আর্কাইভগল্প

গল্প : জমক-দোলার রানি : জায়েদ ফরিদ

আয়েশের ভাতঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ল মিনাকুমারী, আজ রাতে যাত্রাপালায় অভিনয় আছে তার। ছোট ভাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করল সে, ‘তোরে যে নাটাকরঞ্জার গোটা আনতে কইছিলাম, আনছিস ?’

‘হ আনছি দিদি, বেশি পাই নাই, গাছে বেশুমার কাঁটা। মার্বেল হইলে চলে না ? কাচের মার্বেল আর জঙ্গলের নাটাফল তো একই রকম, নাটা একটু হালকা, এই যা। কিন্তু নাটা দিয়া তুমি কী করবা দিদি, খেলবা নাকি ?’

মিনাকুমারী মুচকি হাসে, ‘না, নাটা তো নাটাই, নাটার খেলায় কি মার্বেল হইলে চলে! খেলব মাইনষের লগে যারা আমারে দ্যাখে যাত্রা-প্যান্ডেলের তলায় বইসা। তুই নিচে যা, জমক-দোলাটা ধুইয়া মুইছা রেডি করতে বলল হরদয়ালরে। যাত্রার মহাজন হ্যাজাক দিয়া নয়টার সময় লোক পাঠাইব আমারে নেওনের লেইগা।’

নাটা হাতে নিয়ে সাজঘরে ঢুকে দরজায় খিল এঁটে দিলো মিনা। ড্রয়ার খুলে বুকের কাঁচল হাতে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল সে। মনটা খুঁতখুঁত করল তার, আগেকার তুলার প্যাডিংটা চিমড়ে গেছে। বুকগুলো আরেকটু উঁচু হলে ভালো হতো। দুর্গাষষ্ঠী থেকে জষ্ঠি পর্যন্ত কয়েক মাস যাত্রা চলে, এরপর যাত্রাপালা শেষ হয়ে যায়, ‘সাজুগুজু পড়ে থাকে। তখন ছোটখাটো আসর হয়, গান-বাজনা নৃত্য-কীর্তন চলে, সাজগোজের আর তেমন দরকার হয় না।’

সুইসুতার বাক্স বের করে মিনা। কার্পাস তুলা দিয়ে কাঁচুলিতে নতুন করে প্যাডিং করে, ব্রেসিয়ারের দুই চূড়ায় ভেতরের দিক থেকে ঠেসে ধরে সেলাই করে আটকে দেয় দুটো নাটার গোটা। এবার গায়ে ব্লাউজ গলিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়―স্তনের বোঁটার আভাসটা দারুণ হয়েছে। কৌতূহলবশে কাঁচলার বোঁটাগুলো ঠুকনা দিয়ে দ্যাখে সে। সারা গা ঝিম ঝিম করে ওঠে তার। পুরুষমানুষ এমনই তো চায়, শরীরের এত জায়গা থাকতেও ওই ক্ষুদ্র জায়গাটাতেই চোখ করে চায়, স্তনের আকার তখন গৌণ হয়ে যায়। অষ্টাদশী নিতম্বও বেশ সুগঠিত তার, এতেই ঠমক তৈরি হয় হাঁটার সময়। তবু মনে মনে সে যতটুকু নিতম্বিনী, চোখের দেখায় যেন ততটুকু নয়। একটা তোয়ালে নানা প্রকারে ভাঁজ করে নিতম্বকে বেড় দেয় সে, তার ওপরে সায়া পরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দ্যাখে। নাহ, কারও বোঝার সাধ্যি নেই। 

চৌদ্দ বছর বয়সে গ্রামের খুঁজিলদারদের চোখে পড়ে যায় সে, রূপলাবণ্য আর কোঁকড়াচুলের কারণে। অভাবে আর স্বভাবে যাত্রায় নামে মিনাকুমারী। এরপর অভিনয়ে যখন সে সবার মন জয় করে নেয়, তখন তার টাইটেল হয় রানি, মঞ্চের রানি। যাত্রায় রানির বিপরীতে রাজা টাইটেল পায় নায়ক, শহরের সিনেমায় হিরো আর হিরোইনের মতো। লোকারণ্য বুঝে কখনও কখনও শহুরে সিনেমার নায়ক-নায়িকাও রোল করতে আসে যাত্রায়, খ্যাতি, অর্থ দু কারণেই। এ অঞ্চলের মানুষ যাত্রাপালার রাজা-রানিদের শহরের হিরো-হিরোইনদের চেয়ে এক ধাপ ওপরেই স্থান দেয়।

কদিন ধরে হাটে বাজারে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে আর চোঙা ফুঁকে গেছে যাত্রাপার্টির কর্মীরা, অলিগলিতে এখনও চলছে সেই প্রচার―“আজ থেকে তিন দিনের জন্য শুরু হচ্ছে নতুন যাত্রাপালা ‘অরুণমালা’। এর রানি হলেন অত্র অঞ্চলের পরমাসুন্দরী মিনাকুমারী। আজ রাত নয় ঘটিকায় শীতলক্ষ্যার ঘাটে তার বাড়ি ‘রানি-কাটরা’ থেকে জমক-দোলায় চড়ে যাত্রামঞ্চে আগমন করবেন তিনি। যারা তার ভক্ত-অনুরক্ত তারা তাকে সংবর্ধনা দেবেন কিন্তু দয়া করে তার গায়ে কোনও ফুল ছুড়ে মারবেন না। তবে বিনয়ের সঙ্গে তার হাতে ফুল দেওয়া যেতে পারে।”

আলোমতি, পুষ্পমালা, পণমুক্তি, আলাল দুলাল, যে যাত্রাই হোক, দর্শক জানতে চায় পালার রানি কে! যাত্রা যেন এক অভিনয়শিল্পের মৌচাক, রানিকে ঘিরেই সকল আয়োজন। রানি মিনাকুমারীর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করেই লোকসমাগম হয়, দূরদূরান্ত থেকে মানুষের আগমন ঘটে। এর জন্য মিনাকুমারীর প্রচুর পারিশ্রমিক জোটে, জোটে অনেক সম্মান। তার প্রতি শ্রদ্ধার বাড়াবাড়ি, না-দেখা মানুষের কৌতূহলকে বাড়িয়ে তোলে। রানিকে বাড়ির উঠান থেকে সম্মান করে নিয়ে যাওয়া হয় যাত্রায়, অদ্ভুতরকম এক খোলা পালকিতে করে। অভিনয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বছর দুয়েক আগে যাত্রার অবিনাশ মহাজন এই পালকিটা উপহার দিয়েছিলেন তাকে। জাঁকজমক ডিজাইনের এই পালকিটাকে লোকে বলে জমক-দোলা। গোলাকার কাঠের মঞ্চের মাঝখানে বসানো কারুকাজ করা একটি সিংহাসন, মাথার ওপর ঝুলওয়ালা রঙিন সিল্কের চাঁদোয়া। ভারবহনের জন্য সামনের দিকে একটি সেগুনের কড়ি, মাথাটা ময়ূরের মতো, পেছনে দুটো কড়ি, বেহারা ছয়জন। হেঁটে গেলে রানিজির কাপড়ের ভাঁজ নষ্ট হবে, ধুলায় মলিন হবে চেহারা, বসন্তের ঝরাপাতা, পাখির বিষ্ঠা, বিষ্টির ফোঁটা কোনও কিছুই যেন স্পর্শ না করে তাকে।

যথাসময়ে মাথায় হ্যাজাকবাতি নিয়ে উপস্থিত হলো বেহারার দল। রাস্তার দু পাশে দাঁড়িয়ে আছে রানির ভক্তবৃন্দ, কেউ কেউ রানির হাতে তুলে দিল ফুল। যাত্রামঞ্চের পাশে গিয়ে থামল জমক-দোলা। মিনাকুমারী চারদিক ঘুরে বিনীত কুর্নিশ করল উপস্থিত জনতাকে, তারপর হেঁটে গেল যাত্রাপালার গ্রিনরুমের দিকে।

টানা চার ঘন্টা পালার অভিনয় চলল। সামনের দিকে চেয়ারে বসা ব্যবসায়ী নিরঞ্জন সাহা মন্ত্রমুগ্ধের মতো মিনাকুমারীর অভিনয় দেখল। প্রবল ইচ্ছা হলো তার রানির সঙ্গে কথা বলার কিন্তু মঞ্চের পেছনে গিয়ে তার সঙ্গে নিভৃতে কথা বলার কোনও সুযোগই সৃষ্টি হলো না।

২.

অরুণমালা যাত্রার শেষ দিন বিকেলবেলা রানির কাটরায় গিয়ে উপস্থিত হলো নিরঞ্জন। নিচতলায় দারোয়ান হরদয়ালের কাছে একটি চিরকূট দিয়ে বলল, ‘রানিজি ব্যস্ত জানি, কিন্তু আমি একটু জরুরি কাজে দেখা করতে এসেছি, এই কাগজে নাম-পরিচয় লেখা আছে আমার।’ হরদয়াল উপরে গিয়ে ফিরে এসে বলল, ‘জনাব, আপনেরে নিচে বইতে কইছেন রানিজি, উনি আওয়াজ দিলে উপরে লয়া যামু।’

রানিজি দোতালার বারান্দায় চেয়ারে উপবিষ্ট, নিরঞ্জন সাহা নমস্কার করে দাঁড়াল।

‘আপনি বসুন নিরঞ্জনবাবু, বলুন কী কারণে আমার সঙ্গে দেখা করার দরকার পড়ল আপনার ? একটু সংক্ষেপে বলবেন, জানেন তো রাতে অভিনয় আছে আমার।’

‘আমি ব্যবসায়ী মানুষ, শীতলক্ষ্যার ওপার থেকে যাত্রা দেখতে আসি। আমার নীল পানসিটা আপনার বাড়ি সোজাসুজি ঘাটে নোঙ্গর করে রাখি। মুগ্ধ হয়ে যাত্রাপালায় আপনার অভিনয় দেখছি গত দু বছর থেকে। এবার মনে হলো, আপনার সঙ্গে দেখা করি। খুব ভালো লাগে আপনাকে, আপনার শঙ্খের মতো রূপ, হরিণীর মতো চোখ, দেবদারু পাতার মতো কোঁকড়ানো চুল, সবকিছুই। ভালোলাগার নিদর্শনস্বরূপ সামান্য উপহার এনেছি আমি, গ্রহণ করলে বাধিত হব রানিজি।’

“আমাকে যে ভালো লাগে তা আপনার চোখ দেখেই বুঝলাম। কিন্তু সেটা কি আমার অভিনয়ের কারণে নাকি রূপলাবণ্যের জন্য ? জানি, আপনার উত্তর হবে, ‘দু কারণেই’, কিন্তু প্রধান কারণটা কী তা আমার জানা খুব প্রয়োজন, অভিনয় নাকি রূপ ?”

নিরঞ্জন সাহা এমন সরাসরি প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না। তবু সে উত্তর দেয়, ‘রূপটা আদৌ প্রধান নয় রানিজি, প্রধান হলো অভিনয়, আপনার অভিনয়ের দক্ষতা। আলোমতি, অরুণকুমার পালায় আপনার অভিনয়ের কিছু ডায়ালগ আমি এখন মুখস্থও বলতে পারি।’

“না, তা বলতে হবে না, আমি বিশ্বাস করলে কাউকে পরীক্ষা করি না নিরঞ্জনবাবু,আপনার উত্তর ‘রূপ’ হলে আমার ভেতরে অনেক তোলপাড় হতো, যা কয়েকবারই হয়েছে।”

‘তোলপাড় হবে কেন ?’

‘সেসব অনেক কথা, এত কথা বলার জন্য আজ তো সময় খুব কম। সংক্ষেপে বলি, রূপের কারণেই একবার কিছু অতি-ভক্ত বখাটে মানুষ আমাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই রাতে যাত্রার অবিনাশ মহাজন তার লোকজন নিয়ে না গেলে কী হতো জানি না। এখন তার দেখভালের কারণে আমি অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকি। আমার সবকিছু জেনেও তিনি আমাকে খুব ভালোবাসেন, স্নেহ করেন, যাত্রায় আমার অভিনয়ের ভালোমন্দ নিয়ে প্রতি রাতেই কিছু কথা বলেন। যাক সেসব কথা, বিস্তৃত বলার সময়-সুযোগ এখন নাই, এবার আপনার উপহার বের করে দিন আমাকে।’ 

নিরঞ্জন উপহারের লাল কাগজের মোড়ক খুলতে থাকে, লাল মোড়কের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে নীল মোড়ক। এবার নীল মোড়কটা খুলতে খুলতে বলে, ‘উপহারটা আসলে খুব ছোট, বড় কিছু দেবার অবস্থা জীবনে কখনও সৃষ্টি হয়নি আমার।’

মিনাকুমারী উপহারের এই অদ্ভুত জাদুকরি উপস্থাপনার দিকে চেয়ে বিস্মিত-হাসিতে বলে, ‘যত ছোটই হোক, হাত দিয়ে তা ধরতে পেলেই হবে।’

তৃতীয় মোড়কটা সোনালি রঙের, তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দু খানা নকশাদার সোনার চুড়ি, ‘এগুলো হাত দিয়ে ধরা যাবে রানিজি।’

মিনাকুমারী মৃদু হেসে সোনার চুড়িদুটো হাতে নিয়ে বলে, ‘রানিজি বলতে হবে না, মিনাকুমারী বললেই ভালো। সবাই কেবল রানি-রানি করতে থাকে, মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে আমার, কিন্তু ভক্তদের আমি আহত করতে পারি না কখনও।’

‘মিনাকুমারী, আপনি ব্যস্ত। এখন বলি, শুধু এতটুকুতেই কি সীমাবদ্ধ থাকবে আমাদের পরিচয় ?’

‘না, পরিচয় তো শেষ হয়নি, তবে সেটা শেষ করা খুব দরকার, আমার জীবনের অনেক কথা আছে, যেসব আপনার অজানা, সেগুলো না বললে আপনাকে ধোঁকা দেয়া হবে, আমি কখনও তা করতে চাই না। অরুণমালা যাত্রাপালা কালই শেষ হয়ে যাবে, আপনি চাইলে পরশু দিন আমাদের দেখা হতে পারে। কিন্তু এখানে নয়, সমস্যা না হলে আপনার পানসিতে। শুক্লা দ্বাদশীর রাতে আপনার সঙ্গে শীতলক্ষ্যার বুকে কিছুক্ষণ ঘুরতে মন চাইছে।’

‘নিশ্চয়ই, এ আমার সৌভাগ্য মিনাকুমারী, রাত দশটার পর আমি ঘাটে অপেক্ষায় থাকব।’

৩.

যাত্রার শেষ দিন, প্যান্ডেলের নিচে সামনের সারিতে বসে নিরঞ্জন লক্ষ করল, মিনাকুমারীর হাতে তার দেওয়া উপহারের চুড়িগুলো ঝকমক করছে। সেই ঝকমকি তার অন্ধকার মনের ভেতরটা উজ্জ্বল করে তুলল, কালই তার সঙ্গে দেখা হবে শীতলক্ষ্যার তীরে!

শুক্লা দ্বাদশীর রাতে নদীতে মৃদু জোছনার বান। ঘাটে পৌঁছুতেই এগিয়ে এল নিরঞ্জন। মিনাকুমারী বলল, ‘পানসিটা উঁচু, আমার হাতটা ধরুন নিরঞ্জনবাবু, নইলে পড়ে যেতে পারি।’

‘না, মিনাকুমারী, আমি উপস্থিত থাকতে জীবনে কখনও কি পড়তে দেব আপনাকে! আপনি খোলা পাটাতনে না বসে ছইয়ের ভেতরেও বসতে পারেন।’

‘না, আমি খোলাখুলি আপনার খুব কাছেই বসতে চাই, বলতে চাই অনেক কথা। আজ আপনি আমার কথাগুলো শুনবেন মনোযোগ দিয়ে। তারপর আপনার ভালোলাগার বিশ্লেষণ করবেন।’

‘আপনি বলুন, শ্রোতা হিসাবে আমি বেশ উৎকৃষ্ট।’

হালকা পানসিটা স্রোতের মুখে ঠেলে দেয় নিরঞ্জন, পাল তুলে দেয়। নৌকাটা তিরিতির করে এগুতে থাকে। মিনাকুমারী নিরঞ্জনের আধো-অন্ধকার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আপনি কি জানেন, আমি সত্যিকার নারী নই ?’

নিরঞ্জন থতমত খায় কিন্তু স্পষ্ট করে বলে, ‘জি, তা আমি বলতে শুনেছি যাত্রা দর্শকের কারও কারও মুখে, কিন্তু তাতে আর কী এসে যায়, আপনি বলুন আপনার জীবনের কথা, আমি একজন উৎকৃষ্ট শ্রোতা।’

‘জন্মের পর, কিশোরী বয়সে আমি অনুভব করলাম, আমাকে ঈশ্বর প্রকৃত নারী হিসাবে তৈরি করেননি। কিন্তু মনের দিক থেকে নিজেকে নারীর মতোই অনুভব করতাম আমি। রাতের বেলা মেয়েদের সায়া-ব্লাউজ পড়ে ঘুমাতাম। স্বপ্ন দেখতাম, কাঁচুলি ছিঁড়ে বড় হয়ে উঠছে আমার বুক। আরও যখন বড় হলাম, হালকা কিছু দাড়িও গজালো থুতুনির নিচের দিকে যা আমি সহজেই উপড়ে ফেলে দিতাম। আমার মুখের আদল হলো নারীর মসৃণ মুখের মতো, কণ্ঠ হলো চিকন, পুরুষের কোনও লক্ষণই এতে দেখা যেত না। ফ্রক আর দুল পরে ইশকুলেও গিয়েছি আমি। কিন্তু অভাবের কারণে আর পড়া হয়ে ওঠেনি আমার। এরপর পাড়ার মানুষ আমাকে যাত্রায় নামিয়েছে, এখানে অবিনাশ মহাজনের স্নেহমমতায় আমি ভালো আছি। কিন্তু ইদানীং একটি চিন্তা আমাকে খানিকটা অস্থির করে রাখে। অনুভব করি, আমি যেমনই হই না কেন, সাধারণ মানুষের মতো আমারও মায়ামমতা জড়ানো একটা সংসার করতে বড্ড ইচ্ছা করে। আমার মানসিক অনুভব তো আর দশটা মানুষের মতোই, মানসিকভাবে আমি সম্পূর্ণই নারী। তাই বলে আমার দৈহিক অনুভব যে নেই তা নয়, হয়তো এলোমেলো, কিন্তু দৈহিক অনুভব ঠিক কেমন হওয়া প্রয়োজন, তাও কখনও জানা হয়নি আমার। আপনি নিশ্চয়ই খারাপ অনুভব করছেন এসব শুনে।’

‘না, একটু খারাপ অনুভব করছি। কারণ এতে আমার সঙ্গে আপনার দূরত্ব বেড়ে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে মনে করছেন আপনি। মানুষের কেন যে এক বিশেষ রকম ভালোবাসার দরকার হয় জানি না। মায়ের প্রতি, ভাই বা বোনের প্রতি অনুভব কি ভালোবাসা নয় ? আমি মায়ের সঙ্গে আলাপ করব, তিনি একজন মহান উদার মনের নারী, তিনিও যাত্রার অভিনেত্রী ছিলেন কোনও এক বিস্মৃত যুগে। আমার ধারণা, তিনি এসব অবশ্যই নিজ গুণে মেনে নিতে পারবেন।’

‘আমার মনে হয়, এক্ষুনি মায়ের কাছে রওনা হয়ে যাই, পায়ের কাছে বসে তার কথা শুনি, সেবাযত্ন করে মনটা ভরিয়ে দেই তার।’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই যাবেন, মাকে আমি হালকাভাবে বলেও রেখেছি, তবে তার কাছে হঠাৎ করে না গিয়ে, ধীরে সুস্থে চলুন, দুদিন পর চতুর্দশীতে, চাঁদ যখন পূর্ণ হয়ে উঠবে। আপনিও নিশ্চয়ই পূর্ণ হয়ে উঠবেন সেদিন, আর আমাকেও পূর্ণ করে তুলবেন।’

মিনাকুমারীর মনে হয়, পৃথিবীর কজন মানুষ আর তার মতো একজন অপূর্ণ মানুষকে পূর্ণতা দিয়ে তাকে সংসারে স্থান দিতে পারে! সে ভীষণ অভিভূত হয়ে পড়ে, ‘আমাকে কখন যে আপনি মায়ের কাছে নিয়ে যাবেন! আমি অন্তর থেকে তার কাছে যেতে চাই, মায়ের স্পর্শ, সংসারের স্পর্শ পেতে চাই।’

‘আপনি অস্থির হবেন না মিনাকুমারী, আর তো মাত্র দু দিন বাকি, এরপরই আপনি নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন। এই জায়গা থেকেই আমরা সন্ধ্যার পরপরই পানসি নিয়ে চলে যাব শীতলক্ষ্যার ওপারে, মায়ের কাছে।’

৪.

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠার আগেই ঘাটের চাতালে পৌঁছে যায় মিনাকুমারী। নাহ, এখনও ঘাটে এসে পৌঁছেনি নিরঞ্জনের নীল পানসি। আজ বেশ ঢেউ উঠেছে জলে। সে-ই হয়তো অস্থির হয়ে একটু আগে এসে পড়েছে, আরও অপেক্ষা করতে হবে তার, ধৈর্য ধরতে হবে। শীতলক্ষ্যার ওপারে মায়ের দর্শন না হয় একটু কঠিনই হলো! নিশ্চয়ই এক সময় হাওয়া পড়ে যাবে, গাঙের তাফাল শেষ হবে, নেমে যাবে ঢেউয়ের ফণা। জলের আচরণ শান্ত হলেই পানসি নিয়ে এসে পড়বে নিরঞ্জন। অনেক কিছু ভাবতে থাকে সে, একা একা ঘাটে বসে থাকতে কষ্ট হয় তার, বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। তবু মনকে প্রবোধ দেয় সে, একবার, দুবার, বহুবার।

কিন্তু নিরঞ্জনের পানসি আর আসে না। অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে কাটরায় ফিরে যায় সে। মন তার ভেঙ্গে যায় ঢেউয়ে-ভাঙ্গা শীতলক্ষ্যার জোছনার মতো। তবু সেই ভাঙ্গা-জোছনার টুকরো আভায় মনের ভিতর এক অপার্থিব ক্ষীণ আলো ঝিকমিক করতে থাকে তার। হয়তো গভীর রাতে কাটরাতে ফিরে আসবে নিরঞ্জন। এসে বলবে, মায়ের শরীরটা একদম ভালো ছিল না মিনা, অথবা বলবে, শীতলক্ষ্যায় আজ উঠেছিল নিদারুণ ঢেউ, যা অতিক্রম করতে গেলে দেখা দিত জীবন সংশয়।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button