আর্কাইভগল্প

গল্প : চাকরিজীবী ওসমান আলি : হোসেন আবদুল মান্নান

তখন পড়ন্ত বিকাল। হোটেল ইলিশিয়ামের বাহিরের সিঁড়িতে পা রেখে একা দাঁড়িয়ে আছেন সেলিম সাহেব। তিনি হাঁটার পোশাকে নিচে নেমে আরেকজন সহকর্মীর জন্য অপেক্ষমাণ। সে এলেই একসঙ্গে হাঁটতে বের হবেন। হাঁটা সকাল, বিকেল বা রাত যা-ই হোক, সঙ্গে  একজন সঙ্গীর দরকার লাগে। এতে গল্পের ছলেই শারীরিক কসরত করে নেওয়া যায়, আবার সময়ও পার করা যায়। হঠাৎ সেলিম সাহেব দেখলেন ওসমান আলি নামের তার এক সিনিয়র সহকর্মী হেলেদুলে বাহির থেকে ভেতরে আসছেন। তার হাতে পলিথিনে মোড়ানো দুটো মিষ্টি, যা বাইরে থেকে সহজেই দৃশ্যমান।

সেলিম সাহেব বললেন, কী ভাই, মানুষ চারজন, মিষ্টি দুটো মানে কী ?

ওসমান আলি বলেন, বাসায় কেউ নেই। আমি একাই আছি, তাই।

তাহলে তো এক পিস হলেই চলত।

ওসমান আলি বিরক্ত। এসব কথার কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা তৃতীয় তলায় তার নিজের কক্ষে চলে যান।

সেলিম সাহেব মনে মনে বললেন, আহা! লোকটা এখন আর স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। একদম শেষ হয়ে গেছে।

আর এর জন্য তার পরিবারের অসহযোগিতা অনেকাংশেই দায়ী।

দুই.

ওসমান আলি এক ঔদাসিন্যে ভরা ভাবুকহৃদয় মানুষ। ছাত্রজীবন থেকেই প্রচণ্ড স্মৃতিশক্তির অধিকারী। তারা রাজশাহীতে বড় হলেও পূর্বপুরুষেরা ভারতের মালদা অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন। উচ্চ শিক্ষিত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা-মা উভয়ই স্নাতক ডিগ্রিধারী ছিলেন। রাজশাহী শহরের স্কুল কলেজে পড়াশোনার সময়ে ওসমান আলি নিজেও একজন অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বরাবর ভালো রেজাল্ট করায় পাড়াপড়শিতেও তার ব্যাপক নামযশ ছিল। যে কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় কৃতকার্য হওয়া তার কাছে নিতান্তই মামুলি বিষয় ছিল। মুখস্থ করার অপরিসীম ক্ষমতা তাকে তখন স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতিতে পরিণত করে তুলেছিল। তার কলেজ শিক্ষকগণ তাকে নাম দিয়েছিলেন ‘ওসমান ভ্রাম্যমান অভিধান’। এমনকি এমএ পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই তাকে কলেজের অস্থায়ী শিক্ষকের পদে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। সত্তরের দশকের শেষ দিকে কলেজের শিক্ষকতা করতে করতে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন ওসমান আলি। এবং সকলকে চমকে দেওয়ার মতো রেজাল্ট করেন। মেধা তালিকার শীর্ষ পর্যায়ে তার অবস্থান। ক্যাডার সার্ভিস। চাকরি হয়ে যায় সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় ইডেন ভবনের সচিবালয়ে। চাকরির সুবাদেই ঢাকা এবং সচিবালয়ে তার প্রথম আসা হয়। এবং সেখানেই তিনি জীবনের শেষাবধি কাটিয়ে যান।

তিন.

ওসমান আলির জীবনে বহুমাত্রিক এবং বহুরৈখিক সমস্যা দেখা দেয় মূলত বিয়ে করার পরে। এর আগে তার মধ্যে বাস করা অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ার মতো ছিল না। তার প্রাপ্ত এমন লোভনীয় চাকরির কারণে কিছু দিনের ব্যবধানে ঢাকায় বসবাসকারী এক সুন্দরী বিদুষী রমণীর প্রেমে পড়ে যান তিনি। সে সুন্দরীর নাম শম্পা চৌধুরী। পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকায় তাদের বাসা। মূলত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। বিহারি অরিজিন হলেও শম্পা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। মালদা অঞ্চলের মানুষ হওয়ায়  ওসমান আলির কথা, বাচনভঙ্গি, চেহারা দেখে বোঝার সুযোগ নাই যে, তার ভেতরে বাস করে এক উদাসীন কবির বাউলা জীবন। নারীরা জানে, বিয়ের জন্য এসব কোনও বড় প্রতিবন্ধকতা নয়। যেখানে তার এমন গুরুত্বপূর্ণ চাকরি রয়েছে। সংসার হলে পুরুষমানুষের সব কবিত্বকলা পালিয়ে যায়। অতএব সেই শিক্ষিত সুন্দরী ললনা ওসমান আলিকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করে নিল। বিয়ের কিছুদিন যেতেই দেখা যায়, তার সহকর্মীরা একে একে সবাই পদোন্নতিপ্রাপ্ত হয়েছেন। তাদের বেতন-ভাতাদি বৃদ্ধি পেয়েছে বহু গুণ। কিন্তু ওসমান আলির কিছু হয়নি। তিনি ক্রমাগত ব্যাচের পেছনে পড়ে যাচ্ছেন। প্রথম প্রথম স্ত্রী এসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও পরে নিজেই স্বামীর সহকর্মী বন্ধুদের নিকট থেকে খোঁজখবর নিতে থাকেন। জানতে পারেন, ওসমান  বিভাগীয় পরীক্ষা পাস করেন না বিধায় তার পদোন্নতি হয় না। এ বিষয়ে স্ত্রীর কোনও প্রশ্নের উত্তর না দেওয়া হলো তার কৌশল। ইতোমধ্যে ওসমান আলি এক কন্যাসন্তানের জনক হলেন। মেয়েশিশুটি যেন দেবশিশু রূপে পৃথিবীতে আগমন করল। ইতোমধ্যে স্ত্রী তার গতিবিধি আমলে নিয়ে নিজেই একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। দুজনে মিলে সংসার চালাবার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ওসমান দিনকে দিন অমনোযোগী আর অগোছালো জীবনের পথে হাঁটছেন। তাকে ফেরানো দায়। যেন রাস্তাচ্যুত এক অন্যমনস্ক বোহেমিয়ান তিনি। বছর দেড়েক বাদে তাদের কোলে দ্বিতীয় কন্যাসন্তান চলে আসে। সংসার বড় হচ্ছে। ওসমানের সেদিকে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। তিনি স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে পরীক্ষা দিতে যান, তবে খাতায় উত্তর না লিখেই বের হয়ে আসেন। বলেন তার নাকি বইয়ের পড়া একেবারেই মনে থাকে না।

ওসমান আলির বিভাগীয় পরীক্ষা চলাকালে বা সে যুগে বাংলাদেশ টেলিভিশন দেশব্যাপী এক মজার কুইজ প্রতিযোগিতা চালু করেছিল। প্রতিযোগীরা সরাসরি টিভি সেটে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এতে অংশ নেন। দেশে তখন টেলিভিশন বলতে সেই বিটিভি। এ জাতীয় অনুষ্ঠান শিশু বৃদ্ধ সকলের কাছেই প্রিয়। ওসমান আলি তখন প্রায় মধ্যবয়সী এক চাকরিজীবী। পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে অতি সন্তপর্ণে এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগীরা অপেক্ষাকৃত কম বয়সের হলেও ওসমানের কোনও সমস্যা নেই। সর্ব্বোচ্চ প্রশ্নের সঠিক উত্তরদাতা পাবেন একটা ২৬ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশন।

ওসমান আলি প্রতিজ্ঞা করেন, আমার স্ত্রী আমাকে যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করুক রঙিন টেলিভিশন পেলে বুঝতে পারবে আমি কী জিনিস। তখনকার দিনে টেলিভিশনই এক অমূল্য দর্শনীয় বস্তু। বলা যায়, রঙিন টেলিভিশন ছিল প্রায় বিরল।

চার.

ওসমান আলি সে বছর টিভিতে একটানা পাঁচটা এপিসোডে অংশ নিলেন। প্রতিটাতেই তিনি প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন। অপেক্ষাকৃত তরুণদের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতা তাকে বাড়তি আনন্দ দেয়। তিনি টেলিভিশন শো-তে অংশ নেওয়ার কথা তার স্ত্রীকে না জানালেও স্ত্রী পূর্বেই তার নিকট আত্মীয়স্বজনকে খবর দিয়ে রাখতেন।

যেন সকলেই তার পাগল স্বামীর মেধা দেখেন। অনুষ্ঠানের উপস্থাপক বা সঞ্চালকও ইতোমধ্যে দর্শক দরবারে তার প্রতিভার তারিফ করতে শুরু করেছেন। অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তরও ওসমান মুহূর্তের মধ্যে সশব্দে উচ্চারণ করে সকলকে চমকে দিয়েছেন। রানার-আপ পর্বেই তিনি প্রথম স্থান বাগিয়ে নেন। চূড়ান্ত পর্বে ওঠে তিনি আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হন। এবং যথারীতি পরের সপ্তাহের শেষ এপিসোডে সর্বাধিক পয়েন্ট লাভ করে রঙিন টিভি নিয়ে বাসায় ফেরেন।

সেদিন রাত পোহাতেই কী যেন এক  অভাবনীয় ঘটনা ঘটে গেল। ওসমান আলি তৃতীয় কন্যার বাবা হলেন। স্ত্রীর মন ভেঙ্গে যায়। তিনি সাফ বলে দিলেন কেউ তার টিভি দেখবে না। এই রঙিন টেলিভিশন হোটেলের নিচ তলায় রেখে আস। স্ত্রীপক্ষের সবাই আশা করেছিল এবার অন্তত একটা পুত্রসন্তান আসবে। না, তা হলো না। দু কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে ওসমান ভাবলেশহীন বসে আছেন টিকাটুলি এলাকার একটা মাঝারি মানের ক্লিনিকের অপেক্ষাগারে। তিনি মনে মনে আওরাচ্ছেন ‘এতে কী কারও হাত আছে! আল্লাহ পাক সব ঠিক করে রেখেছেন। রিজিকের মালিক তো তিনি। আমার সুন্দরী কন্যারা অবশ্যই  একদিন অনেক বড় হবে।’

ওসমান আলির জিতে আনা রঙিন টেলিভিশনের আনন্দ যেন মাটি হয়ে গেল। চাকরির বিভাগীয় পরীক্ষা পাস করতে না পারা লোকটা তার স্ত্রীর কাছে সবসময় এক অপদার্থ, অকর্মণ্যই থেকে গেলেন।

পাঁচ.

একদিন দুপুরবেলায় পাশের কক্ষের বাসিন্দা মামুন সাহেবের দরজায় জোরে কড়া নাড়ছেন ওসমান আলি। সময়ে অসময়ে তিনি এমনটা করেন। এতে প্রতিবেশীদের কেউ কিছু মনে করত না। তবে আজকের কড়া নাড়ার একটা বিশেষ হেতু আছে। তিনি মনস্থ করেছেন বাসায় মিলাদ মাহফিলের ব্যবস্থা করলে পরিবারে সুখ শান্তি আসবে। স্ত্রী-কন্যাদের ওপর আল্লাহর তরফ থেকে নেক আমল বর্ষিত হবে। তাই তিনি আগামীকাল বাদ আসর তার কক্ষে অনুষ্ঠেয় এক মিলাদ- মাহফিলের দাওয়াত দিতে এসেছেন। এ উপলক্ষে নিচতলার মসজিদের ইমাম রহমতুল্লাহ হুজুরকে বলা হয়েছে। তিনি অতি উঁচু মানের বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব এবং হাফেজ। তার বয়ান ও কণ্ঠের মাধুর্য নিয়ে সর্বত্র প্রশংসা আছে। এতে আরও অল্প সংখ্যক প্রতিবেশীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। কাজেই মামুন ভাই আপনাকে থাকতেই হবে।

মামুন সাহেবের স্ত্রী জানেন ওসমান আলি ভাইয়ের মিষ্টি খুব প্রিয়। মিষ্টি খাওয়ানোর কথা বলে তাকে যে কোনও স্থানেই নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তিনি তাড়াতাড়ি করে বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দু পিস মিষ্টি এবং এক গ্লাস পানি দেন। বেচারা আনন্দের সঙ্গে মিষ্টি খেয়ে ভাবির জন্য দোয়া করলেন। বললেন, ভাবি কখনও আমাকে এক পিস মিষ্টি দেন না। দুটো করে দেন। ওসমান বাসা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মামুন তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন, বলো, এই পাগলের দাওয়াতে লোকজন যাবে তো ? স্ত্রী বললেন, অন্য কেউ যাক না যাক তুমি কিন্তু যাবে। মিলাদ-মাহফিল বলে কথা।

পরদিন বাদ আসর মামুন সাহেব যথাসময়ে তার নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়ে  হাজির হলেন। তখন ইমাম সাহেব আর হোস্ট ওসমান আলি দুজন মাথায় টুপি পরে মেঝেতে কেবলামুখী হয়ে বসে আছেন। ইমাম সাহেবের হাতে একটা ছোট দানার তসবি। তার চোখ বন্ধ। মামুন সাহেব তৃতীয় জন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও চতুর্থ জনকে পাওয়া গেল না। মনে হয়, আমন্ত্রিত সকলই তাকে উপহাসের পাত্র বিবেচনা করে অনুপস্থিত থাকে। অবশেষে তিনজনের উপস্থিতিতে যথাযথ নিয়মে ওসমান আলির মিলাদ মাহফিলের সমাপ্তি হলো। আগরবাতি, গোলাপজল ও তাবারক সবই আনা হয়েছিল। শুধু  অতিথি ছিল না। কষ্টের ব্যাপার হলো, তার এমন আয়োজনে স্ত্রী এবং তিন কন্যার অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিল।

ছয়.

এই পৃথিবী কত বিচিত্র! সৃষ্টির কী নিগূঢ় রহস্যময়তা, কী ছলাকলার জীবনগাথা! সবকিছু যেন মানুষের অগম্য ও দুর্বোধ্য। মেধাবী ওসমান আলি আর কোনও দিন বিভাগীয় পরীক্ষাগুলো পাস করতে পারেননি। ফলে তার একটাও পদোন্নতি হয়নি। তেত্রিশ বছর পূর্বে তিনি যে পদে সরকারে যোগদান করেছিলেন, বলা যায় একই পদমর্যাদা নিয়ে গোটা জীবন কাটিয়ে দেন। চাকরি জীবনের একটা সময়ে এসে চাকরি, পদ-পদবি, পদোন্নতির আলোচনা শুনলে তিনি নিভৃতে এড়িয়ে যেতেন। পারতপক্ষে নিজের সহকর্মীর নাম মুখে আনতেন না। শুনলে আনমনা হয়ে অন্যত্র তাকিয়ে থাকতেন। তবে জীবনের এক অপরাহ্ন বেলায় দাঁড়িয়ে মনের অজান্তেই অনেকটা স্বগতোক্তির মতন করে একবার বলে উঠেছিলেন, ‘জানেন, বর্তমান সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব কিন্তু আমার ব্যাচমেট এবং মেধা তালিকায় আমার অনেক পরে তার পজিশন ছিল।’

চাকরির শুরু থেকে সুদীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন সরকারের অধীনে তিনি কাজ করেছেন। কাজ বলতে এক প্রকার অফিসে যাওয়া আসার মতন। কখনও কেউ তাকে আমলে নিতেন না। সচিবালয়ের তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের সমকক্ষ জীবিকা ছিল তার। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সরকারের অপার বদান্যতা এবং অনুকম্পা নিয়েই তার এমন বেদনাদায়ক চাকরিকালের করুণ যবনিকাপাত ঘটে। আরও এক বিপন্ন বিস্ময় যে, অবসর জীবনের অম্লমধুর স্মৃতির কোনও মিনার গড়ে তোলার আগেই ওসমান আলি আকস্মিক এক জোছনাভরা রাতে মানুষের পৃথিবীর সব হিসাব-নিকাশ বুঝিয়ে দিয়ে অনন্তলোকে পাড়ি দেন।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button