আর্কাইভগল্প

বড় গল্প : ভ্যান গখের কান : রঞ্জনা ব্যানার্জী

শ্যনন

সুইডেনে ফেরার আগের দিন আমার ফ্ল্যাটে এসেছিল শ্যনন। ওর জন্যেই পেইন্টিং দুটো আনিয়েছিলাম চাটগাঁ থেকে। আমি নিজেও এদের নব্বই সনের পরে সেই প্রথম দেখলাম। মাকে এই নিয়ে জিজ্ঞেস করতে বাধছিল। তাছাড়া পেইন্টিংগুলো আদৌ মা রেখেছে কি না তা নিয়েও সন্দেহ ছিল। কিন্তু ফোনে বলতেই মা বলল, ‘আমি তো ভেবেই রেখেছিলাম এবার তোর কাছে যাওয়ার সময় ছবি দুটো নিয়ে যাব। বাড়িতে অনেক কিছুই আজ  অপ্রয়োজনীয়। বাঁধাই করে রাখিস। তোর দেয়ালে মানাবেও ভালো’। আমি খানিক দোনোমনা করে শ্যননের সন্দেহের কথাটা মাকে বলেই ফেললাম। মা শুনে অবাক, ‘তাই!’ দুই দিন পরে মা নিজেই ফোন দিয়ে জানাল, শ্যননের কথাই ঠিক―দ্বিতীয় পেইন্টিংটাতে আসলেই অন্য কারও হাত পড়েছিল।  

ছবি দুটো কীভাবে পাঠাবে মা ভেবে কুল পাচ্ছিল না। বাবা বা পিপলু ভরসার নয় মোটেই। তাছাড়া টের পেলে পিপলুর বৌ, মন্দিরা এ নিয়ে নতুন করে কাসুন্দি ঘাঁটবে। আমি যাওয়ার কথা পরের মাসে তখন আবার শ্যনন থাকবে না। কী ভেবে জানি না ইব্রাহিমকেই ফোন দিলাম। আমাদের কক্সবাজারে সেই গাইড ইব্রাহিম। ও বলেছিল ঢাকায় এলে দেখা করবে। ঠিকানা দেওয়া হয়নি ওকে। ও হয়তো লজ্জায় চায়নি আর আমিও এইসব দুদিনের পরিচিতদের জীবনে জড়ানোর পক্ষে নই বলে এড়িয়ে গিয়েছিলাম।

ফোন পেতেই সে খুশিতে অস্থির―কোনও কথাই ঠিকঠাক বলতে পারছিল না। বেশ কসরতের পরে বুঝলাম সে ঢাকায় আসতে চায়। ম্যাডামকে কদমবুসি করবে। ম্যাডাম মানে শ্যনন। জানলাম শ্যনন ইব্রাহিমের বাচ্চার জন্যে বেশ বড় অঙ্কের টাকা পাঠিয়েছে। শ্যননের সঙ্গে আমার প্রায় প্রতিদিনই দেখা হচ্ছিল অথচ আমি এইসবের কিছুই টের পাইনি! ইব্রাহিম বারবার বলছিল, ‘উনি ফেরেস্তা’! নিজের কাছে নিজেকে বড় বেশি ছোট লাগছিল। লজ্জাও। সেই দিন কক্সবাজারে ইব্রাহিমের বাড়িতে হাতে করে কিছু নেয়নি বলে আমি শ্যননের উপর বিরক্ত হয়েছিলাম। ইব্রাহিমকে শ্যননের ফিরে যাওয়ার কথা জানালাম। ইব্রাহিম অস্থির হয়ে জানাল সে দেখা করতে চায়। এত সহজে আমার কাজ হয়ে যাবে ভাবিনি! মনে হলো শ্যননের কথাই ঠিক; অলক্ষ্যে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। ওকে অনুরোধ করলাম চট্টগ্রাম আমাদের বাসা হয়ে যেতে; টিকেটের খরচ আমিই দেব। ইব্রাহিম এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল এবং ছবি দুটো সযত্নেই নিয়ে এসেছিল।

আমার বাড়িতেই দুপুরে ডেকেছিলাম ওদের; শ্যনন, আসিফ আর ইব্রাহিমকে। ইব্রাহিম ঝিনুকের গয়না, বার্মিজ কাঠের বাটি-চামচ আর ঝলমলে জড়ি পাড়ের দুটো শাড়ি এনেছিল। শাড়ি দুটোর একটা আমাকে বাকি সবই শ্যননের জন্য উপহার। 

আসিফ আর ইব্রাহিম চলে যেতেই আমরা দু জন পেইন্টিং দুটো নিয়ে বসেছিলাম।

সব কিছু কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল। শ্যননকে এ কথা বলতেই ও বলল, ‘আমরা সকলেই এক প্রাচীন কাফেলার যাত্রী, হাঁটছি তো হাঁটছিই। এই অবিরাম যাত্রায় আমাদের প্রত্যেকের জীবনের অসমাপ্ত বিষয়গুলি মৃত পায়ের ছন্দ নিয়ে জেগে থাকে পরের যাত্রীর পায়ের চিহ্নে জুড়বে বলে। এই প্রবাহ চলতে থাকবে যতক্ষণ না সব হিসেবের মীমাংসা হয়’। শ্যনন বলে যে গল্পের শুরু আছে তার শেষ থাকবেই। মাঝে মাঝে ঘুরপথে সেই শেষবিন্দুতে পৌঁছাতে হয় এই যা!―‘তাহলে অরুণাংশু রায় আর জয়নাল শেখের মতো দুই বিপরীত চরিত্রে হুবহু মিল কি অলৌকিক নয়!’ শ্যনন ওর তত্ত্বে স্থির, ‘অবশ্যই নয়। এরা তোমার শাড়ির কুঁচির নক্সার মতোই মিল-মিল ঘটনা কেবল, যুক্ত না-থেকেও সমপাতন’।   

ছবি

শ্যননের সেই ‘প্রাচীন কাফেলার যাত্রী’র ভাবনাটা আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল এবং যেসব চিহ্ন এতকাল আমার দৃষ্টির অগোচরে ছিল তার প্রায় সবই বড় অদ্ভুতভাবে স্পষ্ট হচ্ছিল। অবশ্য শ্যননের ব্যাখ্যা মানলে চোখে মন লাগাইনি বলেই চোখ চক্ষুষ্মান হয়নি, দেখেও দেখিনি। ‘মাইন্ডফুলনেস ডিয়ার, যা তুমি খুঁজছ তাকে মন দিয়ে খুঁজলেই পেয়ে যাবে। ইচ্ছের তীব্রতার টান মহাকর্ষ-অভিকর্ষ―সকল প্রকারের আকর্ষণ বলের চেয়ে প্রবল।’

কী আশ্চর্য, মন লাগিয়ে দেখার কথা তিনিও বলেছিলেন! এ-ও কি কাকতালীয়!

তবে মানতেই হয় শ্যননের বিশ্লেষণ ক্ষমতা দারুণ―যে পেইন্টিং নিয়ে তাঁর ফিরে আসার নতুন গল্প তৈরি হয়েছিল তা না-দেখে কেবল আমার মুখে গল্প শুনেই শ্যনন রায় দিয়েছিল, উনি আসলে আসেননি। দ্বিতীয় কেউ আছে এর পেছনে। এবং ছবিটা হাতে পাওয়ার পরে অসামঞ্জস্যগুলো একে একে দেখিয়েছিল। আমি কেন দেখলাম না ? কিংবা মা বা অন্যেরা ? শ্যননের উত্তর তৈরি : ‘পেইন্টিংটা যারা দেখছিল তারা ভরাট জায়গাটা দেখছিল, কীভাবে ভরলো তার রহস্য খুঁজছিল না। আর আমি ছবি দেখছি না, ভরাটের রহস্য খুঁজছি। তোমাদের দেখার ক্যানভাস বড়, মনোযোগ নয়। অন্যভাবে বললে আমাদের দুই পক্ষের উদ্দেশ্য ভিন্ন।’ এরপরে হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘আর তুমিও খানিক পরেই আমার মতোই সূর্যমুখীর দোল ছাড়িয়ে বিষম রঙ এবং কাঁচা হাতে আঁকা প্রজাপতিটার বেমিল দেখতে পাবে। তবে এই বেমিলগুলো তোমার সর্বনাশ করবে―পেইন্টিংটাকে আর আগের মতো ভালো লাগাবে না। বরং ঐ ন্যাতানো ফুলের ছবিটাই মাস্টারপিস হয়ে যাবে’।

মায়ের জন্য আঁকা ছবিটার দিকে একভাবে তাকিয়ে ছিল শ্যনন। বেশ অনেকক্ষণ পার করে বলেছিল, ‘এই নেতিয়ে পড়া ফুলের তোড়াটাই ছিল তাঁর মুখ্য পেইন্টিং। তোমরা যেটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে যাচ্ছ সেটা ফাউ। ছবিটা মনোযোগ দিয়ে দেখ’। আমি বিছানার ধার ঘেঁষে বসেছিলাম। শ্যনন বাবু হয়ে বিছানার মধ্যিখানে। ছবিটা ওর চোখের সামনে পাতা। আমি কাছে এসে ঝুঁকে দেখতে লাগলাম। ত্রিশ বছর আগের সেই আট বছরের বালিকা ঠিক এইভাবেই দেখেছিল সেইদিনও। ম্রিয়মান ফুলগুলি দেখে বালিকার মনে হয়েছিল : ‘ফুলগুলি হয়রান হয়ে গেছে’। বুকের ভেতর হু হু হাওয়া মাতম তোলে! মা বলতো এভাবে, হয়রান হয়ে গেছি! সব কাজ সেরে মা যখন ঘরে আসতো, ভাই তখন ঘুমে কাদা। আমার চোখেও ঘুম পিঁড়ি পাততে চাইছে আমি তাড়াচ্ছি প্রাণপণে। মা ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমির গল্প বলবে। গল্প শেষ হওয়ার আগেই নিত্যদিনের মতোই আমি তলিয়ে যাব ঘুমের দেশে, শত চেষ্টায়ও জেগে থাকতে পারব না। রান্নাঘরের কাজ গুছিয়ে বিছানায় ফিরতে মায়ের প্রায় দিনই দেরি হতো। আমার ঘুম ঘুম চোখের দিকে তাকিয়ে মা মাঝে মাঝে বলতো ‘আজ থাক। হয়রান হয়ে গেছি রে।’ আমি নাছোড়, মাথা ঝাঁকিয়ে বলতাম, ‘গল্প বলো’। আমাদের পরিপাটি বাবা পাশের উঁচু খাটে অস্থির অপেক্ষায় থাকত। মায়ের হয়রান ন্যাতানো চেহারা দেখে বাবাও ছাড় দিত না―এখন বুঝি। আমি প্রাণপণে স্মৃতির দুয়ার টেনে বাঁধি। আমার চোখ জ্বলতে থাকে।

শ্যনন ছবিটা আমার দিকে ঘুরিয়ে ধরেছিল, পাপড়িতে আলতো আঙ্গুল রেখে বলেছিল, ‘দেখো ফুলগুলোর বাইরের কিনারায় খয়েরি ছোপ ভেতরটা অতটা ম্রিয়মাণ নয় কিন্তু। তোমার মা মানে সেই কিশোরী যাকে তিনি আবৃত্তি শিখিয়েছেন, যিনি নাচে পুরস্কার পেয়েছিলেন ছেলেবেলায়, সেই মেয়েটাকে জাগাতে চেয়েছিলেন―এত কিছুর পরেও মেয়েটা নিজের ভেতরের সেই ‘আমি’টাকে সজীব রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, এই সত্য তিনি দেখতে পেয়েছিলেন… শ্যনন বলে চলছিল আর আমার মগজের পর্দায় ফের ছবিরা ছুটছিল। আমি দেখছিলাম আমার না-দেখা কিশোরী মাকে, সে পায়ের নূপুর খুলছে। চোখের কাজল ভুলছে। গলার গান উবে যাচ্ছে দ্রুত সিঁথির সিঁদুরের লালে। অতঃপর নিজের ছায়ার ভেতরে গুটিয়ে যেতে যেতেও দু হাতে ঠেলছে বিষণ্নতার মেঘ। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে আমার অস্বস্তি তাড়ানোর চেষ্টা করি। এই নেতি-ভঙ্গিকে ন্যায্যতা দিতে শ্যননকে বলি, ‘তোমার ব্যাখ্যা হয়তো ঠিক নয়, কেননা আমার মনে আছে তিনি বলেছিলেন, দশ বছর পরের বিয়ের উপহার দিচ্ছেন মাকে, সেই কারণেই হয়তো ফুলগুলিকে খানিক ন্যাতানো এঁকেছিলেন’। শ্যনন কপালের পাশে টোকা দিয়ে বলল, ‘থিংক মাই ফ্রেন্ড। মানুষ মুখের ভাষা রপ্ত করবার আগে ছবি দিয়েই মনের কথা বলত। হাজার কথার চেয়ে দামি হতে পারে একটি রেখা। আমার কথা মিলিয়ে নিও। এ ছবি কেবলই ছবি নয়, এটি মেসেজ। ফুল তোড়া বেঁধে রাখলে বাঁচে না। তাজা রাখতে হলে জল চাই। ফুলের তোড়াটি কোনও সুদৃশ্য টবেও নয়, মেঝেতেও নয়―দেখো ব্যাকড্রপ নেই। এক্কেবারে ঝুলিয়ে এঁকেছেন। মূল ছবির বাইরে কোনও আঁক নাই। যেন সিদ্ধান্ত তোমার। এই ফুল ফেলবে নাকি রাখবে। এখন বিষয় হলো এই তুমিটা কে ?’ এবার আমি হাসতে থাকি। ‘এটা তো এমনও হতে পারে প্রেমিক অপেক্ষায় ছিল ফুল হাতে, দেরি দেখে চলে গেছে। তোড়াটি ফেলে দিয়েছে। প্রয়োজন নেই।’ ‘হুম’ শ্যনন আবার দেখল ছবিটা, ‘এই মেসেজ হলে ফুলের পচনের এত ডিটেইল আঁকতেন না।’ একটা কথা মনে পড়ল―খাবার টেবিলে উনি আমার ড্রইং খাতায় আঁকা সূর্যমুখী দেখে বলেছিলেন :  ওটা ড্রইং, আর্ট নয়। দীর্ঘশ্বাস চেপে ভাবলাম শ্যননের চোখ আছে। দেয়ালের আলোছায়ার কুহক থেকে সেও হয়তো পায়রা খুঁজে নিতে জানে।

কথা বাড়ানোর ইচ্ছে হচ্ছিল না।  

ছবিগুলি গুটাতে গুটাতে পরিবেশ হালকা করবার ছলে বলেছিলাম, ‘ভাগ্যিস মা নাই এখানে!’

শ্যনন বলল, ‘ইস, তোমার মায়ের সঙ্গে যদি দেখা হতো!’

সত্যি মাকে আনতে পারলে ভালো হতো। পিপলুর ছেলের স্কুলে ফাংশন। মা, বাবা না-থাকলে বাচ্চাটা মন খারাপ করবে। মা নিজেও শ্যননকে দেখতে চেয়েছিল।

শ্যনন সেই রাত আমার সঙ্গে ছিল। সন্ধ্যায় বেলকনিতে বসে এ কদিনের ঘটনাগুলো আবার ফিরে দেখছিলাম দুজনে। আকাশে কাঁসার থালার মতো ঝলমলে চাঁদ। শ্যননকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই নতুন আয়োজনে পুরোনো কাফেলায় তোমার সংযুক্তিও তবে বিনা কারণে নয় ?’ ও লম্বা টান দিয়েছিল সিগারেটে। চাঁদের দিকে নিখুঁত ধোঁয়ার রিং উড়িয়ে বলেছিল, ‘আমি কারণ না হলেও অনুষঙ্গ তো বটে। এই নাটকে আমরা সকলেই কুশীলব, নাট্যকার নই। নাটকের কোনও দৃশ্যে গড়বড় হলে তা মেরামতও হয় স্বতঃস্ফূর্ততায়। পুনযাত্রার শুরু ঠিক সেইখান থেকে। এই মেরামতের একটা নিজস্ব চিহ্নও থাকে। কেউ কেউ টের পায় বেশির ভাগ সময় ঘটনার স্রোতই ঘটনায় টেনে নিয়ে যায় আমাদের। আমি স্বতঃস্ফূর্ততায় বিশ্বাস করি, কারণে নয়।’

‘আমার পুনর্যাত্রার সেই চিহ্ন তবে ‘ভ্যানগখের কান’ মানে পরের জন, জয়নাল ?’ 

শ্যনন হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘হতে পারে’। 

ওর এই শেষ কথায় আমার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমেছিল। মনে হলো অরুণাংশু রায়ের হাসিখুশি চোখজোড়া কোনও আড়াল থেকে চুপচাপ দেখছে আমাদের। মাঝখানের ত্রিশ বছর কাফেলার যাত্রাপথে তিনি কি ছিলেন ? না কি শ্যনন কিংবা জয়নাল হেঁটেছে তাঁর হয়ে ?    

রাতে ফের শর্ষে চিঙড়ি ভাতে মাখাতে মাখাতে শ্যনন হঠাৎ বলেছিল, ‘তিতলি একটা উপদেশ দিই তোমাকে। এই ভ্যান গখ সিন্ড্রোম থেকে বেরিয়ে এসো এবার’।

‘মানে’ ? আমি অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম ওর দিকে। ও কাঁটাচামচ ঘুরিয়ে চারদিকে দেখিয়ে বলল, ‘তোমার ঘরে সব কিছু হলুদ আর ব্রাউন। সূর্যমুখীর মতো। এখানে সাদা ঢোকাও খানিক।’

আমি নিজেই অবাক হলাম নিজের চারপাশ দেখে। এভাবে দেখিনি তো! দেয়ালের রঙ আমার দেওয়া নয়, অ্যাপার্টমেন্টের মালিকের পছন্দে। বললাম, ‘এখানে সাদা যোগ করলে মনে হতো না শূন্যে ভাসছি ? আমার উচ্চতা-ভীতি আছে’। বাস্তবিকই আমি পারতপক্ষে লিফট চড়ি না। প্লেনে জানালার ধারে বসি না। আসবাবপত্রে খয়েরি এনেছিলাম এই স্পেসকে সসীম করতে। ও আমার টেবিলের থালাবাটির দিকে ফের কাঁটাচামচ তুলল, ‘এই হলুদ ?’ এবার আমি চুপ। ব্যাখ্যা নেই আমার কাছে। আমি সজ্ঞানে করিনি এটুকু বলতে পারি। হলুদ আমার প্রিয় রঙ হলো ঠিক কোন বয়সে তাও তো মনে নেই। এমনকি শ্যননের সামনে যে ফতুয়া পরে বসেছি সেটিও হাল্কা হলুদ। শ্যনন চোখে হাসি নিয়ে আমাকে দেখতে দেখতেই কাঁটাচামচে চিংড়ি গাঁথে।

কাফেলার যাত্রী

কক্সবাজারে শ্যননের ট্যুর-গাইড হওয়ার কথা ছিল যথারীতি আসিফেরই। আসিফ আমাদের প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্টসে কাজ করে। বিদেশি ক্রেতা কিংবা বিনিয়োগকারীরা এলে তাদের সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয় সে। কারণ ইংরেজি এবং ফরাসি দুই ভাষাতে সে চোস্ত। কিন্তু কক্সবাজারে ওর ট্যুর গাইড হওয়ার পেছনে ছিল ওর চট্টগ্রামের স্থানীয় ভাষায় দখল যা শ্যননের এবারের কাজের জন্য অতীব জরুরি।   

দুই বছর আগে শ্যননের প্রথম সফরে আসিফই গাইড ছিল। আর সেই বছরেই আমি ‘স্বপ্নে’র রিসাইক্যালড পেপার গুডস বিভাগের সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। শ্যনন তখন সুইডেনের এক বিজনেস ম্যাগাজিনের জন্য স্বপ্নের ওপর প্রতিবেদন তৈরির কাজে বাংলাদেশে এসেছিল। সুইডেন আমাদের অন্যতম গ্রাহক। আমাদের দেশে ‘স্বপ্ন’ই সর্বপ্রথম পুনঃব্যবহারযোগ্য কাগজ, কাপড়, সুপুরির খোল আর কলার খোলের আঁশ থেকে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী উৎপাদন শুরু করেছিল। আমাদের মূল কারখানা যশোরে। এই যশোর থেকেই সাত বছর আগে মাত্র চারজন কর্মচারী নিয়ে আসমা খান এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেছিলেন। এখন ‘স্বপ্ন’ প্রায় তিন হাজার কর্মচারীর রুটি-রুজির সংস্থান করছে।   

সেবার প্রজেক্টের কাজ সরেজমিনে দেখে আসার জন্যে আসমা আপা ওদের সঙ্গে আমাকেও পাঠিয়েছিলেন। অপারেশন ম্যানেজার নাঈম সাহেব গিয়েছিলেন ব্যবস্থাপকদের তরফ থেকে। আমাদের বিমানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শ্যননের অনুরোধে সড়কপথেই যশোর যাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়। শ্যনন ওর ব্যক্তিগত ট্রাভেল-ভøাগের জন্য বাংলাদেশ সফরের ভিডিও করছিল। শ্যননের কারণে সেই যাত্রা দীর্ঘ হলেও আমরা বেশ উপভোগ করেছিলাম;  নিজের দেশটা যেন নতুন চোখে দেখছিলাম। খানিকক্ষণ পরপর থামছিলাম আমরা। নাঈম সাহেব একাত্তরে  কিশোর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, তাঁর কাছ থেকে আমরা সেই সব যুদ্ধদিনের গল্পও শুনছিলাম। যশোরে ঢুকতেই  আসিফ, মৌসুমী ভৌমিকের ‘যশোর রোড’ বাজানো শুরু করেছিল। বাংলাদেশের উত্থান নিয়ে বেশ পড়াশোনা করে এসেছিল শ্যনন। অ্যালেন গিন্সবার্গের যশোর রোডও শুনেছিল সে। মৌসুমীর যশোর রোড শুনতে শুনতেই মুক্তিযুদ্ধ এবং একটা বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প নিয়ে প্রামাণ্যচিত্রের পরিকল্পনাটা ওর মাথায় আসে। তা শুনে নাঈম সাহেব গাড়িতেই প্রস্তাব করেছিলেন কাজ শেষে সবাই মিলে বেনাপোল সীমান্ত ঘুরে আসব আমরা। তিনি আসমা আপাকে ম্যানেজ করবেন। শ্যননের মতো সেটি আমারও ছিল প্রথম যশোর সফর। খুবই আনন্দ হচ্ছিল এক ঢিলে দুই পাখি মারব ভেবে। কিন্তু এপ্রিল মাসের শেষ দিকের উথালপাথাল বৈশাখী ঝড়ের খপ্পরে পড়ে আমাদের শেষ দুই দিন হোটেলেই কাটাতে হয়। আর এই দু দিনেই শ্যনন আর আমি ঘনিষ্ঠ হই এবং পরের দুই বছরে হোয়াটস-অ্যাপ আর সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে সেই সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছিল।   

দুই বছর পরে এবার বাংলাদেশে নেমেই শ্যনন যশোরে ছুটেছিল। যাওয়ার আগে মজা করে বলেছিল, ‘রিস্কে নাই আমি। তোমাদের আনপ্রেডিক্টেবল কান্ট্রি, আনপ্রেডিক্টেবল পিপল, অ্যান্ড আনপ্রেডিক্টেবল মাদার ন্যাচার’। কক্সবাজারে এসেও আবার সেই আনপ্রেডিক্টেবল সমস্যায় পড়েছিলাম আমরা। যশোরে ওর গাইড হিসেবে আসিফই গিয়েছিল। শ্যনন অবশ্য একাই যেতে চেয়েছিল কিন্তু আসমা আপা ওর নিরাপত্তার ঝুঁকিতে যেতে চাননি। যেহেতু তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদনের কাজে মূলত ওর আসা, ওর নিরাপত্তা ‘স্বপ্নে’র দায়িত্বে পড়ে। তাছাড়া স্বপ্নের উত্থান নিয়েও কথা থাকবে জেনে আসমা আপা শ্যননের এই ব্যক্তিগত তথ্যচিত্র নির্মাণের জন্য সার্বক্ষণিক গাড়ির সুবিধা দিয়েছিলেন। শ্যননের সঙ্গে আসমা আপার সম্পর্কও কাজ ছাপিয়ে ব্যক্তিগত হয়ে গেছে এই ক বছরে। কারণও আছে―দুই বছর আগের শ্যননের করা সেই প্রতিবেদনের সূত্রেই স্বপ্নের উৎপাদিত সামগ্রী ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিল ইউরোপের দেশগুলোতে এবং সুইডেন ছাড়াও অন্তত দুটি দেশ স্বপ্নের পাটের পুতুলের গ্রাহক হয়েছে। তবে শ্যনন সেই বিজনেস ম্যাগাজিনের সঙ্গে নেই আর। নারীদের ফ্যাশন এবং জীবনযাত্রাবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘অ্যাল’-এর সুইডিশ সংস্করণের প্রদায়ক এখন। শ্যনন এবার এসেছে ‘অ্যাল’ ম্যাগাজিনের দক্ষিণ এশিয়ার নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির কাজে। দু বছর আগের অভিজ্ঞতার সূত্রেই শ্যনন এবারেও বাংলাদেশ অংশের দায়িত্ব পেয়েছে। এবং বুদ্ধিমতী শ্যনন স্বপ্নের প্রতিষ্ঠাতা আসমা খানকেই ওর প্রতিবেদনের বিষয় করেছে। এই কাজের জন্যেই গত দুই মাস ধরে সে বাংলাদেশে ছিল। অ্যালের অ্যাসাইনমেন্টের ফাঁকে ফাঁকে ওঁর সেই তথ্যচিত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধের নানা স্থাপনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছিল। এই কাজে ছুটির দিনে ঢাকা শহরের ভেতরে কোথাও গেলে মাঝে মধ্যে আমিও শ্যনন, আসিফের সঙ্গী হয়েছি। 

কিন্তু কক্সবাজারে শ্যননের সফরে আমার অন্তর্ভুক্তি ছিল কাকতালীয়। আসিফের মায়ের কিডনিতে টিউমার ধরা পড়ায় মাকে নিয়ে আসিফকে জরুরি ভিত্তিতে ভেলোরে যেতে হয়েছিল। সত্যি বলতে কী এই সময়ে আমি স্টেশন ছাড়তেই চাইছিলাম না, কেননা সেই সপ্তাতেই রিসাইকেল্ড গুডস সেকশনের কার্ডবোর্ড বাক্স আর পেপারটাওয়েলের একটা বড় চালান যাওয়ার কথা আমেরিকায়। নর্থ আমেরিকায় এটাই আমাদের প্রথম চালান। এই কোম্পানিতে দু বছরের চাকরিজীবনে এই কাজটি সম্পুর্ণ আমার তত্ত্বাবধানেই হয়েছে। আমি চাইছিলাম প্যাকেজিং এবং শিপমেন্টের সময় সশরীরে থাকতে। তাছাড়া চট্টগ্রামে জন্ম হলেও চাটগাঁর ভাষা আমি ভালো বুঝলেও ভালো বলতে পারি না। আমার বিশ্বাস আসিফের বিকল্প হিসেবে নয়, শ্যননের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কারণেই আসমা আপা খুব সম্ভব আমাকে অনুরোধ করেছিলেন।    

কক্সবাজারে শ্যননের দুই দফায় কাজ করবার কথা ছিল। মোট পাঁচ দিনের কার্যক্রম। রোহিঙ্গা শরনার্থীদের এ দেশে জীবনসংগ্রাম এবং বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় এই অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর প্রতিফলন দেখাতে কক্সবাজারকে ওর তথ্যচিত্রে সংযুক্ত করেছে। প্রথম দফায় স্থানীয় জনগণের সঙ্গে কথা বলে  রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি স্থানীয়দের মনোভাব এবং পরের দফায় শরণার্থী-শিবিরে গিয়ে সরেজমিনে শরণার্থীদের জীবনযাত্রার মান এবং তাদের মুখে তাদের সংগ্রাম শোনার পরিকল্পনা ছিল ওর। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের জন্য অনুমতি জোগাড় করা সম্ভব হয়নি। ইউনিসেফের স্থানীয় একজনের সঙ্গে কথা বলে ভেতরের সহযোগিতার আশ্বাস পেলেও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি মেলেনি। আসমা আপা ভরসা দিয়েছিলেন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। রোহিঙ্গা ইস্যু বাংলাদেশের জন্য এক অস্বস্তিকর ইস্যু  হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইদানীং সরকারি মহল থেকে অনুমতি জোগাড় করা কঠিন হয়ে উঠেছে। শ্যনন নিজেও মন্ত্রনালয়ে বেশ কবার ধরনা দিয়েছিল। ওর বাংলাদেশে থাকার সময় বাড়ানো সম্ভব নয়। আসার আগেই ও যে ধারণা নিয়ে ওর স্কেজ্যুল তৈরি করেছিল অনুমতির গেঁড়োতে পড়ে কাজটা ওর পরিকল্পনামতো হবে কি না তা নিয়ে আমিও শ্যননের মতো সংশয়ে ভুগছিলাম। তবে শ্যননের কাছে আমার ভাষাজনিত অস্বস্তির কথা শুনে কক্সবাজারে আসার ঠিক আগের দিন ভেলোরে বসেই আসিফ ইব্রাহিম নামের স্থানীয় যুবকটিকে আমাদের সাহায্য করবার জন্য ঠিক করে দিয়েছিল। ফলে কক্সবাজারে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলা কিংবা শিবিরে কাজ করার অনুমতি পেলে সেখানেও কথোপকথনে ভাষাজনিত জটিলতার দুশ্চিন্তা দূর হয়েছিল।

সূর্যমুখী এবং 

প্রথম পর্বের প্রায় পুরো কাজ তিন দিনে শেষ হয়ে গিয়েছিল। শেষ  দুই দিন তোলা ছিল রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরের জন্য। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি তখনও আসেনি। বিকল্প হিসেবে ইব্রাহিম একজন রোহিঙ্গা রিকশাওয়ালার খোঁজ দিয়েছিল কিন্তু স্থানীয় কাউকে বিয়ে করে সে থিতু হওয়ার চেষ্টা করছে, মায়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনও ইচ্ছেই নেই তার। টাকার টোপ দিয়েও ক্যামেরার সামনে তাকে কিছু বলতে রাজি করানো গেল না। স্থানীয়রা আবার ভিডিওতে চেহারা দেখাতে যতটা আগ্রহী রোহিঙ্গাদের নিয়ে মুখ খুলতে ততটাই অনিচ্ছুক। কেউ কেউ ইব্রাহিমকে একপাশে ডেকে আমাদের আসল উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে জানতে চেয়েছে বেশ কয়েকবার।

তৃতীয় দিনেই লোকটাকে দেখি। ভোরের আলো ফোটার আগেই শ্যনন ইব্রাহিমকে নিয়ে হিমছড়িতে গিয়েছিল ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যোদয়ের দৃশ্য তুলবে বলে। আমি যাইনি। শ্যনন চলে গেলে আমি আরও খানিকক্ষণ শুয়েছিলাম। কটেজের জানালার কাচ চুঁইয়ে আলো ঘরে ঢুকতেই আমি বিছানা ছেড়েছিলাম। কটেজ থেকে সৈকত পাঁচ-সাত মিনিটের পথ। ভোরের হাওয়ায় শ্বাস নিতে বেরিয়ে পড়লাম একাই। জলের ধার ধরে হাঁটছিলাম। তিন-চার জোড়া অল্পবয়সী যুগল ছাড়া তেমন কেউ নেই সৈকতে। লোকটা একমনে বালি দিয়ে কিছু বানাচ্ছিল। প্যান্টের এক পা হাঁটুর ওপর ভাঁজ করে গোটানো, খালি গা। চুল, দাঁড়িতে হৈচৈ। ভবঘুরে টাইপ। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় হাত চালাচ্ছে সে। আধ ঘণ্টার মধ্যেই এক মৎস্যকন্যা বালি ফুঁড়ে জেগে উঠল! এত দ্রুত সে বালি থাবড়ে জড়ো করছিল আর পাতছিল যে শেষ না হওয়া পর্যন্ত বুঝবার জো ছিল না ঠিক কী তৈরি হচ্ছে! কাজ শেষ হতেই লোকটা খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল নিজের সৃষ্টির দিকে। আমি ভালো করে দেখবার জন্য এগিয়ে গেলাম। লোকটা মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখল। শান্ত বিষণ্ন সেই দৃষ্টি। এরপরেই হনহন করে পাড় ধরে উল্টো দিকে হাঁটতে লাগল। আশেপাশে যুগলদের মনোযোগ নেই এদিকে। মনটা ভারী হয়ে গেল আমার। আহা ওরা জানলই না কী এক অসাধারণ শিল্পকর্ম সৃষ্টি হলো এই মুহূর্তে এবং কী ভীষণ অবহেলায় শিল্পী সেটি সমুদ্রকে দান করে দিল! দেখলাম ঢেউ ছুঁয়ে দিচ্ছে মৎস্যকন্যার চুল। খানিক পরেই ধুয়ে যাবে সব। আমি ঝটপট বেশ কিছু ছবি তুলে নিয়েছিলাম। 

বিকেলে শ্যনন কটেজে ফিরলে ওকে দেখিয়েছিলাম ছবিগুলো। কী নিখুঁত কাজ! মৎস্যকন্যার লেজের প্রতিটি আঁশ এমনভাবে ফুটে আছে যেন হাতে নয় ছাঁচে গড়া। শ্যনন বিশ্বাসই করতে চাইছিল না যে কেবল দুই হাত দিয়েই লোকটা এই কাজ করেছে। বিকেলে আমরা লোকটার খোঁজে গিয়েছিলাম সৈকতে। বেশ অনেকক্ষণ ছিলাম কিন্তু লোকটার দেখা পেলাম না। পেলাম পরদিন।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়াসংক্রান্ত অনুমতির কোনও হিল্লে হয়নি। আসমা আপা নিজেও বিরক্ত। যার মাধ্যমে চেষ্টা করছেন সে ব্যক্তি তখনও আশ্বাস দিয়েই চলেছিল। শ্যনন এতসব শুনেও হাল ছাড়তে চাইছে না, না হয় আরও দু’দিন দেখি। আসমা আপা আপত্তি করলেন না। এবং আমাকে আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে আমার নর্থ আমেরিকায় শিপমেন্টের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবেই চলছে। 

সেই দিন সারা সকাল শ্যনন ‘অ্যালে’র প্রতিবেদনের সম্পাদনার কাজ করল। আমি নয়নতারা সায়গলের ‘রিচ লাইক আস’ বইটার শেষ কপাতা পড়ে ফেললাম। শ্যনন তখনও ল্যাপটপের উপর ঝুঁকে আছে। এগারোটার পরে শ্যনন হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘আসমা খানের ফোনের অপেক্ষায় বসে থেকে তো গাছ হয়ে গেলাম, চল বেরোই। কিছু কেনাকাটা করে আসি বার্মিজ মার্কেট থেকে।’ আমাদের ভাড়া গাড়ি কটেজের সামনেই থাকে সকাল নটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত। ইব্রাহিমকে ও বিকেলে আসতে বলেছিল। এখন ফোন দিলে আসতে আসতে আরও আধঘণ্টা। আমি প্রস্তাব দিলাম আমরা বার্মিজ মার্কেটে চলে যাই বরং ইব্রাহিম আসুক ওখানে। শ্যনন মানল। ইব্রাহিম বার্মিজ মার্কেটে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হলো। ইব্রাহিম থাকাতে দামাদামি করতে সুবিধা হলো আমাদের। শ্যনন ওর সুইডেনের বন্ধু-স্বজনদের জন্যে ঝিনুকের গয়না আর কাঠের ছোট ছোট স্মারক কিনল। আমিও ভাইয়ের বৌ আর মায়ের জন্যে টুকটাক কিনলাম। পেটে ছুঁচো চড়ছে আমার। দুপুরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে বেশ আগে। ইব্রাহিমেরও হয়তো একই দশা। সে বেচারা মুখ ফুটে বলতে পারছে না। আশেপাশে ভালো খাবার হোটেল কোনটা জিজ্ঞেস করতে ইব্রাহিম খুব লাজুক গলায় জানাল, যদি আমাদের আপত্তি না থাকে তবে আমরা ওর বাড়িতে খেতে পারি, ওর বাড়ি কাছেই। কিন্তু বলা নেই, কওয়া নেই, ওভাবে কারও বাড়িতে যাওয়া যায় ? শ্যননকে তর্জমা করে বলতেই ও এক পায়ে খাড়া। স্থানীয়দের বাড়িতে খাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করবে না কিছুতেই এবং ইব্রাহিমকে উল্টে বলল ওর কোনও আপত্তি নেই তবে শর্ত আছে ইব্রাহিমের বাড়িতে কাটানো সময়টা ভিডিও করতে দিতে হবে।

ইব্রাহিমের বাড়ি আসলেই বার্মিজ মার্কেটের কাছেই। ওর বৌ খুব গোছানো মেয়ে। বছরখানেকের একটা ফুটফুটে বাচ্চা আছে ওদের। আমরিন নাম। আমরা কিছুই নিয়ে যাইনি। শ্যননের এ নিয়ে কোনও বিকার নেই। আমিই দুজনের নাম করে কিছু কিনে দিতে টাকা গুঁজে দিলাম বৌয়ের হাতে। ইব্রাহিমের বৌয়ের হাতে জাদু আছে। আমরা আসব জানত না। রূপচাঁদা মাছ আর ডাল রেঁধেছিল বরের জন্য। দু বেলার রান্না। দিব্যি চারজনকে হয়ে যায় কিন্তু এত কম পদে সে আমাদের আপ্যায়ন করবে না। সে আমাদের সামনেই রান্নাঘরের ঝাঁকা থেকে ঢেঁড়স বার করল। হাঁসের ডিমও। ইব্রাহিম কোন ফাঁকে বেরিয়ে ঠান্ডা কোক আর চিংড়ি নিয়ে এল আমরা টেরই পেলাম না। আমি ওর বৌকে বললাম, ‘ইস্ তোমার দু বেলার খাবারেই ভাগ বসালাম, কাজ বাড়ল’। সে মিষ্টি হেসে জোরে মাথা নাড়ল। জানাল, ওরই সৌভাগ্য আল্লাহ ওর বাড়িতে আমাদের রিজিক নির্দিষ্ট করেছেন। কথাটা এতই ভালো লাগল আমি শ্যননকে তক্ষুনি তর্জমা করে বললাম। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনদর্শন এমনই, অনুরোধ করলাম এই কথাটা ভিডিওতে যেন সে অবশ্যই রাখে। শ্যনন আমার কথা শুনল। ইব্রাহিমের বৌয়ের চটজলদি রান্নার আয়োজন যত্ন করে ভিডিও করল। ডিম ভাজার পরে ঢেড়স-চিংড়ি বলে অমৃতসমান পদটি শ্যননের ভিডিওর জন্যে ও এমন চৌকসে মুখে বলে বলে প্রতিটি ধাপ দেখাল যে টিভিতে প্রচারিত যে কোনও রান্নার অনুষ্ঠান ওর কাছে মøান হতে বাধ্য। ক্যামেরার সামনে ওর কোনও জড়তাই নেই। মজার ব্যাপার ওর কথায় প্রবল চাটগাঁর টান কিন্তু ওর প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি ভাষার সীমাবদ্ধতাকে হটিয়ে দিয়েছে। মাদুরে খাবার পরিবেশনটাও দারুণ ছিল, অনাড়ম্বর অথচ মমতামাখা। শ্যনন খুঁটিনাটি সবই  ভিডিও করল। এবং রিজিকসংক্রান্ত কথাটাও কায়দা করে বলিয়ে নিল।  

বেশ ভালোই খেয়েছিলাম আমরা দুজন। যা পারি তার চেয়ে বেশি। শ্যনন সরাসরি কটেজে ফিরতে চাইল না। একটু হেঁটে না নিলে সব গায়ে লেগে যাবে। কটেজের কাছে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে সৈকতের দিকে পা বাড়িয়েছিলাম আমরা। সূর্য চলছিল আমাদের সঙ্গে তবে পশ্চিমমুখী তাই তেজ ছিল না তেমন। চারটের কাছাকাছি। শ্যনন ছবি তুলতে তুলতে এগোচ্ছিল। আমি একটু পিছিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ দেখি কোত্থেকে এক ঝাঁক নানা বয়সী কিশোর-কিশোরীর হাজির হয়েছে। শ্যননের চারপাশে বিনবিন করছে―জুতা রাখবে ওরা। ‘ডলার ডলার’, দুই হাতের পাতা খুলে দশ আঙ্গুল দেখাতে দেখাতে বলছে সবচে ছোট জন। শ্যননকে দেখলে এমন হয় রোজই কিন্তু আজকের বাচ্চাগুলো বেশ নাটুকে। শ্যনন ওদের কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে নুইয়ে পড়ছে। আমরা জুতা খুলব না―আমি বললাম। আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম নজর টানল শ্যননের বাম দিকে। সেই লোকটা! কোনও ভুল নেই। শ্যননের সামান্য দূরেই উবু হয়ে কিছু বানাচ্ছে। আমি শ্যননকে দেখানোর আগেই শ্যনন দেখে ফেলেছে। প্রায় চেঁচিয়েই জিজ্ঞেস করল, ‘দ্যাটস হিম রাইট ?’ আমি উত্তর না নিয়ে এগোতে থাকলাম। হ্যাঁ সে-ই।

শ্যনন হঠাৎ বাচ্চাগুলোর দিকে ঘুরে বলল, ‘টাকা দেব যদি কথা শোনো।’ আমি বুঝে গেলাম শ্যননের পরিকল্পনা। আমার ধারণা সত্যি করে শ্যনন জানাল সে ভিডিও করতে চায় লোকটার কাজ। বাচ্চাগুলো দর্শক হয়ে ছড়িয়ে দাঁড়াবে। কী ভেবে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমিও’। আমি মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানালাম, ‘আমায় টেনো না’। আমার তর্জমার আগেই বাচ্চাগুলো কীভাবে যেন বুঝে গেল শ্যননের প্রস্তাব। ঢ্যাঙামতো ছেলেটাই ওদের সর্দার। ও চাটগাঁর ভাষায় আমার দিকে তাকিয়ে তথ্য দিল, ছবি তুললে ২০ টাকা আর ভিডিও করলে ৩০ টাকা। ওর বলার ভঙ্গি দেখে হাসি চাপা দায়। আমি যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে বললাম, ‘দশ টাকা করে পোষালে দাঁড়া নয়তো ভাগ।’  বাচ্চাগুলো বেশ সেয়ানা। বিশ্বায়নের হাওয়ার গতি ওরা রপ্ত করে নিয়েছে : টাকা ছাড়া কথা নেই। ওরা সরল না গাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শ্যনন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জানতে চাইল। আমি ছেলেটাকে বাদ দিয়ে বাচ্চাগুলোকে বললাম, ‘সবাইকে দশ টাকা করে দেবে। দশ মিনিট দাঁড়াবে’। বাচ্চাগুলো দলনেতার দিকে তাকিয়ে রইল, নড়ল না। আমি শ্যননকে বললাম, ‘চলো দর্শক বাদ, তুমি লোকটার কাজের ভিডিও করো।’ ‘একাকী মগ্ন শিল্পী’ ক্যাপশন। শ্যনন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘সেটা বোঝাতেই তো চারপাশের হৈচৈয়ের প্রতীক হিসেবে এদের দাঁড় করাতে চাইলাম’। আমি জবাব না দিয়ে হাঁটতে থাকলাম। শ্যননও লং শটে লোকটার ভিডিও করতে করতে এগোতে লাগল। এবার ছেলেটা এগিয়ে এসে আমাকে বলল, ১৫ হলে করবে। আমি বললাম দশ টাকার বেশি এক পয়সাও দেব না। আমরা লোকটার কাছে যাওয়ার আগেই বাচ্চাগুলো পৌঁছে গেল। শ্যননের নির্দেশনায় দু পাশে দুই কোণে জ্যামিতিক সামঞ্জস্যে দাঁড়িয়েও পড়ল। ব্যাপারটা আমার বড় বেশি সাজানো মনে হচ্ছিল। লোকটার শিল্পকর্মে যে ওদের কোনও কৌতূহল নেই তা ওদের শরীরের ভঙ্গিতেই ধরা যাচ্ছে। শ্যনন হয়তো এডিট করে পরে এতে স্বতঃস্ফূর্ততা আনতেও পারে―আজকাল সবই সম্ভব। 

এইসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতে লোকটার কাজ দেখছিলাম। লোকটা ঠিক কী বানাচ্ছে সেদিনের মতোই বুঝতে পারছিলাম না। তেজহীন সূর্য উবু হয়ে বসেছে ঠিক ওর মাথার ওপর। ওর দুই হাতের তেজি ওঠানামায় হঠাৎ পাতার ওপরে শিরা-উপশিরার নিখুঁত বিন্যাস ভেসে উঠতে দেখে আমার টনক নড়ল, আমি মনোযোগী হলাম এবং খানিক পরেই অবাক হয়ে দেখলাম বালি ফুঁড়ে জেগে উঠছে সূর্যমুখীর ঝাড়। আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি শ্যননের পেছন থেকে অজান্তে বেরিয়ে এলাম। শ্যনন লোকটার হাতের উপর ক্যামেরা জুম করতে করতে ইতোমধ্যে বাঁদিকে সরে ওর মুখের কাছে প্রায় ঝুঁকে ভিডিও করতে শুরু করেছিল। লোকটার বাঁ হাতই চলছে বেশি, ডান হাতে সে কেবল বাড়তি বালি সরাচ্ছে কিংবা টানছে। ক্যামেরা লোকটার মুখের দিকে তাক করেই শ্যনন অস্ফুটে বলে উঠল, ‘হোয়াট দ্য ফাক!’ শ্যননের আশ্চর্য হওয়া কিংবা বিভোর হওয়া, এমনকি রেগে যাওয়া, সবেতেই ‘ফাক’। কিন্তু উলটো দিকে দাঁড়ানো আমিও মনে মনে ওর কথাই পুনরাবৃত্তি করলাম, এমন মিল কীভাবে সম্ভব! লোকটা মাথা তুলে যেন চমকে তাকাল। শ্যনন তখনও ওর ক্যামেরা তাক করে ঝুঁকে আছে। লোকটার নাকের পাটা বুনো মোষের মতো ফুঁসছে। ওর শরীরের ভঙ্গি দেখে মনে হলো এক্ষুনি লাফিয়ে শ্যননের টুঁটি চেপে ধরবে। আমি ছুটে শ্যননকে সরানোর আগেই লোকটা এক টানে ওর হাতের ক্যামেরাটা কেড়ে নিল। হতবিহ্বল শ্যনন সাম্য রাখতে না পেরে চিৎ হয়ে পড়ে গেল সুর্যমুখীর পাপড়ির ওপরেই। লোকটা ক্যামেরা ছুড়ে দিল উলটো দিকে এবং সেই সূর্যমুখীর ঝাড় মাড়িয়ে আমার পাশ ঘেঁষে বালিয়াড়ির ধার ধরে উপুড় করে রাখা জেলে নৌকাগুলোর পেছনে কোথায় যে মিলিয়ে গেল! বাচ্চাগুলো শ্যননের পড়ে যাওয়া দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আমি শ্যননকে তোলার জন্যে হাত বাড়াতে ভুলে গেছি। আমার মাথার ভেতর কোথাও কেউ মন্ত্রপাঠের মতো আওড়ে যাচ্ছে, ‘একে বলে মাইক্রোশা’।

আমি উল্টে হেঁটে পৌঁছে গিয়েছিলাম আদিবিন্দুতে। মাঝখানের ত্রিশটা বছর কুঁচকে মিলে গেল যেন বর্তমানে!

বাচ্চাদের একজন আমার ইতিউতি খোঁজার মর্ম বোঝে যেন। বিজ্ঞের মতো তথ্য দেয়, জেলেপাড়ার পেছনে ছড়ার দিকে গেলে পাওয়া যেতে পারে। আরেকজন মাথা নেড়ে বলে মতিন মিস্ত্রীর ডিপোয়। হঠাৎ করে সূর্যের পায়ে চাকা লাগল, দ্রুত আলো মিলিয়ে যাচ্ছিল। আমার মাথার ভেতর হাতুড়ি চলছে। শ্যননকে বলি, ‘চলো ফিরি’। আমার কথা শেষ না হতেই বাচ্চাগুলো হঠাৎ মারমুখী জনতার মতো ঘিরে ফেলল শ্যননকে। ওদের মুখের শৈশব উড়ে গেল পলকে। চোখে শতজন্মের রাগ নিয়ে হাত মুঠো করে ফেলেছে সকলে। 

শ্যনন ওদের এই কয়েক মিনিটের জন্য প্রত্যেককে দশ টাকা করে দিতে অস্বীকার করছিল। সময়ের হিসেবে কম কিন্তু শ্যননের জন্য বেশি কিছু তো নয়। হয়তো ওরা ওর পড়ে যাওয়ায় মজা নিয়েছে বলেই এই শোধ। ভাষার ভিন্নতা সত্ত্বেও ওরা জোর গলায় তর্ক করে যাচ্ছিল শ্যননের সঙ্গে। আমার মুখের ভেতর জ্বরের তেতো স্বাদ ঘুরছিল প্রবল বেগে। মনে হচ্ছিল বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি উলটে আসবে। আমি শ্যননকে বলি, ‘ঝামেলা করো না, যা বলেছিলে তাই দিয়ে দাও’। শ্যনন অনিচ্ছায় আমার কথা মেনেছিল। 

আমরা হেঁটেই ফিরেছিলাম হোটেলে। সারা রাস্তা দুজনের কেউই কোনও কথা বলিনি। আমার পাশে শ্যনন মাঝে মাঝেই মাথা ঝাঁকিয়ে জিভ দিয়ে চকাশ চকাশ হতাশার আওয়াজ করছিল। ও হয়তো অপরাধবোধে ভুগছিল। আমার মনের তোলপাড়ের হদিশও জানে না ও। হোটেলে পৌঁছেই শ্যনন ইব্রাহিমকে ফোন দেয়। ইব্রাহিম তোলে না। শ্যনন বিরক্ত হয়, ‘এই ছেলের ডিউটি শেষ হতে কিন্তু আরও আধাঘণ্টা আছে’। বিছানায় ফোন ছুড়ে দিয়ে আমাকে বলে, ‘গা ধুয়ে এসে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে লোকটার খোঁজ নেওয়ার জন্য সাহায্য চাইব। তুমি বুঝিয়ে বলবে। আমার খুব খারাপ লাগছে। শিল্পী মানুষ, ভিডিও করার আগে আমার ওর অনুমতি নেওয়া উচিত ছিল’।

আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না, ত্রিশ বছর আগের সেই দিনটা পিং পং বলের মতো মগজের মেঝেতে দুরন্ত লাফাচ্ছিল।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলাম জানি না। চোখ খুলতেই দেখি শ্যনন বিছানায় বসে ক্যামেরার মনিটর চেক করছে। অস্থিরতা সামলাতে পারি না। জানতে চাই, ‘সত্যি লোকটার কান ছিল না ?’ শ্যনন মুখ তুলে তাকায়। ওর মুখে হাসি, ‘এটা ভøাগে দেব না। ভাবতে পার মিয়েস্ত্রো অ্যান্ড হিজ আর্ট বাই এ রুর‌্যাল আর্টিস্ট ? এটা দিয়ে শর্ট ফিল্ম করব।’ হঠাৎ যেন ঘোর কাটল ওর। আমার দিকে চকচকে চোখে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি দেখেছিলে ? তাই অমন সাদা হয়ে গিয়েছিলে ?’ আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে ফের বিস্ময়, ‘কীভাবে দেখলে! আমি তো জুম করার আগে টেরই পাইনি’। আমি উত্তর দিই না। ও ভিডিও রোল করা শুরু করল এবং আমার দিকে বাড়িয়ে ধরল। আমরা দুজনই দেখলাম আবার। সূর্যমুখী পাপড়ি মেলছে গায়ে গা লাগিয়ে, শ্যনন তখনই হাত ছাড়িয়ে লোকটার মুখে ক্যামেরা তাক  করেছে। কানের দিকটা জুম করতে করতে শ্যননের গলা, ‘হোয়াট দ্য ফাক’। ক্যামেরার স্ক্রিনে দেখাচ্ছে লোকটার কানের জায়গায় বাদামের মতো এক টুকরো মসৃণ মাংস উঁচু হয়ে আছে এবং শ্যননের আওয়াজ মিলানোর আগেই একটা ঝাঁকুনি। এরপর সব অন্ধকার! 

শ্যনন বলল, ‘আমার এমন করা উচিত হয়নি। আই মাস্ট হ্যাভ অফেন্ডেড হিম’। 

আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘এটা ভ্যান গখের কান নয় মাইক্রোশা’। শ্যনন বোঝে না, ‘বেগ ইয়র পার্ডন’। আমি বলি, ‘নাথিং’। শ্যনন আমার কাঁধে হাত রাখে, ‘তিতলি আই নো সামথিং ইজ  ট্রাব্লিং ইউ। আই নোটিসড দ্য চেঞ্জ। স্পিল ইট আউট। ইউ হাভ মাই ইয়ারস’। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। আমার দুই চোখ জ্বলছে। ইনি তিনি নন আমি নিশ্চিত, তাও কেন এমন অনুভব ?

জয়নাল শেখ

লোকটার পরিচয় শেষমেশ জানতে পেরেছিলাম আমরা। তার আগে শ্যননের ভিডিও শটের স্টিল থেকে লোকটার ছবি প্রিন্ট করে কটেজের ম্যানেজার থেকে বার্মিজ মার্কেট―সবখানে দেখিয়েছিলাম। কেউই চিনতে পারেনি কিংবা বলতে চায়নি। সেই বিকেলেই মতিন মিস্ত্রির কথা বলেছিল বাচ্চাগুলোর একজন। অন্যেরা বলেছিল লোকটা জেলেপাড়ায় থাকে। মতিন মিস্ত্রির কথাটা মনে পড়ল একদম শেষে, তাও মতিন নামটা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না। ইব্রাহিমকে বলতেই ও চিনে ফেলেছিল আর সেইখানেই আমাদের চূড়ান্ত অবাক হওয়ার ঘটনাটি ঘটেছিল।

মতিন মিস্ত্রি জেলে নৌকার কারিগর। লোকটা মতিন মিস্ত্রির নৌকা রঙ করেছে তিন-চার মাস। ‘ইবা তো জয়নাল শেখ।  রোহিঙ্গা। এক কাইন্না। কানর জাগাত গোস্তর দলা’। (ও রোহিঙ্গা। জয়নাল শেখ। এক কানওয়ালা। কানের জায়গায় মাংসপিণ্ড।) মতিন মিস্ত্রীর গলায় বিরক্তি, কিছু না বলে আধা কাজ করে চলে গেছে। পয়সাও নিয়ে যায়নি। ‘ফউল কিসিমর’। (পাগল কিসিমের)।

মতিন মিস্ত্রির মুখ খুলতে ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছিল। আমাদের আসার উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে ওর প্রশ্নই যেন শেষ হচ্ছিল না। পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে জয়নাল রোহিঙ্গা হওয়ায় ওর নাম মতিন মিস্ত্রির দিনমজুরের বেতনের খাতায় ওঠেনি। শ্যননকে সে রহিঙ্গা ক্যাম্পের কোনও বিদেশি পর্যবেক্ষক বলে ধরে নিয়েছিল। বারবার বোঝাচ্ছিল যে জয়নাল নিজেই উদয় হয়েছিল। জানলাম শুরুতে নৌকার কাঠ চেরাইয়ে কাজ করত। সেই কাজে মন ছিল না। পরে রঙের কাজে লাগিয়েছিল। নৌকার বডি রঙে ও দারুণ চৌকস ছিল। এমনই টান যে কোথাও রঙের কম বেশি ধরা পড়ত না। যে ঘরটায় আমরা বসেছিলাম সেই ঘরটা বেশ তেতে উঠেছিল, আমার প্রচণ্ড অস্বস্তি লাগছিল। গুদামঘরের মতো বদ্ধ, টানা বারান্দার মতো লম্বা। বোঝা যায় মূল বাড়ির গা ছেড়ে বাড়ানো হয়েছে। মাটির মেঝে। এক কোণে কাঠের টুকরো ডাঁই করে রাখা। আলকাতরা, রজন, রঙের কৌটা, ফুলের ঝাড়ু আগোছালো এদিক-সেদিক। একটা ঝাঁঝালো গন্ধ লটকে আছে হাওয়ায়। চারপাশে টিনের ঘেরা। মাথার ওপরে টিনের চাল আগুনের হল্কা ছড়াচ্ছিল। ডানদিকে দরজার পাল্লা ভেতরের ঘরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এই ঘরকে। সেই দরোজার ওপারে কেউ আমাদের লক্ষ করছে টের পাচ্ছিলাম। ইব্রাহিম বাইরে অপেক্ষা করছে। এখানে আমাদের এতটা দেরি হবে ভাবিনি। মতিন মিস্ত্রী গরুর জাবর কাটার মতো পান চিবাচ্ছিল। কাঁধের গামছায় মাঝে মাঝে ঠোঁট মুছছে আর শ্যননকে দেখছিল আড় চোখে। অনেকক্ষণ পরপর হিসেব করে কথা বলছিল।

খানিক পরে, ভেতরের সেই ঘর থেকে বছর সাতেকের একটা বাচ্চা মেয়ে আমাদের দুই জনের জন্যে স্প্রাইটের বোতল নিয়ে এল। মতিন মিস্ত্রি আমাদের ইশারায় বোতল নিতে বলল। আমি হাতে নিয়ে দেখি বোতলও গরম। আমার ভাগেরটা বাইরে ইব্রাহিমের জন্য পাঠাতে অনুরোধ করলাম। শ্যনন নিমেষেই বোতল খালি করে বাচ্চা মেয়েটার হাতে বোতল ফেরত দিয়ে দিল। মতিন মিস্ত্রি মুখে সুপুরি পুরতে পুরতে মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল আমার ছোট মেয়ে। মেয়েটা পরিচয়পর্বের জন্যে অপেক্ষা করল না। খালি, ভরা দুই বোতল নিয়েই চলে গেল ভেতরে। কে জানে ইব্রাহিমকে দেবে কি না! মতিন মিস্ত্রী মেয়ের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বিষণ্ন গলায় বলল, আঁর মাইয়ারও মাতবোল নাই, বুবি। জইনাইল্লা আঁর মাইয়ার দিলত বউত দুখ দিয়ে। (আমার মেয়েটা কথা বলতে পারে না, বোবা। জয়নাল আমার মেয়ের মনেও দুঃখ দিয়েছে।) আমার বুক কেঁপে উঠল। আট বছরের আমিও তো দুই দিনেই কী আপন ভেবেছিলাম তাঁকে! কীভাবে সময় ভাঁজ করে পাটেপাট মিলে যায়!

আমরা যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই মতিন মিস্ত্রি আমাদের অপেক্ষা করতে বলে ভেতরে যায়। দরজাটা অদ্ভুত ভারী মনে হচ্ছিল। খানিক পরে মতিন মিস্ত্রি মেয়েকে নিয়ে ফেরে। বাচ্চাটার হাতে খবরের কাগজে মোড়ানো একটা কিছু ধরা। মতিন মিস্ত্রি মেয়ের হাত থেকে জিনিসটা নেয়। বলে মেয়েটা প্রায়ই কারখানায় যেত। জয়নাল ওকে সুরুয-ফুল আঁকা শেখাতো। আমি থমকে তাকাই। কী ফুল ? এবার খবরের কাগজটা মেলে ধরে মতিন মিস্ত্রি বলে, ‘ইবা আর মাইয়াফোঁয়ারে দিয়েদে।’ (এটা আমার মেয়েকে দিয়েছে।) আমার বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। থোকা থোকা নিখুঁত রঙহীন সূর্যমুখী আমাদের দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। শ্যননের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন, ‘ওয়াও ইনক্রেডিবল!’ আমার গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। শ্যনন ছবিটা হাত বাড়িয়ে নেয়। নিউজপ্রিন্ট কাগজে চারকোলে আঁকা। অসাধারণ! এই লোক পাকা শিল্পী। শ্যনন আমার দিকে তাকিয়ে বলে, জিজ্ঞেস করো, এই ছবি কি বিক্রি করবে ? করলে আমি দশ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে রাজি’। মতিন মিস্ত্রি অবাক হয়ে বলে, ‘ইবা কি ডঁড় মানুষ না ? অঁনেরা চিনুন না ?’ (ইনি কি অনেক বড় কেউ ? আপনারা চেনেন ?) আমি উত্তর দেওয়ার আগেই মেয়েটা হঠাৎ বাবার হাত থেকে টান দিয়ে ছবিটা নিয়ে ভেতরে চলে যায়। যাবার আগে ওর চোখের সেই তীব্র চাউনি আমার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় যেন। 

সেদিন কটেজে ফিরে শ্যননকে বলেছিলাম আমার গল্প।                                                                                        

ভ্যান গখের কান

দিনক্ষণ সব মনে আছে আমার। পয়লা নভেম্বর ১৯৯০। আমার ছোট ভাই পিপলুর চার বছরের জন্মদিন ছিল সেদিন। প্রেসিডেন্ট এরশাদের বিরুদ্ধে জনরোষের ঘূর্ণি তখন চূড়ায়। একটাই চ্যানেল, বিটিভি। এবং তাতে হবু রাজার গবু মন্ত্রিসভার চাহিদার মাপে দর্জিসেলাই খবর সম্প্রচার করা হতো। পাড়ায় পাড়ায় সন্ধে হতেই রেডিওর নব ঘুরতো বিবিসি আর ভোয়ার স্টেশনে থিতু হওয়ার জন্যে। দেশের হালহকিকতের খবর জানাতো তারাই। আমাদের বাড়িতেও অফিস থেকে ফিরেই বাবা জেঠু, দাদুর সঙ্গে চায়ের কাপ নিয়ে সেই যে ডাইনিং টেবিলে রেডিও ঘিরে বসতো একদম রাতের খাবার শেষ করে তবেই উঠত।

আমাদের পরিবার রামঠাকুরের ভক্ত। প্রতি মাসে আমরা যাই ওখানে। কী সুন্দর গাছগাছালি ঘেরা আশ্রম। আমার প্রিয় জায়গা ছিল আশ্রমের বাগান, পদ্মভাসা পুষ্করণী আর নাটমন্দিরের ঠান্ডা মেঝে। ঐ বয়েসেই অনেক পাখি চিনেছি আমি কৈবল্যধামের সবুজের ভিড়ে। কৈবল্যশক্তি নামের সেই বটগাছের শাখায় ঠাম্মা আমাদের জন্য কত কত মানসী সুতো বেঁধেছেন! হামলার খবর শোনার পর থেকে ঠাম্মা খানিকক্ষণ পরপর চোখ মুছছেন।  

পিপলুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ঘরে কোনও আয়োজনই হয়নি। বেলুন নেই এমনকি কেইকও কেনা হয়নি। মা পুডিং বানিয়েছিল। পিপলুও যেন বুঝেছে সময়টা বিরূপ, ওর নতুন পাওয়া গাড়িটা নিয়েও আওয়াজ করে খেলছিল না। জেঠুর মুখে পাহাড়তলিতে হামলার খবর শুনে রহিমা খালা আলো থাকতেই বাড়ি চলে গেছেন। রাতের খাবারও নেননি। জবার জন্যে একটু পুডিং দিয়েছিল মা, খালা রেখে গেছেন, ‘কাইল আইলে খাইবো নে’। জবার বড় ভাই ভাটিয়ারিতে শিপইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙার কাজ করে। ছেলের চিন্তায় খালা কাজে মন বসাতে পারছিল না। 

ভয়েস অব আমেরিকার খবর শুরু হতেই গেটে প্রথম ধাক্কাটা পড়েছিল। টুম্পা! টুম্পা! কেউ একজন ডাকছিল। বাবা রেডিওর আওয়াজ কমিয়ে দিলেন। সারা পাড়াও যেন হঠাৎ করে নিঝুম হয়ে গেল। আবার ধাক্কা পড়তেই সবাই নিশ্চিত হলো আমাদের বাড়িতেই এসেছে কেউ। কলিং বেলটা পিলারের ভেতরে। হাত ঢুকিয়ে বাজাতে হয়। অচেনা কেউ নিশ্চয়ই, নইলে অমন পাড়া কাঁপিয়ে গেইট ভাঙতো না। ফের টুম্পা টুম্পা করে চেঁচাতেই জেঠু নেমে গেলেন উঠোনে, পেছন পেছন বাবাও। টুম্পা আমার মায়ের নাম। মা বুঝতেই পারেনি যে তার নাম ধরেই ডাকা হচ্ছে। মামারা ছাড়া এই নামে কেউ ডাকে না মাকে। মামারাও বছর দু বছরে ক্বচিৎ আসেন আমাদের বাড়ি।  

আমাদের বাড়ির গেইট উঠোন পেরিয়ে খানিক দূরে। রান্নাঘরের বাইরে তারে ঝোলানো লাইটের আলো কলতলা পর্যন্ত কোনওমতে পৌঁছায়। রাস্তার লাইটের এমনিতেই ধার কম আর তাতে ঝাঁক বেঁধে উড়ছে উঁইপোকার দল। জেঠু কারও সঙ্গে কথা বলছে আমরা শুনতে পাচ্ছি কিন্তু কী বলছে বোঝা যাচ্ছিল না। বাবা খানিক পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে। একটু পরেই গেইট বাঁধার আওয়াজ শুনতে পেলাম আমরা। কেউ একজন আসছেন জেঠুর সঙ্গে সমান পায়ে যেন নিজের বাড়ির চেনা পথ। বাবা আসছে পেছন পেছন। বাবা, জেঠু, সবাইকে ছাপিয়ে তাঁর মাথা আমাদের দেখছে। আবছা আলোতে তাঁর চশমা জ্বলছে। বারান্দার সিঁড়ির মুখে আসার আগ পর্যন্ত আমরা তাঁর মুখ দেখতে পাইনি। রাস্তার মরা আলো তাঁর ঢোলা সাদা পায়জামাতে জন্ডিসের হলুদ আভা নিয়ে ঝুলছিল। উঠোনের নারকেল পাতার ছায়া ভেঙ্গে পড়ছিল তাঁর মুখে। কাঁধে ঝোলা, গায়ে পাঞ্জাবি, হাতে আরও একটা পেটফোলা ছোট ব্যাগ। মাথায় ঢুলিদের মতো ডুরে গামছা বাঁধা। কাঁধ অবধি লম্বা চুল। সিঁড়িতে পা দিয়েই তিনি মাকে ঠিক দেখে ফেললেন। হৈহৈ করে বললেন, ‘কী সর্বনাশ টুম্পা, তুই তো আর আমাদের পুচকে টুম্পা নেই রে, বিশাল গিন্নি হয়ে গেছিস!’ মা জেঠিমার পেছনে সরে দাঁড়ায় নিরাপদ দূরত্বে। কিন্তু এক সেকেন্ডেরও কম বিরতিতে সবাইকে অবাক করে উচ্ছ্বল কিশোরীর মতো তড়বড়িয়ে নেমে পৌঁছে গিয়েছিল সিঁড়ির মুখে, ‘ওমা খেলুদা! তুমি দেশে এলে কবে ?’ তিনি হাসছেন, স্বস্তির হাসি। মায়ের থমকে যাওয়া হয়তোবা ভড়কে দিয়েছিল তাঁকে। তাঁর পুরু চশমার ভেতর থেকে খুশির ঝিলিক চুঁইয়ে পড়ছে, ‘আরে তুই তো সেই রকমের জিনিয়াস। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল থেকেও ঠিক আমাকে  চিনে নিলি!’

মায়ের উচ্ছ্বাস বশে আসার পরে জানা গেল তিনি মায়ের পাড়াতুতো দাদা। তাঁর অমন দাড়ি আর লম্বা চুল ছিল না। সেই কারণেই মা চিনতে পারেনি। তিনি শিল্পী এবং থিয়েটারকর্মী। মায়ের বিয়ের মাস খানেক আগে জাপানে গিয়েছিলেন বৃত্তি নিয়ে। নানা দেশে ঘুরে প্রায় এগারো বছর পরে দেশে ফিরেছেন। সেও ছয় মাস হতে চলল। চট্টগ্রামে কোনও এক সাংস্কৃতিক গ্রুপের আমন্ত্রণে এসেছেন আজ সন্ধ্যায়। আসার আগে বড় মামার কাছ থেকে মায়ের ঠিকানা নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন অনুষ্ঠান শেষে ফেরার পথে বোনকে  দেখে যাবেন। কিন্তু সব গড়বড় হয়ে গেল। চাটগাঁর অবস্থা যে এত খারাপ জানা ছিল না। ট্রেন দেড় ঘণ্টা লেট। স্টেশনে আয়োজকদের কাউকে পেলেন না। ওদের সংস্থার ঠিকানা লেখা একটা কাগজ মানিব্যাগে ছিল, সেখানে ফোন নম্বরও। কীভাবে যে পড়ে গেল কে জানে! লাভলেইনে আবেদিন কলোনির আশেপাশে কোথাও ওদের অফিস বলেছিল ওরা; মনে আছে। এত রাতে খোলা থাকার কথা নয়, ধারে কাছের হোটেলে উঠবেন ভেবে রিকশা ভাড়া করতে গিয়ে জানলেন ওদিকে বিকেল থেকে গণ্ডগোল চলছে। স্টেশনেই রাত কাটিয়ে ভোরের ট্রেনে ফিরে যাবেন ভাবছিলেন হঠাৎ তখনই টুম্পার কথা মনে পড়ল। পরিকল্পনা তো ছিলই আসার, কেবল সময়টা এদিক-ওদিক। একটাই ভয় ছিল তাঁর এই ডাকাতে চেহারা দেখে টুম্পা যদি না চেনে! তাঁর বলার ধরনে নিমেষে গুমোট পরিবেশ হাল্কা হয়ে গেল। খানিক পরেই বেশ জমে উঠল বাড়ি।

আমি যে ঘুমের সময় পার করে দাঁড়িয়ে আছি কেউ খেয়াল করেনি। মা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই দেখে ফেলল, ‘ও মা পাকা বুড়ি, তুই এখনও দাঁড়িয়ে!’ তারপরে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘খেলুদা আমার কন্যা, রজতপ্রভা।’ কানে হাত দিয়ে বেশ জোরে উনি জানতে চাইলেন, ‘কী নাম ?’ মাও বেশ চেঁচিয়ে বলল, ‘রজতপ্রভা’! উনি বললেন, ‘আরেব্বাস এ তো দাঁতকপাটি লাগার মতো নাম’। অমন জোরে উত্তর দেওয়ায় সবাই বেশ চমকে তাকাল। উনি যেন বুঝলেন। হাত জোড় করে বললেন, ‘আমি কানে কম শুনি’। পরক্ষণেই আমার দিকে হেসে বললেন, ‘ভ্যান গখের মতো আমি এক-কানা। তোমার মায়েরা ছেলেবেলায় আমায় ভ্যানগাড়ি দাদা ডাকত। তোমায় নিশ্চয়ই ভ্যান গখের গল্প শুনিয়েছে মা ? সেই যে রবি ঠাকুরের ‘সুন্দর বটে তব অঙ্গদখানি তারায় তারায় খচিত’ গানটার মতো রাতের আকাশের ছবি যিনি এঁকেছিলেন ? সূর্যমুখী তো নির্ঘাৎ আঁকিয়েছে তোমায়।’ নাহ। মা আমাকে এই নাম বা গল্প কিংবা গান কিছুই বলেনি। তবে সূর্যমুখীর ছবি সত্যিই আঁকিয়েছে। কিন্তু উনি জানলেন কীভাবে ? উনি আমার উত্তরের অপেক্ষায় নেই। নিজের মনেই কথা বলছেন, ‘জানো তো যারা কানে কম শোনে তারা চেঁচিয়ে কথা বলে। আমার গলার আওয়াজ তাই অমন বিচ্ছিরি বাজখাঁই। রজতপ্রভা তুমি হাই তুলছ মানে ঘুমের সময় পেরিয়ে গেছে তোমার। কাল তোমার সঙ্গে গল্প করব। বড় অবিবেচকের মতো কাজ হলো সবার দেরি করিয়ে দিলাম।’ দাদু ঠাম্মাকে বলল, কুটুমের খাওয়ার ব্যবস্থা করো। রাত তো বাকি নাই বেশি। মা রান্নাঘর থেকেই বলল, ‘তিতলি তোমার ড্রইং খাতার সূর্যমুখী দেখাও মামাকে’। উনি জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বললেন―একটু চা খেতে পেলে চাঙ্গা লাগত। জেঠিমা গলা পিছিয়ে হাঁক দিল, ‘ছোট, কুটুমের জন্য চা দাও। সঙ্গে আমাদের জন্যেও’।

আমি ড্রইং খাতা আনতে গেলাম। বাবা ফের রেডিও অন করল, বেশ অনেকখানি খবর বেরিয়ে গেছে। আমি ড্রইং খাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা, জেঠু, দাদু সবাই নিচুস্বরে কথা বলছে। পরদিন জুম্মাবার। নামাজ শেষে মিছিল বেরোবে। আরও হামলা হবে। উনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। বললেন সকালে উঠেই চলে যাবেন। লাভলেইনে দশটার দিকে যাবেন কাউকে পেলে তো ভালোই ওরাই যাওয়ার ব্যবস্থা করবে নয়তো উনি যে বাস পাবেন সেই বাস ধরেই ঢাকা ফিরবেন। বাবার বন্ধু সোহেল চাচার খালাতো ভাই আমাদের কোতোয়ালি থানার ওসি। কাল জুম্মার সময় আমাদের বাড়ি ঘুরে যাবেন ওসি সাহেব যেন কোনও মতলববাজ সাহস না করে। বাবা আশ্বস্ত করলেন। সকালে সোহেল চাচার সঙ্গে ফোনে কথা বলে সব ঠিক করে নেওয়া যাবে। আর জেঠু বললেন সেই সংগঠনের অফিসে খোলা পেলেও এই পরিস্থিতিতে কোনও অনুষ্ঠান হবে না। সেই কারণেই এরা উনাকে আনতে যায়নি। উনি সাঁয় দিলেন জেঠুর কথায়, ‘হতে পারে।’ তিনি কথা বলতে বলতেই ইশারায় আমাকে ড্রইং খাতা দেখাতে বললেন। আমি সূর্যমুখীর পাতাটা বার করে দিলাম। উনি হাসতে হাসতে যেন নিজেকেই বলছেন, ‘দেখ একই কাণ্ড করছে মেয়ের সঙ্গেও!’ মা চায়ের ট্রে হাতে বেরিয়ে এল। ‘কপি করিয়েছিস না ?’ মা বলল, ‘ওদের ড্রইং টিচার তিন ধরনের ফুল আঁকতে বলল যে!’ উনি চোখ কুঁচকে মাকে বললেন, ‘ও দেখেছে ফুলটা ?’ মা উত্তর দেওয়ার আগেই উনি আমাকেই জিজ্ঞেস করলেন ফের, ‘তুমি সূর্যমুখী দেখেছ ?’ আমি মাথা নাড়লাম। উনি বললেন, ‘তোমার দেখা তিনটে ফুলের নাম বলো ঝটপট’। আমি বললাম, ‘জবা, নয়নতারা আর সন্ধ্যামালতি’। উনি বললেন,’ ‘বাহ, ওদের কাল দেখবে। চোখ খুলে, মন দিয়ে। এরপরে  চোখ বুজে দেখতে পাও কি না দেখবে। যদি পাও তবেই ওরা ধরা দেবে। আর্ট হবে ড্রইং হবে না’। এরপরে বললেন, ‘তোমার মাকে কেন যে ভ্যান গখের ছবি দেখিয়েছিলাম ছেলেবেলায় সে সূর্যমুখীতে আটকে রইল। অথচ সূর্যমুখী সূর্যের দিকে তাকিয়েই ঝরে যায় সূর্যের কাছে যেতে পারে না, নকল করতে হলে পাখিদের ছবি নকল কর। ওদের ডানা আছে উড়ে উড়ে সূর্যের দিকে যাওয়ার অন্তত চেষ্টা করে’। উনি হাত দুটো হেলিয়ে ওড়ার ভঙ্গি করলেন। দাদু বললেন, ‘আজকের মতো অঙ্কনপাঠ শেষ হোক। ঘুমাতে যাও সোনা’।

আমার ওঁকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। যেতে ইচ্ছে করছিল না। এমন অদ্ভুত কথা আমাকে কেউ বলেনি আগে। চোখ বুজে দেখতে পেলেই ছবি আঁকা যায়! নাহ একজন বলেছে, সেকথা খানিকটা এমনই। জবা। রহিমা খালার মেয়ে জবা। জবা পাখির ছবি আঁকে মন থেকে। ছাদে খেলার সময় ও ইটের টুকরো দিয়ে একটানে ফুল আঁকে। মানুষও আঁকতে পারে। না দেখেই। বলে মনে মনে দেখতে পায়।

খবরে পাহাড়তলির কথা বলছে তখন। জেঠু রেডিওতে প্রায় মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। উনি আমাকে কাছে টেনে নিচু স্বরে বললেন, ‘আমার কাছে জাদু আছে। চাও ?’ আমি মাথা নাড়লাম, উনি দেয়ালের গায়ে আমাদের মাথার ছায়ার দিকে আঙ্গুল তুললেন। ‘এমন আলোছায়া থেকে যদি পাখিদের খুঁজে বের করতে পার তবে দেখবে ম্যাজিক ঘটছে। কপি করতে হবে না তুমি যা চাও তাই-ই আঁকতে পারবে। এমন কি পাখিরা গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে’।

আমি বিছানায় এসে মশারির ভেতর দিয়ে দেয়ালে আলোছায়ার আলিম্পনে পাখিদের খুঁজতে থাকি। হঠাৎ কেন যেন বুকের ভেতর হুহু করে ওঠে! আমার ড্রইং খাতা আছে আমি আর্ট পারি না। জবার ড্রইং খাতা নেই ও মন থেকে আঁকতে পারে।  

আমার ঘুম যখন ভাঙল তখন রোদ লাফাচ্ছে বিছানাজুড়ে। পিপলু নেই পাশে। বাবার বিছানাও পরিপাটি। আজ শুক্রবার। আমাকে ডাকেনি মা! তার মানে নাচের স্কুলে যেতে হবে না। তারপরেই মনে পড়ল উনি আমাকে তিনটে ফুল দেখতে বলেছেন মন দিয়ে। তাড়াতাড়ি বাইরে এলাম। বাবা টেবিলে পেপার পড়ছেন। রান্নাঘরে উঁকি দিতেই মায়ের চোখাচোখি, ‘ঘুম ভাঙল ? দাঁত মেজে জামা পাল্টে এসো। ফুলকো লুচি দেব। তারপরে অঙ্ক করবে’। পিপলু ওর নতুন গাড়ি নিয়ে বাবার পাশে মেঝেতে খেলছে। বাথরুমের দিকে পা বাড়াতেই দেখি রহিমা খালা কাপড় শুকাতে দিয়ে নামছে সিঁড়ি দিয়ে। পেছন পেছন জবা।

মা রহিমা খালাকে বললেন, ‘হাত মুছে খাবারটা দিয়ে এসো উপরে’। আমাকে তাড়া দিলেন, ‘জবার মা আজকেও তাড়াতাড়ি চলে যাবে। মামাও। খেলতে চাইলে ঝটপট খেয়ে অঙ্ক সেরে নাও। আমার কিন্তু অনেক কাজ। দেরি করলে খাবার পাবে না’। আমার মন খারাপ হলো। জেঠিমা ছুটির দিনে সহজে ঘুম থেকে ওঠে না। মায়ের কোনও ছুটির দিন নেই। আমারও নেই।

আমি নাকে-মুখে গুঁজে খাওয়া শেষ করলাম। দেখলাম মা ট্রে গুছিয়ে দিচ্ছে অতিথির জন্য। তবে কি উনি সঞ্জয় দাদার ঘরে ছিলেন রাতে! সঞ্জয় দাদা আমার জেঠতুতো দাদা। আমেরিকায় নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। ঐ ঘরে জেঠিমা কাউকে ঢুকতেই দেয় না। মাসে একবার নিজ হাতে ঘর পরিষ্কার করেন। কিন্তু ওখানে কেন ? বাবা সুফিয়া খালার ট্রের দিকে তাকিয়ে মাকে বললেন, ‘উনি কবে যাবেন ? দুপুরের পরে পরিস্থিতি কেমন হয় বলা যাচ্ছে না কিন্তু। খাবার ওপরে পাঠানোর কী হলো ?’ মা বলল, ‘তুমিই তো উনাকে ওপরে নিয়ে গেলে। এখন বড়দি না খেপলে হয়। রহিমার কাছে চা চেয়েছে। রাতে তো তেমন খাননি, হয়তো খিদে লেগেছে। চায়ের সঙ্গে খাবারটাও পাঠিয়ে দিলাম। তাছাড়া দাদা তো ফেরেননি মর্নিং ওয়াক সেরে’। বাবা বিড়বিড় করলেন, ‘ভ্যান গখগিরি করছে। বাড়ি ফিরে ছবি আঁকার তর সইছে না’। মা উত্তর দিল না। বাবার কথাটা মাথায় ঘুরছে আমার, উনি কি ছবি আঁকছেন ? আমি খেয়ে অঙ্ক করতে ছুটলাম। জবাকে মা খেতে দিয়েছে ভেতর। খানিক্ষণ পরে  জবা এল পিপলুকে নিয়ে। টেবিলের কাছ ঘেঁষে জবা বলল, ‘বেডা এমুন সোন্দর ছবি আঁকতাসে মনে হয় য্যান সত্য’। ‘কে ?’ ‘তুমার মামা। ছোট বাপির গামছা মেলতে গেসিলাম। আল্লারে দেখি সঞ্জয়দার ঘর খোলা। আমি আঁতকা এমুন ডরাইসিলাম, আম্মায় কইল তুমার নাকি মামা’। আমারও তর সইছিল না। খানিক ঈর্ষা লাগছিল আমি দেখার আগে জবা ছবি দেখে ফেলল!

অঙ্ক শেষ করেই ছুটলাম জবার পিছু পিছু। বাবা, জেঠা, দাদু সবাই টেবিলে। বাবা বললেন, ‘মামাকে গিয়ে বল দাদু ডাকছে’।

আমরা ছাদে উঠে দেখি উনি এক মনে আঁকছেন। মাথায় সেই ডুরে গামছা বাঁধা। আমাদের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাননি মোটেই। ঝলমলে হলুদ রঙ টিউব থেকে সরাসরি ক্যানভাসে ফুটকির মতো বসাচ্ছেন চেপে চেপে। এরপরে একটা চ্যাপ্টা ছুরির মতো জিনিস দিয়ে তা থেবড়ে দিচ্ছেন। এমন অদ্ভুত কাণ্ড জবা তো নয়ই, আমিও এর আগে দেখিনি। স্কুলে আমরা এখনও ক্রেয়ন, রঙ পেন্সিল আর মার্কার দিয়ে আঁকি। জবা আমাকে ইশারায় দেখাল মেঝেতে আরেকটা ছবি রোদের আলোয় পাতা। একগোছা মিয়ানো সূর্যমুখী আঁকা তাতে। এদের দেখতে মায়ের মতো হয়রান লাগছে। এটাই তবে তিনি সকালে আঁকছিলেন। অবাক হয়ে  দেখি ক্যানভাসের সেই হলুদ ফুটকি কোনও এক জাদুবলে সূর্যমুখী হয়ে পাপড়ি মেলছে! এরা মেঝেতে পাতা ছবির ফুলগুলির মতো স্থির নয়, হাওয়ায় দুলছে! আমাদের বিস্ময় সরে না। উনি ঝট করে ফিরলেন। পুরু চশমার ভেতরে তাঁর চোখ জোড়া আমাদের এফোঁড় ওফোঁড় করে দেখল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে তড়বড়িয়ে বললাম, ‘বাবা ডাকছে’। জবা শুধরে দিল, ‘দাদু ডাকে’। উনি অপ্রস্তুত হেসে বললেন, ‘আবার বলো। আমি বামদিকে শুনতে পাই না। কান নেই’। আমি জবা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। রাতে নাই-কানের কথা বলেছিলেন বটে, ব্যাপারটা ঠিকঠাক বুঝিনি। উনি গামছা খুলে চুল সরালেন। দেখি কানের জায়গায় বাদামের মতো এক টুকরো মসৃণ মাংসপিণ্ড। আমার আর জবার চোখ গোল হয়ে গেল। ‘একে বলে মাইক্রোশা’। আমাদের দুজনের মুখে চোখ ঘোরালেন, ‘বোঝা গেল না, না ?’ আমরা বুঝিনি। উনি গামছা দিয়ে কানটা ফের ঢেকে দিলেন এবং আমাদের দিকে ঘুরে বসলেন। ‘ব্যাপার হলো কি তোমাদের দুজনকে ভগবান ধীরেসুস্থে সময় নিয়ে মনের মতো করে গড়েছেন আর আমার বেলায় কানটা ঠিকঠাক বানাবার আগেই হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিলাম পৃথিবীতে’। জবা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘আমারে আল্লাহ বানাইছে’। উনি হাসতে হাসতে বল্লেন, ‘তাই ? তিনিও দারুণ কারিগর’। এবার তাঁর হঠাৎ মনে পড়ল এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন ‘ভ্যান গখের কথা বলেছিলাম না কাল  ?’ আমি হেসে দিলাম। মনে পড়ল মায়েরা উনাকে ভ্যানগাড়ি দাদা বলতো। উনি জবার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভ্যান গখ মস্ত বড় শিল্পী ছিলেন। তাঁর আঁকা সূর্যমুখী জগদ্বিখ্যাত। তিনি নিজের কান কেটে ফেলেছিলেন’। জবা আঁতকে উঠল, ‘ও আল্লাহ. নিজে নিজের কান কাইট্যা বয়রা হয়নি কেউ ?’ উনি হাসতে লাগলেন। বললেন, ‘আমিও বয়রা। বামদিকে একটুও শুনতে পাই না। ডানদিকেও খুব যে শুনি তা নয় কিন্তু ঠোঁট নড়লেই পড়তে পারি। মানে তুমি আওয়াজ না করে কথা বললেও আমি শুনে ফেলব’। আমি অধৈর্য হয়ে জানতে চাইলাম, ‘ভ্যান গখ কান কাটলো কেন ?’―‘ও কানে বেশি শুনছিল। তাই ছবি আঁকতে পারছিল না’। ‘ওমা! কানে বেশি শোনা ভালো না ?’ তখনই সেই অদ্ভুত কথাটি বলেছিলেন তিনি; আমি আজও ভুলিনি, ‘সব শোনা ভালো না। ছবি আঁকতে হলে মনের চোখ খুলতে হয়। কথা বেশি হলে মনের চোখ ঘুমিয়ে পড়ে’। উনি হাসছিলেন। ‘আচ্ছা তোমার ছোট নামটা কী যেন ?’ আমার আগেই জবা তড়বড়িয়ে বলল, ‘তিতলি’। আমি জবার দিকে রেগে তাকালাম। ‘বাহ ভারী সুন্দর নাম তো ? তুমি দেখতেও প্রজাপতির মতো। তোমরা দুজনই পরির মতো সুন্দর। তোমার নাম কী ?’ তিনি জবাকে জিজ্ঞেস করলেন। এবার আমি উত্তর দিলাম, ‘জবা’। ‘আরে বাহ! একজন ফুল আরেকজন প্রজাপতি! এই ফুলটাতে একটা প্রজাপতি আঁকতে হবে। কী রঙের পাখা হবে বলো তো ?’ আমরা উত্তর দেওয়ার আগেই রহিমা খালা দাঁড়ালেন এসে। আমাদের দুজনের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে খাবারের ট্রেতে চায়ের কাপ তুলতে তুলতে বললেন, ‘আপনারে খালুজান ডাকে’।―‘ও হো বাচ্চারা বলেছিল, আমিই দেরি করলাম। কী কাণ্ড বলো তো! মেসো নিশ্চয়ই বিরক্ত হয়েছেন। বড় অন্যায় হয়ে গেল!’  বলতে বলতে উনি তুলি নামিয়ে রহিমা খালার আগেই দুদ্দাড় করে নেমে গেলেন। রহিমা খালা জবাকে বকতে লাগলেন। আমিও সিঁড়ি টপকে দ্রুত এলাম নিচে।

সেই দিন উনি আরেক দফা চা খেয়েছিলেন দাদুর সঙ্গে গল্প করতে করতে। জেঠিমা জানতে চেয়েছিল স্নানের জন্য গরম জল চাই কি না। চাইলে রহিমা যাওয়ার আগে স্নানঘরে দিয়ে আসবে। উনি মাকে ডেকে বললেন, ‘টুম্পা, তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন অদ্ভুত তো! সকাল না হতেই আমাকে বেরুনোর তাড়া দিচ্ছে’। জেঠিমা হাসছিলেন। এইসব হাসিঠাট্টা কানে যাচ্ছিল না আমার। আমি  নয়নতারা, সন্ধ্যামালতি আর জবা ফুল দেখছিলাম মন দিয়ে।

নিচের ঘরের জানালার পাশেই জবা ফুলের গাছ। খোলা জানালা দিয়ে টেবিলের ওপরে তার পেট মোটা ব্যাগটা দেখলাম। রাতে উনি নিচের ঘরে ছিলেন। ওখানেই অতিথি এলে থাকার ব্যবস্থা হয়। বাবা বেরিয়ে জানালেন সোহেল চাচা জানিয়েছেন তিনি নিজে গাড়িতে করে তাঁকে পৌঁছে দেবেন। বাস না চললেও অসুবিধা নেই। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। উনি সব শুনে মনে হলো খুব খুশি। মাকে ডেকে বললেন, ‘তুই খাবার রেডি কর, আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে নেমে স্নান সেরে আলবিদা  বলব। পরের বার তোর জা যতোই আড়েঠাঁড়ে বলুক বছরখানেকের আগে নড়ছি না।’ জেঠিমা বললেন, ‘এমন মজার মানুষ পরেরবার যেতে চাইলেই যেতে দেওয়া হবে না’। উনি উপরে ওঠার সময় আমি সিঁড়ির কাছে এলাম। আমাকে দেখে  বললেন, ‘যাই তবে, তিতলির ছবিটা তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলি’। মা বলল, ‘সে কি, মামাকে এরই মধ্যে বায়না দিয়ে এসেছ ?’ আমি উত্তর দেওয়ার আগেই তিনি বললেন, ‘তিতলি লক্ষ্মী মেয়ে। তুই তো ছেলেবেলায় আমাকে ছবি আঁকতে দেখলেই সূর্যমুখী এঁকে দাও বায়না করতি, তাই তোকে এঁকে দিতাম না। তিতলিকে আমিই বলেছি একটা ঝলমলে তিতলি এঁকে দেব সূর্যমুখীর উপর’, বলেই মায়ের দিকে হাসলেন। ‘তবে তোর বিয়ের উপহারটা পাওনা ছিল, এঁকেছি। বাসি উপহার’। মাকে কেমন লাল লেগেছিল কি ? এত কিছু খেয়াল করে দেখার বয়স হয়নি আমার। এই সব খুঁটিনাটি হয়তোবা আমি পরে নিজেই ভেবেছি। কিন্তু শ্যননকে বলবার সময় এমনই একটা দৃশ্য কেন যেন চোখের সামনে ভাসছিল আমার। উনি ওপরে ওঠার সময় মাকে বললেন জবাকে দিয়ে একটা পলিথিনের ব্যাগ পাঠা তো তুলিগুলি পরিষ্কার করার সময় নাই, আলাদা করে ভরতে হবে’। আমি পেছনে নয়নতারার ঝাড়ের কাছে চলে গিয়েছিলাম।  

রহিমা খালা চলে গেলেন জবাকে নিয়ে। বলে গেলেন পরিস্থিতি ভালো না থাকলে আর বিকেল আসবে না। ছাদ থেকে নামার পরে জবার সঙ্গে ভালো করে কথাই হয়নি আর। ও যেন দূরে দূরেই থাকছিল নানা কাজের ছুতায়। জবারা চলে যাওয়ার পরেই বাড়িটা হঠাৎ সুনসান হয়ে গেল। 

আমার খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করছিল। ছবিটা কতটা হলো। ভগবান যেন আমার কথা শুনতে পেয়েছিলেন। এগারোটার  দিকে সোহেল চাচা ফোনে জানালেন তিনি আসছেন এই মামাকে নিতে।  বাবা মাকে বলল, ‘উনি তো এখনও নামলেন না!’  মা বলল, ‘আমার হয়ে গেছে খাবার দিচ্ছি। তিতলি যাও তো মামাকে ডেকে আনো।’। জেঠিমা জানতে চাইল, ‘তিতলি বিছানায় বসে আঁকছে না তো ? বললাম ‘না। একটা বোর্ডে লাগিয়ে আঁকছে।’ মা বলল, ‘ওকে ইজেল বলে। বোকা’। জ্যাঠিমা বলল, ‘এত কিছু নিয়ে এসেছে! বাবা টিপ্পনী কাটল আবার, ‘ভ্যান গখ বলে কথা’। আমি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতেই বাবা বলল, ‘তিতলি তুমি থাকো আমিই যাচ্ছি’। আমার খুব রাগ হলো।

মিনিট খানেকের মধ্যে বাবা একা নামলেন, ‘উপরে তো কেউ নেই।’ সবাই তখন খাবার ঘরের টেবিল ঘিরে। কেবল ঠাম্মা পুজোঘরে আর পিপলু টিভির সামনে। বারান্দার সঙ্গেই লাগোয়া ছাদে ওঠা-নামার সিঁড়ি। জেঠু অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘ব্যালকনিতে দেখেছিস ?’ বাবা বলল, ‘সবখানে দেখেছি’। জেঠু ছুটে গেল ওপরে। বাবা আর জেঠিমাও। রহিমা খালা যাওয়ার পরে দাদু গেইট বন্ধ করেছে। জেঠিমা নেমে এসে জানাল, ‘ইজেলে ছবিটা আছে। নিচেও একটা ছবি পাতা আর একটা রঙের টিউব’। মা রান্নাঘরের দরজা ধরে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। 

দাদু ওপরে গিয়ে সঞ্জয়দাদার ঘরে তালা দিয়ে এলেন। দাদুর সঙ্গে আমিও গিয়েছিলাম পিছু পিছু। দরজার মুখেই উনি আঁকছিলেন বসে। ইজেলে আমার জন্যে আঁকা ছবিটা শেষ হয়নি। যতটা আমি দেখেছি ততটাই। মায়ের জন্যে আঁকা ছবিটা আগের মতোই মেঝেতে পড়ে আছে। তার পাশে হলুদ রঙের টিউব। আমার খুব অপমান লাগছিল। কান্নাও। জবার সামনে বলেছিলেন তিতলি এঁকে দেবেন।

দাদু বাবা আর জেঠুকে বললেন, ‘সোহেল এলে ওকে বলো যে উনার লোক এসেছিল নিয়ে গেছে। আর চুপচাপ থাকো’। 

মা স্তব্ধ হয়ে বসেই রইল। ঠাম্মা পুজো শেষ না করেই উঠে এল। বারবার বলতে লাগল, ‘রাগ করে নি তো ?’ দাদু রেগে গেলেন, ‘রাগ তো আমরা করব। অমন চেঁচিয়ে কথা বলে কানের পর্দা ফাটিয়ে দিয়েছে। নিচে উপরে দুই ঘর খুলিয়েছে’। আমার প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছিল। আমি চোখ বুজে নয়নতারা দেখতে চাইছিলাম। কিছুতেই মনে ভাসছিল না। বরং ওঁর আঁকা অসমাপ্ত সুর্যমুখীটাই দোল খাচ্ছিল মনে। 

খানিক পরেই সোহেল চাচা এলেন। অতিথি চলে গেছেন শুনে দেরি করলেন না, গেইট থেকেই দাদু আর ঠাম্মাকে,  সালাম জানালেন। জুম্মার মিছিলের সময় যেন কেউ ছাদে না থাকে মনে করিয়ে দিলেন আর গেইট বন্ধ রাখতে বললেন। আশ্বস্ত করলেন উনার ভাইকে বলা আছে, কোনও বিপদ হবে না। ঘণ্টাখানেক পরেই মিছিল বেরুল। ‘নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবর’―সেই গা হিম করা আওয়াজ তুলে মিছিল গেল। আরও ঘণ্টাখানেক পরে বাবা বড় মামাকে ফোন দিলেন। সব শুনে মামা অবাক। মাকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন ঠিক চিনেছে কি না। ঠিকানা দেওয়া দূরের কথা, উনি যে বাংলাদেশে সে কথাই জানেন না বড়মামা। ওদের বাড়িতে কেউ থাকে না। রিয়েল্টরের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে দু-তিন বছর আগে। ভাই কোথায় জানেন না। তবে একমাত্র বোন ঢাকায় থাকে মামা শুনেছেন। মামা খবর নিয়ে জানাবেন বললেন।

কেউই এর মাথামুণ্ডু উদ্ধার করতে পারল না। পরের দিন রহিমা খালা কাপড় শুকাতে দিতে গিয়ে জানাল ছাদের ঘরে লাইট জ্বালানো। বাবা আর জেঠু তখন অফিসে। দাদু, ঠাম্মা, জেঠিমা গেল দেখতে। সবাই মুখ গম্ভীর করে নামল। মায়ের হাতে ছবি দুটো তুলে দিলেন দাদু। বললেন, ‘কেউ এসেছিল। ব্যালকনির দরজা বাইরে থেকে টেনে বেঁধেছিল পুরো লাগেনি। আর একটা লিফ্লেট পড়ে আছে টেবিলের ফাঁকে। মায়ের হাতে লিফলেটটাও দিলেন দাদু। স্বৈরাচারবিরোধী সেøাগান লেখা আর বামপন্থি রাজনৈতিক দলের লোগো। দাদু বলল, ‘বুঝেছ কেন পালাল ?’  সোহেলের ভাই ওসি জেনেই পালিয়েছে। মায়ের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। একটা বিপদ হতে পারতো। বাবা সরকারি চাকরি করে। ছবি দুটো মা দুপুরে খুলল। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, প্রজাপতি আঁকা। মাকে জানালাম ওটা আঁকা ছিল না ওখানে। মা, দাদু আর জেঠিমাকে দেখাল। দাদুর অতশত মনে নেই কিন্তু জেঠিমার মনে আছে ছবিটাতে ফাঁকা জায়গা ছিল খানিক। আমি কাঁদতে কাঁদতে আঙ্গুল দিয়ে দেখালাম, ‘উনি আমাকে প্রজাপতি এঁকে দেবেন বলেছিলেন। এইখানে ফুলটাতেই। এঁকে দিয়ে গেছেন। জবাও জানে’। কেউ কিছু বলল না। বিশ্বাস করল না হয়তোবা। মা আমাকে কোলে টেনে বলল, ‘হ্যাঁ, উনি কথা রেখেছেন। তোমাকে ফুল এঁকে দিয়ে গেছেন, প্রজাপতিও। কিন্তু উনি আমাদের ছোট করেছেন সবার কাছে। তাই আমরা এই গল্প আর কারও কাছে করব না। জবার কাছেও না’। বিকেলে সব শুনে বাবা আর জেঠু আবার উপরের ঘরে গেল। ব্যালকনির দিকের দরজাতে চেয়ার ঠেকা দিল। নিচে নেমে ছবিগুলো বাবা উঠোনে ছুড়ে ফেললেন। বাবা সরে গেলে মা দুটো ছবিই বাক্সে তুলে রেখেছিল। জেঠু পরে খবর এনেছিলেন, আবেদিন কলোনির আশেপাশে কোনও সাংস্কৃতিক সংগঠন নাই।

মামা এসেছিল সেই বছর। ছবিগুলো দেখেছিল। আমার ছবি সম্পূর্ণ হওয়ার গল্পটা শুনেছিল। পোক্ত সাক্ষী পাইনি আমি। জেঠিমা একবার বলল হ্যাঁ আরেকবার বলল, মনে হয়। আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম ছবিটা, তাই জানতাম উনি এসেছিলেন। আর বড় মামার কথা হয়েছিল উনার বোনের সঙ্গে। কারও সঙ্গেই যোগাযোগ নেই তাঁর। রাজনীতির ব্যাপারটা বড় মামা বললেন, ছাত্র থাকাকালে ঐ সংঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার গুজব আছে। 

শেষ অথবা শুরু

শ্যনন ঢাকা ছাড়ার পরে আমি ছবিটা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। ফুলগুলোর রঙের তারতম্য তো বটেই ব্রাশের স্ট্রোকের তারতম্যও বেশ ধরা যায় এখন। প্রজাপতির পাখা লেপ্টে আছে। অপরিপক্ক হাতের কাজ। কেন আমরা ধরতে পারিনি তখন ? আমি না হয় শিশু, অন্যেরা কেন দেখল না ? শ্যনন যতই ভরাট-খালির ফোকাস বোঝাক আমার মনের ধন্ধ যায় না। মাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত করি এই এক প্রশ্ন নিয়ে। একদিন মা বলল, ‘ছবি নিয়ে আদৌ কেউ ভাবছিল কি ? খেলুদা কেন এল তাই নিয়েই সকলে গবেষণায় ব্যস্ত ছিল। বিয়ের প্রায় এগারো বছর পরেও আমার প্রেম অপ্রেম নিয়ে গোয়েন্দাগিরি চলেছিল। আমিও জানতে ইচ্ছুক ছিলাম কেন এসেছিলেন তিনি ?’ মায়ের গলায় বিষণ্নতা ঝরে পড়ছিল। আমার কানে ফের বাজছিল, হয়রান হয়ে গেলাম রে! এতদিন যা মনে আসেনি তাই মনে এল : আমার মায়ের জীবনটা ভদ্রলোক আরও বিগড়ে দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ছবিটা ভরাট করবার দরকার পড়েছিল কেন ? কে করল ?

এক দুপুরে ছবিটার কথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো ওর মুখ ভেসে উঠল। জবা! জবাই করেছিল এই কাজ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পিপলুকে ফোন দিলাম : জবার ঠিকানা চাই।

পিপলুকে এমনি কিছু বললে মাস কাবার করে কিন্তু এইবার সে দুই দিনের মাথাতেই অনেক তথ্য জোগাড় করেছিল। অবশ্য যেটি জরুরি সেটি ছাড়া। খালা বস্তিতে থাকে না আর। কোথায় থাকে খবর পায়নি। জবা এক এন.জি.ও.র সেলাই শিক্ষা কেন্দ্রে সেলাইয়ের কাজ শিখত এবং ওদের অর্ডারি সেলাইও করতো―এমনই জানতাম। এর পরে ও গার্মেন্টসে কাজ করে তাও শুনেছিলাম। কিন্তু এখন কোথায় সে তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বস্তির একজন খবর দেবে বলেছে। 

বস্তির সেই লোক নয়, প্রায় পাঁচ মাস এবং বিস্তর ঘোরাঘুরির পরে আমাদের পাড়ার এক দোকানির কাছ থেকে খবরটা পেয়েছিল পিপলুর ড্রাইভার। জবা অসুস্থ। মেথর পট্টির ঐদিকে কোথাও ভাড়া বাসায় থাকে। ওর বিয়ে হয়েছিল তবে স্বামীর সঙ্গে বনিবনা নাই। মেয়ে আছে। স্কুলে পড়ত। জবার টিবি। কাজ থেকে ছাঁটাই হয়ে গেছে। তবে ওর মেয়েকে নিয়েছে সেই গার্মেন্ট কোম্পানি। খুব মন খারাপ হলো শুনে।

পিপলুই নিয়ে গিয়েছিল আমাকে। কিন্তু ভেতরে গেল না। আমি একাই ঢুকলাম। আমাকে দেখেই চিনল সে। আমি সেই হাড়মাংসের অবয়বে কোত্থাও ছেলেবেলার তেজি জবাকে পেলাম না। ও বিষণ্ন হেসে জানতে চাইল, ‘আপনি ভালো আছেন ?’ খট করে কানে লাগল। ‘তুমি আমাকে আপনি করে তো বলতে না!’ ও হাসল, ‘ছুডুকালে সক্কলে ছুডুই থাকে। বড় হইতে হইতেই উঁচানিচা জ্ঞান হয়। আপ্নে উঁচা তাই আপ্নে। আমি নিচাতেই, তুমি কইরা কওনই জায়েজ’ ।

আমি কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছিলাম না। যে চৌকিতে বসেছি তার নিচ থেকে একটা তোরঙ্গ টেনে বার করে জবা। সেটি খুলে ভেতর থেকে কাপড়ে মোড়ানো একটা প্যাকেট চৌকির ওপর আমার পাশে রাখে। প্যাকেটটা খুলতে খুলতে বলে, ‘আপ্নারেই দিব বইলা রাখসিলাম। আম্মার নজর বাঁচাইতে বাঁচাইতেই জীবন শ্যাষ। আমি ভাবসিলাম আপনি আরও আগে বুঝবেন’। প্যাকেট খুলতেই এক গাদা তুলি, সেই হলুদ টিউব এবং এক প্যাকেট রঙ। হলুদ টিউবটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমি হাত পেতে নিই। লোহার মতো শক্ত। ‘আপনি তো জানতেন আমি আঁকতে পারি, কিন্তু উনার মতো পারার কথা না। অনেক চেষ্টা করছিলাম তারপরেও পাপড়ি মিলাইতে পারি নাই। সঞ্জয় দাদার ঐখানে পেন্সিল আছিল না। তোকাইতে গেলে আওয়াজ হইতো। ভুরে আইসা করসি তো। আলো ফুটে নাই। আম্মা মনে করসে টাট্টির লাইনে। আম্মা তো আপনাগো বাড়িত যাইয়াই কাম সাইরতো। হাত কাঁপতেসিল। উনারে আমিই বাইর কইরা দিসিলাম। সামনে দিয়াই গেছেন। আপ্নে তখন পিছে, ফুল গাছের তলে। সেই কারণে দেখেন নাই। আমি ব্যাগ নামাইছি ছাদের কিনার দিয়া’। আমি অবাক হয়ে জানতে চাই, ‘কিন্তু কেন ?’ ‘পলিথিনের ব্যাগ চাইসিল না ? আমি উপ্রে দিতে গেস্লাম। উনি আমারে আঁকতে পারি কি না জিগান। সুময় নাই। আপনারে কথা দিসিলেন। আপনারে তো আমি তখন চিনতাম। কাইন্দা ভাসাইবেন। উনি প্রজাপতি আঁকবেন কইসিলেন না ? উনি খুব মন খারাপ করতেসিলেন। কইলেন থাকলে ছোট বাপির বিপদ হইবে। আমি বুঝি নাই। আমি বলছি আমি প্রজাপতি আইকা দিবো নে। তিতলি বুঝবে না। উনি পয়সা দিতে চাইসিলেন আমি নিই নাই। তখন আমারে এই সব তুলি দিলেন। রঙ দিলেন। তখন বুঝি নাই পয়সাই দরকার আমার, তুলি, রঙে পেড ভরে  না।’ আমার চোখ দিয়ে অবিরাম জল গড়ায়। ও কাশতে থাকে। আমি নিজেকে সামলে বলি, ‘কেউ বোঝেনি উনার আঁকা নয়। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। প্রজাপতিটা না থাকলে আমার আসলেই মন খারাপ হতো। আমি তোমার চিকিৎসা করাব। তুমি ছবি আঁকবে। তোমার মেয়েকেও আমি পড়াব’। ও উত্তর দেয় না। মুখে কাপড় দিয়ে কাঁদতে থাকে।

ফেরার জন্য উঠে দাঁড়াতেই ও আমাকে মাথার আঁচল সরিয়ে দেখায়। ওর ডান কানের চেয়ে বাম কান বেশ খানিকটা ছোট। ও হাসতে হাসতে বলল, ‘আগে দ্যাখছিলা ?’ আমি মাথা নাড়ি। কখনওই চোখে পড়েনি। ও বলে, ‘তিনি দ্যাখসিলেন’ তারপরে বলে, ‘ছুডুকাল সোন্দর’। ও আমাকে ফের তুমি বলছে! আপন ভাবছে! আমি ওকে জড়িয়ে বলি, ‘বড়কালও আমরা সুন্দর বানাবো’। ও হাসে। তারপর বলে, ‘কান ছুডু তয় হুনি বালাই। ভ্যান গখের মতন এক―কানা না’। ও হাসে। আমি অবাক হই জবাও ভ্যান গখ মনে রেখেছে! আমরা দু-জনই হাসতে থাকি। আমি জানি ওর চোখের সামনেও সেই স্মৃতি ভাসছে। আমিও যেন দেখছি জবা গালে হাত দিয়ে বলছে, ‘ও আল্লাহ নিজে নিজের কান কাইট্টা বয়রা অয়নি কেউ ?’  হাসতে হাসতে আমার চোখ দিয়ে জল গড়ায়। জবার ফের কাশি ওঠে। আমি মনে মনে বলি, তোমাকে ভালো হতেই হবে। 

বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমায় ভালোবাসতেন ?’ মা আমার চোখ ছুঁয়ে তাকিয়ে বলে, ‘মুখ ফুটে যদি বলতো কখনও হাত ছাড়তাম না’।

আমি মার কোলে মাথা রাখি। জানি মা কাঁদছেন…

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button