অনুবাদ সাক্ষাৎকার : রহস্য, ভাষা ও সীমা ছাড়িয়ে লেখার অন্বেষণ

ফরাসি সাহিত্যিক অ্যান সেয়ার সঙ্গে আলাপচারিতায় নিনা লেজার
বাংলা অনুবাদ : রিটন খান
[অ্যান সেয়া একজন বিশিষ্ট ফরাসি ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার, যিনি ১৯৬০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, ফ্রান্সের বোর্দোতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং ম্যাডাম ড’অলনোয়ের রূপকথার উপর একটি গবেষণাপত্র সম্পন্ন করেন। তাঁর সাহিত্যিক যাত্রা শুরু হয় ১৯৯২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস খবং Les Gouvernantes (দ্য গভর্নেসেস) দিয়ে। এরপর তিনি এক ডজনেরও বেশি উপন্যাস, ছোটগল্প এবং প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখাগুলো প্রায়ই জাদুবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করে এবং সাহিত্যিক ঘরানার সীমানাকে অনুসন্ধান করে।অ্যান সেয়ার বেশ কিছু সাহিত্যকর্ম ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং মার্ক হাচিনসন কর্তৃক নিউ ডিরেকশনস থেকে প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য ইংরেজি অনুবাদের মধ্যে রয়েছে : The Governesses (2018), The Fool and Other Moral Tales (2019), The Beginners (2021), A Leopard-Skin Hat (2023)
তাঁর রচনাশৈলীর জন্য তিনি সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। ২০২০ সালে তাঁর ছোটগল্প সংকলন Au cœur dÕun été tout en or এর জন্য তিনি Prix Goncourt de la Nouvelle পুরস্কারে ভূষিত হন।
অ্যান সেয়া বর্তমানে প্যারিসে বসবাস করছেন এবং আধুনিক ফরাসি সাহিত্যে অবদানের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত।
এখানে রইল দ্য হোয়াইট রিভিউ-এ প্রকাশিত ফরাসি সাহিত্যিক অ্যান সেয়ার সাক্ষাৎকার।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিনা লেজার। সময় নভেম্বর, ২০২০]
প্যারিসের একটি বইয়ের দোকানের তাকে অ্যান সেয়াকে প্রথম আবিষ্কার করি। তাঁর বইটি ছিল বেশ পাতলা এবং সোনালি হলুদের মলাটে মোড়া, শিরোনাম―Petite table, sois mise!!―যা ছিল একই সঙ্গে রহস্যময় ও কাব্যিক। বইটির প্রথম লাইন : ‘প্রথমবার আমি আমার বাবাকে মেয়েদের পোশাকে দেখেছিলাম, তখন আমার বয়স ছিল সাত।’ (বইটি ইংরেজিতে The Wishing Table নামে অনূদিত)। এই বাক্যটি যেমন বিস্ময় জাগিয়েছিল, বইটি পড়তে গিয়ে তেমনই রহস্য আরও গভীরতর হয়েছিল। পারিবারিক, ইরোটিক এবং আনন্দময় দৃশ্যাবলি এমনভাবে মিশে ছিল যা দৈনন্দিন বাস্তবতায় কল্পনাতীত। কিন্তু অ্যান সেয়া তাঁর অসাধারণ কবিত্বময় ভাষা ও সৃজনশীল স্বাধীনতার মাধ্যমে দেখালেন যে সাহিত্য এমন জিনিসকে একত্র করতে পারে, যা আমাদের সাধারণ জীবন আলাদা করে রাখে।
আমি মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম এবং তারপর থেকেই তাঁর লেখার প্রতি এক ধরনের নিবিড় আকর্ষণ অনুভব করেছি। যখনই তাঁর কোনও বই খুলেছি, মনে হয়েছে যেন এক অজানা জগতে প্রবেশ করছি―একটি নির্জন পারিবারিক বাড়ি অথবা অনন্ত প্রাকৃতিক দৃশ্যপট। বই শেষ করে যখন তা বন্ধ করি, মনে হয় সেই রহস্যময় জায়গাটি আমার বইয়ের তাকেই অপেক্ষা করছে। যখন আবার ফিরি, সেই রহস্য আগের মতোই গূঢ়, তবু কিছুটা পরিচিত মনে হয়।
অ্যান সেয়ার লেখাগুলি ক্ষুদ্র কিন্তু রহস্যময়। সেগুলো যেন ছেনির চেয়েও সূক্ষ্ম, ছুরির ধারের মতো তীক্ষè, যা লেখার অনুপম শক্তিকে প্রকাশ করে। প্রতিটি রচনা একটি স্বতন্ত্র জগৎ, চলমান ক্ষুদ্র শিল্পকর্ম, যা কোনও প্রচলিত ধারা বা আন্দোলনের সঙ্গে মেলে না। এ কারণেই তাঁর সাহিত্যকর্ম এত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যান সেয়ার লেখা মনে করিয়ে দেয়, উপন্যাসকে নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার করতেই হবে―নিজের সীমানা নিজের হাতে গড়ে তুলতে হবে। যখন কেউ কেউ উপন্যাসে অসংখ্য উপাত্ত দিয়ে ভরাট করেন, তখন অ্যান সেয়া সেই অসীম শূন্যতায় প্রবেশ করে এমন গল্প বোনেন, যা আমাদের সামনে এমন এক দরজা খুলে দেয়, যার অস্তিত্ব আমরা কল্পনাও করিনি।
এই সাক্ষাৎকার সেই অদ্ভুত দরজাগুলোর কথা নিয়ে। যা লেখালেখি, পড়া এবং বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা উন্মোচিত করি। এটি সেই অজানা ভূমিগুলোর গল্প বলে, যা সাহিত্যের পথ ধরে আমরা প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করি।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : যখন আমরা এই সাক্ষাৎকারের জন্য দেখা করার কথা ঠিক করেছিলাম, তখনই লকডাউন শুরু হয়। এটি আমাকে আপনার লেখায় ঘরবাড়ির গুরুত্ব নিয়ে ভাবতে বাধ্য করল―লে গোভারনান্তেস ((The Governesses, নিউ ডিরেকশনস থেকে ২০১৮ এবং লে ফুজিটিভস থেকে ২০১৯ সালে প্রকাশিত) উপন্যাসে বাগানঘেরা বড় বাড়ি, অ সুকুরস (Help me!)-এর সেই দ্বীপের বাড়ি, যেখানে বর্ণনাকারী শুরুতেই বাড়ি ছাড়ার ঘোষণা দেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা করতে ব্যর্থ হন। এছাড়া, পেতিত তাবল সোয়া মিজ! (The Wishing Table) এবং এভা লোন-এর পারিবারিক বাড়িগুলোও মনে পড়ে। আপনার লেখায় ঘরবাড়ির ভূমিকা আসলে কী ?
অ্যান সেয়া : ঘর আসলে পরিবার। এমন এক পরিবার, যা নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। আমার শৈশবে মা মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবারও ঠিক এভাবেই গুটিয়ে গিয়েছিল। আমার বাবা গভীর বিষণ্নতায় ডুবে যান, আর আমার বোনেরা ও আমি, এভা লোন-এর বাড়ির শিশুদের মতো, প্রাণপণে চেষ্টা করি―যেমন সব শিশুই এমন পরিস্থিতিতে করে থাকে―তাঁকে রক্ষা করতে, আবার জীবনের পথে ফিরিয়ে আনতে, তাঁর জীবনীশক্তি ধরে রাখতে। এই কারণেই আমার কাছে ঘর এমন একটি স্থান, যা ভয়, আতঙ্ক, ভালোবাসার মতো তীব্র অনুভূতিতে ভরা।
তবে এই শোকাবহ পরিস্থিতির জন্যই এটি লেখকের জন্মভূমিও হয়ে ওঠে, সেই দোলনা যেখান থেকে একজন লেখক উঠে আসেন―যা আমি দ্য উইশিং টেবিল-এ তুলে ধরেছি। আবার, অ সুকুরস-এর মতো, এটি এমন এক জায়গাও, যেখান থেকে একসময় নিজেকে মুক্ত করতে হয়, নইলে শোক অথবা সাহিত্য নিজেই আপনাকে গ্রাস করে নেবে।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : অন্যদিকে, গ্রঁদ তিকেতে একেবারেই ভিন্ন―এটি একটি ঘরবাড়িবিহীন উপন্যাস, যেখানে কাহিনি ও ভাষা উন্মুক্ত পথের মতো একধরনের চিরস্থায়ী গতিশীলতায় গ্রাম্য প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় ।
অ্যান সেয়া : লেখার জন্য বা তীব্র আবেগের ভার থেকে মুক্তি পেতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নিজের ‘বাড়ি’ থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির কাছে যাওয়া―খুব দূরে নয়, কিন্তু নিজের পরিচিত গণ্ডির বাইরে। আমার বেড়ে ওঠার বছরগুলোতে জার্মান রোমান্টিকদের Wanderschaft (আত্ম-অনুসন্ধান) এবং রবার্ট ওয়ালসারের অন্তহীন ‘প্রমেনাদ’ আমাকে মুগ্ধ করেছিল―যা এই ধারণার আরেকটি রূপ। আমার প্রথম দিকের বইগুলোর চরিত্ররা, ঠিক গ্রঁদ তিকেতে-র চরিত্রদের মতো, হেঁটে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। এই হাঁটাহাঁটিতেই তারা চিন্তা করার, ভালোবাসার, এবং জীবনের আনন্দ উপভোগ করার স্বাধীনতা খুঁজে পায়, যা ঘরের মধ্যে সম্ভব নয়।
গ্রাম্য প্রকৃতিতে হাঁটা আমার জীবনে সবসময়ই একটি বিশেষ, নিখুঁত ভূমিকা পালন করেছে। এমন মুহূর্তেই আমি আমার বইগুলোর ‘পরিমাপ’ করি―সেগুলোর গঠন, গুণাবলি এবং ত্রুটিগুলো নিয়ে ভাবি। কীভাবে এটি হয়, তা ঠিক নিশ্চিত নই। মনে হয় আমার গল্পগুলিকে প্রকৃতির সঙ্গে তুলনা করি, যেন কোনও ছবির উপর ট্রেসিং পেপার রাখছি। তখনই দেখতে পাই, কোথায় ভুল করেছি আর কোথায় সঠিক।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনি একজন লেখকের ‘জন্ম’ নিয়ে কথা বলছিলেন। আপনার লেখালেখির শুরুটা কীভাবে হয়েছিল ? এবং কীভাবে আপনি সেই শুরু থেকে এগিয়ে ১৯৯২ সালে ফ্রান্সে প্রকাশিত এবং সম্প্রতি ইংরেজিতে অনূদিত আপনার প্রথম উপন্যাস দ্য গোভারনান্তেস লিখলেন ?
অ্যান সেয়া : আমার শুরুটা ছিল অনুকরণ দিয়ে। শৈশব থেকেই আমি প্রচুর বই পড়তাম, এবং পড়াটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। দ্য ফেমাস ফাইভ সিরিজের বড় ভক্ত ছিলাম, আর বারো-তেরো বছর বয়সে সেই সিরিজের ওপর ভিত্তি করে দুটি ‘উপন্যাস’ লিখেছিলাম। এগুলো আমি এনিড ব্লাইটনের ফরাসি প্রকাশকের কাছে পাঠিয়েছিলাম―কোথা থেকে সেই ধারণা এসেছিল জানি না, তবে সম্ভবত তখন থেকেই নিজেকে লেখক হিসেবে কল্পনা করতাম। প্রকাশক সেগুলো গ্রহণ করেননি, কিন্তু তিনি দয়ালু ছিলেন; আমাকে চিঠি লিখে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তারপর আমি পড়া ও অনুকরণ চালিয়ে গেলাম।
সতেরো বছর বয়সে প্যারিসে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে ফ্রানৎস কাফকা, ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড, হেনরি জেমস এবং আরও অনেকের লেখা পড়ি। তখন ছোটগল্প লিখতে শুরু করলাম, যা মূলত আমার পড়ার অভিজ্ঞতা থেকে অনুপ্রাণিত। আমার লেখার বেশির ভাগ উপাদান জীবনের চেয়ে বেশি বই থেকেই নেওয়া ছিল। এই ছোটগল্পগুলোর কয়েকটি ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হতে থাকে। তারপর কেউ একজন আমাকে একটি উপন্যাস লেখার পরামর্শ দিলেন। তখনই সদ্য প্রকাশিত আমার ছোটগল্প লে গোভারনান্তেস ধরে এগিয়ে সেটিকে উপন্যাসে রূপ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : একটি ছোটগল্প ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হতে পারে এবং পরে উপন্যাসে রূপ নিতে পারে। আপনি নিজেও ম্যাগাজিনে ছোটগল্প ও উপন্যাসের অংশ প্রকাশ করেছেন। ম্যাগাজিনে লেখা প্রকাশ সম্পর্কে আপনার মত কী ?
অ্যান সেয়া : আমার লেখালেখির শুরুর দিকে, সেই ১৯৯২ সালে প্রথম উপন্যাস প্রকাশের আগে, আমি বেশ কয়েকটি ছোটগল্প ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছিলাম। ম্যাগাজিন ছিল অনুশীলনের ভালো একটি ক্ষেত্র। আমি এই গল্পগুলোকে পূর্ণাঙ্গ লেখা নয়, বরং অনুশীলন―যেন গানের সুর তোলার প্রস্তুতি হিসেবে দেখতাম। তবু আমার প্রথম প্রকাশক সেগুলোর কয়েকটি একত্র করে অঁ ভোয়াজ আঁ বালোঁ নামে ১৯৯৩ সালে প্রকাশ করেন। আমার কাছে এগুলো আমার শিল্পের ‘শৈশব’। আজ সেগুলো আমার কাছে শৈশবস্মৃতির মতো দূরবর্তী মনে হয়, যা আমার প্রথম উপন্যাসের ক্ষেত্রে নয়।
প্রথম উপন্যাসের পর সেই অনুশীলন আর করতে চাইনি―হয়তো সময়টাই পার হয়ে গিয়েছিল। তখন থেকে উপন্যাসই প্রাধান্য পায়―যদিও আমার লেখা ঠিক উপন্যাস নয়, বরং ছোট উপন্যাস বা নভেলা। যে কোনও লেখা শুরু করার সময় আমি তখন সেটিকে বইয়ে রূপ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোই। এখনও মাঝে মাঝে সাহিত্য ম্যাগাজিনে লিখি, তবে সেগুলো মূলত আমার নোটবুকের অংশ বা কোনও আলোচনার বক্তব্যের অনুবাদ।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনার বইগুলো ছোট। আপনি নিজেই সেগুলোকে ‘নভেলা’ বলছেন। নভেলার প্রতি আপনার এই আকর্ষণ কেন ?
অ্যান সেয়া : যদি এই প্রশ্নটি আমার পুরনো বন্ধু ও অনুবাদক মার্ক হাচিনসনের সঙ্গে আলোচনা করতেন, আমরা হয়তো হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তাম। এটি আমাদের কাছে এক ধরনের রসিকতা। আমার লেখার যেন এক অলিখিত নিয়ম, সব বই শেষমেষ দাঁড়ায় ঠিক ১২০ পৃষ্ঠায়―না এক পৃষ্ঠা বেশি, না কম। কখনও যদি কম লিখি (দ্য ফুল, দ্য উইশিং টেবিল বা গ্রঁদ তিকেতে-এর মতো), কিংবা বেশি লিখি (১৬০ পৃষ্ঠা পর্যন্তও), সেটি যেন শুধুই এই জাদুকরি সংখ্যাকে এড়ানোর প্রচেষ্টা।
মার্ক প্রায়ই জিজ্ঞেস করেন, ‘এবার কি ১২০ পৃষ্ঠার বাইরে যেতে পারবেন ?’ আমি উৎসাহভরে বলি, ‘অবশ্যই, অবশ্যই।’ তারপর হয়তো লিখি ১৫০ বা ১৭০ পৃষ্ঠা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাটতে কাটতে যা থাকে, তা আবারও সেই ১২০ পৃষ্ঠাই! যেন লেখার নিয়ম আমার হাতে নাই, এটি কোনও অদৃশ্য দৈব শক্তির কাজ।
তবে এই মজার বাইরে, বড় উপন্যাস লিখতে আমি সত্যিই অক্ষম। লেখার সময় পুরো কাজটি, তার খুঁটিনাটি সব, প্রতিটি মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কে উপস্থিত থাকে। ১২০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত আমার মস্তিষ্কের ক্যানভাসে সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। এর বেশি হলেই মনে হয়, যেন জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়ছে, এবং আমি পুরো ক্যানভাসের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনার বই শেষ হয়ে গেলে কেমন বোধ করেন ?
অ্যান সেয়া : আমার বইগুলো যেন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতীতে বিলীন হয়ে যায়। আমি একসঙ্গে দুটো বই নিয়ে কাজ করতে পারি না, এবং নতুন বই শুরু করার আগে অবশ্যই চাই যে সাম্প্রতিক বইটি কয়েক মাসের জন্য নিজের মতো করে একটি ‘পাবলিক জীবন’ যাপন করুক। সেটি ভুলে যাওয়ার আগে নতুন কিছু শুরু করা সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়ায় সাধারণত এক বা দুই বছর লাগে।
এমনও হয়েছে যে একটি প্রায় প্রস্তুত পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসে থেকেছি, তবে তা সম্পূর্ণ মনে হয়নি। একটি ছোট্ট বিশদ সংযোজন বা পরিবর্তন দরকার ছিল। উদাহরণস্বরূপ, দ্য উইশিং টেবিল-এর বর্তমান রূপটি বড় একটি পাঠ্য থেকে আলাদা করতে আমার কয়েক বছর সময় লেগে যায়। আমি কাজ থামিয়ে রেখেছিলাম যতক্ষণ না একদিন মনে হলো এর একটি নির্দিষ্ট অংশ আলাদা করা উচিত। সেই অংশটিই বই হয়ে উঠল।
এভাবেই গ্রঁদ তিকেতে কয়েক বছর আটকে ছিল যতক্ষণ না আমি একটি প্রস্তাবনা ও উপসংহার যোগ করি। তখনই বুঝতে পারলাম এটি শেষ হয়েছে। একইভাবে অ কোয়ের দ্যুন এত তু আন অর নিয়ে আমি এক বছরের বিরতির পর ফিরে এসে লেখাটির কিছু অংশের ক্রম বদল করি, কয়েকটি সরিয়ে দিই এবং একটি নতুন অংশ যোগ করি। তখনই মনে হলো এটি সম্পূর্ণ হয়েছে।
বলতে চাইছি, বইটি নিয়ে কাজ না করলেও এটি আমার ভেতরে চলতে থাকে। আর সেই চলমান প্রক্রিয়া প্রমাণ করে, কাজটি এখনও শেষ হয়নি।

দ্য হোয়াইট রিভিউ : ডিয়ালগ দেতে-তে আপনি বলেছেন, অন্যদের লেখা দৃশ্যের মধ্যে চরিত্র ঢুকিয়ে দেন। এই চরিত্রগুলো মূল চরিত্রদের সরিয়ে দেয়, ‘তাদের মেরে ফেলে, গিলে খায়’ এবং তাদের জায়গা দখল করে। তাহলে কি সাহিত্য এক ধরনের পারস্পরিক আত্মভোজন ?
অ্যান সেয়া : সাহিত্য এমন এক ক্ষেত্র যেখানে পড়া ও জীবনের অভিজ্ঞতা এক অদ্ভুত মিশ্রণে জড়িয়ে থাকে। বছরের পর বছর ধরে পড়া থেকে যা সংগৃহীত হয়―চিত্রকল্প, অনুভূতি, স্মৃতি―সবই অস্থির, এক রূপ থেকে অন্য রূপে বদলে যায়। এগুলো জীবনের ঘটনাগুলোর সঙ্গে মিশে যায় এবং সেই ঘটনাগুলোও এগুলোকে রূপান্তরিত করে।
একসময় এই মিশ্রণ এমন এক জায়গায় পৌঁছায়, যেখানে যা পড়েছেন এবং যা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে আর কোনও ভেদ থাকে না। দুটি উপাদান এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে তা এক হয়ে যায়, আর সেখান থেকেই সৃষ্টি হয় কল্পকাহিনি।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনি ওয়ালসার, কাফকা, ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ড এবং হেনরি জেমসের লেখায় প্রভাবিত হয়েছেন। তবে আপনার লেখায় রূপকথার ছায়াও অনুভব করি। রূপকথার ধারা কি আপনি সচেতনভাবে অনুসরণ করেন ?
অ্যান সেয়া : সত্যি বলতে, রূপকথার প্রতি আমি কখনওই বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করিনি! ছাত্রজীবনে আমি ম্যাডাম ড’অলনোয়ার রূপকথা নিয়ে আমার মাস্টার্স থিসিস লিখেছিলাম। কিন্তু সেটি ছিল আমার অধ্যাপকের পছন্দে। তখন আমি মূলত সপ্তদশ শতকের সাহিত্যে আগ্রহী ছিলাম এবং পরে অষ্টাদশ শতকের। সেই সময় বোচ্চাচ্চো এবং মার্গারিট দ্য নাভারের পাশাপাশি নানা রেনেসাঁ ও ধ্রুপদী লেখকদের পড়তে ভালোবাসতাম।
আমার মনে হয়, কুড়ি থেকে পঁচিশ বছর বয়সের মধ্যে যা পড়া হয়, তা লেখালেখির ভিত্তি গড়ে তোলে। ছাত্রজীবনে আমি সমকালীন প্রায় কিছুই পড়িনি। ফরাসি, ইংরেজি ও জার্মান অষ্টাদশ শতকের সাহিত্য গোগ্রাসে পড়ার পর অবশেষে রিলকে ও বেকেটের কাছে পৌঁছাই। তবে একই সময়ে ভিলিয়ার দ্য লি-ল’আদাম এবং বার্বে দ’অরেভিলির মতো লেখকদেরও পড়ছিলাম।
তবে মনে পড়ে প্রথম আধুনিক যে বইগুলো আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, সেগুলো পড়েছিলাম ষোল বছর বয়সে―আন্দ্রে জিদের লে নুরিত্যুর তেরেসত্র (The Fruits of the Earth) এবং পালুদ (Marshlands) । কিন্তু এই বইগুলোকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন ? এগুলো উপন্যাস নয়। বরং ভলতেয়ারের দার্শনিক রূপকথার ধারার সঙ্গে এগুলো মেলে, যেগুলোও আমি খুব পছন্দ করতাম।
পেরোর বা ব্রাদার্স গ্রিমের চেয়ে এই অর্থে আমার কিছু বই হয়তো দার্শনিক রূপকথার সঙ্গে বেশি সাযুজ্যপূর্ণ।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনার বইগুলোর মধ্যে, যেমন দ্য গোভারনান্তেস, অ সুকুরস বা এভা লোন- যে বিষয়টি আমাকে রূপকথার কথা মনে করিয়ে দেয় তা হলো আপনার রহস্যময়, ব্যাখ্যাতীত এবং নিবিড়ভাবে মনে থাকার মতো ছবিগুলো―যা পাঠককে বই শেষ করার পরও তাড়িয়ে বেড়ায়।
অ্যান সেয়া : আপনি যে ছবিগুলোর কথা বলছেন সেগুলো কি স্বপ্নে দেখা ছবির মতো নয় ? এ কারণেই সেগুলো এত প্রভাবশালী ও রহস্যময় মনে হয়। স্বপ্ন সবসময় যেন আমাদের কোনও কিছু বলতে চায়, এক ধরনের ধাঁধার আকারে―আপনার কি তা মনে হয় না ? এই ছবিগুলোর গঠন ইচ্ছাকৃত নয়। আমি হয়তো এমনভাবেই ভাবি―ছবির মতো করে।
তবে আমি তো চলচ্চিত্র নির্মাতা নই, ফটোগ্রাফারও নই। আমি কেবল লেখার মাধ্যমে ছবি তৈরি করতে পারি। যখন ফেলিনির কোনও ছবিতে স্বপ্নের দৃশ্য দেখি―যেমন আমারকোর্ড-এ একটি জাহাজের আশ্চর্য আবির্ভাব, কিংবা ক্যাসানোভা-য় ভেনিসের কোনও খাল থেকে মাথা উঁকি দেওয়া, বা গায়ক দৈত্যের বিরাট মূর্তি―তখন কখনও কখনও ইচ্ছে হয় আমার লেখায় যদি শব্দ থাকত, ফেলিনির সেই শব্দ, যা প্রায়শই এক গভীর নীরবতার মধ্যে বাতাসের বয়ে যাওয়ার মতো।
ফেলিনির ছবিতে যখন বাতাস বইতে শুরু করে, তখন আপনি নিশ্চিত হতে পারেন কিছু বিস্ময়কর, কিছু ব্যাখ্যাতীত এবং গভীরভাবে হৃদয়গ্রাহী কিছু দেখতে চলেছেন। এই ব্যাখ্যাতীত ছবিগুলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে মৌলিক সত্যের দিকে ইঙ্গিত করে। যা আপনাকে এক ধরনের অন্তর্নিহিত বিষণ্নতা এবং শান্তিতে ভরে তোলে। আমার মনে হয়, এই ছবিগুলো মৃত্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত। যেন মৃত্যু সম্পর্কে কোনও এক গূঢ় সত্য আপনাকে প্রকাশ করা হয়েছে।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনার লেখা কি এই ধরনের ছবিগুলোর মাধ্যমে শুরু হয় ?
অ্যান সেয়া : আমি মনে করি, আমার প্রায় প্রতিটি বই-ই এমন একটি ছবি থেকে শুরু হয়েছে। যা নিজেই আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে একটি কাল্পনিক দৃশ্য, যা কোথা থেকে এসেছে বলতে পারি না। যেমন, দ্য গোভারনান্তেস-এ সেই প্রাসাদের বাগানে তিনটি ছায়ামূর্তি, অ সুকুরস-এর ছোট অন্ধকার দ্বীপ, বা এভা লোন-এর কমলা টাইলের ছাদযুক্ত বাড়ি। আমার কাছে এই ছবিগুলো এতটাই বিশদ এবং স্পষ্ট যেন সেগুলো এমন কোনও চিত্রকর্মের স্মৃতি, যা আমি দীর্ঘক্ষণ ধরে নিবিড়ভাবে দেখেছি। তবে এগুলো স্থির ছবি আর এই ছবিগুলোতে গতিশীলতা আনার দায়িত্ব আমার।
যদি এমন একটি ছবি দিয়ে আমি কোনও উপন্যাস শুরু করি, তা এই কারণে যে ছবিটির ভেতর থেকেই একটি গল্প যেন ফুঁসে উঠছে। এটি আমার কাছে যেমন রহস্যময়, তেমনি পাঠকের কাছেও। তবে আমার কাছে এর বিশেষত্ব হলো, এটি জীবন্ত, এর মধ্যে এক ধরনের অনুরণন রয়েছে। মূলত পুরো উপন্যাসটি হচ্ছে এই ছবিটি অন্বেষণ করার প্রক্রিয়া―এটি কী ধারণ করছে, এটি কী বলছে তা খুঁজে বের করা।
আমি জানি না কীভাবে এই ছবিগুলো তৈরি হয়, যেগুলো নিজে থেকেই আমার কাছে আসে। আমার ধারণা এগুলো হয়তো হাজারো দেখা, পড়া ও স্বপ্ন দেখা জিনিসের সংমিশ্রণ, যা একত্র হয়ে একটি স্পষ্ট, ছোট্ট ছবি তৈরি করে।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনার এই ছবিগুলো, যেগুলো কোনও নির্দিষ্ট বর্ণনা না দিয়েও গল্পের জন্ম দেয়। প্রাচীনকালের বক্তাদের ব্যবহৃত সেই ছবিগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যেগুলো তাঁরা তাদের বর্ক্তৃতা মনে রাখার জন্য ব্যবহার করতেন। আপনার বর্ণনা অনুযায়ী, ইমাগো অ্যাজেন্স―একটি সক্রিয় ছবি, যা গতিশীল, যা স্থানিক এবং প্রায়ই অদ্ভুত বা বৈচিত্র্যময়―মনে গেঁথে থাকার মতো জিনিস। আমি মনে করি আপনার ছবিগুলোর একটি আবেগময় দিক হলো, যখন আমি এগুলো পড়ি তখন নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি এই অদ্ভুততা কোনও খামখেয়াল নয়। এগুলো অর্থপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়, যদিও এগুলোর কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হবে না। ছবিগুলো রহস্যময়ই থেকে যাবে যেমনটি আপনি বলেছেন।
অ্যান সেয়া : ইমাগো অ্যাজেন্স একটি অত্যন্ত সুন্দর ধারণা। এটিকে আপনি প্রুস্তের সেই ‘হলুদ দেয়ালের ছোট্ট অংশ’-এর সঙ্গে তুলনা করতে পারেন, তাই না ? ঠিক মনোসমীক্ষণের মতো! মনে পড়ে লরেনজেত্তির একটি বিখ্যাত বিশদ চিত্রকর্ম, যেখানে একটি ছোট নৌকা একটি হ্রদে ভাসছে এবং সেটি দেখতে মুখের মতো। সেই নৌকাটি অবিশ্বাস্য; যেন তা আপনাকে কিছু ইঙ্গিত করছে, কিছু বলছে, যা আপনি কখনও পুরোপুরি সংজ্ঞায়িত করতে পারবেন না। অথচ সেই নৌকাটি নিজেই যেন দীর্ঘ, নিখুঁত একটি বক্তৃতা।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনার লেখার রহস্যগুলো অত্যন্ত সরলভাবে উপস্থাপিত হয়। শব্দ, বাক্য, বাক্যগঠন―কোনও কিছুই জটিল নয়, অথচ সবকিছুই রহস্যময় থেকে যায়।
অ্যান সেয়া : জেন অস্টেন বলেছেন, ‘উপন্যাসের বর্ণনাকারী সবসময় যেন একটি রহস্য বর্ণনা করছেন’। আমি মনে করি এটি উপন্যাসের নিখুঁত সংজ্ঞা। বিশেষত যখন আপনি আমার মতো লিখতে বসেন―কিছু উদঘাটন করতে বা যা অধরা সেটিকে স্পষ্ট করে তুলতে, যদিও আসলে কিছুই পুরোপুরি উদঘাটিত হয় না। যখন আপনি ‘রহস্য’-এর কথা বলেন আমার মনে পড়ে প্রাচীনকালের সেই গোপন ধর্মীয় আচারগুলোর কথা, যেগুলোও রহস্য নামে পরিচিত ছিল।
আমার দ্য উইশিং টেবিল নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করা হয়েছিল, যেখানে একটি পরিবারের অদ্ভুত যৌন জীবন বর্ণিত হয়েছে। আমি প্রায়ই বলতাম, সেই দৃশ্যগুলো আমাকে প্রাচীন সেই রহস্যময় আচার এবং তাদের গোপন দীক্ষার কথা মনে করিয়ে দেয়।
আপনার সরল শব্দভাণ্ডার ও বাক্যগঠন সম্পর্কে মন্তব্য শুনে হোল্ডারলিনের কাজ নিয়ে এক সময়কার একটি মন্তব্য মনে পড়ে। কেউ তার লেখার সরলতা নিয়ে বলছিলেন, এবং আমার তরুণ বয়সে বিস্মিত হয়েছিলাম, এত মহান একজন কবি কীভাবে এত সীমিত শব্দভাণ্ডার নিয়ে কাজ করতে পারেন।
আমার নিজের সরলতার প্রতি আকর্ষণ নিয়েও মাঝে মাঝে সতর্ক থাকতে হয়। আমি সাধারণ শব্দগুলি ব্যবহার করি―যেমন ম্যানর, ওক, বা আইরিস বদলে বাড়ি, গাছ, ফুল―এমন নির্দিষ্ট শব্দ। যেন এক শিশুর আঁকা ছবির মতো।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : সাধারণ শব্দভাণ্ডারের ঠিক বিপরীতে আপনি গ্রঁদ তিকেতে-র মতো একটি বই লিখেছেন, যেখানে একটি কল্পিত ভাষা তৈরি করেছেন। তবু পাঠকের গল্প বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। এটি কীভাবে সম্ভব করলেন ?
অ্যান সেয়া : আমিও মনে করি, এই কল্পিত ভাষাটি আসলে খুবই সরল, হয়তো আমার ব্যবহার করা সবচেয়ে সরল ভাষা। কীভাবে এটি করেছি বলতে পারব না। এটি যেন নিজে থেকেই জন্ম নিয়েছে। বইটির ভূমিকায় উল্লেখ করেছি, আমার বাবা মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে তিনি যে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছিলেন, সেটিই এই ভাষার সূচনা। তাঁর আসন্ন মৃত্যু, তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসা এবং এই ধারণা যে এগুলো তাঁর শেষ কথা―এসব কারণে আমি সেই ভাষা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলাম।
তবে লেখার সময় আমি সেই ভাষাকে হুবহু পুনর্গঠন করিনি। বরং সেই পরিস্থিতি থেকে আরেকটি ভাষার জন্ম হয়, যা আমার কাছে মনে হলো যেন এটি আমার আদি ভাষা। এমনকি আমার আগের সমস্ত লেখা যেন এই ভাষার ফরাসি অনুবাদমাত্র। আমি এতটাই মোহিত ও মুগ্ধ হয়েছিলাম নিজের এই ‘আদি ভাষা’ আবিষ্কার করতে পেরে যে, পূর্বে ব্যবহৃত ভাষা হঠাৎই অপরিশীলিত মনে হচ্ছিল। তবে এটিও হয়তো একটি মায়া―মায়া দীর্ঘজীবী হোক! পিটার হ্যান্ডকের সাক্ষাৎকারের একটি বইয়ে যেমন বলা হয়েছে, ‘মায়া ছাড়া আমরা কোথাও পৌঁছাতে পারতাম না’।
নিজের ভাষা আবিষ্কার করে তাতে লেখা নিঃসন্দেহে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। তবে এর অর্থ এই নয় যে সাধারণ ভাষাকে অবজ্ঞা করা উচিত। সাধারণ ভাষাও যথাযথ হতে পারে।
আমি যখন তরুণী, তখন পল ক্লদেলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং তাঁর বহু নাটকের অভিনয়-দলে থাকা প্রবীণ ফরাসি অভিনেতা অ্যালাঁ কুনির সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। যখন আমি একজন গুরুতুল্য ব্যক্তিত্বের সন্ধানে ব্যাকুল ছিলাম তখন কুনি সেই সময়ে আমার কাছে আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক ছিলেন। একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘সাবধান, স্বচ্ছতার মাধ্যমে স্বচ্ছতা অর্জন করা সম্ভব নয়।’
এই কথাটি আমার মনে প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল। আমি কখনও তা ভুলিনি। স্পষ্ট মনে আছে, তিনি এটি আমাকে বলেছিলেন প্যারিসের বিবলিওথেক নাসিওনাল-এর বাইরে দাঁড়িয়ে।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : গ্রঁদ তিকেতে-তে যে ভাষা আপনি আবিষ্কার করেছিলেন, সেটি কি এখনও আপনার জীবনের অংশ ?
অ্যান সেয়া : সৌভাগ্যবশত, বইটি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাষা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। লেখার সময় এটি এতটাই স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছিল যে মনে হয়েছিল, হয়তো আমি আর কখনও এর থেকে মুক্তি পাব না। কিন্তু বইয়ের শেষ শব্দটি লেখার পরই সব শেষ। ভাষাটি যেন মাটিতে পড়ে গেল, ঠিক একটি কোট খুলে ফেলার মতো।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আমরা আপনার সাহিত্যকর্মের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ নিয়ে কথা বলতে পারি। এই সাক্ষাৎকারটি ইংরেজিতে প্রকাশিত হবে, এবং আপনার বেশ কয়েকটি বই ইতোমধ্যেই ইংরেজি ও স্প্যানিশে অনূদিত হয়েছে। এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় আপনার কাজের এই রূপান্তর সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী ? আপনি কি অনুবাদ প্রক্রিয়ায় অংশ নেন, নাকি এতে বিশেষ আগ্রহী নন ? আর প্রকাশিত হওয়ার পর আপনার বইগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন থাকে ?
অ্যান সেয়া : আমার বইগুলোর ইংরেজি অনুবাদ আমার জন্য বিশেষ একটি অভিজ্ঞতা। কারণ আমার অনুবাদক মার্ক হাচিনসন, কেবল আমার তিরিশ বছরেরও বেশি সময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নন, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে আমি সত্যিকারের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি। তিনি শুরু থেকেই আমার সাহিত্যিক সঙ্গী। আমরা একসঙ্গে অনুবাদ নিয়ে কাজ করি বলব না, কারণ তাঁর আমার সাহায্যের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু যেহেতু আমরা গত তিরিশ বছর ধরে প্রায় প্রতিদিন কথা বলছি, মাঝেমধ্যে অনুবাদ নিয়েও আলোচনা হয়।
অন্যদিকে, আমার স্প্যানিশ অনুবাদকদের সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি বা কোনও যোগাযোগও হয়নি। তবু আমার বইয়ের জীবন, তা ফরাসি হোক বা অনুবাদে, আমাকে বরাবরই আগ্রহী করে তোলে। বিশেষত সেগুলো থেকে উঠে আসা প্রশ্ন বা মন্তব্য। যেমন এই সাক্ষাৎকারে আপনি করছেন। কারণ এগুলো আমাকে অনেক কিছু শেখায়। কখনও কখনও এই প্রশ্ন বা দৃষ্টিভঙ্গি আমার লেখার পথকে সামান্য বদলে দেয়, এমন একটি দরজা খুলে দেয়, যার অস্তিত্ব আমি আগে টেরও পাইনি।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনি জানুয়ারিতে (২০২০) শঁ ভ্যালোঁ থেকে গ্রঁদ তিকেতে এবং মে মাসে মেরকুর দ্য ফ্রঁস থেকে অ কোয়ের দ্যুন এত তু আন অর, যা প্রি গঁকুর দ্য লা নুভেলের পুরস্কার পেয়েছেন, প্রকাশ করেছেন। আপনি শঁ ভ্যালোঁ, মেরকুর দ্য ফ্রঁস এবং ভার্দিয়ে―তিনটি প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে কাজ করেন। প্রতিটি প্রকাশনা সংস্থার জন্য কি আলাদা আলাদা লেখা তৈরি করেন ?
অ্যান সেয়া : আমি প্রেমের মতো খুবই বিশ্বস্ত। শঁ ভ্যালোঁ-র প্যাট্রিক বোন ছিলেন আমার প্রথম প্রকাশক, এবং তিনি আমার প্রথম বইগুলো প্রকাশ করেছিলেন বলে আমি তাঁর প্রতি গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। সাধারণত লেখকেরা তাঁদের প্রথম প্রকাশকদের ছেড়ে বড় ও বেশি পরিচিত প্রকাশনায় চলে যান। আমিও যখন শঁ ভ্যালোঁ ছেড়ে মেরকুর দ্য ফ্রঁস-এ যোগ দিলাম, যা গ্যালিমার্দের অংশ, তখন আমি আমার প্রকাশককে বলেছিলাম, যেদিন আমার বই কিছুটা সাফল্য পাবে, সেদিন আমি তাঁর কাছে ফিরে আসব। গ্রঁদ তিকেতে দিয়ে আমি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।
আমি মেরকুর দ্য ফ্রঁস-এর প্রতিও বিশ্বস্ত। আমার প্রকাশক ইসাবেল গ্যালিমার্দ শুরু থেকেই আমার প্রতি আস্থা রেখেছেন। ২০০২ সালে আমি তাঁর সঙ্গে প্রথম বই প্রকাশ করি। যদিও সাম্প্রতিক সময়েই তিনি আমার কাজ থেকে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেছেন, তবু তিনি আমার লেখা তখন প্রকাশ করেছেন।
ভার্দিয়ে যখন ২০০৫ সালে আমাকে একটি বই লেখার আমন্ত্রণ জানায়, যা পরে দ্য ফুল নামে প্রকাশিত হয়, আমি অভিভূত হয়েছিলাম। এত অসাধারণ একটি প্রকাশনা সংস্থা আমার কাছে কিছু চেয়েছিল―এটা আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। এই কারণেই ২০১২ সালে আমি তাদের জন্য দ্য উইশিং টেবিল পাঠিয়েছিলাম, কারণ মনে হয়েছিল এটি কিছুটা মনোযোগ পাবে। ভবিষ্যতেও তাদের জন্য লেখা দেব।
আমি যেন এক ভালোবাসা থেকে আরেক ভালোবাসার মধ্যে চলাচল করি। তবে প্রতিটি প্রকাশকের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করি। কোন লেখা কোন প্রকাশকের সম্পাদনার মেজাজের সঙ্গে ভালো মানাবে, তা ভেবেই কাজটি তাদের কাছে দিই।
দ্য হোয়াইট রিভিউ : আপনি আপনার প্রকাশক বা অনুবাদক মার্ক হাচিনসন, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ লেখক এবং আপনার জীবনের অন্য মানুষদের―যেমন অ্যালাঁ কুনি―সম্পর্কে যে আন্তরিকভাবে কথা বলেন, তা থেকে মনে হয় যে আপনার জন্য লেখালেখি বা অন্তত সাহিত্য এক প্রকার বন্ধুত্বের বিষয়ও। লেখক হিসেবে আপনার জীবনে বন্ধুত্বের ভূমিকা কী ?
অ্যান সেয়া : এটি আমার জীবনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ―যা শুধুই একজন লেখকের জীবন, কারণ আমার আর কোনও জীবন নেই। আমি মনে করি এটি সবসময়ই ছিল। বন্ধুত্ব এবং যাঁদের প্রতি আমি আস্থা ও স্বস্তি অনুভব করি তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতা আমার জীবনের অন্যতম বড় সম্পদ। এই আলাপচারিতায় আমরা নানা বিষয়ে কথা বলি। তবে সাহিত্য নিয়ে খুব একটা নয়―সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে আমার বিশেষ ভালো লাগে না।
বন্ধুত্ব আমার জন্য এক বড় আশ্রয়, যেন এক দোলনা। বন্ধুত্ব বা ভালোবাসার ক্ষেত্রে আমি কেবল এমন মানুষের প্রতিই আকৃষ্ট হই, যাঁরা আমার লেখালেখিতে বাধা দেন না। যাঁরা আমাকে লেখার স্বাধীনতা দেন, তাঁরাই আমাকে সত্যিকারের ভালোবাসেন। একজন লেখকের জন্য এই স্নেহ বা ভালোবাসার শক্তি অবিশ্বাস্য; এটি তাঁকে কাজের মধ্যে মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে।
আজকাল, বেশির ভাগ আলাপ ইমেইল বা ফোনের মাধ্যমে হয়। আগে বন্ধুরা মিলে প্রায়ই বাইরে খেতে যেতাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, আমি সন্ধ্যাগুলো ঘরে কাটাতেই বেশি পছন্দ করি। তবু এই যোগাযোগগুলোর মাধ্যমে পুরানো বন্ধুত্ব টিকে থাকে এবং নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়।
[নিনা লেজার ১৯৮৮ সালে ফ্রান্সের আন্তিব শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ২০০৯ সালে লিয়নের ইকোল নরমাল সুপেরিয়র থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং ২০১৭ সালে শিল্পতত্ত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি মার্সেইর বোজ-আর্টসে শিল্প ইতিহাস ও তত্ত্ব পড়ান।২০১৪ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ইস্তোয়ার নাতুরেল প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৭ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় উপন্যাস মিজ আন পিয়েস (ইংরেজিতে দ্য কালেকশন)-এর জন্য তিনি প্রি আনাইস নিন এবং প্রি লিতেরের দ্য লা ভোকাসিওন পুরস্কার লাভ করেন।
২০২২ সালে তাঁর তৃতীয় উপন্যাস আন্তিপোলিস প্রকাশিত হয়, যা সোফিয়া আন্তিপোলিস প্রযুক্তি পার্কের ইতিহাস অনুসরণ করে। ২০২৪ সালে প্রকাশিত চতুর্থ উপন্যাস মেমোয়ার সোভে দ্য ল’ও-এর জন্য তিনি প্রি দ্যু রোমাঁ হিস্টোরিক পুরস্কার অর্জন করেন।
নিনা লেজার তাঁর লেখালেখির পাশাপাশি শিল্প ইতিহাস ও তত্ত্বের শিক্ষকতায় নিয়োজিত আছেন। তিনি স্থান ও ইতিহাসের জটিলতা নিয়ে গবেষণা করেন এবং তাঁর উপন্যাসে সেগুলোকে তুলে ধরেন।]