আর্কাইভগল্প

গল্প : জীবন এক আশ্চর্য দাঁড়কাক : সাঈদ আজাদ

দুপুরের বৈশাখ। তপ্ত তপ্ত চারপাশ! রোদে যেন ঝলসে ঝলসে যাচ্ছে গাছের পাতাসকল। পাতাদের মাঝে কোনও ঢেউ নাই। নাই কোনও  আলোড়ন। থাকবে কী করে! বাতাসের নাম-গন্ধও যে নেই চারপাশে! তার বদলে বিদ্যমান প্রখর রোদ। গুমোট গরম। তাই পাতারা সব স্থির, অচঞ্চল। যেন নড়াচড়া করলেই তারা আরও ঝলসে যাবে।

 কেউ বোধহয় একটু আগে টিউবওয়েল চেপেছে। তাতে টিউবওয়েলের আশপাশের মাটি ভেজা ভেজা আছে এখনও। ভেজা মাটিতে বসে কুকুরটা জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে। আমগাছের ডালে বসে কুকুরটার দিকে তাকিয়ে একটা দাঁড়কাক তার লাল টাকরা বের করে ক্লান্ত স্বরে ডাকছে : ক্বা! ক্বা! ক্বা! ক্বা!

ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে পা ফেলতেই, মন্তাজের চোখ পড়ে দাঁড়কাকটার উপর। আর সব দিনের মতোই কাকটা টিউবওয়েলের উপরে আমগাছটার ডালে বসে আছে। দাঁড়কাক এমনিতেই পাতিকাক থেকে আকারে বড় হয়, কিন্তু এই কাকটা যেন আরও বড়। দাঁড়কাকেরা সাধারণত লোকালয়ে বা মানুষের কাছাকাছি থাকতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না, জানে মন্তাজ। কিন্তু এই কাকটা প্রায়ই তাদের বাড়ি এসে আমগাছে বসে থাকে। কাকটাকে সে আরও কদিন দেখেছে। এই কাকটাই যে সব সময় আসে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত মন্তাজ। এর চোখ দুটো অন্যরকম। অবশ্য আজকের মতো আর কোনওদিন কাকটাকে এত খেয়াল করে দেখেনি সে। তবে আগেও কাকটাকে দেখেছে ঠিকই। বাড়ির আর দশটা পোষা প্রাণির মতো, সাফিয়া-তানিয়ার মতোই যেন কাকটাও এ বাড়ির সদস্য হয়ে গেছে। আসে, আমগাছে বসে। ভাত ছিটালে কুকুরের সঙ্গে ঝগড়া করে খায়। আচ্ছা, কাকটা কি সারা দিন এই বাড়িতেই থাকে, নাকি অন্য কোনও বাড়িতেও যায় ? এর কি কোনও সঙ্গী নেই ? কাকটাকে তো একাই দেখা যায় সব সময়! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে যায় মন্তাজ।  

 কাকটার দিকে তাকিয়ে থাকে মন্তাজ। তবে সে যে কাকটাকে দেখছেই তা না। এমনি তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে কত সময় যে চলে গেছে, সেই খেয়াল নাই তার। কাঁধে গামছা নিয়ে গোছল করতে বের হয়েছিল সে। কিন্তু উঠানের মাঝামাঝি পৌঁছে হঠাৎই ভুলে গেছে কোথায় যাবে! তার একবার মনে হচ্ছে, স্কুল থেকে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলার জন্য বের হয়েছে সে। আবার মনে হচ্ছে, সে বোধহয় কবরস্থানের দিকে যাওয়ার জন্য বের হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হচ্ছে নাহ, সে বোধহয় অন্য কোনও কাজের জন্য বের হয়েছে। কিন্তু কী কাজে যে বাড়ি থেকে বের হয়েছে, সেটা মনেই করতে পারে না মন্তাজ। তাই উঠানের ঠিক মাঝখানে বেভুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে। আর তাকিয়ে থাকে কাকটার দিকে। উঠানের মাঝে গাছ নাই বলে সূর্যের আলো সরাসরি পড়ছে তার উপরে। ঘাড়-পিঠ দরদর করে ঘামছে, কিন্তু সেদিকে ভ্রƒক্ষেপই নাই তার।

 একসময় রোদের তেজে মন্তাজের মাথা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকে। তবু, কোথায় যাবে সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে সে কাকটার দিকেই তাকিয়ে থাকে। মিশকালো দাঁড়কাকটার মধ্যে কী যেন একটা আছে। চাহনিতে কেমন একটা সারল্য, নিষ্পাপ শিশুর দৃষ্টির মতো। সম্মোহিতের মতো কাকটার চোখের দিকে তাকিয়েই থাকে মন্তাজ। হঠাৎ তার মনে হয়―আরে, ধীরে ধীরে কাকটার গায়ের রঙ কেমন বদলে যাচ্ছে না! কালো কাকটা নীলচে হয়ে যাচ্ছে! আকার-আকৃতিতেও কেমন বড় হয়ে হচ্ছে। গায়ে তার ফুটে উঠছে অদ্ভুত সুন্দর নকশা। আরও নীল হতে হতে কাকটা ঝলমলে একটা ময়ূর হয়ে যায় আচমকা। কী সুন্দর লম্বা লেজ ময়ূরটার! কী সুন্দর মাথার তাজ! উড়াল দেওয়ার জন্য ধীরে ধীরে ডানা মেলছে ময়ূরটা। এই বুঝি উড়াল দিল!

আব্বা, কী দেখতাছো ?

মেয়ের ডাকে চোখ ফিরিয়ে বাড়ির প্রবেশপথের দিকে তাকাতেই মাথাটা ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগে মন্তাজের। মেয়ের ডাকটা সে শুনেছে নিশ্চিত, কিন্তু মেয়েকে সে দেখতে পায় না। শব্দে নীল ময়ূরটা উড়াল দিয়েছে। তার ডানায় করে দুপুরের সবটুকু রোদ নিয়ে যাচ্ছে ময়ূরটা। তাই বুঝি উঠানজুড়ে বাদুরের ডানার মতো আঁধার নেমে এসেছে হঠাৎ! চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে মন্তাজ। তার চোখের সামনে সবকিছু কেমন কাঁপছে। ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে সে। কাঁপা কাঁপা সেই আঁধারের মধ্যে ধীরে ধীরে আবছা একটা দৃশ্য ভেসে উঠে। দৃশ্য নাকি দৃশ্যপট, বুঝে উঠতে পারে না মন্তাজ। 

গ্রামের সব লোক মনে হয় জমায়েত হয়েছে তাদের উঠানে। পরস্পর অস্ফুট স্বরে কথা বলছে তারা। উঠানের মাঝ বরাবর চারকোনা কী যেন একটা। অনেকটা লাশ বহনের খাটিয়ার মতো দেখতে। খাটিয়াই! লোকজন ঝুঁকে ঝুঁকে কিছু একটা দেখছে সেই খাটিয়াতে। খাটিয়ায় কী আছে দেখার চেষ্টা করে মন্তাজও। কিন্তু মানুষের ভিড়ে ঠিকমতো দেখতে পায় না। ভালোভাবে দেখার জন্য উঠে দাঁড়াতেই, হঠাৎ আবছা দৃশ্যটা উধাও হয়ে যায় তার চোখের সামনে থেকে। সামনে এখন স্বাভাবিক উঠান। তেজালো রোদ, কলতলা, আমগাছ, কুকুর, কাক। তানিয়া দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে মন্তাজকে।

কী হলো বুঝতে পারে না মন্তাজ। তার ঘোর ঘোর ভাবটা কাটে না। কার যেন একটা লাশ খাটিয়াতে ছিল না ? লাশটা কোনও শিশুর যেন! মুখটা একঝলক দেখেছিল কি সে ? না বোধহয়। নাকি দেখেছিল ? ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সে।

আব্বা, কী দেখতাছিলা তুমি ?

কিছু নারে মা। গোসল করতে যামু তো, তাই পুকুর পাড়ের দিকে যাইতেছিলাম। বলতে বলতেই মনে পড়ে মন্তাজের, আরে সে তো আসলেই গোসল করার জন্য গামছা কাঁধে বের হয়েছিল বাড়ি থেকে। মেয়ের মুখের দিকে তাকায় সে। তাকাতেই, বুকের ভেতরে ধরাস করে উঠে তার। মনে হয় খাটিয়ায় কাফনে মুড়ে রাখা লাশের মুখটা যেন অনেকটা তানিয়ার মতো ছিল ? না, না ও আল্লাহ―এসব কী ভাবছে সে। তার কলিজার টুকরা মেয়েটা কেন লাশ হবে ? সে তো তার চোখের সামনেই আছে। জ্যান্ত। মেয়েকে কোলে নিয়ে চুমু খায় মন্তাজ। মেয়েটা আহ্লাদী ভাব করে তার কাঁধে শুয়ে থাকে। হঠাৎ বদ একটা গন্ধ নাকে লাগে মন্তাজের। মেয়েটা কোথায় কোথায় ঘুরেছে সারাটা দিন কে জানে! গন্ধটা আসছে মেয়ের গা থেকেই। সাফিয়া যে কোথায় গেল! মেয়ের কোনও খোঁজই তো রাখে না সে। মেয়ের খোঁজ আর রাখবে কী, নিজেই সকাল থেকে লাপাত্তা। কে জানে কার বাড়িতে গিয়ে গল্প জুড়েছে। একবার কারও বাড়িতে গেলেই হয়েছে, নাওয়া-খাওয়া ভুলে দিন পার করে দেওয়ার বদ অভ্যাস আছে সাফিয়ার।

সমবয়সী একটা মেয়েকে দেখে বাবার কোল থেকে নেমে পড়ে তানিয়া। মেয়ের গমন পথের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মন্তাজ। ইদানীং কী যে হয়েছে তার, মাঝে মাঝে মাথার ভেতরটা মনে হয় হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যায়। তখন চোখের সামনে আজব আজব দৃশ্য দেখে সে।

চারপাশে ঘন কুয়াশা। তার মধ্য থেকে লোকটা বের হয়। দু হাতে সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছু একটা নিয়ে কুয়াশা পেছনে ফেলে সে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। আর একটু এগুতেই কুয়াশা হালকা হয়ে লোকটার চেহারা দেখা যায়। লোকটা মন্তাজ! তার হাতে ধরা ধবধবে সাদা কাপড়টা দেখে মনে হচ্ছে সেটা কাফনের কাপড়। তাতে লাশ মোড়ানো, সেটাও বুঝা যাচ্ছে। মন্তাজ এবার জোর পায়ে এগিয়ে যায়। হেঁটে গিয়ে সে সাফিয়ার কবরের কাছে পৌঁছায়। হাঁটু গেড়ে বসে। মোড়ানো লাশটা মাটিতে রাখে।

হাতের লাশটা রাখতে না রাখতেই কবর থেকে একটা শরীর উঠে আসে। শরীরটা সাফিয়ার। সে ইঙ্গিতে কী যেন বুঝাতে চায় মন্তাজকে। মন্তাজ ইঙ্গিত বুঝতে পারে পষ্ট। সে মোড়ানো লাশটা হাতে নেয় আবার। সাফিয়ার ইঙ্গিতমতো সেটা কবরে রাখতে গেলে সাফিয়া কাফনের মুখটা খুলে দেখতে চায়। দেখেও। সেই মুখ দেখে চমকে ওঠে মন্তাজ।

মুখটা তানিয়ার।

ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিছানায় উঠে বসে মন্তাজ। তার শরীর ঘামে জবজব করছে। কাঁপছে সমস্ত শরীর। বুকের ভেতরে ধড়ফড় করছে। এটা সে কী দেখলো স্বপ্নে! স্বপ্ন এত বাস্তব হয় ? মনে হচ্ছে, এখনও কবরস্থানে সাফিয়ার কবরের কাছেই বসে আছে সে।

শরীরের কাঁপুনি থামছেই না মন্তাজের। প্রচণ্ড পিপাসা পেয়েছে তার। কিন্তু উঠে গিয়ে পানি খাওয়ার শক্তিটুকু পাচ্ছে না সে। পাশেই শুয়ে থাকা মেয়ের মাথায় হাত বুলায় মন্তাজ। হঠাৎ মনে পড়ে তানিয়ার গা থেকে সেদিন অচেনা একটা গন্ধ পেয়েছিল সে। বাসি পচা ধরনের গন্ধ। মাংশ পচে গেলে যেমন গন্ধ হয় অনেকটা তেমন ধরনেরই গন্ধ ছিল সেটা। তখন সে বুঝতে পারেনি গন্ধটা কিসের। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে, গন্ধটা পচতে থাকা লাশের। সাফিয়ার লাশ কবরে নামানোর সময় এমন গন্ধটা পেয়েছিল সে।

সাফিয়ার লাশ ঘরে ছিল চারদিন মতো। মন্তাজই সাফিয়ার মৃত্যুর খবর সবার কাছে চেপে গিয়েছিল আসলে। জন্ম থেকেই সাফিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মন্তাজের। সাফিয়ার মা আর তার মা খালাতো বোন। মায়েদের বিয়ে হয়েছে পাশাপাশি বাড়িতে। সেই সুবাদে হাঁটতে শেখার পর থেকেই সাফিয়ার সঙ্গে চলাফেরা। বয়সন্ধিতে প্রেম। যৌবনে বিয়ে। মেয়ে তানিয়াকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় সাফিয়া। মাত্র উনিশ বছর বয়সে। সাফিয়ার মৃত্যুকে মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি মন্তাজ। ঠান্ডা লাশকে সে কাপড় পরিয়ে কাঁথা চাপা দিয়ে রেখেছিল। সাফিয়ার শীত করছে ভেবে। বাড়ির কাউকে কিছু জানায়নি। আর সব দিনের মতোই স্বাভাবিকভাবে খাওয়া-দাওয়া করেছে, চলা-ফেরা, কাজকাম করেছে। সবাইকে বলেছে, সাফিয়া খুব অসুস্থ। সে সেবা করছে। ছোট্ট তানিয়াকে যথারীতি মায়ের কাছেই রেখেছে সারা দিন। তাকে সাফিয়ার বুকের দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। ফিডারে গরুর দুধ খাইয়েছে। রাতে সাফিয়ার লাশের পাশেই শুয়েছে সে।

এমন করে করে চারদিন গিয়েছে। মন্তাজের মা কী একটা কাজে মন্তাজের ঘরে উঁকি দিয়েছিল, গন্ধ পেয়েই সে চিৎকার করে উঠে। তারপর সব জানাজানি হয়।

চার বছর হয়ে গেল সাফিয়া নেই। তানিয়াকে পৃথিবীতে এনে নিজে মন্তাজের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। একটা মানুষ আরেকটা মানুষের জীবনের কতখানি জুড়ে থাকে জানে না মন্তাজ। তবে জানে, সাফিয়া এখনও তার জীবন। মা-বাবা, ভাই-বোন, নিজের মেয়ে তানিয়া সবাই মিলেও তার জীবনে এতখানি না, যতখানি সাফিয়া। 

তানিয়ার বাপ, এই তানিয়ার বাপ ওঠ। দিনের বেলা কেউ এমনে ঘুমায় ? সকাল থাইক্যা তানিয়ারে পাওয়া যাইতাছে না। একটু খুঁজতে বাইর হও না তুমি। মেয়েটা সাঁতার জানে না, পানিতে টানিতে পড়ল কি না আল্লাহ জানে। উইঠ্যা খুঁজতে বাইর হও আল্লার দোহাই লাগে।

গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল মন্তাজ। তার ঘুম সহজে ভাঙতে চায় না। ঘুমের ঘোরে তার মনে হয়, কেউ একজন তাকে ডাকছে আকুল হয়ে। কণ্ঠটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকে তার। ধীরে ধীরে সে ঘুমের জগৎ থেকে ফিরে আসতে থাকে। চেতনা পুরোপুরি ফিরে আসতেই সে বুঝতে পারে, সাফিয়া ডাকছে তাকে।

একক্ষণে ঘুম ভাঙল তোমার ? কখন থাইক্যা ডাকতাছি, জাগনের নাম নাই!

ঘুম! মন্তাজ বুঝতে পারে না সাফিয়া ঘুমের কথা কেন বলছে! সে তো দিনের বেলা কোনওদিন ঘুমায় না। আজকে কেন ঘুমাবে!

সারা বাড়ির মানুষ পাগলের মতো পুকুরে-খালে তানিয়ারে খুঁজতাছে, আর বাপ হইয়্যা তুমি মরার মতো ঘুমাইতাছো ?

তানিয়ারে খালে-পুকুরে খুঁজব কা! কী কও না কও, মাথা ঠিক আছে তোমার ? শোয়া থেকে উঠতেই মন্তাজ দেখে দু হাত বাড়িয়ে তানিয়া তার দিকে দৌড়ে আসছে। মেয়েটা এভাবেই দৌড়ে এসে তার কোলে উঠে। মেয়েকে দেখে মুখে হাসি ফুটে উঠে তার। ওই তো তানিয়া।

                কী হইলো, মেয়েরে পাওয়া যাইতাছে না শুইন্যাও তুমি এমনভাবে হাসতাছো কিয়ারে ? সাফিয়া চিৎকার করে উঠে। সেই চিৎকার মন্তাজের কানে পৌঁছায় না। তানিয়া ততক্ষণে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মেয়ের গায়ের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সে।

আব্বা, আম্মায় কবে বাড়িতে আইব ? তুমি না কইছিলা আমারে আম্মার কাছে নিয়া যাইবা। গেলা না তো! আম্মায় কই আছে আব্বা ? আদুরে গলায় কথা বলতে থাকে তানিয়া।

এই তানিয়ার বাপ, কী হইছে তোমার, ঘুমেত্থে উইঠ্যা এমন তব্দা মাইরা বইসা রইলা কিয়ারে ? যাও না সড়কের দিকে গিয়া একবার দেখো না। কই গেল মেয়েটা। সকাল থাইক্যা কিছু খায়ও নাই।

সড়কে যাইতাম কিয়ারে, মেয়ে তো আমার কোলে। চোখে কি কম দেখো ? বলতে বলতে নিজের কোলের দিকে তাকায় মন্তাজ। কই, কেউ তো নাই তার কোলে!

চোখ তুলে মন্তাজ তাকায়। আরে! যেখানে এতক্ষণ সাফিয়া দাঁড়িয়ে কথা বলছিল তার সঙ্গে, সেখানেও তো কেউ নাই এখন। কিন্তু উঠানে অত লোকজন কেন ? তারা কী নিয়ে যেন উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। সেই কথার মাঝে তো তার নামও বলছে তারা। মন্তাজের মাথা যেন ঠিকমতো কাজ করছে না। সে ধীর পায়ে উঠে উঠানের দিকে হেঁটে যায়। তাকে অগ্রসর হতে দেখেই, লোকজনের জটলা একটু ফাঁকা হয়। ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, উঠানের ঠিক মাঝখানে একটা খাটিয়া। মন্তাজ অবাক হয়ে যায়। সে তো এমন একটা দৃশ্য আগেও দেখেছে। সে জানে উঠানের খাটিয়াতে কে আছে। মন্তাজ কি স্বপ্ন দেখছে ? কিন্তু এখন তো সে ঘুমিয়ে নেই। মানুষ কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে পারে ? একটু আগে কি আসলেই ঘুমিয়ে ছিল মন্তাজ ? সে তো জীবনেও কোনওদিন দুপুর বেলায় ঘুমায়নি। সাফিয়াই বা কোথায় গেল ?

মন্তাজ শোনে―লোকজন বলাবলি বলছে, অত ছোট মেয়ে! সে কি আর সাঁতার জানত ? কোনওভাবে হয়তো পড়ে গিয়েছিল পানিতে। উঠতে আর পারেনি।

দুপুর থেকে মন্তাজ মেয়ের লাশ কোলে নিয়ে কবরস্থানের কাছে বসে আছে। তার সঙ্গে এসেছিল গ্রামের আরও কজন লোক। তারা কবর খোঁড়ার জন্য এসেছিল। এসেছিল লাশ দাফন করার জন্য। কিন্তু মন্তাজ কারও সাহায্য নিতে চায়নি। বলেছে, নিজেই মেয়ের জন্য কবর খুঁড়বে, নিজেই মেয়েকে দাফন করবে মাটির তলে। গ্রামের লোকেরা জানে মন্তাজ পাগল কিসিমের লোক। তারা অনেক বুঝিয়েও মন্তাজের কোল থেকে লাশ নিতে পারেনি। শেষে বিরক্ত হয়ে আধখোঁড়া কবর রেখেই সবাই চলে গেছে।

বিকাল শেষ হয়ে সন্ধ্যা যতই ঘনিয়ে আসছে, চারপাশ ততই চুপচাপ হয়ে আসছে যেন। মন্তাজ মেয়ের লাশ কোলে নিয়ে বসেই থাকে। এক সময় সূর্য ডুবে গিয়ে আকাশের গায়ে আধখানা চাঁদ ওঠে। তখন মন্তাজ উঠে দাঁড়ায়। স্বপ্নের লোকটা যেভাবে কুয়াশা ভেঙ্গে লাশ নিয়ে কবরের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, মন্তাজও  সেভাবে জোছনা ভেঙ্গে তানিয়ার কাফন  মোড়ানো লাশ নিয়ে এগিয়ে যায়। হেঁটে গিয়ে পুরনো একটা কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। কবরটা সাফিয়ার।

তানিয়ার লাশটা মাটিতে নামায় মন্তাজ। তারপর ভাঙ্গচোড়া কবরটার উপর থেকে শুকনো পাতা, আবর্জনা, পচে যাওয়া বাঁশ হাত দিয়ে সরাতে থাকে। চাঁদের আলোতে তার দেখতে সমস্যা হয় না মোটেই। যত্ন করে, মমতা নিয়ে এক একটা বস্তু সে কবরটার উপর থেকে সরাতে থাকে। এক সময় কবরের উপরের অংশ পুরো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। চাঁদের আলোয় কবরটার অর্ধেক দেখা যায় পষ্ট। বাকি অর্ধেকে চাঁদের আলো পড়েনি বলে অন্ধকার। কিছুক্ষণ কবরের দিকে তাকিয়ে থাকে মন্তাজ। তারপর ধীরে ধীরে তানিয়ার লাশটা কবরে নামায় সে।

মেয়ের লাশ মায়ের কবরে নামিয়ে কবরের পাশেই বসে থাকে মন্তাজ। একটু পর চাঁদের আলো গ্রাস করে কালো কালো মেঘ। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায়। সময় বয়ে যায়। খানিক পর চাঁদের আলোকে ফেরত দিয়ে মেঘ কোথায় হারিয়ে যায়। সময় বয়েই যায়। বয়েই যায়। কবরের অন্ধকার অংশের দিকে তাকিয়ে মন্তাজ ফিসফিস করে বলে, সাফিয়া! এই সাফিয়া ? তুমি কই ? বাড়ি যাইবা না।

ডাকতেই থাকে মন্তাজ। সাফিয়াকে ডাকতেই থাকে। ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। 

এই তো আমি। মন্তাজের ডাকে এক সময় সাড়া দেয় সাফিয়া। আমারে হাত ধইরা তোল তুমি। আমি উঠতে পারতাছি না।

মন্তাজ তড়িঘড়ি করে সাফিয়াকে কবর থেকে তোলে। সাফিয়া উপর উঠেই বলে, কতদিন তানিয়ারে দেখি না। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো।

প্রবল জ¦রে প্রায় অচেতন হয়ে বিছানায় পড়েছিল মন্তাজ। হঠাৎ কারও ডাকে তার হুঁশ ফেরে। কে যেন ডাকছে তাকে! কে যে ডাকছে, ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারে না সে। তবে কণ্ঠটা পরিচিতই লাগছে। কণ্ঠের মালিককে খুঁজতে গিয়ে দিশা পায় না মন্তাজ। চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঘোলা ঘোলা। মাথাটা এত ভারী যে সেটা তুলবে কী, একটু নাড়াতেও পারছে না। কত দিন ধরে যে শুয়ে আছে বিছানায়, সেই হিসাব নেই তার। জ¦রের ঘোরে দিনরাত টের পায়নি। শুধু অনুভব করেছে মাঝে-মধ্যে কেউ তাকে খাবার দিয়ে গেছে। অথবা তার গা মাথা মুছেছে। 

কণ্ঠটা আবার কী যেন বলে। এবার যেন একটু একটু বুঝতে পারছে মন্তাজ। কথা বলছে তানিয়া। উঠান থেকে তাকে ডাকছে মেয়েটা। মুহূর্তেই যেন জ¦র সেরে যায় তার। গায়ের বল ফিরে পায় সে। বিছানায় উঠে বসে মন্তাজ। সেদিন সাফিয়াকে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। আজ তানিয়াও চলে এসেছে! তার জীবনটা আবার পূর্ণ হয়ে উঠবে। যা হারিয়ে ছিল, সব ফিরে পেয়েছে সে।

আব্বা ও আব্বা! উঠান দাঁড়িয়ে অধৈর্য স্বরে চিৎকার করছে তানিয়া। তুমি আম্মারে বাড়িতে নিয়া আইছো, আমারে আনলা না ? আমি ছোট মানুষ, বাপ-মা ছাড়া একা থাকতে পারি। আম্মা কই ?

তানিয়ার ডাকে পৃথিবীটা যেন দুলতে শুরু করেছে মন্তাজের চোখের সামনে। তবে এই দোলাটা সুখের। তার চোখের সামনে সবকিছু যেন আনন্দে নাচছে। উঠানজুড়ে আলোর বন্যা। ঘর থেকে পষ্ট দেখতে পাচ্ছে মন্তাজ। উঠে দাঁড়ায় সে, বাইরে যাওয়ার জন্য।

ঠিক তখনই সবকিছু আবার বদলে যেতে থাকে। উঠানের আলো কমতে থাকে। তানিয়ার কণ্ঠ কেমন ক্ষীণ হয়ে যেতে থাকে। মনে হয়, মেয়েটা অনেক দূর থেকে ডাকছে তাকে। আলো কমতে কমতে বাদুরের ডানার মতো কালো আঁধারে ছেয়ে যেতে থাকে চারপাশ। গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেও মন্তাজ দেখতে পায়, সেদিনের উড়ে যাওয়া ময়ূরটা ফিরে আসছে আঁধার সরিয়ে সরিয়ে। যে দাঁড়কাকটা ময়ূর হয়ে উড়ে গিয়েছিল উঠানের সমস্ত আলো নিয়ে, আমগাছের ডালে বসতে বসতে সেই ময়ূরটা আবার দাঁড়কাক হয়ে যাচ্ছে। আবারও যেন চারপাশ আলোকিত হচ্ছে! আজও কি উঠানের, বাড়ির সমস্ত আলো নিয়ে নিজেকে আবার সাজিয়ে ফের দাঁড়কাকটা ময়ূর হয়ে উড়াল দেবে অজানার পথে ? আজকের পর হয়তো আর ফিরবে না দাঁড়কাকটা। ময়ূর হয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে অন্য কোথাও।

হঠাৎ মন্তাজ যেন গায়ে হাতির শক্তি অনুভব করে। পাগলের মতো দৌড়ে ঘর থেকে বের হয় সে। উঠানে গিয়ে দাঁড়কাকটাকে হুস হুস শব্দ করে করে তাড়ানোর চেষ্টা করে। দাঁড়কাকটাই উড়ে যাক আজ। কাকটা যেন বদলে ময়ূর হয়ে উঠতে না পারে আবার।

সচিত্রকরণ : রজত   

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button