অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : একগুচ্ছ অণুগল্প

মূল : অগাস্তিনা বাজতেরিকা

বাংলা অনুবাদ : এলহাম হোসেন

[অগাস্তিনা বাজতেরিকার জন্ম ১৯৭৪ সালে আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ারস-এ। পড়াশোনা করেছেন চারুকলা নিয়ে। ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখে তিনি পাঠকমহলে বেশ পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তিনি স্থানীয় ভাষা ও ইংরেজিতে লেখেন। লেখালেখির জন্য এ পর্যন্ত অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। জাদুবাস্তবতা কৌশল ব্যবহারের কারণে তাঁর রচিত সাহিত্যকর্ম পাঠে পাঠককে বিশেষ মনোযোগ দিতে হয়। অনূদিত অণুগল্পগুলো তাঁর ১৯ 19 Claws and a Black Bird (2023) শিরোনামের গল্পসংকলন থেকে সংগৃহীত।]

দোজখ

তিন বৃদ্ধা একসঙ্গে যাচ্ছেন। হাতে হাত ধরে। সময়ের বাইরে এসে ওরা মিথজৈবিক ক্রিয়ায় লিপ্ত হয়েছেন। ওদের শরীরের জীর্ণদশা বহনকারী হাড়গুলো চামড়ার নিচে যেন খনিজ লবণে সিজন করা। ওদের ধমনীতে বয়ে চলা রক্ত কারুকাজ খচিত। যেন মুক্তার ঝালর ওদের শ্রান্তির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। ওরা একে অপরকে ভালোবাসে কারণ, ওরা একে অপরকে পাত্তা দেয় না।

বৃদ্ধারা উচ্ছ্বসিত। ওরা ট্রিনিটির জ্ঞানে ঋদ্ধ। ওটিই ওদের চালিকাশক্তি। ওদের দেখে মনে হয় শান্ত, নিশ্চুপ। যেন গতিহীন গ্লুকোজ-জমা রক্ত সব চঞ্চলতা হারিয়েছে। তবে ওরা এতটাই ধীরে ধীরে হাঁটছে যেন ওদের নড়াচড়াকে বিমূর্ত ক্রিয়া মনে হচ্ছে।

যে মুহূর্তগুলো ওদের অমরত্ব দিতে পারে সেগুলো জ¦লজ¦লে সকালটা থেকে নিঃশব্দের আকারে উবে গেছে।

ওরা খাঁচায় করে একটা পাখি নিয়ে যাচ্ছেন। পাখিটার নাদুসনুদুস শরীর খাঁচার শক্ত ও কালো শিকগুলোকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। পাখিটার নড়াচড়াহীন অবস্থা বৃদ্ধ মহিলাদের নিস্তরঙ্গ জীবনের প্রতীক বহন করে। ওরা সযত্নে পাখিটির পালকগুলো স্পর্শ করেন। রেশমের মতো পেলব। পাখিটির মন্দলাগা অনুভূতি যেন তার সব নীরবতা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসে।

নির্ভয়ে বৃদ্ধারা তাঁদের অস্থিরতা প্রকাশ করেন। গোটা পার্ক জুড়ে। দুরারোধ্য ভঙ্গুরতার এক দুর্ভেদ্য দেয়াল তৈরি করেন। এক ধরনের স্বচ্ছ, কৌশলী, সজীব গতিবিধি প্রদর্শন করতে থাকেন। ওদের নিঃশ্বাস এক অদৃশ্য সুতার কুণ্ডলী তৈরি করে। বারংবার প্রদর্শিত আবেগের ভঙ্গুর ও ক্ষণস্থায়ী শক্তি ওদের মধ্যে এক ক্লান্তিকর সম্পর্কের বাঁধন তৈরি করেছে। ওরা একসঙ্গে একটা বসার জায়গা বেছে নিলেন। এক দুর্বোধ্য, অচেনা-অজানা, উন্মত্ত নৃত্য করলেন।

ওরা একটা কাল্পনিক সুগন্ধি প্রদর্শন করেন। বলিরেখাগুলো ছড়িয়ে বড় হয়ে যায়। বাজে গন্ধ বের হয়। এসবের সবই ভুয়া। স্নিগ্ধ দিনের বাতাসে ভর করে কয়েক মিনিট থাকে এই দুর্গন্ধ।

বেশ ভাবগাম্ভীর্যের  সঙ্গে ওরা খাঁচাটা নিচে রাখেন। পাথরে ধাক্কা লাগে। পাখিটা কেঁপে ওঠে। সেদ্ধ হচ্ছে। জ¦লছে। পাখিটা একটু সরতে চাইলো। খাঁচাটা কিঞ্চিৎ সরে গেল। একটা পালক খসে পড়ল। তারপর আরেকটা। বৃদ্ধারা একে অপরের দিকে বেশ সমীহমিশ্রিত হতাশায় তাকালেন। ওরা জুতা দিয়ে খাঁচাটাকে আড়াল করেন। এতে পাখিটা তার শুষ্ক শরীর আর ভীত-সন্ত্রস্ত নখরে আঘাত পায়। পাখিটা খাঁচার ভেতরে জড়সড় হয়ে পড়ে। ভয়ে এক পাশে সেঁটে থাকে। বৃদ্ধারা পাখিটিকে আদর করেন। কিন্তু তাঁদের আদর বড়ই নির্দয়, একেবারে খাঁটি নির্মমতা।

ওরা একটা রুটিভর্তি থলে বের করেন। কোঁচকানো। ব্যাগের গায়ে ঘুঘু ও শালিক পাখির ছবি আঁকা। বৃদ্ধাদের চোখেমুখে প্রশান্ত  হাসি ছড়িয়ে পড়ে। রুটি বের করার সময় ওদের মধ্যে অস্থিরতা দেখা যায়। পাখিটা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। ওর আকৃতির বিকৃতি ঘটে। ওরা খাঁচাটা চাপ দিয়ে চিঁড়েচ্যাপ্টা করতে থাকেন। এর ভেতরে থাকা পাখির ছটফট করার ব্যাপারটিকে পাত্তা দেন না। পাখির শরীরটা দুমড়েমুচড়ে ফেলেন। ওদের সুঁচালো পায়ের গোড়ালি দিয়ে পাখির সাদা পালকগুলো নোংরা করতে থাকেন।

উজ্জ্বল আলোয় যে সময়টাতে ওদের রাশভারী দেখাচ্ছিল, সেই সময়টা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। গরম পাথরটা খাঁচার পাখিগুলোর হাবভাব বদলে দেয়। ওরা স্তব্ধ, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। বৃদ্ধারা খাওয়া বন্ধ করেন না। খাঁচার পাখিগুলোর মধ্যে একটা অকল্পনীয় যুদ্ধ শুরু হয়। ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁটের। নখরের সঙ্গে নখরের। একটা ঘুঘু একটা শালিককে আক্রমণ করে বসে। মেরে ফেলে। পাথরের গায়ে রক্ত পড়ে ফুটতে থাকে। বৃদ্ধারা সন্ত্রস্ত ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়েন। ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। মৃত শালিকটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। চোখে-মুখে বিস্ময়, ভিন্ন রং, বলিরেখাগুলো আরও দীর্ঘ হয়ে যায়।

রোদে-পোড়া দুপুরে দিনটি সব উত্তাপ নিয়ে ফেটে পড়ে।

পাখিটি এবার অনুভব করল যে, খাঁচাটা শিথিল হয়ে আসছে। জুতাগুলো আর খোঁচাচ্ছে না। এখন পাখাগুলো নাড়ানো যায়। এটি খাঁচার মধ্যে চারপাশে পাখা ঝাড়তে লাগল। পাথরের উত্তাপ খাঁচার ভেতরে রাখা কাঠি পর্যন্ত পৌঁছল। এতে পাখিটির চামড়া পুড়ে গেল। খাঁচা কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেল। একটা চাপা, ফাঁপা শব্দ শোনা গেল। পাখিটির বাম ডানা ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়ে গেল। এরপর ধাতব একটা শব্দ শোনা গেল। স্ক্রু খোলার শব্দ। পাখিটি কোনওরকম ব্যথা অনুভব করল না। ধীরে ধীরে একটি পবিত্র হাত খাঁচার দরজা খুলে দিল। বৃদ্ধারা এ দৃশ্য দেখতে পেলেন না। মৃত শালিক এবং মাটিতে ফুটতে থাকা রক্ত দেখে ওরা ভয় পেলেন।

পাখিটি খাঁচার বাইরে মাথাটি বের করল। প্রতিটি সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা ও দিন যে এর সাদা পালকগুলোর ওপর ক্রিয়াশীল ছিল, তা সে অনুভব করল। একটু কেঁপে উঠল। বৃদ্ধারা দৃশ্যটি দেখতে পেলেন। খাঁচাটা তুলে নিয়ে উত্তপ্ত দণ্ডের সঙ্গে আঘাত করে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন।

সম্ভবত পাখিটি সম্ভাব্য সব নক্ষত্রপুঞ্জের বিষয় জানে, বোঝে। হয়তো পুরো ব্রহ্মাণ্ডের বিষয়। এবার প্রথমবারের মতো পাখিটি নরকের এক ঝলক দেখতে পায়।

একটা পালক খসে পড়ল। তারপর আরেকটা।

হালকা, দ্রুত, কিন্তু ভয়ঙ্কর শব্দ

প্রথমে দাঁতের পাটি দুটো আপনার আঙিনার নীল টাইলসের ওপর খসে পড়ল। একেবারে দুই ভাগ হয়ে গেল। কর্কশ ধাতব শব্দে আপনি চলতে চলতে থেমে পড়লেন। একপাটি দাঁত তুলে নেওয়ার জন্য বসে পড়লেন। এটি অবশ্য কোনও বুড়া, অগোছালো লোকের। দাঁতের যত্ন একেবারেই নেয় না। আপনি থতমত খেয়ে ভাবলেন, এটা কার হতে পারে। সম্ভবত কোনও প্রতিবেশীর হতে পারে, যে হয়তো বেখেয়ালে ফেলে গেছে অথবা ফেলে দিয়েছে। অপর পাটির দাঁত কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য এককদম সামনে এগোতেই আপনার মনে হলো―ঘটনাটা আপনার ইচ্ছাবিরুদ্ধ। দাঁতের ডাক্তারের আঙিনাতেই কেবল দাঁতের পাটিগুলো পড়ে রইল কেন ? ঠিক সেই মুহূর্তে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মেনেন্দেজের নিথর দেহটা মাটিতে এসে পড়ল।

মেনেন্দেজের দেহটা পড়ার শব্দ আলতো, ক্ষীণ, ভঙ্গুর। শব্দটি আপনার আঙিনার নীল টাইলসের মধ্যে বিলীন হয়ে গেল। সেই অশ্রুতপূর্ব ও চাপা শব্দ আপনাকে অবশ করে দিল। আপনি দাঁতের পাটিগুলো ততক্ষণ ধরে থাকলেন যতক্ষণ না ওগুলো দিয়ে আপনার হাত কেটে গেল। মেনেন্দেজের দেহ-নিঃসৃত রক্তে আপনার আঙিনা রঞ্জিত হয়ে গেল। ভেবেছিলেন, ওর রক্তে আপনার আঙিনা সয়লাব হওয়ার শব্দ শুনতে পাবেন। ভেবেছিলেন, রক্ত বয়ে যাওয়ার শব্দ শীতের হাওয়ার শব্দের মতো মৃদু, চঞ্চল, অথচ ভয়ানক।

আপনি কুঁজা হয়ে এমনভাবে বসলেন যেন এভাবে বসা আপনার অভ্যেস। তারপর আপনার নগ্ন পা দুটোর কাছে পড়ে থাকা দাঁতের মাড়িটি কুড়িয়ে নিলেন। এভাবে অবশ্য অনেকেই জানুয়ারি মাসের প্রথম দিনে জুতা ছাড়াই হাঁটে। বিশেষ করে, বছরের প্রথম ছুটির দিনে, বাসায়। এটিকে সুঅভ্যাস বলা মনে করা হয়। মেনেন্দেজের দেহটা আপনার আঙিনার টাইলসের ওপর নিস্তেজ পড়ে রয়েছে। তার দাঁতবিহীন নিথর দেহটির দিকে আপনি তাকিয়ে রইলেন। একটু হাসলেন, কারণ ভাবলেন, আপনি খুব সহজেই দাঁতের মাড়ি দুটি সেট করে দিতে পারতেন। তাও আবার বিনা পয়সায়। মেনেন্দেজ আপনার প্রতিবেশী তো, তাই। ওর মুখটা এখন খোলা, হা হয়ে আছে। ফাঁকা। চোখেমুখে ছড়িয়ে আছে ঘৃণা। তার সব ঘৃণা একজন মহিলার দিকে তাক করা। সেই মহিলা অ্যাপার্টমেন্ট ‘বি’-তে থাকেন। তার প্রতিবেশী।

এরপর মেনেন্দেজের রক্ত দেখতে পেলেন। মূলত এর রঙ কালো। ধীরে ধীরে গড়িয়ে আসছিল আপনার ডান পায়ের দিকে। দুয়ের মধ্যে মাত্র আধা সেন্টিমিটার ব্যবধান। দুর্বল হাড়গুলো প্রচণ্ড আঘাতের অভিঘাতে গুঁড়িয়ে গেছে। হলুদ, তেল চটচটে আর বীভৎস তাঁর ত্বক। মুখে কোনও দাঁত নাই। নোংরা বুড়া মেনেন্দেজ।

আপনার বাড়ির আঙিনায় তার নিষ্প্রাণ দেহটি পড়ার শব্দ এখন আর নেই। এটি শূন্যে বিলীন হয়ে গেছে। তাৎপর্যহীন। তবে অত্যন্ত নির্মম। আপনার মনে প্রশ্নের উদ্রেক হলো―তিনি কেন আত্মহত্যা করলেন! তাও আবার আপনার আঙিনায়। এখানে তো আরও বড় বড় ফুল গাছে ঢাকা, পরিত্যক্ত, ফাঁকা আঙিনা রয়েছে। এমনও আঙিনা রয়েছে যেখানে কোনও প্রতিবেশীকে কাপড় শুকাতে দেওয়া হয় না। ওখানে জানুয়ারির এক তারিখে রাতের পোশাক পরে খালি পায়ে কেউ হাঁটে না। উপরের দিকে তাকালেন। তারপর ভাবলেন, মেনেন্দেজ সম্ভবত ছাদের চারপাশে তোলা দেয়ালে ওঠার সময় পা ফসকে পড়ে গেছেন। মেনেন্দেজ আপনার আঙিনা বেছে নিয়েছেন। তিনি আপনাকে পছন্দ করেছেন। আপনাকে খুন করার চেষ্টা করেছেন। কমপক্ষে ক্ষতি তো করেছেন। মেনেন্দেজ অনেক চেষ্টা করেছেন। তারপরও তার সেই চেষ্টাগুলো ছিল নিস্ফল।

ধীরে ধীরে রক্ত গড়িয়ে যেতে দেখে আপনার গায়ে কাঁটা দিল। কী নির্মমভাবে আপনার পায়ের চারপাশে রক্ত ছড়িয়ে পড়ছিল। লাল তরল রক্তের গড়িয়ে চলার আলতো শব্দ আপনার শরীরকে হিম শীতল করে দিল। মনে হলো চিৎকার করে উঠবেন। তবে তা না করে আপনি শুধু দাঁতের দুই পাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আপনার অ্যাপার্টমেন্টের দরজার পেছনের দিকে বসবাস করা প্রতিবেশীদের শোরগোল শুনতে পেলেন। অনেক প্রতিবেশী, অনেক আঙিনা, অনেক শোরগোল। ওরা কলিংবেলের বোতাম চেপে আপনার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। কিন্তু আপনি তো একেবারে হতভম্ব। ভয়ানকভাবে তৈরি করা হয়েছে মেনেন্দেজের দাঁতের পাটিগুলো। নিজে নিজে হাসলেন। কারণ, নিয়তি আপনার সঙ্গে এক মজার কৌতুক করছে। এরকম একটা ঘটনা ঘটেছিল এক সহকর্মীর চাচাত ভাইয়ের মেয়ে-বান্ধবীর সঙ্গে। সে তার গল্পটা মজা করে বলেছিল। খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। যে যে জায়গায় ভুলে যায়, সেই সেই জায়গায় কল্পনার রং মাখায়। তার সঙ্গে শহরের সব আষাঢ়ে গল্প জুড়ে দেয়। তবে সবাই সুরা পান করতে করতে ভাবেন, একজন প্রতিবেশী নিশ্চয়ই আরেক প্রতিবেশীর কাঁধে কখনই পড়বে না। ভাবলেন, আপনার মতো একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কেন এমন ব্যাপার ঘটবে। আপনি একজন পেশাজীবী, শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন-যাপন করেন। লোকজন আপনাকে ভালো বলে জানে। আপনি সবার কাছে ভালো একজন ব্যক্তি। আপনার মূল্যবোধ রয়েছে। আপনি সফল একজন ব্যক্তিত্ব। বছরের শুরুতে মেনেন্দেজের নোংরা, নগ্ন শরীরটা একটা অশুভ অর্থ বহন করে। এমন স্বর্গ থেকে আসা আলামত একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। প্রতিদিনের ব্যবহৃত সাদামাটা জিনিস, যেমন―দাঁতের পাটি আপনার শরীরটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। মেনেন্দেজের শরীরের নিচে চাপা পড়েনি। তাঁর বুড়া, ঘাম-ঝরা ত্বক আপনার জন্য এক ধরনের অমর্যাদা। ওখানে দু পাটি দাঁত হাতে নিয়ে আপনি কুঁজা হয়ে বসে রইলেন। তখন কে যেন লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে ফেলল। প্রতিবেশীরা সঙ্গে পুলিশ নিয়ে প্রবেশ করলেন। সবাই হৈ চৈ, চিৎকার-চেচামেচি করতে লাগলেন। সবাই সন্ত্রস্ত। সবাই উল্টোপাল্টা কী সব বলা শুরু করলেন। কেউ বললেন সেনোরিটা, কেউ থানা, কেউ আত্মহত্যা, কেউ আবার অ্যাম্বুলেন্স ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ আবার বললেন, রিপোর্ট করুন। কী দুঃখ রে বাবা! মেনেন্দেজ বিষাদের সাগরে ডুব দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

কেউ একজন আপনার কাঁধে কম্বল জড়িয়ে দিলেন। বুয়েনস আয়ার্সে তখন গ্রীষ্মের মাঝামাঝি। লোকজনের বোকামি আপনার কাছে খুব স্বাভাবিক ঠেকল। কাউকে রক্ষা করার স্বয়ংক্রিয় ও নির্বোধ সব কৌশল। কেউ একজন আপনাকে চেয়ারে বসিয়ে দিতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু আপনার পায়ের কাছে গড়িয়ে আসা রক্তের যে অশ্রুতপূর্ব শব্দ, তা আপনি মিস করতে চাইলেন না। এই শব্দ বন্ধ হোক, তা আপনি চাইলেন না। ওরা একটা চেয়ার আনলে তাতে বসে পড়লেন। আপনার খালি পা ততক্ষণে রক্তে ভেজা। লাল।

এবার আপনার চার তলার প্রতিবেশী চলে এলেন। বন্ধ ঘরে থাকলে গায়ের যেমন চিমসা গন্ধ হয় সেই গন্ধে এবং মাত্র দশ সেন্ট দামের সুগন্ধির গন্ধে তাঁকে আপনি চিনে ফেললেন। তিনি তাঁর হাত দুটো দিয়ে মুখ ঢেকে বললেন, কী ভয়ানক ব্যাপার রে বাবা! উনি আপনার মাথার চুল স্পর্শ করলেন। কিন্তু আপনি এমন চটকানি দিয়ে তাঁর হাতটা সরিয়ে দিলেন যেন আপনি প্লেগের সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করছেন। প্লেগ তো খুবই সংক্রামক রোগ। বাইবেলে এই রোগটিকে অভিশাপ বলা হয়েছে। উনি অভিমান করলেন। ঘৃণাভাবে কিছু একটা বললেন। নার্ভাস, রুক্ষ তরুণ মহিলা। কিন্তু কথাগুলো এমনভাবে বললেন যেন সব শব্দ এক সঙ্গে জড়িয়ে গেল। নার্ভাস-রুক্ষ-তরুণ মহিলা। নিজে নিজেই জিজ্ঞেস করলেন, এমন কোনও তরুণী কি আছে যে আপনাকে সভ্যতা বা সদাচার শেখাতে পারে। তাও আবার নগ্ন, দাঁতের পাটিবিহীন মৃতদেহের পাশে এসে। মহিলাটি রান্নাঘরে চলে গেলেন। সঙ্গে চিমসা গন্ধ আর অ্যালকোহল, ঔষধ আর মুখের দুর্গন্ধও নিয়ে গেলেন। সবকিছুর সঙ্গে আবার কফির গন্ধ মিশে বাজে একটা আবহ তৈরি করেছে। আপনি চান না যে, বিল্ডিংয়ের অন্য মহিলারা এই চতুর্থ তলার মহিলার সঙ্গে যোগ দিন, আর ওসভালদিতোর দিকে আঙুল তুলে এই ব্যথিত প্রতিবেশীরা মন্তব্য করুন, বলাবলি করুন ও দীর্ঘশ্বাস ফেলুন। ওরা মেনেন্দেজকে ওসভালদিতো বলে ডাকেন। ওরা ওর অনেক দিনের প্রতিবেশী। আপনি ভেবেছিলেন, যেসব জ্যেষ্ঠ শর্টস পরা, চুলের যেনতেন রকমের রং করা, বড় বড় নখে নেইল পলিশ দিয়ে রঙিন করা বুদ্ধিহীন মহিলা ড্রয়িং রুমে সমবেত হয়েছেন, তাঁরা এই বিপথগামী নির্বোধের সঙ্গে যোগ না দিন। তাঁরা ছোটখাটো ব্যাপার, যেমন ধরুন বেশ ছটফট করা ছোট ছোট কুকুর, সেগুলোর অজানা বংশপরিচয় ইত্যাদি নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ প্রদর্শন করে থাকেন। অথচ একটু মনোযোগ দিলে এই কুকুরগুলোর কান্নাকাটি ঠিক করে ফেলা যায়। মহিলাদের দেখে মনে হয়, এরা পুরোপুরি নিষ্পাপ। অথচ এরা পুরোপুরি অস্বাস্থ্যকর পরিমাণে অবসর সময় নিঃসৃত শয়তানি আর স্বাভাবিকতার মধ্যে ডুবে থাকে। বার্ধক্যের দোহাই দিয়ে বেঁচেও যান। যে কেউ যে কোনও সমস্যায় পড়লে ওরা সেখানে এসে হাজির হন যাতে পরে গল্প করার রসদ পান। কী ড্রয়িংরুম, কী লিফট আর কী বাড়ির মালিকদের সভা, বেকারির দোকান বা দরজার সামনে―সবখানে এরা জুটে যান, সুপারিনটেন্ডেন্টের সঙ্গে, কখনও বা তাদের বিল্ডিং-এর প্রতিবেশীর সঙ্গে এবং যাঁরা এই তরুণ মহিলাদের সঙ্গে থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেননি, তাঁদের সঙ্গে এরা গল্পগুজবে মেতে ওঠেন।

এদের আপনি খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখেন। এদেরকে জঘন্য মানুষ মনে হয় আপনার কাছে। এরা আপনার রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন। ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে খান। নির্বোধের মতো ধূমপান করেন। এই ব্যাপারগুলো মেনেন্দেজের দেহটা আপনার আঙিনায় পড়ে থাকার চাইতেও জঘন্য। মানুষের শয়তানির কোনও সীমা-পরিসীমা নেই। আপনিই তো বলতেন। এই বাক্যটির পূনরাবৃত্তি করেন। আপনার পায়ে রক্ত লেগেছে। অন্যের দাঁতের চিকিৎসা দিয়ে আপনি সুখী ও আরামদায়ক জীবন-যাপন করছেন। দাঁতের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করেন। পনের ব্লেডবিশিষ্ট যন্ত্রটি যখন আপনি ব্যবহার করেন, তখন নিজেকে বিশেষ ক্ষমতাবান মনে করেন। যখন অবাধ্য দাঁতের ক্যাভিটির চিকিৎসা করেন তখন মনে হয় যেন কোনও অভিযানে নেমেছেন। যখন দাঁতের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে রোগীকে ধমকান, তখন নিজেকে শক্তিশালী মনে হয়। পহেলা জানুয়ারিতে কিছু একটা ঘটবেই। যেমন ধরুন, একজন প্রতিবেশী আপনার আঙিনায় পড়ে মরে গেল। মুহূর্তে আপনার সব নিরাপত্তা, আপনার বাড়ির নিরাপত্তা নেমে এল অন্তহীন এক শৈথিল্যের পায়ের কাছে। এদের কাছ থেকে দূরে সরে বরং পা স্পর্শ করা গড়িয়ে আসা রক্তের শব্দ শুনতেই আপনার বেশি ভালো লাগে।

আপনি এবার পা থেকে চোখ অন্য দিকে ফেরালেন (বীভৎস পা)। রক্ত থেকেও (অচেনা রক্ত)। দুজন লোক এই মৃত প্রতিবেশীর ব্যাপারে নোট নিলেন। ছবি তুললেন। মৃতদেহটা আপনার আঙিনায় পড়ে রয়েছে। আপনি মেনেন্দেজের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন তাঁকে প্রথমবারের মতো দেখছেন। বুঝতে পারলেন, এই নগ্ন, দাঁতবিহীন শরীর মাটিতে পতনে যে শব্দের সৃষ্টি হয়েছে, তা এই বুড়াটার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ও এখন আপনার আঙিনায় পড়ে রয়েছে। আপনাকে নৈরাজ্যের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে তৈরি হওয়া শোরগোলের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এরা আপনার দিকে এক ধরনের মেকি সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকান। অবজ্ঞাও আছে সে চোখে। এই সভ্য, অশান্ত পৃথিবীতে যান্ত্রিক, ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে পুলিশ আপনার সঙ্গে কথা বলেন।

কম্বলটা আর একটু জড়িয়ে নিলেন। বেশ গরম পড়েছে। এখন আপনি জানেন, ঐ দেহপতনের শব্দ আপনাকে স্বাভাবিক স্বস্তি থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। জীবনের সব আরাম-আয়েশ লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। জীবনের সব বিজ্ঞ সিদ্ধান্ত ও সত্যকে ঠুনকা প্রমাণ করেছে। মেনেন্দেজের দেহপতনের শব্দ ছোট হলেও বেশ শক্তিশালী। নিজের শরীরের মধ্যকার বিস্ফোরণের শব্দ। হাড়গোড়ের নিচের শব্দ। এ এক অব্যক্ত অনুভূতি। কিন্তু আপনি যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝেছেন যে, এটিই আসলে আত্মপরিচয় নির্মাণকারী শক্তি, অপ্রতিরোধ্য। শ্বাস নেন, শ্বাস ছাড়েন। নির্মম শব্দ বাড়ির প্রতিটি আনাচে কানাচে, শহরে, গোটা বিশ্বে রাজত্ব করে। মাটির আড়ালে নীরবে বয়ে চলা নদীর মতো। চোখে দেখা যায় না। রক্তের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। ওত পেতে থাকে। তবে বোঝা যায়, এটি কীভাবে আপনাকে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে। অনবরত। এক হালকা ও দানবীয় নৈঃশব্দ্য। আপনার ভাবনার গভীরে। একেবারে মগজের অন্তঃস্থলে।

ধরিত্রী

পৃথিবীটা আমাকে পুড়িয়ে মারছে। এটি শুষ্ক নয়। আমাকে পোড়াচ্ছে আর পোড়াচ্ছে। গরম তো, তাই। সূর্যটা পৃথিবী থেকে একটু একটু করে পানি বের করে দিচ্ছে। বাবা এখন নিচে। আমি এখানে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে আছি। ব্যথা পাচ্ছি। আমার পা বাবার উপরে। জুতা খুলে ফেললাম। ছুড়ে ফেলে দিলাম। কারণ, আমার গরম লাগছে। এখন আর জুতা জোড়া খুঁজে পাচ্ছি না। আমি চাই রাত আসুক। কারণ রাতে সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যায় আর আমিও বাবার গা ঘেষে শুয়ে পড়তে পারি। যদিও আমি তার থেকে অনেক দূরে কারণ, আমি উপরে তো, তাই।

সে চায়, আমি সবসময় তার কাছে কাছে থাকি। ‘কামিলা, কোথায় যাচ্ছো ? এখানে এসো। আমি তো তোমাকে ডাকছি।’

‘আসছি, বাবা। মা চায় তাকে থালাবাসন ধুতে সাহায্য করি।’

‘আমি চাই না তুমি থালাবাসন ধোও। একটি থালাও না। তুমি তো ছোট। তোমার মা নিজেই এ কাজ করতে পারে।’

মা সবসময় ট্যাপ চালু রাখে। এক গাদা থালাবাসনের উপর জলের ধারা আছড়ে পড়ে। ওগুলো ভেঙ্গে গেলেও সে পাত্তা দেয় না।

সে আমার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। বাবা আমাকে এই প্রথম তার কাছে ডাকল। এরপর যা ঘটল তা হলো মা আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিল। সে রকিং চেয়ারে বসে দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

‘মা, কী দেখছ ?’

‘কামিলা, মাকে একা থাকতে দাও। এখানে এসো। তোমার বাবা তোমাকে কিছু একটা দেখাতে চায়।’

মা স্থির হয়ে বসে রইল। তার চেয়ারটাও স্থির। সে দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন সে অদৃশ্য হতে চলেছে। একেবারে স্থির ও সাদা হয়ে গেছে।

আমিও চেয়ারে বসে ঝুঁকে ঝুঁকে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকতে চাই। কিন্তু পারি না। কারণ, রোদে আমার মাথাটা পুড়ে যাচ্ছে। চোখটাও ব্যথা করছে। বাবা ঘরে এলে যেমন চোখ বন্ধ করে থাকতাম সেভাবে আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি।

এই পরিত্যক্ত স্থানে কেউ ফুল রেখে যায় না। কালো ফটকবিশিষ্ট এটি একটি কবরস্থান। শহর থেকে সত্যিই বেশ দূরে। জায়গাটা এতটাই দূরে যে মা তার সব সঞ্চয় গাড়ি-ভাড়া দিতেই শেষ করে ফেলেছে। তাকে এখানে আনতে দুজন লোক ভাড়া করে। দুদিন লেগেছে। বাবার ক্রসও নেই, ফুলও নেই। তবে মেঝেতে পড়ে থাকা খবরের কাগজ কেটে আমি ফুল বানিয়েছি। বেটি আমাকে কাগজের ফুল বানানো শিখিয়েছিল। পাখিও। ও মার সঙ্গে মেইট পান করতে আসত। আমি যখন ছোট ছিলাম, সে প্রায়ই চকলেট ও মার্কার পেন নিয়ে আসত। ঐ মার্কার পেন দিয়ে আমি রং করতাম। কিন্তু সেদিনের পর যখন আমি রান্নাঘরে গেলাম, সেদিন দেখলাম, বেটি মার সঙ্গে কথা বলছে এবং আমাকে দেখে চুপ হয়ে গেল। দুজনেই। একদিন মাকে বললাম, আমি দোকানে যাচ্ছি। তবে গেলাম না। রান্নাঘরের টেবিলের নিচে লুকিয়ে রইলাম। টেবিলক্লথ দিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিলাম। কেউ দেখতে পেল না। শীঘ্রই বেটি এসে পড়ল।

‘ঐ পিচ্চিটা কি এখানে আছে ?’

‘নাহ, দোকানে গেছে।’

‘নোরিতা, তুমি কী করতে যাচ্ছ ?’

‘জানি না।’

‘ওদের সঙ্গে তোমার কখন সাক্ষাৎ হয়েছিল ?’

‘এক মাস আগে।’

‘ওরা কি তোমাকে দেখেছিল ?’

‘নাহ, আমার তা মনে হয় না।’

‘ব্যাপারটা আরও খারাপ হচ্ছে।’

‘জানি।’

‘ওকে জানাও।’

‘তাহলে ও আমাকে মেরেই ফেলবে।’

দীর্ঘক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। মনে হলো মা কাঁদছে। কালো জামাটা আমাকে আড়াল করে রেখেছে। যেদিন বাবা মারা যায়, মা সেদিন এটি আমাকে পড়তে দেয়। আমি তার সঙ্গে যেতে চাচ্ছিলাম না। সে জামাটি আমার বিছানায় রাখে। তারপর পরতে বলে। তবে কথায় নয়। সে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আমি যতক্ষণ জামাটা না পরি ততক্ষণ আমার দিকে তাকিয়েছিল। পৃথিবী বিলীন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এটি এখনও নরম। এতে পিঁপড়া, গোবরেপোকা লেগে আছে। পিঁপড়া মেরে ফেলা মজার বিষয়। গোবরে পোকা দেখলে গা ঘিন ঘিন করে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ি। জামা ময়লা হলে হোক। এখন আর এটা কোনও ব্যাপার নয়। পিঁপড়া সারিবদ্ধভাবে একটা গর্তে ঢুকে যায়। ওদের সারির সামনে আমি পাতা বা খড়কুটো বা পাথর রাখি যাতে ওরা সারিবদ্ধভাবে যেতে না পারে। কিন্তু ওরা ওগুলোর উপর দিয়ে উঠে যায়। ওদের কেউ কেউ পথ হারিয়ে লাইন থেকে বেরিয়ে যায়। ওরা বুঝতে পারে না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার লাইনে এসে যোগ দেয়। তারপর গর্তে হারিয়ে যায়। বাবা আমাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখত। প্রথম প্রথম অভিযোগ করে বলতাম, আমার কষ্ট হয়। কিন্তু বাবা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসত। মুখ ঢেকে দিত। তারপর চলতে থাকত। লাল পিঁপড়াগুলো আমাকে কামড়াচ্ছিল। কাজেই ওদের মারলাম।

আমার ক্ষুধা ও তেষ্টা পেয়েছে। ‘মা, আমার তেষ্টা পেয়েছে।’ মা ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করে ধীরে ধীরে গ্লাসে পানি ঢালল। গ্লাস যতক্ষণ না ভরত ততক্ষণ শব্দ হতো। পুরো টেবিল জুড়ে পানি ছিটকে পড়ত। আমি মার কাছে এগিয়ে যেতাম। তারপর টেবিলের কাছে মুখ রেখে দাঁড়াতাম। এতে আমার মুখেও জলের ছিটা পড়ত। তখন অবশ্য আমি ছোট ছিলাম। বাবা তখন অনেক ভ্রমণ করত। বাড়িতে থাকত না বললেই চলে। তারপর একদিন তার চাকরিটা চলে যায়। তখন আর তাকে ভ্রমণ করতে হয় না। একটা গোবরে পোকা আমার পা বেয়ে উঠতে চায়। আমিও তাকে উঠতে দিই। কিন্তু তারপর ওকে ঝেড়ে ফেলে দিই। বাগানের সব পোকামাকড় মারার জন্য যে বিষ মা ব্যবহার করে সেটি যদি আমার থাকত, তবে ভালো হতো। গোবরে পোকার পাখায় সূর্যের আলো আছড়ে পড়ে। অনেক রংয়ের বাহারি আবেশ তৈরি হয়। আমি চাই এটি নির্বিঘ্নে আমার পা থেকে নেমে যাক। কিন্তু এটি আমার পা বেয়ে উপরে উঠতে থাকে।

মা লোকগুলোর সঙ্গে বাইরে চলে গেল। কালো ফটকবিশিষ্ট কবরস্থানে আমাকে রেখে। ওরা মাটিতে একটা গর্ত খুঁড়ল। বাবাকে গর্তে রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে দিল। মা লোকগুলোকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলল। আমাদের খানিকটা সময় একা থাকতে দিতে বলল। লোকগুলো বেশ দূরে সরে গেলে মা কালো মাটিতে থুথু নিক্ষেপ করল। তারপর আমাকেও থুথু দিল। কিছু না বুঝেই ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর সে চলে গেল। যখন আমি তার পেছন পেছন দৌড় দিলাম তখন সে আমার চুলের মুঠি ধরে টেনেহিঁচড়ে বাবার কবরের কাছে এনে স্যাঁতস্যাঁতে মাটির ওপর আমাকে ঠেসে ধরল। যখন দাঁড়াতে পারলাম তখন দেখলাম, সে ইতোমধ্যে গাড়িতে উঠে বসেছে। দৌড় দিলাম কিন্তু ধরতে পারলাম না।

এ তো গতকালের কথা। আমি জানি সে আর ফিরে আসবে না। বিষয়টা জানি, কারণ বাবা যখন মারা যায়, তখন আমি রান্নাঘরের টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিলাম।

মা বেটিকে বলল, ‘ওকে অনেক দূরে নিয়ে যাব, কালো ফটক পার হয়ে কবরস্থানে।’

‘এত দূরে কেন ?’

‘কারণ, ও যে আমার কাছাকাছি আছে, তা আমি আর ভাবতে পারি না।’

‘কিন্তু এর জন্য তোমাকে অনেক মূল্য দিতে হবে, নোরিতা। দুই দিনের জার্নির জন্য গাড়ি আর লোকজন ভাড়া করে।’

‘আমি কোনও পরোয়া করি না।’

‘মেয়েটাকে কী করবে ?’

দীর্ঘক্ষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করল। ‘আমি ওর সঙ্গে কোনও ধরনের ঘনিষ্ঠতা আর সহ্য করতে পারছি না।’

‘কিন্তু সে তো তোমার মেয়ে।’

‘আর নয়, বিশেষ যা ঘটে গেছে তারপর আর নয়।’

‘এতে তো ওর কোনও দোষ নেই।’

‘হ্যাঁ, ওরই দোষ।’

‘নোরিতা, আমি বুঝতে পারছি না। ও আসলে পরিস্থিতির শিকার।’

‘নাহ, তা নয়। ও সাংঘাতিক।’

এসব কথা শোনার পর আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। রোদে শরীরটা আমার শক্ত হয়ে যাওয়ায় নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। দু’টি গোবরে পোকা আমার পা বেয়ে উঠতে শুরু শুরু করেছে। ওদের ঝেড়ে ফেলে দিলাম। আশেপাশে কোনও গাছ নেই। শুধু ঘাস আছে। মাটি দিয়ে পা দুটো ঢেকে নিলাম। মাটির আর্দ্রতা অনুভব করার জন্য আমি মাটির সঙ্গে পা দুটো লাগিয়ে রাখলাম। রোদে পোড়া থেকে পাগুলো বেঁচে গেল। গোবরে পোকাগুলো চলে গেল।

বাবা যখন আশেপাশে ছিল না তখন সবকিছু অধিকতর ভালো ছিল। সে ফিরে এলে মনে হলো, সে চলে গেলেই শান্তি পাব।

সেই গোবরে পোকাগুলো ছারপোকার মতো আমাকে অনবরত বিরক্ত করতে থাকে। মা জানত, আমি কী করি। এজন্য সে আমাকে এখানে ফেলে চলে গেছে। সে মনে করে, আমিও তার সঙ্গে একই কাজ করব। কিন্তু আমি কোনওদিন তার সঙ্গে কিছুই করিনি। শুধু তার সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলাম। তার কান্না থামাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন আর এটি কোনও ব্যাপার নয়। একটা হাত মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে দিলাম স্যাঁতস্যাঁতে ভাব অনুভব করার জন্য। এতে রোদে পোড়া থেকে রক্ষা পেলাম।

যেদিন বাবা মারা যায় সেদিন সে আমার ঘরেই ছিল। সে আমার কাছে এক গ্লাস মদ চায়।

‘ক্যামিলা যা, আরেকটু মদ নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি যা। বোতল খালি হয়ে গেছে।’

‘মাকে বলছি। বোতল তো আলমারির ওপর। আমি ওখানে পৌঁছতে পারব না।’

‘নাহ, তোর মাকে কিছু বলবি না। বাইরে থেকে একটা টুল নিয়ে এসে ওটা এখুনি নামা।’

আমি রান্নাঘরে গিয়ে একটা টুল টেনে নিয়ে মদের বোতল নামালাম। গ্লাস খুঁজতে গিয়ে দেখি মা ভুল করে রান্নাঘরের টেবিলের উপর পোকা মারার বিষ রেখে গেছে। আমি এটাকে চিনি মনে করে এখান থেকে নিয়ে তিন চামচ পাউডার মেশালাম। তারপর গ্লাসটা দিতেই এক ঢোকে সে পুরোটা সাবাড় করে দিল। তারপর অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল। যেন সে বিষয়টা জানত। এবার গলাটা চেপে ধরে, লাল হয়ে একটু চিৎকার দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম। তার মুখ লাল, আরও লাল, আরও লাল হয়ে গেল। মুখটা ফুলে গেল। আরও ফুলে গেল। কাঁপছিল। স্থির হতে পারল না। কিন্তু এরপর সে নিস্তেজ হয়ে গেল। মা আমার দিকে না তাকিয়েই ঘরে ঢুকল। বলল, ‘তুই ওকে মেরে ফেলেছিস ?’

‘হ্যাঁ।’

সে আর কিছুই বলল না। বাবার দিকে তাকাল। কিছু একটা বলতে চাইল। কিন্তু তার মুখ থেকে কোনও কথা বেরুল না।

‘আমি চাইনি, মা। কিন্তু সে আমাকে কষ্ট দিয়েছে। তোমাকে কাঁদিয়েছে।’

‘চুপ কর, পুচকে শয়তান। এটা তোর দোষ। তুই আমার স্বামীকে হত্যা করেছিস।’

আমি কান্না থামাতে পারলাম না। কোনও কথা বলতে পারলাম না।

‘আজ আমার স্বামীকে মেরেছিস। কাল আরেকজনকে মারবি।’

আমি তার কথা বুঝতে পারলাম না। শুধু চাইলাম সে আমার দিকে একটু তাকাক। চুমু দিয়ে আমার অশ্রু দূর করুক। এরপর মা আর আমার সঙ্গে কথা বলল না। সে গোটা শহরকে  বুঝিয়ে শুনিয়ে মানিয়ে ফেলল এই বলে যে, তার স্বামী হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। সবাই তার কথা বিশ্বাস করে। কেউ কোনও প্রশ্ন করে না। সন্দেহও করে না। জানি না, আমার ব্যাপারে সে কী করেছিল। সম্ভবত লোকজন ভাবে যে, আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম।

আমার পা দুটো এখন মাটির ভেতরে। আমি আর পা দুটো  অনুভব করতে পারছি না। আমার দু হাত, বাকি শরীর মাটির মধ্যে ডুবে যাচ্ছে। লাল পিঁপড়াগুলো হামাগুড়ি দিয়ে আমার মুখমণ্ডলে বেয়ে বেয়ে উঠছে। আমি ওদের মারতে চাই না। মারতে পারি না। সূর্যটা এখন আর আমার চিন্তার বিষয় নয়। কারণ, এখন প্রায় রাত নেমে গেছে। একটা গোবরে পোকা আমার গলা বেয়ে উঠছে। পিঁপড়াগুলো আমার চোখের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সারিবদ্ধভাবে চলছে। এদের সারিবদ্ধভাবে চলার কোনও শেষ নেই। থামে না। মাটি এখনও স্যাঁতস্যাঁতে।

আমি কাছে, আরও কাছে যাচ্ছি, বাবার কাছে।

 সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button