অনুবাদ গল্প : চন্দ্রাহত

মূল : আন্তন চেখভ
বাংলা অনুবাদ : প্রবাল দাশগুপ্ত
[ছোটগল্পকার, নাট্যকার ও চিকিৎসক আন্তন পাভলোভিচ চেখভ দক্ষিণ রাশিয়ার তাগানরোগে ১৮৬০ সালের ২৯ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম সেরা ছোটগল্পকার বিবেচনা করা হয়। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এমন নাট্যকারদের মাঝে শেক্সপিয়র ও ইবসেনের পাশাপাশি তাঁর নামও উল্লেখ করা হয়। চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। কিন্তু দরিদ্রদের চিকিৎসায় টাকা নিতেন না। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন চেখভ পুরো পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। খরচ জোগাড়ের জন্য রুশ জীবন নিয়ে ছোট ছোট হাস্যরসাত্মক নাটক বা রচনা লিখতেন এবং অলঙ্করণমূলক নকশা আঁকতেন। এর অনেকগুলোই লিখেছিলেন আন্তোশা চেখন্তে এবং রাগহীন মানব ছদ্মনামে। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে চেখভ মারা যান।চেখভের গল্প হলো ক্লাইম্যাক্সবিহীন, নিস্তরঙ্গ, কিন্তু একই সঙ্গে প্রচণ্ড বাস্তবমুখী সমস্যার গল্প। বস্তুত আমাদের জীবনে ক্লাইম্যাক্স আর কতখানিই বা আছে ? বেশির ভাগ ঘটনাই তো সাদামাটা, বিশেষত্বহীন। চেখভের মুন্সিয়ানা হচ্ছে এই সাদামাটা, বিশেষত্বহীন জীবনকেই ছোটগল্পে স্থান দেওয়া। কোনও ক্লাইম্যাক্স ছাড়াই সার্থক ছোটগল্প। অবশ্য এর ব্যত্যয়ও দেখা যায়। কিন্তু চেখভের ক্লাইম্যাক্স তাঁর গল্পের মতোই জীবনমুখী ও স্বাভাবিক। পড়ে চমক লাগে না, অথচ গল্পটিও অসাধারণ থাকে।]
ঘটনাটা সেই বছরের যে বছরে আমি রেলের এক জনমানুষহীন হল্ট স্টেশনে ওভার্সিয়ার। জীবন মনোরম ছিল নাকি উল্টো, সেটা না বলে বরং এমনটা বলি, দশ বারো কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে মনুষ্যবসতি ছিল না, নারী তো নয়ই এবং না ছিল কোনও-বলার-মতো ঠেক। ওই ঋতুতে আমি তরুণ, সুঠাম, রাগী, একগুঁয়ে এবং বোকা ছিলাম। একমাত্র আমোদ ছিল ধাবমান প্যাসেঞ্জার ট্রেনের জানালায় নারীদর্শন―যতক্ষণ না ট্রেনটা বিন্দু হতো মিলিয়ে যাবার একটু আগে―আর বাংলা খাওয়া; ওটা ড্রাগ মিশিয়ে বিক্রি হতো।
হাতে গোনা মানুষের বাস হল্ট স্টেশনটায় : আমি, আমার স্ত্রী, কালা ও যক্ষ্মারোগী চেহারার টেলিগ্রাফ যন্ত্রচালক এবং তিন রক্ষী। আমাদের সন্তান ছিল না, কোনও যে অতিথি আসবে এমনও জায়গা নয় ওটা এবং আমিও ওই মাসে একবার কিংবা একবারও-না, রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোনও সহকর্মীর বাড়ি যেতাম। দুঃসহ, নির্বাসিতের যাপন চলছিল।
তাও, নববর্ষ উদযাপনের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম আমরা। টেবিলে আমি আর বৌ। দুজনে বসে অলসভাবে কী যেন চিবাচ্ছিলাম। পাঁচ গেলাস ওই ড্রাগ মেশানো বাংলা ততক্ষণে গিলে ফেলেছি। পাশের ঘর থেকে আসা নিরবচ্ছিন্ন টরেটক্কার আওয়াজ শুনতে শুনতে ভাবছিলুম এই স্থবির, বেরঙিন যাপন-অভিশাপের কথা এবং আমার বৌ পাশে বসে অপলক দেখছিল আমায়। জগতে রূপবান স্বামী ছাড়া যার আর কিছু নেই সেই স্ত্রী যেভাবে তাকায়, অমন দৃষ্টি তার। পাগলের মতো ভালোবাসত ও আমায়। কিংবা ক্রীতদাসীর মতো। শুধু যে আমার সৌন্দর্য বা সুচারু আত্মাই ও ভালোবাসত তা নয়, ভালোবাসত আমার পাপ, রাগ, আমার একঘেয়েমি, এমনকি আমার গালাগালও―যখন আমি মদের তাড়নায় বেসামাল হয়ে সমস্ত বিরক্তি, সব বিরাগ আর কাউকে না পেয়ে ওর ওপরে ঢেলে দিতাম।
এসব সত্ত্বেও আমরা নতুন বছরের আগমন উৎসবে মেতে উঠতে চাইছিলাম। আঞ্চলিক ওভার্সিয়ারের থেকে দু বোতল ভালো মদ বাগিয়েছিলাম কদিন আগে। অঙ্ক ক্লাসের বাতাস যখন একঘেয়েমিতে ভারী হয়ে যায় তখন যদি একটা প্রজাপতি পথ ভুলে সেখানে এসে পড়ে, ছেলেরা চনমনে হয়ে উঠে তার গতিপথে উৎসাহিত দৃষ্টি ধাবিত করে―যেন ওটা আদৌ সামান্য প্রজাপতি নয়, যেন নতুন কিছু, অদ্ভুত কিছু দেখছে তারা। একঘেয়ে রেলওয়ে হল্টে আমাদের টেবিলে উড়ে এসে বসা মদের বোতল দুটোর দিকে তাকিয়ে আমরা অমনই আমোদিত হচ্ছিলুম আর তেরছা নজর ছিল ঘড়িটার দিকে।
বারোটা বাজতে যখন ঠিক পাঁচ মিনিট বাকি, আমি একটা বোতল খুলে মদ ঢালতে গেলাম আর হাত ফস্কে বোতলটা মাটিতে পড়ল। না ভাঙলেও, বেশ খানিকটা মদ মাটিতে গড়িয়ে গেল।
দুটো গ্লাস ভর্তি করে বৌকে বললাম, শুভ নববর্ষ। আমাদের সব আশা সত্য হোক।
গ্লাসটা তুলে আমার দিকে ভয়ার্ত মুখ ও চোখ নিয়ে তাকাল ও।
তুমি বোতলটা ফেলে দিয়েছিলে ?
হ্যাঁ। তো ?
খুব খারাপ। খুবই খারাপ সংকেত। এ বছর ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটবে আমাদের।
ওর মুখ পাণ্ডুর।
বড্ড কুসংস্কার তোমার। বুড়িদের মতো কথা বলছ। খাও, খাও।
হয়তো পাগলামি আমার। কিন্তু খুব খারাপ কিছু নির্ঘাৎ ঘটবে, তুমি দেখে নিও।
এক ফোঁটাও না খেয়ে উঠে গেছিল ও। জানালার সামনে দাঁড়াল। চিন্তান্বিত। অর্ধেক বোতল শেষ করতে করতে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জ্ঞান দিতে দিতে এবং পায়চারী করতে করতে আমি বাইরে বেরিয়ে গেছিলাম―ঠান্ডা, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রান্তরের জনমানবহীনতায়।
এমব্যাংকমেন্ট ধরে হাঁটছিলাম।
গর্দভ মহিলা! আর কি খারাপ হবে! আর কি খারাপ হতে বাকি! অতীত ও বর্তমান―দুটোই তো নিঃস্ব, দুঃস্থ। অভিজাত পরিবারের সন্তান আমি। বাপ-মা সেই শৈশবে মারা গেলেন, স্কুল থেকে বের করে দিল! শ্রমিক হয়ে উঠলাম। সামান্য শ্রমিক। আশ্রয়হীন, আত্মীয়হীন, পেশাগত শিক্ষাহীন এক ফালতু লোক যার উচ্চতম অর্জন রেলের ওভার্সিয়ারি! মাছ ধরে, ভেজে, প্লেটের ওপর সস মাখিয়ে সাজিয়ে দেবার পর মাছের আর কী ক্ষতি করা যায়!
একটা ট্রেন আসছিল আমার দিকে। আমার ভাবনাগুলো এতই তিক্ত যে আমি যেন ওদের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। টেলিগ্রাফের গুঞ্জন, ট্রেনের ঝমঝম―আমারই চিন্তারা যেন বাক্সময়।
কী ভয়ঙ্কর হবে, আর ? হয়তো বউ খোয়াবো। সে আর এমন কি ভয়াবহ! বিবেকের থেকে লুকিয়ে রাখছি না: বউকে ভালোবাসি না আমি। সেই কৈশোরে বিয়ে করে ফেলেছি। এখন তো আমি তরুণ যুবক! আর ও ? বয়স্কা, সঙ্কুচিতা এক বোকা গর্দভ যার মাথায় কুসংস্কারের গুদাম। শিথিল, ম্রিয়মান স্তনের মিষ্টি মিষ্টি অসুস্থ প্রেম আমার কী কাজে লাগবে যখন আমার যৌবন পালাচ্ছে ? নারী তো আমার জীবনে এখন শুধু ট্রেনের জানালায়! আর এদিকে পড়ন্ত নক্ষত্রের মতো আমার পৌরুষ, আমার সাহস, আমার আকুতি, কাম সব নিভে আসছে রোজ, উড়ে যাচ্ছে ধুলোর মতো। আমি রোগে ভুগেছি, টাকা খুইয়েছি, প্রত্যেক দিন বকুনি খাই সুপিরিয়রের, ক্ষুধার্ত আমি এবং তিন চারটে শকুন ঘুরে বেড়ায় এ তল্লাটে। আরও শতবার আমি প্রশ্ন করছিলাম নিজেকে: এর চেয়ে আরও ভয়াবহ, আরও কষ্টকর আর কি ? দুর্ভাগ্য আর ব্যর্থতা ছাড়া কী দেখেছি আমি এ যাবৎ ? কী ?
বেরোনোর সময় ছোকরা যে মেঘ দুটিকে দেখেছিলাম চাঁদের সঙ্গে গলাগলি করতে, ওরা এখন চাঁদের থেকে একটু দূরে। কী সব কথা বলছিল ওরা নিজেদের মধ্যে―এমন ফিসফিসিয়ে এবং সন্তর্পণে যেন চাঁদ সেটা শুনতে না পায়।
তোমার জন্য একটা দারুণ খবর আছে―বাড়ি ঢুকতেই উজ্জ্বল হাসিমুখে বউ বলল। শিগগির নতুন জ্যকেটটা পরে এস, অতিথি এসেছেন একজন।
অতিথি! সে কি ? কে আবার ?
আরে সীমন্তিনী, আমার তরুণী কাকি। মলয় কাকুর বউ।
শুনেছি এর কথা ?
না। শোনোনি। বিস্ময়কর ওঁর আসা। কিন্তু প্লিজ, রেগে যেও না। দিন তিনেক থাকবেন। স্বামীটা শয়তানের বাচ্চা। বয়স্ক এবং স্বেচ্ছাচারী।
দীঘল চোখ নিয়ে মহিলাটি টেবিলে বসেছিলেন। সবকিছু, এমনকি মেঝের ধূলিও যেন নবীন হয়ে উঠেছিল ওঁর তারুণ্যে, সৌন্দর্যে আর মুখরতায়। ওঁর হাসি, সুগন্ধ, চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া দৃষ্টি, আঁখিপল্লবের মূর্ছনা ও গলার স্বর আমায় রঙ্গিনীর বার্তা দিয়েছিল। বলে দিতে হয়নি, আমি বুঝেছিলাম, উনি যে পালিয়ে এসেছেন। আমি বুঝেছিলাম মলয়কাকু বুড়া, স্বেচ্ছাতান্ত্রিক কিন্তু উনি হাসিখুশি এবং দয়ালু।
ওয়াও, আমার যে এমন সুন্দর ভাইপো আছে জানতাম না! দীঘল চোখ বলে উঠলেন।
আর আমার যে এমন জমকালো কাকি আছেন তাই বা কে জানতো!
আমি খুশিমাখা উত্তর দিই।
ডিনার শুরু হয়ে গেছিল। সীমন্তিনী দ্বিতীয় বোতলের প্রায় অর্ধেক উজাড় করে দিলেন। আর, আমার গিন্নী যখন অন্য ঘরে গেলেন, টক করে একটা গ্লাস একবারে মারলেন। মদ আমায় মাতাল করেছিল, সীমন্তিনীর উপস্থিতি মত্ত। সেই গানটা জানেন ?
আমায় পুড়িয়েছিল; কৃষ্ণসুন্দর আঁখি!
দীর্ণ করেছিল আমায়; কৃষ্ণসুন্দর আঁখি!
নিয়ে যাও প্রেম আমার
নিয়ে যাও ভয়!
এর পর কী হয়েছিল আমার মনে নেই। কেউ যদি জানতে চান প্রেম কী করে শুরু হয় তাঁদের বলব গল্প, উপন্যাস পড়ুন। আমি ও বিষয়ে খুব অল্পই বলতে পারি, তাও ওই বোকা গানটার খেই ধরেই :
দিন ছিল অশ্রেয়
তুমি যবে এলে প্রিয়…
উল্টেপাল্টে গেল সব পাগল, শয়তান প্রেমে। আমার শুধু সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা মনে আছে যার কেন্দ্রে আমি যেন একটা পালক। উড়িয়ে নিয়ে গেল সব―আমার স্ত্রী, সীমন্তিনী এবং আমার সব শক্তিও উড়ে গেল সেই ঝড়ে। সেই নির্বান্ধব হল্ট স্টেশন থেকে আজ আমি আঁধার রাতে, আঁধার পথে।
এর চেয়ে অকল্যাণকর, অশুভ আর কী ঘটতে পারত আমার জীবনে ? বলুন দেখি!
সচিত্রকরণ : শিকদার সৈকত