আর্কাইভকবিতা

কবিতা

হাসনাত শোয়েব

মৃত্যু

‘মৃত্যুরও হয়তো কোনও নিরাময় আছে

কিন্তু বেঁচে থাকার কোনও নিরাময় নেই।’

―ফিরাক গোরখপুরী

গলায় বিষ নিয়েই জন্ম। বিষ নিয়েই বেড়ে ওঠা আর বেঁচে থাকা। খুব ছোট থাকতে একবার পুকুরে পড়ে গিয়েছিলাম, এলাকাবাসী মৃত ঘোষণা করেছিল। এরপরও অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিলাম। বারবার মরার জন্য যার জন্ম, তার কি অত সহজে মরলে চলে। আমিও মরিনি। ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে যে বাস আমি মিস করেছিলাম, সেটা সীতাকুণ্ড পেরিয়েই এক্সিডেন্ট করেছিল। কেউ বাঁচেনি। শুধু আমার সিটটাই ফাঁকা পড়ে ছিল। মৃত্যুর ফেরেশতাও নিশ্চয়ই অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন। একটা প্রাণ কম নিয়েই! আর যেদিন ঝাউ বনে ঝড় উঠল, আনারস গাছগুলোও দুলতে দুলতে চিৎকার করে বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিল। আমি হাসি মুখেই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। স্যান্ডেলের ছাপ তখনও আনারস বনে স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থেকে গিয়েছিল। পরদিন সকালে গাছে আর কোনও আনারস ছিল না, ছাপটা তখনও সূর্যের আলোয় চিকচিক করছিল। এভাবেই বেঁচে আছি, না থাকার মতো। কোয়েতজে যেমনটা বলেছিলেন, ‘আমি মরে গেছি। কিন্তু মৃত্যু শালার আসতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ সে আসবে নিশ্চয়ই, যেদিন মালকোষ বাজাতে বাজাতে হৃৎপিণ্ড বিকোতে বেরোবে বিষণ্ন কিশোরেরা।

………..

পিয়াস মজিদ

ধোপাখালি

ভোরে আমি অন্য মানুষ। স্বপ্নের নবাবি ঝেড়ে দাঁতে দিই বাস্তবের ব্রাশ। কখনও সফর শুরু করি। কোথাও কেউ কি অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য ? তাহলে সে কুমারী প্রতীক্ষার সঙ্গে কথা কই। বাসে অচেনা লোকজন। বাস চলে গতির গানে। আমি দেখি বাইরে অপার আকাশমাটির মাঝামাঝি স্মৃতির হাওয়া খুঁটে খায় কোনও এক পাখি। যারা চলে গেছে, যারা থেকে আছে―আমার জীবনে; সবার কাছ থেকে পালাতে চাই। এমনকি পালানোর হাত হতে নিস্তার চাই। তবু অপেক্ষায় বসে আছে ধনবাড়ি বাসস্ট্যান্ডে, জামিলুর কিংবা সৌরভ। মধুপুরের আনারসের মিষ্টি অবয়বে বিষাক্ত সব আগামীকালের আগে আমাকে আজ বেঁচে থাকতে হবে। ঘুরতে হবে। এক একটা গল্পে ঢুকতে হবে। লিরিকের লাশ দাফনে অংশ নিতে হইবেক। মসজিদের কারুকর্ম আবেশ আনে। ওদিকে উপাসনার সময় যে যায়। নামাজ আমার হইলো না আদায়! দুপুরের ঝিমধরা নবাবির কাছে নবাববাড়ি বড্ড নিষ্প্রভ, নিঃসঙ্গ। ২টা শালিক, ৪টা জলশরি ফুল, কিছুটা ভূত, অনেকটা ভবিষ্যৎ নিয়ে আসমানের তলায় আমরা প্রাচীন কোনও জমিদারির দিকে। অভিশপ্ত অঙ্গনে কয়টা ভেড়া, ইতিহাস বড় বলবান খাদ্য; কারও কেনার কিংবা কারও বেচার জন্য। হুটহাট বৃষ্টি; তুমি আমাকে রোদ আর ছায়া তো দেখালে, বৃষ্টি এসে পূর্ণ করল কোর্স। সফর জারি থাকে অনন্ত যমুনাবাহারে, দুনিয়ায় চড়ে বেড়ায় বিবিধ মানুষ ও হাঁস। তালশাঁসের মতো গোটা দিন মুখে পুরে দিয়ে আরও একটা রাত আসে, কিছুটা অচিন। মাটির চুলার চায়ের মতো মায়ালু অন্ধকার। ভাঙ্গা গরুর হাটের জোরদার গন্ধে কেটে যায় রাত। স্বপ্নের ছায়া এসে এই গরমে বাতাস করে তবু ভোরেলা রোদ বসে না থাকে। চলো চলো, রাস্তা ডাকছে। যা বাড়ি তাই তো সমাধি। বৃষ্টি এসে মুছে দেয় তোমার-আমার সব পার্থক্য; একাকার হয়ে গেলে আমার সফরই তো তোমার সফর! একটা বিদায় আর একটা স্বাগতের দরজা খুলে দেয় কিন্তু জানালায় হাত নেড়ে আমার সময়কে স্থির করে রাখি, সে কোন অস্থির আমি ?

…………………..

মুশাররাত

অধিকার

আকাশ তোমার, সবুজ তোমার

মাতাল করা হলুদের

সর্ষেফুলের বিস্তীর্ণ বাগান কিংবা গোধূলিতে

ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া দুরন্ত রেডপোল

সবই তোমার

আমারও তো তাই

নদী তোমার

দূর্বাদল, সুললিত সংগীত, সুরচিত চতুষ্পদী

আবুল হাসানের গদ্য কবিতায়

মাতামাতি ভালো লাগে আমার তোমারই মতো

মধ্যশীতে লতিয়ে পড়া যৌবনবতী

সিমের চমক আর বারান্দায় ক্ষুধার্ত

অর্কিডের সৌন্দর্যের উপহাস

সবই তোমাকে একচ্ছত্র ভালোবাসার আভাস

বন্দরে নোঙর করা বিরহী জাহাজের সুদেহী মাস্তুল

আর নগরের ঝলমলে রাতের নিষিদ্ধ কোলাহল

গ্যালাপাগোসের নীল সমুদ্রের পাড়ে

জানালায় ভোর হয়ে জাগে তোমার প্রথম সকাল

সবই তো তোমার

সবই তো আমার

তবে তোমাকে চাইবার নাই কেন

আমার অধিকার ?

………………………

সেঁজুতি বড়ুয়া

মা ও প্রকৃতি

মার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করো না

তোমার আত্মা, তোমাকে পাবে না

যে শেকড়ে আষ্টেপৃষ্টে রয়েছেন মা

তার ডালপালা কেটো না

স্তব্ধতায় ঢেকে যাবে, মহাপাপে

মার প্রতি পুষে রেখো না, ঘৃণা

অভুক্ত অজগর খেয়ে নিতে পারে

মা, তোমার নিয়তি অন্নপূর্ণা, স্বয়ং প্রকৃতি!

…………………..

ওবায়েদ আকাশ

একাকিত্ব, বৃষ্টি এবং প্রেমের কবিতা

হাসতে হাসতে তোমার নামে বৃষ্টির প্রসঙ্গ তুলেছি

রুপালি চিতলসন্ধ্যায় ঝরিয়েছি সাদাকালো কান্নার ধারা

এবার বৃষ্টির দেবতা ঘুমের ওপর পড়ে যেতে যেতে

তোমার দিকে আঙ্গুল বাড়িয়ে দিলেন―

তার ভবিষ্যৎজুড়ে এক চিরায়ত সংসারের ভেলা

                          কিনারা পেল বঙ্গোপসাগরে

সেই থেকে সাগরপাড়ে বেঁধেছি আমার অতীত ভবিষ্যৎ আর

নদীবর্তী মানুষের অনিবার্য ভাঙ্গনের লেখমালা

এখন সমুদ্রে প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস, বৃষ্টি ও উদগিরিত ফেনা―

তিমি মাছ গিলে খাচ্ছে সমগ্র নভোনীল সাগর আর

উগরে দিচ্ছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কী গভীর শূন্যতা তোমার ঢেউয়ের কঙ্কাল ধরে ঝুলছে―

তার ভিতর দাঁড়িয়ে আছো অবিচল তুমি, একা

তোমার একাকিত্ব নিয়ে মুখর করেছি এই বালুকাবেলা

………………….

সৈকত হাবিব

আত্মহত্যার আগে

আত্মহত্যার আগে, নিজেকে জন্ম দাও আবার

অন্তত সম্পন্ন করো নিজের পূর্ণাঙ্গ একটি পাঠ

আমরা কি এনেছি টেনে এই জীবন, পৃথিবীতে ?

তবু মৃত্যুর কেন এই সহাস্য-প্ররোচনা, হননের

                               এই বিপন্ন সঙ্গীত ?

দেয়নি জীবন কিছু, এই ভেবে জীবনের প্রতি

                              ঘৃণায়-বিবমিষায়

তাকে শাপশাপান্ত করে নিজেকে ধ্বংসের আগে

এসো, পুনর্বার নিজেকে পাঠের দিকে নিয়ে যাই

যদি পেয়ে যাই সোনাদানা উড়িয়ে কিছু ছাই!

……………….

ভাগ্যধন বড়ুয়া

নিঃসঙ্গ সন্ধ্যা

নিবন্ত লালাভ লেপন গোলীয় সীমারেখায় জানায়

আসন্ন রাতের কথা

কিছু কালো চিহ্ন ভালো করে কেড়ে নেয় আলো

অপসৃত আলোরেখার নিচে অন্ধকার

মুছে যাবে বর্ণিল আয়োজন, পাখির গান,

এমনকি বিদ্রƒপের কূটচাল!

দৈনিক ভাতা নিয়ে ফেরা মানুষেরা দ্রুত লয়ে হাঁটে সদাই খোঁজে…

দেরী হলে হবে না কেনা সপ্তাহের বাজার!

কিছুক্ষণ পর রাতের জগৎ; মদিরা মুহূর্তে মিনতি

বানানো প্রহরে গালিচায় হাঁটে মাধুরী মন

প্রহর গভীর হয়, গল্প জমে…

ঘোর লাগে ভোরের বাতাসে,

আহা! কতদিন দেখি না সাদা ভোর, জবালালে মোড়ানো সূর্য!

গ্রহণ কেটে যাক, বেশি বেশি ভোর নেবো শুভ্রতা জড়িয়ে…

……………………

রওনক আফরোজ

হবে না

অবশেষে কী হলো ?

আমি ছুটেছি তুমিও ছুটে চলো;

এক আলোকবর্ষ পরে জানলাম,

আমরা ছুটেছি বিপরীতে;

আমি সমুদ্রে তুমি মরুতে

আমি দিগন্তে তুমি অনন্তে।

উত্তর থেকে দক্ষিণে;

সমান্তরালে নাকি কোনাকুনি,

আমি জানি না, তুমিও কী বোঝনি ?

আমি মানচিত্র পড়তে পারি না,

আমি আবহাওয়ার খবর রাখি না,

তুমিও কি তাই, জানি না।

আমরা দুজনেই খুঁজেছি দুজনকে

ছুটেছি পরস্পরের কক্ষপথ লক্ষ করে,

আমাদের সাথে অদম্য আকাক্সক্ষা

একবার একসাথে নীহারিকা ছুঁয়ে দেখা

তারপরেও হয়নি,

আমাদের আর কোনওদিন

দেখা হলো না।

……………….

মতিন রায়হান

দৃশ্যশিকার

এসো, শিকার করি পথদৃশ্য

যৌথ হাতে তুলে নিই

                 তীক্ষè তির ও ধনুক

প্রথমেই গেঁথে ফেলি

        একটি শিউলিফোটা ভোর

তারপর হেমন্তের ধূপছায়া-সন্ধ্যা

শীত এলে পাতা ঝরে

সমুদ্র দেখায় তার নগ্ন শরীর

দৃশ্যকল্পে সাবানের ফেনা

         স্নানঘরে শাওয়ারের নিচে

            লেখা হয় উষ্ণ পঙ্ক্তিরাশি

যৌথভ্রমণে এমন দৃশ্যশিকার ভারি উপভোগ্য!

জানো তো পা বাড়ালেই

           সামনে এসে দাঁড়ায় পথ

পথ থেকে শিখে নাও পথের তত্ত্ব

যদি ভাবো, জীবন এক ছুটে চলা দীর্ঘ পথ

তাহলে এখানেই যতি টানো

             কমা কিংবা দাঁড়ি

প্রশ্ন তুলে একবার পেছনে তাকাও

আশ্চর্য!

কেউ বসে নেই

           ছুটছে সবাই

প্রতিদিন শিকার করছে ব্যক্তিগত স্মৃতি

এসো, তুমিও শিকার করো

          তোমার শৈশব

যেখানে রয়েছে রাশি রাশি জন্মস্মৃতি

স্মৃতিসরণিতে দৃশ্যশিকারের কোনো বিকল্প নেই!

…………………

মুস্তফা হাবীব

ঝরাপাতার ধূসর উপমা

যখন স্বেচ্ছাবিস্তৃত ঘন গভীর বনানীর ভেতর

একা আমি ঘাসের মখমল মাড়িয়ে সম্মুখে যাই

চোখ রাখি পাতায়, পাখির অকৃত্রিম গান শুনি

শুদ্ধ অক্সিজেনে প্রশান্ত মন, নিসর্গের মায়াটানে

এক লহমায় ভুলে যাই জনপদের জ্বালা-যন্ত্রণা।

যখন প্রখ্যাতজনের রেখে যাওয়া ঐতিহ্য দর্শনে

নিবেদিত, সোনার তরী ভাসাই পদ্মার জলে

ডাকে আমাকে ধানসিড়ি―কপোতাক্ষ নদ,

সংসারবিরাগী কবি-শিল্পীর আদুল ফোটে মননে

মুহূর্তেই ভুলে যাই গন্ধময় শহরের দুঃসহ লীলাচিত্র

সংগোপনে পাঠ করি তাদের জীবনের ইতিহাস।

যখন সবুজাভ দিক-দিগন্ত ছেড়ে আপন খেয়ালে

স্বপ্নবিধৌত চোখ মেলে দেই সমুদ্রের নীল জলে

শো শো শব্দের পরম ঐকতান আমাকে উদাস করে

মনে হয় সমুদ্রই আমার একমাত্র শেষ ঠিকানা

অতীত জীবন অসার, ঝরাপাতার ধূসর উপমা।

………………..

শিহাব শাহরিয়ার

চলো নদী হই

সুলিখিনি

চলো নদী হই

নদ ও নদীর মতো হই

দেখো, শহর মরে যাচ্ছে

নদী না হলে আমরাও মরে যাব

শহরের ছাদে উড়ছে বেলুনের কান

চলো আমরা তার দ্বিগুণ গতিতে ভেসে উঠি

লাউয়ের সবুজ পাতার মতো তাজা হয়ে উঠি

চলো হরিণডাঙার কাছে যাই

চলো জীবনকে নাড়াচাড়া করি

চলো হাতের পিঠে নিঃশ্বাস ফুটাই

অথবা বুড়ো হয়ে চলে যাবার আগেই

চলো ভালোবেসে যেতে যেতে মরে যাই পথেই

আমাদের মৃত্যু যেন নদীর মতো হয়

মৃত নদীর পিঠে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসী যেন বলে :

‘আহা এখানে একটি পুরুষ, একটি নারী ও একটি নদী ছিল’

সুলিখিনি ?

আমরা তো বিরান বাড়ির আত্মাকে ছুঁয়েছি

চলো এখন জিহ্বা দিয়ে ছুঁয়ে দিই

মৃত নদীর হিমায়িত ঠোঁট

চলো নদী হই…

………………….

জাফর সাদেক

হীরের শ্রমিক

ভেবে দেখো এই হীরক-প্রবাহ―ওপরে স্বচ্ছ ও সুন্দর

হীরে কিন্তু দীর্ঘক্ষণ ওষ্ঠে নিতে জানলে

পেয়ে যেতে পারো হননপ্রিয় শয্যায়

জীবস্মৃত হবার এক গুপ্ত জগৎ

আমিই আমার মতো করে দিতে পারি

বিষপ্রিয় অবগাহন এবং বিষ-নৃত্যের নিঃস্ব ভোর

নেবার কেউ নেই―রাতের অঙ্গীকার রেখায়

অথচ এই উন্মূল প্রবাহ মিড়খনির সন্ধান দিতে প্রস্তুত

গ্রহণ করো চির-অবচেতন হবার এই ওষ্ঠ-তরল

হীরের নাকফুলের দৃষ্টিতে

হননের নিষ্পাপ বিষ থাকে গোপন

আমিও পিঁপড়ের চলনবলন দেখে

শীতভাষা শিখেছি বলেই

পৌষের গোধূলিতে তোমার শিশির-শরীর

আজও সন্ধের খনিতে যাপিত হীরের শ্রমিক

……………….

মারুফ রায়হান

মৃত লোকটার প্রেমিকা

ও স্যামুয়েল বেকেট

এক মৃত ব্যক্তির প্রেমিকাকে আমি ভালোবাসি।

হ কইসে। তুই মরা বুড়ার ইয়াং ডার্লিংয়ের লগে পিরিত করস।

আমি যাকে ভালোবাসি সে ১০ বছর আচ্ছন্ন হয়ে আছে মৃতের প্রেমে।

হ। এইডা জাইনাও তার প্রেমে তুই দিওয়ানা। নিজের বউডারে তুই ছোঁস না।

―এ কয়টি সংলাপ লিখে আজকের স্যামুয়েল বেকেট পানপাত্রে ঢালেন সুরা; ভাবেন,

নিজের ভবিষ্যৎই কি দেখতে পেলেন!

তারপর আরও ভাবলেন মৃত্যু, বয়স এবং নর-নারীর সম্পর্ক নিয়ে।

মৃত্যু : মানে শারীরিক অনুপস্থিতি; যুগলের জীবিতজনের যতক্ষণ না

প্রয়াণ হচ্ছে, মৃত ততক্ষণ কি সম্পূর্ণ মৃত ?

বয়স : প্রস্থানের নির্ধারিত বয়স নেই, যেমন প্রেমের।

শরীরী ক্রিয়ায় দেহের বয়স জরুরি, অচল এ নিয়ম মনের বেলায়।

নর-নারীর সম্পর্ক : এ বিষয়ে কোনও অভিধান বা সংবিধান নেই

প্রতিটি সম্পর্কই রচনা করে নতুন সত্য, জুটির অজান্তেই।

যা জানে কেবল সাচ্চা কবি ও দার্শনিক, এবং স্বয়ং বেকেট।

………………

শাহীন রেজা

তোমাকে পড়িনি আমি

তোমাকে পড়িনি আমি;

অথচ রোজ দেখো দেয়ালের লেখা পড়ি,

চোখ বুলাই প্রিয় পত্রিকায়―

বারান্দায় উঁকি দেওয়া পাখিটার চোখের ভাষা

একান্তে করি পাঠ কী মুগ্ধতায়

জানি তুমি দুঃখ পাবে

অথচ সত্য এটাই―

বাতির নিচের কালো সহজে পড়ে না চোখে,

দূরে দেখা চশমায় কাছের দৃশ্যগুলো

ঝাপসা কেমন;

অগ্রসর নদীগুলো থেমে যায় পানিশূন্যতায়―

তোমাকে পড়িনি আমি এ আমার পাপ,

অদৃশ্য করাতে কাটে মৌনতার তাপ

নদীকে পড়তে হলে যে লেন্স লাগে

নারীকে পড়ার জন্য তারও বেশি কি ?

………………….

জুয়েল মাজহার

রান্নার নতুন রেসিপি

হু-হু শীতে রোদে নয়, আমি বসি শীত-গালিচায়

ফুলকি ছিটিয়ে জলে গা ধুই আগুনে

মওকা যদি মিলে যায়

কল্পমাছ ধরে আনি অচিন পুকুরে জাল ফেলে

জানি, সকলেরই পুরনো রান্নায় খুব অরুচি ধরেছে

রন্ধনপ্রণালি তাই লিখে দিচ্ছি নতুন ভাষায়

ভিক্ষে করে আনা আর নিজ হাতে বানানো মশলায়

রাঁধতে বসেছি মাছ বরফের অল্প আঁচ দিয়ে

আশা করি―

নবীন রাক্ষসগণ কবজি ডুবিয়ে খেয়ে তুলবে ঢেঁকুর

হৈ-হৈ রাজার সমীপে গিয়ে তারা বলবে :

পুরনো ভাষার রাজা, হয়েছ জরদ্গব ঢের

এইবার সিংহাসন ছাড়ো

 শিশুরা শালদুধ খেয়ে মালজোড়া গান গাইবে তোমার প্রাসাদে

…………………..

রেজাউদ্দিন স্টালিন

অস্বীকার করি না

অস্বীকার করি না

এই মৃত্যুমথিত বাংলায় আমার জন্ম

আর্তনাদ আর নৈঃশব্দ্যে স্তম্ভিত

 পদক্ষেপ নিষিদ্ধ যেখানে

হত্যা আর অপমানে কাঁপছে সূর্য

সূচনা ও সমাপ্তির ক্রুশ বহনের শক্তি কারও নেই

স্তূপীকৃত কান্না জমা হচ্ছে চৌকাঠে

আমি পাশ ফিরে দাঁড়াই আর উপেক্ষা 

করি অবৈধ প্রজ্ঞাপন

ধীরে অহংকারের অগ্নিশিখা প্রোজ্জ্বল হোক

কারা জলকামান দিয়ে মুছে দেবে পদশব্দ

শ্বাসরুদ্ধ করবে নদীর কলস্বর 

জলকামান আমার ভাই

টিয়ারশেল আমার বোন

রাবার বুলেট খেলার সাথী

ওদের লেলিয়ে দিয়ে কী লাভ

সব নাটকের শেষ আছে

কিন্তু সংলাপের নেই

হোরেশিয়োর প্রতি হ্যামলেটের

প্রশ্ন অন্তহীন 

ঘরেফেরা প্রতিটি ক্ষুধার্ত প্রাণি বাঘ

তল্লাশি চালানো প্রতিটি বাড়ির ছাদ

ভয়ার্ত পাখি

সিসিফাসের অদৃশ্য পাথরের

 জিজ্ঞাসায় জর্জরিত সময়

নিজেকে বাঁধতে চায় যে মাটির মাস্তুলে

লহমায় বুক থেকে ছিঁড়ে আনে নিজের চামড়া

 জাদুবলে দুনিয়ার বই থেকে

মুছে দেয় বর্বর ট্যাঙ্ক

খুলে ফেলে সংসদের গোপন কুঠরি

পৃথিবীর শুরুর দিনগুলোর মতো সুন্দর ও পবিত্র তার স্বপ্ন

বিশ্বাসঘাতকদের বয়ান কার ভালো লাগে

কে দেখতে চায় বজ্রনিরোধকের মাথায় বিদেশি পতাকা

কে শুনতে চায় সেলাই করা ঠোঁটের গান

আমাদের খুঁজে বের করতে হবে

ডাইনিদের স্তনের মাঝে লুকানো চাবি

সব মিথের খোলস খুলে ফেলতে হবে

অর্থহীন অনুপ্রাস ভরা ব্যর্থ কবিতা

সন্তান না ফেরার অনিশ্চিত অপেক্ষা

উপনিবেশের রূপকথায় ডুবে থাকা রাষ্ট্রযন্ত্র

আর পাচার গুম খুন ধর্ষণের

কর্ণধার-সাইবার ক্রাইম

আইসিটি অ্যাক্ট কালাকানুনে নিমজ্জিত কণ্ঠস্বর

উন্নয়নের চমক কাগজের ঘণ্টা

অস্বীকার করি না

অন্ধকারের আগুনে অবগুণ্ঠিত মাতৃভূমি

তার সব জানালার তলদেশে রক্তনদী

তার দরোজায় মরুভূর প্রতিধ্বনি

কিন্তু আমার প্রতিহিংসা ভালোবাসার বজ্র দিয়ে ঠাসা 

আমি জানি যুদ্ধক্ষেত্রে রক্তের চেয়ে পানি মূল্যবান

আর বিজয়ের জন্য

প্রাগৈতিহাসিক পাসওয়ার্ড

…………………

ওমর কায়সার

বৈশাখ ও এপ্রিল

আরক্তিম ম্যাপলের নিচে ঝরে ঝরে গেছে

কত-শত বসন্তের ভুল

অনন্ত চেরির পাশে অগোচরে হেসে ওঠে

দু-একটি মনসার ফুল।

বৈশাখ ঘুমিয়ে আছে শীতল চিঠির মতো

অভিনব এপ্রিলের খামে

কিছুটা অক্ষর তার দাবদাহে পুড়ে গেছে

বাকিটুকু ভিজে গেছে ঘামে।

ফিরে এসো, ফিরে এসো উঠানে ও ঘরে

বৃষ্টি তুমি আছ কত দূরে

ঘুঘুর কান্নার মতো কেউ কেউ গান করে

বাঁশঝাড়ে অলস দুপুরে ।

তৃষ্ণাগুলো গান হবে বলে কেঁদে কেঁদে মরে

বোবা কোনও আমলকীর বনে

তার সুর অলৌকিক তরঙ্গ তুলেছে

সকালের ঠান্ডা হাডসনে।

…………………

তমিজ উদ্দীন লোদী

বাড়ি

আমার পায়ের কাছে এসে থেমে গেল একটি হলুদ হৃদয় আর তার উপর দুলতে থাকা একটি বলয়।

সেই হৃদয় নিয়ে আমরা কি কথা বলেছিলাম তা আমার মনে নেই, কেবল তার অনেকগুলি ধমনী

নিয়ে কয়েক মিনিটের গলদঘর্ম ।

এবং আলোচনায় ছিল সূর্যের ঔজ্জ্বল্য এবং অন্য একটি বাড়ির স্মৃতি, যেখানে আমরা দুজনেই

গৃহস্বামীর পানের নিঃশব্দ ভয়ে সিঁটিয়ে ছিলাম। আমি খুব কমই বাড়িটির বারান্দার ধাপ 

চিনতে পারলাম এবং সামনের দরজায় নিরলস হাঁটার পথ।

দুর্ভাগ্য তখন এবং সর্বদা, এবং আমরা বাড়িটি দেখতে পেলাম, ছিন্নভিন্ন ভ্রমণকারীর হাতের

তালুতে ঢাকা, কিংবা সন্ধ্যার বাতাসের ভেজা চাদরে আবৃত। বাড়িটি ক্রমশ দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে।

অবসৃত হতে হতে কুয়াশার আড়ালে অন্তর্হিত হলো।

……………….

কামরুল হাসান

বিভ্রমের পুনর্লিখন

প্রাথমিক খসড়া

ডানা ঝাপটিয়ে কাছে আসা নদী

তোকে দেখে লুপ্ত সাঁতার ভুলেছি।

পূর্ণিমায় সে কি পড়েছিল সাদা শাড়ি,

সিল্ক, না কি ছিল পূর্ণ নিরাভরণই ?

পরি কিংবা পরি নয় বলে প্রতিভাত হলো।

পুনর্লিখন

সাঁতরে সাঁতরে কাছে আসা নদী

পাড়ি দিতে ডানা নিয়ে তৈরি হয়েছি।

চরাচরে প্রতিভাত হলো এক নারী

সিল্কে বা সাটিনে নয়, পূর্ণিমায় মোড়া।

পুনর্লিখনের পর

ভাঁজ করা ঢেউসমগ্র নিয়ে নদী আজ স্তব্ধশোকগাথা,

পরিরা প্রভাতের নয়, অন্ধকারে খসে-পড়া ডানা।

……………..

মাহমুদ কামাল

আড়াল প্রকাশ্য নয়

যে আড়াল পেছনে থাকে

তাকে প্রকাশ করে দিলে

হতাশা ও গ্লানি

আড়ালকেই ঘৃণা চোখে দেখে।

আড়াল প্রকাশ্য নয়

প্রকাশিত ঘৃণার চেয়ে

আড়ালের সামাজিকতা

গোপনের মাদকতা নিয়ে

যার যার সমীহ সমীপে

নির্ধারিত থাকুক হৃদয়ে।

…………………..

গোলাম কিবরিয়া পিনু

মূর্খতার মূর্ছনা নিয়ে মূর্ছা যাই 

ছাড় দিতে দিতে

      গ্রহণ করতে করতে

          নিজের নিজস্বতা থাকছে না!

নদীও উদারতায় উন্মুক্ত হয়ে থাকলে

ইঞ্জিনের তেল

    কারখানার বর্জ্য

আর বিষাক্ত রাসায়নিক ক্রোমিয়ামে

নদী তার স্বচ্ছজল হারিয়ে চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়বে!

মিলমিশ আর সংসর্গ নিয়ে কত বর্গে থাকা যায় ?

মাখামাখি ঢলাঢলি করে

     নিজের বৈশিষ্ট্য কতটুকু রক্ষা করা যায় ?

মিলনপ্রয়াসী হয়ে কোন মিলনায়তনে প্রবেশ করছি ?

                     মিলনপ্রত্যাশী কারা ?

রাহুমুক্ত হব ? নাকি পূর্ণগ্রাসে চলে যাব ?

হরিহর আত্মা হতে গিয়ে

     নিজের আত্মা পুরো ধ্বংস করা সমীচীন ?

চীন থেকে কনফুসিয়াসও এমন বাতিকগ্রস্ত হতে

              ―বারবার নিষেধ করেছে!

তার চেয়ে অন্তর্মুখী হই!

স্বেচ্ছা নির্বাসনে যাই তিব্বতে! দালাইলামার মতো!

মূলনীতি আর মূলজ্ঞান লুপ্ত হলে

              মূলভূমি হারিয়ে ফেলব!

অবশেষে মূর্খতার মূর্ছনা নিয়ে মূর্ছা যাব

                        ―গোঙাতে গোঙাতে!

…………………

সোহরাব পাশা

ভালোবাসার প্রিয়ভাষা

প্রিয়দিন অন্যদিন

গতকাল,

ভালোবাসা পুরনো ছেঁড়া চিঠির মলিন অক্ষর

শূন্যতা আক্রান্ত স্বপ্নভাষা;

রৌদ্রগুলি লোকালয় ছেড়ে চলে গেছে

পাগুলি অন্যমুখি জন্মান্ধ কুয়াশার

হলুদ পাঁজরে―

ওইখানে বধ্যভূমি ছিল

বিভ্রান্ত সময় শুধু ঋতু ফিরে আসে

বসন্ত ফেরে না,

কৃষ্ণচূড়া লাল হয়েছে কি ?

অরক্ষিত শহিদ মিনারে একটা কুকুর মরে

আছে―

কী যে তীব্র কুহক অশ্লীল কোলাহল

দ্রুত সরে যাচ্ছে মাথা উঁচু করা মানুষের ছায়া,

দূরে-বহু দূরে অবিশ্বাসের তিমিরে উড়ছে কোথাও

তোমার অবিশ্বাসের ঘ্রাণ;

নিচে অসুস্থ ক্লান্ত পৃথিবী। তুমি কী নিদ্রিত নাকি

ভীষণ অস্থির খুব নিদ্রাহীনতায়―

কেউ কি ক্ষিপ্র খুঁজে ফিরছে ফাগুনের উন্মাদনা

বুনো আগুন দুপুর!

‘আমি দ্বিতীয় কাউকে

না-জ্বালিয়ে একা-একা জ্বলতে পেরেছি

সেই ভালো।’

…………………

জাহিদ হায়দার

চিরদিনের অতিথি

‘হাল-ভাঙা পাল-ছেঁড়া ব্যথা চলেছে নিরুদ্দেশে।’

                : পূজাপর্ব (৬১৫) : গীতবিতান : রবীন্দ্রনাথ             

নদী, সমুদ্র, বনভূমি

আর পৃথিবী ও আকাশের সব খাদ সমতল পার হয়ে এসে

                ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, না-ঘুমানো ব্যথা

                আমার ভিতরে দেশ

                                আর পিপাসার শান্তিপ্রিয় জল খুঁজে পেল।

অতিথি উত্তম, বিনয়ী, প্রসঙ্গে স্মিতহাস্যময়।

বারান্দায় বাগান করছে। প্রেম না পাওয়া মানুষের মতো

ফুলের জন্মকষ্ট আর ঝরে পড়বার ইতিহাস বলতে পারে।  

প্রতিদিন হয়ে উঠছে নিজেকে পার হয়ে যাওয়া নতুন আনন্দ।

পাঠ নিচ্ছে নতুন নতুন সামাজিক প্রথার।

সুন্দরের আবর্জনা সরাতে সরাতে বোঝে,

একদা ছিল রজনীগন্ধা।

কৃত্রিম বুদ্ধির ব্যথার সৌন্দর্য না থাকা নিয়ে চিন্তিত।

ব্র্যান্ডের পোশাক পরে।

লাল ও শাদা দুটো সেলফোনে তরঙ্গ সারাক্ষণ।

প্রশ্ন করে, ‘কাপড় পরা ও নগ্ন শরীরের পার্থক্য কোথায় ?’    

উপায় ছিল না, হতে হয়েছে কনজুমার সোসাইটির সদস্য। 

ভাজা মাংস সহযোগে একা মদ্যপান করে। মাতলামি নেই।

ঘুম এক সভ্যতাবিরোধী কাজ, বলেছে আমাকে।

প্রেমে অক্লান্ত।  

মানসশূন্যতায় পাপড়ি ঝরায়।

প্রিয় পশু ডোরাকাটা বাঘ। পাখি কাকাতুয়া।

হরিণের আহ্লাদ অপছন্দ।

ঘরে যখন বেহালা বাজে

নক্ষত্র-পতনের আলোয়

                কোনো এক দূরতর ছায়া চোখেমুখে পড়ে।

ব্যথাও কি ব্যথিত কোনও এক হারানো বন্ধনে ?

আকারে ইঙ্গিতে বারবার বোঝাই,

কবে কোন মহাদেশে

                অথবা চাঁদের দিকে পর্যটনে যাবে ?

                হিমালয়ের শীর্ষ-শূন্যতার কষ্ট তোমার সঙ্গ চায়।

মনে মনে বলি, তুষারপাতে যদি চিরদিনের বরফ হয়ে যায়।

মানবের স্বরে বলে, ‘তোমাকে একলা ফেলে কোন পরবাসে যাব ?’

ব্যথাও সঙ্গ চায় পেতে ভালোবাসা।

…………………

মোহন রায়হান

ও জল ও তৃষ্ণা

দু চোখে আমার তৃষ্ণা অথচ সমুদ্র বহুদূর

তৃষ্ণার খুব ভেতরে রয়েছে একটি লাল গোলাপ

বহুদিন থেকে তাকে আমি শুধু চুম্বন দেব বলে

বিশুষ্ক করে রেখেছি ঠোঁটের নিজস্ব আগ্রহ

সাহারা মরুর মতো দুই চোখ সে চোখের ভিনদেশে

খেলা করে শুধু ধু ধু মরীচিকা মায়া আর বিভ্রম

আর আমি সেই ভুলের মাটিতে রেখে আসি স্বপ্নকে

বিনীত কাতর মানুষের মতো ছুটে যাই বারবার

একদিন এই পোড়াজমি আর শ্মশান পেরুতে হবে

দূর মরীচিকা পাড়ি দিতে হবে জাহাজের মতো একা।

……………….

দিলারা হাফিজ

কে আমাকে ঠেকায় ?

আমার পাখিরাত যায়—উড়ে-পুড়ে, বিজয়ের নেশায়!

দু চোখে জ্বলে তারাবাতি, লাল-সবুজের ভ্রƒপল্লবে…

আমি তবু দূরগামী, চলে যাই হাঁটু জোড়ায় থুতনি রেখে

বিশ্বময় তেড়ে আসা যুদ্ধের খচখচানি চাই না আর!

চাই শান্তি, চাই সৌহার্দ্য—সোনালি ভোরের উন্মাদনা!

চাই স্বাধীনতা-মুক্তি শেষে জেগে ওঠা নতুন পৃথিবী!

এ দেশ আমারও! সর্বংসহা এক মানবতরী—আমিও,

এ দেশের একমুঠো ধুলিবালি জন্ম দিয়েছে আমাকে

আমার অন্তরাত্মা থেকে জন্ম নিয়েছে এ দেশ ও জাতি

আমিও অধিকার রাখি কিছু বলবার—

শৈশবে ভেবেছি বায়োলজিক্যালি যে দুজন

জন্ম দিয়েছে আমাকে—আমি শুধু সেই বাবা-মায়ের সন্তান!

নাহ, মোটে তা নয়!

আমি এ দেশের হাজার-কোটি প্রেমজ-সন্তানের একজন

আমি কবি, এই পৃথিবীর সুপেয় জলের সন্তান

রক্তস্নাত এই স্বাধীন বাংলাদেশ ও বঙ্গের সন্তান

কে ঠেকায় আমাকে আজ ?

……………….

হাসান হাফিজ

আবেগের ছিটেফোঁটা

ক.                                  

ছি ছি

কেন মিছেমিছি

ভালোবাসলে ? ভালো

চাদ্দিকে নিভেছে সব আলো

দাগা দুঃখ সার

অনন্ত আন্ধার

খ.

ভালোবাসা, অন্ধতা ও ভুল

অনুরাগে সিক্ত হওয়া শুকানো বকুল।

গ.

সূর্য ডুবে যায়

আকাক্সক্ষা মরে না।

কাম ক্রোধ রিপুর চাহিদা

ওরাও অমর!

ঘ.

যে গিয়েছে ভুলে

তাকে ফের মনে করা কেন ?

ঙ.

দূরবর্তিনীর ঢেউ খোলাচুল

কবিকে পোড়ায়

শুকায় না ক্ষত, তৃষ্ণা বেড়ে যায়।

……………….

নাসরীন নঈম

ফিরে যাওয়া কষ্টের

সাদা কাগজ নিয়ে বসে আছি

বাইরে নিঝুম বৃষ্টি।

ইচ্ছে হচ্ছে ছাদে উঠি

নয়তো সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাই

সেই পুরনো গলিতে যেখানে

প্রথম তোমার সাথে দেখা হয়েছিল

কাঁঠালচাঁপার ঝাকড়া গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে

ছটফট করছিলাম ঘড়ির দিকে চেয়ে।

একই ভঙ্গিতে কতক্ষণ থাকা যায়

শুধু চোখে চোখে উৎসুক প্রশ্ন

কাঠখোদাইয়ের মতো বিচিত্র ক্যানভাস

দুজনের চোখে ছিল।

কেটে গেছে দু বছর

এখন ভাবছি মহাভুল হয়েছিল

বড় বেশি বেশি ভেবেছিলাম

এভাবে অতিথি হয়ে কারও জীবনে

থাকা যায় না, তাই ফিরে যাই।

ফিরতে গিয়ে ক্লান্তি ছিল, বৃষ্টি ছিল না।

……………..

মঈনউদ্দিন মুনশী 

সৃষ্টি

মানুষের সৃষ্টি ঈশ্বরের প্রতিবিম্ব রূপে―

যা বদলে যায়, যেমন আলো বদলে যায়; সকালের সূর্য হয়ে যায়

দুপুরের সূর্য, তারপর বিকেলের সূর্য হয়ে যায় রাতের…

ঈশ্বরের অনুরূপ হওয়ার অর্থ আলোর মতো প্রোজ্জ্বল হওয়া;

যেমন করে গাছপালা বা সমুদ্র হয়ে ওঠে সূর্যালোকের মতো যখন

আলো এসবের ভেতরে প্রবাহিত হয়।

ঈশ্বরের অনুরূপ হতে বৃক্ষের কেয়ারির ভিতরে অথবা সমুদ্রের তলদেশে

স্থিত হতে হয় যখন আলো এসব ভেদ করে যায়।

মানুষ যখন আবির্ভূত হয়, স্বর্গদূতগণ তাঁর সাথে নিজেদের কোনও

সাদৃশ্য দেখেনি, জলে তাঁদের ছায়ায় কোনও অনুরূপতা ছিল না,

তাঁদের স্বর, মেঘে মেঘে হাসি এবং চিৎকার ভিন্ন রকম শুনিয়েছে…

স্বর্গদূতগণ যখন মানুষকে স্বর্গ থেকে ঠেলে ফেলে দিল ঈশ্বর

তঁদেরকে কিছু বলেননি। স্বর্গদূতগণ সূর্যকে ভাবলো ঈশ্বরের চোখ,

যদিও তাঁরা নিশ্চিত অনুভব করেছিল যে ঈশ্বরের কোনও চোখ নেই,

শরীর নেই, কণ্ঠস্বর নেই, যাতে করে সে তাঁদেরকে নির্দেশ দিতে পারে।

তাঁরা দেখল, বিশাল এক অরণ্যের ভিতরে মানুষের দল বৃক্ষ কেটে

তাঁদের শিবিরে নিয়ে গেল, তাঁরা বৃক্ষ খণ্ড খণ্ড করে তাতে

ঈশ্বরকে খোদাই করলো; তার দীপ্ত মুখ, চোখ ও শরীর এঁকে দিল;

অতঃপর, তাঁরা তার সামনে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করল।

স্বর্গদূতগণ দেখল, মানুষগুলো যেন ছোট শিশু, অনুকরণ করছে

নর্তকীদেরকে, নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ভুলে নতজানু হচ্ছে নর্তকীদের মতো!

…………………

শিহাব সরকার

সুখের বসতে অবশেষে

ঘর বেঁধে যাযাবর খোঁজে উঠানের মায়া

বেদেদল নদী খোঁজে, নদী কই, পানি কই

পাড়ে বাঁধা নাও সারি সারি, তুফানে গিয়েছে ছই

বর্গীরা দল বেঁধে লুটিছে নারীর ছায়া ও কায়া।

বালকদল জলপিপাসায় কেঁদে আকুল

নারীরা স্বপ্নে দেখে বৃষ্টিভেজা মালতী ফুল।

মাঠ বরাবর ফাটা পথে হেঁটে আসে কারা ?

এবারেও আসমানে মেঘ, উড়ে যায় তারপর

ধানশস্য পোড়ে, মাইল মাইল ধেয়ে আসে ধূলিঝড়

দূর-বিদেশে বর্ষার বন্যায় প্লাবনে ডোবে গ্রাম।

খরা তো বাহানা, মরুতুফান গর্জন করে

ভুখামিছিলে খুনোখুনি, পথভ্রষ্ট গেরিলা

নারীদের টেনে নেয় তাঁবুর ভিতর,

মরুর মরীচিকায় ঘরের আভাস নড়েচড়ে।

ঐ দ্যাখো, মাটিলেপা ঘরের সারি গ্রামের কিনারে

বেদেপল্লীর রূপসী গানে গানে ধান ঝাড়ে,

সুখের বসতে অবশেষে একদিন পোড়া লাগে

মায়াবি বিকেলেও ঈশানের দৈত্যরা জাগে।

……………….

নাসির আহমেদ

আবহাওয়ার খণ্ডচিত্র

আকাশের রং দেখো কেমন বিকট!

ভয়াবহ মেঘ জমে আছে কুণ্ডলী পাকিয়ে

এই মেঘে কোনওদিন হবে না সামান্য বৃষ্টি,

যেন হিরোশিমা-নাগাসাকির আকাশ!

কালো আগুনের লাভা কুণ্ডলী পাকানো

নেমে আসে ওই দেখো!

নামছে নিচের দিকে―

যেখানে সবুজ আর জলের কল্লোলময় নদী।

এ আগুনে পুড়বে সবুজ নদী আর

ঝাঁক ঝাঁক জেলেনৌকো দরিদ্র মাঝির।

………………

রবীন্দ্র গোপ

মাধবীলতা

আমার চারপাশে হঠাৎ অন্ধকার চিৎকার করে উঠল

সিঁড়ির বাল্বটি কোন অভিমানে বুকের পাঁজর ছিঁড়ে

নিভিয়ে দিয়েছে আলো। সবকিছু আমার আলোকিত ছিল, ধীরে ধীরে নিভে গেল মাধবী ছাড়া হঠাৎ আলোকিত পৃথিবী আমার সবই ঝাপসা

সবকিছু অন্ধকারে কাটল সাঁতার।

চায়ের পেয়ালায় অনেক দিন ধোঁয়া ওঠেনি

অনেক দিন আমার পকেটে সুগন্ধি রুমাল সুবাস

ছড়ায়নি, অনেক দিন আমার বাড়ি ফেরার বিলম্বে

ঘন ঘন ফোন বেজে ওঠে না

কেউই আর বলেনি বাড়ি ফেরার আর কত দেরি।

জুতার পেটে ঘাম ভেজা মোজাগুলো দুর্গন্ধ ছড়ায়

একান্ত ব্যক্তিগত পোশাক-আশাক

অবহেলায় বিমর্ষ মলিন মুখে কাঁদতে থাকে

মাধবী ছাড়া একটি সংসার আর্তনাদে ফেটে পড়ে।

হাসপাতালে সাদা বিছানায় মাধবীকে বড় বেশি

বেমানান লাগে। এত বড় ঘর-সংসার ফেলে

মাধবী কি এভাবে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে শুয়ে থাকতে পারে, মাধবী মাধবী বলে ডেকে ওঠে আমার প্রিয় ময়না পাখিটি। কেঁদে কেঁদে কথা বলে হীরামন পাখি।

শেলফে সাজানো রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুনীল, শক্তি আরও কত বিশ্বজয়ী লেখক চুপচাপ পাশাপাশি

মাধবী ছাড়া একটি সংসার নির্জীব নিথর নিস্তব্ধতা

গভীর রাতে কে যেন আমাকে আজও ডাকে।

……………….

মাহবুব বারী

নারী

আমাকে ভোলাতে চায় নারী, রূপে লাবণ্যে।

ভুলি কিন্তু ভুলি না, তবু তার

সমস্ত অপরূপ দিয়ে ডাকে, যেন আমি

তার চরণের নিচে ঘাসের মতো জন্ম নিই,

মৃত্যুবরণ করি, আবার জন্ম নিতে থাকি…

কিন্তু আমি যাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি

তাকে, প্রতিদিন কল্পনায়, আমি নিজেই রচনা করি।

আর একজন আছে যার জন্ম এখনও হয়নি।

………………

আবিদ আনোয়ার

‘আমাদের ছোট নদী’

বলা চলে বর্ষাকালে প্রথমত নিজেকেই খায়!

কে ডাকে ‘অমুক’ নামে যখন সে দু পারে ছড়ায় ?

ধীরে-ধীরে খায় মাঠ, গেরামের ব্যস্ততম হাট,

বন-উপবন খায়, লবি-লন-সিঁড়ি খেয়ে

         শহরেও চালায় লোপাট!

আমাদের ছোট নদী তরল সন্ত্রাসী!

যেন এক সাহসী তস্কর :

প্রকাশ্যে দখলে নেয়

ফসলের জমি থেকে বসতের ঘর;

স্বভাবেই সর্বভুক :

এ যেন জটিল কোনও ক্ষুধার অসুখ :

এতটাই বেশরম :

অকাতরে খেয়ে ফেলে বানভাসি নারীর সম্ভ্রম। 

অথচ বৈশাখে দেখি আজ তার হাঁটুজলও নেই―

শুনি তার ন্যায্য হিসসা জমা থাকে দূর উজানেই!

………………..

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button