অনুবাদ গল্প : শিশুটি

মূল : এলি স্মিথ
বাংলা অনুবাদ : ফারহানা আনন্দময়ী
লাঞ্চব্রেকে ওয়েট্রোজে গিয়েছিলাম ঘরের সাপ্তাহিক কেনাকাটার জন্য। ট্রলিটাকে শাকসব্জির সেকশনে রেখে আমি গেলাম কিছু শাকপাতা নিতে, স্যুপের সঙ্গে মেশাব বলে। কিন্তু ফিরে এসে দেখি আমার ট্রলিটা আর আগের জায়গায় নেই, মনে হলো কেউ সরিয়ে নিয়েছে। আর আমার ট্রলির জায়গায় দেখলাম অন্য একজনের ট্রলি রাখা; সেটায় একটা বাচ্চা বসে আছে, ওর মোটাসোটা পা দুটো ঝুলে আছে পা-রাখার জায়গায়।
বাচ্চাটি যে ট্রলিতে বসা, ওটার দিকে তাকিয়ে দেখি এর আগে আমার নেওয়া জিনিসগুলোই রাখা আছে; তিন ব্যাগ কমলালেবু, অ্যাপ্রিকর্টস, অরগানিক আপেল, একটা ভাঁজ করা গার্ডিয়ান পত্রিকা আর এক টব কালামাটা জলপাই। এই জিনিসগুলো আমারই নেয়া। তাহলে তো নিশ্চিতভাবেই এটা আমার ট্রলি।
বাচ্চাটির মাথাভর্তি সোনালি কোঁকড়া চুল আর গায়ের রং টুকটুকে লাল ফরসা। দেখতে কিউপিডের মতো চওড়া থুতনি কিংবা ক্রিসমাস কার্ডের ফোলা ফোলা-আঙ্গুলের শিশুটির মতো। কিংবা পুরনো ইংরেজি বইতে দেখা প্রখর গ্রীষ্মে সূর্যের তেজ থেকে বাঁচতে বড় টুপি পরা শিশুর মতো। ওর পরনে নীল রঙের ট্র্যাক স্যুট আর নীল জুতা। দেখতে পরিষ্কার হলেও জুতার আগায় সামান্য ময়লা লেগে ছিল। ওর ঠোঁট দুটো গাঢ় গোলাপি রঙা আর ধনুকের মতো বাঁকা। চোখ দুটোও নীল রঙের, স্বচ্ছ। সব মিলিয়ে শিশুটি দেখতে দুর্দান্ত রকম সুন্দর।
বললাম, হ্যালো। তোমার মা কোথায় ?
শিশুটি শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি দাঁড়িয়েছিলাম আলুর শেলফটার পাশে আর আমার আশপাশের মানুষজন যে যার মতো কেনাকাটা করছিল। ওদের মধ্যে কেউ একজন শিশুটিকে আমার ট্রলিতে বসিয়ে দিয়ে গেছে নিশ্চিত। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলাম, আর বলতে চাইছিলাম এগুলো আমার জিনিস। আর ট্রলিটাও সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।
এরপরে মিনিট পাঁচেক ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে, কোনও উপায় না পেয়ে শিশুসহ ট্রলিটাকে টেনে নিয়ে গেলাম কাস্টমার সার্ভিস ডেস্কের সামনে।
আমি ভাবছিলাম, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই শিশুটিকে খুঁজছেন। কাউন্টারের পেছনে কম্পিউটারে কাজ-করা মহিলাকে সেই কথা বললামও।
আপনি কী চাইছেন ? মহিলাটি আমাকে জিজ্ঞেস করল।
ওকে বললাম, আমি ধারণা করছি এই শিশুটিকে হারিয়ে কেউ হয়তো অস্থির হয়ে আছে এখানে। এই নীলরঙা চোখ শিশুর কথা বলছি।
কাস্টমার সার্ভিসের মহিলার নাম মেরিলিন মনরো, ওর পোশাকের ব্যাজে এই নামই লেখা।
বাহ দারুণ একটা নাম তো! ওর ব্যাজের দিকে তাকিয়ে বললাম।
দুঃখিত, কিছু বলছেন ? মহিলাটি জানতে চাইল।
তোমার নামটা। তুমি জানো তো, মনরো। মেরিলিন।
সে বলে উঠল, হ্যাঁ। এটা আমারই নাম।
আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন অদ্ভুত কিছু বলেছি আমি!
আমি ঠিক কীভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি, রিনরিনে কণ্ঠে বলে উঠল সে।
আমি বলতে চাইছিলাম। আহ, এই শিশুটি।
বাহ! কী সুন্দর দেখতে বাচ্চাটা। একেবারে মায়ের মতো!
শোনো, আমি একে ঠিক চিনি না। শিশুটি আমার নয়। আমি বললাম।
ওহ! সে যেন একটু বিব্রত হলো। বলল, কিন্তু তোমার মতোই দেখতে। কী বাবু, তুমি ওর মতো নও দেখতে ? বলো লক্ষ্মীসোনা, তুমি মায়ের মতো নও ?
মহিলাটি ওর চাবির রিঙের সঙ্গে বাঁধা লাল ফিতেটা শিশুটির মুখের সামনে নাড়াতে থাকল, আর ইঞ্চিখানেক দূর থেকে সে সেটা দেখছিল। আমি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না ওর কথাটা। শিশুটি কোনওভাবেই আমার মতো দেখতে নয়।
না, সে আমার মতো নয়। এটা বলে আমি কোণের শেলফের দিকে এগোলাম আরও কিছু নিতে। ফিরে এসে দেখি শিশুটি ওই ট্রলিতেই বসে আছে।
না। এখানে কেউই তার বাচ্চা হারায়নি, এরকম কোনও রিপোর্ট আসেনি। মহিলাটি অবাক হয়ে বলল।
ইন্টারকমে কোনও বোতাম টিপে সে বলল, হ্যালো, কাস্টমার সার্ভিস ডেস্ক থেকে মেরিলিন বলছি। ভালো আছি। তুমি কেমন আছ ? আচ্ছা, শোনো, তোমাদের ওখানে কোনও রিপোর্ট জমা পড়েছে, কোনও বাচ্চা হারিয়ে গেছে, বা খুঁজছে এমন কেউ ? এখানে একজন মহিলা এসে দাবি করছেন যে তিনি একটা বাচ্চাকে খুঁজে পেয়েছেন।
ইন্টারকম রেখে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলল, না, ম্যাডাম, কোনও বাচ্চা হারিয়ে গেছে বা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এমন কোনও রিপোর্ট কেউ করেনি।
মানুষের ছোটখাট একটা জটলা লেগে গেল আমার পেছনে। একজন বলে উঠল, বাহ! খুব আদুরে সে। এই কি তোমার প্রথম বাচ্চা ?
সে আমার বাচ্চা নয়, বললাম আমি।
একজন বলে উঠল, কত বয়স হলো ওর ?
আমি জানি না, আমি উত্তর দিলাম।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী ? তুমি জানো না ?
বাহ! খুব সুন্দর বাচ্চাটি, এ কথা বলে উঠলেন এমন একজন বৃদ্ধ, যাকে দেখলে মনে হয় না তার সামর্থ্য আছে ওয়েট্রোজে কেনাকাটা করবার। পকেট থেকে ৫০ পেন্স বের করে আমার দিকে তুলে ধরে বললেন, এই নাও, এটা তোমার সৌভাগ্যের জন্য দিলাম।
বলেই সেটা তিনি শিশুটির জুতার মধ্যে গুঁজে দিলেন।
এটা দেখে মেরিলিন মনরো বলে বসল, এই কাজ আমি কখনও করব না। বাচ্চাটা এটা ওখান থেকে বের করে মুখে দেবে এখন আর ওর গলায় আটকে যাবে।
বৃদ্ধ লোকটি তখন বললেন, এটা সে কখনও করবে না। বলো, তুমি করবে ? তুমি খুবই লক্ষ্মী ছেলে। তাই না ? সে খুবই ভালো ছেলে। তোমার নাম কী ? কী নাম ওর ? আমি নিশ্চিত ও ওর বাবার মতো দেখতে। তাই নয় কি ?
আমার কোনও ধারণা নেই। আমি উত্তর দিলাম।
কোনও ধারণা নেই! এত সুন্দর দেখতে একটা বাচ্চা। আর তুমি এরকমভাবে বলছ ?
সত্যিই বলছি, না। একে আমি আমি জানি না। কোনও সম্পর্ক নেই আমার সঙ্গে। একে আমি ট্রলিটার মধ্যে পেয়েছি যখন কেনাকাটা করে ফিরেছিলাম।
ঠিক সেই মুহূর্তে শিশুটি আমার দিকে তাকিয়ে, ওর মোটা মোটা হাতটা উপরে তুলে বলে উঠল, মাম্মাম।
এটা শুনে আশপাশের সমস্ত মানুষজন তাকাল আমার দিকে। কয়েকজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়তে লাগল।
শিশুটি আবারও একই কাজ করল। হাতটা শূন্যে তুলে, এবং নিজেকে যতটা সম্ভব ট্রলি থেকে তুলে সোজাসুজি আমার দিকে তাকিয়ে ডাকল, মাম্মাম বলে।
ডেস্কের মেরিলিন মনরো নামের মহিলাটি এবার ইন্টারকমে আবার কথা বলতে শুরু করল। শিশুটি কাঁদতে শুরু করে দিল এর মধ্যে। সে চিৎকার করে কাঁদছিল, মাম্মাম বলে চিৎকার করছিল, সেই সঙ্গে ট্রলিটা ধরে ঝাঁকাতে শুরু করে দিল।
তোমার গাড়ির চাবিটা ওকে দাও, ওটা দিয়ে খেলতে পছন্দ করবে। ডেস্কের মহিলাটি বলল।
দেব কি দেব না ভাবতে ভাবতে গাড়ির চাবিটা দিলাম ওকে। সে কী করল! চাবিটা মেঝেতে ছুড়ে দিয়ে আরও জোরে কাঁদতে শুরু করে দিল।
শ্যানেল স্যুট পরনে একজন এটা দেখে বলল, ওকে ট্রলি থেকে তুলে নাও। ও তোমার কোলে উঠতে চাইছে।
এ আমার বাচ্চা নয়। কোনওদিন ওকে আমি দেখিনি আগে। আমি বললাম।
ও আচ্ছা, উত্তরে বলল সে।
এবার সে নিজেই শিশুটিকে ট্রলি থেকে তুলে নিল। হাতটা একটু দূরে সরিয়ে এমনভাবে ওকে কোলে নিল যেন তার স্যুটটায় না মাখে কিছু। শিশুটির পা ট্রলির বাইরে বেরিয়ে আসা মাত্রই সে আরও জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। এত জোরে যে পুরো দোকানের মানুষজন ঘুরে তাকিয়ে রইল এদিকে। আরও লালচে হয়ে উঠল ওর লালচে মুখটা। অনেক বিব্রত লাগছিল তখন আমার। মনে হচ্ছিল, এসবের জন্য আমিই দায়ী। সকলের দিকে ফিরে বললাম, দুঃখিত। শ্যানেল স্যুট পরা মহিলাটি তখন শিশুটিকে আমার কোলে দিয়ে দিল। আর শিশুটিও হাত দিয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে শান্ত হয়ে গেল। সে মুখ দিয়ে অর্থহীন সব শব্দ করতে লাগল।
ওহ জেসাস! আমি বললাম, কারণ এত শক্তিমান আগে নিজেকে কখনও মনে হয়নি।
চারদিকের মানুষজন এটা দেখে নিজেরা বলাবলি শুরু করল, দেখলে তো! বৃদ্ধ লোকটি বললেন, এটাই করবে তুমি। এত ভয় পাবার কিছু নেই তোমার। একজন পাশ থেকে বলল, অনেক আদুরে বাচ্চাটা। প্রথম তিনটা বছর একটু ঝামেলার, এটা বলতে বলতে ট্রলি নিয়ে আরেকজন পাশ কাটিয়ে গেল। ইন্টারকমে তখন মনরো বলছে, হ্যাঁ, এতক্ষণ বলছিল তার নয়। কিন্তু বাচ্চাটি তারই। ঠিক আছে এখন। তাই তো, ম্যাডাম ? সব ঠিক তো ?
শিশুটির মাথাভর্তি সোনালি চুল মুখের কাছে নিয়ে বললাম, ঠিক আছে।
সেই বৃদ্ধ লোকটি তখন বলে উঠলেন, হ্যাঁ, ওকে বাসায় নিয়ে সন্ধ্যার খাবারটা খেতে দাও। দেখবে, সব ঠিকঠাক মতো করছে।
আমার চেয়েও আরও দশ বছরের ছোট হবে, এমন একজন মহিলা বলল, দাঁত উঠছে হয়তো। এ সময় এরকম করে। পুরনো কর্মী হবে সে। বলল, এত অস্থির হয়ো না। বাসায় গিয়ে এক কাপ হার্ব চা খাও। বাচ্চাটি এর মধ্যে শান্ত হয়ে যাবে।
জি হ্যাঁ। অনেক ধন্যবাদ। কী একটা দিন গেল, আমি বললাম।
কয়েকজন মহিলা আমাকে সাহসজাগানিয়া হাসি উপহার দিল, কেউ আবার হাত চাপড়ে দিতে থাকল আমার বাহুতে। বৃদ্ধ লোকটিও আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, এই পঞ্চাশ পেনি দশ শিলিং হিসেবে ব্যবহার হতো। নিয়ে যাও। অনেক অনেক আগে এটাই এক সপ্তাহের খাবার কেনার জন্য ব্যয় করা যেত। আহা! পুরনো সেসব দিন! কিছু বিষয় পরিবর্তন হয়। কিছু একই রকম রয়ে যায়। বুঝলে, ম্যাম ?
মাথ নেড়ে আমি বললাম, জি। আমি কি তা জানি না ?
শিশুটিকে নিয়ে এবার আমি গাড়ি পার্কিংয়ে এলাম। এত ভারী লাগছিল ওকে নিয়ে আসতে!
পার্কিং-এর রিসাইক্লিং বিনের পেছনে তাকে রেখে দিয়ে চলে যাব, এমনটা ভাবলাম। এখানে রাখলে সে খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না আর খিদে পাবার আগেই কেউ-না-কেউ তাকে খুঁজে পাবে। তারপরই মনে হলো, না, স্টোরের সবাই তো জানে ব্যাপারটা। ওরা সহজেই বুঝতে পারবে কাজটা আমি করেছি। তাই পেছনের সিটে বসিয়ে দিলাম শিশুটিকে। সিট বেল্ট বেঁধে, কম্বল দিয়ে ঢেকে সামনে এসে গাড়ির ইঞ্জিন চালু করলাম।
গাড়ি চালিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে গ্রামের দিকটায় যেতে পারতাম আমি। কোনও একটা নির্জন জায়গায় কারও দরজার সামনে বা দোকানের সামনে রেখে এলে, পরে কেউ ওকে দেখে শিশুটির সত্যিকারের বাবা-মায়ের সন্ধান করে ফেরত দিতে পারত। এরকম হলে কেউ আমাকে দেখতে পেত না, তাই কেউ আমাকে বলতেও পারত না যে আমি শিশুটিকে পরিত্যাগ করে চলে গেছি।
অথবা সোজাসুজি পুলিশের কাছে দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে জটিলতা আরও বাড়ত। তারা ভাবত, শিশুটিকে আমি চুরি করেছি। কারণ সুপার মার্কেটে অনেকেই দেখেছে ওকে আমি নিজের বাচ্চা বলে ওখান থেকে নিয়ে এসেছি।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ইতোমধ্যেই অনেক দেরি করে ফেলেছি কাজে যেতে।
তাই আমি বাগানের মধ্য দিয়ে মোটরওয়ে ছাড়িয়ে প্রথম বাম দিকের মোড়টা নিলাম, যাতে নির্জন কোনও জায়গা দেখলে শিশুটিকে রেখে যাব। এরপর আবার শহরের দিকে ফিরব, এজন্যই ভেতরের দিকে লেইনে গাড়ি চালাতে থাকলাম যাতে গ্রামের দিকের পথচিহ্ন চোখে পড়ে।
তুমি সত্যিই একটা ফালতু গাড়িচালক―কেউ একজন বলে উঠল পেছনের আসন থেকে। তোমার জায়গায় হলে আমি অনেক ভালো গাড়ি চালাতে পারতাম। তুমি কি সেই সব ফালতু নারী গাড়িচালকদের প্রতিনিধিত্ব করো ? কিংবা সেই সব নারীদের একজন যারা ফালতুভাবে গাড়ি চালায় ?
আরে, পেছন থেকে ওই বাচ্চাটাই কথা বলল। এমন করে সে কথা বলল, আমার হাসি পাচ্ছিল শুনে। ওর আওয়াজ এত মিষ্টি এবং স্পষ্ট ছিল যেন সুরেলা ঘণ্টা বেজে উঠল কোথাও। সে এত জটিল শব্দগুলো এত নির্মলভাবে উচ্চারণ করল, শুনতে মনে হলো অনেক প্রাচীন, যেন এইমাত্র সে শব্দগুলো শিখেছে আর আমাকেই পেল সেগুলো বলবার জন্য।
আমি সজোরে গাড়িটাকে মোটরওয়ের দিকে ঘুরিয়ে ইঞ্জিন থামিয়ে দিলাম। আমার আসনটা পেছনে হেলে দিয়ে দেখলাম, শিশুটি কম্বলের মধ্যে অসহায়ের মতো শুয়ে আছে, সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থায়। সে যে কথা পর্যন্ত বলতে পারে, এমনটা মনে হচ্ছিল না। বড়জোর এক বছর বয়স হতে পারে, এমনটাই দেখতে সে।
খুব মিষ্টি এবং অতিপ্রাকৃত স্বরে বাচ্চাটা বলল, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা আর বিদেশিরা আমাদের দেশে এসে সকল কাজ আর সুবিধা নিয়ে ফেলছে। অতি সত্বর ওদেরকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো জরুরি।
ইংরেজি ‘এস’ বর্ণটি সে অস্ফুট উচ্চারণে বলছিল, যখন বলল এসাইলাম, সিকার্স, ফরেনার্স, জবস, বেনিফিটস এবং সেন্ট।
কী ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
কেন, শুনতে পাওনি, কানে তুলো গুঁজে রেখেছ ? সে বলল, যারা সত্যিকারের ইংলিশ নয় তারাই সন্ত্রাসী। এরাই সুযোগ বুঝে ফুটবল স্টেডিয়ামে ঢুকে খ্রিস্টিয়ানদের বোমায় উড়িয়ে দেয়, যারা ইংলিশ দলদের সমর্থন জানাতে আসে ওদেরকে।
কথাগুলো ওর লাল-লাল মুখ থেকে বেরিয়ে এল। ঠিক তখনি ওর সদ্য উঠতে থাকা দাঁতটা এক মুহূর্তের জন্য দেখলাম আমি।
সে আরও বলল, পাউন্ড হলো আমাদের অধিকারগত ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্যকে আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। নারীরা যারা সন্তান উৎপাদন করে, ওদের বাইরে কাজ করা উচিত নয়। এমনকি, নারীদের কাজ করারই প্রয়োজন নেই। এটা প্রাকৃতিকভাবে সঠিক কাজ নয়। যেমন ঠিক নয় সমকামী বিবাহ।
আমাকে হাসিয়ো না আর।
এবার সে উচ্চস্বরে হেসে উঠল, হাসিটা অনেক সুন্দর, যেন আমার জন্যই হাসল। ওর নীল বড়-বড় চোখগুলো দিয়ে সোজা ও আমার দিকে তাকাল; যেন এত সুন্দর কিছু আগে দেখেনি।
আমার অনেক ভালো লাগছিল। আমিও ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম।
কোথা থেকে যেন একটা কালো মেঘ সূর্যকে ঢেকে দিয়ে ছিটকে এসে পড়ল। মনে হলো ওর চোখে আর পায়ে এসে লাথি মারল। তখন শিশুটি একটা হাত কম্বলের বাইরে বের করে নাড়তে লাগল আর আরেকটি হাত দিয়ে কম্বল মুঠি করে ধরে চিৎকার দিয়ে কাঁদতে শুরু করল।
শিশুটি ক্ষুধার্ত ছিল। আমি কী মনে করে আমার শার্টের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বোতাম খুলতে লাগলাম। বোতাম খুলতে খুলতে ভাবছিলাম, এলাকার কোনও ভালো স্কুলে ওকে ভর্তি করানো যায়।
তারপর গাড়ি ঘুরিয়ে আমি বাড়ির দিকে রওনা হলাম। এবং সিদ্ধান্ত নিলাম সুন্দর এই শিশুটিকে নিজের কাছে রাখব। আমি ওকে খাওয়াব। ওকে ভালোবাসব। আমার প্রতিবেশীরা অবাক হয়ে ভাববে, আমি হয়তো আমার গর্ভাবস্থা লুকিয়ে শিশুটিকে জন্ম দিলাম। ওরা নিশ্চয়ই ওকে এই এলাকার সবচেয়ে সুন্দর শিশু হিসেবে ভাববে। আমার বাবা তার কোলে বসিয়ে ওকে আদর করবে। প্রায় সময় বাবা বলত, ‘তুমি হয়তো কখনও আমাকে নানা হতে দেবে না। কিন্তু এখন আমি শান্তিতে মরতে পারব।’
শিশুটি সুরেলা স্বরে ইংরেজি ‘আরপি’ বর্ণটা যেভাবে নিখুঁত উচ্চারণ করছিল, আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম, সে একটা চমৎকার পাবলিক স্কুলে গিয়ে শিখেছে কীভাবে এত সঠিকভাবে কথা বলা যায়।
মেয়েরা কেন বিয়ের দিন সাদা পোশাক পরে ? গাড়ির পেছনের আসন থেকে বলে উঠল সে।
কী বলতে চাইছ তুমি ?
আমি বলছি, মেয়েরা কেন সাদা পোশাক পরে বিয়ের সময়ে ? সে আবারো বলল।
কারণ, সাদা রঙটা পবিত্রতার প্রতীক। আমি বলতে থাকলাম, সাদা রঙটা…বাড়িতে ফিরে চুলা আর ফ্রিজের সাদা রঙের সঙ্গে বাকি জীবন ঘরকন্নার কাজে নিজেকে মিলিয়ে নিতে―শিশুটি আবার বলে উঠল আমার কথার মাঝখানে। শোনো, একজন ইংলিশ, একজন আইরিশ, একজন চায়নিজ এবং একজন ইহুদি অতলান্তিক মহাসাগরের উপরে বিমানে উড়ছিল।
কী বলছ তুমি এসব ? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
নিষ্পাপ কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করল, মেয়েদের সোনা এবং যোনির মধ্যে পার্থক্য কী জানো ?
বিরক্ত হয়ে বললাম, তোমার ভাষা ঠিক করো।
আমার শাশুড়িকে একটা চেয়ার কিনে দিয়েছিলাম কিন্তু তিনি সেটায় বসতে অস্বীকৃতি জানালেন। আমি বলছি না যে তিনি অনেক মোটা। কিন্তু তাকে কিছুতেই ম্যালকম এক্স টিশার্ট কেনা থেকে থামাতে পারতাম না। জানো তো, হেলিকপ্টার ভুল করে তার উপরে ল্যান্ড করার চেষ্টা করত।
গত কুড়ি বছরে কোনও মোটা শাশুড়িকে নিয়ে বলা এমন হাসির কৌতুক আমি শুনিনি। না হেসে পারলাম না।
আচ্ছা, ঋতুস্রাব হয়নি এমন নারীদেরকে কেন তারা ইরাকে পাঠিয়েছিল যুদ্ধ করতে ? কারণ তারা চারদিন পর্যন্ত জল ব্যবহার না করে কাটাতে পারত। একজন ইরাকিকে তুমি কী নামে ডাকবে যে মাথায় একটা কাগজের ব্যাগ বেঁধে রাখে ?
ঠিক। আমিও ঠিক এটাই ভাবি।
আমি গাড়িটা ব্রেক করে ভেতরের লেইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। আর শুনলাম পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়িগুলো জোরে হর্ন বাজিয়ে চলে গেল। আমি হ্যাজার্ড আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম আর দেখলাম শিশুটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
রাজনৈতিকভাবে বললে তুমি সঠিক আছ। পেছন থেকে সে বলল। তুমি একজন ভয়ংকর ড্রাইভার। একজন নারী কিভাবে এমন অন্ধ হয় উইন্ডস্ক্রিনটাকে সামনে রেখে ?
হা হা। এটা অনেক পুরনো।
আবার আমি বি রোডটা ধরে ডেন্স-উডের মধ্যে দিয়ে গাড়ি নিয়ে এগোলাম। পেছনের দরজা খুলে বাইরে বের করলাম সোনালি চুলের শিশুটিকে। এরপর গাড়ি লক করে বাচ্চাটাকে নিয়ে আধা মাইল হেঁটে এলাম। একটা ছায়াঢাকা জায়গা পেয়ে গাছের নিচে কম্বল জড়িয়ে ওখানে রেখে দিলাম শিশুটিকে।
জানো তো, আমি আগে এসেছিলাম এ জায়গাটায়। ‘এস’ আমার প্রথমবার নয়। বাচ্চাটি বলে উঠল।
বিদায়। আমি আশা করছি, বন্য পশুরা তোমাকে খুঁজে পাবে এবং ভালোমতই লালন করবে। এটা বলে গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম।
কিন্তু সারা রাত কিছুতেই ঘুমাতে পারলাম না। খালি মনে হচ্ছিল, শিশুটি ওই বনের মধ্যে ঠান্ডার ভেতরে অসহায় কষ্ট পাচ্ছে। কিছুই খাবারদাবার নেই আর কেউ তো জানেই না যে সে ওখানে আছে।
ভোর চারটের দিকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। পায়চারি করতে থাকলাম ঘরের মধ্যে। এরপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম সেখানটায়, যে বনের মধ্যে ওকে রেখে এসেছিলাম। গাড়ি পার্ক করে আধা মাইল হেঁটে ওই গাছটার কাছে গেলাম আবার।
গিয়ে দেখি, ঠিক যেখানটায় বাচ্চাটাকে রেখে গিয়েছিলাম, ও সেখানেই আছে, কম্বলে জড়ানো অবস্থায়।
অযথাই তোমার সময়টা গেল। আমি ভালো আছি। ধন্যবাদ জিজ্ঞেস করবার জন্য, বাচ্চাটি বলল। আমি জানতাম তুমি ফিরে আসবে। নিজেকে আটকাতে পারবে না।
আমি শিশুটিকে আবার গাড়ির পেছনের আসনে রাখলাম।
আমরা আবার যাচ্ছি তাহলে। এবার কোথায় যাব ? জিজ্ঞেস করল সে।
আন্দাজ করো তুমি।
আমরা কি এমন কোথাও যেতে পারি যেখানে ব্রডব্যান্ড বা ওয়াইফাই আছে, যাতে পর্ন দেখতে পারি আমি ? খুব সুন্দর করে এ কথাটি বলল সুন্দর শিশুটি।
গাড়ি চালিয়ে পরের শহরে সামনেই যে সুপারশপটি পেলাম সেখানে গিয়ে গাড়ি পার্ক করলাম। তখন সকাল পৌনে ছটা বাজে।
দারুণ! বাচ্চাটি বলল, আমি এই প্রথমবার ২৪ আওয়ার টেসকোতে এলাম। এর আগে আসডা বা অয়েট্রওজে গেছি, কিন্তু টেসকো আসিনি।
আমি আমার টুপির সামনের দিকটা এমনভাবে নামিয়ে নিলাম যাতে সিসিটিভিতে আমাকে চেনা কঠিন হয়। এবার কম্বলে জড়ানো বাচ্চাটিকে নিয়ে ‘বাহির’ লেখা পথ দিয়ে ভেতরে গেলাম, ওই পথ দিয়ে দুজন মানুষ বের হচ্ছিল তখন।
সে সময় সুপারমার্কেটে বেশ কিছু মানুষজন কেনাকাটা করছিল। কেমন চুপচাপ পরিবেশ ওখানে। আমি ঢুকে বিস্কুটের আইলের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই একটা অর্ধেক-ভর্তি ট্রলি পেলাম, সেখানে ফ্রেঞ্চ বাটার, ইটালিয়ান অলিভ ওয়েল, আর গার্ডিয়ানের পত্রিকার নতুন সংখ্যাটা ভাঁজ করে রাখা ছিল। বাচ্চাটাকে আমি কম্বল থেকে বের করে ওই ট্রলিটার মধ্যে বসিয়ে দিলাম। বসানোর সময়ে ওর পা দুটো বেবিসিটের ফাঁক দিয়ে ঢুকে গেল।
বিদায় এবং শুভকামনা রইল তোমার জন্য। এবার আমি যাই, বললাম শিশুটিকে। এবার নিশ্চয়ই তুমি যা চাইছ তা পাবে।
আমি জানি তুমিও যা চাইছ পাবে, বাচ্চাটি আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, যাতে আশপাশে আর কেউ শুনতে না পায়। হিসহিস আওয়াজে বলল, কোনও মহিলার যদি দুটো ব্রেইন সেল থাকে, তাকে কী বলে ? গর্ভবতী! বাজার করার জন্য এই ট্রলিগুলো কেন আবিষ্কার হয়েছিল ? মহিলারা যাতে পেছনের পা দিয়ে হাঁটা শিখতে পারে ?
বলেই সে তার শিশুসুলভ চাহনি দিয়ে সুন্দর করে হাসতে শুরু করল। আমি দেরি না করে ওই আইলের পাশ থেকে সরে গিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। পাশে দেখলাম, দোকানের মেয়েটি সকালের ট্যাবলয়েডের বোঝাটার দড়ি কেটে পত্রিকাগুলো শেলফে সাজিয়ে রাখছে। আমি পার্কিং থেকে বেরিয়ে যেতেই শুনলাম তখন ইংল্যান্ডের চার্চগুলোতে সকালের ঘণ্টা বাজছে। ব্রিটিশ পাখির সঙ্গীত নতুন দিনকে আহ্বান করছে আর ঈশ্বর তখন স্বর্গে, জগতের মঙ্গল হচ্ছে।
সচিত্রকরণ : রজত