
২৫ জানুয়ারি, ১৯৯৩
সে বছর প্রচণ্ড শীত পড়েছে। তিনি নিজের বিছানায় শুয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন জানালার কাচে অনেক দিন পর বাবা-মাকে দেখতে পেলেন। আরে! সঙ্গে ছোটভাই ম্যালোরিকেও দেখা যাচ্ছে। মাত্র নয় বছর বয়সে ম্যালেরিয়ায় সে মারা গিয়েছিল! মায়ের হাত ধরে সে মুচকি হাসছে, মাও হাসছেন। বাবা, পাইপ টানতে টানতে ভ্রƒ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর কোঁচকানো ভ্রƒতেও কী প্রচণ্ড মমতা! একটু পর বাবার পেছন থেকে উঁকি দিল ম্যারিনা। তাঁর ছোট বোন। সে চুলে পনিটেল বেঁধেছে, জামায় টেডি বিয়ার আঁকা। ছোট্ট হাতের মুঠোয় অনেকগুলো ছোট বুনো ফুল। কী আশ্চর্য ও না চুরাশি বছর বয়সে মারা গেল! সে শিশুরূপ নিয়ে ফিরে এল কোত্থেকে? তিনি জানালার কাচে ভাসতে থাকা অতি প্রিয় মানুষগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আসছি।’
বারো ঘণ্টা পর স্থানীয় কয়েকজন সহকর্মী এবং স্থানীয় বাসিন্দা তাঁকে কবর দিলেন। কবরের পাশে কে যেন একটি কদম গাছ লাগিয়েছিল। এখন সেটি বিশাল হয়েছে। বর্ষায় সেখানে ফোটা ফুলগুলিকে সোনালি টেনিস বলের মতো দেখায়।
জায়গাটির নাম দুলাহাজরা। উপজেলা চকরিয়া। জেলা কক্সবাজার।
৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
কার্ডিনাল ভিক্টর ম্যানুয়েল মহামান্য পোপের ধর্মীয় কাজের প্রধান সহকারী। তাঁর পদবি হচ্ছে, ‘ডিকাস্টারি ফর দ্য ডকট্রিন অব ফেইথ’। সংক্ষেপে ডাকা হয় ‘ডিডিএফ’। পোপের পক্ষে সব ধরনের ধর্মীয় বিষয় তিনি দেখাশোনা করেন। এটি ভ্যাটিকানের সর্বোচ্চ পদগুলোর একটি। কার্ডিনাল ভিক্টর এ অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অনেক বছর ধরে কাজ করছেন। বর্তমান পোপের আগে দুজন পোপকে তিনি বিদায় দিয়েছেন। বাইরে হালকা বৃষ্টি হচ্ছে। নিজ অফিসের বিশাল জানালা দিয়ে তিনি দেখতে পেলেন অসংখ্য মানুষ ছাতা মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে টুরিস্ট যেমন আছেন, ধর্মপ্রাণ ক্যাথলিকও আছেন। কেউ কেউ পোপের প্রাসাদের বাইরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেন, যদি তাঁকে এক ঝলক দেখা যায়। তাদের মাথার ওপর ঝুলতে থাকা বিভিন্ন রং-এর ছাতাগুলোকে দূর থেকে বিশাল আকৃতির ফুলের মতো মনে হচ্ছে, যে ফুলগুলো হাঁটতে পারে। কার্ডিনাল ভিক্টর সেইসব বিশাল ফুল থেকে চোখ সরিয়ে একটি বেশ পুরোনো ফাইল টেনে নিলেন। তারপর মনোযোগ দিয়ে তা পড়তে লাগলেন। এর আগেও তিনি এটি বেশ কয়েকবার পড়েছেন। যতবার পড়েন ততবার অবাক হন এবং ভাবেন দুনিয়ার পূর্বপ্রান্তে এক গহিন গ্রামে শুয়ে থাকা মানুষটি কি আসলে তাঁরা যা ভাবছেন তা? নাকি শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হবে তাঁদের পঁচিশ বছরের শ্রম ছিল আসলে মরীচিকার পেছনে ছোটা। দেখা যাবে ত্রিশ বছর আগে মারা যাওয়া মানুষটি আসলে কেউ না। প্রায় আধ ঘণ্টা সময় নিয়ে তিনি ফাইলে চোখ বুলানো শেষ করলেন। তারপর বেল টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সেক্রেটারি দরজায় উঁকি দিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং, ইয়োর এমিনেন্স।’
‘গড ব্লেস ইউ, সন। কিছুক্ষণের মধ্যে আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ফেদেরা আসবেন। তুমি কি দয়া করে তাঁকে আমার কাছে নিয়ে আসবে? সকাল সাড়ে দশটায় তাঁর আসার কথা। এখন দশটা বিশ। দশ মিনিটের মধ্যে তিনি আসবেন। তাঁর কখনও লেইট হয় না।’
‘অবশ্যই ইয়োর এমিনেন্স। আমি যাচ্ছি।’
‘গড ব্লেস ইউ, সন।’ কার্ডিনাল ম্যানুয়াল আবার ফাইলে চোখ নামালেন।
ঠিক সকাল দশটা পঁচিশে আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ফেদেরাকে নিয়ে একটি ভাড়া গাড়ি ভ্যাটিকানের ‘পালাজো দেল সান্তা উফিসিও’-এর সামনে এসে দাঁড়াল। এ দালানেই কার্ডিনাল ভিক্টর ম্যানুয়েলের অফিস। তাঁর তরুণ সেক্রেটারি দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ফেদেরাকে রিসিভ করল। তিনি গাড়ি থেকে নামতেই সে তাঁর ডান হাতের অনামিকায় পরা আঙটিতে চুমু খেয়ে পরম শ্রদ্ধাভরে বলল, ‘ওয়েলকাম টু হলি সি, ইয়োর এমিনেন্স।’
ফাদার রোজারিও মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, ‘মার্সি বি আপন ইউ, সন।’ তারপর বললেন, ‘চলো, যাওয়া যাক।’
ঠিক সকাল সাড়ে দশটায় তিনি কার্ডিনাল ভিক্টর ম্যানুয়েলের অফিসে ঢুকলেন। ভিক্টর আসন ছেড়ে উঠে এসে রোজারিওর হাত টেনে নিয়ে তাতে চুমু খেলেন। তারপর বললেন, ‘মার্সি বি আপন ইউ, ফাদার। পরম পিতা আপনার কল্যাণ করুন।’ ফেদেরা সসম্মানে সে চুমু ফেরত দিয়ে বললেন, ‘আই অ্যাম অনার্ড, ইয়োর এক্সেলেন্সি। একই করুণা তিনি আপনার ওপরও বর্ষণ করুন।’
‘বসুন প্লিজ।’ কার্ডিনাল বললেন।
‘ধন্যবাদ, এক্সেলেন্সি।’
‘আপনার কেইসটা নিয়ে আমাদের দ্য কংগ্রেগেশন ফর দ্য কজেস অব সেইন্টস তাঁদের পর্যবেক্ষণ পাঠিয়েছেন। প্রায় পঁচিশ বছর অক্ষরে অক্ষরে নিয়ম পালন করে তাঁরা ব্যাপারটি পরীক্ষা করেছেন।’
‘তাঁদের অভিমত?’ আর্চ বিশপ ফেদেরার কণ্ঠে আগ্রহ এবং উত্তেজনা।
কার্ডিনাল মৃদু হাসলেন, সে হাসি থেকে ছড়িয়ে পড়ছে তৃপ্তি এবং শান্তি। তিনি বললেন, “কংগ্রেগেশন মনে করেন আপনি যার কথা রেফার করেছেন তিনি প্রথম তিনটি ধাপে উত্তীর্ণ হয়েছেন। ধাপগুলো আপনি জানেন। সারভেন্ট অব গড, ভেনারেবল এবং বিয়াটিফিকেশন। প্রথম দুটো ধাপ অর্থাৎ সারভেন্ট অব গড বা ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্য এবং ভেনারেবল বা পবিত্র জীবনের অধিকারী―এ দুটো ব্যাপারে তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। তৃতীয় ধাপ মানে বিয়াটিফিকেশন পর্যায়ে প্রমাণ করতে হয়েছে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা। সেটা নিয়েও আমরা কাজ করেছি এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ তাঁর পক্ষে গেছে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, আপনি অজানা একজন ‘টরু সারভেন্ট অব গড’কে আবিষ্কার করেছেন।”
‘আই অ্যাম রিলিভড, ইয়োর এমিনেন্স।’
‘মি টু। আপনি ব্যর্থ হলে আমার খারাপ লাগত। কিন্তু এখন শুরু হবে সবচে কঠিন কাজ। আপনাকে অতিক্রম করতে হবে চতুর্থ ধাপ―ক্যানোনাইজেশন। এ ধাপেই চূড়ান্তভাবে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। ঈশ্বর মহান। তিনি পৃথিবীতে অনেক সারভেন্ট অব গড পাঠান, কিন্তু সেইন্ট পাঠান হাতে গোনা। এই স্বীকৃতি পেতে হলে ভ্যাটিকানকে নিশ্চিত হতে হবে যে ঈশ্বর আপনার রেফার করা সারভেন্ট অব গডকে অলৌকিক ক্ষমতাও দিয়েছিলেন, যা দিয়ে তিনি মানবমুক্তি ঘটাতে পারতেন। বাট ইট ইজ টাফ। টু টাফ। লৌকিক পৃথিবীতে অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে খুব বেশি মানুষ জন্ম নেন না। সেজন্যই সেইন্ট হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে বিয়াটিফিকেশন পর্যায়ে একবার অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হওয়ার পরও ক্যানোনাইজেশন পর্যায়ে আরও একটি অলৌকিক কাজের প্রমাণ দিতে হয়। কারণ প্রথমটি ঝড়ে কাক মরার মতো কাকতালীয়ও হতে পারে। তাই ভ্যাটিকান অন্তত দুটো ঘটনার প্রমাণ চায় যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় যাকে সেইন্ট ঘোষণা দেওয়া হবে তিনি ইচ্ছে করলেই অলৌকিক ঘটনা ঘটাতে পারতেন। অন্য কথায় বলা যায়, তিনি ঈশ্বরের এত প্রিয় ছিলেন যে, তিনি যা চাইতেন ঈশ্বর সে ইচ্ছাই পূরণ করতেন। পার্থিব পৃথিবীতে তা যতই অপার্থিব হোক না কেন।’
ফাদার ফেদেরা সামান্য সামনে ঝুঁকলেন, তারপর বললেন, ‘তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। বিয়াটিফিকেশন পর্যায়ে তা প্রমাণিত হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি ক্যানোনাইজেশন বা চূড়ান্ত পর্যায়েও অলৌকিকতার পরীক্ষা পার হতে পারবেন। আমি সেটা বের করেছি।’
‘হলি খ্রাইস্ট! আপনি কি সেটা আবিষ্কার করেছেন। তাঁর দ্বিতীয় কোনও অলৌকিক ক্ষমতা?’
‘জি, করেছি। চাইলে আপনারা সেইন্ট ঘোষণার শেষ ধাপ ক্যানোনাইজেশন শুরু করতে পারেন। মানুষটি প্রায় ত্রিশ বছর ধরে মাটির নিচে শুয়ে থাকলেও তাঁর অলৌকিকত্বে উপকৃত হয়েছেন এমন কিছু মানুষ এখনও বেঁচে আছেন। যারা সাক্ষ্য দেবেন।’
‘ওয়ান্ডারফুল! আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে, জন হেনরি নিউম্যান মারা যান ১৮৯০ সালে, কিন্তু তাঁর ক্যানোনাইজেশন পর্ব শেষ করে তাকে সন্ত ঘোষণা করা হলো মাত্র সেদিন। ২০১৯ সালে। আপনার ভদ্রলোক মারা গেছেন ত্রিশ বছর আগে। সেইন্ট হেনরির তুলনায় তা দীর্ঘ সময় নয়। এবার বলুন আমরা আপনার ভদ্রলোকের ক্যানোনাইজেশন পর্ব কীভাবে শুরু করব? সাক্ষী কে? যিনি তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা প্রমাণ করবেন?’
‘তাঁর আধ্যাত্মিকতায় যার জীবন রক্ষা পেয়েছিল এমন একজন মানুষ স্বয়ং সাক্ষ্য দেবেন। একটি হাসপাতালের একজন ডাক্তার এবং দুজন নার্স তাঁর বক্তব্য সমর্থন করবেন। তারা সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এর বাইরে স্থানীয় প্রবীণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তারাও ব্যাপারটি জানেন। চারিদিকে তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়েছিল।’
‘তিনি কি কথা বলবেন?’ কার্ডিনাল ম্যানুয়েল জিজ্ঞেস করলেন।
‘বলবেন।’
‘কীভাবে নিশ্চিত হলেন? আপনি কি যোগাযোগ করেছিলেন? নিয়মানুযায়ী আপনি কিন্তু তা করতে পারেন না। কারণ এতে সাক্ষীকে প্রভাবিত করা হয়। নিয়ম হচ্ছে ভ্যাটিকান টিম হঠাৎ করে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করবে যাতে কোনও গল্প সাজানোর সুযোগ না থাকে।’
‘ইয়োর এমিনেন্স, আমি ঐড়ষু ঝবব-এর নিয়ম জানি। না জানলে আর্চ বিশপ হতে পারতাম না। আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করিনি। তবে নিশ্চিত ধারণা করছি ভ্যাটিকান অ্যাপ্রোচ করলে তিনি তা ফেলতে পারবেন না। কৃতজ্ঞতাবোধ থেকেই পারবেন না। জীবনরক্ষার ঋণ অনেক বড় ব্যাপার, এক্সেলেন্সি।’
‘আই অ্যাপোলোজাইজ, ফাদার। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য কথাটি বলিনি।’
‘সমস্যা নেই। এই নিন, উনার ঠিকানা এবং ফোন নাম্বার। একই সঙ্গে সেই চিকিৎসক ও দুজন নার্সের ডিটেইলও এখানে আছে। এরা তাঁর বক্তব্য সমর্থন করবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমি অনেক ঝামেলা করে লোক লাগিয়ে এগুলো জোগাড় করেছি। কিন্তু তাদের জানতে দেওয়া হয়নি এগুলো কেন সংগ্রহ করা হচ্ছে।’ বলতে বলতে ফাদার ফেদেরা এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, ‘ভদ্রলোক থাকেন নিউ জার্সিতে। এখন তাঁর বয়স বাষট্টি।’
‘অনেক ধন্যবাদ, ফাদার। আমরা উনার সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
‘ধন্যবাদ, ইয়োর এমিনেন্স ।’
আজ রবিবার। ছুটির দিন। অবিনাশ দাস গতকাল অনেক রাতে ঘুমাতে গেছেন। অন্যদিন তিনি ব্যস্ত থাকেন তাই গানের রেওয়াজ করার সুযোগ পান না। তাই সাপ্তাহিক ছুটি শুরু হলে তিনি শুক্র এবং শনিবার সন্ধ্যা থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত রেওয়াজ করেন। দেরি করে ঘুমাতে যাওয়ায় আজ তাঁর ঘুম ভেঙেছে অনেক দেরিতে। তিনি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে গেলেন। স্যান্ডউইচ আর কফি দিয়েই আজ দিনের খাবার সারবেন। স্ত্রী দেশে যাওয়ার পর তিনি মোটামুটি এগুলো খেয়েই টিকে আছেন। তাঁর রান্নার হাত অপূর্ব, কিন্তু তিনি তাতে সময় দিতে চান না। বরং হারমোনিয়ামে সময় দিতেই তিনি পছন্দ করেন। সঙ্গীতের তুলনায় খাবার তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ বিষয়। কিচেন টেবিলে বসেই খাওয়া শেষ করে তিনি বসার ঘরে পাটি পেতে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন। তারপর সঙ্গীতের ধ্যানে ডুব দিলেন। তাঁর ধারণা ধ্যানস্থ অবস্থায় তিনি গানের রং দেখতে পান। একেক গানের একেক রং। রবীন্দ্র সঙ্গীত হলে তিনি উজ্জ্বল সোনালি রং দেখেন, নজরুল সঙ্গীত হলে দেখেন লাল, উচ্চাঙ্গ হলে দেখেন হালকা আকাশী রং ধীরে ধীরে তীব্র নীল হচ্ছে। মূলত তিনি উচ্চাঙ্গ ঘরানার গায়ক হলেও অন্যান্য গানও গান। আজ তিনি জয়পুর ঘরানার খেয়াল গাইছেন। বন্ধ চোখের ভেতরে আকাশি রং ধীরে ধীরে নীল হচ্ছে, এমন সময় মোবাইল ফোনের তীব্র শব্দ সেই অপূর্ব রং-এর খেলাকে খুন করল। ফোন বন্ধ করতে ভুলে যাওয়ায় তাঁর নিজের উপরই রাগ হলো। খুবই বিরক্তি নিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কে বলছেন?’
‘পিস বি আপন ইউ। আমি ভ্যাটিকান থেকে কার্ডিনাল ভিক্টর ম্যানুয়াল বলছি। আপনি কি অবিনাশ দাস?’
অবিনাশের মেজাজ খারাপ হলো। খেয়েদেয়ে কাজ নেই ভ্যাটিকানের একজন কার্ডিনাল তাঁকে ফোন করবেন! পোপের পরেই কার্ডিনালদের অবস্থান। তাঁদের একজন আর কাউকে না, তাঁকে ফোন করবেন! সিউর, কোনও ফাজিলের প্রাংক কল। তিনি খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘ফাজলামির আর জায়গা পাও না। তুমি কার্ডিনাল! এর অর্থ বোঝো?’
ওপার থেকে নম্র কণ্ঠে বলা হলো, ‘আপনার রেগে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। একজন কার্ডিনাল আপনাকে কেন ফোন করবেন? তবে আমি মোবাইল নাম্বার থেকে আপনাকে ফোন করিনি। ল্যান্ডফোন থেকে করেছি। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন ভ্যাটিকানের জন্য আলাদা একটি টেলিফোন কোড নির্ধারণ করেছিল। সেটা হচ্ছে ৩৭৯, কিন্তু এই কোড ভ্যাটিকান নরমালি ব্যবহার করে না। রোমের টেলিফোন কোড ০৬ ব্যবহার করে। শুধু মহামান্য পোপ এবং কার্ডিনালরা ৩৭৯ কোডটি ব্যবহার করার অনুমতি পেয়েছেন। তাই এ কোড থেকে ফোন গেলেই আপনার বুঝতে হবে এটি স্বয়ং পোপ বা কার্ডিনাল করেছেন। আপনি গুগল করে চেক করতে পারেন।’
অবিনাশ দাস একটু থমকে গেলেন, তিনি কানের কাছ থেকে ফোন নিচে নামিয়ে দেখলেন আসলেই ৩৭৯ কোড নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। তিনি কণ্ঠ কিছুটা নরম করে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না আপনি আমাকে কেন ফোন করেছেন?’
‘ভ্যাটিকান আপনার ব্যাপারে আগ্রহী।’
‘আমার ব্যাপারে আগ্রহী! কেন?’
‘আপনার কি মনে আছে বারো বছর বয়সে আপনি মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন?’
‘থাকবে না কেন? মৃত্যুর এত কাছ থেকে ফিরে আসার স্মৃতি কি ভোলা যায়?’
‘আপনি অনুমতি দিলে আমরা এ ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে চাই।’
‘আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।’ অবিনাশ বাবুর বিস্ময় বাড়ছে।
‘আমার প্রতিনিধি ফাদার ম্যান্ডেলা ডিমারজিও আপনার সঙ্গে আগামী উইকএন্ডে দেখা করবেন। তিনি নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ডায়োসিসের বিশপ। তিনি সব খুলে বলবেন। আগামী শনিবার সকাল এগারোটায় আমি উনাকে আপনার কাছে পাঠাতে পারি?’
‘অবশ্যই পারেন। আমি ব্যাপারটি নিয়ে খুব কৌতূহলী হয়ে উঠছি।’
‘মার্সি বি আপন ইউ। এখন রাখি।’
‘ফাদার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
পরের শনিবার অবিনাশ দাস রেওয়াজে বসলেন না। তিনি একই সঙ্গে তীব্র কৌতূহল ও নার্ভাসনেস নিয়ে বিশপ ম্যান্ডেলা ডিমারজিও-এর সঙ্গে দেখা করার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ভ্যাটিকান কেন বারো বছর বয়সে তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নিয়ে এতদিন পর আগ্রহী সেটা কোনওভাবেই তিনি ভেবে কূল করতে পারছেন না। ব্যাপারটি তিনি কারও সঙ্গে শেয়ারও করেননি। কেন জানি মনে হচ্ছে, ভ্যাটিকান কোনও ভুূল করছে, জানাজানি হলে পরে লোকে হাসবে।
ঠিক এগারোটায় ডোরবেল বেজে উঠল। পিপহোল দিয়ে তিনি দেখলেন পাদ্রির পোশাকে দীর্ঘদেহী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বোঝাই যায় ইনিই বিশপ ম্যান্ডেলা। তিনি দ্রুত দরজা খুললেন। বিশপ নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি অবিনাশ দাস?’
‘জি।’
‘আমি ম্যান্ডেলা। ব্রুকলিন ডায়োসিসে কাজ করি।’
‘প্লিজ ভেতরে আসুন, ফাদার। আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’
‘ঈশ্বর আপনার মঙ্গল করুন।’
‘আপনি বসুন, ফাদার। আমি কফি নিয়ে আসছি।’
‘খাওয়ার ব্যাপারে আমার কিছু রেস্ট্রিকশন আছে, আফটার অল বয়স তো সত্তর পেরিয়েছে। তাই কিছু খেতে চাইছি না, আপনি বরং এক গ্লাস পানি দিতে পারেন।’
‘ঠিক আছে, আমি নিয়ে আসছি।’
বিশপ বেশ সময় নিয়ে পানির গ্লাস শেষ করলেন, তারপর বললেন, ‘এবার কাজের কথায় আসি। শ্রদ্ধেয় কার্ডিনাল ভিক্টর ম্যানুয়েল নিশ্চয়ই আমার আসার উদ্দেশ্য বলেছেন।’
‘তিনি বলেছেন বারো বছর বয়সে আমার অলৌকিকভাবে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে আসার ব্যাপারে তিনি জানতে আগ্রহী। তবে বিস্তারিত বলেননি। বলেছেন সেটা আপনি বলবেন?’
‘আপনি কি জানেন ক্যাথলিক চার্চের পক্ষ থেকে কিছু মানুষকে সেইন্ট ঘোষণা করা হয়?’
‘আমার তেমন ধারণা নেই। তবে কোথায় যেন পড়েছিলাম মাদার তেরেসাকে সেইন্ট ডিক্লেয়ার করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনও আইডিয়া নেই।’
‘কারেক্ট, মাদার তেরেসাকে ২০১৬ সালে মহামান্য পোপ সেইন্ট ঘোষণা করেছিলেন। সেইন্ট তেরেসা অব ক্যালকাটা। এ সম্মান পাওয়া অতি বিরল ঘটনা। শত বছরেও একজন পান না। আমাদের পরম সৌভাগ্য সম্ভবত আমরা একজন সেইন্টকে খুঁজে পেতে যাচ্ছি এবং এর সঙ্গে আপনি জড়িত।’
‘আমি! কীভাবে? কে সেই সেইন্ট, ফাদার?’
“প্রথমে আপনাকে সেইন্ট ডিক্লেয়ার করার প্রক্রিয়াটি বলি। তারপর আপনার অন্য প্রশ্নের উত্তর দেব। এটি অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। যাতে অনেকগুলো ধাপ আছে। প্রথমে স্থানীয় বিশপ তাঁর এলাকায় মৃত কোনও ক্যাথলিককে যদি সেইন্ট ঘোষণার উপযুক্ত মনে করেন তবে তিনি নিজে আগে সে ব্যক্তির ব্যাপারে বিস্তারিত তদন্ত করেন। এ পর্যায়ে সে ব্যক্তির জীবনধারা ও ধর্মীয় অবদান বিশদ পর্যালোচনা করা হয়। তাতে সন্তুষ্ট হলে তিনি তা ভ্যাটিকানের ‘দ্য কংগ্রেগেশন ফর দ্য কজেস অব সেইন্টস’ নামের কমিটির কাছে পাঠান। এ কমিটি তাঁর সঙ্গে একমত হলে সে ব্যক্তিকে ‘সারভেন্ট অব গড’ ঘোষণা করা হয়। এরপর শুরু হয় সেইন্ট ঘোষণার আরও তিনটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াগুলো সরাসরি ভ্যাটিকানের তত্ত্বাবধানে হয়। এখানে প্রথমে যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তাকে বলা হয়, ‘ভেনারেবল’ এ পর্যায়ে দেখা হয় প্রস্তাবিত ব্যক্তির খ্রিস্টিয় গুণাবলি ছিল কি না? ক্যাথলিক ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা এটা পর্যালোচনা করেন। এতে টিকে গেলে মৃত ব্যক্তিকে ‘ভেনারেবল’ মানে ‘পরম শ্রদ্ধেয়’ বলে ঘোষণা করা হয়।” একটানা কথা বলে ফাদার ম্যান্ডেলা থামলেন। তারপর একটু দম নিয়ে বললেন, ‘আপনি কি আমার কথায় বিরক্ত হচ্ছেন?’
‘না, তবে আমি বুঝতে পারছি না এর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী?’
‘একটু পরই ক্লিয়ার হবেন। আমি এগুই?’
‘শিউর, ফাদার।’
ভেনারেবল পর্ব শেষ হওয়ার পর শুরু হয় কঠিন একটি পর্ব। এর নাম ‘বিটিফিকেশন’ এ পর্বে দেখা হয় সন্ত ঘোষণা হওয়ার অপেক্ষায় যিনি আছেন তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা ছিল কিনা। এ পর্বে অলৌকিকত্ব প্রমাণিত হলে মৃত ব্যক্তিটিকে ‘ইষবংংবফ’ ঘোষণা করা হয়। তবে এ পর্যন্ত এসে বেশির ভাগ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। কারণ তাঁদের অলৌকিকত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না। যারা টিকে যান তাদের শেষ ধাপ পেরুতে হয়। এটিকে আমরা বলি, ‘ক্যানোনাইজেশন’―এখানে আবার অলৌকিক ক্ষমতার পরীক্ষা দিতে হয়। প্রশ্ন আসতে পারে দ্বিতীয়বার এ পরীক্ষা কেন? বিয়াটিফিকেশন পর্যায়ে তো তা প্রমাণ হয়েছে! তারপরও দ্বিতীয়বার এটা পরীক্ষা করা হয়, কারণ ভ্যাটিকান নিশ্চিত হতে চায়, ‘প্রথম ঘটনা মানে বিয়াটিফিকেশন পর্বে যে অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে তা কাকতালীয় ছিল কিনা?’ অনেকক্ষণ কথা বলে বিশপ হাঁপাচ্ছেন। অবিনাশ বাবু বললেন, ‘পানি খাবেন?’
‘খাব, খুব তেষ্টা পেয়েছে।’
অবিনাশ দ্রুত আরেক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে এলেন, সঙ্গে কয়েকটি বিস্কুট। বিশপ ম্যান্ডেলা ঢক ঢক করে শুধু পানি খেলেন। তারপর আবার বলতে লাগলেন, ‘এবার আপনাকে এত কথা বলার কারণটি বলি।’
‘বলুন, প্লিজ বলুন।’ অবিনাশ দাসের কণ্ঠে তীব্র উত্তেজনা।
‘আমরা এখন একজনকে সেইন্ট ঘোষণার প্রক্রিয়ায় আছি। কাজটি শুরু হয়েছে পঁচিশ বছর আগে। সৌভাগ্যক্রমে তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব মানে সারভেন্ট অভ গড, ভেনারেবল এবং বিয়াটিফিকেশন এসব পর্যায়ে টিকে গেছেন। এখন চলছে তাঁর ক্যানোনাইজেশন মানে শেষ পর্ব। আমরা আরেকটি অলৌকিক ঘটনা খুঁজছি। নিশ্চিত হতে চাইছি তাঁর অলৌকিক ঘটনা রিপিট করার ক্ষমতা ছিল। এ পর্বের জন্যই আমাদের আপনাকে দরকার।’
‘আমাকে দরকার! সরি, আমি খুবই কনফিউজড।’ অবিনাশের মধ্যে উত্তেজনার সঙ্গে তীব্র কৌতূহল জায়গা করে নিয়েছে।
‘আপনার কনফিউশন দূর করছি। আপনার জন্ম তো বাংলাদেশে তাই না?’
‘জি।’
“বারো বছর বয়সে আপনার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। গত শতকের সত্তর দশকে। তখন সারা দুনিয়াতেই ব্লাড ক্যান্সারের চিকিৎসা অনেক পিছিয়ে ছিল। আর আপনার সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তো তা ছিল না বললেই চলে। তারপরও আপনার বাবা দেশের সেরা চিকিৎসকদের আশ্রয় নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসা সুবিধা নিশ্চিত করার সুযোগ তাঁর ছিল। কারণ তিনি ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁর সুর করা গানগুলো মানুষের মুখে মুখে গাওয়া হতো। তাই তাঁকে সবাই খুব সম্মান করত। কিন্তু তাঁর এ যোগাযোগ কোনও কাজ দিল না। চিকিৎসকরা ঘোষণা দিলেন আপনি চিকিৎসার অতীত। তাদের কিছুই করার নেই। ক্রমেই আপনার অবস্থা খারাপ হতে লাগল। এক সময় ডাক্তাররা বললেন, আপনাকে হাসপাতাল থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া ভালো, কারণ তাদের ধারণা আপনি যে কোনও সময় মারা যেতে পারেন। শেষ সময়টা আপনার বাড়িতে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গেই থাকা ভালো। ঠিক এই সময় পরিচিত একজন চিকিৎসক আপনার বাবাকে দুলাহাজরা মিশনারি হাসপাতালের কথা বললেন। এটি কক্সবাজারে চকরিয়া নামের একটি জায়গায় অবস্থিত। আপনার বাবাকে বলা হলো, এ হাসপাতাল যেহেতু বিদেশিদের ফান্ডে চলে তাই তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা ও সরঞ্জামাদি অনেক ভালো। তাছাড়া সেখানকার চিফ মেডিক্যাল অফিসার ফাদার লুকাস মাথিয়াস খুবই ভালো ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ। সুদূর ইতালি থেকে তিনি এ দুর্গম এলাকায় এসেছেন অসহায় রোগীদের সেবা করার জন্য। তাই শেষ চেষ্টা হিসেবে আপনাকে সেখানে নেওয়া যেতে পারে। আপনার বাবা তখন আপনাকে বাঁচাতে মরিয়া। খড়কুটো পেলে তা-ই আঁকড়ে ধরেন। তাই কোনও লাভ হবে না জেনেও তিনি একটি অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আপনাকে দুলাহাজরা হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। তখন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। হাসপাতালে পৌঁছাতে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা লেগে গেল। শেষ পর্যন্ত যখন আপনারা সেখানে পৌঁছালেন তখন আপনি সংজ্ঞাহীন। এখন যায়, তখন যায় অবস্থা। ডাক্তার লুকাস আপনাকে দেখে হতাশায় মাথা নেড়ে বললেন, ‘দেয়ার ইজ নো হোপ। বাচ্চাটিকে বাঁচানোর কোনও সুযোগ নেই। সে চিকিৎসার বাইরে চলে গেছে।’ তারপর তিনি অদ্ভুত একটি কাণ্ড করলেন। তা হলো, তিনি তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে ডেকে বললেন, ‘আমরা রোগীর কোনও চিকিৎসা করব না। অন্যভাবে তাকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করব, সেটা হচ্ছে প্রার্থনা। আমি রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে ঈশ্বরের কাছে তার জীবন ভিক্ষা চাইব। তাঁর দয়া ভিক্ষা করব। আর কিছু না।’ তারপর তিনি তাই করতে লাগলেন। প্রার্থনা শুরু হলো রাত বারোটায়, শেষ হলো ভোরে। এভাবে তিন দিন চলল। কী আশ্চর্য! চারদিনের মাথায় আপনার শরীরে রং ফিরতে লাগল। চোখে ভাষা ফিরে এল এবং পঞ্চম দিনে আপনি অনেক দিন পর সলিড ফুড খেতে পারলেন। এক মাস পর পুরো সুস্থ হয়ে আপনি বাড়ি ফিরে এলেন। কোনও এক অদৃশ্য কারণে ক্যান্সার পরাজিত হলো এবং এখন পর্যন্ত আপনি দিব্যি সুস্থ আছেন। ব্যাপারটা নিয়ে অন্য চিকিৎসকরা অনেক গবেষণা করেছেন, কিন্তু আপনার সুস্থ হওয়ার ব্যাখ্যা পাননি। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে পরম করুণাময় ঈশ্বর ডাক্তার লুকাসের প্রার্থনা শুনেছিলেন। ঘটনাটি কি আপনার মনে আছে?”
‘অবশ্যই আছে। মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে আসার স্মৃতি কি ভোলা যায়? তা ছাড়া বাবা প্রায়ই এ ঘটনার কথা বলতেন।’
‘আপনার কি মনে হয় না ফাদার লুকাস আপনাকে বাঁচানোর মাধ্যমে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিলেন?’
‘মনে হয়’―বলেই অবিনাশ দাস ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। কেন কাঁদছেন তা তিনি জানেন না।
‘আপনি কি পুরো ঘটনা লিখে তাতে সাইন করে আমাকে দেবেন?’
‘অবশ্যই দেব। আপনারা কি ফাদার লুকাসকে সেইন্ট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন?’
‘জি। তিনি মারা যান ১৯৯৩ সালে। দুলাহাজরা হাসপাতালে তাঁর কোয়ার্টার থেকেই তিনি প্রভুর সঙ্গে মিলিত হন। এর পাঁচ বছর পর ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ফেদারা তাঁকে সেইন্ট ঘোষণার জন্য পোপের কাছে আবেদন করেন। ভ্যাটিকান সে আবেদন গ্রহণ করে। তারপর থেকে আমরা তা নিয়ে কাজ করছি। আপনার ক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া ঘটনা হচ্ছে তাঁকে অফিসিয়ালি সেইন্ট ঘোষণার শেষ ধাপ। আগেই বলেছি এটাকে আমরা ক্যানোনাইজেশন বলি। তবে শুধু আপনার বক্তব্য নয়, আপনাকে সমর্থন করবেন এমন সাক্ষী লাগবে। সৌভাগ্যক্রমে সে সময় দুলাহাজরা হাসপাতালে কর্মরত একজন বাংলাদেশি চিকিৎসক ও দুজন নার্স বেঁচে আছেন। আমরা তাদের সাক্ষ্যও নেব।’
‘আমার একটি ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করছে।’ অবিনাশ বললেন।
‘বলুন।’
‘আপনি বলছেন আমার ঘটনা প্রমাণিত হলে তাঁকে সেইন্ট ঘোষণা করা হবে। কিন্তু এর জন্য দুটো অলৌকিক ঘটনার প্রমাণ পেতে হবে। তার মানে কি আপনারা ফাদার লুকাসের আরও একটি অলৌকিকত্বের প্রমাণ পেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ, পেয়েছি এবং তা প্রমাণিত।’
‘ঘটনাটি কি আমি জানতে পারি?’
বিশপ হাসলেন, ‘হ্যাঁ, পারেন। আমার ধারণা ছিল আপনি এ ব্যাপারে জানতে চাইবেন। আপনার পরে তিনি অলৌকিক ক্ষমতায় আরেকজনের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন। যার প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন তার লিখিত বক্তব্য আমার কাছে আছে। আপনি পড়ে দেখতে পারেন।’
‘প্লিজ।’
বিশপ তাঁর ব্যাগ থেকে একটি ভ্যাটিকানের সিল অংকিত ফাইল বের করে অবিনাশের হাতে দিলেন। তিনি সেটা খুলে একটি দু পাতার বক্তব্য পড়তে লাগলেন। তাতে লেখা,
“আমার নাম আহমেদ সাঈদ। বয়স একান্ন। পেশায় ব্যাংকার। ১৯৯১ সালে ছুটি কাটাতে কক্সবাজার গেছি। একা। উঠেছি একটি নির্জন বাংলোয়। ফিরে আসার আগের রাতের ঘটনা। খাবার শেষে চা নিয়ে বারান্দায় বসলাম। সে রাতে পূর্ণ জ্যোৎস্না। ক হাত দূরে সমুদ্রে চাঁদের আলো ক্ষীরের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। পূর্ণিমাস্নাত স্রোতের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া চারিদিক ভূতুড়ে নির্জনতা। এমন সময় মাথায় আগুন জ্বালালেন রবীন্দ্রনাথ। হেডফোনে তিনি বেজে উঠলেন, ‘আজি জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে…।’ আমার মনে হতে লাগলো, আরে, এই অসাধারণ জ্যোৎস্না রাতে আমি এই ইট-পাথরের বাংলোয় কী করছি? সবাই তো বনে চলে গেছে। জ্যোৎস্না অবগাহনে চলে গেছে। আমি কেন এখানে? মাথায় ভূত চাপল। দশ মিনিটের মাথায় আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। একপাশে সমুদ্র আরেক পাশে পাহাড়, তার মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আমি বাড়ি ফিরে যাব। মাঝে মাঝে গাড়ি থামিয়ে লাফ মেরে চাঁদের আলো ধরব! আমি ঘোরের মধ্যে গাড়ি চালাচ্ছি। সঙ্গে কেউ নেই, শুধু বেজে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্নরকণ্ঠী ইন্দ্রানী সেন। আহা! অসম্ভব ভাগ্যবান হলেই কেবল এরকম একটি রাতের দেখা পাওয়া যায়। হঠাৎ দুলাহাজরার কাছাকাছি এসেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এল। দমকে দমকে বুকে উঠে এল তীব্র ব্যথা। মনে হচ্ছে সেখানে টন টন চাপ। সারা শরীরে ঘাম। সামনের সব দৃশ্য আবছা হয়ে আসছে, স্টিয়ারিং ছুটে যাচ্ছে, জ্যোৎস্নার আলোর বদলে চোখের সামনে লাল নীল আলোর ফুলকি ফুটছে। হা করে বাতাস নিতে চাইছি, পারছি না। আগেও একবার হয়েছিল, তাই বুঝলাম কী হয়েছে। কারডিয়াক অ্যারেস্ট। সিভিয়ার। সঙ্গে বুঝতে পারলাম, ইমিডিয়েট চিকিৎসা না পেলে আমি মারা যাব। দ্রুত আমাকে হাসপাতালে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু এই নির্জন পাহাড়ি ধ্যাদ্দরা গোবিন্দপুরে হাসপাতাল কোথায়? হঠাৎ মনে পড়ল সামনেই কোথাও দুলাহাজরা মিশনারি হাসপাতাল। যেভাবেই হোক সেখানে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু কীভাবে পৌঁছাব? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে, ঘামে পিচ্ছিল হাত স্টিয়ারিং থেকে ছুটে গেছে, গাড়ি ছুটে চলছে খাদের দিকে। কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। খুব বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আমার মেয়েটা এখনও খুব ছোট। প্রতিদিন বিকেল হলেই ফোন করে অস্থির করে তোলে বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য। আমার স্ত্রী খাবার টেবিলে দুটো প্লেট সাজিয়ে অপেক্ষা করে। আমার তাদের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারছি না। ব্যথাটা ক্রমশ যেন পুরো শরীরকে অবশ করে ফেলছে। আমি স্টিয়ারিং-এর উপর ঝুঁকে পড়লাম, ঘুম আসছে, গভীর ঘুম। মনে হচ্ছে আমি ভেসে বেড়াচ্ছি, চারিদিকে হলুদ ফেনা। ভাসতে ভাসতেই হঠাৎ আমি চাপা গলায় বলতে লাগলাম, হেল্প, প্লিজ হেল্প মি, আমাকে বাঁচান। আমার মেয়েটা এখনও খুব ছোট―কাকে বলছি আমি জানি না। এমন সময় আমাকে ধাক্কা দিয়ে কে যেন ড্রাইভিং সিট থেকে সরিয়ে দিল। হালকা আলোয় দেখলাম কেউ একজন স্টিয়ারিংয়ে বসে আছেন। হাল্কা শিস দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। পরনে থ্রি পিস সুট, মাথায় ফেডোরা হ্যাট, ঠোঁটে ঝুলছে চুরুট। হালকা সুরে গাইছেন, যিবহ ও ধিং ুড়ঁহম ও’ফ ষরংঃবহ ঃড় ৎধফরড়…। মারা যাওয়ার চেয়েও আমার কাছে যেটা বেশি বিস্ময় হয়ে দেখা দিল, তা হচ্ছে, যিনি গাড়ি চালাচ্ছেন, তিনি একজন ইউরোপীয় সাহেব। এদেশি কেউ নন! এরপর শুধুই অন্ধকার, আলকাতরা অন্ধকার।
দু দিন পর আমার জ্ঞান ফিরে এল দুলাহাজরা মিশনারি হাসপাতালে। এরমধ্যে আমার এনজিওগ্রাম হয়েছে। তাৎক্ষণিক জীবন বাঁচানোর জন্য যা যা দরকার সব করা হয়েছে। কাল আমাকে ঢাকায় পাঠানো হবে, সেখানে বাইপাস সার্জারি হবে। অনেক ফ্রেশ লাগছে। রাতে হালকা খাবার খেয়ে শুয়ে আছি। এদের খাবারও ভালো। স্যুপ, সবুজ সালাদ। আরামে ঘুম নেমে আসছে। রাতও অনেক। এমন সময় দরজা খুলে গেল। হুইল চেয়ার ঠেলে এক বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। নিজের হুইল চেয়ার নিজেই ঠেলছেন। বোঝাই যাচ্ছে, পাদ্রি। মিশনের ফাদার। তিনি আমার পাশে এসে বললেন, ‘সন, এখন কেমন বোধ করছেন?’ আমি বললাম, ‘ভালো, খুব ভালো। ধন্যবাদ, অনেক অনেক’―, তিনি আমার কথা শেষ করতে দিলেন না, বললেন, ‘আমাকে নয়, ওপরে যিনি আছেন তাঁকে ধন্যবাদ দিন। তিনিই সব।’ আমি তাঁর হাত আঁকড়ে ধরলাম, ‘ফাদার, আপনি কত দিন এ দেশে?’ তিনি হাসলেন, ‘ফ্লোরেন্স থেকে যখন এখানে পৌঁছালাম তখন বয়স ছিল চল্লিশ, এখন চলছে চুরাশি। লম্বা সময় তাই না?’ আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি নিশ্চিত সেদিন গাড়ি চালিয়েছিলেন আপনি। আমার পরিষ্কার চেহারা মনে আছে। আপনি স্যুট পরেছিলেন, মাথায় ছিল ফ্যাডোরা হ্যাট। অথচ আপনি পঙ্গ্।ু কিছু মনে করবেন না আমি এভাবে বলতে চাইনি―কিন্তু, কিন্তু…, আপনি গাড়ি কীভাবে চালালেন? সেদিন কীভাবে সেখানে উপস্থিত হলেন!’
তিনি আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘মাই সন, আপনি সাহায্য চেয়েছিলেন মহান প্রভুর কাছে। তিনি কারও না কারও মাধ্যমে সাহায্য পাঠান। তাঁর ক্ষমতা অসীম। সেই অসীমত্বের কাছে পঙ্গুত্ব কোনও ব্যাপার না, কীভাবে আমি সেখানে হাজির হলাম সেটাও কোনও ব্যাপার না―তিনিই সাহায্য পাঠান, আমরা উপলক্ষ্য মাত্র।’ ফাদার হাসছেন। এরকম পবিত্র হাসি আমি আর দেখিনি।
পরে জানতে পারি তাঁর নাম ফাদার লুকাস মাথিয়াস। তিনিই এ হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক। অবশ্য তিনি ছিলেন ক্যান্সার স্পেশালিস্ট। তাঁর অন্য সহকর্মীরাই আমার হার্টের চিকিৎসা করেছিলেন। ফাদার চিরাচরিত চার্চের পোশাকের পরিবর্তে স্যুট পরে কীভাবে সেদিন সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন, ‘কিংবা সম্পুর্ণ পঙ্গু মানুষটি কীভাবে গাড়ি চালিয়েছিলেন তার কোনও ব্যাখ্যা আমি পাইনি।
পুরোটা পড়ে অবিনাশ দাস বিশপ ম্যান্ডেলার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। বিশপ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভদ্রলোকের বর্ণিত ডাক্তারকে আপনি চিনতে পারছেন?’
‘পারছি। আমার চিকিৎসার সময়ও তিনি পঙ্গু ছিলেন। হুইল চেয়ার ব্যবহার করতেন।’
‘হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মুসোলিনি বাহিনীর পোঁতা একটি ল্যান্ড মাইনে না জেনে পা রাখায় সেগুলো উড়ে গিয়েছিল। আপনি কি বিশ্বাস করেন আহমেদ সাঈদের ব্যাপারটিও অলৌকিক?’
‘অবশ্যই করি।’ বলতে বলতে অবিনাশ বাবু আবার কাঁদতে লাগলেন।
‘আমরাও করি। কারণ তখন সেখানে কর্মরত কয়েকজন ডাক্তার, নার্স ও গার্ডরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, সেদিন রাতে তারা অবাক হয়ে দেখেছিলেন, সম্পূর্ণ পঙ্গু ডাক্তার লুকাস একটি অপরিচিত গাড়ি চালিয়ে একজন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এসে চিৎকার করছিলেন, ‘ইমার্জেন্সি, ওকে আইসিউতে নিয়ে যাও, কুইক।’ তবে তারা তাঁকে ফাদারের পোশাক পরা অবস্থাতেই দেখেছেন, আহমেদ সাঈদের মতো স্যুট পরা অবস্থায় নয়। সম্ভবত পোশাকও ছিল ফাদার লুকাসের অলৌকিক রহস্যময়তার অংশ। যাই হোক, কীভাবে পঙ্গু ডাক্তার এত দূরে ছুটে গিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে মৃতপ্রায় একজন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে এলেন কিংবা রোগীর খোঁজ তিনি কীভাবে পেলেন তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। পাওয়ার কথাও না। কারন পুরো ঘটনা ফাদার লুকাস তাঁর আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় ঘটিয়েছিলেন। হি ওয়াজ ব্লেসড। তিনি ছিলেন ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট। আপনিও তাই, কারণ একজন সত্যিকারের সাধুর অলৌকিক ক্ষমতায় আপনার জীবন রক্ষা পেয়েছিল।’
অবিনাশ বাবু কোনও জবাব দিতে পারলেন না। দু হাতে মুখ ঢেকে তিনি ফোঁপাচ্ছেন। সম্ভবত তিনি বারো বছর বয়সের সে ভয়ংকর দিনগুলোতে ফিরে গেছেন।
২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
ভ্যাটিকানে অন্যরকম বড়দিন পালিত হলো। কারণ সেদিন মহামান্য পোপ ফ্রান্সিস বাংলাদেশের অখ্যাত একটি খ্রিস্টান কবরস্থানে শুয়ে থাকা এক চিকিৎসককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সাধু’ হিসেবে ঘোষণা করলেন।
অফিসিয়ালি তাঁর নাম হলো ‘সেইন্ট লুকাস অব কক্সবাজার।’
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ



