অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : তুষারপাত

মূল : হান কাং

বাংলা অনুবাদ : বিনয় বর্মন

[হান কাং-এর জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে, ২৭ নভেম্বর ১৯৭০ সালে। তিনি ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এর পূর্বে তিনি ২০১৬ সালে তার ভেজিটেরিয়ান উপন্যাসের জন্য ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তাঁর অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য―দ্য হোয়াইট বুক, হিউম্যান অ্যাক্টস, গ্রিক লেসনস, আই ডু নট বিড ফেয়ারওয়েল এবং স্কার্স। উপন্যাস ছাড়াও তিনি অনেক ছোটগল্প ও কবিতা লিখেছেন।

এই বঙ্গানুবাদটি করা হয়েছে গল্পের ইংরেজি ভার্শন Heavy Snow থেকে। গল্পটি মূল কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ই. ইয়োন এবং পেইজ আনিয়া মরিস। ইংরেজি গল্পটি নিউ ইয়র্কার পত্রিকায় ২০২৪-এর ১৮ নভেম্বর সংখ্যায় ছাপা হয়।]

ইনসিয়নের পুরো মেসেজটি হলো এই : আমার নাম।

আমি যে-বছর স্নাতক হই সে-বছর তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমি একটি সাময়িকীতে কাজ শুরু করেছিলাম, যেখানে লেখকরা নিজেদের ছবি নিজেরা তুলত। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার ও ভ্রমণসংক্রান্ত লেখার জন্য আমাদেরকে বিশেষ ফ্রিল্যান্সারদের সঙ্গে যেতে হতো। সড়কপথে যাওয়া মানে অতিথির সঙ্গে কমপক্ষে তিন রাত চার দিন কাটানো। এজন্য আমার সহকর্মীদের উপদেশ হলো, নারী হলে নারীর সঙ্গে এবং পুরুষ হলে পুরুষের সঙ্গে জোট বাঁধো। ইনসিয়নের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আগে আমি কয়েকটি ফটো প্রডাকশন হাউসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। ইনসিয়ন আমার সমবয়সী। পরের তিন বছর, সাময়িকীর কাজে ইস্তফা দেওয়ার আগ পর্যন্ত, ইনসিয়ন ও আমি একসঙ্গে মাসিক অ্যাসাইনমেন্টগুলো সারতাম। এখন হিসাব করে বলা যায়, আমাদের বন্ধুত্ব দুই দশকের অধিক। তার অধিকাংশ অভ্যাস আমার অবগত। যখন সে আমার সঙ্গে আলাপের সূত্রপাত করত, তখন বুঝতাম, এমনি এমনি কথা বলা নয়, বরং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোনও আলোচনা আছে।

হাই, সবকিছু ঠিক আছে তো ? উত্তর দেওয়ার জন্য আমি হাত থেকে উলের দস্তানাটি খুলি এবং অপেক্ষা করতে থাকি। আমি আবার দস্তানা পরি এবং তখনই আরেকটি টেক্সট আসে।

এখনই আসতে পারবে ?

ইনসিয়ন এখন আর সিওলে বাস করে না। সে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। মায়ের বয়স যখন চল্লিশের কাছাকাছি তখন তার জন্ম। ফলে সে মায়ের বয়সী দুর্বলতাগুলো দেখেছে। আট বছর আগে সে তার মায়ের যত্ন নিতে পাহাড়ি গ্রাম জেজুতে ফিরে গেছে। তার মায়ের তখন স্মৃতিভ্রংশ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিয়েছে। এর চার বছর পর সে তার মাকে হারায়। এরপর থেকে সে নিজে ঐ বাড়িতে বসবাস করে আসছে। ইনসিয়নের চলে যাওয়ার আগে সে ও আমি একে অপরের বাসায় গিয়ে রান্নাবান্না ও খাওয়াদাওয়া করেছি। কিন্তু সে দূরে চলে যাওয়ার কারণে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ ক্রমে কমতে থাকে। অবশেষে, অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে বছরে একবার কি দুইবার দেখা হয়। গত বছর শরতে একবার জেজুতে গিয়েছিলাম। তার সঙ্গে চার দিন ছিলাম, সাদামাটা কাঠ-পাথরের বাড়িতে। সে তার ছোট সাদা একজোড়া বাজরিগার পাখির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এগুলোকে সে দুই বছর আগে বাজার থেকে কিনেছে। পাখিগুলো দু-একটি সহজ শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। উঠান পেরিয়ে সে আমাকে তার কাঠের কাজের কারখানায় নিয়ে যায়। এখানে সে দিনের অধিকাংশ সময় কাটায়। সে তার বানানো একটি চেয়ার দেখাল। এটি কাঠ চেঁছে মসৃণ করে জোড়া ছাড়াই তৈরি করা হয়েছে। সে বলে, বসে দেখো কেমন আরাম। পরে সে চুলায় কেটলি বসায় এবং আমাকে মালবেরি ও র‌্যাস্পবেরি দিয়ে অম্লস্বাদের চা বানিয়ে খাওয়ায়। আমি চা মুখে দিয়ে উশখুশ করতে থাকি। আর ইনসিয়ন জিন্স ও কাজের জুতা পরে বোর্ডের ওপর যন্ত্রপাতি দিয়ে মাপজোক করতে থাকে। তার চুল মাথার পিছনে শক্ত করে বাঁধা, কানে কলম গোঁজা, অনেক টিভি তথ্যচিত্রে যেমনটা দেখা যায়।

বোধ করি সে জেজুতে যাওয়ার কথা বলছে না। তুমি কোথায় ? টেক্সট পাঠিয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করি। সে সিওলের একটি হাসপাতালের নাম বলে। আমি এটি চিনি না। তারপর আবার সেই প্রশ্ন :

এখনই আসতে পারবে ?

তারপর আরেকটি বার্তা :

আইডি নিয়ে এসো।

প্রথমেই আমার চোখে পড়লো ময়লা ব্যানারে কালো অক্ষরে লেখা ‘দেশের সবচেয়ে সেরা’। আমি হাসপাতালের প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে যাই। ভাবছিলাম, কেন এখানকার ছুরিচিকিৎসা সবচেয়ে সেরা। আমি তো আগে এদের ব্যাপারে কিছু শুনিনি। ঘোরানো দরজা ঠেলে স্বল্পালোকিত একটি লবিতে এসে পড়লাম। একটি দেয়ালে দেখলাম হাত-পায়ের কিছু ছবি। হাত-পায়ে আঙুল নেই। জানি আমার স্মৃতিতে এগুলো বিকৃত হয়ে আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে। আমি জোর করে সেগুলোর দিকে তাকাই। যতই কাছ থেকে দেখি সেগুলো অধিক যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। আমার চোখ অনিচ্ছাকৃতভাবে পরের ছবিগুলোর ওপর গিয়ে পড়ে। একইরকম হাত-পা, তবে এগুলো আঙ্গুলের সঙ্গে সেলাই করা। সেলাইয়ের দু পাশের প্রত্যঙ্গের চামড়ার রঙ ভিন্ন।

আমার মনে হচ্ছিল, ইনসিয়ন হয়তো তার কারখানায় কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার পড়েছে। সেজন্যই হয়তো তাকে এখানে আসতে হয়েছে।

কিছু লোক সক্রিয়ভাবে তাদের জীবনের ধারা পরিবর্তন করে। তারা এমন কিছু বেছে নেয় যা অন্যেরা স্বপ্নেও কল্পনা করে না। এভাবে তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত ও পরিণতির ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে-সময় তাদের জীবনপথ যাই হোক না কেন, লোকজন আর তাতে আশ্চর্য হয় না। কলেজে ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনার পর ইনসিয়ন প্রায় এক দশক তার পেশায় লেগে থাকে। তারপর জীবন-জীবিকার জন্য সে এটা-সেটা নানা কাজ করতে থাকে। কিন্তু তার দরিদ্রাবস্থা আর ঘোচে না। সে কম খায়, কম খরচ করে। লাঞ্চ তার একেবারে সাদামাটা, কোনও মেকআপ নেই, কাঁচি দিয়ে নিজের চুল নিজেই কাটে। আশ্চর্যজনকভাবে, এসব তার অভ্যাসে পরিণত হয়, এবং নিজস্ব স্টাইল হয়ে দাঁড়ায়। আমি তখন জানতাম না, সে কার্পেন্ট্রি স্কুলে আবেদন করেছে এবং ভর্তি হয়েছে। জেজুতে আসার পরপরই ইনসিয়ন তার ভাঙ্গাচোরা ঘরটিকে, যেখানে আগে ফসল রাখা হতো, ওয়ার্কশপ বানিয়ে ফেলে। তারপর সেখানে সে আসবাবপত্র বানানো শুরু করে।

ইনসিয়নের গড়ন হালকাপাতলা, লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। আমাদের বয়স যখন বিশের কোঠায়, আমি তাকে ক্যামেরার নানা সরঞ্জাম বহন করতে দেখেছি। তার শরীর কাজের জন্য দুর্বল নয়, তবু তার পেশাপছন্দ দেখে আমি অবাক হয়েছি। সে শরীরে আঘাত পেলে আমি দুশ্চিন্তায় পড়তাম। তার মা মারা যাওয়ার পরের একটি ঘটনা। ইলেকট্রিক গ্রাইন্ডারে তার জিন্স আটকে গিয়েছিল এবং তার ঊরুতে ত্রিশ সেন্টিমিটার ক্ষত তৈরি হয়েছিল। হাসতে হাসতে সে আমাকে পরে বলেছে, আমি গ্রাইন্ডার থেকে জিন্স টেনে বের করার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি। ওটা কেবল ঘড়ঘড় করে ঘুরেছে, দৈত্যের মতো। দু বছর আগে কাঠের আঘাতে তার তর্জনী ভেঙ্গে যায় ও রগ কেটে যায়। এ থেকে সেরে উঠতে তার ছয় মাস লেগেছিল।

কিন্তু এবার আরও খারাপ কিছু ঘটেছে। নিশ্চয়ই তার কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাটা পড়েছে।

ইনসিয়ন!

আমি তার নাম ধরে ডাকি। একটি ছয় বেডের রুমের শেষপ্রান্তে সে শুয়ে আছে। আমি প্রবেশ করার সময় সে উদ্বিগ্নভাবে কাচ-দরজার দিকে তাকায়। সে যে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল তা নয়। সম্ভবত জরুরিভাবে তার একজন নার্স বা ডাক্তার দরকার ছিল। তারপর হঠাৎ করেই সে দেখে আমি দরজা দিয়ে ঢুকছি। আমাকে দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়, তারপর বুজে আসে। তার চোখ যেন অন্ধকার আকাশে দুটো বাঁকা চাঁদ।

তুমি এসেছ, সে বলে।

তার বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আমি বলি, কী হয়েছে ?

ঢিলাঢালা পোশাকের আড়াল থেকে তার কণ্ঠের হাড় বেরিয়ে এসেছে। তার শরীর দুর্বল হলেও চেহারা অতটা রোগা দেখাচ্ছে না। তার শরীর ফুলে গেছে বলে হয়তো এমন দেখাচ্ছে।

বৈদ্যুতিক করাতে আমার আঙ্গুল কাটা পড়েছে। ইনসিয়ন ফিসফিস করে এমনভাবে বলে যেন তার শ্বাসতন্ত্রীতে চাপ না পড়ে। এতে এমন ধারণা জন্মে যে তার আঙ্গুল নয়, গলা কাটা পড়েছে।

কী ? কখন ? আমি জিজ্ঞেস করি।

দুই দিন আগে।

সে তার হাতটি আস্তে আস্তে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, দেখতে চাও ?

আমি ভেবেছিলাম তার হাত পুরোপুরি ব্যান্ডেজ করা, কিন্তু তা নয়। তার তর্জনি ও মধ্যমার অগ্রভাগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, সেগুলো আবার জোড়া দেওয়া হয়েছে। সেলাইয়ের জায়গাগুলোতে রক্ত জমাট বেঁধে কালচে হয়ে আছে।

আমার চোখ পিটপিট করে।

দেখার মতো ব্যাপার, তাই না ? ইনসিয়ন বলে।

আমি তার চোখেমুখে এক ধরনের আত্মতিরস্কার লক্ষ করি।

খুব ঠান্ডা লাগলেও পাওয়ার টুলস চালানোর সময় হাতে কটন গ্লাভস লাগানো ঠিক নয়। এটা আমারই ভুল ছিল।

দরজা খোলার শব্দ শুনে ইনসিয়ন মাথা ঘোরায়। তার চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখে বুঝিতে পারি, এ সেই ব্যক্তি যার জন্য সে অপেক্ষা করছিল। বাদামি অ্যাপ্রন পরা ছোট চুলের এক মহিলা, যার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে, আমাদের দিকে এগিয়ে আসেন।

এ হচ্ছে আমার বন্ধু, ইনসিয়ন মহিলাকে জানায়। তারপর আমাকে বলে, তিনি আমার সেবাশুশ্রƒষা করছেন।

মহিলা হাসে এবং বলে, হ্যালো! সে হাতের তালুতে স্যানিটাইজার নেয় এবং দুহাত ভাল করে ঘষে। তারপর বিছানার পাশের টেবিল থেকে একটি অ্যালুমিনিয়াম বক্স নিয়ে তার কোলে রাখে।

মজার ব্যাপার কী জানো, ইনসিয়ন বলে, আমার এক প্রতিবেশী বয়স্ক মহিলার সেদিন হাসপাতালে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল এবং তার ছেলে তাকে নেওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে জেজুতে এসেছে।

ইনসিয়নের কথা বলার সময় অ্যালুমিনিয়াম বক্সটি খট করে খুলে যায়। বক্সের ভেতরে দুটি ভিন্ন সাইজের সিরিঞ্জ, এক বোতল অ্যালকোহল জীবাণুনাশক, এক টুকরো জীবাণুমুক্ত তুলা এবং একটি ছোট চিমটা এক সারে সাজানো।

ভদ্রমহিলা আমার জন্য এক বাকসো খাবারদাবার নিয়ে এসেছিলেন। কাজেই তারা আমার বাড়ির কাছে গাড়ি থামায় এবং আওয়াজ দেয়। কিন্তু তারা যখন দেখে আমার কোনও সাড়া নাই অথচ কারখানার লাইট জ্বলছে, তারা ভেতরে প্রবেশ করে। তারা আমাকে অচেতন অবস্থায় খুঁজে পায়। তারা প্রথমে রক্ত থামানোর চেষ্টা করে। তারপর ধরাধরি করে গাড়িতে তোলে এবং হাসপাতালে নিয়ে আসে। গাড়িতে যতক্ষণ ছিলাম, মহিলা আমার আঙ্গুলসহ গ্লাভসটি চেপে ধরে রাখে। যেহেতু আমাদের দ্বীপটিতে কোনও হ্যান্ড সার্জন নেই, তারা আমাকে ফ্লাইটে করে দ্রুত সিওলে নিয়ে আসে।

ইনসিয়নের ফিসফিসে কথায় ছেদ পড়ে। সেবিকা ইনসিয়নের রক্তমাখা সেলাই করা তর্জনীতে সুই ঢুকিয়ে দেয়। ইনসিয়নের হাত ও ঠোঁট যুগপৎ কাঁপতে থাকে। সেবিকা আরেকটি সুই অ্যালকোহল-ভেজা তুলা দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে দক্ষতার সঙ্গে নির্দ্বিধায় ইনসিয়নের মধ্যমায় ঢুকিয়ে দেয়। যে পর্যন্ত না সেবিকা সুইদুটো জীবাণুমুক্ত করে অ্যালুমিনিয়াম বক্সে না ভরে সে পর্যন্ত ইনসিয়ন চোখ বন্ধ করে রাখে। 

এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এটা নিশ্চিত করা যে রক্তপ্রবাহ যাতে বন্ধ না হয়, সে বলে।

যদিও সে ফিসফিসিয়ে কথা বলছিল, শব্দের মাঝখানে প্রায়শ স্বরধ্বনি এসে যাচ্ছিল। মনে হয় যন্ত্রণা চেপে রাখার চাপ থেকেই এটা হচ্ছিল।

যাতে ক্ষতের ওপরটা শক্ত হয়ে না যায় সেটা খেয়াল রাখতে হবে, সে কথা চালিয়ে যায়। তারা বলেছে যে রক্ত প্রবাহিত হতে দিতে হবে, এবং সে সঙ্গে যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। অন্যথায় ঘায়ের নিচে স্নায়ুগুলো শুকিয়ে যাবে। যাতে তেমনটা না ঘটে সেজন্য প্রতি তিন মিনিট পরপর আমরা এটা করি।

যদি স্নায়ু শুকিয়ে যায় তাহলে কী হবে ? আমি বোকার মতো প্রশ্ন করি।

হঠাৎ ইনসিয়নের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তার শিশুসুলভ উজ্জ্বলতা দেখে আমি মৃদু হাসি।

তাহলে জোড়া দেওয়া আঙ্গুলের অগ্রভাগ পচে যাবে।

আমি ইনসিয়নের আঙ্গুলের দিকে তাকাই। সেগুলো রক্তাক্ত, ফোলা ও কালচে। আমি দৃষ্টি সরিয়ে নিই, কিন্তু আমার চোখ গিয়ে পড়ে ইনসিয়নের চোখে।

সত্যি বলতে কী, আমি হয়তো আশা ছেড়েই দিব, কিয়ুঙ্গা।

কালো চোখের পাতার নিচে তার দৃষ্টি জ্বলজ্বল করে। কাটা আঙ্গুলগুলো জোড়া লাগানোর চেষ্টা না করাই ভাল ছিল। তাহলে ক্ষতস্থান সেলাই করে তাড়াতাড়ি আমরা জেজুতে ফিরে যেতে পারতাম।

আমি মাথা নাড়ি।

তুমি হাত দিয়ে কাজ করো, তাই নয় কি ? আমি বলি।

হ্যাঁ ঠিক কথা, সে বলে। যদি এখনও আমি জোড়া লাগানো থেকে বিরত হই, তাহলেও আমাকে ব্যথা সহ্য করে যেতে হবে।

আমি বুঝতে পারি, ইনসিয়ন অঙ্গ কেটে ফেলার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবছে। সম্ভবত প্রতি তিন মিনিটে সুই ফোটানোর সময় সে এটা ভাবে। ডাক্তাররা তাকে ভুতুড়ে যন্ত্রণার কথা বলেছে। এখন আঙ্গুল জোড়া লাগাতে গিয়ে যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে এটা ঠিক, কিন্তু যদি সে জোড়া লাগানো বাদ দেয় তবে তাকে আজীবন এমন যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচতে হবে যার কোনও নিরাময় নেই।

ওটা কি তুষার ?

আমি ইনসিয়নের কথায় চমকে উঠি এবং ঘাড় ঘুরিয়ে আমার পিছন দিকে তাকাই।

একটা বড় জানালা রাস্তার দিকে মুখ করা। বাইরে হালকা তুষার পড়ছে। বাতাসবাহিত শুভ্র তুষারকণা ঝুরঝুর করে শূন্য রাস্তায় এসে পড়ছে। ওয়ার্ডের রোগী ও নার্সরাও আমার মতো বাইরে তাকিয়ে নীরবে তুষারপাত দেখছে।

ইনসিয়নের দৃষ্টি জানালার বাইরে। আমি তার অবয়বের দিকে তাকাই। কিছু মানুষ সুন্দর না হওয়া সত্ত্বেও সৌন্দর্যের অনুভূতি তৈরি করে। ইনসিয়নও সেরকম। এটি কিছুটা তার বিভাময় চোখের জন্য, কিন্তু প্রধানত তার ব্যক্তিত্ব ও বাচনভঙ্গির জন্য। এখনও সে ধীরস্থির, যখন তার হাত রক্তাক্ত, গায়ে ঢিলাঢালা হাসপাতালের পোশাক, এবং হাত দিয়ে ঢুকছে স্যালাইন। তাকে কোনওভাবেই বিধ্বস্ত মনে হচ্ছে না।

মনে হয় ঝড় হবে, তাই না ? সে বলে।

আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ি। সত্যি ঝড় হবে। আলো খুব মিটমিটে হয়ে এসেছে।

কীভাবে আকাশ ভেঙ্গে ঝড় আসে ? ইনসিয়ন অস্ফুটস্বরে বলে যা আমি প্রায় শুনতেই পাই না।

সে ফিসফিস করে কথা বলতে থাকে। আমি উত্তর দিই বা না দিই তার তোয়াক্কা নেই। যেন সে অন্য কারও সঙ্গে কথা বলছে।

হঠাৎ তার কণ্ঠ একেবারে পরিষ্কার, যন্ত্রণাহীন।

আমি তোমাকে আজ আসতে বলেছি কারণ একটা ব্যাপারে তোমার সাহায্য দরকার।

তার জীবন্ত উজ্জ্বল চোখ থেকে আমার দৃষ্টি সরে না। সে কী বলে আমি তার জন্য অপেক্ষা করি।

এরকম ঝড় জীবনে প্রথম দেখলাম। দশ বছর আগে এক শীতে সিওলের রাস্তায় হাঁটুসমান তুষার দেখেছিলাম। কিন্তু তখন আকাশ ছেয়ে এমন ঘন তুষার পড়েনি। উপকূলবর্তী এক রাস্তা দিয়ে আমাদের বাস চলছে। আমরা সম্মুখসারির সিটে সিটবেল্ট বেঁধে বসে আছি। তুষার আছড়ে পড়ছে, পামগাছগুলো বাতাসের দাপটে দুলছে। ভেজা রাস্তা প্রচণ্ড ঠান্ডা নিশ্চয়ই। কিন্তু তার মধ্যে তুষার পড়ে কীভাবে গলে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। রাস্তায় তার চিহ্নমাত্র থাকছে না।

আমি অস্বস্তি বোধ করি। ভাবতে থাকি বাসে চড়ে কি ঠিক করেছি ?

দু ঘণ্টা আগে যে প্লেনে চড়েছিলাম তা ঝাঁকি খেয়ে জেজু এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে। রানওয়েতে চলতে চলতে যখন প্লেনটি থামে তখন পাশের সিটে বসা এক যুবতী তার ফোন বের করে কথা বলে, দেখো কাণ্ড, আমাদের পরের সকল ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। তার সঙ্গের যুবকটি মন্তব্য করে, আমরা ভাগ্যবান। যুবতী হাসে। তুমি একে ভাগ্য বলবে ? কীরকম আবহাওয়া দেখেছ ?

আমরা যখন এয়ারপোর্টের বাইরে আসি তখন এত জোরে তুষারপাত হচ্ছিল যে আমি চোখ মেলতে পারছিলাম না। একজন কুলি আমাদের উপদেশ দেয় বাসে চড়তে। এই দ্বীপে তুষারঝড়ের সতর্কবার্তা জারি করা হয়েছে। এ সময় কোনও ক্যাব ইনসিয়ন যেখানে থাকে ততদূর উপরাঞ্চলের গ্রাম পর্যন্ত যেতে রাজি হবে না। সকল রুটের বাস টায়ার চেইন লাগিয়ে চলবে, কিন্তু রাতে তুষারপাত হলে তারাও যাত্রা স্থগিত করবে। আগামীকাল সকাল নাগাদ উপরাঞ্চল জলবেষ্টিত হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।

আমি উদ্বিগ্ন। পাঁচটার মধ্যে আঁধার নেমে আসবে, এখন বাজে আড়াইটা। গ্রামের বাকি অংশ থেকে ইনসিয়নের বাড়িটা বিচ্ছিন্ন। সেখানে পৌঁছাতে বাস থেকে নেমে কমপক্ষে আধ ঘণ্টা হাঁটতে হবে। এই আবহাওয়ায় পথ চেনা মুশকিল। বাজে অবস্থা। কিন্তু কাল সকাল পর্যন্ত জেজুর নিম্নাঞ্চলে বসে থাকতে পারব না। এয়ারপোর্টের এক লোক বলেছে আজ রাতে পাহাড়ি রাস্তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

খানিক বাদে একটি এক্সপ্রেস বাস আসে। এটি দক্ষিণ উপকূলবর্তী এলাকায় যাবে যেখান থেকে ইনসিয়নের গ্রাম খুব বেশি দূরে নয়। এক্সপ্রেস বাস থেকে নেমে একটি লোকাল বাস ধরতে হবে। কিন্তু এক্সপ্রেস বাস যেহেতু উপকূল দিয়ে ঘুরে আসবে, ততক্ষণে ছোট লোকাল বাস হয়ত তুষারের কারণে বন্ধ হয়ে যাবে।

আমি ইনসিয়নের অনুরোধে এ পর্যন্ত এসেছি। সে বলেছে, আমাকে জেজুতে যেতে হবে।

কখন ? আমি জিজ্ঞেস করি।

আজ, সূর্যাস্তের আগে।

সে যা চাইছে তা প্রায় অসম্ভব। যদিবা সবচেয়ে দ্রুতগামী পথে এয়ারপোর্টে যাওয়া যায় এবং জেজুগামী পরবর্তী ফ্লাইটটি ধরা যায়। আমার মনে হয় সে কৌতুক করছে, কিন্তু তার চেহারা দেখে মনে হয় সে সিরিয়াস।

তুমি যদি না যাও তাহলে সে মারা যাবে।

কে মারা যাবে ?

আমার পাখি।

কী পাখি জিজ্ঞেস করতে যাব, হঠাৎ মনে পড়ে গেল বাজরিগার (বাজি) পাখিগুলোর কথা। গত শরতে আমি যখন ইনসিয়নের ওখানে বেড়াতে যাই তখন সেগুলো দেখেছিলাম। সেগুলোর কণ্ঠ ছিল ইনসিয়নের মতো, এবং তা লক্ষ করে আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম। আমি জানতাম না, বাজিরা কেবল মানুষের উচ্চারণই নকল করতে পারে না, স্বরবৈশিষ্ট্যও নকল করতে পারে। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, পাখিটি ইনসিয়নের সঙ্গে কথাবার্তা বলত। ইনসিয়নের কথার জবাবে সে বলতে পারত―নিশ্চয়, হ্যাঁ, না, জানি না, ইত্যাদি। ইনসিয়ন তাড়া দেয়, যাও ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো। ওকে তোমার হাতে এসে বসতে বলো। আমি দ্বিধা করি, কিন্তু তার হাসি আমাকে পাখির দরজা খুলতে এবং হাত বাড়িয়ে দিতে সাহসী করে তোলে। এখানে বসবে ? আমি জিজ্ঞেস করি। কিন্তু আমাকে বিব্রত করে সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দেয়, না। তারপর সে যা বলেছে তা বাতিল করে দিয়ে ঝটপট আমার হাতে এসে বসে। তার ওজন প্রায় নেই বললেই চলে। আমার চামড়ায় তার ছোট ছোট পায়ের আঁচড় লাগছিল।

অ্যামি কয়েক মাস আগে মারা গেছে, ইনসিয়ন জানায়। এখন কেবল অ্যামা বেঁচে আছে।

যদি আমি ঠিকঠাক মনে করতে পারি, অ্যামি আমার সঙ্গে কথা বলেছিল। সেটির গায়ে ছিল হলুদ-কমলা দাগ, মাথা ও লেজ ছিল সাদা। ইনসিয়ন বলেছিল, তার পাখিগুলো আরও দশ বছর বাঁচবে। তাহলে অ্যামির অকস্মাৎ মৃত্যু হলো কেন ?

গিয়ে দেখো অ্যামা এখনও বেঁচে আছে কিনা, ইনসিয়ন বলে। যদি সে বেঁচে থাকে তবে তাকে পানি দিও।

অ্যামা দেখতে অ্যামির চেয়ে ভিন্ন ছিল। পুরোপুরি সাদা। যদিও সে কথা বলত না, কিন্তু সে ইনসিয়নের গুনগুন শব্দের প্রতিধ্বনি করতে পারত। অ্যামা যখন আমার আঙ্গুলে বসেছিল, অ্যামি তখন উড়ে এসে আমার কাঁধে বসেছিল। আমি তার হালকা শরীর অনুভব করতে পারছিলাম। তার পায়ের নখ আমার সোয়েটার ভেদ করে চামড়ায় এসে লাগছিল।

ইনসিয়নের সিরিয়াসনেস দেখে বলি, ঠিক আছে, আমি যাব। আমি বাড়ি গিয়ে গোছগাছ করব, তারপর আগামীকাল সকালে প্রথম ফ্লাইট ধরব।

না, তা হবে না।

আমি ইনসিয়নের আপত্তিতে বিস্মিত হই।

এতে দেরি হয়ে যাবে। দুর্ঘটনার পর থেকে দুদিন চলে গেছে। সে-রাতে আমার সার্জারি হয়েছে এবং গতকাল পর্যন্ত আমার অবস্থা বেগতিক ছিল। চেতনানাশকের প্রভাব কাটার পর আজকেই আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।

তুমি কি জেজুর কাউকে বলতে পারো না ?

না, সে বলে।

সেই যে ভদ্রমহিলা তোমাকে উদ্ধার করেছিল ?

আমি তার ফোন নম্বর জানি না।

তার গলার স্বরে এক অদ্ভুত জরুরি ভাব ছিল।

আমি চাই তুমি যাও, কিউঙ্গা। সেখানে গিয়ে অ্যামার যত্ন নাও, যে পর্যন্ত না আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাই।

তুমি কী বলছ ? আমি প্রশ্ন করার আগেই সে বলা শুরু করে।

ভাগ্যিস, সেদিন সকালে ওর জলের পাত্রটি ভরে দিয়েছিলাম। খাঁচায় রেখেছিলাম পর্যাপ্ত মিলেট, পেলেট ও শুষ্ক ফল। কারণ অনেক সময় কাজ করতে করতে রাত হয়ে যায়। যে খাবার দেওয়া ছিল তা দিয়ে দুদিন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু তিন দিন নয়। তুমি যদি আজ সেখানে যেতে পারো, তবে সে হয়ত বেঁচে যাবে। তা না হলে, নিশ্চিত, আগামীকাল সে মারা যাবে।

আপনি কোথায় যাবেন ? বাস ড্রাইভার জেজু ভাষায় চেঁচিয়ে বলে। আমার সঙ্গে ব্যাগ নাই, এবং ঢিলাঢালা পোশাকে আমাকে টুরিস্টের মতো লাগছে না। তার হয়ত ধারণা হয়েছে আমি এখানকারই লোক।

পিতে যাব, আমি বলি।

কোথায় ?

আমি বলি, আপনি কি বলতে পারেন পিতে যেতে হলে আমাকে কোথায় নামতে হবে ?

যদিও আমরা কাছাকাছি, তবু মনে হয় ড্রাইভার আমার কথা স্পষ্টভাবে শোনেনি। বাতাসের শব্দে কথা ঢেকে যাচ্ছে। আমার ধারণা সে আমার গন্তব্য জানতে চেয়েছে কারণ প্রতিটি বাসস্টপ ছিল ফাঁকা। বাসে আমি একমাত্র যাত্রী। যদি সে সামনের স্টেশনে কাউকে অপেক্ষা করতে না দেখে, তবে সে গাড়ি না থামিয়ে সামনে এগিয়ে যাবে।

ইনসিয়ন কি এ ধরনের তুষারে অভ্যস্ত ?

কাজের প্রথম বছর আমরা যখন ভ্রমণ শুরু করি, তখন লক্ষ্য করেছি ইনসিয়ন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলত না। এর কারণ বোধ করি, সে সিওলে জন্মগ্রহণ করেছে ও বেড়ে উঠেছে। তারপর এক রাতে আমাদের বাসস্থানের লবিতে পে ফোনে তার মায়ের সঙ্গে তাকে কথা বলতে শুনি। তার কথা শুনে তখন বুঝতে পারি সে দ্বীপ অঞ্চল থেকে এসেছে। সে এমন এক উপভাষায় কথা বলছিল যা আমার পক্ষে বোঝা কঠিন ছিল। দু একটা বিশেষ্য পদ ছাড়া আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সে হেসে হেসে কথা বলছিল, প্রশ্ন করছিল, আমুদে মন্তব্য করছিল, তারপর কৌতুককর কিছু শুনে ফোন রেখে দিয়েছিল।

তুমি ও তোমার মা কী এমন মজার বিষয় নিয়ে কথা বলছিলে ? আমি জিজ্ঞেস করি।

তেমন কিছু না। মা টিভিতে দেখা একটি বাস্কেটবল খেলা নিয়ে কথা বলছিল। ইনসিয়ন মিটিমিটি হাসে। আমার মা অন্য যে কোনও দাদি-নানির মতো। আমার যখন জন্ম হয় তখন তার বয়স ছিল চল্লিশ, এখন তার বয়স ষাটের কোঠায়। সে খেলার নিয়মকানুন অতটা ভাল জানে না; খেলা দেখে মূলত মানুষের ভিড়ের জন্য। কাজ না থাকলে সে একাকিত্ব বোধ করে। সে থাকে এক জনবিরল জায়গায়।

ইনসিয়নের চোখেমুখে চটুল ভাব। যেন দুষ্টুমি করছে।

সে কি এই বয়সেও কাজ করে ?

অবশ্যই। সেখানকার মহিলারা আশি বছর বয়সেও কাজ করে। যখন মান্দারিন তোলার সময় আসে, তখন তারা একে অপরের বাগানে গিয়ে সাহায্য করে।

ইনসিয়ন হেসে আবার পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে যায়।

মা ফুটবল দেখতেও পছন্দ করে, যেখানে আরও বেশি ভিড় থাকে। সে সমান আগ্রহ নিয়ে প্রতিবাদ ও মিছিলের সংবাদ দেখে। যেন সে ভিড়ের মধ্যে পরিচিত কাউকে খোঁজে।

সেদিনের পর থেকে ট্রেন বা বাসে ভ্রমণকালে যখনই একটু বিরতি জোটে অথবা কোনও রেস্টুরেন্টে খাওয়ার অবসরে আমি তাকে বলি আমাকে একটু একটু জেজু ভাষা শিখাতে। সে ভাষার সুন্দর ধ্বনি ও স্বরভঙ্গি আমার ভাল লেগেছে। সে তার মায়ের সঙ্গে ঐ ভাষায় কথা বলছিল।

প্রথমে সে অনিচ্ছুক ছিল। আমার মনে হয় জেজুতে বেড়াতে গেলে এ ভাষা তোমার কোনও কাজে লাগবে না, সে বলে। সবাই তোমাকে দেখেই বলবে তুমি মেইনল্যান্ডার। কিন্তু যখন সে দেখল আমি আন্তরিকভাবে শিখতে আগ্রহী, সে আমাকে তার ভাষার মৌলিক পাঠদান শুরু করে। ভিন্নরকম শব্দযোজনা দেখে আমি বেশ মজা পাই। তার সঙ্গে আলাপের সময় আমার ভুল হয়ে যেত : হাডা-হায়েন-হামেন-হাজায়েন। ইনসিয়ম মিষ্টি হেসে শব্দ ঠিক করে দিত।

লোকজন বলে আমাদের শব্দাবলির শেষ প্রান্ত ছোট। কারণ দ্বীপে জোরে বাতাস বয়। একদিন সে কথায় কথায় জানায়। বাতাসের আওয়াজ শব্দকে ছোট করে ফেলে।

ইনসিয়নের গৃহ সম্পর্কে আমি এতটুকু জানি। কাটা কাটা শব্দান্তের ভাষায় সে কথা বলে, তার মা লোকজনের ভিড় প্রত্যাশায় টিভি দেখে।

অবশেষে আমরা পিতে এসে পৌঁছি। পোস্ট অফিসের সাইনবোর্ড দেখে সেটা বোঝা যায়। আমি বেল চেপে বাস থামার সিগনাল দেই। বাসের গতি কমে এবং আস্তে আস্তে সেটি থেমে যায়। বাইরে বাতাস একটু কমেছে বলে মনে হয়। আমি যেখানে আছি সেখানে বাতাস কম হলেও আশেপাশে কিন্তু বাতাসের তোলপাড়। মনে হয় আমি কোনও ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে আছি। এখন বিকাল চারটার চেয়ে একটু বেশি, কিন্তু চারপাশে আলো এত ফিকে হয়ে এসেছে যে মনে হয় প্রচণ্ড ঝড় সমাসন্ন।

রাস্তাঘাট জনহীন। কোনও গাড়িঘোড়া চলছে না। কেবল ঝিরঝির করে অবিরাম তুষার পড়ছে। ঘন তুষারের ওপারে একটি ট্রাফিক লাইট উজ্জ্বল লাল হয়ে জ্বলছে। তুষারকণাগুলো ভেজা সড়কে পড়ে কিছুক্ষণ থমকে থাকে। তারপর, কথোপকথনের শেষ বাক্যটির মতো, তরঙ্গের পতনের মতো, কাঁধ থেকে আঙ্গুল সরে যাওয়ার মতো, মসৃণ কালোর মধ্যে ডুবে যায়, একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়।

চোখ-মুখ থেকে তুষার ঘষে ফেলে আমি সামনে পথের দিশা খুঁজি। এটি উপকূলীয় রাস্তা; লোকাল বাস এখানে থামে না। আমাকে ইন্টারসেকশন দেখে বাস স্টপ খুঁজে নিতে হবে। একবার ইনসিয়ন এটা দেখিয়েছিল।

জায়গাটা অবিশ্বাস্যরকম শান্ত।

আমার মাথায় গালে তুষারের ঠান্ডা লাগছে, নইলে মনে হতো আমি স্বপ্ন দেখছি। ঝড়ের কারণেই কি রাস্তাঘাট জনহীন ? রবিবার বলেই কি দোকানগুলোতে আলো জ্বলছে না ? ধাতব চেয়ারগুলো টেবিলের ওপর উলটে রাখা, পেভমেন্ট সাইনগুলো তালা দেওয়া দরজার ভেতরে কাত হয়ে পড়ে আছে। জানালার ওপাশে একটি ম্যানিকুইনের গায়ে ফিনফিনে শারদীয় পোশাক। রাস্তার কোণে একটি ক্ষুদ্র দোকান, এই ছোট নীরব শহরের একটিমাত্র জায়গায় কেবল আলো জ্বলছে।

আমার একটি লণ্ঠন ও বেলচা দরকার। কোণের দোকানটিতে সেসব নাও থাকতে পারে। কিন্তু আমি দোকানে গিয়ে দোকানদারকে আমার পথের কথা জিজ্ঞেস করতে পারি। আমি তার কাছে এটাও জেনে নিতে পারি ইনসিয়নের গ্রামে যেতে হলে কোথা থেকে বাস ধরতে হবে। কিন্তু যেই না দোকানের দিকে পা বাড়াই, তার লাইট বন্ধ হয়ে যায়। জ্যাকেট-পরা মধ্যবয়সী এক লোক বেরিয়ে আসে। অভ্যস্ত হাতে সে গ্লাসডোরের হাতলে চেইন ও তালা লাগায়। আমি পা চালিয়ে তার দিকে এগিয়ে যাই।

দাঁড়ান, আমি ডেকে বলি।

লোকটি দোকানের সামনে রাখা একটি মিনিভ্যানে উঠছে। আমি দৌড়াতে শুরু করি। দৌড়াতে দৌড়াতে চোখের ওপর থেকে তুষার ঝাড়ি।

দয়া করে থামুন!

তুষার-শৈত্যে আমার কণ্ঠ ভোঁতা হয়ে গেছে। আমি শুনতে পাচ্ছি গাড়িটি স্টার্ট নিচ্ছে। চাপা ঘড়ঘড় শব্দ। গাড়িটি ব্যাক করে ফাঁকা রাস্তায় ওঠে। আমি ড্রাইভারের দিকে হাত নাড়ি। কিন্তু হায়, অসহায়ভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি মিনিভ্যানটি দ্রুত চলে যাচ্ছে।

বাস স্টপ দেখে আমি চমকে উঠি।

আমি ভেবেছিলাম এখানে কেউ থাকবে না। কিন্তু দেখি খাম্বার কাছে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে যার বয়স হবে আশির ওপরে। তার পিঠ বাঁকা, হাতে একটি লাঠি। তার ছোট সাদা চুলের ওপর একটি হালকা-ধূসর উলের হ্যাট, তার সঙ্গে ম্যাচ করা গায়ের মোটা কোট। পায়ে কালো রাবারের জুতা। আমাকে আসতে দেখে সে আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। আমি তাকে সম্ভাষণ করি, কিন্তু সে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়ত সে আমার সম্ভাষণ লক্ষ করেনি। তাই আমি তার কাছে গিয়ে মাথা নোয়াই। তার ঠোঁটে এক ঝলক হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

আমি তার পাশে দাঁড়াই এবং তার দিকে তাকাই। সে ধীরে ধীরে আমার দিকে ফেরে। তার ফ্যালফ্যালে চোখ পড়ে আমার চোখে। তার দৃষ্টি বন্ধুত্বপূর্ণও নয়, শীতলও নয়। প্রকৃতপক্ষে, সেখানে রয়েছে নীরব উষ্ণতা। তাকে দেখে আমার ইনসিয়নের মায়ের কথা মনে পড়ে। তার নড়বড়ে ক্ষুদ্র অবয়বে চাপা করুণার সঙ্গে মিশে আছে উদাসীনতার ভাব।

শেষবার যখন দেখা হয়, ইনসিয়নের মা বলেছিল, তোমার ভ্রমণ আনন্দদায়ক হোক। তখনও তার চোখে-মুখে ছিল আশঙ্কার ছাপ, কিন্তু সে তখন সিওলের ভাষায় কথা বলেছিল। জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর, অনেক ভোগান্তির পর, মানুষের মধ্যে নিরাসক্তি দেখা দেয়। তার মধ্যে এক ধরনের স্থিরতা আসে, যার ফলে সে আসন্ন যে-কোনও বিপদের জন্য তৈরি থাকে। এমনকি আনন্দের সময়ও সে সতর্ক থাকে।

তার মাকে দেখে আমি অবাক হয়েছি। শুনেছি তার সচেতনতা পড়তির দিকে। কিন্তু এখন তাকে অপ্রত্যাশিতভাবে পরিচ্ছন্ন ও নিয়ন্ত্রিত মনে হচ্ছে। জানি না সে আমাকে কী মনে করেছে। ইনসিয়ন আমাকে জানিয়েছিল, তার মা প্রায়শ ভুলে যায় তার একটি মেয়ে আছে, এবং মাঝে মাঝে বাচ্চাদের মতো আচরণ করে। ভুল করে মেয়েকে সে তার নিজের বড় বোন মনে করে। ইনসিয়নের মা যখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, তার চোখের পাতা প্রায় বোঝা এবং দৃষ্টি ঘোলা। তাকে হাত বাড়াতে দেখে আমিও হাত বাড়িয়ে দিই। আমাদের চোখে চোখ, হাতে হাত। সে আমাকে কৌতূহল ভরে সতর্কভাবে নিরীক্ষণ করে, বোঝার চেষ্টা করে আমি কে। যখন সে স্মিত হেসে আমার হাত ছেড়ে দেয়, আমি মাথা ঝুকিয়ে কক্ষ ত্যাগ করি। দেখি ইনসিয়ন রান্নাঘরে।

কী রান্না করছ ?

বিন পরিজ, শরীর না ঘুরিয়ে ইনসিয়ন বলে। আমি সাদা বিনের সঙ্গে কালো বিন মিশিয়েছি। অর্ধেক-অর্ধেক।

সে হাতা দিয়ে বিশাল পাত্রের জিনিসগুলো নাড়তে থাকে। আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সে আমার দিকে তাকায়।

তার প্রোটিন দরকার, কিন্তু সে অন্য কোনওকিছু হজম করতে পারে না। এজন্য তার জন্য আমি এটা বানাচ্ছি। সাধারণত আমরা দু’জন যতটুকু খেতে পারি ততটুকুই বানাই। কিন্তু আজ যেহেতু তুমি আছ, সেজন্য একটু বেশি বানিয়েছি।

আমি ঘন ধূসর-কালো পরিজ দেখি। ইনসিয়ন আস্তে আস্তে নাড়ে।

খাবার থেকে সুন্দর গন্ধ বেরুচ্ছে।

খেতে খুব সুস্বাদু। ইনসিয়ন আস্থার হাসি হেসে চুলা বন্ধ করে দেয়।

তুমি কি ওটা ব্যবহার করবে ? তাকের ওপর একটি বড় বাটি দেখিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি। সে মাথা নাড়ে। আমি কাঠের ট্রেতে বাটিটি নিয়ে তার নিকটে আসি। সে তাতে খাবার ঢালে। আমরা কিচেন সিঙ্কের দিকে যাই। দুজন হাত লাগিয়ে বাসন মাজি। যেন আমরা দুটি বোন।

খাবার খুব ভাল হয়েছে।

তুমি সেই প্রবাদটি জানো―ভালো খাবার মানে দীর্ঘ জীবন। মা দীর্ঘদিন বাঁচবেন।

ইনসিয়ন হাতে ট্রে নিয়ে প্রধান শয়নকক্ষের দিকে যায়। আমি তার আগে আগে গিয়ে দরজা খুলে দিই। ইনসিয়ন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। আমি টেবিলে গিয়ে চামচ ও চপস্টিক সাজাই। দুটি বাটিতে বিন পরিজ তুলে রাখি। আমি চেয়ার টেনে বসি এবং ধোঁয়া ওঠা খাবারের দিকে তাকিয়ে থাকি।  

ইনসিয়ন ফিরে আসে এবং চামচ হাতে নেয়। আমিও চামচ হাতে নেই এবং খাওয়া শুরু করি। গরম গরম খাবারে বেশ তৃপ্তি আসে।

খুব ভাল, আমি বিড়বিড় করে বলি। ইনসিয়ন হাসিমুখে বলে, যতটা ইচ্ছা করে খাও। পর্যাপ্ত আছে।

মনে হয় বাস আসবে না।

এখন যদি কোনওভাবে যাত্রা শুরু করতে পারি, তাহলেও ইনসিয়নের গ্রামে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্ধকার নেমে আসবে, তখন আর পথ খুঁজে পাব না।

এখন এখানেই কোথাও রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।

কিন্তু প্রথমে ইনসিয়নকে কল করতে হবে, আমার বিড়বিড় কিছুটা উচ্চস্বরে বাজে। আমার নিঃশ্বাস পড়ন্ত তুষারে গিয়ে মেশে।

তাকে জানাতে হবে আমি আর পারছি না। এখানে তুষারঝড় হচ্ছে।

আমি পাশের মহিলার দিকে তাকাই। চলে যাওয়ার আগে কি তাকে বলা উচিত নয় ? তার কি আমার সাহায্যের প্রয়োজন হবে না ?

আমি একটু চিন্তা করি এবং তার সঙ্গে কথা বলি।

সামচুন, আমি বলি।

ইনসিয়ন আমাকে শিখিয়েছে এখানকার বয়স্ক লোকদের সামচুন বলে সম্বোধন করতে। কেবল বাইরের লোকেরাই―আজোসি বা আজুমনি, হালমনি বা হারাবজি―এমন শব্দ ব্যবহার করে।

তাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি কি অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন ?

মহিলা শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।

শীঘ্র কোনও বাস আসবে কি ?

ধীরে ধীরে সে লাঠি থেকে এক হাত তোলে। পিটপিট করে তাকায়, তার কানের দিকে ইঙ্গিত করে। সে দুপাশে মাথা ঝাঁকায়। তার মুখে ম্লান হাসি। তার পাতলা ঠোঁটজোড়া একটুখানি ফাঁক হয়।

কী যে তুষার পড়ছে!

মাথা নাড়তে নাড়তে সে অন্যদিকে ফেরে, যেন সে আর কথা বলতে চাচ্ছে না। সে দূরে কোথাও তাকিয়ে থাকে।

তার চোখে ক্ষীণ আলোর প্রতিফলন। আমি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দূরে তাকাই। অবিশ্বাস্য, দেখি একটি ছোট বাস মোড় ঘুরছে। গাড়ির ছাদে তুষারের স্তূপ।

ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করে বাস থামে। এ আওয়াজ শুনে ব্ল্যাকবোর্ডে চকের ঘর্ষণের কথা মনে পড়ে। তুষারপ্রবাহের শব্দে গাড়ির ক্যাঁচক্যাঁচ অতটা কানে আসে না।

সামনের দরজা খুলে যায়। নির্গত ভ্যাপসা গরম বাতাস আমার নাকে এসে লাগে। ড্রাইভারের কটন গ্লাভস পরা একটি হাত গিয়ার লিভারে। সে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাকে ডাক দেয়।

অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছো ? দুটো বাস পাহাড়ের তুষারে আটকে গেছে। এই বরফ-জমা ঠান্ডায় তুমি এত সময় ধরে অপেক্ষা করছ, আহা রে!

আগের মতো মহিলা তার কানের দিকে ইঙ্গিত করে এবং উত্তর না দিয়ে মাথা ঝাঁকায়। হাতের লাঠির ওপর ভর দিয়ে সে আস্তে আস্তে বাসে ওঠে। আমি তার পিছে পিছে উঠি। বাসে আর কোনও যাত্রী নেই।

আপনি কি সেচিয়ন-রিতে যাচ্ছেন ? আমি জিজ্ঞেস করি।

হ্যাঁ, ড্রাইভার ভদ্রভাবে সিওল ভাষায় জবাব দেয়। তার পরিবর্তিত কণ্ঠে আমি দূরত্ব লক্ষ করি।

আমরা কখন সেখানে পৌঁছাব ?

ঠিক কোন জায়গাটায় ? সে জানতে চায়। সেচিয়ন-রিতে আমরা চার জায়গায় থামি। গ্রামটি বেশ বড়।

উত্তর না পেয়ে ড্রাইভার আমার দিকে তাকায়। ওয়াইপার গাড়ির সামনের কাচ থেকে ঘ্যাঁশঘ্যাঁশ শব্দ করে তুষার ঝাড়ে।

সচরাচর নয়টা পর্যন্ত বাস চলে। কিন্তু আজকে আর কোনও বাস নেই, সে জানায়।

আমি বাসস্টপের নাম জানি না। কিন্তু আমি দেখলে চিনতে পারব। আমি আপনাকে বলব।

আমার উত্তরে আমিই খুশি নই। পাশে মহিলা বসা। সে লাঠিতে ভর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে। তার হ্যাটের ওপর জমে থাকা তুষার ইতোমধ্যে গলে গেছে এবং তা বিন্দু বিন্দু জল হয়ে গায়ে উলের পোশাকে এসে পড়ছে।

দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। উপকূলীয় সড়ক থেকে বাসটি ধূসর-সাদা তুষার-কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে চলেছে। রাস্তার দুপাশের বাড়িঘর আর চোখে পড়ে না। বাস এখন তুষারময় পত্রপতনশীল বৃক্ষঘেরা পথ দিয়ে যাচ্ছে।

এক জায়গায় বাস থামে। মহিলা তার সিট থেকে ওঠে। সে ড্রাইভারকে বলেনি কোথায় যাবে, কিন্তু ড্রাইভার মনে হয় জানে সে কোথায় নামবে। মহিলা লাঠি নিয়ে ঠকঠক করে পিছনের দরজার দিকে হেঁটে যায়। নামার আগে সে ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকায়। তার চেহারায় কি ঝাপসা হাসি, বিদায়ের ইঙ্গিত, নাকি শূন্য দৃষ্টি ? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

ড্রাইভার কি এরকম নির্জন জায়গায় যাত্রীদের নামিয়ে দেয় ? আমি চারপাশে তাকাই এবং গাছপালার ফাঁক দিয়ে একটি কালো পাথরের নিচু দেয়াল দেখতে পাই। একটি বাড়ি। ড্রাইভার মহিলার নামার জন্য সময় দেয়। মহিলা দুই পা মাটিতে রাখে এবং তুষারের মধ্য দিয়ে টুকটুক করে হেঁটে চলে যায়। আমি আমার সিটে বসে তার ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া দেখি। আমি এর অর্থ বুঝি না। সে তো আমার অপরিচিতই ছিল, যার সঙ্গে বাসস্টপে দেখা। তাহলে তার বিদায়ে খারাপ লাগছে কেন ?

হালকা ঢালু পথে বাস আস্তে-ধীরে এগিয়ে চলে। পাঁচ মিনিট চলার পর থামে। ড্রাইভার ব্রেক কষে এবং ইঞ্জিন বন্ধ করে। দয়া করে চাকায় চেইন লাগানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন, সে গলা চড়িয়ে বলে।

দেখতে পাচ্ছি আঁধার ক্রমান্বয়ে ঘনীভূত হচ্ছে এবং খোলা দরজা দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢুকছে। তুষারঝড় আবার শুরু হবে। এরূপ মনে হয়, মহিলা যতক্ষণ ছিল, বাতাসও ততক্ষণ শান্ত ছিল। মহিলা চলে যাওয়ার পর থেকে বাতাস আবার উথালপাথাল করছে।

বাস থেকে আমার নামা উচিত হয়নি।

বাসের চেইনযুক্ত চাকাগুলো তুষারের ওপর দাগ ফেলেছে। কিন্তু তুষারঝড় শুরু হওয়ার পর এই দাগগুলো নতুন তুষারের নিচে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

এখন আলো কম, তুষারের মধ্যে ধূসরাভা বিদ্যমান। ফলে কোনওরকমে পথ চেনা যাচ্ছে।

আমি পথ চলতে শুরু করি। আমি মেইন রোড থেকে নেমে তুষারাবৃত মেঠোপথ দিয়ে হাঁটতে থাকি। পিচকালো গ্রিনহাউসগুলো পেছনে ফেলে কাঁটাঝোপের রাস্তায় এসে পড়ি। এই রাস্তা এত সরু যে এখান দিয়ে কোনও ছোট গাড়িও চলতে পারবে না। হাঁটু পর্যন্ত তুষার। আমাকে আস্তে আস্তে থপথপ করে হাঁটতে হচ্ছে। পায়ের জুতামোজা ভিজে একাকার। কোনও বিল্ডিং নেই যাকে ল্যান্ডমার্ক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। চারপাশে গাছপালা, তুষারের স্তর, বাড়ন্ত অন্ধকার। পথ কোথাও উঁচু কোথাও নিচু, কোথাও প্রশস্ত, কোথাও সরু। কোনওরকমে আন্দাজ করে করে পথ চলছি।

ধূসর-নীল গোধূলির আলো হারিয়ে গেছে। আমি দুই রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালি। ফোনে ব্যাটারি কম, ফলে খুব প্রয়োজন ছাড়া জ্বালানো যাবে না। আমি একটি পথ ধরে সামনে এগুতে থাকি। সামনে তিনটি পায়ে-চলা পথ গাছপালার মধ্য দিয়ে তিনদিকে চলে গেছে। আমি বিভ্রান্তিতে পড়ি। ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে বোঝার চেষ্টা করি কোন পথে যেতে হবে। কিন্তু ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় গাছের ছায়াগুলো বিভ্রান্তি আরও বাড়িয়ে দেয়, সবকিছু আরও অপরিচিত মনে হয়। অনেক ভেবেচিন্তে আমি সবচেয়ে প্রশস্ত পথটি বেছে নিই। কিন্তু পা বাড়াতেই আমার পায়ের নিচের মাটি সরে যায় এবং আমি তুষারের স্তূপে হুমড়ি খেয়ে পড়ি।

আমি দুই হাত দিয়ে আমার মাথা ঢেকে ফেলি। আমার ফোনটা হাত থেকে খসে পড়ে। হাচড়েপাচড়ে তুষারস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসি। তুষারের নিচে পাথর ছিল, ফলে মাথায় পাথরের আঘাত লেগেছে। তবে আঘাতের ফলে চেতনা হারাইনি।

খুব দ্রুত ঘন অন্ধকারে চারপাশ ছেয়ে যায়।

আমি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম ?

আমার বাম হাত কাঁপছে। সেই হাত দিয়ে কোটের স্লিভ উঁচু করি। ডান হাতের কব্জিতে আমার ঘড়ি। ঘড়িতে লাইট নেই, ফলে কিছু দেখা যাচ্ছে না। কেবলই অন্ধকার ভাসে চোখে।

দাঁতে দাঁত লেগে খটখট শব্দ হচ্ছে। চোয়ালটা যেন খুলে পড়বে। মাথার হুড ও স্কার্ফ ভেদ করে ঠান্ডা ঢুকে যাচ্ছে। ঠকঠক হাঁটু কাঁপছে। আমি সেগুলো হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরি এবং ভাবতে থাকি।

আমি পাখি নিয়ে ভাবছি।

ইনসিয়ন বলেছে যে পাখিটিকে বাঁচাতে হলে সেদিনই তাকে পানি দিতে হবে।

কিন্তু পাখির দিন কখন শেষ হয় ?

আলো নেভার সঙ্গে সঙ্গে এরা ঘুমিয়ে পড়ে।

গত শরতের এক সন্ধ্যায় ইনসিয়ন আমাকে এমনই বলেছিল। তখন সে পাখিদুটোকে ছেড়ে দিয়েছে ঘণ্টাখানেক উড়ে বেড়াবার জন্য। তারা মুক্তভাবে ওড়াউড়ি করে আবার খাঁচায় ফিরে আসে। সে পাখিদের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে, তারপর খাঁচাটি কালো কাপড়ে ঢেকে দেয়।

তারা সবসময় চোখ খোলা রাখে এবং কিচিরমিচির করে। কিন্তু আলো নিভিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। মধ্যরাতে যদি খাঁচার কাপড় সরানো হয়, দেখা যাবে, তারা তৎক্ষণাৎ জেগে উঠে কিচিরমিচির শুরু করে দিয়েছে।

আমি ঘুমাতে চাই।

আমার বিশ্বাস আমি এক সময় ভেসে যাব।

কিন্তু পাখির কী হবে!

আবার কখন বাতাস বইতে শুরু করেছে ?

আমার শরীর এখন কুঁকড়ে নেই। আঙ্গুলগুলো জড়তাহীন। আমি হাত চালিয়ে চোখ-মুখ থেকে তুষার অপসারণ করি। আমার চোখে আলো পড়ে, মধ্যরাতের অন্ধকারে নীল আলো, যদিও খুব আবছা।

নাকি আমি স্বপ্ন দেখছি ?

আমি সটান চিত হয়ে শুয়ে পড়ি এবং আকাশের দিকে তাকাই। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। চারপাশের অন্ধকার দূরীভূত। তুষারপাত থেমে গেছে। এখনও বাতাস আছে, তবে তা ঘুরে ঘুরে পুরনো তুষারকে তাড়িত করছে। আকাশে আধখানা চাঁদ, গাছপালার মাথার ওপর। বাতাসে তুষারমেঘ ভেসে গেছে।

শুষ্ক জলধারা থেকে একটি নীলচে আলো লম্বা সাদা সাপের মতো বনভূমির মধ্য দিয়ে পাক খেতে খেতে ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমি সাবধানে এক পা এক পা করে এগুচ্ছি। চাঁদ মাঝে মাঝেই মেঘের আড়ালে হারিয়ে যায়। গাছের মাথাগুলো দুলছে। সেখানে নীলচে আলোর খেলা। এ আলো যেন কখনওই নিভে যাবে না।

সামনে দুটি পথ দুদিকে চলে গেছে।

এবার আমি আর ভুল করি না। আমি ঢাল বেয়ে কিছুটা নামি, তারপর একটি সমতল পথ ধরে হেঁটে যাই। তুষারে প্রতিফলিত চাঁদের আলোয় আমি পথ চিনে নিই। বনপত্রালির খসখস, তুষার-স্তর ভেঙ্গে আমার পদচালনার ছপছপ, আমার নিঃশ্বাসের হুশহাশ, সব শব্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।

ওখানে কিছু একটা আছে। কিছু একটা দ্যুতিময়।

ঝোপঝাড় পেরিয়ে ওপাশে পৌঁছাতেই সামনে পড়ে একটা ঘন নীল রাস্তা। সে রাস্তা বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে। সেখান দিয়ে যতই এগুতে থাকি তা উজ্জ্বল হতে থাকে। রাস্তার শেষ মাথায় এক ঝলমলে রুপালি পুকুর। আমি জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছি আর তুষারের মধ্য দিয়ে শরীরটাকে টেনে চলছি। রাস্তা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে পৌঁছে আমি চোখ ডলি এবং সরাসরি আলোর দিকে তাকাই।

ইনসিয়নের কারখানা!

লোহার দরজা খোলা, ফলে ভিতর থেকে আলো বাইরে এসে পড়ছে। আমার আগে কি কেউ এখানে এসেছে ? আমার শরীর কাঁপতে থাকে। আমি চিন্তা করি।

সেদিনের পর থেকে কেউ এখানে আসেনি।

সেই লোকগুলো রক্তাক্ত ইনসিয়নকে দ্রুত গাড়িতে তুলেছে। আলো নিভানোর কথা কারও মাথায় ছিল না। দরজা বন্ধ করারও সময় ছিল না।

দরজা পুরোপুরি খোলা, যেন কারও জন্য অপেক্ষা করছে। দমকা হাওয়া কারখানায় ঢুকছে, সঙ্গে করে আনছে চকচকে তুষার।

আমি দরজা বন্ধ করি। শক্ত করে খিল লাগিয়ে দিই যাতে বাতাস হানা দিতে না পারে।

মেঝেতে কাঠের স্তূপ। আমি তাদের মাঝখান দিয়ে যাই। কংক্রিটের এক জায়গায় তুষারের নিচে রক্তের দাগ চোখে পড়ে। বেঞ্চের পাশে আরও রক্ত জমাট বেঁধে আছে। সম্ভবত এখানেই ইনসিয়ন আঘাত পেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। বেঞ্চের ওপর একটি আধ-কাটা কাঠ, একটি অ্যাঙ্গেল গ্রাইন্ডার, ইয়ার প্রটেক্টর, কাঠের টুকরাটাকরা―সবকিছুতে রক্তের ছোপছোপ দাগ।

আমি সাবধানে নড়াচড়া করি যাতে রক্ত বা কাঠে পা না পড়ে। পিছনের দরজার কাছে গিয়ে বাইরে উঠানের দিকে তাকাই। সেখানে দেয়ালে হেলান দেওয়া অনেক কালো রঙ করা কাঠ। কাঠগুলো যেন একে অপরের সঙ্গে কথা বলছে।

আমি দরজা খোলার চেষ্টা করি, কিন্তু খোলে না। দরজার পাল্লা ধরে টান দিই, কাজ হয় না। ধাক্কা দেই, তাতেও কাজ হয় না। তুষারের আস্তরে দরজা শক্ত হয়ে লেগে আছে। আমি দরজা সামান্য ফাঁক করে তুষার কাটতে থাকি। দরজা আরেকটু ফাঁক হয়। আমি তার ভিতর দিয়ে শরীরটা সেঁধিয়ে দিই।

তুষারের মধ্য দিয়ে আমি অন্ধকার বাড়িটার দিকে এগিয়ে যাই।

এই অন্ধকারের মধ্যে অ্যামা নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। আমি জানি আলো না জ্বালা পর্যন্ত সে জাগবে না। আমি দেখেছি ইনসিয়ন সকালে কালো কাপড়টি খাঁচা থেকে সরানো মাত্র পাখি কিচিরমিচির শব্দে মেতে ওঠে।

অ্যামা যখন আমার কাঁধে এসে বসত এবং আমি তার পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতাম, সে আরামে নুয়ে পড়ত।

সে আরও আদর চায়।

আমি তার ঘাড়েপিঠে আবারও হাত বুলিয়ে দিতাম। সে আরও নুয়ে পড়ত, যেন অভিবাদন জানাচ্ছে। এসব দেখে ইনসিয়ন হাসতো।

আরও, আরও আদর চায় সে তোমার কাছে।

সম্মুখ দরজায় তালা দেওয়া নেই। আমি ঘরে প্রবেশ করি। প্রবেশপথে দাঁড়িয়েই আমি গ্লাভস খুলে কোটের পকেটে রাখি। ভেজা জুতা ও মোজা খুলি। পা ঠান্ডায় অবশ হয়ে আছে। ভিতর ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে কাঠের মেঝেতে পা রাখি। দেয়ালে হাত রাখি। সুইচ টিপে লাইট অন করি।

নিষ্প্রাণ ঘর। দরজা-জানালার ফাঁক দিয়ে হালকা বাতাস ঢোকে। জানালার ওপাশে অন্ধকার, ফলে কাচে আমার প্রতিবিম্ব ফুটে ওঠে। আমি কোটের হুড নামাই। চোখের সামনে আমার রক্তাক্ত চেহারা, আলুথালু চুল। জানালার পাশে ক্রিপ্টোমেরিয়া কাঠের তৈরি একটি টেবিল। টেবিলের ওপর পাখির খাঁচা। টেবিলের পাশে আংটায় ঝুলছে কালো কাপড় এবং পরিষ্কার করার কয়েকটি সামগ্রী। খাঁচার ভেতরে পাখির বসার জন্য দুটো কাঠি।

বিকট নিস্তব্ধতার মধ্যে আমি খাঁচার দিকে এগিয়ে যাই। পানির পাত্রটি শুষ্ক। খাবারের পাত্রটিও শূন্য। দু-একটি শস্যদানা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আর খাঁচার এক কোণে নিথর পড়ে আছে অ্যামা।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button