে পার্থক্য আলোচনা করে মনোযোগ দিচ্ছেন অর্থনীতির নির্দিষ্ট (রেস্ট্রিক্টেড) ব্যবহার এবং অর্থনীতির সাধারণ (জেনারেল) ব্যবহারের মধ্যে। তিনি বলছেন যে আধুনিক যুগে অর্থনীতির গুরুত্ব ছিল এর নির্দিষ্টকরণের মধ্যে, অর্থাৎ অর্থনীতিকে শাস্ত্র হিসেবে একান্তই আলাদা একটা বিষয় হিসেবে ধরা হতো, বলা হতো অর্থনীতি থেকে সাহিত্য বা অন্য যে কোনও বিষয় ছিল বিচ্ছিন্নকৃত। কিন্তু উত্তরাধুনিক যুগে এসে অর্থনীতির ব্যবহার কিছুটা পুরানো অ্যারিস্টোটলীয় কায়দায় ফিরে গেছে যেখানে অর্থনীতিকে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়, বরঞ্চ স্বীকার করা হলো যে সব ক্ষেত্রের মধ্যে অর্থনীতির সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি বলছেন সাহিত্যের ভাষা অর্থ উৎপাদন করে, আর টাকা ভ্যালু উৎপাদন করে। অত্যন্ত সুখপাঠ্য এবং পুরোটাই উদ্ধৃতিযোগ্য এই ২২৩ পৃষ্ঠার ছোট্ট বইটিতে হকস বলছেন যে, বিস্ময়কর হলো শেক্সপিয়ারের সাহিত্যে কিংবা তাঁর সমসাময়িক এলিজাবেথ-জ্যাকোবিয়ান লেখকেরা অর্থনীতির এই উত্তরাধুনিক ব্যবহারকে নিজেদের অজান্তেই আত্মস্থ করে সিদ্ধ করে নিয়েছিলেন, এবং তার প্রমাণ তাঁদের রচিত সাহিত্যের যত্রতত্র পাওয়া যায়। যেমন শেক্সপিয়ারের সমসাময়িক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কবি বেন জনসন তাঁর বিখ্যাত কমেডি ভলপনি (১৬০৫) শুরু করছেন স্বর্ণকে ঈশ্বর হিসেবে অভিবাদন জানানোর মধ্য দিয়ে : ‘গুড মর্নিং টু দ্য ডে; অ্যান্ড নেক্সট, মাই গোল্ড’ (১. ১. ১)। এই সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা এই প্রবন্ধের পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করব, কীভাবে শেক্সপিয়ারের সমুদ্রযাত্রা-নির্ভর এবং বিদেশাচারী নাটগুলোতে―যেমন দ্য কমেডি অব এররস (১৫৯২-১৫৯৪), দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস (১৫৯৬-১৫৯৮), টুয়েলফথ নাইট (১৫৯৯-১৬০১), ওথেলো (১৬০৩-১৬০৪), টাইমন অব এথেন্স (১৬০৫-১৬০৬), পেরিক্লিস, প্রিন্স অব টায়ার (১৬০৬-১৬০৮), দ্য টেম্পেস্ট (১৬১০-১৬১১), দ্য উইন্টারস টেইল (১৬১০-১৬১১)―এই নাটকগুলোতে অর্থনীতি-সম্পৃক্ত শব্দ, ভাষা বা শব্দগুচ্ছ শুধু ব্যবহার করা হয়নি, বরঞ্চ তাঁর বিখ্যাত ট্র্যাজেডিগুলো যেমন হ্যামলেট (১৬০০-১৬০১), কিং লিয়ার (১৬০৫-১৬০৬), অ্যান্টনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা (১৬০৬-১৬০৭) এবং সনেট ও কবিতাসহ অন্যান্য আপাত দৃষ্টিতে অর্থনীতি-সম্পৃক্ত নয় এমন নাটক- গুলোতেও শেক্সপিয়ারের অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা বিধৃত হয়েছে। ডেভিড হকসের এই উল্লেখযোগ্য বইটির পর আমরা আসছি রবার্ট বিয়ারম্যান রচিত, ২০১৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত শেক্সপিয়ার্স মানি : হাউ মাচ ডিড হি মেইক অ্যান্ড ওয়াট ডিড দিস মিন ? বইটির প্রসঙ্গে। এ বইটি আক্ষরিক অর্থে সকল শেক্সপিয়ার গবেষকের জন্য অবশ্যই পাঠ্য কেননা বিয়ারম্যান শেক্সপিয়ারের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের মধ্যে আর্থিক লেনদেনগুলোর পর্যালোচনা ও সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাটক ও কাব্যে সেগুলির অভিঘাত কী তার একটি স্বচ্ছন্দ বয়ান করেছেন। এ বইটি আরও উল্লেখযোগ্য এই কারণে যে শেক্সপিয়ারের ব্যবসায়িকভাবে নাট্যমঞ্চের সঙ্গে সম্পৃক্ততা, দ্য চেম্বারলেইনস মেন (বা পরবর্তী দ্য কিংস মেন) নাট্যদলের সঙ্গে তাঁর প্রায় দেড় যুগের শক্তিশালী ব্যবসায়িক সম্পর্ক (১৫৯৪-১৬১১) ইত্যাদি নিয়ে তাঁর বিবরণ গ্রিনব্ল্যাট কথিত নব্য-ইতিহাসবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত বিধায় শেক্সপিয়ারের ওপর গবেষণার ক্ষেত্রে এটি একটি কার্যকর বই। এরপর আমি আসব শেক্সপিয়ারের সাহিত্যে অর্থনৈতিক ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রকে পুঁজি করে প্রকাশিত দুটি বিশিষ্ট সমালোচনা সংকলনের উল্লেখে। প্রথমটি হচ্ছে, শেক্সপিয়ারের সাহিত্যালোচনায় নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা প্রবিষ্টের ওপর সুবিদিত শেক্সপিয়ার পণ্ডিত লিন্ডা উডব্রিজ সম্পাদিত এবং প্যালগ্রেইভ ম্যাকমিলান থেকে ২০০৩ সালে প্রকাশিত মানি অ্যান্ড দ্য এইজ অব শেক্সপিয়ার : এসেইজ ইন নিউ ইকোনোমিক ক্রিটিসিজম শীর্ষক বইটি। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, বিশিষ্ট শেক্সপিয়ার পণ্ডিত গ্রাহাম হোল্ডারনেস কর্তৃক সম্পাদিত এবং বার্গান বুকস থেকে ২০২০ সালে প্রকাশিত শেক্সপিয়ার অ্যান্ড মানি শীর্ষক গ্রন্থটি।

মূল আলোচনা : লিন্ডা উডব্রিজ সম্পাদিত গ্রন্থটি উল্লেখ করার সময় আমরা হ্যামলেট কর্তৃক কথিত সে উক্তি ‘চল্লিশ হাজার ভাইয়ের’ কথায় ফিরে যাব, যেখানে আমি বলেছিলাম যে এই উক্তিটি একজন প্রেমিকের তার বিগত প্রেমিকার জন্য শ্রেষ্ঠ উচ্চারণ মনে হলেও নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনার আলোকে দেখলে দেখব যে এইখানেও হ্যামলেট দুটি শব্দ ব্যবহার করেছে যেগুলি অর্থনৈতিক পরিভাষা। হ্যামলেট বলছে, ‘আই লাভড ওফেলিয়া, / ফোর্টি থাউজ্যান্ড ব্রাদার্স / কুড নট উইথ অল দেয়ার কোয়ান্টিটি অব লাভ / মেইক আপ মাই সাম’ (৫. ১. ২৬৯-৭১)। ‘কোয়ান্টিটি’ এবং ‘সাম’ অর্থনৈতিক পরিভাষা। উডব্রিজ তাঁর ভূমিকায় বলছেন যে শেক্সপিয়ারের যুগের সময় তাঁর দেশ একটি বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। সামন্তবাদী অর্থনীতির অবসান হয়ে প্রাক-পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ হচ্ছিল। অঙ্কশাস্ত্রের ক্ষেত্রে এ অভিঘাতটি  আসলো যে, আগে মানুষ এবাকাস, কাউন্টার কিংবা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন আঙ্গুলের কড়ায় গোনার প্রচলন চালু ছিল। কিন্তু শেক্সপিয়ারের যুগে কলম দিয়ে হিসাব লেখার প্রথা চালু হলো। অন্যদিকে জ্যোর্তিবিজ্ঞান, নৌবিজ্ঞান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞান প্রাধান্য পায়। ফলে বুককিপিং বিশ্বদ্যিালয়গুলোতে পাঠ্যসূচিতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে,  শেক্সপিয়ারের যুগের সময় সমুদ্রযাত্রা বেড়ে যায়। রানি এলিজাবেথ ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর লন্ডনের এক দল ব্যবসায়ীর সঙ্গে একটি নৌ-বাণিজ্য সম্পর্কিত চার্টার অনুমোদন দেন, যেটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে পরিচিতি লাভ করে। সমুদ্রযাত্রা-নির্ভর আন্তর্জাতিক ব্যবসাপাতি বেড়ে গেলে পাশাপাশি উন্নততর অঙ্কশাস্ত্র অধ্যয়ন করার প্রয়োজন দেখা দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ গণিতের বাইরে জ্যামিতি ও এলজেব্রা ব্যাপকভাবে পঠিত হতে লাগল। ব্যাল্যান্স শিট মেলানোর মতো কঠিন যৌগিক জ্ঞান ইংল্যান্ডের মানুষ তাঁর পেশাগত জীবনে প্রয়োগ করতে শিখতে লাগল। ফলে সংখ্যা গোনার ক্ষেত্রে আঙ্গুলের কড়ায় হিসাব করার বদলে আধুনিক হিসাবাবজ্ঞান তৈরি হলো। এর ফলে শুধু সংখ্যার গুণীতক প্রকাশও লোকের ব্যবহারের মধ্যে জায়গা পেল। উডব্রিজ বলছেন, হ্যামলেটের চল্লিশ হাজার ভাইয়ের উল্লেখের মধ্যে সে সংখ্যার বহু গুণ প্রকাশও তৎকালীন সমাজজীবনের মধ্যে সংখ্যার বিশালত্ব নিয়ে আচ্ছন্ন থাকারই আলামত খুঁজে পাবো আমরা। সংখ্যার আধিক্যের ওপর গুরুত্ব প্রসঙ্গে আমার নিজের একটা আর্টিকেলের কথা বলতে পারি। ২০০৮ সালে ইউল্যাবের জার্নাল ক্রসিংস-এ আমার ‘দ্য ইম্পেরিয়াল ডিজাইন অ্যান্ড শেক্সপিয়ার’ প্রবন্ধটি ছাপা হয়। সেখানে অ্যান্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা নাটকটি থেকে প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে লিখিত সংলাপটির উল্লেখ করি। ক্লিওপেট্রা অ্যান্টোনিওকে জিজ্ঞেস করছে ‘ইফ ইট বি লাভ ইনডিড, টেল মি হাউ মাচ’ (১. ১. ১৪)। তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, বলো কতটুকু। উত্তরে অ্যান্টোনিও বলে যে : যে ভালোবাসার পরিমাণ প্রকাশ করা যায় সেটি ভিখারির ভালোবাসা। ক্লিওপেট্রা তখন বলে, আমি তা হলে একটা সীমানা ঠিক করে দিই। তখন অ্যান্টোনিও বলে, ‘দেন মাস্ট দাউ নিডস ফাইন্ড আউট নিউ হেভেন, নিউ আর্থ’ (১. ১. ১৭)। এই সংলাপটির আমি উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম ইংল্যান্ডের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে উত্থানের সাহিত্যিক নমুনা হিসেবে। কিন্তু বর্তমান প্রবন্ধটি রচনা করার সময় আমি দেখতে পাচ্ছি, এটা আসলে সংখ্যার আধিক্যের গুরুত্বের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট করা যায়। এমনকি রাজা লিয়ারের ভালোবাসার টেস্টও আসলে সংখ্যাধিক্যের গুরুত্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেখানো যায়। অর্থাৎ, শেক্সপিয়ারের সক্রিয় সাহিত্যজীবনের কালেই ইংল্যান্ডের জীবনযাত্রায়, সংস্কৃতিতে ও ভাষায় বাণিজ্যিক জীবনের প্রভাব প্রবিষ্ট হতে থাকে।

এখানে একটি কথা বলে নেওয়া দরকার যে, এই প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে শেক্সপিয়ারের সাহিত্যে অর্থনৈতিক সংজ্ঞা, শব্দ, শব্দাবলি, শব্দগুচ্ছ, বাক্যাংশ এবং বাক্য ও পাশাপাশি অর্থনৈতিক লেনদেন কীভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে সেটি দেখানোর জন্য, এবং ওপরে হ্যামলেট, অ্যান্টোনি অ্যান্ড ক্লিওপেট্রা বা রাজা লিয়ারের উল্লেখ করে এটাও দেখাচ্ছি যে শেক্সপিয়ারের সাহিত্যসমগ্র কেবল অর্থনৈতিক-পরিভাষা স্পৃষ্ট হয়েছে সেটা বললে ভুল হবে। কারণ তখন প্রচলিত সমালোচনা সম্ভারের কোনও মূল্য থাকে না। বরঞ্চ এই কথাটি এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য যে বর্তমানে নতুন অর্থনীতির সমালোচনার আলোকে শেক্সপিয়ারকে নতুনভাবে পাঠ করার অধ্যয়নিক শৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে, এবং সেই আলোকেই এই প্রবন্ধটি লিখিত। 

আবার সংকলন দুটির আলোচনায় ফিরে আসি। উডব্রিজের সম্পাদিত বইয়ে তাঁর নিজের ভূমিকা ছাড়া মোট ১৬টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে, যার মধ্যে ১১টি সরাসরি শেক্সপিয়ারের নাটকের ওপর, যার মধ্যে আবার ৪টি হচ্ছে দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস-এর ওপর। পরবর্তী পর্যায়ে আমি যখন শেক্সপিয়ারের বিভিন্ন নাটকের ওপর আলোচনা করব, তখন এগুলি থেকে প্রসঙ্গক্রমে উদ্ধৃতি দেব।

গ্রাহাম হোল্ডারনেস সম্পাদিত সংকলনটিতে ‘শেক্সপিয়ার, মিন্টেড’ শীর্ষক ভূমিকা প্রবন্ধে হোল্ডারনেস জানাচ্ছেন যে শেক্সপিয়ার নিজেই মুদ্রিত টাকার মতো মর্যাদা পান যখন ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ১৯৭০ সালে বিশ পাউন্ড নোটের ওপর শেক্সপিয়ারের আবক্ষ মূর্তির ছবি ছাপে, এবং এই নোটটি ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বাজারে সরবরাহকৃত ছিল। হোল্ডারনেসের বইটিতে ভূমিকা আর ‘আফটারথট’ শীর্ষক শেষ পরিচ্ছেদ ছাড়া মোট ৯টি প্রবন্ধ আছে যার সবগুলি শেক্সপিয়ারের নাটক, কবিতা কিংবা তাঁর নিজের ওপর। এই প্রবন্ধগুলি থেকে আমি পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন নাটক আলোচনা করার সময় প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করব।

বস্তুবাদিতা : কার্ল মার্ক্সের শেক্সপিয়ার পাঠ

এ পর্যায়ে শেক্সপিয়ারের রচনায় বস্তুবাদিতার স্পৃষ্টতা নিয়ে একটা তাত্ত্বিক ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করব। ব্রিটিশ সাহিত্যতাত্ত্বিক টেরি ইগেলটন একবার বলেছিলেন যে শেক্সপিয়ারের সাহিত্য পড়ার সময় এই বোধ মনে না জেগে পারে না যে শেক্সপিয়ার নিশ্চয়ই হেগেল, মার্ক্স, নিটশে, ফ্রয়েড, উইটজেনস্টাইন এবং দেরিদা পড়েছিলেন। তেমনি স্লোভানিয়ার মনস্তত্ত্ববিদ তাত্ত্বিক স্ল্যাভোজ জিজেক বলেছিলেন, ‘শেক্সপিয়ার নিঃসন্দেহে লাকাঁ পড়েছিলেন’। (সূত্র: জোনাথন জিল হ্যারিস, শেক্সপিয়ার অ্যান্ড লিটারারি থিওরি [২০১০], পৃ. ৪)।

শেক্সপিয়ারের রচনার সঙ্গে মার্কসবাদের সম্পর্কটা ঝালাই করে নিলে শেক্সপিয়ারের ওপর বস্তুবাদী সমালোচনার উৎপত্তিটা বুঝতে পারব, যদিও শুরুতে বলে রাখা দরকার মার্ক্সবাদ ও নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা একই ধরনের হলেও এক তত্ত্ব নয়। মার্ক্সবাদের মূল কথা হলো সমাজের মধ্যে মানবসম্পর্কগুলো তৈরি হয় উৎপাদনের অর্থনৈতিক সূত্রগুলোর ওপর ভিত্তি করে। এটা সমাজের মূল কাঠামো বা বেইজ স্ট্রাকচার। এই অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংস্কৃতির কাঠামো দাঁড়ানো, যেটাকে বলা হচ্ছে ওপরের কাঠামো বা সুপারস্ট্রাকচার। সমাজের উৎপাদন বা অর্থনৈতিক উপায়গুলো দখলের জন্য দুটি শ্রেণির মধ্যে নিরন্তর সংগ্রাম চলে, এবং সংগ্রামের ক্ষেত্রে একটি শ্রেণি অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হতে থাকে। এরাই শাসকগোষ্ঠী এবং বিপরীতে অন্যরা হলো প্রলেতারিয়েত। অন্যদিকে নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা মনোযোগী হচ্ছে সাহিত্যের মধ্যে অর্থনৈতিক শব্দগুচ্ছ, বাক্যাংশ, এবং চিন্তা কীভাবে প্রবিষ্ট হচ্ছে তার ওপর। মার্ক্সবাদ যেমন এক দিকে শ্রেণিসংগ্রামের বিভিন্ন লড়াইজাত উপাত্ত শেক্সপিয়ারের রচনার মধ্যে খুঁজে পেতে আগ্রহী, নতুন সমালোচনা সাহিত্য সে ধরনের কোনও শ্রেণিগত চেতনা বা লক্ষ্য নিয়ে শেক্সপিয়ারের রচনা পাঠ করতে আগ্রহী নয়। বরঞ্চ আমরা এভাবে বলতে পারি যে মার্ক্সবাদী শেক্সপিয়ার সমালোচনা যেমন একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে প্রমাণিত করতে সচেষ্ট, নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা সেটিকে একটি ডিসকোর্স বা আলোচ্য বিষয় হিসেবে দেখবে, যেটার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা প্রকট থাকবে না।

তবে শেক্সপিয়ারের প্রতি মার্ক্সের ভালোবাসার কথা উল্লেখ করতে হয়। ডেভিড হক্সের বাক্যটা আবার উদ্ধৃত করি : ‘কার্ল মার্ক্স লাভড উইলিয়াম শেক্সপিয়ার।’ ক্রিশ্চিয়ান স্মিথ তাঁর ‘মার্ক্সিয়ান স্টাডিজ’ শীর্ষক প্রবন্ধে জানাচ্ছেন যে শেক্সপিয়ার মার্ক্সের অর্থনৈতিক চিন্তার গঠনে বিরাট প্রভাবক ছিলেন। মার্ক্স তাঁর রচনাবলিতে প্রায় দ্বিশতবার শেক্সপিয়ারের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দেন। তাঁর বিখ্যাত রচনা ক্যাপিট্যাল বা পুঁজিতে তেরবার শেক্সপিয়ারের রচনার উল্লেখ আছে। মার্ক্স লল্ডনে ১৮৪৯ সাল থেকে ১৮৮৩ সাল, অর্থাৎ তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় চৌত্রিশ বছর সপরিবারে বাস করেছিলেন। শেক্সপিয়ারের সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রীতির জন্য তিনি ১৮৭৭ সালে দ্য ডগবেরিজ নামক একটি শেক্সপিয়ার পাঠ ও অভিনয় ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। মার্ক্স, যিনি ছিলেন হেগেলের দ্বান্দ্বিকতাবাদ দর্শনের একজন অনুসারী, শেক্সপিয়ারের মধ্যে সে ধরনের দ্বান্দ্বিকতা খুঁজে পেলেন, এবং প্রুশিয়া সরকারের সংবাদ মাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার বিরুদ্ধে মার্ক্স তাঁর প্রথম প্রবন্ধ, ‘প্রসিডিংস অব দ্য সিক্সথ রাইন প্রভিন্স এসেম্বলি। দ্য ডিবেইটস অন ফ্রিডম অব দ্য প্রেস অ্যান্ড পাব্লিকেশন অব দ্য প্রসিডিংস অব দ্য এসেম্বলি’ ছাপালেন ১৮৪২ সালে রাইনিশ জাইটুঙ পত্রিকায়―যেখানে তিনি হ্যামলেটের বিখ্যাত ‘টু হোল্ড অ্যাজ ইট ওয়ের দ্য মিরর আপ টু নেচার’ (৩. ২. ২১-২) উক্তিটি উদ্ধৃত করে বলতে চাইলেন যে প্রেস হচ্ছে সমাজের আয়না স্বরূপ। হ্যামলেট যেখানে অভিনয় কলা বিশ্লেষণে করার জন্য এই উক্তিটি করেছিলেন, সেখানে মার্ক্স সেটি প্রেস ফ্রিডমের প্রেক্ষাপটে প্রয়োগ করলেন। বস্তুত এই প্রবন্ধে মার্ক্স আ মিডসামার নাইটস ড্রিম, হ্যামলেট, কিং লিয়ার এবং দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস থেকে বহুল উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্যে পৌঁছালেন যে : পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা কেবলই ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষা করে, মানবিক স্বার্থ নয়। পুঁজির সর্বভুক চরিত্র প্রকাশ করতে গিয়ে মার্ক্সবাদী সমালোচক হিউ গ্রাডি ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিদার অন্যতম চরিত্র ইউলিসিসের বিখ্যাত ‘ডিগ্রি’ উক্তির উল্লেখ করে বললেন, পুঁজি হলো একটি ‘ইউনিভার্সেল উলফ’ বা ‘বৈশ্বিক নেকড়ে’ (১. ৩. ১২১)।

ইউলিসিস কথিত এই বৈশ্বিক নেকড়েটা কি সেটি একটু বোঝার চেষ্টা করা যায়। ডেভিড হকস তাঁর পূর্বে উল্লিখিত বইয়ের প্রথম দিকে অর্থনীতি বলতে প্রাচীন গ্রিসের দার্শনিকেরা কী বুঝতেন সে সম্পর্কে বলছেন যে সক্রেটিস এবং অ্যারিস্টোটল অর্থনীতি বলতে দুধরনের ব্যবহার বুঝতেন। একটি হলো দ্রব্যের ব্যবহারিক উপযোগিতা, আরেকটি হলো দ্রব্যের বিনিময় উপযোগিতা। প্রথমটি হলো ইউজ ভ্যালু বা দ্রব্যের মূল উপযোগিতা, যেটি স্বাভাবিক এবং অবিচ্ছিন্নকর। যেমন অ্যাজ ইউ লাইক ইট কমেডির রাখাল চরিত্র কোরিন তার মেষপালকের কার্যক্রম বর্ণনা করতে গিয়ে বলছে : ‘স্যার, আই অ্যাম আ ট্রু লেবারার : আই আর্ন দ্যাট আই ইট, গেট দ্যাট আই ওয়ের; ঔ নো ম্যান হেইট, এনভি নো ম্যানস হ্যাপিনেস; গ্ল্যাড অব আদার মেনস গুড, কন্টেন্ট উইথ মাই হার্ম; অ্যান্ড দ্য গ্রেটেস্ট অব মাই প্রাইড ইজ টু সি মাই ইউজ গ্রেইজ অ্যান্ড মাই ল্যাম্বস সাক’ (৩. ১. ৭০-৭৪)। অর্থাৎ, মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে কোরিনের বক্তব্যটি হচ্ছে ইউজ ভ্যালু বা ব্যবহারিক উপযোগিতার একটি মোক্ষম উদাহরণ। কিংবা আমরা বলতে পারি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতার উপেনের কাছে তার পিতৃমাতৃর ভিটামাটি ছিল তার প্রাণের আবেগের সঙ্গে জড়িত। এটি তার স্বাভাবিক ব্যবহারিক উপযোগিতা বা ইউজ ভ্যালু। আর উপেনের জমিদারের কাছে উপেনের জমির মূল্য হলো এর বিনিময় মূল্য বা এক্সচেঞ্জ ভ্যালু। পণ্যের ইউজ ভ্যালু ছিল মানবিক এবং সামাজিক, কিন্তু পণ্যের বিনিময় মূল্য, যেটিকে গ্রিক ভাষায় বলে ক্রিম্যাটিস্টিক, সেটির পক্ষে ছিলেন না অ্যারিস্টোটল বা অন্য প্রাচীন দার্শনিকেরা। অ্যারিস্টোটল পণ্যের বিনিময়মূল্য থেকে সৃষ্ট সুদের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন, কারণ সুদ হলো টাকা থেকে টাকার বাচ্চা হওয়া, যেখানে পণ্যের কোনও ভূমিকা নেই। সেইন্ট পল প্রথম খ্রিস্টীয় শতাব্দীতে বললেন, টাকা হলো যত নষ্টের গোড়া। ডেভিড হকস আরেকটি মূল্যবান তথ্য দিচ্ছেন যে অ্যারিস্টোটলের সময় অর্থনীতির সংজ্ঞা ছিল অবাধ বা জেনারেল, কিন্তু রেনেসাঁ যুগের পর আধুনিক যুগে অর্থনীতির সংজ্ঞা হয়ে পড়ে সীমিত বা রেস্ট্রিক্টেড। শেক্সপিয়ারের যুগের পর আধুনিক যুগে অর্থনীতি একটি আলাদা বিষয় হয়ে পড়ে, যেটির সঙ্গে অন্য শাস্ত্রগুলোর সংমিশ্রণকে স্বীকার করা হতো না। শেক্সপিয়ারের যুগ ছিল একটি সন্ধিক্ষণ, যখন সামন্তবাদী অর্থনীতি বিদায় নিয়ে প্রাক-পুঁজিবাদের প্রবাহ শুরু হয়। আবার বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে অর্থনীতি বিষয় হিসেবে অবাধ হতে থাকে। সে দিক থেকে নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনা বা নিউ ইকনোমিক ক্রিটিসিজমের আওতায় শেক্সপিয়ারের রচনা পাঠ একটি উর্বর ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। তখন হিউ গ্রাডি যেমন মার্ক্সীয় তত্ত্বের আলোকে শেক্সপিয়ারের ‘ইউনিভার্সেল উলফ’-এর সঙ্গে পুঁজির সংহারী রূপের মিল খুঁজে পান, তেমনি তাঁর আগে মার্ক্স পুঁজিবাদের বিস্তারে এই কারণে শংকিত হয়ে ওঠেন যে পুঁজিবাদ সকল কিছুকে বিনিময়মূল্যধারক পণ্যে রূপান্তরিত করে ফেলে। যেমন, ওপরে আমরা বলেছি যে কোরিনের কাছে তার ভেড়ার বা উপেনের কাছে তার পৈতৃক ভিটার যেমন কোনও বিনিময় মূল্য হয় না, কিন্তু জমিদারের কাছে ভিটাটির বিনিময় মূল্যই প্রধান, ঠিক তেমনি মার্ক্স শেক্সপিয়ারের বহু নাটক থেকে পুঁজির এই সর্বভুক চরিত্রের নিশানা খুঁজে পান। অর্থাৎ, আধুনিক যুগ নিতান্তই বস্তুচিন্তা দ্বারা শাসিত, এবং তারই আলামত শেক্সপিয়ার আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। মার্ক্স শেক্সপিয়ারের যে নাটকটিকে অবলম্বন করে বুর্জোয়া সমাজে পুঁজির প্রভাব নিয়ে সমালোচনায় নামলেন সেটি হলো, শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি টাইমন অব এথেন্স (১৬০৪-১৬০৬)। প্রবন্ধটির শিরোনাম : ‘দ্য পাওয়ার অব মানি ইন বুর্জোয়া সোসাইটি’ (১৮৪৪)। টাইমনের গল্পটা হলো এরকম : তিনি এথেন্সের একজন ধনী অভিজাত ব্যক্তি ছিলেন। সবাইকে অকাতরে দান-খয়রাত করতেন ও কর্জ দিতেন। এ করে তাঁর ভাণ্ডার একসময় নিঃস্ব হয়ে যায়। তাঁর পতিত অবস্থায় তিনি আগে যাদেরকে দান-খয়রাত করেছিলেন তাদের কাছে সাহায্য চেয়ে লোক পাঠালেন। সবাই নানা উছিলা দেখিয়ে তাঁর অনুরোধ উপেক্ষা করল। তখন মানবজাতির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে তিনি মানবজাতিকে ঘৃণা করে বনে চলে গেলেন। বনের মধ্যে বহু কষ্টে দিনাতিপাত করার সময় একদিন খাবারের সন্ধানে তিনি শিকড় খুঁড়তে গিয়ে গুপ্তধনের সন্ধান পেলেন। এই গুপ্তধন ছিল এক তাল স্বর্ণ। অর্থাৎ তাঁর ভাগ্য পরিবর্তনের রাস্তা তৈরি হলো। ক্রিশ্চিয়ান স্মিথ বলছেন, মার্ক্সবাদে পুঁজির সমালোচনার মূল দিকটা হলো পুঁজি মাত্রই বিপরীতধর্মী, যেটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ইনভার্সন। অর্থাৎ, পুঁজির লক্ষ্য ও পরিণতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। এত স্বর্ণ একসঙ্গে পেয়ে তিনি আনন্দে যেমন শিহরিত হলেন, তেমনি একটা চরম সত্যে উপনীত হলেন। তাঁর এই উপলব্ধি তিনি একটি বিখ্যাত স্বগতোক্তির (৪. ৩. ২৫-৪৪) মাধ্যমে প্রকাশ করলেন। তিনি বললেন, গোল্ড বা স্বর্ণ বিপুল ক্ষমতাধারী। এটা কালোকে সাদা, বিশ্রিকে সুন্দর, ভুলকে শুদ্ধ, পাজিকে মহৎ, বুড়াকে যুবক, কাপুরুষকে বীর ইত্যাদিতে রূপান্তরিত করতে পারে, অর্থাৎ স্বর্ণ (বা টাকা) ইনভার্সন ঘটাতে চতুর। তিনি আরও বললেন, এমনকি পুরোহিতেরা এবং চোরেরা তাদের নিজ নিজ পক্ষ ত্যাগ করতে পারে টাকার জন্য। টাকার এই পরিবর্তন করার ক্ষমতাকে ভিত্তি করে পুঁিজ বা টাকার একটি শক্তিশালী তত্ত্ব দাঁড় করালেন মার্ক্স। তিনি বললেন, টাকার যে শক্তির কথা টাইমন স্বীকার করেছেন, সেটি আসলেই প্রণিধানযোগ্য। কারণ টাকা মানুষকে এলিয়েনেটেড এবিলিটি বা বিচ্ছিন্নকৃত সামর্থ্য দান করে। মানুষের এলিয়েনেটেড এবিলিটি বোঝাতে মার্ক্স একটি উদাহরণ দিলেন। বললেন, ধরুন তাঁর খুব ইচ্ছা হলো অমুক সুন্দরীর সঙ্গে তিনি একটি ভালো সময় কাটাবেন। কিন্তু সুন্দরী হতে পারে তাঁর ধরাছোঁয়ার বাইরে। তখন টাকা থাকলে সে সুন্দরীকে ম্যানেজ করা তার পক্ষে সম্ভব।

যখন টাকার এই সামর্থ্য অর্জিত হয়, তাঁর একটা সংজ্ঞা দিলেন মার্ক্স। ইংরেজিতে রেইফিকেশন, বাংলায় যেটার অর্থ আমরা করতে পারি এরকম : বস্তুনিচয়কে প্রাণিবাচক ভাবা। অর্থাৎ প্রাণহীন বস্তুকে প্রাণ আছে মনে করা। শেক্সপিয়ারের নাটকে রেইফিকেশনের অন্যতম উদাহরণ হতে পারে রাজমুকুট পণ্যটি। রাজা হেনরি ফোর্থ টু ঐতিহাসিক নাটকে যুবরাজ হাল তাঁর অসুস্থ পিতার শয্যাপার্শ্বে রাখা রাজমুকুটটিকে দেখে সেটি যেন একটি জীবন্ত জিনিস সেভাবে বলছেন, ‘ও পোলিশড পার্টাবড! গোল্ডেন কেয়ার!’ (৪.৫.২২) রাজমুকুট হচ্ছে একটি বস্তু, যেটি রাজার জন্য রাজ্যশাসনের প্রতীক বা সিগনিফায়ার। রাজা এটি মাথায় পরে রাজ্য শাসন করবেন, সে অর্থে রাজমুকুটটি একটি সামাজিক দায়িত্ব পালনের প্রতীকী বস্তু। এটির নিজের কোনও ইন্ট্রিনজিক বা নিজস্ব ভ্যালু বা প্রাণ নেই। কিন্তু যুবরাজের পিতা রাজা চতুর্থ হেনরি এই রাজমুকুট দখল করেন বেআইনিভাবে রাজা রিচার্ড দ্বিতীয়কে প্রথমে রাজসিংহাসন থেকে বিতাড়ন করে ও পরবর্তী হত্যার আদেশ দিয়ে। রাজমুকুট মাথায় পরার পর তিনি আবিষ্কার করলেন যে তিনি যে অবৈধ রাজা সেটা তাঁর বিবেক থেকে সরে যাচ্ছে না। যে মুকুটটি দখল করে তিনি ভেবেছিলেন সেটি তাকে ক্ষমতা ও শান্তি দেবে, তিনি এখন আবিষ্কার করলেন যে সেই মুকুটটি নিছকই একটি প্রাণহীন বস্তু, এবং তাঁর অশান্তির কারণ। তখন তিনি বললেন, ‘আনইজি লাইস দ্য হেড দ্যাট ওয়েরস আ ক্রাউন’ (৩. ২. ৩১)। যিনি রাজমুকুট পরেন, তিনি আর শান্তি পান না। শেক্সপিয়ারের রাজা তৃতীয় রিচার্ডও রাজমুকুটকে হেনরি দ্য ফোর্থের মতো স্বয়ংক্রিয় বা রেইফাইড অবজেক্ট হিসেবে দেখেছিলেন। রাজা হিসেবে শাসন করার সমস্ত মানবিক আর সামাজিক দায়িত্বকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি রাজমুকুটটিকেই জীবন্ত ভাগ্যনিয়ন্ত্রক হিসেবে দেখে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে গেলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করলেন যে সুশাসনের মধ্যে রাজ্য শাসন না করলে, শুধু রাজমুকুটকে সবকিছুর নিয়ন্তা হিসেবে ধরে নিলে যেটি হয় সেটি হচ্ছে ব্যক্তি বস্তুকে পরিচালনা না করে বস্তুই ব্যক্তিকে পরিচালনা করে। এটিই মার্ক্সীয় রেইফিকেশন। তখন বসওয়ার্থ যুদ্ধে ১৪৮৫ সালে রাজা তৃতীয় রিচার্ড যখন পরাজয়ের সম্মুখীন, তখন তাঁর আর মাথায় রাজমুকুট পরার সময় নাই, বরঞ্চ প্রাণ বাঁচানোর জন্য রাজমুকুট নয়, তাঁর রাজ্য নয়, প্রয়োজন একটি ঘোড়ার। তাই চিৎকার করে বললেন, ‘আ হর্স! আ হর্স! মাই কিংডম ফর আ হর্স।’ (৫. ৪. ৭), আমার রাজ্যের প্রতিদানে একটি অশ্ব চাই। রাজমুকুটের প্রতি ম্যাকবেথের দৃষ্টিভঙ্গিও একই। তিনিও রাজমুকুটকে নিজস্ব শক্তিসম্পন্ন মনে করে রাজা ডানকানকে হত্যা করে মুকুট মাথায় দিয়ে বুঝতে থাকলেন, সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজ্য শাসন করা এক জিনিস আর ব্যক্তিগত লোভে রাজমুকুট মাথায় পরলে, যে মুকুটটা শান্তি দেবার কথা, সেই মুকুটটাই শান্তি হরণের কারণ হয়ে শাস্তি হিসেবে দাঁড়ায়। তিনি লেডি ম্যাকবেথকে বলছেন, ‘ও! ফুল অব স্কর্পিয়নস ইজ মাই মাইন্ড, ডিয়ার ওয়াইফ।’ (৩. ২. ৩৬) আমার মন কাঁকড়াবিছাতে ভরে গেছে। ঠিক একইভাবে আমরা ওথেলোর বিখ্যাত রুমালটিকে আরেকটি রেইফাইড বস্তু হিসেবে বিবেচনা করতে পারি। তিনি জ¦লজ্যান্ত রক্তমাংসের ডেসডেমোনার কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে রুমালটাকে এমনভাবে দেখতে লাগলেন যেন ঐ কাপড়ের বস্তুটিই ডেসডেমোনার সতীত্বকে ধরে রেখেছে কিংবা রাখেনি : ‘বাই হেভেন, আই স মাই হ্যান্ডকারচিফ ইনজ হ্যান্ড!’ (৫.২.৬২)।  

ওপরের প্রতিটি উদাহরণ আরেকটি মার্ক্সীয় তত্ত্ব প্রকাশ করছে যে প্রতিটা ক্ষেত্রে মানুষকে উপেক্ষা করে দ্রব্যের কদর বেড়ে গেছে, যেটাকে মার্ক্স বলছেন ‘কমোডিটি ফ্যাটিশিজম’ বা বস্তু-প্রেম। অর্থাৎ, পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ দ্রব্য বা পণ্যকে মানুষের ওপরে স্থান দেয়। কমোডিটি ফ্যাটিশিজমের একটি উপাত্ত আমাদের সমাজে আমরা খুঁজে পাই। অনেক সময় শুনি প্রতিষ্ঠিত ছেলে গ্রাম থেকে আসা তার বাবা-মাকে দুদিনও থাকতে দিতে চায় না কারণ তার বসার ঘরের সোফাগুলিকে সরাতে হবে, তাই। অর্থাৎ, বাবা-মার চেয়েও ছেলের কাছে সোফার মূল্য বেশি। এটাই কমোডিটি ফ্যাটিশিজম।

ওপরের উদাহরণগুলি থেকে আরও একটি মার্ক্সীয় তত্ত্ব প্রমাণিত হয়। সেটি হলো রেইফিকেশন বা কমোডিটি ফ্যাটিশিজম মানুষকে উপেক্ষা করে বস্তুকে কদর দেয় বলে মানুষে মানুষে এলিয়েনেশন বা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রাজমুকুটকে প্রাণসর্বস্¦ মনে করাতে হেনরি ফোর্থ, রিচার্ড থার্ড এবং ম্যাকবেথের সঙ্গে অন্যদের দূরত্বের সৃষ্টি হয়, তেমনি রুমালটাকে রেইফাইড ভাবাতে ওথেলোর সঙ্গে ডেসেডেমোনার দূরত্বের সৃষ্টি হয়। এটাও উল্লেখযোগ্য যে রেইফিকেশন ও কমোডিটি ফ্যাটিশিজম শেক্সপিয়ারের নাটকগুলোতে খলনায়কদের চরিত্রে অস্তিত্বশীল হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন রাজা লিয়ার নাটকের খলনায়ক এডমান্ড। সে অবৈধভাবে সম্পদ দখলের জন্য পিতা ও পুত্রের মধ্যে, অর্থাৎ গ্লস্টার ও এডগারের মধ্যে শত্রুতা বাঁধিয়ে দেয় : ‘ওয়েল, দেন, / লেজিটিমেইট এডগার, আই মাস্ট হ্যাভ ইয়োর ল্যান্ড’ (১.২.১৫-১৬), ঠিক আছে হে বৈধ এডগার, আমি তোমার জমি নেবই।

পুঁজিবাদের মানসিকতার তলার ভিত্তি হচ্ছে লোভ―বিশেষত বস্তুর জন্য লোভ। তখন হয় কি মানুষের যে কোনও মানবিক উপাদানকে সে বস্তুর সমষ্টি দিয়ে বিচার করে কিংবা প্রচার করতে চায়। মার্ক্স পরবর্তী সময়ে তাঁর ক্যাপিট্যাল গ্রন্থে বললেন যে, মানুষ টাকাকে মানবীয় গুণাবলির স্থলে বসিয়ে দেয়। তিনি তাঁর বিখ্যাত শোষণের প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করে বললেন যে শ্রমিকের সময়ের উপযোগিতা মালিকের কাছে চলে যায়। অর্থাৎ একজন শ্রমিক যে শ্রম ও সময় দিয়ে একটি পণ্য উৎপাদনে সহায়তা করে, দিনশেষে সে পণ্যের ওপর তার কোনও অধিকার থাকে না। অর্থাৎ, পণ্য থেকে মানুষের কষ্ট ও শ্রম, চিন্তা ও সময় বিযুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে পণ্যের সঙ্গে শ্রমিকের দূরত্ব বা এলিয়েনেশন সৃষ্টি হয়। মালিক এই অর্থে শ্রমিকের সময়টা শোষণ করে নেয়।

মার্ক্সের বস্তুগত কাঠামোর কথা স্বীকার করলেন পরবর্তী সময়ের বিখ্যাত সমাজচিন্তক মিশেল ফুকো (১৯২৬-৮৪)। তিনি ফ্রয়েডের ইন্দ্রিয়গত জগতের সৃষ্টি মানুষের মনস্তত্ত্বের গভীর কোনও নিষ্পেষিত প্রাক-সামাজিক আদিম উৎস থেকে হয়েছে না ভেবে―বললেন : মনস্তত্ত্বও সামাজিক বস্তুগত কাঠামোর বিন্যাস থেকে উৎসারিত। ফুকো আরও বললেন, লেডি ম্যাকবেথের মস্তিষ্ক বিকৃতি যতটা না তাঁর মানসিক এবং শারীরিক কারণ থেকে সৃষ্ট, তার চেয়ে বেশি সামাজিক কারণ থেকে। ম্যাকবেথ-এ লেডি ম্যাকবেথের অনিদ্রাপীড়িত দৃশ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন সমাজ লেডি ম্যাকবেথকে সত্য বলার অধিকার দেবে না। তিনি সত্য তখনই বলবেন যখন তিনি অপ্রকৃতিস্থ হবেন। সমাজের এই কর্তৃত্বকে স্বীকার করে মার্ক্স বলেন : ক্ষমতা এবং জ্ঞানের মধ্যে একটি পারস্পরিক নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মার্ক্স যেমন ক্ষমতা বলতে বোঝাচ্ছেন একটি শক্তিশালী শ্রেণির মধ্যে ক্ষমতা ও জ্ঞান কেন্দ্রীভূত থাকে, ফুকো তেমন মনে করতেন না। তিনি বললেন, ক্ষমতা ওপর থেকে নিচে পর্যন্ত একটি নেটওয়ার্ক, যেখানে বিভিন্ন খণ্ডিত জনগোষ্ঠীর অংশের চূড়ামণির সঙ্গে ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক থাকে। যেমন, উদাহরণ হিসেবে বলি, ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ঢাকার অনেক প্রথম সারির নেতাকে উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলের যেমন খাগড়াছড়ির নেতাকে অবশ্যই তিনি চিনবেন এবং গুরুত্ব দেবেন। এটিই ক্ষমতার বিশেষ প্রকরণ বা নেটওয়ার্ক।

পুঁজিবাদী সমাজের বৈষয়িক কাঠামোগত প্রকরণই মানুষের মনের প্রবণতা নির্দিষ্ট করে―এই বস্তুবাদিতার নিরিখে মার্ক্স এবং ফুকোর মধ্যে মিল থাকলেও, একটা বৈপরীত্য আছে। মার্ক্সের দৃষ্টিতে বস্তুকে কেন্দ্র করে সমাজে দুটি শ্রেণির মধ্যে নিরন্তর সংগ্রাম চলছে, যেটিকে ডাইলেক্টিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম বা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ হিসেবে পরিচিতি দেওয়া হয়। শেক্সপিয়ারের নাটক কোরিওলেনাস-এর প্রেক্ষাপটে বলতে পারি শাসকদল (প্যাট্রিসিয়ান) এবং শাসিতের দল প্রোলেতারিয়েতদের মধ্যে বস্তুবাদী দ্বান্দ্বিকতা সমাজকে ব্যাখ্যা করে।

শেক্সপিয়ারের রচনায় প্রোলেতারি- য়েতদের বিরাট সম্মিলন আছে। কোরিওলেনাস (১৬০৮)-এ রোমের বুভুক্ষু লোকেরা যখন বিদ্রোহ করে শস্যের বৈষম্যমূলক বণ্টনের বিরুদ্ধে, তখন অভিজাত মেনেনিয়াস তাদেরকে পেটের গল্পটা শোনায় যে পেট আপাত দৃষ্টিতে কিছু করে না। কিন্তু পেট যদি খাবার সংরক্ষণ না করে, তা হলে পুরো শরীরটাই অকেজো হয়ে যায় : ‘বিকজ আই এম দ্য স্টোরহাউজ অ্যান্ড দ্য শপ / অব দ্য হোল বডি’ (১. ১. ১৩২-১৩৩)। অভিজাত শ্রেণি হলো স্টোর হাউজ, কাজেই অন্যদের দায়িত্ব হলো তাদেরকে রক্ষা করা। এতে অবশ্য বিদ্রোহী লোকগুলো খুব আশ্বস্ত হয় না। এর আগে ১৬০৫ সালে রচিত রাজা লিয়ার-এ শেক্সপিয়ার নাঙা-ভুখা লোকদের প্রতীকী চিত্র আঁকেন ভিখারি টম ও ব্যাডলাম (ছদ্মবেশে এডগার)-এর চরিত্রের মাধ্যমে। লিয়ারের বিখ্যাত উক্তি ‘পুওর,  নাকিড রেচেস, হোয়েরসোর ইউ আর,… হাউ শ্যাল ইয়োর হাউজলেস হেডস অ্যান্ড আনফেড সাইডস / ইয়োর লুপড অ্যান্ড উইনডোড র‌্যাগিডনেস, ডিফেন্ড ইউ / ফ্রম সিজনস সাচ অ্যাজ দিজ’ (৩. ৩. ২৮-৩২) নিশ্চিত মার্ক্সকে নাড়া দিয়েছিল। লিয়ারের দরিদ্র লোক সম্পর্কে এই অনুধাবন―যে তোমরা কেমন করে বেঁচে থাকো―এটাই সত্য প্রমাণ করে যে যদিও লিয়ার সামন্ত যুগের রাজা, কিন্তু শেক্সপিয়ার যখন নাটকটি লিখছিলেন তখন ইংল্যান্ডে প্রাক-পুঁজিবাদীর আগমন হয়ে গেছে, এবং শোষিত শ্রেণি পুঁজিবাদী উঠতি বুর্জোয়ার কাছে ক্রীড়নক হয়ে পড়ছিল। অর্থাৎ, পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে সংঘর্ষটাই সত্য, ডায়াক্রোনিক। কিন্তু ফুকো বলছেন, ব্যাপারটা তত সরাসরি যুদ্ধ্যমান নয়, বরঞ্চ সমাজ চলে প্রতিপক্ষ দলগুলোর মধ্যে অলিখিত আদান-প্রদান ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্যে। নিরেট বিরোধিতা বলে কিছু নেই। আমরা বলতে পারি, ফুকোর সামাজিক ব্যাখ্যাটা অনেকটা ম্যাকবেথ নাটকের শুরুতে ডাইনিদের উক্তির মতো : ‘ফেয়ার ইজ ফাউল, অ্যান্ড ফাউল ইজ ফেয়ার’ (১. ১. ৯) অর্থাৎ, বস্তুজগৎ বা বাণিজ্যিক জগৎ চলে একটি অপার লেনেদেনের মধ্যে। যাকে প্রতিপক্ষ ব্যবসায়ী ভাবা হচ্ছে, তার কাছেই হয়তো ঋণ নেবার জন্য যেতে হচ্ছে, যেমনটি আমরা দেখতে পাই দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস নাটকে, যেখানে অ্যান্টোনিওর মতো বিশুদ্ধ ক্রিশ্চান ব্যবসায়ীকে আরেক ক্রিশ্চান ব্যবসায়ীর জন্য ঋণ খুঁজতে যেতে হয় তাঁর জাতশত্রু ইহুদি সুদখোর ব্যবসায়ী শাইলকের কাছে। মার্ক্সের সমাজচিন্তাকে ডায়াক্রোনিক বললে, ফুকোর চিন্তাকে বলতে হবে সিনক্রোনিক। অর্থাৎ, সমন্বয়ভিত্তিক।

মার্ক্স এবং ফুকোর বস্তুগত দর্শন থেকে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে শেক্সপিয়ারের সমালোচনা সাহিত্যে দুটো বস্তুবাদী সমধারার বিকাশ হয়। একটি হলো, বর্তমান দুনিয়ায় শেক্সপিয়ারের সমালোচনা সাহিত্যের সর্বোচ্চ প্রভাবশালী পণ্ডিত হার্ভার্ডের মানবিকবিদ্যা ও ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক স্টিফেন গ্রিনব্ল্যাট যাঁকে নিউ হিস্ট্রিসিজম বা নব্য ইতিহাসবাদ তত্ত্বের জনক বলা হয়, যিনি তাঁর ‘ইনভিজিবল বুলেটস’ (১৯৮৮) শীর্ষক প্রবন্ধে শেক্সপিয়ার পাঠ নিয়ে একটি নতুন দিকের উন্মোচন করলেন, যেটির আলোচনায় আমরা একটু পরে আসছি, আর এর পাশাপাশি, অর্থাৎ আমেরিকায় নব্য ইতিহাসবাদের পাশাপাশি গ্রেট ব্রিটেনে অ্যালান সিনফিল্ড, জোনাথন ডলিমোর প্রমুখ পন্ডিত দ্বারা কালচারাল ম্যাটেরিয়ালিজম বা সাংস্কৃতিক বস্তুবাদ নামক প্রায় একটি সমধারার আন্দোলন শুরু হয়। তবে দুটোর মধ্যে সামান্য একটু পার্থক্য আছে। যেখানে গ্রিনব্ল্যাট ফুকোকে অনুসরণ করে বলছেন যে, ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে ক্ষমতাধর শ্রেণি বা শেক্সপিয়ারের নাটকের আলোকে রাজন্যবর্গ নানা ম্যাকিয়াভেলিয়ান কূটকৌশল ও নেগোশিয়েশন্সের  আশ্রয় নেয়, ফলে সাবভার্সন, ইমপ্রোভাইজেশন, ও কন্টেইনমেন্ট এগুলির প্রয়োগ হতেই থাকে, অন্যদিকে এই শাসকদল ও শাসিতদলের মধ্যে গ্রিনব্ল্যাট কথিত বনিবনার ডিসকোর্স পুরোপুরি মেনে না নিয়ে অ্যালান সিনফিল্ডেরা মার্ক্সের মতোই স্বীকার করে নিলেন যে যতই বনিবনা হোক না কেন দিনশেষে ফল্ট লাইনস বা বিরোধিতার সূত্রগুলো অমোচনীয় থেকেই যায়। অর্থাৎ, নব্য ইতিহাসবাদীরা যেখানে সমন্বয়বাদী বা সিনেক্রোনিক চিন্তা করে, সেখানে সাংস্কৃতিক বস্তুবাদীরা প্রতিপক্ষতামূলক বা ডায়াক্রোনিক চিন্তা করে।

তবে আমার বিশেষ আগ্রহ গ্রিনব্ল্যাটের চিন্তাধারা সামান্য পরিসর নিয়ে আলোচনা করার। গ্রিনব্ল্যাট প্রথম বিপ্লব ঘটালেন ১৯৮০ সালে তাঁর প্রথম গ্রন্থ রেনেসাঁ সেল্ফ-ফ্যাশনিং : ফ্রম মুর টু শেক্সপিয়ার প্রকাশ করে, যেখানে ছয়টি প্রবন্ধে তিনি ইংরেজি সাহিত্যের রেনেসাঁ যুগের শ্রেষ্ঠ ছয়জন লেখক-কবিকে নিয়ে ছয়টি সুদীর্ঘ এবং অত্যন্ত তথ্যবহুল ও উদ্ধৃতিসমৃদ্ধ প্রবন্ধ লিখলেন (যে পঠনশৈলীর নাম ক্লিফোর্ড গিয়ারটজের ভাষায় হলো ‘থিক ডেসক্রিপশন’)। আলোচ্য লেখকবৃন্দ হলেন যথাক্রমে টমাস মুর, উইলিয়াম টিনডেইল, টমাস ওয়াট, এডমান্ড স্পেনসার, ক্রিস্টোফার মার্লো এবং উইলিয়াম শেক্সপিয়ার―যে প্রবন্ধগুলির প্রত্যেকটিতে গ্রিনব্ল্যাট বলতে চেয়েছেন যে সমাজ মাত্রই চলে ক্ষমতাধর শ্রেণির সঙ্গে ক্ষমতাবঞ্চিতদের মধ্যে বৈষয়িকভাবে লেনদেনের মধ্যে। কিংবা যিনি মূল নায়ক তাকে অ্যালিয়েন বা অচেনা প্রতিপক্ষের সঙ্গে লেনদেন করে চলতেই হবে। গ্রিনব্ল্যাটের দ্বিতীয় বই শেক্সপিয়ারিয়ান নেগোশিয়েশনস প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে, যেখানে পূর্বে উল্লেখিত ‘ইনভিজিবল বুলেটস’ প্রবন্ধটি অর্ন্তভুক্ত হয়।

প্রথমে বলে রাখি, এডওয়ার্ড সাইদের একটি উক্তির সঙ্গে গ্রিনব্ল্যাটের সাহিত্য-অধ্যয়নে সামঞ্জস্য আছে। ‘কনভার্সেশন উইথ এডওয়ার্ড সাইদ’ শীর্ষক ২০০৫ সালে প্রকাশিত একটি গ্রন্থে তারিক আলীর ২০০৩ সালে নিউ লেফট রিভিউ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকার ‘রিমেমবারিং এডওয়ার্ড সাইদ’ প্রকাশিত হয়, যেখানে সাইদ বলেন যে তিনি সাহিত্য ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট না করে পড়তে পারেন না। গ্রিনব্ল্যাটও মনে করেন যে সাহিত্যপাঠ তার পরিপার্শ্ব পাঠ করা ছাড়া সম্পূর্ণ হয় না। (বস্তুত এই ধারণাটি বহুল প্রচলিত প্রাচীন কাল থেকেই যে, সাহিত্য মানবসমাজের অন্যান্য শাখা থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়, কিন্তু গ্রিনব্ল্যাট এই ধারণাটির প্রত্যক্ষ রূপ দিলেন।) গ্রিনব্ল্যাটের সাহিত্যপাঠের সঙ্গে জ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রের সংযোগের বিষয়টি বোঝার জন্য আমরা গ্রিনব্ল্যাটের চারটি প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেব, তা হলে পরিষ্কার হবে গ্রিনব্ল্যাটের প্রেক্ষাপটে কীভাবে মার্ক্স এবং ফুকোর বস্তুবাদিতা ঢুকে পড়েছে।

প্রথম প্রবন্ধটি সেল্ফ ফ্যাশনিং-এর শেষ প্রবন্ধ শেক্সপিয়ারের নাটক ওথেলো-র ওপর। শিরোনাম : ‘দ্য ইম্প্রোভাইজেশন অব পাওয়ার,’ দ্বিতীয় আর তৃতীয় প্রবন্ধ নিলাম শেক্সপিয়ারিয়ান নেগোশিয়েশনস থেকে। শিরোনাম যথাক্রমে ‘ইনভিজিবল বুলেটস’ আর ‘শেক্সপিয়ার অ্যান্ড দ্য ইগজরসিস্টস,’ আর চতুর্থ প্রবন্ধটি হচ্ছে এইচ আরাম ভিসার সম্পাদিত ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত দ্য নিউ হিস্ট্রিসিজম গ্রন্থটি যেখানে গ্রিনব্ল্যাট ‘টুয়ার্ডস আ পোয়েটিকস অব কালচার’ শীর্ষক প্রবন্ধে ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত নিউ ক্রিটিক জন ডোভার উইলসন কর্তৃক সম্পাদিত কিং রিচার্ড টু-র ভূমিকা-প্রবন্ধটির তীক্ষè সমালোচনা করেন।

‘ইনভিজিবল বুলেটস’-এ তিনি ১৫৯৩ সালে ঘটিত রিচার্ড বেইনস নামক একজন গোপন সংবাদদাতার উল্লেখ করে বললেন যে, তিনি নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লো সম্পকে অভিযোগ করলেন যে মার্লো যীশু খ্রিস্টকে জাগলার বা লম্পট বলেছেন, এবং বলেছেন যে যীশু খ্রিস্ট যে মির‌্যাকল দেখিয়েছেন তার চেয়ে ভালো যাদু হ্যারিয়ট দেখিয়েছেন। গ্রিনব্ল্যাটের চিন্তার বিস্তৃতিটি এবার দেখি। তিনি বলছেন, বেইনস যে হ্যারিয়টের উল্লেখ করেছেন, তিনি হচ্ছেন টমাস হ্যারিয়ট, যিনি ছিলেন একজন অঙ্কশাস্ত্রবিদ, অভিযাত্রিক এবং জ্যোর্তিবিজ্ঞানী। ১৫৮৮ সালে আ ব্রিফ অ্যান্ড ট্রু রিপোর্ট অব দ্য নিউ ফাউন্ড ল্যান্ড অব ভার্জিনিয়া প্রতিবেদনটিতে হ্যারিয়ট লিখেছেন যে আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের বশে রাখতে তাঁরা নানা কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন, যেগুলি ছিল গ্রিনব্ল্যাটের ভাষায় ম্যাকিয়াভেলিয়ান কূটকৌশল। গ্রিনব্ল্যাট তাঁর বর্ণনায় কলম্বাসের ১৫০৪ সালের চতুর্থবার আমেরিকা সফর নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। কলম্বাস জ্যামাইকাতে পৌঁছালে দ্বীপবাসী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা তাঁর দ্বীপে অবস্থান করার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়লে তাঁকে এবং তাঁর নাবিকদেরকে খাবার সরবরবাহ করতে অস্বীকার করে। (কলম্বাস কখনও উত্তর আমেরিকার মূল ভূমিতে নামেননি। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জগুলিতে তাঁর ভ্রমণ সীমাবদ্ধ ছিল। অবশ্য তাঁর তৃতীয়বার সফরের (১৫৯৮) সময় তিনি দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার মূলভূমিতে পা রেখেছিলেন।) তখন কলম্বাস পঞ্জিকা ঘেঁটে দেখেন যে কয়েক দিন পরে পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ হবে। তাই তিনি দ্বীপবাসীদের দলনেতাকে ডেকে বললেন যে তোমরা যদি আমাদেরকে শস্য না দাও কয়েক দিন পরে ঈশ্বর আকাশে একটি অসন্তুষ্টির চিহ্ন দেখাবে। বস্তুত চন্দ্রগ্রহণ হলো। দ্বীপবাসীরা ভয় তো পেলোই, তারা কলম্বাসকে ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ মনে করে খাবার সরবরাহ করল। কলম্বাসের এই ম্যাকিয়াভেল্লিয়ান আচরণকে গ্রিনব্ল্যাট বললেন, সাবভার্সন, অর্থাৎ একটি ঐশ্বরিক প্রভা দেখিয়ে বৈষয়িক কাজ (এখানে অভিযাত্রীদের জন্য খাবার) উদ্ধার করা। এই ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে দানা সংগ্রহ করে গ্রিনব্ল্যাট নামলেন শেক্সপিয়ারের হেনরি দ্য ফোর্থ পার্ট ওয়ান ও পার্ট টু আলোচনায়। সেখানে যুবরাজ হেনরি বা হাল, যিনি হবেন ইংল্যান্ডের ভবিষ্যৎ রাজা পঞ্চম হেনরি, তিনি প্রথম জীবনে খুব উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন করতে লাগলেন। তাঁর পিতা রাজা হেনরি দ্য ফোর্থও যুবরাজের এই আচরণ নিয়ে খুব বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। যুবরাজ হাল ফলস্টাফ নামক একজন ভাঁড়ের সঙ্গে মেশেন, গণিকালয়ে যান, তীর্থযাত্রীদের মালামাল লুণ্ঠন করে সকল রকম অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুবরাজ হাল তাঁর চালচলন নিয়ে তাঁর পিতাসহ অন্যদের দুশ্চিন্তা লক্ষ করে একটি স্বগতোক্তির মাধ্যমে বললেন, তাঁর এই উল্টাপাল্টা জীবন নিছক লোক দেখানোর জন্য, এবং উদ্দেশ্য হলো নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা অনুধাবন করা, যাতে তিনি যেদিন রাজা হবেন সেদিন তিনি অত্যন্ত প্রাজ্ঞ রাজা হতে পারেন। এবং যেদিন তিনি রাজা হন, সেদিন তিনি তাঁর পূর্বের সখা ফলস্টাফ এবং অন্যদের মুখের ওপরে বলেন, ‘আই নো দি নট ঔল্ড মেন।’ (৫. ৫. ৪৭) অর্থাৎ, হে বৃদ্ধ অনাচার, আমি তোমাদেরকে চিনি না।

এই আখ্যানটির প্রসঙ্গ টেনে গ্রিনব্ল্যাট প্রমাণ করলেন যে ক্ষমতায় থাকার মধ্যে একটি কার্যকর অংশ হচ্ছে সাবর্ভাসন বা নীতি-নৈতিকতার ব্যত্যয় ঘটানো। যুবরাজ হাল যেমন ফলস্টাফ এবং তাঁর দলবলের সঙ্গে কেবল বন্ধুত্বের ছলনা করেছিলেন, কিন্তু প্রকৃত বন্ধুত্ব করেননি। এই ছলনার প্রসঙ্গে গ্রিনব্ল্যাটের অন্যতম চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধ ‘দ্য ইমপ্রোভাইজেশন অব পাওয়ার’-এ ওথেলোর সংকট সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন, ইয়াগো নিজেকে ওথেলোর কাছে সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে দাঁড় করান। ওথেলো তাঁকে একাধিকবার ‘অনেস্ট ইয়াগো’ (১. ৩. ২৯৬ এবং অন্যত্র) হিসেবে সম্বোধন করেন। কিন্তু ইয়াগোর মনে বিষ ছাড়া কিছু নাই। একে তো ওথেলো তাঁকে পদোন্নয়ন না দিয়ে দিয়েছেন তাঁর জুনিয়ার অফিসার ক্যাসিওকে, দ্বিতীয়ত ওথেলো শ্বেতাঙ্গ রমণী ডেসডেমোনাকে বিয়ে করার পর শুধু ডেসডেমোনার বাবা ব্রাবানশিওর যে চক্ষুশূল হয়েছেন তা নয়, তিনি ইয়াগোর মতো সাধারণ ভেনিসবাসীরও বিরাগভাজন হয়েছেন। তখন ইয়াগো সিদ্ধান্ত নেয় যে ওথেলো আর ডেসডেমোনার এই অসম বিয়েটা ভাঙতে হবে। গ্রিনব্ল্যাট বলছেন যে এখানে ইয়াগো যে পন্থাটা প্রয়োগ করলেন, এটা শুধু যে ইয়াগোর ব্যক্তিগত পন্থা তা নয়, বরঞ্চ ষোড়শ শতাব্দী থেকে ইউরোপের দেশগুলো যে পৃথিবীর চারদিকে অভিযানে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং বিদেশি বন্দর, পোতাশ্রয়, এমনকি দেশ দখল করে একের পর এক উপনিবেশ স্থাপন করল তার মূলে হলো ইয়াগো ওথেলোর ওপর যে কৌশলটি প্রয়োগ করল তারই সম্প্রসারিত রূপ।

সেটি কী ? ইয়াগো এখানে ওথেলোর সঙ্গে ডেসডেমোনার বিয়ের মধ্যে যে কয়টি বৈষম্য চাপা পড়ে গেছিল সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করল। বলল যে, ওথেলো হচ্ছে কৃষ্ণকায় মুর আর ডেসডেমোনা তরুণী শ্বেতাঙ্গিনী, দ্বিতীয়ত ওথেলো প্রৌঢ়, কিন্তু ডেসডেমোনা একান্তই কৈশোর পেরুনো একটি মেয়ে। তৃতীয়ত, ডেসডেমোনা হচ্ছে ইউরোপের তৎকালীন প্রধান মেট্রোপলিটান নগরী ভেনিসের নাগরিক, আর ওথেলো এসেছেন উত্তর আফ্রিকার একটি অধিকতর পশ্চাৎবর্তী সভ্যতা থেকে। এই সব পার্থক্যের কারণে এটাই স্বাভাবিক যে ডেসডেমোনার যখন মোহ কেটে যাবে, তখন সে ওথেলোর ওপর বিরক্ত হয়ে দ্বিতীয় বাছাই বা সেকেন্ড চয়েজের দিকে যাবে। সাংস্কৃতিক বৈষম্যকে প্রাধান্য দিয়ে ইয়াগো ওথেলোকে আরও বোঝাল যে সে হচ্ছে ভেনিসের লোক, কিন্তু ওথেলো বাইরের লোক। ওথেলোর ভেনিসের মেয়েদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই। তারা ঈশ্বরকে ভয় পায় না, কিন্তু স্বামীকে ভয় পায়। তাই স্বামীর আড়ালে তারা সমস্ত আদিরসাত্মক অপকর্ম ঘটায়, স্বামী জানতেও পারে না। এইভাবে ওথেলোর মনে তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে ইয়াগো সন্দেহের বীজ ঢুকিয়ে দেয়। ইয়াগো এখানে থেমে থাকে না, ওথেলোর দেওয়া উপহার রুমালটি দিয়ে সে শয়তানির মাধ্যমে ওথেলোর মনে স্পষ্ট সন্দেহ ঢোকায় যে ওথেলোর ডেসডেমোনাকে দেওয়া রুমালটা যেহেতু ক্যাসিওর কাছে পাওয়া গেছে, তার অর্থ হচ্ছে ক্যাসিও আর ডেসডেমোনার মধ্যে নিশ্চয়ই ব্যাভিচার চলছে, আর ওথেলো হয়ে পড়েছে কাকল্ড, যে স্বামীর স্ত্রী অসতী থাকে। গ্রিনব্ল্যাট ইয়াগোর এই কৌশলটির নাম দিয়েছেন ইমপ্রোভাইজেশন―বা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা, বা রোগ বুঝে ঔষধ দেওয়া। ইয়াগো যেহেতু ঔপনিবেশিক শক্তির একজন প্রতিভু, তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এই ধরনের একটি কথা ওথেলোকে বোঝানো যে পুরানো কিছু ধর্মীয় টীকায় আছে যে স্বামী-স্ত্রীও যদি অতিরিক্ত রতিক্রিয়া করে সেটিও এডালটেরি বা অনৈতিক যৌনতার ব্যবহারের মধ্যে পড়ে। গ্রিনব্ল্যাটের এই তত্ত্বটি যদি আমরা ব্রিটিশ ভারতের যুগে ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শক্তি কীভাবে নানা ইমপ্রোভাইজেশনাল পন্থায় ভারতকে দাবিয়ে রেখেছিল সেটি ভাবি, তা হলে আমাদের বলতে হয় হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির প্রবর্তন করাই ছিল ব্রিটিশদের একটি ইমপ্রোভাইজেশনাল চাল। গ্রিনব্ল্যাটের তৃতীয় উদাহরণটি আসছে ‘কিং লিয়ার অ্যান্ড দ্য ইগজরজিস্টস’ শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে। এখানে নাটকটিতে টম ব্যাডলাম (তথা ছদ্মবেশধারী এডগার)-এর ভাষা ও কার্যক্রম লক্ষ করে গ্রিনব্ল্যাট বললেন, শেক্সপিয়ার এখানে ক্যাথলিকদের অনুসৃত কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্টদের দ্বারা পরিত্যাজ্য একটি সামাজিক ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে নাট্যমঞ্চের একটি প্রধান উপকরণের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন। আর সেটি হলো, ইগজরসিজম বা ভূত তাড়ানোর কৌশল। রানি এলিজাবেথের আগে ক্যাথলিক রানি মেরির সময় ইগজরসিজম বা ভূত তাড়ানোর ওঝাগিরির ব্যাপক প্রচলন ছিল। কিন্তু ব্যবহারটা মূলত ছিল লোক-ঠকানোর একটি আদি কৌশল। ওঝারা নানা কৌশলে ভূতে পাওয়া লোকের ওপর থেকে ভূত ঝাড়তে যে কৌশলগুলো নিতেন তার প্রধান উপকরণ ছিল ভূত তাড়ানোর কৌশল দেখতে আসা উপস্থিত জনগণের মধ্যে ভূতে পাওয়া লোকটাকে ভূত ছেড়ে যাচ্ছে কি না, বা কখন যাবে, এই পুরো প্রক্রিয়াটাতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাদেরকে ধরে রাখা। কিন্তু বস্তুত এটা ছিল লোক-ঠকানোর একটা তরিকা। কিন্তু ভিড় করা লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন শেষ পর্যন্ত পরিণতি দেখতে। এই ইগজরসিজম যে নেহায়েত লোক ঠকানোর একটা ব্যবসায় সেটি উন্মোচন করে ১৬০৩ সালে স্যামুয়েল হার্সনেট একটি তীব্র  সমালোচনামূলক বই লিখলেন, আ ডিক্লেয়ারেশন অব এগ্রেজিয়াস পোপিস ইম্পোশ্চারস। গ্রিনব্লাটের ধারণা শেক্সপিয়ার নিশ্চয়ই এ বইটি পড়ে থাকতে পারেন, কারণ টম ও ব্যাডলামের মুখে দেওয়া খিস্তিগুলি সরাসরি হার্সনেটের বই থেকে নেওয়া। তখন গ্রিনব্ল্যাট যে বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত দিলেন সেটি হলো ইগজরসিজমের মধ্যে লোকের সাসপেন্স বা আগ্রহ ধরে রাখার যে কৌশল সেটি এলিজাবেথীয় যুগের নাট্যকারেরা মঞ্চের প্রতি দর্শক ধরে রাখার অন্যতম কৌশল হিসেবে গ্রহণ করলেন। হার্সনেটের বইয়ের প্রভাবে বা এমনিতেই একটি ক্যাথলিক প্র্যাকটিস জনজীবন থেকে উঠে গেলেও সেটি চালান হয়ে গেল নাট্যমঞ্চে। গ্রিনব্ল্যাটের চতুর্থ প্রবন্ধটি হচ্ছে, ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত শেক্সপিয়ারের ঐতিহাসিক নাটক কিং রিচার্ড টু নিয়ে। নামকরা নিউ ক্রিটিক জন ডোভার উইলসন এটি শুধু সম্পাদনাই করলেন না, তার সুদীর্ঘ ভূমিকায় লিখলেন যে রিচার্ড টু-তে যুবরাজ বোলিংব্রুকের হাতে রিচার্ড টু-র ক্ষমতাচ্যুতির বিষয়টি থাকলেও এটি নিয়ে রানি এলিজাবেথের মনে তেমন উদ্বেগ ছিল না। কিন্তু গ্রিনব্ল্যাট উইলসনের এই মতকে নিতান্তই নিউ ক্রিটিসিজমের ত্রুটি হিসেবে দেখলেন, এবং ইতিহাস ঘেঁটে কয়েকটি উপাত্ত বের করে প্রমাণ করলেন যে রানি এলিজাবেথ তাঁর প্রায় দুশ বছর আগের একজন বৈধ নৃপতির ক্ষমতাচ্যুত হওয়াটা মোটেও সহজভাবে নেননি, বরঞ্চ তাঁর গ্রন্থাগারিক উইলিয়াম ল্যাম্বার্ডের কাছে তিনি ১৬০১ সালের ৪ আগস্ট বলেন যে ‘আই অ্যাম রিচার্ড টু, নো ইউ নট দ্যাট।’ তবে ল্যাম্বার্ডের কাছে রানি এলিজাবেথ এই উক্তিটি করেছিলেন কি না এটার সঠিক তথ্য আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অবশ্য গ্রিনব্ল্যাট বলছেন যে রানি এটা নিয়েও উদ্বিগ্ন ছিলেন যে মানুষের ঘরে ঘরে এ নাটকটি ৪০ বার অভিনীত হয়েছিল। আসলে নাটকটিতে রাজা রিচার্ড টু-র ক্ষমতাচ্যুতির দৃশ্যটি (৪. ১.) ১৬০৮ পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। রানি এলিজাবেথ আজীবন অবিবাহিতা ছিলেন। ফলে তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়ে তাঁর মধ্যে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। বিশেষ করে ১৬০১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রানির একান্ত আস্থাভাজন অমাত্য আর্ল অব এসেক্স বিদ্রোহ করে রানির পতন ঘটাতে চাইলে, জানা যায় তার আগের দিন শেক্সপিয়ারের নাট্যদল লর্ড চেম্বারলেইনস মেনকে এসেক্সের একজন সমর্থক স্যার গেলি মেরিক ৪০ শিলিং দেন ৭ ফেব্রয়ারি নাটকটি মঞ্চায়ন করার জন্য ক্ষমতাচ্যুতির দৃশ্যটিসহ। যা হোক, এসেক্সের বিপ্লব ব্যর্থ হয়, এবং তাঁর শিরñেদ করা হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৬০১, এবং মেরিকের শিরñেদ করা হয় মার্চ ১৩, ১৬০১। কাজেই গ্রিনব্ল্যাট বললেন যে জন ডোভার উইলসনের পাঠটি ছিল নিতান্তই অনৈতিহাসিক।

গ্রিনব্ল্যাটের সমালোচনার ধারা সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বলেছি এ জন্য যে যদিও তিনি সাহিত্যপাঠের সঙ্গে ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি পাঠ করে একটি সম্পূর্ণ প্যাকেজ দিতে চেষ্টা করেন, কিন্তু তাঁর মূল লক্ষ্যটা হচ্ছে সমালোচনাতত্ত্বকে বৈষয়িক বা বস্তুগত বিষয়াদির সঙ্গে পাঠ করে বিবেচনা করা। এ কারণেই যে কোনও বস্তুবাদী শেক্সপিয়ার পাঠে গ্রিনব্ল্যাটের প্রসঙ্গ আসা যৌক্তিক।

অর্থনীতিক সম্পৃক্তি নিয়ে রচিত কয়েকটি নাটকের আলোচনা

এরপর আমরা এই লেখার শেষ পর্যায়ে আসছি। আমরা এ ক্ষেত্রে কিছু নাটক এবং সনেট যেগুলিতে সরাসরি অর্থনৈতিক ভাষা ও থিম আছে, সেগুলির একটি নাতিদীর্ঘ আলোচনা করব।

শেক্সপিয়ারের প্রথম দিককার নাটক, রাজা জন (১৫৯০-৯৫)। সেখানে বাস্টার্ড নামক চরিত্রটি একটি বিখ্যাত স্পিচ দেয়, যার গোড়ার কথা হলো সমাজ চলে লেনদেনের ভারসাম্যে। তিনি স্পষ্টত ‘কমোডিটি,’ যেটার অর্থনৈতিক অর্থ হলো পণ্য, সেটিকে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন মানুষের সকল সম্পর্ক তৈরি হয় কমোডিটির প্রতি পক্ষপাত থেকে। তাঁর ৩৮ লাইনের এ বক্তৃতায় তিনি ছয়বার ‘কমোডিটি’ শব্দটি উচ্চারণ করে বলছেন, দুনিয়া চলে স্বার্থ নিয়ে যেটিকে তিনি ‘বায়াস’ বলছেন। আমরা আগে আলোচনা করেছি কীভাবে ১৬০৯ সালের নাটকে টাইমন স্বর্ণকে সকল নষ্টের গোড়া হিসেবে দেখেছিলেন, ঠিক সেরকম স্বার্থ বা কমোডিটিকে বাস্টার্ড বলছেন, ‘দিস বন্ড, দিস ব্রোকার, দিস অল-চেঞ্জিং ওয়র্ড।’ (২.২.৫৮৩), এই বেশ্যা, এই দালাল, এই সব পরিবর্তনকারী শব্দ। 

কিং জন-এর একটু আগে লেখা কমেডি অব এররস (১৫৮৯-১৫৯৪) পুরোটাই বণিক সম্প্রদায়েরর ওপর রচিত। এই নাটকে বহু ‘ভ্রান্তিবিলাস’ থাকলেও, বাস্টার্ডের ধারণা অনুসারে এখানে কমোডিটির পণ্যরূপ, অর্থাৎ একটি সোনার হার হয়ে দাঁড়ায় যত বিপত্তির কারণ, প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঘর ভাঙ্গার মতো অবস্থায় পড়ে যায় এক জোড়া জমজ ভ্রাতা, যাদের নাম অ্যান্টিফোলাস। একজন সাইরাকিউজের অ্যান্টিফোলাস, আরেকজন এফিসাসের অ্যান্টিফোলাস। তাদের আবার দুই যমজ ভৃত্য একজন সাইরাকিউসের গ্রোমিও, আরেকজন এফিসাসের গ্রোমিও। দুই জোড়া জমজ ভাইয়ের চেহারা হুবহু এক হওয়াতে তাদেরকে বিপদে পড়তে হয়। বউকে খুশি করার জন্য অ্যাঞ্জেলো নামক এক স্বর্ণকারকে এফিসাসের অ্যান্টিফোলাস বাকিতে একটি স্বর্ণের হার বানাতে দেয়। অ্যাঞ্জেলো সেটা ভুল করে চেহারার সাদৃশ্য থাকাতে সাইরাকিউজের অ্যান্টিফোলাসকে দিতে আসে এবং বকেয়া টাকা দাবি করে। এইভাবে চমৎকার সব খিচুড়ি হবার পর আমাদের উদ্দিষ্ট অর্থনৈতিক সম্পৃক্তি এই অর্থে ফুটে ওঠে যে অ্যাঞ্জেলোর চোখে অ্যান্টিফোলাস অব এফিসাস (যদিও সে আসলে ছিল সাইরাকিউজের অ্যান্টিফোলাস) চুক্তির পণ ভঙ্গ করেছে। ক্রেইগ মালড্রু পূর্বে উল্লেখিত বই দ্য ইকোনোমি অব অব্লিগেশন-এ জানাচ্ছেন যে রেনেসাঁ যুগে ইংলান্ডে বকেয়াতে কাজ করা হতো জানাশোনা লোকের মধ্যে (পৃ. ৪-৫)―যেখানে ট্রাস্ট বা আস্থাটা ছিল বড়। বাজার অর্থনীতির আগমনের ফলে এটা ফিকে হয়ে আসে, এবং আস্থার জায়গায় সংকট তৈরি হয়।

এই চুক্তিভঙ্গের এ বিষয়টি সবচেয়ে নিদারুণভাবে নাট্যায়িত হয় ১৫৯৬ সালে রচিত শেক্সপিয়ারের অত্যন্ত বিখ্যাত ট্র্যাজি-কমেডি দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস-এ, যেখানে ইহুদি সুদখোর ব্যবসায়ী শাইলক খ্রিশ্চান ব্যবসায়ী অ্যান্টোনিওর বক্ষ থেকে এক পাউন্ড মাংস দাবি করে, যেহেতু চুক্তি অনুযায়ী অ্যান্টোনিও তিন মাসের মধ্যে তাঁর দেনা ৩ হাজার ডাকাট বা স্বর্ণমুদ্রা ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়। অ্যান্টোনিওকে বাসানিওর জন্য শাইলক টাকা ধার দিলেও তার দুটো ব্যাপারে খুব ক্ষোভ ছিল। একটি হলো, অ্যান্টোনিও ব্যবসা করত বিনা সুদে, আর দ্বিতীয়টি ছিল তখনকার ভেনিসের জীবনরীতি অনুযায়ী খ্রিশ্চানেরা ইহুদিদের নানাভাবে অপদস্থ করত। ফলে শাইলক এই প্রতিহিংসা পালনের সুযোগটা নেবেই নেবে। সে আদালতে ঢুকেই বলল, ‘আইল হ্যাভ মাই বন্ড, স্পিক নট এগেইনস্ট মাই বন্ড’ (৩.৩.৪)। ভেনিসের ডিউক শাইলককে বোঝালেন অ্যান্টোনিওকে দয়া করতে। আর পোর্শিয়া উকিল বালথাসারের ছদ্মবেশে খ্রিশ্চান ধর্ম অনুযায়ী দয়া বা মার্সির মাহাত্ম্য বুঝিয়ে শাইলককে বলল, মার্সি হলো বৃষ্টির মতো স্বর্গ থেকে সবার জন্য সমানভাবে বর্ষিত হয়, এবং কোনও শর্ত ছাড়া। তখন শাইলককে বাসানিও কর্জের তিন গুণ টাকা অফার করলেও সে নেবে না। কারণ, সে অ্যান্টোনিওর পার্সকে (টাকা) নয়, অ্যান্টোনিওর পার্সনকে (শরীরকে) টার্গেট করেছে। মার্ক শেলসহ বিভিন্ন সমালোচক এই পর্যায়ে মন্তব্য করেছেন, যে শাইলক টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না, সে শাইলক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে টাকাটাই অস্বীকার করছে। পিটার এফ গ্রাভ বলছেন, শাইলকের মধ্যে টাকার ক্ষতিপূরণ নেওয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা (পৃ. ৮৫)। অবশ্য শাইলকের এই নির্মোহ বেশিক্ষণ টেকে না, কারণ পোর্শিয়া যখন সে বিখ্যাত আইনি যুক্তিটা দেয় যে, ভেনিসের আদালত শাইলক একজন ভিন-নাগরিক হলেও তাকে আইনের সম্পূর্ণ সুবিধা দিতে বাধ্য, সে জন্য শাইলক চুক্তির লিখিত শর্ত অনুযায়ী অবশ্যই অ্যান্টোনিওর বক্ষ থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে পারবে, কিন্তু এক বিন্দু রক্তপাত ঘটাতে পারবে না, যেহেতু চুক্তিতে রক্তপাতের উল্লেখ নেই : ‘দিস বন্ড হিয়ার গিভ দি হিয়ার নো জট অব ব্লাড, / দ্য ওয়র্ডস এক্সপ্রেসলি আর ‘আ পাউন্ড অব ফ্লেশ’ (৪.১.৩০৪-৩০৫)। শাইলক তখন পরাজয় মেনে বলে যে ঠিক আছে তাকে যেন মূলের তিন গুণ টাকাই দেওয়া হয়। কিন্তু শাইলক যেহেতু খ্রিশ্চানের রক্তপাত ঘটাতে চেয়েছে, সেহেতু তাঁর প্রাণ নেওয়া হবে যদি না ডিউক তাকে ক্ষমা করেন। এ জায়গায় আলেসান্দ্রো মারজালার একটি মন্তব্য যুক্ত করতে চাই। তিনি ‘পিটি সাইলেন্সড : ইকোনোমিজ অব মার্সি ইন দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলছেন যে এমনকি পোর্শিয়ার মার্সি বক্তৃতাটাও বিনিময়ের সূত্র ধরে নির্মিত। ভিনধর্মী শাইলক যদি আশ্বস্ত হয় ক্রিশ্চিয়ান মার্সিতে, তা হলে বিনিময়ে একজন ক্রিশ্চিয়ানের প্রাণ বেঁচে যায়। (হোল্ডারনেস, পৃ. ৭৪)।

যদিও পোর্শিয়ার যুক্তিটি আসলে আইনের চাতুরি ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু প্রাক-পুঁজিবাদী টেক্সট হিসেবে নাটকটিতে অর্থনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয়টি ফুটে উঠেেেছ। প্রতীকী অর্থে সেটি হলো পণ্যের ইউজ ভ্যালুকে পরিহার করে পণ্যের বিনিময়মূল্য বা এক্সচেঞ্জ রেইট ঠিক করে দিচ্ছে যে টাকার বিনিময়ে মানুষের কলজেও কেনা যায়। ডেভিড হকস তাঁর প্রবন্ধ ‘শেক্সপিয়ার অ্যান্ড ডিরাইভেটিভস’-এ জানাচ্ছেন যে কার্ল মার্ক্স তাঁর রচনাবলির বিভিন্ন জায়গায় শাইলককে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রতিভূ বলেছেন  (হোল্ডারনেস, পৃ. ১৮)।

পূর্বে উল্লেখ করেছি অ্যারিস্টোটলের সুদের প্রতি অনীহার কথা। তাঁর গ্রন্থ পলিটিক্স-এ সুদ ব্যবসার বিরুদ্ধে বলেছেন। পণ্য বিনা টাকাপয়সার লেনদেনকে তিনি বলতেন টাকার বাচ্চা দেওয়া : ‘কারেন্সি, দ্য সান অব কারেন্সি’ (উডব্রিজ, এরিক স্পেন্সার, ‘টেকিং একসেস, একসিডিং একাউন্ট: অ্যারিস্টোটল মিটস দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস’ (পৃ. ১৪৮।)) এই ধারণা থেকে অ্যান্টোনিও যখন শাইলককে সুদের ব্যাপারে তিরস্কার করে বলে যে, সে যে লাবানের ভেড়ার গল্প করছে, সে ভেড়ার জন্মের পেছনে তো প্রকৃতি তথা সৃষ্টিকর্তার হাত আছে : ‘ওয়াজ দিস ইনসার্টেড টু মেইক ইন্টারেস্ট গুড ? / অর ইজ ইয়োর গোল্ড অ্যান্ড সিলভার ইউজ অ্যান্ড র‌্যামস ?’ (১. ৩. ৯২-৯৩)। অর্থাৎ, ভেড়ার বাচ্চা তো সুদের টাকার মতো জন্মায় না। উত্তরে শাইলক বলে, ‘আই ক্যাননট টেল, আই মেইক ইট ব্রিড অ্যাজ ফাস্ট’ (১. ৩. ৯৪)। অর্থাৎ শাইলক মার্ক্সের ভাষায় ‘ক্যাপিট্যালিস্ট ইনকারনেট’ হিসেবে বলতে চায় ভেড়াগুলি কীভাবে জন্মাচ্ছে সেটা নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই, তার প্রবৃদ্ধি বাড়লেই হলো। এই অর্থে শাইলক টাকা কীভাবে আসছে, সুদ থেকে নাকি সুস্থ ব্যবসা থেকে সেটাকে আমলে আনছে না, অন্যদিকে একজন খ্রিশ্চান হিসেবে অ্যান্টোনিও তার ব্যবসায়নীতিতে একটি নৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে চায়। এখানে আইরনি হলো, যে অ্যান্টোনিও সুদকে ঘৃণা করে, সে অ্যান্টোনিওকে সুদের ব্যবসায়ী শাইলক থেকে টাকা ধার নিতে হচ্ছে। 

শেক্সপিয়ারের আরেকটি সমুদ্র-পারাপার সংক্রান্ত নাটক হলো টুয়েলফথ নাইট (১৬০১) যেখানে ম্যালভোলিওর পরিচ্ছেদের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এভাবে এসেছে যে ম্যালভোলিও মনে করছে যে আকর্ষণীয় পোশাক পরে সে কাউন্টেস অলিভিয়ার মন জয় করতে পারবে। ভ্যালেরি ফোরম্যান তাঁর ‘ম্যাটেরিয়াল ডিসপজেসনস অ্যান্ড কাউন্টারফিট ইনভেস্টমেন্টস : দ্য ইকোনোমিস অব টুয়েলফথ নাইট’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলছেন যে, এই কাপড় কিনতে ম্যালভোলিওকে যে টাকা পুঁজি করতে হয়েছে, তার শব্দগত ব্যুৎপত্তি হচ্ছে ‘ভেস্ট’ (পোশাক) থেকে ইনভেস্টমেন্ট (পুঁজি), এবং খানিকটা ইতিহাস টেনে তিনি এই তথ্য দিচ্ছেন যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকদের চিঠির আদান-প্রদান থেকে প্রথমে ‘টু ইনভেস্ট’ বা ‘ইনভেস্টমেন্ট’ শব্দগুলি আহৃত হয়। অর্থাৎ, ইংল্যান্ডের বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের প্রধান উপকরণ ছিল বস্ত্র, তারই একটি আলামত টুয়েলফথ নাইট-এ প্রকৃষ্ট হয়। এবং ম্যালভোলিও যখন মারিয়ার চক্রান্তে পড়ে কাউন্টেস অলিভিয়ার অভিপ্রায় অনুযায়ী চড়া হলুদ রঙের চাদর পরে নিজেকে ভাঁড় হিসেবে প্রকাশ করে, তার অর্থনৈতিক গুরুত্বটা হচ্ছে টাকা দিয়ে কাপড় কিনে মানুষ নিজের স্বরূপকে বদলাতে পারে, অর্থাৎ টাইমন যা বলেছেন, এবং মার্ক্স যেটাকে সমর্থন করেছেন সেটা হলো টাকা মানুষের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে।

শেক্সপিয়ারের আরেকটি নাটকে অর্থনৈতিক বিনিময় প্রথার অসরাসরি ইঙ্গিত আছে। মেজার ফর মেজার (১৬০৩)-এ ইসাবেলার একটি উচ্চারণ খুবই মারাত্মক। সে একটি স্বগতোক্তিতে বলে : ‘মোর দ্যান আওয়ার ব্রাদার ইজ আওয়ার চেসটিটি’ (২. ৪. ১৮৪), বোনদের সতীত্ব ভাইদের জীবনের চেয়ে বড়। দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস-এ যেমন শাইলক অ্যান্টোনিওর কলজের সঙ্গে তিন হাজার স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়মূল্য নির্ধারণ করেছিল, তেমনি মেজার ফর মেজার-এ ভণ্ড প্রশাসক অ্যাঞ্জেলো ক্লডিওর জীবনের সঙ্গে তার বোন ইসাবেলার সতীত্বের তুল্যমূল্য করে ফেলেছিল। অ্যাঞ্জোলো যখন ইসাবেলাকে এই গুরুতর প্রস্তাব দেয় যে সে যদি তার সতীত্ব তার কাছে সঁপে দেয় তাহলে তার ভাই ক্লডিওর প্রাণ রক্ষা পাবে, তখন বুঝতে পারি মার্ক্স যে অর্থে রেইফিকেশনের কথা বলেছিলেন সে অর্থে অ্যাঞ্জোলোর চোখে নারীর সতীত্ব কিংবা মানুষের জীবন পণ্যসামগ্রীর পর্যায়ে নেমে বিনিময়মূল্য নির্ধারিত হবার পর্যায়ে পড়েছে। এর কিছু আগে রচিত নাটক ট্রয়লাস অ্যান্ড ক্রেসিদা (১৬০০-১৬০৩) এতটাই বিনিময়প্রথার সঙ্গে জড়িত যে সামান্য উল্লেখ না করলে নয়। এই নাটকে ক্রেসিদাকে নারীর অবস্থান থেকে অবচয়িত করে একেবারে গ্রিক আর ট্রোজানদের মধ্যে বিনিময় পণ্য হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। অন্যদিকে হেলেনকে একটি  লাভ-ক্ষতির বিচেনায় রেখে ট্রোজান ক্যাম্পে বিতর্ক চলছে তাকে ধরে রাখা ঠিক হবে কি না। হেক্টর বলেন, হেলেন ‘আ থিং নট আওয়ার্স, নর ওয়ার্থ টু আস’ (২. ২. ২১)। হেক্টর হেলেনের মানবিক পরিচয় অবজ্ঞা করে তাকে থিং বা জিনিস বা পণ্য বলছে। ট্রয়লাস বলছে, হেলেন হলো দুটোই : ‘… আ পার্ল / হুজ প্রাইস হাথ লঞ্চট আ থাউজ্যান্ড শিপস’ (২. ২. ৮০-১), এবং হেলেন হলো একটি মূল্যবান উপহার : ‘আ ওয়ার্দি প্রাইজ’ (২. ২. ৮৫)।      

ধনসম্পদের সঙ্গে রোম্যান্টিক প্রেমের একটি নিকট আত্মীয়তা শেক্সপিয়ারের প্রায় সকল প্রেমসংক্রান্ত নাটকে পাওয়া যায়। দ্য টেইমিং অব দ্য শ্রু-র (১৫৯৩-৯৪) পেট্রুকিও ঘোষণা দিচ্ছে : ‘আই কাম টু ওয়াইভ ইট ওয়েলদিলি ইন পাদুয়া’ (১.২.৭৪), অর্থাৎ সে পাদুয়া নগরীতে এসেছে ধনাঢ্য কোনও রমণীকে বিয়ে করার জন্য। বস্তুত শেক্সপিয়ারের যুগে অভিজাত পরিবারের যুবকদের উচ্চাকাক্সক্ষা থাকত ধনী পরিবারে বিয়ে করতে। বলা যায়, বিয়ের মাধ্যমে শুধু শ্বশুরের মেয়েটি নয়, শ্বশুরের সম্পত্তিও জামাতার কাছে চলে যেত। দ্য মার্চেন্ট অব ভেনিস-এ বাসানিও যখন অ্যান্টোনিওর কাছে যায়, তখন আমরা জানতে পারি বাসানিও অভিজাত ঘরের ছেলে হলেও অপরিমিত ব্যয়ের জন্য  অ্যান্টোনিওর কাছে অনেক দেনায় আবদ্ধ। তারপরও তার নতুন কর্জের দরকার কেননা ‘ইন বেলমন্ট ইজ আ লেডি রিচলি লেফট’ (১. ১. ১৬১), বেলমন্ট দ্বীপে একজন ধনাঢ্য মহিলা অপেক্ষমাণ। যদিও বাসানিওর সঙ্গে পোর্শিয়ার সম্পর্কটা একেবারে হৃদয়ভিত্তিক হতে যাবে, কিন্তু বাসানিওর শব্দচয়নে ‘রিচলি’ বা ‘সম্পন্নভাবে’ আমাদেরকে সজাগ করে যে শুধু সামাজিক বিয়েতে নয়, প্রেমের বিয়েতেও সম্পদ বা বিষয়-আশয় সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। যেমন কিং লিয়ার নাটকে লিয়ার যখন কর্ডেলিয়াকে অবাধ্য মেয়ে হিসেবে নির্বাসন দেয়, তখনই রাজদরবারে তার পাণিপ্রার্থী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুজন প্রার্থী : ফ্রান্সের রাজা আর ডিউক অব বার্গান্ডি। রাজা লিয়ার তাঁর কন্যা কর্ডেলিয়াকে নির্বাসন দণ্ড দেবার পর প্রথমে বার্গান্ডিকে বলেন এই নির্বাসিত কন্যাকে তিনি গ্রহণ করবেন কি না। বার্গান্ডি দ্রুত উত্তর দেয় যে যৌতুকের প্রতিজ্ঞা ঠিক থাকলে সে কর্ডেলিয়াকে বিয়ে করবে। লিয়ার বলেন, যৌতুক হিসেবে তাঁর মেয়েকে তাঁর অসন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছু দেবার নেই। তখন বার্গান্ডি বলেন, ‘আই নো নো আনসার’ (১.১.২০২)। অর্থাৎ, যৌতুক ছাড়া তিনি বিয়ে করবেন না। আমরা ওপরে অ্যাঞ্জোলোর পাপাচারি মনের কথা আলোচনা করেছি। মেজার ফর মেজার নাটকের এই শঠ লোকটা আরেকটা দোষে দুষ্ট যে, সে তার বাগদত্তা রমণী মারিয়ানাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেছিল। কারণ মারিয়ানা যৌতুকের শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল। মারিয়ানার ভাই নাবিক ফার্ডিন্যান্ড জাহাজডুবিতে মারা গেলে মারিয়ানা সহায়সম্বলহীন হয়ে পড়ে। কিন্তু অ্যাঞ্জোলোর মধ্যে মারিয়ানার দুরবস্থা বোঝার এই মানবিক বিবেচনাটুকু ছিল না। ওথেলো ডেসডেমোনাকে বিয়ে করার পর ডেসডেমোনার নিজের রূপ ও তার পিতার সম্পদের দিকে ইঙ্গিত করে ইয়াগো একটি বাণিজ্যপোতের চিত্রকল্প ব্যবহার করে। সে ক্যাসিওকে বলে, ‘ফেইথ, হি টুনাইট হাথ বোর্ডেড আ ল্যান্ড ক্যারাক’ (১. ২. ৫০), অর্থাৎ, ওথেলোর ভাগ্য খুলে গেছে, তিনি একটি বিরাট ধনসম্পদ পরিপূর্ণ স্থলজাহাজ অধিকার করেছেন। ইয়াগোর বাণিজ্যিক ভাষা পরবর্তী সময়ে ওথেলোকে ব্যবহার করতে দেখি যখন তিনি ডেসডেমোনাকে তাঁকে হত্যা করার পর অত্যন্ত দামি পাথরের সঙ্গে তুলনা করে বলেন যে, নির্দোষ ডেসডেমানাকে তিনি কখনও সবচেয়ে দামি পাথরের সঙ্গে বিনিময় করতেন না : ‘অফ ওয়ান এনটায়ার অ্যান্ড পারফেক্ট ক্রিসোলিট, / আইড নট হ্যাভ সোল্ড হার ফর ইট’ (৫. ২. ১৪৩-৪৪)। ক্রিসোলিট অত্যন্ত দামি একটা পাথর। ওথেলোর তুলনায় মানুষের সঙ্গে পণ্যের তুলনা আসায় শেক্সপিয়ারের যুগে সাহিত্যের ভাষায় বাণিজ্যিক শব্দাবলির প্রবিষ্টকরণ স্পষ্ট হয়েছে।

দ্য টেম্পেস্ট (১৬১০) এককভাবে রচিত শেক্সপিয়ারের শেষ নাটক। এটির মূল নায়ক প্রসপেরো তাঁর মেয়ে মিরান্ডার জন্য পাত্র খুঁজতে গিয়ে নেপলসের যুবরাজ ফার্ডিন্যান্ডকে উপযুক্ত বিবেচনা করে জাদুর মাধ্যমে তাকে যে দ্বীপে প্রসপেরো তার মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছিলেন সেখানে নিয়ে আসেন। ফার্ডিন্যান্ড এবং মিরান্ডার মধ্যে প্রথম সাক্ষাতে তারা, শেক্সপিয়ারের লাভ কমেডিগুলোর ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ (প্রথম দৃষ্টিতে প্রেমে পড়া) রীতি অনুযায়ী, পরস্পরের প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে প্রসপেরো তাদের সম্পর্কের অবাধ অগ্রসরে বাধ সাধেন। তিনি ফার্ডিন্যান্ডকে কঠিন কিছু কায়িক শ্রমে নিয়োজিত করেন, যেমন কাঠ চেরাই করা। তাঁর উদ্দেশ্য হলো ফার্ডিন্যান্ডকে বুঝতে দেওয়া যে শ্রমের মর্যাদা আছে। কৃচ্ছ্রতা ইত্যাদির প্রয়োজন জীবনে সফল হতে গেলে। এই অর্থে দ্য টেম্পেস্ট-এ আপাত ভালোবাসার কাহিনির তলায় গভীর অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য জড়িত আছে।

শেক্সপিয়ারের সনেটগুলোও অর্থনৈতিক পরিভাষায় স্পৃষ্ট। ম্যানফ্রেড ফিস্টার তাঁর “‘লাভ মার্চেন্ডাইজড’: মানি ইন শেক্সপিয়ারস সনেটস”, বলছেন যে শেক্সপিয়ারের সনেটগুলোতে অর্থনীতি-স্পৃষ্ট শব্দাবলির ছড়াছড়ি। তিনি একটি হিসাব দিয়ে বলছেন, ‘এক (কাউন্ট)’ শব্দটি এসেছে সনেট ৩০, ৫৮, ৬২, ৮৬, ৯০-এ। ‘ব্যাংকরাপ্ট’ (৬৭), ‘অডিট’ (৪, ৪৯, ১২৬), ‘সো প্রাইজ, সো ডিয়ার’ (৪৮), ‘প্রাইজ’ (৮৬), ‘ক্রেডিট’ (১৩৮) নম্বর সনেটগুলোতে। শেক্সপিয়ারের যুগে স্বর্ণমুদ্রাকে অ্যাঞ্জেল বা গুড অ্যাঞ্জেল বলা হতো। অর্থনীতিবিদ গ্রেশামের সূত্র ‘ব্যাড মানি ড্রাইভস গুড মানি আউট অব সার্কুলেশন’ অনুযায়ী সনেট ১৪৪-এ পাচ্ছি এ লাইনটি : ‘মাই ব্যাড মানি ফায়ার মাই গুড মানি আউট’। সনেট ৬ : ‘দ্যাট ইউজ ইজ নট ফরবিডেন ইউজারি / হুইচ হ্যাপিজ দোজ দ্যাট পে দ্য উইলিং লোন’ (৫-৬)। যারা নিজেরাই ঋণ পরিশোধ করতে চায়, তাদের সুদকে সুদ বলা যায় না। ভালোবাসার পণ্যাদিকরণ সম্পর্কে সতর্কতামূলক উচ্চারণ আসছে সনেট ১০২-এ : ‘দ্যাট লাভ ইজ মার্চেন্ডাইজড হুজ রিচ সিমিং / দ্য ওনার্স টাঙ ডাথ পাবলিশ এভরিওয়ের’ (৩-৪)। সনেট ১৩৪ পুরোটাই অর্থনৈতিক লেনদেনের শব্দ দ্বারা আকীর্ণ : ‘মর্গিজড’ (২), ‘ফোরফিট’ (৩), ‘শিওরিটি’ (৭), ‘বন্ড’ (৮), ‘ইউজারার’ (১০), ‘ইউজ’ (১০), ‘ডেটর’ (১১), ‘লুজ’ (১২), এবং ‘পেইজ’ (১৪)।  

এই প্রবন্ধে উপসংহারে এসে বলতে চাই শেক্সপিয়ারের সমগ্র রচনায় অর্থনৈতিক-স্পৃষ্টতা সম্পর্কে যে ধারণা দেবার চেষ্ট করলাম, সেটি হিমবাহের উপরিভাগমাত্র। ক্রমশ বিস্তৃতমান এই তাত্ত্বিক অধ্যয়নটি সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনও আসেনি। তবে এই প্রেক্ষাপটটি পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছি যে শেক্সপিয়ারকে যদিও তাঁর সমসাময়িক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী কবি বেন জনসন ‘হি ওয়াজ নট অফ অ্যান এইজ বাট ফর অল টাইম’ বলে শেক্সপিয়ারের চিরকালীনতার ওপর বড় সনদ দিয়ে গেছেন, এবং গ্রিনব্ল্যাট তাঁর নর্টন শেক্সপিয়ার সিরিজের ভূমিকায় সেটিকে ব্যাখ্যা করেছেন যে অল টাইম বলতে প্রতিটা যুগের নিজস্বতাকে ধরে নিতে হবে, যার অর্থ হচ্ছে শেক্সপিয়ারকে প্রতি যুগে প্রতি সংস্কৃতিতে নতুন নতুনভাবে ব্যাখ্যা করা হবে, সেটিই ‘অল টাইম’। আমরা গ্রিনব্ল্যাটের সঙ্গে দ্বিমত না করে বলব যে হ্যাঁ, শেক্সপিয়ার প্রকৃত অর্থেই প্রাসঙ্গিক, এবং যেহেতু মানুষের জীবন অর্থনৈতিক বিবেচনা ছাড়া চলে না, সেজন্য শেক্সপিয়ার পাঠে এই নতুন অর্থনৈতিক সমালোচনার আঙ্গিক বস্তুতই চিন্তা-পরিপুষ্টকারী একটি আঙ্গিক। আশা করি, বর্তমান প্রবন্ধে আমি এই নতুন তাত্ত্বিক-সমালোচনার মূল থ্রাস্ট বা জিগিরকে তুলে ধরতে পেরেছি।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button