আর্কাইভগল্প

গল্প : মুই তোরে কোচপাঙ : বিশ্বজিৎ চৌধুরী

বনশ্রী টিচার, মানে বাঘাইছড়ি সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা বনশ্রী সেনগুপ্ত নিখোঁজ বা অপহরণ হওয়ার পর রাঙ্গামাটি সদর ও আশেপাশের পার্বত্য উপজেলাগুলোতে বড় ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা ২০০৪ সালের মার্চ মাস। আমি তখন বাঘাইছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।

পাহাড়ে বাঙালিদের সংগঠনগুলো মিছিল-মিটিং, মানববন্ধন ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে অপহরণের জন্য পাহাড়ি সংগঠনগুলোকে দায়ী করলেও নানা উপদলে বিভক্ত পাহাড়ি সংগঠনগুলো এর দায় অস্বীকার করে আসছিল। মনে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা কমিটির বৈঠকের আলোচনায়ও একটি বিষয়ে প্রায় সবাই একমত হয়েছিল যে, এ যাবৎ আর যাই হোক পাহাড়ি সংগঠনের সদস্যরা কোনও বাঙালি নারী অপহরণের মতো দুষ্কর্মে জড়ায়নি। তাছাড়া বনশ্রী এমন কোনও বিত্তবান পরিবারের সদস্য নয় যে, তাঁকে আটকে রেখে কিছু টাকা-পয়সা আদায়ের মতলব হাসিল করা যাবে।

বনশ্রীর পরিবার চট্টগ্রাম শহরে বাস করত। মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রায় সাত দিন পর পরিবারের কেউ একজন, সম্ভবত বনশ্রীর বড় ভাই এসে থানায় মামলা দায়ের করে গিয়েছিল। পত্র-পত্রিকাগুলো বনশ্রী অপহরণের সম্ভাব্য নানা কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে শুরু করলে আমার ওপর চাপ বাড়ল। এসপি সাহেব বললেন, ‘এই মামলার তদন্তভার তোমার ওপর হাকিম।’

আমি উত্তরবঙ্গের মানুষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে পুলিশের চাকরিতে ঢুকেছি। কর্তৃপক্ষ আমার ওপর প্রসন্ন হলে এই পাহাড়-জঙ্গলে আমার পোস্টিং হয় না। সুতরাং চাকরি নিয়ে আমি যারপরনাই হতাশ ও গ্লানিময় দিন কাটাচ্ছিলাম তখন। দায়সারা কাজ করলে বনশ্রীর মামলাটি চাপা পড়তে সময় লাগবে না তা আমি জানি। আমি সে পথে যেতেও পারতাম। কারণ, এই ব্যর্থতার কারণে আমার নতুন করে শাস্তিমূলক বদলি আর কীইবা হতে পারে! আর কোনও উঁচু পাহাড়, বা সুন্দরবন বাদ দিলে এর চেয়ে ঘন জঙ্গল এই দেশে আর কোথায়! সুতরাং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা কর্তব্যনিষ্ঠা কোনওটা নিয়েই চিন্তিত ছিলাম না আমি। কিন্তু আড়াল থেকে যেন আমাকে প্ররোচনা জোগাচ্ছিল স্বয়ং বনশ্রী সেনগুপ্ত। আমি তাঁকে চিনতাম বলেই হয়তো তার অন্তর্ধান বা অপহরণের কারণ বের করা, কিংবা বেঁচে থাকলে উদ্ধার করার একটা তাগিদ ভেতর থেকেই অস্থির করে তুলেছিল আমাকে।

প্রথমবার বনশ্রীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল থানায় আমার জন্য নির্ধারিত নামফলক লাগানো কামরাটিতে। বাঘাইছড়ি স্কুলের দুজন শিক্ষিকাকে সঙ্গে নিয়ে প্রধান শিক্ষক অনন্ত বিকাশ চাকমা এসেছিলেন আমার কাছে একটি নালিশ জানাতে। সম্ভবত প্রতিবেশীর সঙ্গে স্কুলের জায়গা-জমি সংক্রান্ত কোনও বিরোধ। স্কুলটি সরকারি, সুতরাং এর সম্পত্তি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা প্রশাসনের দায়িত্ব―এ কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমার সাহায্য চেয়েছিলেন অনন্ত চাকমা। আমি তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলাম এবং যতটুকু মনে পড়ে, দু-একদিনের মধ্যেই লোক পাঠিয়ে সমস্যাটির সুরাহা করেছিলাম।

সেই প্রথম দিন দুজন শিক্ষিকার মধ্যে একজনের প্রতি আমি বিশেষভাবে কৌতূহলী হয়েছিলাম দুটি কারণে। প্রথমত তিনি ছিলেন চোখে পড়ার মতো সুন্দরী, দ্বিতীয়ত আমার ধারণা হয়েছিল তিনি আদিবাসী তো ননই, পাহাড়ি বাঙালিও নন। এতদিনের চাকরিসূত্রে আমি পাহাড়িদের চালচালন কথাবার্তা বলার ধরন চিনতে শিখেছি। আমার অনুমান সত্যি হয়েছিল। বনশ্রী সেদিন জানিয়েছিলেন, তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে সরকারি স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা পদে যোগ দিয়েছেন। আগে হাটহাজারি এলাকায় একটি স্কুলে ছিলেন, সম্প্রতি বদলি হয়েছেন এই স্কুলটিতে। আমি তাঁকে আমার মতো দুর্ভাগা ভেবে সমবেদনা জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু মিস সেনগুপ্ত আমাকে বলেছিলেন, বাঘাইছড়িতে একটি স্কুলে পোস্টিং হওয়ায় তাঁর কোনও মনোবেদনা বা ক্ষোভ তো নাইই, বরং চাকরির সুবাদে এমন একটি প্রকৃতিশোভিত অঞ্চলে থাকতে পেরে তিনি প্রকৃত অর্থেই সুখী। এমনকি দীর্ঘ ছুটির দিনগুলোতে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে এখন নাকি তাঁর মন টেকে না। আশ্চর্য, এই পৃথিবীতে কত মানুষের মন কত রকম! মাত্র চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী একটি শহুরে মেয়ের মুখে এ রকম কথা শুনে সন্দেহ নাই যারপরনাই বিস্মিত হয়েছিলাম সেদিন। আমার এই বিস্ময়ের অভিব্যক্তি বোধহয় চেহারায় ফুটে উঠেছিল, বনশ্রী হেসে বলেছিলেন, ‘আসলে আমার ভাগ্য আমাকে এখানে টেনে এনেছে। বনের শোভা হয়ে থাকব বলেই না আমার নাম বনশ্রী।’

স্বীকার করি আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম, কেননা বনশ্রীর সামান্য ঠোঁট টেপা হাসির রেণু সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল।

এরপর এখানে-ওখানে সরকারি দিবসের অনুষ্ঠানে আরও দু-একবার দেখা হয়েছে। কথা বলার সুযোগ খুব একটা হয়ে ওঠেনি, কেমন আছেন, ভালো… ইত্যাদি, অথবা শুধুই সৌজন্য রক্ষার মতো দৃষ্টিবিনিময়।

কিন্তু একবার বিজু উৎসবের পরদিন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার স্থানীয় এক সাংবাদিকের বাড়ির উঠানে খুব জমিয়ে আড্ডা হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে আমরা দুজনই এ অঞ্চলের বাইরে থেকে আসা লোক বলে পাহাড়িদের খাবারের আইটেম, এই যেমন বাঁশকোড়ল দিয়ে চিংড়ি শুঁটকি, সাবারাং পাতা দিয়ে মুরগির মাংস বা বাঁশের ফালিতে কাতাল মাছের রান্না নিয়ে আলাপ শুরু করেছিলাম মনে আছে। অতিথিদের সবার হাতে হাতে ছিল দোচুয়ানি নামের এখানকার জনপ্রিয় মদ। এরকম একটি গ্লাস বনশ্রীর হাতেও দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনি পান করেন ?’

সারা মুখে হাসির রেণু ছড়িয়ে বনশ্রী বলেছিলেন, ‘না, ভান করি। একটা দুটো চুমুক দিই… বাকিটা আড়ালে ফেলে দিই।’

আমার পানাভ্যাস ছিল না বলে এই বুদ্ধিটা বেশ মনে ধরেছিল। ডিনারের আগে পর্যন্ত হাতে পানীয় ভরা একটি গ্লাস নিয়ে আমিও একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিলাম।

ওই অনুষ্ঠানে গানবাজনা হয়েছিল। তবে সবচেয়ে মজার কাণ্ড ঘটেছিল একটি কবিতা পাঠ নিয়ে। এক ভদ্রলোক, সম্ভবত কবি হিসেবে তিনি স্থানীয়দের কাছে সমাদৃত, কবিতা পাঠ করতে করতে অঝোরে কাঁদছিলেন। শ্রোতাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল সেই বেদনা। চাকমা ভাষার কবিতা বলে এর বিন্দু-বিসর্গ কিছুই বুঝতে পারছিলাম না আমি। কিন্তু তার চেয়েও যেটা দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছিল সেটা হচ্ছে কবির অশ্রুপাত। ভদ্রলোক কাঁদছেন কেন ? আমার এই বিস্মিত প্রশ্নের উত্তরে বনশ্রী আমাকে বহুলশ্রুত একটি ইংরেজি কোটেশন শুনিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ঙঁৎ ংবিবঃবংঃ ংড়হমং ধৎব ঃযড়ংব ঃযধঃ ঃবষষ ড়ভ ংধফফবংঃ ঃযধঁমযঃ.’

ছাত্রজীবনে এরকম বাণী-চিরন্তনী ঢের শুনেছি, ফলে খুব একটা চমৎকৃত হওয়ার কিছু এতে ছিল না। তবে এরপরই পৃথিবীর প্রথম কবিতা কীভাবে রচিত হয়েছিল সেই আশ্চর্য গল্পটা আমাকে শুনিয়েছিলেন বনশ্রী।

তমসা নদীতে স্নান করতে গিয়ে দুটি বক-পাখিকে মনের আনন্দে খেলতে দেখেছিলেন মুনি বাল্মিকী। এই প্রেমের দৃশ্য আনন্দচিত্তে উপভোগ করছিলেন তপস্বী। হঠাৎ এক নিষ্ঠুর শিকারি এসে তির ছুড়ে এই পক্ষীযুগলের একটিকে হত্যা করল। সাথীহারা অন্য বকটির তীব্র ক্রন্দনধ্বনি প্রকম্পিত করে তুলেছিল বনভূমি। দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিল বাল্মিকীর হৃদয়। তিনি সেদিন শিকারির উদ্দেশে যে অভিশাপবাণী উচ্চারণ করেছিলেন সেটিই পৃথিবীর প্রথম শ্লোক বা কবিতা।

এই গল্পের শ্রোতা হিসেবে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে উপযুক্ত মনে করার কোনও কারণই ছিল না। সামান্য পাখি শিকারের মতো ব্যাপারকে হিংস্রতা বলে অনুভব করার মতো শক্তি বা সংবেদন তার মধ্যে অবশিষ্ট থাকার কথাও না। তবু বনশ্রী গল্পটি আমাকে বলেছিল, এবং কী আশ্চর্য এই গল্প আমাকে কিছুটা স্পর্শও করেছিল।

এহেন বনশ্রী সেনগুপ্তার অপহরণ বা অন্তর্ধান রহস্য উদ্ঘাটন করতে না পারলে আমার কেরিয়ারে ইতরবিশেষ হওয়ার শংকা থাকে না বটে, অথচ একটা গভীর অশান্তি আমার অনিদ্র রাতগুলোকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে তোলে।

তদন্তে নেমে মেয়েটির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে কোনও ধরনের সূত্র পাওয়া গেল না। এমনকি স্কুলের সহকর্মীরাও তেমন কিছু জানাতে পারল না। শুধু যে বাঙালি পরিবারটিতে বনশ্রী সাবলেট থাকত, তাদের মেয়েটি সামান্য একটু ইশারা দেখাতে পারল। সুধাসিন্ধু ত্রিপুরা নামের এক লোকের সঙ্গে বনশ্রীর কিছুটা রাগারাগির মতো হয়েছিল।

কে সুধাসিন্ধু ? সুধাসিন্ধু একজন খামারি। বাঘাইছড়ি ও আশেপাশের এলাকায় কয়েক একর পাহাড়ি জমিতে আম, পেয়ারা, আনারস, লটকন এসবের চাষ করে ভালো আয়-উপার্জন করেছে। টাকা-পয়সার চেয়েও নাম হয়েছে বেশি। সেরা খামারি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরস্কারও পেয়েছে। ভালো কথা। বনশ্রীর সঙ্গে তার সমস্যা কি ? না, তেমন কিছু সমস্যা না। বনশ্রী একবার তার খামার দেখতে গিয়েছিলেন, বোধহয় মুগ্ধও হয়েছিলেন। তারপর থেকেই লোকটা বনশ্রীর সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করতে আসত। সঙ্গে নানা জাতের ফলের খাঁচা নিয়ে আসত। এত ফলমূল আনত যে পুরো পাড়ায় বিলিয়েও ফুরাত না। শেষে একবার সরাসরি নিষেধ করেছিলেন বনশ্রী, এমনকি বোধহয় তার সঙ্গে আর দেখা করতেও বারণ করেছিলেন। ক্ষুব্ধ অপমানিত সুধাসিন্ধু রাগের মাথায় সঙ্গে নিয়ে আসা সব ফল একটা নোংরা জলাশয়ে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল।

সুধাসিন্ধু কি বনশ্রীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল ? বাঙালি পরিবারের মেয়েটা বলে উঠল, ‘না না স্যার, কোথায় কী ? কার সঙ্গে কী, এত সাহস তার হবে না।’

আমিও তাই ভাবি, কোথায় সুধাসিন্ধু আর কোথায় শিশিরবিন্দু। কিন্তু সন্দেহের তালিকায় সুধাসিন্ধুকে রাখতেই হলো।

সুধাসিন্ধুর খামারগুলোতে খোঁজ করলাম, নাই। তাতে সন্দেহ বাড়ল। এই সামান্য ঘটনা থেকে রাগের মাথায় সুধাসিন্ধু কি কিছু একটা করে ফেলতে পারে ?

‘পারে, সুধাসিন্ধু রগচটা ধরনের মানুষ স্যার।’―এ কথা বলল সুধাসিন্ধুকে ঘনিষ্ঠভাবে চেনে এমন একজন পাহাড়ি-যুবক। তারও ছোটখাট খামার আছে। লোকটা ঈর্ষাবশত সুধাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে কি না বুঝতে চেষ্টা করলাম। হতেও পারে। তবে লোকটাকে আপাতত আমার দরকার।

‘সুধাসিন্ধুর বাড়ি কোথায় ?’

‘অনেক দূর স্যার, বোটে গেলে লংগদু ফেলে কাট্টলী বাজার। কাট্টলী বাজার ঘাটে নেমে তারপর জঙ্গলের পথে পূর্ব-দক্ষিণে দেড় দুই মাইল হেঁটে গ্রাম…, সেখানে চাকমাপাড়া, ত্রিপুরা পাড়া…।’ জানাল বুদ্ধজ্যোতি খীসা।

বুঝলাম, ভালো ঝামেলায় পড়েছি। কিন্তু আমার আর উপায় নেই, অপহরণকারীকে আটক করতে পারলে ভালো, নইলে বনশ্রীকে, নিদেনপক্ষে বনশ্রীর মৃতদেহ উদ্ধার না করে আমার শান্তি নেই। আমি জড়িয়ে পড়েছি নিজের অজান্তে। বুদ্ধজ্যোতিকে বললাম, ‘তুমি যাবে আমার সঙ্গে ?’

দোনমনা করে লোকটা বলল, ‘যেতে পারি।’

অনুমান করলাম লোকটার সঙ্গে শুধু ঈর্ষার সম্পর্ক নয়, রীতিমতো শত্রুতা আছে সুধাসিন্ধুর।

দুজন কনস্টেবল আর বুদ্ধজ্যোতিকে নিয়ে বাঘাইছড়ি সদরের মারিশ্যাঘাট থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়ে যাত্রা শুরু করেছি বিকেল পাঁচটার দিকে। ঘণ্টা তিন বা সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ লংগদু। সেটা ২৭ বা ২৮ মার্চ। স্বাধীনতা দিবসের পরদিন বা তারও একদিন পর গিয়েছিলাম বলে মনে পড়ে। সেটা ২০০৪ সাল।

দুপাশে পাহাড়ি বনজঙ্গল, কোথাও বা দু-এক টুকরা বসতি ফেলে অবিরাম অস্বস্তিকর শব্দ তুলে এগিয়ে যাচ্ছে ইঞ্জিন নৌকা। কাপ্তাই হ্রদটিকে কোথাও নেহাৎ গৃহস্থবাড়ির পাশের সরু খাল মনে হলেও, কোথাও রীতিমতো দৃষ্টি থেকে দু প্রান্ত হারিয়ে যাওয়া নদী মনে হয়। নৌকার যাত্রীদের মধ্যে কথোপকথন তেমন জমে উঠছিল না বলে যাত্রাটা ছিল ক্লান্তিকর। তবে এও সত্য গল্পগুজব করার মতো মেজাজ ছিল না আমার। প্রায় সন্ধ্যার দিকে লংগদুতে নৌকা থেমেছিল।

লংগদুতে ইবনে সিনা ট্রাস্টের অতিথিশালায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল আমাদের। বুদ্ধজ্যোতি খীসার সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করেছিলাম শেষ রাতের দিকে নৌকায় চেপে কাট্টলী বাজারে গিয়ে পৌঁছালে আমাদের সেখানে পৌঁছানোর খবর কেউ জানবে না। কাট্টলী বাজার ঘাট থেকে বনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘণ্টাখানেক হেঁটে ভোরে পৌঁছে যাব ত্রিপুরা পাড়ায়। ভোরবেলাটা হচ্ছে আসামিকে কবজা করার মোক্ষম সময়।

বুদ্ধজ্যোতির কথায় প্রভাবিত হয়ে কি না জানি না সুধাসিন্ধুকেই টার্গেট ধরে নিয়েছি আমি। সামান্য কথাকাটাকাটি বা অভিমান থেকে একটা মেয়েকে অপহরণ বা হত্যা করার মতো হিংস্র মানুষ কি না সে, ভালো করে ভেবে দেখার সময়ও পেলাম না যেন। এখন আর দ্বিতীয় চিন্তার কোনও সুযোগ নাই।

সে রাতে পূর্ণিমা ছিল। আমার হাতে একটি জোরালো টর্চ আর রিভলবার, কনস্টেবল দুজনের হাতে বন্দুক, আর বুদ্ধজ্যোতির হাতে একটা হারিকেন ছিল। আলোর অভাব ছিল না বটে, কিন্তু বিভ্রম ছিল। অন্ধকারে মানুষ পথ হারায়, তবে চাঁদের আলোর অদ্ভুত মায়া পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে অন্তত ঘন জঙ্গলের মধ্যে যে পথ হারিয়ে যায় আমার তা জানা ছিল না। আমরা বনের মধ্যে ভয় পাওয়া সরীসৃপের সরসর করে সরে যাওয়ার ভেতর, হঠাৎ ঘুমভাঙ্গা পাখির ডানা ঝাপটানোর ভেতর নানা ভুল পথে হাঁটাহাটির পর অবশেষে সরু দীর্ঘ লক্ষ্য অভিমুখী পথ খুঁজে পেয়েছিলাম। সেই পথ এসে শেষ হলো ঝরনা ও তার গা ঘেঁষে বয়ে চলা অগভীর সরু একটি ছড়ার ধারে।

ভোর ফুটেছে। এখন এই হাঁটুজল পেরিয়ে আমাদের যেতে হবে গ্রামে। কিন্তু নির্জন এই পরিবেশে হঠাৎ মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম যেন কাছে কোথাও। আমি সতর্ক ও উৎকণ্ঠ হলাম। পুরো দলটিকে একটু দূরে অপেক্ষা করতে বলে গাছের আড়াল ধরে এগিয়ে গেলাম সামনে।

ভোরের নরম আলোয় এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম আমি। ঝরনার উচ্ছ্বসিত জলধারায় স্নান করছে দুটি নারী-পুরুষ। পুরুষটির খালি গা, কোমরে শুধু একফালি নেংটি। আর মেয়েটি লুঙ্গির মতো রাঙ্গা খাদির পিণন জড়িয়েছে কোমরে, নগ্নবক্ষা। মেয়েটির খিলখিল হাসির শব্দে মাঝে মাঝে চাপা পড়ে যাচ্ছে জলধারার শব্দ। আঁজলা ভরে জল নিয়ে সে ছুড়ে দিচ্ছে পুরুষটির দিকে, আর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে দুর্বোধ্য পাহাড়ি ভাষায় কী যেন বলছে বারবার। মেয়েটিকে প্রথম দেখায় চিনতে পেরেছি আমি, বনশ্রী। কিন্তু তার ভাষা বুঝতে পারছি না। ইশারায় বুদ্ধজ্যোতিকে ডেকে নিলাম পাশে। বুদ্ধজ্যোতি ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এটাই সুধাসিন্ধু স্যার। গুলি করেন স্যার… না হলে পালিয়ে যাবে।’

আমি বললাম, ‘মেয়েটি, মানে বনশ্রী বারবার এসব কী বলছে সুধাসিন্ধুকে ?’

বুদ্ধজ্যোতি বলল, ‘ম্যাডাম ত্রিপুরা ভাষা বলছে, আঙ নন হাঙ্গাগো…।’

‘এ কথার অর্থ কী ?’

‘এইটার অর্থ হলো স্যার, মুই তরে কোচপাঙ।’

‘আরে বাবা তা-ও তো চাকমা ভাষাই হলো, আমি কি তোমার ভাষা জানি ? বাংলা অর্থটা বলো।’

বুদ্ধজ্যোতি একটু শরমিন্দা হলো যেন, মাথা নিচু করে বলল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

আমি হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম বুদ্ধজ্যোতির মুখের দিকে। অপহৃতা মেয়েটি ঝরনার ধারাজলে দাঁড়িয়ে অপহরণকারীকে বলছে, ‘আঙ নন হাঙ্গাগো!’

বুদ্ধজ্যোতি বলল, ‘স্যার সময় নষ্ট করবেন না, গুলি করেন, না হলে শালা পালিয়ে যাবে…।’

‘আমি পারব না বুদ্ধ, গুলি করলে বাল্মিকী আমাকে অভিশাপ দেবেন।’

বুদ্ধজ্যোতি অবাক, ‘বাল্মিকী কে ?’

আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, ফিরে যেতে যেতে মøান হেসে বললাম, ‘আমি তাঁকে চিনি না, বনশ্রী চেনে।’

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button