আর্কাইভগল্প

গল্প : দেশি মুরগি : নূর কামরুন নাহার

বাইরের চেহারা দেখে ভেতর বোঝার উপায় নেই। বাইরে রংচটা শ্রীহীন সাড়ে নয়তলা, ভেতরে গাদাগাদি করে রাখা মানুষযন্ত্র, মেশিনযন্ত্র, কাপড়, সুতা, মেশিনের শব্দ, কুৎসিৎ গালি, খিস্তিখেউড়, গরমবাতাস, ভাপ আর ধোঁয়া। 

দোতলায় অফিস আর স্যাম্পলিং। তিনতলায় ঘুরছে বিশাল বিশাল ওয়াশিং মেশিন, উড়ছে ভাপ, ধোঁয়া। মেশিনের একদিকে ঠেসে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে সোয়েটার, ধুয়ে, শুকিয়ে বের হয়ে আসছে অন্যদিক দিয়ে। কুচকানো কাগজের মতো সোয়েটারগুলো টেনে টেনে সাইজমতো তৈরি চলছে স্টিম আয়রনে। আয়রন হবার পর ট্রলিতে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সাততলায়। ওটা প্যাকেজিং সেকশন। এখানে রাখা আছে থ্রি প্লাই, ফাইভ প্লাই, সেভেন প্লাই কার্টন, প্রিন্টেড পলি, হ্যান্ডট্যাক, সাইজ লেবেল, কেয়ার লেবেল। কেউ পলি প্যাক করছে, কেউ কার্টনে ভরছে, কেউ মেশিন পাঞ্চ করে হ্যান্ডট্যাক, সাইজ লেবেল, কেয়ার লেবেল লাগাচ্ছে। চারতলার একপাশে দিনরাত চলছে মেন্ডিং। হাত চলছে মেশিনের মতো। নিপুণ শিল্পীর হাতে খুঁতগুলো নিখুঁত হচ্ছে। ওপাশে খটাখট আওয়াজ তুলে চব্বিশ ঘণ্টা চলছে লিকিং। নিটিং করা অংশগুলো জোড়া লাগছে, জাদুর মতো তৈরি হচ্ছে পূর্ণ সোয়েটার। কাজ করছে কিশোরী আর যুবতী, আছে কিছু মধ্যবয়স্কা নারী। এখানে পুরুষ নেই বললেই চলে।

পাঁচতলা আর ছয়তলায় ঘোঁতঘোঁত আওয়াজে চলছে ফাইভ গেজি, সেভেন গেজি, থ্রি গেজি নিটিং মেশিন। দুই তলা জুড়ে পুরোটাই নিটিং সেকশন। এখানে চলছে নানা রকম ডিজাইয়ের নিটিং সাকার, সার্পেনটাইল আরও কত কী! মেশিন থেকে বের হয়ে আসছে সোয়েটারের বডি, হাত, কলার। এই সেকশন খোলা রাখতে হয় চব্বিশ ঘণ্টা। এখানে আছে শিফটিং ডিউটি, আছে ওভারটাইম। মানুষগুলো সারাদিন, সারারাত দাঁড়িয়ে নিটিং মেশিন টানে। পেশির ফুলে উঠা রগে সার্পেন্টাইল ডিজাইনের মতোই ঘাম চিকচিক করে। এখানে কাজ করা শ্রমিকের নিরানব্বই ভাগ পুরুষ।   আটতলায় চরকির মতো অনবরত ঘুরছে উনডিং মেশিন। এখানে বাতাস অত্যধিক গরম। বাতাসে উড়ছে সুতার সূক্ষ¥ আঁশ। কাজ করছে নারীরা। মেশিনের শব্দের সঙ্গে থেকে থেকে উঠে কাশির আওয়াজ। গরম আর সুতার আঁশে এখানের শ্রমিকরা সারা বছর শ্বাসকষ্টের রোগী। 

নয়তলায় স্টোর আর ইনভেন্টরি। একটা মাত্র ফ্লোরে এত বড় ফ্যাক্টরির স্টোর কিছুই হয় না। ভবনের জায়গায় জায়গায় বিচ্ছিন্ন গুদামঘর। একতলা থেকে নয়তলা পর্যন্ত সিঁড়ির একপাশে রাখা আছে বস্তার পর বস্তা। বস্তা বোঝাই আছে সুতা, উল, পলি, পুরোনো মাল, রিজেক্টের মাল, স্যাম্পলিং-এর মাল। সিঁড়ি প্রায়ান্ধকার, স্তূপ করা মালে একবারে সরু। একসঙ্গে দুজনের চলাচলে ঠোকাঠুকি লাগে। সকালে অফিস শুরুর সময় আর সন্ধ্যায় এক শিফটের ছুটির পরে সিঁড়িতে জট বাঁধে মানুষের।  

বাইরে দেখে যেমন ভেতর বোঝা যায় না, তেমনি সামনে দেখে বোঝা যায় না বিল্ডিং দুটো। পাশাপাশি গায়ে গায়ে লাগানো দুটো বিল্ডিং-এর একটার পুরোটা জুড়ে কিং সুইং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। আর একটা বিল্ডিং-এর পাঁচতলা পর্যন্ত গুদাম, বাইন্ডিং, বোতলের ছিপিখানা আর সব কী কী। চারতলায় ঝুলে আছে রহস্যময় পুরোনো একটা সাইনবোর্ড ‘নিয়াজ আবাসিক হোটেল’। 

‘নিয়াজ আবাসিক হোটেল’ নামক সাইনবোর্ডের এই বিল্ডিং- এর মালিক গনি মিয়া। উত্তরাধিকার সূত্রে সে পেয়েছে এ বিল্ডিং। একসময় পুরো নয়তলারই মালিক ছিল সে। এখন পুরো বিল্ডিং তার মালিকানায় নেই। একতলা থেকে তিনতলা আর পাঁচতলা বিক্রি করা হয়েছে অনেক আগেই। চারতলার ‘নিয়াজ আবাসিক হোটেল’ ফ্লোরটা তার। এটার অর্ধেকটা কিং সুইং-এর গুদাম আর নানা কাজে ব্যবহার করা হয়। এই অংশ বিক্রি নাকি ভাড়া দেওয়া সেটাও রহস্যে ঢাকা। পাঁচতলা থেকে নয়তলা পর্যন্ত মাঝখানে জোড়া লাগিয়ে দুটো বিল্ডিং এক করা হয়েছে। এর মধ্যে আটতলার পুরোটা তার। অর্ধেক কিং সুইংকে ভাড়া দেওয়া বাকি অর্ধেকে থাকে তার পরিবার। বাকি সব ফ্লোরেই কিং সুইং এর কার্যক্রম চলছে। কিং সুইং-এর কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ার পর এইভাবে জোড়া লাগিয়ে ফ্যাক্টরি বড় করা হয়েছে। এইফ্লোরগুলোর মধ্যে দু একটা ফ্লোরের কিছু অংশ খামচি দিয়ে ধরে রেখেছে গনি মিয়া, বাকিগুলো চলে গেছে নানা মালিকানায়। কিছু গেছে কিং সুইং-এর মালিকানায়ও। এই বিশাল নয়তলা ছাড়াও বহু সম্পত্তির মালিক ছিলেন গনি মিয়ার পিতৃপুরুষ। এ এলাকার অধের্কটাই ছিল তাদের দখলে। তিন পুরুষের বসত ও স্থানীয় হিসেবে প্রতিপত্তিও ছিল বেশ। স্বাধীনতার আগেই এ অঞ্চলে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগে। যখন এখান দিয়ে চলে যায় টানা রাস্তা। পাকিস্তান আমলের এ রাস্তা ধরেই রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা, জাতীয় সম্প্রচার কেন্দ্র এসব ঘিরে গড়ে উঠেছে জনবসতি আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এখন এখানে বহু গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। স্বাধীনতার পর ঢাকা হাত-পা মেলেছে সব দিকে। জায়গার দাম আর গুরুত্বও বেড়ে গেছে বহু গুণ। এ জায়গাকে এখন ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র বলা যায়। এমন জায়গায় একটা নয়তলা বাণিজ্যিক ভবন সচ্ছল ও অভিজাত জীবনের জন্য যথেষ্টের চাইতেও বেশি। কিন্তু বাপের সম্পত্তির একাংশ মাত্র এখন গনি মিয়ার দখলে। বাকি সব উজাড় হয়েছে মদ, নারী আর জুয়ায়। তিন বউয়ের দুই বউ এখনও বর্তমান। একবউ অতীত হলেও তার ফসলাদি আছে। তিন সংসারের বাল-বাচ্চায় তার ঘর ভরা। ছেলেরা বাবার মতোই পয়সা উড়ানো, ফুটানি, মস্তানি আর গায়ে হাওয়া লাগানো ফুর্তিবাজ। তিন ঘরে তিন তিনটা মেয়ে। দুটো প্রায় সমান। গায়ে গতরে বেড়ে উঠেছে। তাদের বিয়ের এখন উপযুক্ত সময়। যদিও তারা বাপ-ভাইয়ের মতো নাম স্বাক্ষরে কলম ভাঙে না। বাপের সম্পত্তির হুঙ্কারে খাটের ওপর পা তুলে যে খাওয়া যাবে না সেটাও ভালোই বোঝে। তারা পড়াশোনা করে। দুজনই ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। তারা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর বিয়ে করার কথা ভাবে। তবে তাদের বিয়ের ভাবনায় মায়েদের ঘুম নেই। আর গনি মিয়ার এসবের কোনও তোয়াক্কাই নেই।

 সংসার দেখার সময় তার হয় না। পরিবারে কিছু শাসন, মাঝেসাঝে ঘরে গিয়ে চোটপাট, হুঙ্কার, কখনও কখনও দু বউয়ের কোনও একটাকে দু-এক ঘা লাগিয়ে সংসারে তার আধিপত্য বুঝিয়ে আসে। দুনিয়ার সব কিছুকেই সে থোড়াই কেয়ার করে। তার ছোটখাট শরীরের গোলগাল মুখে গোল গোল চোখদুটো জ¦লতে থাকে ইটের ভাটার মতো। ঢাকাইয়া টানে মুখে বানের পানির মতো চলে খিস্তি আর খেউড়। হাসি হাসি মুখে সে বাজে মস্করা আর রসিকতা করে। নিজের খেয়ালে খরচ করে। বাড়িতে কদাচিৎ খায়। হোটেল থেকে তার খাবার আসে। পুরোনো ঢাকার বিরিয়ানি, কাবাব, রোস্ট তার নিত্যদিনের ভোজন। খাসির মাংস, গরুর ভুনা আর দেশি মুরগি ছাড়া তার চলে না। ফার্মের মুরগি সে খায় না। দিনের বেশির ভাগ থাকে ‘নিয়াজ হোটেল’ সাইনবোর্ড ঝোলানো চারতলার এক কক্ষে। এটাই তার নিজের কক্ষ। বলা যায় কক্ষ এখানে দুটো। সামনের ছোট কক্ষে টেবিল চেয়ার তার পেছনে দরজা। দরজা দিয়ে ঢুকলে দেখা যায় ডাবল খাট, একটা ছোট সোফা, ছোট একটা ওয়ারড্রব। সঙ্গে এটাচড বাথরুম। এই ঘরের দরজা বন্ধ করলে দুটো আলাদা কক্ষ হয়ে যায়। চারতলায় থাকলে গনি মিয়া বেশির ভাগ সামনের এই টেবিলেই বসে থাকে। দরজাও তার খোলা থাকে। এখানে বসেই সে গ্লাসে গ্লাসে পান করে। তার কোনও রাখঢাক নেই। পান করা আর মাঝেসাঝে মাতবরি করা ছাড়া তার অন্য কোনও কাজ নেই। যখন মনে চায় পেছনের কক্ষে রেস্ট নেয়, ঘুমায়। যখন মন চায় বাইরে গিয়ে হাসিমস্করা করে আর বন্ধুদের সঙ্গে খেয়ে-দেয়ে ফুর্তি করে আসে। মাঝে সাজে কিং সুইংয়ের দু-একটা ফ্লোরে গিয়ে একটু চক্কর মেরে আসে। কখনও কিছু শ্রমিককে অকারণ হুমকি-ধামকি দিয়ে শাসিয়ে আসে। আর মন চাইলে সুযোগ বুঝে নারী এনে মৌজ করে। মেয়ে এনে ফুর্তি করা নিয়েও তার কোনও শরম নেই, বরং গর্ব আছে। বড় গলায় বলে―‘মাঝে মইধ্যে মাইয়া মানুষ না আনলে মাথাডা গরম গরম লাগে’।  গতর খাটানো কাজ গনি মিয়ার কাছে ‘ছোটলোকি কাম’। ঢাকাইয়া টানে সে বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বলে―‘গনি মিয়া কাম করব ক্যালা, ফকিরনির পোলানি ?’ তার বয়স হচ্ছে। সেটাকেও সে থোরাই কেয়ার করে। যদিও শরীর আগের মতো বানের পানির মতো তরতরিয়ে চলে না। এখন এ কক্ষেই তার বেশির ভাগ সময় কাটে। হাতে রাঙা পানির গ্লাস ধরাই থাকে।

এখানে আর একটা সাজানো কক্ষে বসে মোতালিব মিয়া। এটিও এমন দুটো কক্ষের মতো। সামনে টেবিল চেয়ার আর ফাইল রাখার র‌্যাক। পেছনের কক্ষে ডাবল খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, ওয়ারড্রব সঙ্গে এটাচড বাথরুম। তিনি এই কিং সুইং গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির জিএম। সাইনবোর্ডে ঝোলানো ঐ নাম ছাড়া এখানে হোটেলের আর কোনও চিহ্ন দেখা যায় না। তবে সাজানো এই দুটো কক্ষ দেখে বোঝা যায় কোনও এক সময় এখানে আবাসিক হোটেল ছিল। কিং সুইং-এর এই জিএম পদটাও বেশ ঘোলাটে, সঙ্গে লোকটাও। তাকে ফ্যাক্টরি থেকে এক প্রকার বিচ্ছিন্নই দেখা যায়। অফিসের অন্যদের সঙ্গে কথাও বলেন খুব কম। নিজে এ কক্ষ থেকে বেরও হন খুব কম। ফ্যাক্টরির ফ্লোরেও যান কদাচিৎ। তিনি কী কাজ করেন সেটা তিনি আর মালিকই ভালো বোঝেন। তবে কিছু স্বাক্ষর-টাক্ষর করতে দেখা যায়। পাশের র‌্যাকে বেশ কিছু মোটা মোটা ফাইল। তাতে ধারণা করা যায়, এখানে কিছু দাপ্তরিক কাজও হয়তো চলে। শোনা যায় তিনি সোয়েটার ফ্যাক্টরির মালিকের অতি পরিচিতজন। তার বেশ কিছু মালপানি ঢালা আছে এ ফ্যাক্টরিতে। কারও কারও কাছে আবার আরও জানা যায়, তিনি মালিকের জানি দোস্ত, মালপানি ছাড়াও অনেক গোপন বিষয়ের সাক্ষী। তাই  মালিক তাকে ভালোই খাতির করেন। এ ফ্যাক্টরিতে তার প্রভাব আর ক্ষমতাও বেশ। তাকে সবাই যথেষ্ট দাম দিয়ে চলে।

সময়টা এখন রেডিমেড গার্মেন্টেসের। রপ্তানি খাতে নতুন স্বপ্নের দ্বার খুলেছে গার্মেন্টস। পাল্টে দিয়েছে শহর আর জীবন। ঢাকা শহরের জায়গায় জায়গায় এখন ফ্যাক্টরি। পুরোনো স্থাপনায় তো আছেই। নতুন করে কিছু স্থাপনাও দাঁড়াচ্ছে। শহরের রাস্তায় মিছিলের মতো করে শ্রমিক যাচ্ছে ফ্যাক্টরিতে। আশির দশক থেকেই শুরু আর মধ্য আশিতে শ্রমিকের এই মিছিল ঢাকা শহরের রাস্তার স্থিরচিত্রে পরিণত হয়েছে। এই রেডিমেড গার্মেন্টস-এর খাত মূলত প্যান্ট-শার্ট আর জ্যাকেটের। গার্মেন্টেসের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ওভেন ফ্যাক্টরি’। আশির দশক পেরিয়ে এখন এই নব্বই দশকে এসে গার্মেন্টস খাতে নবীন শাখা হিসেবে নাম লিখিয়েছে সোয়েটার ফ্যাক্টরি। গার্মেন্টেসের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘নিট ফ্যাক্টরি’। কিং সুইং হচ্ছে একবারে প্রথম দিকের ‘নিট ফ্যাক্টরি’। বলা যায় কিং সুইং-এর মাধ্যমেই গার্মেন্টেস সেক্টরে সোয়েটার ফ্যাক্টরির হাতেখড়ি। রেডিমেড গার্মেন্টস এখন  প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হবার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। জোয়ারের এই কালে এই নিট যুগের সূচনা ব্যাপক আশাজাগানিয়া ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নব্য প্রতিষ্ঠিত এই কিং সুইং তাই গার্মেন্টস খাতে ব্যাপক ঔৎসুক্য সৃষ্টি করেছে এবং এটার মধ্য দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে নিট ফ্যাক্টরির ভবিষ্যৎ। কিং সুইং-এর ফ্লোরে ফ্লোরে শ্রমিকের কালো মাথার আধিক্য দেখে বোঝা যায় এই ফ্যাক্টরি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শক্তভাবে। তারপরও সোয়েটার ফ্যাক্টরির টিকে থাকা এখনও চ্যালেঞ্জের মুখে। এখনও বহুবিধ সমস্যা। নিট ফ্যাক্টরির জন্য প্রয়োজন প্রচুর বিনিয়োগ। এক সোয়েটার ফ্যাক্টরির বিনিয়োগে দেয়া যায় তিনটা ওভেন ফ্যাক্টরি। বিনিয়োগের পাশাপাশি দক্ষ শ্রমিকও এর বড় চ্যালেঞ্জ। 

কিং সুইং-এর প্রতিষ্ঠাও এক বিরাট কাহিনি। এর মালিকানায় প্রথমে ছিল এক বিদেশিনীর ব্যাপক বিনিয়োগ। এখন অবশ্য তার হাত গলে পুরো ফ্যাক্টরির মালিকানাই কাশিম খানের। কাশিম খানের ব্যবসায় আসার কাহিনিও ভিন্ন ও গূঢ় রহস্যের। তিনি ছিলেন নির্দিষ্ট পোশাকের কর্মকর্তা। সেই পোশাকের দাম বেশ চড়া। দাম আরও অনেক বেশি চড়ে যখন ঐ পোশাকে দায়িত্ব পালনের সুবাদে তিনি চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে যান কিছু রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার। এই গোপন তথ্য তাকে  দেয় গোপন খনির সন্ধান। তবে তাকে ছাড়তে হয় ঐ পোশাকের মায়া। রাতারাতি ইস্তফা আর পকেট ভরা মাল। গুপ্ত রহস্যের গুপ্ত ভাণ্ডারে রাতারাতি ফ্যাক্টরির মালিক। তবে তখন তিনি ছিলেন ঐ বিদেশি পার্টনারের লেজ। ব্যবসা কাকে বলে জানেন না, এসব নিট, ওভেনের কিছুই বোঝেন না। পার্টনারের টাকা আর পার্টনারের বায়ারেই শুরু হয় সোয়েটার ফ্যাক্টরির যাত্রা। বুদ্ধি আর কৌশলে একসময় লেজ থেকে তিনি হয়ে যান শরীর, লেজ হয়ে ঝুলে থাকে পার্টনার। তাতে অবশ্য কিছু সুবিধাও থাকে। বিদেশি পার্টনার থাকাতে বায়ার পেতে সুবিধা হয়। একসময় বায়ার পুরোই তার কব্জায় আসে। তারপর লেজটা খসিয়ে তিনি হয়ে যান পুরো ফ্যাক্টরির মালিক। তাকে বলা হয় স্বল্পতম ভাগ্যবানদের একজন। কারণ কথা ছিল তার কবরে শুয়ে থাকার, তার বদলে বসে আছেন সিংহাসনে। এরকম রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য জানা অধিকাংশ মানুষই শিকার হয় গুপ্তহত্যার। আর তিনি গুপ্তখুন না হয়ে পেয়েছেন গুপ্তধন। 

সাহস বুদ্ধি আর মালপানি মিলিয়ে তিনি এখন বিশাল রাজ্যের রাজা। তার এখন পোয়াবারো। কাউকে পরোয়া করতে হয় না। গার্মেন্টস সেক্টরে সোয়েটার ফ্যাক্টরির ব্যবসায় একচেটিয়া প্রাধান্য তার। নিপুণ দক্ষতায় নিয়ন্ত্রণ করছেন নিটের জগৎ। তার নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে বায়ার আর অর্ডার। বেশি হয়ে গেলে সাবকন্ট্রাক্ট দেন। কিন্তু হাতের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েন না। শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ করেন কঠোর হাতে। সেক্ষেত্রে কাউকে মাথায় হাত বোলান, কাউতে লাথি মারেন। এত বড় ফ্যাক্টরি নিয়ন্ত্রণে অনেক কিছুই করতে হয়। সবকিছু হাতের মুঠোর মধ্যে থাকলেও রাজ্য টিকিয়ে রাখতে মন্ত্রী, সেপাই দরকার হয়। দরকার হয় কর্মী আর মস্তানের। কত রকম দুর্ঘটনা, কত বিদ্রোহ, কত অনাকাক্সিক্ষত বিষয় ঘটে যায়, এগুলো সামলাতে হয়। এগুলো সামলাতে কিছু মানুষকে পাত্তা দিতে হয়, হাতে রাখতে হয়। সেরকম তালিকায় গনি মিয়াকেও রাখতে হয়। কারণ গনি মরা হাতি হলেও লাখ টাকা। তিনি এ এলাকার স্থানীয়। আর মালিক হলেও কাশিম খান বহিরাগত। গনি  মিয়ার দিন পড়ে গেলেও এখনও তারাই এ এলাকার মাতব্বর। তিন পুরুষের বংশপরম্পরার মাতব্বরি তাদের। একসময় তাদের ওপর কথা বলার কেউ ছিল না। এখন দিন বদলেছে। ঢাকা শহর বদলেছে। গার্মেন্টস এসেছে। এলাকা আবাসিক থেকে বাণিজ্যিক হয়েছে। মালিকানায় কোপ পড়েছে। অনেক কিছু বদলে গেলেও আর আগের মতো তাদের কথাই শেষ কথা এমন ক্ষমতা না থাকলেও স্থানীয়ের  প্রভাব এখনও অনেকটাই আছে। মহল্লার আচার-বিচারে গনি  মিয়ার ডাকও পড়ে। গনি মিয়া ছোটখাট শরীর থেকে বাঘের গমগমা বিরাট আওয়াজ বের করে যখন আগুনের গোল্লা চোখে তাকায় তখন ভেতরে ভয় ধরে যায়। সবচেয়ে বড় কথা তার মুখের কোনও লাগাম নেই, রাগেরও লাগাম নেই, লাগাতার গালির ফোয়ারায় তিনি যে কাউকে ভাসিয়ে দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে তার কোনও বাছ-বিচার নেই। ন্যায়-অন্যায়ের ধারদেনাও নেই। তার এই বেফাঁস মুখ আর অনিয়ন্ত্রিত রাগের কারণে তাকে মেপে চলতে হয়। গনি মিয়ার পালিশ করা মুখের পাল্লায় কেউ সহজে পড়তে চান না। তবে গনি মিয়া আবার দিলখোলা, হাতখোলা। ঠা ঠা করে হাসেন। মানুষকে খাওয়ালে মন ভরে খাওয়ান। কিছু দিলে হাত খুলে দেন। কারও পাশে দাঁড়ালে হাতে লাঠি নিয়ে দাঁড়ান। এই রকম একজন মানুষকে কাশিম খানের হাতে রাখতেই হয়। রাজ্য রক্ষায় মন্ত্রীর তখতেও বসিয়ে রাখতে হয়। গনি মিয়া তিনতলায় নারী এনে মৌজ করলে কিছু বলেন না। দেখেও না দেখার ভান করেন। আর একটা বিষয় কাশিম খানের মাথায় থাকে। গনি মিয়ার কাছ থেকে বেশ কয়েকটা ফ্লোরের কিছু অংশ কিনে নিলেও তিনি এই ভবনের পুরো মালিক না। কিং সুইং চালানোর জন্য এই ভবনের আরও কিছু অংশের পুরো মালিকানাই তার দরকার। পানীয়, নারী আর জুয়ায় ডুবিয়ে যদি আরও কিছু খমানো যায় তবে বাকি ফ্লোরগুলোও সস্তায় বাগানো যাবে। তাই গনি মিয়া চাইলে তিনি টাকশাল খুলে দেন। ফ্যাক্টরির দু-একটা নারী শ্রমিকের দিকে চোখ লাগালে এড়িয়ে যান।

কিং সুইং-এর নীচতলায় প্রতিদিন বিভিন্ন বয়সের নারী- পুরুষের লম্বা লাইন দেখা যায়। এই লাইন বিল্ডিং ছাড়িয়ে ফুটপাথ হয়ে অনেক সময় রাস্তায় গিয়ে ঠেকে। এটা হলো নতুন শ্রমিক নিয়োগের লাইন। বিল্ডিং-এর প্রবেশ মুখে বড় বড় করে লেখা ‘দক্ষ/ অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ হচ্ছে’। এই শ্রমিক নিয়োগ চলে সকাল থেকে দুপুর তিনটা পর্যন্ত। কাজপ্রত্যাশী এইসব নিম্নবর্গের মানুষদের সাধারণ পরীক্ষা নেওয়া হয়। যাদের দক্ষতা আছে তাদের বেতন বেশি আর যারা অদক্ষ তাদের কম। অদক্ষ শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। ফ্যাক্টরির শ্রমিকদের সময়মতো অফিস  ঢোকা এবং বের হওয়া এবং এই নতুন শ্রমিক নিয়োগের প্রাথমিক বাছাইয়ের মূল দায়িত্ব টাইম কিপার জলিলের, সঙ্গে থাকে দুই সাহায্যকারী। জলিল দেখতে সুর্দশন কিন্তু কঠিন অন্তর। কঠোরতা আর রূঢ় ব্যবহারের মাধ্যমে সে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ করে। একইভাবে চালায় বাছাই প্রক্রিয়া। তার দর্শন হলো এই সব ছোটলোক শ্রমিকদের সঙ্গে খুব বেশি ভালো ব্যবহার দেখানো যায় না। তাদের কিল-গুঁতা না মারলে তারা ঠিক থাকে না। তার সঙ্গের দুজনও বেশ শক্তপোক্ত আর নির্দয়। তারাও জলিলের দর্শন আরও বেশি কঠোরতার সঙ্গে মেনে চলে।

এই অবিরত শ্রমিক নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান থাকার কারণ হচ্ছে সোয়েটার ফ্যাক্টরির এখন সূচনালগ্ন। তাই দক্ষ ওভেন কর্মী পাওয়া গেলেও দক্ষ নিটিং কর্মী পাওয়া বেশ কঠিন। দ্বিতীয়ত এখানের কাজে বিপুল শক্তি আর শ্রমের প্রয়োজন। এখানে পুরুষশ্রমিকও বেশি। অতিরিক্ত পরিশ্রমে অনেকেই টিকে থাকতে পারে না। কিং সুইং যেভাবে ডাল-পালা ছড়িয়ে ভিত পোক্ত করে দাঁড়াচ্ছে তেমনভাবে দক্ষ শ্রমিকের জোগান মিলছে না। প্রতিদিনের এই লাইনে দাঁড়ানো নিয়োগ প্রক্রিয়া ছাড়াও কাশিম আলী নানাভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। এসব নিয়োগ দেওয়া মানুষদের ধরে রাখতে পাশের বিল্ডিং ভাড়া নিয়েছেন। সেখানে হোস্টেল করেছেন। ব্যবস্থা করেছেন তাদের থাকা-খাওয়ার। সেজন্য খুব কম পয়সা কাটা হয়। হোস্টেলে ভিন্ন ভিন্ন ফ্লোরে পুরুষ এবং নারী শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা আছে। সরু সরু দোতলা খাটে কোনও ঘরে ছয়জন, কোনও ঘরে আটজন করে গাদাগাদি করে থাকে শ্রমিকরা। অপরিচ্ছন্ন স্যাঁতস্যাতে এই হোস্টেলের খাবারও থাকার জায়গার মতোই নিম্নমানের। তবু শ্রমিকরা থাকে। বিশেষ করে যারা গ্রাম থেকে আসে এবং শহরে যাদের কেউ নেই। 

গার্মেন্টসে চাকরির বিষয়টি এখন শহর ছাড়িয়ে গ্রামের মানুষের কাছেও বেশ পরিচিত। ফ্যাক্টরির শ্রমিক হবার আশায় অনেকেই এখন গ্রাম থেকে শহরমুখী। কাশিম খানের কর্মী আর শিষ্যদেরও বলা আছে শহরমুখী এই মানুষদের ফ্যাক্টরিতে নিয়ে আসার জন্য। গ্রামে কারও অভাব আছে, কাজের প্রয়োজন আছে এমন বোঝা গেলেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাদের ফ্যাক্টরির কাজে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। গ্রাম থেকে বুঝিয়ে শুনিয়ে পুরুষ, যুবা, গ্রাম্যবধূ আর কিশোরীদের নিয়ে আসার জন্য নিয়োজিত আছে বেশ কিছু কর্মী। তারা বিভিন্ন জেলায় জেলায় চিরুনি অভিযান চালায়। পেটে টান পড়েছে এমন সব মানুষদের তারা নিয়ে আসে ফ্যাক্টরির চাকরির নানা সুবিধার কথা বলে। কোনও জায়গায় বেশি মানুষের সন্ধান মিললে তাদের গাড়ি ভরে নিয়ে আসা হয় ফ্যাক্টরিতে। এমন বেশ কিছু মানুষের চালান মাঝেমধ্যেই আসে। তারাও যে সব টিকে যায় তা নয়। নানা কারণে ঝরে পড়ে। অতি পরিশ্রমে অনেকে টেকে না। কেউ শহরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। কেউ কেউ নানা বিপদে পড়ে যায়। কেউ বাড়ির জন্য চোখ মুছতে মুছতে চলে যায়। যারা সন্তান রেখে আসে তেমন মায়েরা সন্তানের মায়ায় ফিরেও যায়।

তাই নানা রকমভাবে শ্রমিক জোগানের পরও কিং সুইং যেমন মাথা ঝাঁকি দিয়ে বাড়ছে তত দক্ষ শ্রমিক মিলছে না। সংকট থেকেই যাচ্ছে। তবে শ্রমিক সংকট যেমন আছে, চালানও বহমান আছে। কারণ নব্বইয়ের পর দেশের অনেক কিছুই বদলে গেছে। গার্মেন্টস খাত দৃশ্যমান হবার সঙ্গে সঙ্গে শহরের রাস্তায় দৃশ্যমান হয়েছে ঘরের মেয়েরা, বধূরা। বাজারে সস্তা প্রসাধনীর ঢল নেমেছে। জায়গায় জায়গায় হয়েছে স্বল্প টাকায় শ্রমিক মেয়েদের থাকা-খাওয়ার মেস। মেয়েরা লিপস্টিক, সস্তা পাউডার আর কাজল টেনে টিফিন বাটি নিয়ে মার্চপাস্টের মতো শহরের রাস্তা আর ফুটপাথে মিছিল করে দৌড়ে দৌড়ে ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছে। গৃহকর্মের ‘কাজের মানুষ’ নামক তাচ্ছিল্যের পদবিকে ছুড়ে দিয়ে তারা এখন নিজস্ব পরিচয়ে দাঁড়াচ্ছে। এখন তারা অফিস করা মানুষের মতো টিফিন বাটি বহন করা গার্মেন্টস কর্মী। এই ঘরের বার হওয়া অফিস করা ফ্যাক্টরির কর্মী হবার স্বপ্ন আর হাওয়া শুধু শহরে নয়, গ্রামের উঠানে আর মাটির ঘরেও লেগেছে। বলা যায় ব্যাপকভাবেই লেগেছে। এই অর্থনৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে রাজনীতিতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে কথিত স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। গণতন্ত্র ফিরে আসার উৎসব হয়েছে। মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করেছে। একানব্বইয়ে নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতার বদল হয়েছে। গণতান্ত্রিক সরকারেরও বর্ষপূর্তি হয়েছে। এখন বিরানব্বইয়েরও বিদায় ঘণ্টা বাজছে। এত সব পরিবর্তনেও মানুষের ভাতের লোকমা এখনও নিশ্চিত হয়নি। ভাতের লোকমার সন্ধানরত মানুষগুলো তাই শহরের দিকে আসছে। এইসব কর্ম খোঁজা শ্রমিক হবার স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোকে খুব সহজেই গরু-ছাগলের মতো গাড়িতে ভরে নিয়ে আসা যায় শহরে এবং এ শ্রেণির মানুষদের দ্বারা কিং সুইং-এর শ্রমিক জোগানও প্রবহমান থাকে। গত কয়েক মাসে কিং সুইং-এ গ্রামের নারী-পুরুষের বিশেষ করে নারী ও কিশোরীদের বেশ কিছু চালান এসেছে। এই সব চালানের সব টিকেনি। কিছু টিকে আছে কিছু বিদায় নিয়েছে।

শ্রমিক টিকে থাক বা না থাক, শ্রমিক উদ্বৃত্ত হোক বা না হোক চালান চলমান রাখার সিদ্ধান্ত জারি আছে। ফলে মাঝে মাঝেই চালান আসছে। এই সব চালানের ধারাবাহিকতাতেই প্রায় সন্ধ্যার দিকে কিং সুইং-এর গেটে দুটো গাড়ি থামতে দেখা যায়। তাদের ভেতর থেকে ইঁদুরের মতো পিলপিল করে নামতে দেখা যায় বেশ কিছু নারী, কিশোরী ও পুরুষকে। তবে নারী আর কিশোরীর সংখ্যাই বেশি। এই সব নারী-পুরষের চেহারা, পোশাক, চলন-বলন এবং শহরের দিকে তাদের তাকানো দেখেই বোঝা যায় ঢাকা শহরে তারা নবাগত। তাদের কারও কারও হাতে পুুঁটুলি, কারও সঙ্গে জরাজীর্ণ কাপড়ের থলে। সেখানে তারা তাদের সর্বস্ব বেঁধে নিয়ে এসেছে। এই মানুষের মধ্যে কাউকে কাউকে খুব দুর্বল, রুগ্ণ ও শীর্ণ দেখা যাচ্ছে। তাদের মধ্যে আবার কেউ কেউ অসুস্থ বোধ করছে। তাদের গাড়ি চড়ার অভ্যেস নেই। রাস্তায় বমি করে করে তারা ক্লান্ত, বির্পযস্ত। আধমরা মানুষগুলোকে প্রথমে পাঠানো হয় পাশের হোস্টেলে। ঠেলে ঠেলে উঠানো হয় সিঁড়িতে। সারাদিনের অভুক্ত মানুষগুলোর পাতে দেওয়া হয় কাঁকর মেশানো ভাত, প্রায় মশলাহীন আলু দিয়ে রান্না করা ছোট নলামাছের ঝোল, পানির মতো ডাল। তারা এসব খাবার কোনওরকম গিলে। কেউ কেউ কাচা মরিচের আবদার করে। আবদার শুনে পুরোনো শ্রমিকরা অট্টহাসি হাসে। ক্রমাগত চালান আর পুরোনো শ্রমিকের ভারে হোস্টেল উপচে পড়ছে। এখানে এই নতুন চালানের সবার জায়গা দেওয়া খুব কঠিন। খাওয়ানোর পর কিছু নারী ও কিশোরীকে হোস্টেলের মেঝেসহ নানা জায়গায় গাদাগাদি করে শোয়ানো হয়। পুরোনো শ্রমিকরা তাদের পায়ে পায়ে লাথি মেরে যায়। পুরুষদের পাঠানো হয় তাদের জায়গায়। সেখানেও একইভাবে ফ্লোরে গাদাগাদি করে নিচে চটের বিছানা করে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তবে বেশ কিছু নারী আর কিশোরী উদ্বৃত্ত হয়। তাদের কোনওভাবেই জায়গা দেওয়া সম্ভব হয় না। জলিল মিয়ার নেতৃত্বে তাদের নিয়ে আসা হয় কিং সুইং-এ। রাত তখন নটা। নানা জায়গায় এদের স্থানের চেষ্টা শেষে নিয়ে আসা হয় নিয়াজ আবাসিক হোটেল সাইনবোর্ডের চারতলায়। জায়গা করা হয় গুদামঘরে। গুদামের নানা জিনিসকে পায়ে ঠেলে ঠেলে একপাশে খানিকটা জায়গা করা হয়। গুদামঘরের লাইট নষ্ট। পাশের ঘরের সামান্য আলো এসে পড়ছে গুদামের ভেতর। সেই অস্পষ্ট আলোয় পুরোনো ফেলে দেয়া সোয়েটার বিছিয়ে নামমাত্র বিছানা বানানো হয়। এরপর প্রায় অন্ধকার গুদামঘরে তাদের ঠেলে দেওয়া হয়।

এ সময় গুদামঘরের চারপাশে পাওয়া যায় বিরিয়ানির তীব্র গন্ধ। গনি মিয়া টেবিলে বসে আয়েশ করে খাবার খাচ্ছে। চিকেন বিরিয়ানি আর কাবাব। শ্রমিকের শোওয়ার ব্যবস্থা করে জলিল মিয়া গনি মিয়ার কক্ষের পাশ দিয়ে সিঁড়িঘরের দিকে হাঁটা দেয়। জলিলকে দেখে হাসে গনি মিয়া―

আবে জইল্যা তুই এত রাতে এমিহি ?

চালানের মাল রাইখ্যা গেলাম। জায়গা দেওনের জায়গা নাই।

চালানে আইছে কি ?

আইছে সব গ্রামের আবাল। আওভাও কিছুই বুঝে না। স্যারে তো খালি আইন্যা ঢুকাইতেছে। সব গ্যারাইম্যা ভূত।

গুদামে রাখলি কি ? সব মানুষ নি ?

হ, সব মাইয়্যা মানুষ।

কি কস, দেশ তে আইচে নি সব মাইয়্যা মানুষ ?

হ, গ্যারাইম্যা দেশি মাল।

গনি মিয়া মুরগির রানে একটা কামড় দিয়ে শরীর দুলিয়ে খেকখেক করে হাসে―এই রহমার দেশিনি ?

জলিল হাসে―আপনে বুঝেনগা দেশি-বিদেশি। আমার নাওয়া নাই খাওয়া নাই। আমি যাই।

আবে ঐ জইল্ল্যা বিরানি খাইয়্যা যা। খাঁটি দেশি মুরগি, সোনারগাঁওয়ের থন আনছে খাইয়্যা দেখ, স্বাদ জব্বর।

আপনে বইয়্যা দেশি মুরগী খান। বিরানি খান। আমার বহুত কাম। যাওন লাগব।

শহরের নতুন বাস্তবতায় বিহ্বল আধমরা আধপেটা নারী আর কিশোরী তখন গুদামঘরের অন্ধকারে নিজেদের পুুঁটলি মাথায় দিয়ে অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে শুয়ে পড়েছে। বিরানির গন্ধ গুদামঘরের অন্ধকারে সেধিয়ে থাকা আধপেটা মানুষগুলোর নাকেও সুড়সুড়ি দিয়ে যায়। চাপাপড়া খিদেটা আবার চনমন করে উঠে। নাকে টেনে নেয় বিরানির ভুরভুরে গন্ধ। অনিশ্চিত জীবন আর শহর দেখার উত্তেজনায় তারা তখন বিবশ। তাদের ক্লান্ত চোখ কিছুক্ষণ খোলা থাকে। তারপর সারা দিনের ধকল আর না খাওয়া শরীরের ক্লান্তি ও বিরানির খোশবু নিয়ে তারা বেঘোর ঘুমে ঢলে পড়ে।

রাত আরও একটু গড়ালে গনি মিয়ার দরজা বন্ধ হয়, আলো নিভে না। গনি মিয়া আয়েশ করে বোতল খোলে। ঢালে, খায়। আবার ঢালে, আবার খায়। আরও একটু রাত হলে নিয়াজ আবাসিক হোটেলের করিডোর আর আশেপাশের বাতিগুলো নিভে যায়। ফ্লোরে তেমন কোনও দামি মাল নেই। গুদামভরা সব রদ্দি আর রিজেক্টেড মাল। দামি মাল না থাকায় এখানে রাতে দারোয়ানের ডিউটির প্রয়োজন হয় না। তারা সময়মতো বাতি নিভায়, অন্য ফ্লোরের ডিউটিতে যায়। মোতালিব মিয়ার বন্ধ ঘরের ফাঁক গলিয়ে কিছু আলো পড়ে থাকে করিডোরে। গনি মিয়ার দরজার ফাঁক দিয়েও আসে কিছু আলো। সেই আলোতে করিডোরে আলো-আঁধারির খেলা। পুরো চারতলা জুড়ে নিস্তব্ধতা। 

গ্লাসের পর গ্লাস খেয়ে গনি মিয়া আলো নেভায়, শুয়ে পড়ে। মোতালিব মিয়ার কক্ষের আলোও নেভে। সব কক্ষের আলো নিভে নিয়াজ আবাসিক হোটেলের পুরো চারতলায় অন্ধকার নেমে আসে। 

শুনশান অন্ধকারের মধ্যে মধ্যরাতে ইটের ভাটার মতো জ¦লে দুটো চোখ। দুটো জ্বলন্ত আগুনের কুণ্ড করিডোরে হাঁটে। তারপর এসে থামে গুদামঘরের কাছে। বিকট একটা শব্দ অন্ধকার আর নিস্তব্ধতা ভাঙে। লাথিতে দুর্বল দরজার হুড়কো ভেঙে আগুনের কুণ্ড এসে থামে চালানের মালের কাছে। এলোপাথাড়ি হাত চলে। নানা বয়সী, নানা রকম শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় কামনার হাত। ভয়ে এক কোণে গিয়ে  জড়ো হয় তারা। ভীত, আত্মরক্ষার শক্তিহীন বিহ্বল নারীকণ্ঠের ক্ষীণ অসহায় রোল ওঠে। প্রতিহতের শক্তি আর বুদ্ধিও তাদের ক্ষয়ে যায়। তবু কিছু হাত অন্ধকারে লড়ে, প্রতিহত করতে চায় ছোবল। আগুনের গোল্লার পাশে অন্ধকারে জিনের মতো দাঁড়ায় আরও একটা কালো ছায়া, তার হাতও খেলে যায় উঁচু-নিচু জায়গায়। জিন আর আগুনের গোল্লা মিলে প্রতিহত করে দুর্বল প্রতিরোধ। অন্ধকারে শরীর হাতড়ে পরখ করে যৌবন। তারপর খোঁয়াড়ের ভেতর থেকে মুরগি ধরার মতো খাবলা দিয়ে ধরে নিয়ে আসে পুরুষ্ঠু শরীর।

সচিত্রকরণ : রজত 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button