অনুবাদ গল্প : ঘুমন্ত রাজকুমারী এবং হাওয়াই জাহাজ

মূল : গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
বাংলা অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত
[গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (৬ মার্চ, ১৯২৭ – ১৭ এপ্রিল, ২০১৪ ), যিনি গাবো নামেও পরিচিত ছিলেন, একজন কলম্বীয় সাহিত্যিক, সাংবাদিক, প্রকাশক ও রাজনীতিবিদ এবং ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নিঃসঙ্গতার একশ বছর বইয়ের লেখক হিসেবে তিনি বিশেষভাবে পরিচিত। কলম্বিয়ার সন্তান গার্সিয়া মার্কেস জীবনের বেশির ভাগ সময় বসবাস করেছেন মেক্সিকো এবং ইউরোপের বিভিন্ন শহরে।সাহিত্যবিশারদদের মতে তিনি হোর্হে লুইস বোর্হেস এবং হুলিও কোর্তাসারের সাথে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দক্ষিণ আমেরিকান কথাসাহিত্যিক। একই সঙ্গে জনপ্রিয় এবং মহৎ লেখক হিসেবে চার্লস ডিকেন্স, লেভ তলস্তয় ও আর্নেস্ট হেমিংওয়ের সঙ্গে তার নাম উচ্চারিত হয়। ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সময় সুইডিশ একাডেমি মন্তব্য করেছিল যে তাঁর প্রতিটি নতুন গ্রন্থের প্রকাশনা বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মতো। জনমানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক যোগাযোগের কারণে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল প্রবাদপ্রতিম।]
মেয়েটি সুন্দরী এবং তৎপর। গৌরবর্ণ কোমল ত্বক, সবুজ চোখ, কাঁধের ওপর ফেলে রাখা ঘন কৃষ্ণ কেশরাশি। সত্তাজুড়ে সুদূর অতীতের মোহময় আবরণ। ইন্দোনেশিয়ার মেয়ে না পার্বত্য আন্দেজের বোঝা মুশকিল। পোশাক-আশাকে সূক্ষ্ম রুচির ছোঁয়া―লিনক্সের জ্যাকেট, কমনীয় ফুলের নক্সাকাটা রেশমের ব্লাউজ, লিনেনের ট্রাউজার, আর বুগেনভেলিয়া ফুলের রঙের সরু স্ট্রাইপ দেওয়া ছুঁচলো জুতা। ‘আমার নিজের দেখা শ্রেষ্ঠ সুন্দরী’, পারির শার্ল দ্য গল বিমানবন্দরে নিউ ইয়র্ক যাবার চেক-ইন লাইনে অপেক্ষারত অবস্থায় মেয়েটিকে সিংহীর অলক্ষ্যসঞ্চারী পদক্ষেপে হেঁটে যেতে দেখে আমার মনে হলো। এক লহমার অনৈসর্গিক সন্নিধির রেশ রেখে টার্মিনালের দিকে জনতার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।
তখন সকাল নটা। সারা রাত তুষারপাতের ফলে শহরের রাস্তায় যানবাহনের ভিড় যথেষ্ট বেশি, বিশেষ করে হাইওয়েতে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাক আর ট্রলির জন্য গতি আরও মন্থর। তুষারের ওপর সেই সব যানবাহনের ধোঁয়ায় পরিবেশ কলুষিত। বিমানবন্দরের ভেতরে অবশ্য বসন্ত বিদ্যমান।
একজন ডাচ রমণীর পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম। তাঁর এগারোখানা স্যুটকেসের ওজন নিয়ে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে টিকিট-ক্লার্কের সঙ্গে বাগ্-বিতণ্ডা করে চলেছেন। বেশ বিরক্ত বোধ করছিলাম, আর তখনই সেই অচির অনির্বচনীয় অভ্যুদয় আমাকে এমনই আনমনা করে চলে গেল যে বিতর্কের অবসান কখন হলো টেরই পাইনি। মেঘের কল্পরাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে এলাম আমার অন্যমনস্কতায় টিকিট-ক্লার্কের মৃদু অসন্তোষ প্রকাশে। পরিবেশ হালকা করার জন্য ওর কাছে জানতে চাইলাম প্রথম দর্শনে প্রেমে ও বিশ্বাস করে কিনা। ‘নিশ্চয়ই করি,’ মেয়েটি বলল। ‘অন্য কিছু কল্পনায়ই আনা যায় না।’ কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে জানতে চাইল ধূমপায়ী না অধূমপায়ী কোন ধরনের আসন পছন্দ আমার।
‘তাতে কিছু যায় আসে না,’ কণ্ঠস্বরে বেশ খানিক বিদ্বেষ ফুটিয়ে বললাম, ‘ওই এগারোটা স্যুটকেসের পাশে বসতে না হলেই হলো।’
কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে চোখ না তুলেই, বাণিজ্যিক হাসি দিয়ে আমার কথার রসোপলব্ধি করল।
‘একটা সংখ্যা নির্বাচন করুন,’ মেয়েটি বলল। ‘তিন, চার, না সাত ?’
‘চার।’
মেয়েটির মুখে সাফল্যের হাসি। বলল, ‘আমার পনেরো বছরের অভিজ্ঞতায়, আপনিই প্রথম যিনি সাত পছন্দ করলেন না।’
বোর্ডিং পাসের ওপর নম্বরটা লিখে অন্য কাগজপত্রের সঙ্গে সেটি আমাকে ফেরত দিল। সবুজ চোখ মেলে আমার পানে চাইল। স্বপ্নসুন্দরীর বিচ্ছেদে আমার বেদনাতুর হৃদয়ে এ যেন এক সান্ত্বনা পুরস্কার। মেয়েটি জানাল যে সাময়িকভাবে বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়, সব উড়ানই দেরি করে ছাড়বে।
‘সে কতক্ষণ ?’
‘একমাত্র ভগবানই বলতে পারবেন,’ মেয়েটি হেসে বলল। ‘রেডিও জানিয়েছে আজ সকালের তুষারপাত নাকি এ বছরের বৃহত্তম।’
মেয়েটি ঠিক জানত না। বছর নয় শতাব্দীর বৃহত্তম আজকের তুষারপাত। তবে প্রথম শ্রেণির যাত্রী প্রতীক্ষালয়ে বসন্ত এতটাই অকৃত্রিম যে ফুলদানিতে রাখা গোলাপ আর চ্যানেলে পরিবেশিত সংগীতের মূর্ছনা হৃদয়ে সুগভীর প্রশান্তি ছড়িয়ে দিল। যে আবেগ এই সৃষ্টিকে অনুপ্রাণিত করেছিল, সেটাই যেন অনুভব করলাম। চকিতে মনে হলো আমার স্বপ্নসুন্দরীর জন্য এ যে অত্যন্ত অনুকূল পরিবেশ। খুব সাহসী দৃষ্টিক্ষেপ করে প্রতীক্ষালয়ের আনাচে কানাচে ওর সন্ধান করে চললাম। নজরে এল ইংরেজি সংবাদপত্রে চোখ ডুবিয়ে রাখা রূঢ় বাস্তব থেকে উঠে আসা কিছু পুরুষমানুষ, আর সারি সারি বিস্তীর্ণ গবাক্ষের মধ্য দিয়ে বিমানবন্দরে তুষারে আটক বিমান, অবিরাম তুষারপাত আর অদূরে শার্দুল অধ্যুষিত রোয়াসি গ্রামের বিস্তৃত প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে পরপুরুষের চিন্তায় মগ্ন তাদের পত্নীরা। অপরাহ্নের মধ্যে বসার কোনও জায়গা আর খালি রইল না। উত্তাপ অসহ্য হতেই মন টাটকা বাতাসের জন্য আকুল হয়ে পড়ল।
বাইরের দৃশ্য অভূতপূর্ব। প্রতিটা প্রতীক্ষালয় লোকে লোকারণ্য। সিঁড়ি, গলি কানায় কানায় ভর্তি। অনেকেই স্থান অকুলান দেখে মেঝেতে আশ্রয় নিয়েছে। পশু, শিশু, জিনিসপত্র সব কিছু মিলে ঠাসাঠাসি ভিড়। শহরের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের ডোমটা ঝঞ্ঝাবিধ্বস্ত মহাকাশযান মনে হচ্ছিল। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যেও মনে হলো আমার স্বপ্নসুন্দরী এই ভিড়েই কোথাও রয়েছে। ভাবনাটা আমাকে আরও প্রতীক্ষা করার অনুপ্রেরণা জোগাল।
মধ্যাহ্নভোজনের সময় মনে হলো আমাদের যেন জাহাজডুবি হয়েছে। সাতটা রেস্তোরাঁ, কাফেটেরিয়া, আর বারে কাতারে কাতারে মানুষের ভিড়, আর ঘণ্টা তিনেকের মধ্যেই সেগুলোও বন্ধ করে দেওয়া হলো, কারণ খাদ্য আর পানীয় দুই-ই নিঃশেষ হয়ে গেছিল। শিশুরা একসঙ্গে প্রবল কান্না জুড়ে দিল, পৃথিবীর সব শিশুই যেন সেই বিশেষ মুহূর্তে ওখানে এসে জমায়েত হয়েছে। বিপুল মানুষের সমাবেশের ফলে একটা যূথভূত পানসে গন্ধ পরিবেশকে অস্বস্তিকর করে তুলল। সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজেকে সমর্পণ করার মুহূর্ত। এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আমি শিশু ও অল্পবয়সীদের খাবার স্টল থেকে শেষ দুটো ভ্যানিলা আইসক্রিমের কাপ কোনওভাবে জোগাড় করতে পারলাম। গ্রাহক না থাকায় স্টলের কর্মচারীরা টেবিলের ওপর চেয়ার তুলে রাখতে শুরু করে দিয়েছে। কার্ডবোর্ডের শেষ কাপ থেকে কার্ডবোর্ডের শেষ চামচ দিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে আমি আয়নায় নিজেকে দেখছিলাম আর আমার স্বপ্নসুন্দরীর কথা ভাবছিলাম।
সকাল এগারোটার নিউ ইয়র্কের উড়ান রাত আটটায় ছাড়ল। যতক্ষণে বিমানে উঠবার সুযোগ পেলাম, ততক্ষণে প্রথম শ্রেণির অন্যান্য যাত্রীরা আসনে বসে পড়েছেন। একজন বিমান পরিচারক আমাকে আসনের দিকে নিয়ে গেল। হৃৎস্পন্দন বন্ধ হবার জোগাড়! ঠিক আমার পাশের আসনে, জানালার ধারে, স্বপ্নসুন্দরী অত্যন্ত দক্ষ যাত্রীর মতো নিজে জায়গার দখল নিচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, ‘যদি কখনও লিখি এই কথাটা, কেউ বিশ্বাসই করতেই চাইবে না!’ অস্ফুট স্বরে, প্রায় তোৎলে ওর দিকে একটা দ্বিধান্বিত অভিবাদন ছুড়ে দিয়ে নিজের আসনে বসে পড়লাম। শুনতে পেল বলে মনে হলো না।
নিপুণ দক্ষতায় জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখে আসনের স্বল্প পরিসরে এমন আদর্শ গৃহের রূপ ফুটিয়ে তুলল, যাতে হাত বাড়ালেই ঈপ্সিত বস্তুটি মিলে যায়। সব কিছুর পরে নিজ আসনে প্রতিষ্ঠিত হবার পর মনে হলো যেন জীবনের অনেকগুলো বছর ওকে এখানেই যাপন করতে হবে। ইতিমধ্যে বিমানসেবক আমাদের অভ্যর্থনার জন্য শ্যাম্পেন পরিবেশন করতে এলেন। একটা গ্লাস ওর জন্য উঠিয়ে নিয়েও কী ভেবে নিজেকে সম্বরণ করলাম। ভাগ্যিস! এক গ্লাস জলই শুধু ওর দরকার আর―প্রথমে দুর্বোধ্য ফরাসিতে, পরে ইংরেজিতে―সেটাও বেশ দ্রুত লয়ে―নির্দেশ জারি করল―শূন্যধাবনের সময়ে কোনও কারণেই যেন তার নিদ্রায় ব্যাঘাত না ঘটানো হয়। উষ্ণ গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে প্রাচ্যদেশীয় বিষাদের আভাস।
জল নিয়ে আসার পর, প্রায় ঠাকুমার তোরঙ্গের আকারের, তাম্রকোণযুক্ত প্রসাধন পেটিকা কোলের ওপর রেখে, একটা বাক্সের বহুবর্ণের বড়ির থেকে সোনালি রঙের দুটো বড়ি তুলে নিল। ওর সকল কার্যকলাপই এমন এক ভাবগম্ভীর শৃঙ্খলাবোধ দ্বারা চালিত যেন আজন্ম ওকে কোনও অভাবিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। অবশেষে ও জানলার শেড নামিয়ে নিল, আসনটা পেছনে হেলিয়ে নিল যত দূর যায়, কোমর পর্যন্ত কম্বল দিয়ে ঢেকে নিল জুতা না খুলে, স্লিপিং মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে আমার দিকে পেছন ফিরল। তারপর নিউ ইয়র্ক পৌঁছনোর অনন্ত যাত্রার আট ঘণ্টা এবং বিলম্বের জন্য বাড়তি বারো মিনিট নিরবচ্ছিন্ন সুপ্তিতে বিভোর হয়ে রইল, অবস্থানের চুলমাত্র অদলবদল না ঘটিয়ে, এবং মুখ থেকে সামান্যতম কাতরোক্তি বের না করে।
সে এক অনুরাগময় উড়ান। প্রকৃতির সুন্দরতম দান হলো সুন্দরী মহিলা, এ কথা আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই আমারই পাশের আসনে বসা, অচেতন নিদ্রায় বিভোর, কল্পকাহিনি থেকে উঠে আসা এই নায়িকার মোহ আবরণ এক লহমার জন্যেও ছিন্ন করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। বিমান বায়ুবাহিত হওয়ার পরেই সেই বিমানসেবক অদৃশ্য হয়ে গেলেন। তাঁর জায়গা যিনি নিলেন নিজেই নিজের তুলনা। সুন্দরীর নিদ্রাভঙ্গ করে ওর করকমলে একটি প্রসাধনের বাক্স এবং সঙ্গীত উপভোগ করার জন্য একজোড়া ইয়ারফোন ধরিয়ে দেওয়া তাঁর মনোগত বাসনা। সুন্দরী যে নির্দেশ জারি করে নিদ্রার জগতে পাড়ি লাগিয়েছিল, সেটা শুনিয়ে দিলাম। কথাটা তিনি সুন্দরীর নিজের মুখ থেকেই শুনতে চান এবং সেই সঙ্গে নৈশাহার লাগবে কি না, সেটা নিশ্চিত করা। সুন্দরী ‘আমাকে বিরক্ত করিবেন না’ জাতীয় কোনও ইশতেহার গলায় ঝুলিয়েও রাখেননি। ফলে আমাকে ভর্ৎসিত হতে হলো।
নৈশাহার নিঃসঙ্গতায় সমাপ্ত হলো। জেগে থাকলে যে কথাগুলো ওকে বলতে পারতাম সেগুলোই মনে মনে আওড়াতে লাগলাম। এতটাই নিঃসাড়ে মেয়েটা ঘুমাচ্ছিল যে, হয়তো ওই দুটো বড়ি ঘুম নয় মৃত্যুর অতলে তলিয়ে যাবার জন্য, এরকম একটা বেদনাদায়ক ভাবনা কিছুক্ষণের জন্য হলেও মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। প্রত্যেকবার পান করার সময় পানপাত্র তুলে ধরে সুন্দরীর স্বাস্থ্যকামনা করছিলাম :
‘তোমার উত্তম স্বাস্থ্যের কামনায়, হে সুন্দরী!’
নৈশাহার হয়ে যাবার পর ক্যাবিনের আলো কমিয়ে দেওয়া হলো। একটা মুভি দেখানো শুরু হলো, কেউই দেখলাম না। বিশ্বময় অন্ধকারাচ্ছন্নতায় কেবল আমরা দুজন। শতাব্দীর প্রবলতম তুষারঝঞ্ঝা সমাহিত। অতলান্তিক যামিনী অপরিমেয়, অনাবিল। নক্ষত্র পরিবৃত হাওয়া জাহাজ নিশ্চল। প্রহরের পর প্রহরজুড়ে ওর বিদ্যমানতায় প্রতি ইঞ্চিতে নিজেকে নিবিড়ভাবে মগ্ন রাখলাম। একরাশ স্বপ্ন ছায়া হয়ে ওর মুখের ওপর ঘোরাফেরা করছে, জলের ওপর ভেসে থাকা একফালি মেঘের মতন। প্রাণের স্পন্দন বলতে এটুকুই। গলায় সূক্ষ্ম সোনার চেন, সোনালি ত্বকের মাঝে মিশে আছে। অলঙ্কারছিদ্রবিহীন নিখুঁত কান। গোলাপি আভাযুক্ত সুস্থ নখ। বাঁ হাতের অনামিকায় চাকচিক্যহীন অঙ্গুরীয়। মেয়েটিকে দেখে বছর কুড়ির বেশি মনে হয় না। এই ভেবে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম ওটা বিবাহের আংটি হতেই পারে না, বড়জোর ক্ষণস্থায়ী কোনও প্রতিশ্রুতির নিদর্শন। শ্যাম্পেনের ফেনায়িত বুদ্বুদের দিকে তাকিয়ে আমার জেরার্দো দিয়েগোর অসাধারণ সনেটটা মনে পড়ে গেল : ‘আমার শৃঙ্খলিত বাহুর খুব নিকটেই, যদি জানি, তুমি নিদ্রিত রয়েছ, নিশ্চিন্তে, আত্মোৎসর্গের সঙ্কল্পে অবিচল, অখণ্ড পবিত্রতায়।’ তারপর আমার আসনের পেছনটা ওর সমতলে হেলিয়ে দিলাম। এখন আমরা দুজনে শুয়ে আছি, খুব কাছাকাছি, বিবাহশয্যায় রাখা ব্যবধানটুকুও নেই। ওর শ্বাসপ্রশ্বাসের পরিমণ্ডল আর কণ্ঠস্বর একসূত্রে গাঁথা। কমনীয় প্রশ্বাসে ওর ত্বকে মাধুর্যের সৌরভ। অবিশ্বাসনীয় মনে হচ্ছিল। গত বসন্তে ইয়াসুনারি কাওয়াবাতার চমৎকার একটা উপন্যাস পড়েছিলাম। কিয়োতোর প্রাচীন বুর্জোয়াশ্রেণি অপ্রতুল অর্থ ব্যয় করতেন শহরের সুন্দরতম ললনাদের নগ্ন, মাদকাসক্ত শরীর রাত্রিভর দৃষ্টিলেহন করার তাড়নায়। একই শয্যায় এঁরাও নিশিযাপন করতেন অতৃপ্ত যৌনতাড়নার অস্থিরতা নিয়ে। এদের নিদ্রাভঙ্গ বা স্পর্শ করার অধিকার এঁদের ছিল না। চেষ্টাও করতেন না। কারণ দৃষ্টিলেহনের মাধ্যমে কামচরিতার্থ করাটাই ছিল এঁদের একমাত্র সম্বল। সেদিন রাত্রে নিদ্রারতা সুন্দরীর পানে চেয়ে থাকতে থাকতে, সেই বার্ধক্যগ্রস্ত কামুকদের মনস্তত্ত্ব উপলব্ধি করাই শুধু নয়, নিজেকেও সেই কামনাবহ্নিতে পুরোপুরি সমর্পণ করে দিয়েছিলাম।
‘কে ভাবতে পেরেছিল,’ শ্যাম্পেনের প্রভাবে উজ্জীবিত হয়ে আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘যে জীবনের এই শেষ প্রান্তে পৌঁছে অতিবৃদ্ধ জাপানিদের মতো আমিও একই নেশার শিকার হব!’
শ্যাম্পেন এবং নীরব করে রাখা মুভির বিস্ফোরণে পরাক্রান্ত হয়ে বোধহয় কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জেগে উঠতেই টের পেলাম মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে। বাথরুমে গেলাম। আমার দুটো আসন পরে এগারো স্যুটকেসওয়ালা সেই বৃদ্ধা মহিলা বেখাপ্পাভাবে এঁকেবেঁকে শুয়ে আছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকা বেওয়ারিশ মৃতদেহের মতো। রঙিন পুঁতির চেন লাগানো ওঁর চশমা করিডরের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। সেটা উঠিয়ে না দিয়ে আমি এক হিংস্র উল্লাস বোধ করলাম।
শ্যাম্পেনের মাত্রাধিক্য থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেবার পর আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছায়ায় নজর পড়ল। কী ঘৃণিত আর কুৎসিত দেখাচ্ছে! প্রণয় বিধ্বস্ততায় চেহারা এমন ভয়াবহ হয়ে যেতে পারে ভেবে চমকে উঠলাম। কোনও সতর্কীকরণ ছাড়াই উচ্চতা হঠাৎ হ্রাস করে বিমান পূর্ণগতিতে এগিয়ে চলল। ‘নিজের জায়গায় ফিরে যান’ সংকেত জ্বলে উঠল। দ্রুত পা চালিয়ে আমি নিজের আসনে ফিরে এলাম। ঈশ্বর-প্রেরিত এই সহিংস বিশৃঙ্খলায় সুন্দরীর সুখনিদ্রার ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আমার বাহুডোরে আশ্রয় নিয়েই হয়তো আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে চাইবে। তাড়াহুড়ায় সেই ডাচ মহিলার চশমায় আমার পা প্রায় পড়েই গেছিল। সেটা হলে খুশিই হতাম। যাই হোক পিছিয়ে গিয়ে ওটা উঠিয়ে নিয়ে ভদ্রমহিলার কোলের ওপর ফেলে দিলাম। আমি নেবার আগেই চার নম্বর আসনটা না নিয়ে নেবার জন্য সহসা ওঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম।
বিশৃঙ্খলাও সুন্দরীর নিñিদ্র নিদ্রাকে জয় করতে পারেনি। বিমান থিতু হবার পর, যে কোনও অজুহাতে ওকে ঝাঁকানি দিয়ে জাগিয়ে দেবার প্রলোভন থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে সম্বরণ করলাম। বিমানযাত্রার এই শেষ কয়েক ঘণ্টায় ওকে আমার জাগ্রত দেখার বাসনা হচ্ছিল। হয়তো অগ্নিমূর্তি ধারণ করবে তবু। তাতে করে আমার স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে পাব, হয়তো যৌবনও। পেরে উঠলাম না। ‘ধুর ছাই!’ নিদারুণ অবজ্ঞাভরে ভাবলাম। ‘আমার জন্ম কেন যে বৃষ রাশিতে হলো না!’
বিমান অবতরণের আলো জ্বলে উঠতে ও নিজে থেকেই জেগে উঠল। সতেজ আর সুন্দর, যেন কোনও গোলাপ বাগিচার ভেতরে ঘুমিয়ে ছিল। তখনই মনে হলো প্রৌঢ় দম্পতিদের মতন বিমানের পাশাপাশি আসনের যাত্রীরাও, জেগে ওঠার পর, একে অপরকে প্রত্যুষের শুভেচ্ছা জানায় না। সুন্দরীও ব্যতিক্রমী হলো না। মাস্কটা খুলে ফেলে দীপ্র চোখ মেলে তাকাল, আসনের পেছনটা সোজা করল, কম্বলটা পাশে সরিয়ে রাখল, কেশরাশিকে নাড়া দিতেই স্বস্থানে গড়িয়ে পড়ল, দ্রুত হাতে অহেতুক মেক-আপে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, যাতে বিমানের দরজা খোলা অবধি আমার দিকে তাকাতে না হয়। তারপর লিনক্সের জ্যাকেটটা পরে, প্রায় আমাকে মাড়িয়ে দিয়ে, বিশুদ্ধ লাতিন আমেরিকান স্প্যানিশে গতানুগতিক মাপ চাওয়া গোছের বাক্যবন্ধ ছুড়েদিল। কোনও বিদায় অভিবাদন নয়। এমনকি রাত্রিভর দু’জনে পাশাপাশি থাকার যে সুখদ পরিবেশ রচনা করেছিলাম তার জন্য কোনও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন, তাও নয়। হনহন করে এগিয়ে গিয়ে নিউ ইয়র্ক নামক অ্যামাজনের জঙ্গলে আজকের সূর্যকিরণে চিরকালের মতো হারিয়ে গেল।
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ