অনুবাদ গল্প : রূপান্তর

মূল : বিরহিলিও পিনিয়েরা
বাংলা অনুবাদ : বিকাশ গণ চৌধুরী
[বিরহিলিও পিনিয়েরা (৪ আগস্ট, ১৯১২ – ১৮ অক্টোবর, ১৯৯৭)। কুবা বা আমাদের চালু কথায় ‘কিউবা’-র এই লেখক একাধারে নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্প লেখক, কবি ও প্রাবন্ধিক। পিনিয়েরা তাঁর নাটকের কারণে বিখ্যাত হলেও তাঁর অনুরাগীরা তাঁর ছোটগল্প ও কবিতাগুলোকেই নাটকের ওপর স্থান দেন। পিনিয়েরা ১৯৪০ সালে আর্জেন্তিনায় চলে যান, সেখানে তাঁর পরিচয় হয় বোর্হেসের সঙ্গে, বোর্হেসের ঝঁৎ (সুর) পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। তারপর ১৯৫৭ সালের বিপ্লবের পর দেশে ফেরেন, কিন্তু ১৯৬১ সালেই ‘রাজনৈতিক এবং অনৈতিকতা’র অপরাধের নামে তাঁকে জেলে পোরা হয়। জেল থেকে ছাড়া পাবার পর একজন প্রান্তিক মানুষ হিসেবেই বাকি জীবনটা কাটান। যদিও ১৯৬৯ সালে তাঁর ‘দুটি প্রাচীন আতঙ্ক’ নাটকের জন্য কুবার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার ‘কাসাদু লাস আমেরিকা’ পান। পিনিয়েরার লেখায় এক কল্পজগতের পাশাপাশি আমরা পাই এক মানসিক বৈকল্যের জগৎ; আর এসবের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা নানা রাজনৈতিক ভাষ্যের। তাঁর গল্পসংগ্রহ ঠান্ডা কাহিনি-র অন্তর্ভুক্ত এরকমই একটি গল্প আপনাদের সামনে রাখা গেল। গল্পটির রচনাকাল ১৯৪৭ এর কোনও একটা সময়।]যমজ বাচ্চা দুটো যখন তাদের ছ-বছরের জন্মদিন পালন করছিল তখনই তাদের বাবা-মা বাচ্চা হয়ে গেল।
তবে এটা ঠিক যে এই রূপান্তর ঘটে যাবার আগে গোটা কতক ঘটনা অবশ্যই ঘটেছিল; কয়েকটা ছাড়া―বলা যায়―প্রত্যেকটাই অস্বাভাবিক।
কিন্তু সেসব ঘটনা ও দৃশ্যপট নিয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলার আগে এটা অবশ্যই বলা উচিত যে এই যমজ বাচ্চাগুলো জন্মাবার আগে তাদের বাবা-মা দুজনেই খুব স্বাভাবিক মানুষ ছিল।
দারুণ স্নেহশীল, যারা যমজ বাচ্চা হওয়ায় নিজেদের ঈশ্বরের আশীর্বাদধন্য মনে করত।
তারা বলত : ‘এরকম সৌভাগ্য অল্প কিছু বাবা-মায়ের কপালেই জোটে।’
যেদিন বাচ্চা দুটো জন্মাল সেদিন ওদের মা ধাইকে বলেছিল, ‘তুমি জানো না আমি ওই বাচ্চাদুটোকে কী পরিমাণ হিংসে করি, আমার কেবলই মনে হয় : ইস, আমি যদি ওদের একটা হতুম।’
শুনে ধাই হাসতে হাসতে দৌড়ে বাচ্চাদের বাবাকে মায়ের সেই গোপন কথা বলতে গেল।
কিন্তু ধাইকে অবাক করে দিয়ে নতুন বাবা তাকে বলল : ‘ও তো দেখছি আমার মনের কথাই ভাবছে।’
কিন্তু এ সমস্ত কথাই এমন ভঙ্গিতে বলা যে সেটাকে খুবই মজার একটা ব্যাপার বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।
বাচ্চা দুটোর এক বছর বয়স হলে খুব বড় করে পার্টি দিয়ে তাদের জন্মদিন উদযাপিত হলো।
বাচ্চাগুলোকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার দিন তাদের ধর্ম বাপ-মা যখন তাদের পবিত্র জলের পাত্রের সামনে তুলে ধরল তখন বাচ্চাদের বাবা-মা তাদের নিজেদের মাথায় সে জল ছেটাল।
জন্মদিনের গল্পটা বলি : সময় এল জন্মদিনের কেকের ওপর রাখা দুটো জ্বলন্ত মোমবাতি নেভানোর।
ধর্ম বাপ-মা আর মাসি-পিসিরা মিলে বাচ্চা দুটোকে মোমবাতির সামনে ধরে কীভাবে ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাতে হবে সেসব বোঝাতে লাগল। কিন্তু এই ফাঁকে বাচ্চাদের বাবা-মা ফুঁ দিয়ে মোমবাতি দুটো নিভিয়ে দিল।
ব্যাপারটা সেভাবে কারও নজরেই এল না। সবাই এটাকে অস্বাভাবিক না ভেবে স্বাভাবিক একটা ঘটনা বলেই গ্রহণ করল, আর সবাই এতে খুব হাসতে লাগল। তারপর আবার সেই দুটো মোমবাতি জ্বালানো হলো, বাচ্চাদুটো ফুঁ দিয়ে সেগুলো নেভাল, আর স্বাভাবিকভাবেই পার্টি চলতে লাগল।
কয়েক দিন পর আর্তুরো (যমজ ছেলে বাচ্চাটা)-র ধর্ম-বাপ ওকে একটা খেলনা রাইফেল উপহার দিল আর ওলগা (যমজ মেয়ে বাচ্চাটা)-র ধর্ম-মা ওকে দিল একটা পুতুল।
কিন্তু ওরা চলে যেতে না যেতেই ওলগা আর আর্তুরোর বাবা-মা খেলনাগুলো উধাও করে দিল।
পরে ওই ধর্ম বাপ-মা খেলনাগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলে ওরা বলল যে, বাচ্চারা খেলনাগুলো ভেঙ্গে ফেলেছে, আর তারপরই অনেক অনুনয় বিনয় করে বলল যে ওরা যেন আর কোনওদিন ওদের কোনও খেলনা উপহার না দেন।
দ্বিতীয় বছরের জন্মদিন এল; এল চারটে মোমবাতি জ্বালানো আরেকটা কেক। গত বছরের ঘটনাটাই ফিরে ঘটল। আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা নিজেদের মধ্যে গুজগুজ-ফুসফুস করতে লাগল, যদিও তারা চাইছিল পরিবেশটা স্বাভাবিক থাক। তৃতীয় বছরে―আগের বছর দুটোর কথা মনে রেখে বাচ্চাদুটো প্রতিবাদে চেঁচিয়ে উঠল, কিন্তু তাদের ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না তাদের বাবা-মায়ের ছটা মোমবাতি নেভানোর ফু-এর মধ্যেই হারিয়ে গেল। তিন বছরের বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক কিছুই করা যায়।
এরপর ওলগাকে তার মা কীভাবে যন্ত্রণার দেবী হয়ে উঠতে হয় তা শেখাতে লাগল, দিন-রাত ও মুখ চুন করে বাড়ির অন্ধকার অন্ধকার ঘরগুলোয় ওর ছোট ছোট হাতে-পায়ে, বুকে ঘষে ঘষে ঘুরত। আর অনেকটা লুশিয়া দি ল্যামারমুর ট্রাজিক অপেরার লুশিয়ার মতো আর্তচিৎকার করত। উল্টাদিকে তাদের বাবা আর্তুরোকে নেপোলিয়ন তৈরি করছিল, ওয়াটার লুর যুদ্ধের নেপোলিয়ান, সবকিছু থেকে মোহভঙ্গ হওয়া, কথা বলতে অনিচ্ছুক, হঠাৎ করে বুড়া হয়ে যাওয়া এক নেপোলিয়ান।
শৈশবের জীবনীশক্তি আর সারল্যের কারণে আর্তুরো জানতেও পারত না যে ও একটা হেরো নেপোলিয়ানের অনুকরণ করছে, আর ওলগাও বুঝতে পারত না যন্ত্রণার দেবীমূর্তি কী। কিন্তু… দিন কাটতে কাটতে যখন কয়েক বছর পার হয়ে গেল দেখা গেল ওসব কেমন তাদের স্বভাবে পরিণত হয়েছে। ওই চরিত্রগুলো বাচ্চাদুটোকে সম্পূর্ণ গ্রাস করে ফেলেছে। আর্তুরো চলনে বলনে একটাই ভাব ফুটিয়ে তুলতে পারে: সেটা হলো হাত দুটো পিছনের দিকে রেখে দাঁড়ানো। আর ওলগা এমন করে আঁ-আঁ করে যে তা বুকের মধ্যে গিয়ে বেঁধে।
এ কথা বলার বোধহয় আর প্রয়োজন নেই যে এরপর থেকে বাচ্চাদের জন্মদিন পালন করাটাই উঠে গেল। এরপর একদিন একটা সুন্দর সকালে বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের দেশের বাড়িতে চলে গেল।
তারপর সেখানে শুরু হলো বাবা-মায়ের রূপান্তর। যেমন ওলগার মা তাকে তাদের বিয়ের বিশাল খাটে ঘুম পাড়িয়ে শোয়ালো যাতে সে নিজে তার বাচ্চার ছোট্ট খাটটায় শুতে পারে। আর্তুরোকে শোয়ানো হলো একটা ক্যাম্প খাটে যাতে ওর বাবা ওর ছোট্ট বিছানাটাতে শুতে পারে। ওরা বাচ্চাদের মতো ঘ্যানঘ্যান করে ঘুম থেকে উঠতে লাগল। বাচ্চাদের মতো বিছানা ভেজাতে লাগল। তারপর ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে গিয়ে নিজেদের জন্য দুধ গুলে দুধের বোতলে ভরে বাচ্চাদের মতো চুকচুক করে খেতে লাগল।
আর বাচ্চারা তারা যে ভূমিকায় অভিনয় করছে সেই চরিত্রের মতো খাবার খেতে পেল: আর্তুরোকে দেওয়া হলো করকরে টোস্ট করা পাউরুটি; ওলগা পেল মৌরিফুলের মদ।
এর কিছুদিন পর বাবা-মা বড়দের মতো করে কথা বলা বন্ধ করে দিল। এখন ওরা আধো আধো স্বরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা উল্টাপাল্টা শব্দে কথা বলে। আর উল্টোদিকে ওলগা ওর আঁ-আঁ! আর্তনাদটা চালিয়েই যাচ্ছে; আর তার সঙ্গে আর্তুরো যোগ করছে একটা ওহ! আমি জানি না নেপোলিয়ান কখনও ওরকম ওহ! বলতেন কি না।
বাচ্চাদের দশম জন্মদিনের দিন তাদের বাবা-মা বাচ্চাদের নিয়ে তাদের পোঁদ পৌঁছাল। বাবা-মা দুজনেই তাদের প্যান্ট আর ডায়াপার নোংরা করে ফেলেছিল। এভাবেই আর্তুরো আর ওলগার বাবা-মা তাদের শৈশব শুরু করল।
এভাবে দিন কাটতে কাটতে অনেকগুলো বছর কেটে গেল। পার হয়ে গেল কুড়িটা বছর। কেউ একটা নালিশ ঠোকার পর পুলিশ সেই দেশের বাড়িতে হঠাৎ উদয় হলো। বাড়িতে ঢুকে বার করে আনল চারটে হাবা লোক : দুটো বুড়া-বুড়ি আর দুটো বাচ্চা। বাচ্চাগুলো কেবলই বলে চলল তারা একজন যন্ত্রণার দেবী, আরেকজন নেপোলিয়ান; আর বুড়ো-বুড়ি বলে চলল, ওলগা আর আর্তুরো তাদের বাবা-মা।
সচিত্রকরণ : শিকদার সৈকত