
এক
ধ্বজাদণ্ডটি উন্নতশীর্ষ। ঋজু। অনড়। সুদৃঢ়ভাবে রথলগ্ন। প্রবল ঝঞ্ঝা আর প্রচণ্ড আঘাত সহনক্ষম। রথের ধ্বজাটি শত্রুপক্ষের মনে ভীষণ ভয় জাগায়।
দণ্ডটির প্রান্তভাগে একটি জ্যান্ত শকুন। বিরাটাকার। পাখা দুটো দু পাশে প্রসারিত। পাখার ঝাপটায় বাতাসে ঘূর্ণি। মাঝে মাঝে দুটো পায়ের একটি দিয়ে অদৃশ্যমান শত্রুকে ঘায়েল করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে শকুনটি। এর নখাগ্রভাগ তীক্ষè। ঠোঁট বক্র। এবং তিরের ফলার মতো শাণিত। চোখ দুটো হিংস্র। অবিরত ক্রূর ক্রুদ্ধ চিৎকার করে যাচ্ছে। চঞ্চল ক্ষুব্ধ গৃধ্রটির কর্কশ আওয়াজ চারদিকের অরণ্যময় প্রশান্ত পরিবেশে চিড় ধরাচ্ছে।
ধ্বজার পতাকাটির রং লাল। যেন শোণিতে চোবানো।
পক্ষিকুলের মধ্যে শকুন অত্যন্ত হিংস্র। চেহারা বিকট। নিষ্ঠুরতা তার স্বভাবজাত। দূরাকাশ থেকে শিকার খুঁজে নেবার এমন দক্ষতা আর কোনও পাখির নেই। শকুনের স্বভাবের সঙ্গে রথমালিকের প্রকৃতির সাজুয্য আছে। পতাকার রঙের সঙ্গে রথীর চরিত্রের মিল খুব। রক্তিম নিশানটি রথারোহীর মনোচিত্রের প্রতীক যেন!
পতাকাদণ্ডটি যে-রথে স্থাপিত, তা সাধারণ কোনও রথ নয়। এর আকৃতি বিশাল। রথটি লৌহনির্মিত। সুবৃহৎ আটটি চাকার ওপর স্থাপিত। ভালুকের চামড়ার আস্তরণ গোটা রথটায়। অষ্টচক্রবিশিষ্ট এই রথ কিন্তু ঘোড়ায় টানে না, হাতিও নয়। টানে হাতির মতো দেখতে ভয়ালদর্শন এক ধরনের পশু। এই পশুর দেহ-গঠনে উট, গণ্ডার আর হাতির সংমিশ্রণ। রথটির পথ-অতিক্রমণের সময় মেঘের মতো ঘড়ঘড় শব্দ হয়।
এই অদ্ভুত ভয়ংকর অদৃশ্যপূর্ব অষ্টচক্রযানটির অধীশ ঘটোৎকচ। রথটির নাম―বিয়াস। ঘটোৎকচেরই দেওয়া। ভারতবর্ষের যে উত্তরাঞ্চলের নৃপতি সে, সেই অঞ্চলের প্রধান নদী বিয়াস। হিমালয়ের পাদদেশের তুষারাবৃত পর্বতময় প্রদেশে এর উৎপত্তি। ঘটোৎকচের জীবনের অনেকটা অংশ জুড়ে এই নদী। তাই তার প্রিয়তম যুদ্ধযানটির নাম বিয়াস রেখেছে সে। লঙ্কাধিপতি রাবণের যেমন পুষ্পকরথ, রাক্ষসরাজ ঘটোৎকচের তেমনি বিয়াস।
শকুন আর রক্তলাল পতাকা ঘটোৎকচের দুর্ধর্ষতাকে চিহ্নিত করে।
শূল, মুদ্্গর; প্রস্তরখণ্ড, বৃক্ষকাণ্ড এবং নানা আকারের গদা বিয়াসে থরে থরে সাজানো। এগুলোই ঘটোৎকচের যুদ্ধাস্ত্র। আদিম অস্ত্র ছাড়াও আধুনিক অস্ত্রেও সুনিপুণ সে।
ঘটোৎকচের দেহ স্বাভাবিক নয়। অনেক বিশাল। মুখটিও বেশ বড়। মুখের তুলনায় চোখ দুটি ছোট। সেই চোখের দৃষ্টি তীব্র। ভীতি জাগানিয়া। কান দুটি বিরূপ। বহির্ভাগ শলাকাকৃতির। ঘটোৎকচের মাথাটি বড়োসড়ো। ঠোঁট মোটা। ঠোঁটের রং তামাটে। দাঁতগুলো দীর্ঘ এবং তীক্ষè। বৃহৎ নাসিকা। ছিদ্র দুটো যেন গুহা। সেই ছিদ্রপথে প্রবল বাতাসের গমনাগমন। দৈহিক উচ্চতা পর্বতপ্রমাণ। সারা শরীর মাংসল। প্রশস্ত বুক। সুদৃঢ়। গদার প্রচণ্ড আঘাতেও সে-বক্ষঃস্থলের কোনও ক্ষতি হবে না। দু পা সামান্য বাঁকানো। সেই বক্র পা দুটিকে মজবুত পেশিসমূহ আবৃত করে রেখেছে। ঘটোৎকচ ভীষণ শক্তিশালী। অতি দ্রুত বেগে ছুটতে পারা ঘটোৎকচের সাধারণ গুণ। তার মাথাটি কেশবিরল। রাক্ষস জনজাতির মানুষদের মধ্যে এমনটি দেখা যায় না। কিন্তু ঘটোৎকচে ব্যতিক্রম। তার মাথায় একটিও চুল নেই।
জন্মের পর মা হিড়িম্বা পুত্রের চুলহীন মাথা দেখে বেশটুকু আহত হয়েছিল। চকচকে মাথাটিতে আদুরে ডানহাতটি বোলাতে বোলাতে বলেছিল, ‘তোর মাথায় যে একটিও চুল নেই রে বাছা!’ ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে আরও বলেছিল, ‘আমি তোর নাম দিলাম ঘটোৎকচ।’
বড় হবার পরও ঘটোৎকচের মাথায় কোনও চুল গজাল না। শেষ পর্যন্ত মায়ের দেওয়া নামটিই চালু হয়ে গেল। ‘ঘট’ অর্থ মাথা। ‘কচ’ মানে চুল। ‘উৎকচ’ অর্থ উন্মূলিত। ‘ঘটোৎকচে’র অর্থ দাঁড়ায়―যার মাথায় চুল নেই মোটেই।
ঘটোৎকচ তার যুদ্ধরথে চড়ে বসেছে। প্রবল প্রতাপী এক ক্ষত্রিয়ের ঔরসে অনার্যা রাক্ষসী হিড়িম্বার গর্ভে জন্ম ঘটোৎকচের। ঘন কালো দেহের ঘটোৎকচ হলুদ বসন পরিধান করেছে। পীত বসনখানি ঘটোৎকচকে দুর্দান্ত আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কাঁধ ছাড়ানো শুভ্র পৈতেটি তার বসন-ভূষণের মধ্যে সর্বাধিক আকর্ষক। রাক্ষস জনজাতির মানুষদের পৈতে পরার অধিকার নাই। পিতার দিক থেকে ঘটোৎকচ ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয়রা পৈতে পরে, তাই ঘটোৎকচও পৈতে ধারণ করেছে।
আজ ঘটোৎকচের যুদ্ধযাত্রার দিন। সাতদিন আগে সৈন্যসজ্জার নির্দেশ দিয়েছিল সেনাপতিকে। সাতদিন আগেই পাণ্ডবপক্ষের পত্র নিয়ে ঘটোৎকচের রাজসভায় পাণ্ডবদূত এসেছিল। যুধিষ্ঠিরই লিখেছিল পত্রটি। সংক্ষিপ্ত। কিন্তু মর্মস্পর্শী। ‘বড় বিপদে পড়েছি পুত্র। কৌরব-পাণ্ডবের দ্বন্দ্বের কথা তোমার অজানা নয়। মুখোমুখি আমরা, এখন। তোমার সাহায্য প্রয়োজন। এসো।’
ঘটোৎকচ তখন-তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল―যাবে। দূতকে বলেছিল জ্যেষ্ঠতাতকে গিয়ে বলো, আমি আসছি।
সেদিনই যুদ্ধপ্রস্তুতির আদেশ দিয়েছিল ঘটোৎকচ। নির্দেশ পাওয়ামাত্র সেনাপতি মুদ্্গর সমরসজ্জা আরম্ভ করে দিয়েছিল। গোটা বাহিনীকে হঠাৎ-যুদ্ধের জন্য তৈরি করা সহজ ব্যাপার নয়। দু চার-দশ-পঞ্চাশ হাজার সৈন্য তো নয়! পুরোপুরি এক অক্ষৌহিণী সৈন্য ঘটোৎকচের সেনাবাহিনীতে। লক্ষাধিক সৈন্যকে যুদ্ধসাজে সজ্জিত করতে, তাদের যুদ্ধমনস্ক করে তুলতে অনেকটা দিনের প্রয়োজন। কিন্তু ঘটোৎকচের কড়া নির্দেশে দিন-রাতের কঠোর পরিশ্রমে সাতদিনের মাথায় সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করে ফেলল সেনাপতি মুদ্্গর।
ঘটোৎকচের রাজ্য পর্বতময়, অরণ্যঘন। এই রাজ্যের অধিকার সে পিতৃপক্ষ থেকে লাভ করেনি। মাতৃপক্ষ থেকে সে এই রাজ্যের প্রভুত্ব পেয়েছে। বিয়াস নদীর তীরে রাজ্যটি। নাম―কাংড়া। কাংড়ার নৃপতি ঘটোৎকচের মাতামহ―কুম্ভাণ্ড। কুম্ভাণ্ডের দুই সন্তান―হিড়িম্ব আর হিড়িম্বা। কুম্ভাণ্ডের মৃত্যুর পর যুবরাজ হিড়িম্ব কাংড়ারাজ্যের রাজা হয়। অনার্য জনজাতির হিড়িম্ব আর্যদের প্রতি প্রবল বিদ্বেষ পোষণ করত। সহজাত আর্যবিদ্বেষের কারণে একদিন অবিবাহিত কাংড়ারাজ হিড়িম্ব প্রচণ্ড শক্তিধর এক আর্য দ্বারা নিহত হয়। ভাইয়ের মৃত্যুতে হিড়িম্বার হাতে রাজ্যের দায়িত্ব আসে। হিড়িম্বাপুত্র ঘটোৎকচ যুবক হয়ে উঠলে হিড়িম্বা ঘটোৎকচের হাতে রাজ্যভার অর্পণ করে। রাজা হয়েই ঘটোৎকচ নিজ রাজ্যের নাম পরিবর্তন করে। কাংড়ার পরিবর্তে এই রাক্ষসরাজ্যের নাম হবে―হিড়িম্বাপুর, ঘোষণা করল ঘটোৎকচ। এই নাম পরিবর্তনের সঙ্গে ঘটোৎকচের নিবিড় মাতৃভক্তি জড়িয়ে থাকল।
ধীরে ধীরে ঘটোৎকচ দোর্দণ্ডপ্রতাপী নরপতি হয়ে ওঠে। বিশাল এক সৈন্যবাহিনী গঠন করে সে। সে নিজে রাক্ষস জনজাতির মানুষ। রাক্ষস ছাড়াও এই অরণ্য রাজ্যগুলোতে নিষাদ, ভিল, নাগ, পক্ষী, কোচ, গন্ধর্ব, দানব প্রভৃতি অনার্য জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাস করে। কাংড়া রাক্ষসরাজ্য বলে এখানকার অধিকাংশ অধিবাসী রাক্ষসজাতির। ঘটোৎকচের সহানুভূতিময় দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তার রাজ্যে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরাও স্বচ্ছন্দে বসবাস করে।
ঘটোৎকচের সেনাবাহিনীতে রাক্ষস-প্রাধান্য। অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সৈন্যরাও বাহিনীর উঁচু পদে অধিষ্ঠিত। যে এক অক্ষৌহিণী যোদ্ধার সমাবেশ ঘটিয়েছে সেনাপতি মুদ্্গর, তাদের মধ্যে রাক্ষস, নাগ, নিষাদ, ভিল এবং অন্যান্য অরণ্যচারী মানুষের সন্নিবেশ হয়েছে। সবার মনোবল সুকঠিন। সবাই সশস্ত্র। সবাই রক্তলিপ্সু, যুদ্ধোন্মাদ। অশ্ব যেমন দৌড় দেওয়ার আগ-মুহূর্তে মাটিতে খুর দিয়ে আঁচড়াতে থাকে, ঘটোৎকচবাহিনীর প্রতিটি যোদ্ধা যুদ্ধযাত্রার আগে মাটিতে তেমনি পা ঘষতে শুরু করেছে।
সৈন্যবাহিনীর অগ্রভাগে, সেনাপতি মুদ্্গরের পাশে অঞ্জনপর্বাকে দেখা যাচ্ছে। বিরাট দেহ তার। প্রশস্ত বক্ষদেশ। সে অশ্বারোহী। সুঠাম দেহের শুভ্র অশ্বটির ওপর অঞ্জনপর্বাকে ইন্দ্রের মতো তেজোময় দেখাচ্ছে। ঘটোৎকচের প্রথম পুত্র এই অঞ্জনপর্বা।
সিংহাসনে আরোহণ করার আগেই হিড়িম্বা ঘটোৎকচকে বিয়ে করিয়ে দিয়েছিল। তার ধারণা―রাজা হবার পর একজন মানুষের আর স্বাভাবিক জীবন থাকে না। নিজস্ব সময় বলে কোনও সময় থাকে না একজন নৃপতির। সকাল-সন্ধ্যা, দুপুর-রজনীর সবটাই রাজ্য এবং প্রজারা কেড়ে নেয় রাজার কাছ থেকে। রাজ্যের নানা ঝঞ্ঝাটে রাজার রোমাঞ্চ, ভালোবাসা, প্রেমবোধ―সবই শুকিয়ে যায়। তখন মাতা-পিতার প্রতি আলাদা করে শ্রদ্ধা দেখানোর জন্য, সন্তানদের প্রতি বাৎসল্য প্রকাশের জন্য, পত্নীর প্রতি সঘন প্রেম প্রদর্শনের জন্য আলাদা করে সময় বের করতে পারে না রাজারা। তাদের বাৎসল্য, প্রেম, ভক্তি প্রকাশের সময় থাকে শুধু রাজ্যাভিষেকের পূর্বে। এই বিশ্বাস থেকে হিড়িম্বা ভেবে নিয়েছে―ঘটোৎকচের উদ্দাম পত্নীপ্রেম প্রকাশের উপযুক্ত সময় যৌবরাজ্যকালীন। যুবরাজ ঘটোৎকচকে বিয়ে করাতে হিড়িম্বা তাই কালবিলম্ব করেনি।
ইতিপূর্বে প্রাগ্্জ্যোতিষপুর রাজ্যের রাক্ষস সেনাপতি মুরুদানবের কন্যা কামকটঙ্কটার স্নিগ্ধ রূপময়তার কথা হিড়িম্বার কানে এসে পৌঁছেছে। মুরুদানবের কাছে অঢেল উপঢৌকনসহ ছেলের বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে হিড়িম্বা। দূতের মুখে প্রস্তাব পেয়ে উৎফুল্ল হয়েছে রাক্ষস সেনাপতি। ঘটোৎকচের বীরত্বসঞ্চারী দেহগঠনের কথা, তার দৈহিক শক্তিমত্তার বৃত্তান্ত এরই মধ্যে উত্তর ভারতের সকল অনার্যরাজ্যে কিংবদন্তির মতো প্রচারিত হয়ে গেছে। কন্যা কামকটঙ্কটার জন্য মনে মনে ঘটোৎকচকেই কামনা করত মুরুদানব। স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দিলে সেনাপতির আনন্দের সীমা থাকল না।
যথাসময়ে, সাড়ম্বরে ঘটোৎকচ-কামকটঙ্কটার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। উত্তর ভারতবর্ষের অরণ্যরাজ্যসমূহের সকল রাজা বিবাহানুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিল।
জীবনকে উপভোগ করার সময় দিয়েছিল হিড়িম্বা, পুত্রকে। দুজন নবীন নর-নারী বনে-অরণ্যে, নদী-জলাশয়ে, পর্বতে-সমতলে ভ্রমণ করতে করতে একে অপরের দিকে তাকিয়েছিল। একের স্পর্শ নিজের শরীরের সকল গোপন আর প্রকাশ্য স্থানে অনুভব করতে করতে ওরা মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। একদিন ঘটোৎকচ এবং কামকটঙ্কটার বৈবাহিক জীবনে পূর্ণতা এল। বিহার আর ভোগের পরিণতি তাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কামকটঙ্কটার গর্ভধারণ প্রকাশিত হলো। সেদিনই হিড়িম্বা ঘটোৎকচের রাজ্যাভিষেকের ঘোষণা দিল। কাংড়া রাজ্যের নৃপতি হওয়ার এক বছরের মধ্যে ঘটোৎকচ পুত্রবান হলো।
পুত্রের নাম রাখার ক্ষেত্রে মা-হিড়িম্বাকে কোনও সুযোগ দিল না ঘটোৎকচ। মা যে নাম রাখার ক্ষেত্রে রুচিশীল নয়, নিজের নাম দিয়ে অনুভব করে যাচ্ছে সে। নাতির নাম রাখার দায়িত্ব মাকে দিলে তার প্রিয়দর্শন সন্তানটির আবার কী বিদ্্ঘুটে নাম দিয়ে বসে, তার কোনও ঠিক নেই। তাই পুত্রের কদর্য নাম এড়াবার জন্য চালাকির আশ্রয় নিল ঘটোৎকচ।
মাকে গিয়ে বলল, ‘মা, তুমি তো তোমার নাতিটির নাম রাখার অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়ে দিয়েছ।’
‘তা-ই তো দেওয়া উচিত রে বাছা! সমাজনিয়মে ওর নাম রাখার সময়টুকু যে বয়ে যায়!’
ঘটোৎকচ বলল, ‘তা মা, নাতির নাম ভেবেছ কি কিছু ?’
‘ওমা, ভাবিনি আবার!’ হিড়িম্বার কথায় রহস্য আর আনন্দের মেশামেশি।
‘কী নাম রাখবে বলে ঠিক করেছ মা ?’
‘তোমাকে বলব কেন ?’ আগে ছেলেকে ‘তুই’ করে বললেও রাজা হওয়ার পর হিড়িম্বা ঘটোৎকচকে ‘তুমি’ করে বলে।
ছেলেকে মনমরা দেখে সোৎসাহে হিড়িম্বা আবার বলল, ‘তুমি বিচলিত হয়ো না ঘটোৎকচ। খারাপ নাম রাখব না তোমার পুত্রের। তোমার নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ওর নাম রাখব আমি।’
‘মানে…!’ এক দলা কফ ঘটোৎকচের কণ্ঠস্বরকে আটকে দিল। পরের কথাগুলো মাকে শোনাতে পারল না সে। শুধু ভীষণ আঁতকে উঠল সে। তার ছেলের নামটিও যদি তার নামের মতো বিশ্রী হয়! না না! তা হতে দেওয়া যাবে না!
ত্বরিত বলল, তার কণ্ঠস্বর মোলায়েম, শ্রদ্ধাপূর্ণ, ‘মা, তুমিই জন্মের পর আমার নাম রেখেছিলে। বাবাকে নাম রাখার অধিকার দাওনি তুমি। তুমি বলেই আমার এমন সুন্দর নাম রেখেছ!’ হঠাৎ খুক খুক করে কেশে উঠল ঘটোৎকচ।
‘তোমার নাতির বেলাতেও কি মা সেই নিয়ম চালু থাকতে পারে না ?’
হঠাৎ পুত্রের দিকে চোখ তুলল হিড়িম্বা। মৃদু হাসল। এই হাসির অর্থ শুধু হিড়িম্বাই জানে। বলল, ‘ভালো বলেছ তুমি। কামকটঙ্কটাই তার পুত্রের নাম রাখবে।’ হিড়িম্বার কণ্ঠস্বর ফেচফেচে শোনাল।
কামকটঙ্কটা তার প্রথম পুত্রের নাম রেখেছিল―অঞ্জনপর্বা। বীভৎস একটা নামের ধারা থেকে রাক্ষসবংশটি রেহাই পেল। অঞ্জনপর্বার পর এই দম্পতির আরেকজন সন্তান জন্মেছিল। ঘটোৎকচ এই পুত্রের নাম রেখেছিল―বর্বরীক।
যুদ্ধযাত্রার আগের রাতে কামকটঙ্কটা ঘটোৎকচের বক্ষলগ্না। অনেক রাত। চারদিক নিস্তব্ধ। গোটা রাজধানী ঘুমিয়ে পড়েছে। রাজপ্রাসাদ, কেন জানি আজ, গাঢ় নীলের পরতে ঢাকা। নীল কি বেদনার রং ? শোকের প্রতীক ? কোনও শোক কি এই রাজপ্রাসাদকে গ্রাস করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে ? কক্ষের মাঝখানে বিশাল দুগ্ধফেননিভ শয্যায় দুটো নরনারী পরস্পর আলিঙ্গন-আবদ্ধ হয়ে শুয়ে আছে। মৃদু আলোতে দুজনকে স্বর্গীয় বলে মনে হচ্ছে।
‘এ কী! তুমি কাঁদছ কামকটঙ্কটা ?’ গাঢ় উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠল ঘটোৎকচ।
দুই
রাতের শেষ প্রহর। আকাশভরা তারা। মিটমিট করে জ্বলছে। আকাশে আজ চাঁদ নেই। অমাবস্যা বুঝি। তারাদের চূর্ণ আলো অন্তরীক্ষের এদিকে-ওদিকে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে যেন। সন্ধ্যা থেকে আধেক রাত পর্যন্ত জোনাকিরা আলো বিলিয়েছে। এখন ওরা ক্লান্ত। ঝোপঝাড়ের আনাচে-কানাচে জোনাকিরা এখন ঘুমাচ্ছে। কিন্তু এখনও ওদের গুঁড়ো গুঁড়ো সবুজাভ আলো বাতাসে ভর করে এধারে-ওধারে ভেসে বেড়াচ্ছে।
প্রাসাদজুড়ে নানা বৃক্ষের সমারোহ। কিছুক্ষণ আগেও বৃক্ষসকল, এদের পত্রবহুল শাখা-প্রশাখাসমূহ স্থির ছিল। এখন বাতাস ছেড়েছে। মৃদু হাওয়ায় গাছের পাতারা শিরশির করে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এসব মিলে ঘটোৎকচের রাজপ্রাসাদের বাইরের বাতাবরণ রহস্যময়। প্রাসাদের অভ্যন্তরের সেই বিশেষ কক্ষটিতে দুজন নর-নারীর জীবন আজ বিরহকাতর, ভবিষ্য-বিপদাশঙ্কায় উদ্বিগ্ন এবং প্রেমজ আকর্ষণে শিহরিত।
প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে ঘটোৎকচ আবার বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন কামকটঙ্কটা!’
চাপল্য আর মুখরতা এখন কামকটঙ্কটায় স্তব্ধ হয়ে আছে। এমনিতে চঞ্চলতা তার চরিত্রলক্ষণ। মনের অনুভব-আবেগ শব্দের ফুলঝুরি হয়ে কামকটঙ্কটার মুখ থেকে বের হতে থাকে অবিরত। স্বামীকে গম্ভীর হয়ে থাকতে দেয় না কখনও সে। কথা না বলতে চাইলেও কথা বলিয়ে ছাড়ে ঘটোৎকচকে। সেই কামকটঙ্কটা আজ ভীষণরকম স্তব্ধ, মূক। স্ত্রীর এরকম আচরণে বিস্মিত ঘটোৎকচ।
এটা ঠিক যে, কাল প্রত্যুষে সে যুদ্ধে যাচ্ছে। প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ। এ কারণে কামকটঙ্কটা হয়তো আতঙ্কিত। স্বামীর বিপদ-আশঙ্কায় হয়তো সে বিচলিত। কিন্তু এটা তো তার প্রথম যুদ্ধযাত্রা নয়! এর আগে বহু বহুবার সে নানা দেশে যুদ্ধাভিযানে গেছে! সেই যুদ্ধগুলো ছিল একক যুদ্ধ। মানে শুধু নিজের সৈন্যবাহিনী নিয়ে সে ওই সব যুদ্ধগুলো করেছে এবং কোনও কোনও যুদ্ধে পরাজিত হলেও অধিকাংশ যুদ্ধেই জিতেছে। আর কাল যে যুদ্ধে যাচ্ছে সে, তা কিন্তু একক রাজার যুদ্ধ নয়। অনেক রাজার যৌথবাহিনীর যুদ্ধ। সে যে-পক্ষের হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে, সেই পাণ্ডবপক্ষেও নানা দেশের নানা রাজা সসৈন্যে যোগ দিয়েছে। সুতরাং এই যুদ্ধ একক যুদ্ধের চেয়ে কম ভীতিপূর্ণ। তার পরও কামকটঙ্কটা এত ভীত হয়ে পড়েছে কেন ? কামকটঙ্কটা যে এই মুহূর্তে শঙ্কিত, তা তার নিস্তব্ধতাই প্রমাণ দিচ্ছে। সে সাধারণ কোনও নারী নয়। সেনাপতির কন্যা কামকটঙ্কটা। ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধ, অস্ত্র, হত্যা, রক্তপাত, রাজ্যদখল―এসবের সঙ্গে পরিচিত। সে নিজেও একজন দক্ষ যোদ্ধা। পিতা উপযুক্ত যুদ্ধবিদের তত্ত্বাবধানে কামকটঙ্কটাকে অস্ত্রকুশলী করে তুলেছে।
ঘটোৎকচ কৃষ্ণ আর কামকটঙ্কটার যুদ্ধের কথা জানে। বিয়ের কথাবার্তা সম্পন্ন তখন। বিয়ের তারিখও সুনির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এর মাঝখানে হঠাৎ একদিন কামকটঙ্কটার পিতা মুরুদানবের সঙ্গে কৃষ্ণের যুদ্ধ বেঁধে যায়। কৃষ্ণের হাতে মুরুদানব নিহত হলে কামকটঙ্কটা কৃষ্ণের বিরুদ্ধে হাতে অস্ত্র তুলে নেয়। নারী বলে কৃষ্ণ প্রথম দিকে কামকটঙ্কটার প্রতি অবহেলা দেখায়। কিন্তু অচিরেই বুঝতে পারে―প্রচণ্ড রণকুশলী এক যোদ্ধার সঙ্গে সে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। উভয়ের মধ্যে তুমুল লড়াই শুরু হয়। কৃষ্ণের কালঘাম ছুটে যায়, তারপরও কামকটঙ্কটাকে পরাজিত করতে পারে না। কৃষ্ণ ভীষণ বিচলিত বোধ করতে থাকে। মস্ত মস্ত বীরদের পর্যুদস্ত করা কৃষ্ণ সামান্য এক নারীকে বধ তো দূরের কথা, নিরস্ত্রও করতে পারছে না!
ঠিক এই সময় যুদ্ধক্ষেত্রে দেবী কামাখ্যা উপস্থিত হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, ‘আপনি কিছুতেই কামকটঙ্কটাকে পরাজিত করতে পারবেন না কৃষ্ণ। কেন না সে আমার বরপুষ্ট।’
কৃষ্ণ একটু থমকাল। তারপর উষ্ণ গলায় বলল, ‘আপনার আশীর্বাদপুষ্ট হয়েছে তো কী হয়েছে ? কেউই কৃষ্ণের অবধ্য নয়।’
রুষ্ট হলেন দেবী কামাখ্যা, ‘তাহলে যে আপনার বিরুদ্ধে আমাকে অস্ত্র ধরতে হবে কৃষ্ণ! আপনার অহংকারের কাছে আমার গৌরবকে ম্লান হতে দেব কেন ?’
দেবী কামাখ্যার কথা অনুধাবন করল কৃষ্ণ। বুঝল―দেবীর কথাকে উড়িয়ে দিয়ে কামকটঙ্কটাকে মারতে উদ্যত হলে দেবী ওর পক্ষ নেবে এবং তাতে তার পরাজয় নিশ্চিত। কৃষ্ণ নিজেকে গুটিয়ে নিল।
এবার কামাখ্যা কামকটঙ্কটার দিকে মুখ ফেরালেন, ‘শোনো মেয়ে, শ্রীকৃষ্ণ কে তা তুমি ভালো করে জান না। পৃথিবীতে এমন কোনও বীর নেই, যে শ্রীকৃষ্ণকে পরাজিত করতে পারে। ক্ষান্ত হও তুমি। অস্ত্র ত্যাগ করো। কৃষ্ণকে প্রণাম করো। নিজ গৃহে ফিরে যাও। তোমার বিয়ে আসন্ন।’
দেবীর আদেশ উপেক্ষা করে না কামকটঙ্কটা। কৃষ্ণকে প্রণাম করে যুদ্ধস্থান ত্যাগ করে যায়।
এই ঘটনার কথা অন্য সবার মতো ঘটোৎকচও জানে। কিন্তু জানে না, কৃষ্ণের প্রতিশোধস্পৃহার কথা।
সেদিন কৃষ্ণকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবার পর উঠে দাঁড়ালে হঠাৎ কৃষ্ণের চোখে চোখ পড়েছিল কামকটঙ্কটার। এ কী! কৃষ্ণের চোখ দুটো এরকম জ্বলজ্বল করছে কেন ? ক্রোধের তীব্র অনল সেই চোখে একটুখানি ঝিলিক দিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। বিচক্ষণ কামকটঙ্কটা বুঝতে পেরেছিল―তাকে পরাজিত করতে না পারার অপমান কৃষ্ণকে চূর্ণবিচূর্ণ করছে। প্রতিশোধের লেলিহান শিখা দেখতে পেয়েছিল সেদিন কৃষ্ণের চোখে, কামকটঙ্কটা। সে বুঝে গিয়েছিল―সুযোগমতো প্রতিশোধ নেবে কৃষ্ণ।
সেদিনের কৃষ্ণের হিংস্র অবয়বের কথা মনে করে ঘটোৎকচলগ্না কামকটঙ্কটা স্তব্ধ নিথর। কাল স্বামীর সঙ্গে তার দুটো পুত্রসন্তানও যাচ্ছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। অঞ্জনপর্বা সমরবিদ। তার অস্ত্রদক্ষতার কথা অরণ্যাঞ্চলের সকল মানুষ জানে। তার দ্বিতীয় পুত্র বর্বরীকও কম যায় না। সেও কুশলী শস্ত্রবিদ। তরুণ বর্বরীক নর্মদা নদীর তীরবর্তী গুপ্তক্ষেত্রে গিয়ে কঠোর সাধনা করেছে। তিন বছরের তপস্যায় সে দেবী শক্তির কাছ থেকে নানা দিব্য অস্ত্র লাভ করেছে। এই মুহূর্তে স্বামীর চেয়ে পুত্রদের জন্য অধিক উদ্বেগবোধ করছে কামকটঙ্কটা। তার বার বার মনে হচ্ছে―কৃষ্ণের দ্বারা তার দুই পুত্রের অথবা অন্তত একপুত্রের ক্ষতি সাধিত হবেই।
এই আতঙ্কগ্রস্ততার মধ্যে কামকটঙ্কটা স্বামীর প্রশ্নের উত্তর দেয়, ‘পুত্রদের কথা চিন্তা করে নিজের কান্নাকে ধরে রাখতে পারছি না।’
‘অ―! তা-ই বলো! আমি ভাবলাম অন্য কিছু!’ নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নিল ঘটোৎকচ। স্ত্রীকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন ? আমি আছি না পুত্রদের সঙ্গে ? আর আমাদের সঙ্গে আছে এক অক্ষৌহিণী দুর্ধর্ষ রাক্ষসসৈন্য! এতেও তোমার ভয় কাটছে না প্রিয়!’
‘কৃষ্ণকে আমি চিনি বলেই এ কথা বলছি।’
পত্নীর কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল ঘটোৎকচ। আরে, কামকটঙ্কটা জানে না নাকি, যে-পাণ্ডবপক্ষের হয়ে সে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে যাচ্ছে, সেই পাণ্ডবপক্ষের কাণ্ডারি শ্রীকৃষ্ণ! পাণ্ডবদলের মানুষ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ কেন ঘটোৎকচের ক্ষতি করতে যাবেন! এ কামকটঙ্কটার অমূলক আশঙ্কা।
সে কথা বললও ঘটোৎকচ, ‘তুমি শুধু শুধু আতঙ্কিত হচ্ছ। পাণ্ডবপক্ষের শুভাকাক্সক্ষী হয়ে শ্রীকৃষ্ণ আরেক শুভাকাক্সক্ষীর ক্ষতি করতে যাবেন কেন ? আর এই ক্ষতি করার কারণই-বা কী ?’
কামকটঙ্কটা বলে, ‘প্রতিশোধ।’
‘প্রতিশোধ! কীসের প্রতিশোধ ?’
স্বামীর কাছে কৃষ্ণচরিত্র বিশ্লেষণ করতে চায় না কামকটঙ্কটা। বিশ্লেষণ করলেও ঘটোৎকচ যে বুঝবে না বা বুঝতে চাইবে না, নিশ্চিত কামকটঙ্কটা। স্বামী না জানলেও সে জানে―কৃষ্ণ বড় প্রতিশোধপরায়ণ। তাকে পরাজিত করতে না পারার অপমানটা সেদিন সে কৃষ্ণের চক্ষে বিলক্ষণ দেখেছিল। একদিন না একদিন এই অপমানের শোধ যে কৃষ্ণ নেবেন, বুঝে গিয়েছিল কামকটঙ্কটা। তাকে তো কোনওদিন নাগালে পাবেন না! কিন্তু কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধ উপলক্ষে তার স্বামী আর পুত্রদের কাছে পেয়ে যাবেন। তখন নিশ্চিতরূপে আগের অপমানের শোধ তুলবেন কৃষ্ণ। কিন্তু কীভাবে প্রতিশোধ নেবেন, বুঝে উঠতে পারছে না কামকটঙ্কটা। তবে প্রতিশোধ যে নেবেন, সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ।
কথা ঘোরাল কামকটঙ্কটা, ‘আমার মনে হচ্ছে―এই যুদ্ধ হবে ভয়ংকর। দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না জানি না, তবে বিধ্বংসী যে হবে, তা তুমিও বুঝতে পারছ আর্যপুত্র। কৌরবরা পাণ্ডবদের চেয়ে বহুগুণে শক্তিধর। ভারতবর্ষের অধিকাংশ রাজার সমর্থন দুর্যোধনের দিকে। এই যুদ্ধ হবে অসম দুই শক্তির মধ্যে। তুমি যাচ্ছ পিতৃঋণ পরিশোধ করতে, বুঝি আমি। কিন্তু সেই ঋণপরিশোধ প্রাণের বিনিময়ে হবে না তো ? তুমি, আমার পুত্ররা…।’ কথা শেষ করতে পারল না কামকটঙ্কটা। কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে গেল।
শোয়া থেকে উঠে বসল ঘটোৎকচ। কামকটঙ্কটাকেও টেনে তুলল। বাহুলগ্ন করে কামকটঙ্কটার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল, ‘তোমার ভয় অমূলক কামকটঙ্কটা। তুমি দেখে নিয়ো, পাণ্ডবরাই জয় পাবে এই যুদ্ধে এবং আমরা তোমার সামনে অক্ষতদেহে উপস্থিত হব।’
‘কোনও একটা অছিলায় শ্রীকৃষ্ণ আমার পুত্রদের এমনকি তোমারও ক্ষতি করবেনই করবেন।’ অত্যন্ত নিম্ন স্বরে কথাটা বলল কামকটঙ্কটা।
ঘটোৎকচ তা শুনতে পেল না।
রাতের আঁধার অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে ততক্ষণে। গাছে গাছে পাখির ওড়াউড়ি শুরু হয়েছে।
ঘটোৎকচের কণ্ঠে আবেগের ছোঁয়া, ‘তুমি দুশ্চিন্তা ত্যাগ করো কামকটঙ্কটা। আমার বাহুবলের ওপর ভরসা রাখো।’
একটু থামল ঘটোৎকচ। তারপর বলল, ‘মহাসমরে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে তোমার বিষণ্ন চেহারা দেখে যেতে চাই না। তুমি হাস কামকটঙ্কটা। তোমার প্রসন্নতা, তোমার হাস্যস্নিগ্ধ চেহারাখানি আমাকে যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবে। তুমি আমার বুকে এসো প্রিয়।’
কামকটঙ্কটা মৃদু হাসবার চেষ্টা করল। বেদনাক্লিন্ন বিষণ্নমুখে সেই হাসিটা বড় মধুর মনে হলো ঘটোৎকচের চোখে।
সেই শেষ রাতে দুটো দেহ কাছাকাছি এল। ভোগে-উপভোগে দুটো শরীর স্বর্গসুখে আপ্লুত হলো।
পরদিন সকালে হিড়িম্বাপুরের সৈন্যদলে রণদামামা বেজে উঠল। বাজনার তীব্রতা এই ইঙ্গিত দিচ্ছে―যুদ্ধযাত্রা শুরু হতে আর বেশি বিলম্ব নাই।
প্রত্যুষে স্নানান্তে কুলদেবীর মন্দিরে গেছে কামকটঙ্কটা। প্রৌঢ়া হিড়িম্বা আগেই মন্দিরে পৌঁছে গিয়েছিল। পূজা শেষে হিড়িম্বা এবং কামকটঙ্কটা কুলদেবীর আশীর্বাদী পুষ্প নিয়ে এসেছে রাজপ্রাসাদে। ততক্ষণে ঘটোৎকচ যুদ্ধসাজে সজ্জিত হয়ে গেছে। তার অদূরে অঞ্জনপর্বা আর বর্বরীক দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুরমা আর জননীর পদধূলি মাথায় ঠেকিয়ে সৈন্যবাহিনীর দিকে এগিয়ে গেল দুই ভাই।
হিড়িম্বা পুষ্পথালা হাতে ঘটোৎকচের কাছে এগিয়ে গেল।
পুত্রের মাথায় পুষ্প ছুঁইয়ে মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘যুদ্ধে জয় পেয়ে ফিরে এসো ঘটোৎকচ। আমি তোমাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করছি পুত্র, রাক্ষসজাতির মুখ উজ্জল করো তুমি, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে।’
ঘটোৎকচ মাথা নত করে মায়ের কথা শুনে গেল। তার তখন খুব কামকটঙ্কটার স্পর্শ পেতে ইচ্ছে করছিল। অদূরে দাঁড়িয়েও ছিল সে। কিন্তু মা আছে বলে কামকটঙ্কটা স্বামীর কাছে এগিয়ে আসতে সাহস করল না। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল ঘটোৎকচ।
হিড়িম্বা কিন্তু পুত্রের সামনে থেকে সরল না। তার যে আরও কিছু কথা বলার আছে, ‘পিতা-মাতার ঋণ সন্তানরা কখনও শোধ করতে পারে না। তারপরও জাগতিক জীবনে সন্তানরা সেই ঋণের কিছুটা শোধ করতে পারে, যদি ঋণশোধের সেরকম কোনও সুযোগ আসে তাদের হাতে। আর তুমি সেই সুযোগ পেয়েছ পুত্র। পিতৃঋণ শোধ করার সুযোগ পেয়েছ তুমি।’
এই সময় ঘটোৎকচ কিছু বলতে চাইল।
তাকে থামিয়ে দিয়ে হিড়িম্বা বলল, ‘জানি, জন্ম দেওয়া ছাড়া তোমার প্রতি পিতার কোনওই কর্তব্য পালন করেনি তোমার পিতা। তোমার মধ্যে যে পিতার বিরুদ্ধে চাপা অভিমান আছে তাও অনুমান করি। তারপরও বলছি বাছা, যাও তুমি। নিজের শক্তিমত্তা দেখিয়ে এই যুদ্ধে পাণ্ডবদের জিতিয়ে দাও।’
আঁচলে মুখ চেপে দ্রুত সে স্থান ত্যাগ করে গেল হিড়িম্বা।
ধীর পায়ে কামকটঙ্কটার নিকটে এগিয়ে গেল ঘটোৎকচ। ‘তুমি কিছু বলবে না কামকটঙ্কটা ?’
অশ্রুসিক্ত মুখটি ওপর দিকে তুলে দুদিকে মাথা নাড়ল কামকটঙ্কটা।
ঘটোৎকচ দু বাহু বাড়িয়ে কামকটঙ্কটাকে বুকের গভীরে টেনে নিল।
তারপর দৃঢ় পদক্ষেপে সমবেত সৈন্যবাহিনীর দিকে ঘটোৎকচ এগিয়ে গেল।
বিয়াস রথে উঠে হুঙ্কার দিল, ‘এগিয়ে চলো।’
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ



