নজরুলের ধূমকেতু : জন্মমৃত্যু কথা : মানবর্দ্ধন পাল

প্রচ্ছদ রচনা : নজরুলের ধূমকেতু আঁধারে অগ্নিসেতু
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
―নজরুল
ধূমকেতু শব্দটি কাজী নজরুল ইসলাম ‘ধূমকেতু’ কবিতায় এমন বিপ্লবোদ্দীপক ভাবধারায় প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি ‘ধূমকেতু’ ঋণাত্মক অর্থে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় : ‘আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,/ আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!’ (অগ্নিবীণা, ১৯২২)। ‘ধূমকেতু’ শীর্ষক কবিতার পরে কুহেলিকা উপন্যাসে শব্দটি পাওয়া যায় সদর্থে, এভাবে : ‘চল্-চল্―ওরে ধরার ধূমকেতু!’ (আবদুল কাদির সম্পাদিত নজরুলসম্ভার/২, পৃ. ২৪৮)। অভিধানে ‘ধূমকেতু’ শব্দটির অর্থ যা-ই থাক, বাংলা সংবাদপত্রের ইতিহাসে এবং নজরুলের সাংবাদিক-জীবনে এই শব্দটি নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। অশুভ-অকল্যাণের প্রতীক হিসেবে মহাকাশের এ জ্যোতিঃপুচ্ছ নজরুলের অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকার শিরোনাম হিসেবে হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের মুখপত্র। যখন অহিংস-অসহযোগ এবং খিলাফত আন্দোলন অনেকটা স্তিমিত ও অকার্যকর হয়ে পড়েছিল তখন সশস্ত্র আন্দোলনের বিপ্লবী কর্মযজ্ঞে ঘৃতাহুতি দিয়েছিল নজরুল-সম্পাদিত অর্ধসাপ্তাহিক পত্রিকা ধূমকেতু। গণজাগরণ এবং বিপ্লবের আগুনে ফুঁ দিতে কাগজটি ছিল যেন কামারের হাঁপর।
আয়ুষ্কাল বিবেচনায় নজরুলের ধূমকেতু মহাকাশের ধূমকেতুর মতোই ছিল ক্ষীণজীবী। এর জন্মমৃত্যুর সালতামামির দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা লক্ষ করি, নজরুল-সম্পাদিত ধূমকেতুর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১১ আগস্ট ১৯২২ এবং ২০তম শেষ সংখ্যাটি ৭ নভেম্বর ১৯২২―মাত্র তিন মাস। অবশ্য নজরুলের কারাবন্দিত্বের পর অমরেশ কাঞ্জিলালের সম্পাদনায় ধূমকেতুর দুয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। অন্তরীক্ষের ধূমকেতু যেমন চোখ-ধাঁধানো ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’তে আলোকিত করে দেয় নভোমণ্ডল তেমনই নজরুলের ধূমকেতুও ভারতবর্ষের তৎকালীন তরুণসমাজের ‘বিপ্লবস্পন্দিত বুকে’ ব্রিটিশ-বিতাড়নের অগ্নিশিখা প্রজ্বলন করেছিল। প্রসঙ্গত নজরুল-গবেষক ড. সুশীলকুমার গুপ্ত লিখেছেন : “অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতায় ঝিমিয়ে-পড়া ও নৈরাশ্যপীড়িত সন্ত্রাসবাদীদের উদ্বুদ্ধ করবার জন্যে ধূমকেতু যে দুরূহ ও দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে, ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে ‘ধূমকেতু’ ‘বিজলী’, ‘শঙ্খ’, ‘আত্মশক্তি’ ছাড়িয়ে যায়।” (নজরুল-চরিতমানস, পৃ. ২৯৫)। ড. গুপ্ত এখানে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনরতদের শাসকশ্রেণির ভাষায় নিন্দার্থে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বললেও আমরা তাঁদের সদর্থে বলব ‘বিপ্লববাদী’।
দুই
অর্ধসাপ্তাহিক ধূমকেতু নজরুল-সম্পাদিত দ্বিতীয় পত্রিকা। এর আগে সাংবাদিক হিসেবে তিনি নবযুগ-এর (১৯২০) যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। ‘হপ্তায় দু’বার দেখা দেবে’―এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফলিও সাইজের আট পৃষ্ঠার কাগজটি বের হয়। দাম ছিল একআনা এবং বার্ষিক গ্রাহকচাঁদা পাঁচ টাকা। এর মুদ্রাক্ষরিক ছিলেন মেটকাফ প্রেসের মণি ঘোষ―প্রকাশক ও কর্মসচিব ছিলেন যথাক্রমে আফজাল্-উল হক ও শান্তিপদ সিংহ। পত্রিকাটির প্রথম কার্যালয় ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে, পরে তা স্থানান্তর হয় ৭ নম্বর প্রতাপ চাটুজ্যে লেনে। ধূমকেতু প্রকাশের সূচনাকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, রাজনীতিক সরোজিনী নাইডু, বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবি কালিদাস রায়, মাতৃময়ী বিরজাসুন্দরী দেবী প্রমুখ বিশিষ্টজনেরা আশীর্বাণী ও অভিনন্দনপত্র পাঠিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহুল উদ্ধৃত কাব্যাশীর্বাদবাণীতে (১২ আগস্ট, ১৯২২) লেখেন :
‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু―
আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন।
অলক্ষণের তিলকরেখা
রাতের ভালে হোক না লেখা,
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।’
এই রবীন্দ্রবাণী পত্রিকার প্রথম সংখ্যার দ্বিতীয় পৃষ্ঠায়, দ্বিতীয় সংখ্যার তৃতীয় পৃষ্ঠায় এবং পরবর্তী প্রতি সংখ্যার প্রচ্ছদে ধারাবাহিকভাবে উৎকীর্ণ হয়।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের আশীর্বচন ছিল এরকম :
‘কল্যাণীয়বরেষু,
তোমাদের কাগজের দীর্ঘ জীবন কামনা করিয়া তোমাকে একটি মাত্র আশীর্বাদ করি, যেন শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে নির্ভয়ে সত্য কথা বলিতে পার। তারপর ভগবান তোমার কাগজের ভার আপনি বহন করিবেন।’
কবি কালিদাস রায় নজরুলকে ‘ভাই’ সম্বোধন করে লেখেন :
‘তোমার ধূমকেতুকে সাদর আহ্বান করি―
জাগ ধূমকেতু ধ্বংসের হেতু
স্বাগত অশিব মহোৎসব,
শিবের শ্মশান, জীবের মশান
স্বাগত অশভ উপ্লব।…’
পুনশ্চ―তোমার লেখা পড়ছি আর অবাক হচ্ছি, তুমি নিজেই ধূমকেতু। তোমার লেখনীতে পাশুপতের শক্তি।’
সেকালের মুসলিম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন একাধিক লেখক-সম্পাদক। তাঁদের অন্যতম ফজলুল হক সেলবর্সী লেখেন :
‘ভাই কাজী সাহেব,
স্বয়ং বিশ্বকবি যাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ, তাঁকে আমার মত লোকের ভক্তি নিবেদন করিতে যাওয়াও ধৃষ্টতা। সেই পরম পুরুষকে ধন্যবাদ; আজ মুসলমান বাংলার একটি দৈন্য দূর হইয়াছে। আজ সাহিত্যের পুণ্য আঙ্গিনায় আপনার সমাজ দাঁড়াইবার মত যে স্থানটি পাইয়াছে, তাহা আপনারই দয়ায়।…’
সমাজসেবিকা মিসেস এম. রহমান লেখেন :
“শ্রদ্ধাস্পদ ধূমকেতু সারথি!
অনেকদিন আগে আমি আপনাকে খেতাব দিয়েছিলাম, ‘বাঁধন-ছেড়া’। আজ দিলাম ‘সত্য সাধক’। সত্যের সাধনায় সিদ্ধিলাভ করুন ইহাই প্রার্থনা।”
নজরুলের অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ও পরামর্শক ছিলেন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমদ। লেখক হিসেবে তাঁর ছদ্মনাম ‘দ্বৈপায়ন’। তিনি লেখেন :
‘ভাই সারথি!
তোমার ধূমকেতু আমি রীতিমত পড়ছি, কিন্তু সত্য কথা বলতে কি, সমস্ত প্রাণ মন দিয়ে যে জিনিসটি চাইছি সেটিই ওতে আমি পরিস্ফুটরূপে পাচ্ছি নে। আমাদের দেশের নির্যাতিত জনমণ্ডলীর প্রতি তোমার সহানুভূতি আছে, তোমার লেখাতে তার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বড় দুঃখ যে তুমি তাদের বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু আজও কিছু বলনি। নির্যাতিত জনসাধারণ বলতে আমি আমাদের দেশের কৃষক ও শ্রমিকদিগকেই বুঝি।…’
(এই পর্বের উদ্ধৃতিগুলো মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সমকালে নজরুল ইসলাম গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত)। এখানে মুজফ্ফর আহমদ ধূমকেতু ও নজরুলের নির্জলা প্রশংসা করেননি। কিছুটা সমালোচনা ও বন্ধুসুলভ পরামর্শদানের ভাষায় নজরুলকে পথনির্দেশ করেছেন। তিনি চরিত্রে কমিউনিস্ট এবং মননে সাম্যবাদী চিন্তক হওয়ায় একান্ত রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই চিঠি লিখেছিলেন।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন বারীন্দ্রকুমার ঘোষ। নজরুল তাঁকে ‘দাদা’ সম্বোধন করতেন এবং ‘ভাঙা বাঙলার রাঙা যুগের আদি পুরোহিত, সাগ্নিক বীর’ অভিধায় আখ্যায়িত করে তাঁকে কবি অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন। এই বিপ্লবী নজরুলকে ‘ভাই পাগল’ বলে স্নেহময় সম্বোধনে সিক্ত করে লেখেন : ‘অনর্থক গরম গরম লিখে জেলে যেয়ো না। জেলে যাওয়ায় আর নতুনত্ব নেই। মরে অমর হওয়ার বাজীও কানাই (লাল) জিতে নিয়েছে।’
বিপ্লবী বারীন্দ্রকুমার যেন ভবিষ্যদ্রষ্টার মতো নজরুল ও ধূমকেতু পত্রিকার পরিণাম দেখতে পেয়েছিলেন। মাত্র মাসতিনেকের ব্যবধানে তাঁর আশংকা সত্যে পরিণত হয়েছিল। নজরুল গেলেন কারাবাসে, ধূমকেতুর হলো অকালমৃত্যু!
তিন
সাংবাদিক ও কবিজীবনে নজরুল কেবল জিন্দাবাদ ও ফুলচন্দনে নন্দিত হননি―বিরূপ সমালোচনা, গালমন্দ, অসংস্কৃত আক্রমণের শিকারও হয়েছেন। বৈরীপক্ষ ও বিরোধীমঞ্চ তাঁকে আসুরিক ভাষায় নিন্দাবাদে জর্জরিত করেছে। নজরুল-বৈরিতার প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্র, ধর্মীয় কুসংস্কারমগ্ন পত্রপত্রিকা এবং বিরূপ কবি-লেখক। নজরুলের কবিতা ও প্রবন্ধনিবন্ধ বলদর্পী ব্রিটিশরাজের স্বার্থবিরোধী হওয়ায় তারা নজরুলকে কালো আইনে দমন করতে চেয়েছে। অসাম্প্রদায়িক মুক্তচিন্তার অধিকারী বলে কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠী তাঁকে নগ্ন ভাষায় আক্রমণ করেছে। আবার নজরুলের জনপ্রিয়তায় কেউ কেউ ঈর্ষান্বিত হয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ ও নিন্দার কাঁটায় বিদ্ধ করেছে। তাই লক্ষ করা যায়, শনিবারের চিঠি, মোহাম্মদী, ইসলাম দর্শন, মোসলেম দর্পণ, নওবাহার, ছোলতান প্রভৃতি পত্রপত্রিকা নজরুল-নিন্দায় ছিল পঞ্চমুখ।
নজরুলের ধূমকেতু জন্মকালেই আক্রমণের শিকার হয়। ইসলাম দর্শন পত্রিকায় তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যায় ধর্মান্ধ সায়েফুল ইসলাম আক্রমণাত্মক ভাষায় লেখেন : …‘ধূমকেতুর এই নবঅবতার ধর্ম ও নীতিদ্রোহিতায় এবং দেশসমাজের অনিষ্টকারিতায় প্রকৃত ধূমকেতু হইতেও অধিক ভয়ঙ্কর।… ইহার সারথি বা সম্পাদকের নাম কাজী নজরুল ইসলাম―অর্থাৎ একজন মুসলমান।’ (নজরুল ও সাময়িকপত্র, মোবাশ্বের আলী)।
ইসলাম দর্শন পত্রিকায় কার্তিক, ১৩২৯ সংখ্যায় ‘লোকটি মুসলমান না শয়তান’ শিরোনামে মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজুদ্দীন আহমদ একটি প্রবন্ধ লেখেন। তাতে বলা হয় : … ‘ধূমকেতু প্রত্যেক সংখ্যায় পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে গরল উদ্গীরণ করিতেছে। এই উদ্দাম যুবক যে ইসলামী শিক্ষা আদৌ পায় নাই, তাহা ইহার লেখার পত্রে পত্রে ছত্রে ছত্রে প্রকাশ পাইতেছে। হিন্দুয়ানী মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ। হতভাগ্য যুবকটি ধর্মজ্ঞান সম্পন্ন মুসলমানের সংসর্গ কখনও লাভ করে নাই; অন্ততঃ যেটুকু লাভ করিলেও পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে স্বীয় পৈশাচিক খড়ম উত্তোলন করিত না।’ (সমকালে নজরুল ইসলাম, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পৃ. ১৭)।
সমকালে নজরুল ইসলাম বৈরীপক্ষের বহুমুখী বিরোধিতা, নিন্দাবাদ ও আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এই অপপ্রচারকারী, প্রতিহিংসাপরায়ণ ও নিন্দুকদের মধ্যে নজরুলের স্বধর্মের মানুষ যেমন আছে তেমনই আছে সনাতনধর্মের সমাজপতিরাও। তবে ধূমকেতু প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পর সমকালীন যেসব পত্রিকার সম্পাদকবৃন্দ সৌজন্য সংখ্যা পেয়েছেন বা সংগ্রহ করেছেন তারা অনেকেই অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়েছেন। এর মধ্যে আছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাসন্তী, দৈনিক বসুমতী, অমৃতবাজার পত্রিকা, হংসদূত ইত্যাদি।
চার
মহাকাশের ধূমকেতু বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় যেমন ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’তে ভূমণ্ডল আলোকোজ্জ্বল করে তেমনই ধূমকেতুর সূচনাসংখ্যা থেকেই তা আলোকিত ও উদ্দীপিত করেছিল বাংলার ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী তরুণসমাজ ও ভারতের স্বাধীনতাকামী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজকে। ক্ষণজীবী হলেও নজরুলের ধূমকেতু বাংলার সাময়িকপত্র ও সাংবাদিকতার ইতিহাসে অমোচনীয় স্বাক্ষর রেখেছে। অতি অল্পকালে এমন বিপুল পাঠকপ্রিয়তা আর কোনও পত্রিকা অর্জন করেনি। রবীন্দ্রনাথের আশীর্বচন এবং নজরুলের ধূমকেতু শীর্ষক কবিতা ধারণ করে প্রকাশিত হয় প্রথম সংখ্যা ধূমকেতু। সেই অবিস্মরণীয় কবিতায় নজরুলের প্রদীপ্ত কণ্ঠস্বরযুক্ত :
‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু।’
পত্রিকা প্রকাশের পর সারা কলকাতায় সাড়া পড়ে যায়, সৃষ্টি হয় আলোড়ন, যেন ভূমিকম্প। ধূমকেতুর চেতনার আগুন দাবানলের মতো, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসের মতো, বৈশাখী ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ে দিগি¦দিক। এ সম্পর্কিত স্মৃতিচারণে খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন লিখেছেন :
‘ধূমকেতু যেদিন প্রকাশিত হলো, কোলকাতার কলেজ স্কোয়ারের মোড়ে দেখেছি কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। সারা দেশের মনের কথা টেনে বার করে নজরুল যেন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পাড়ায় পাড়ায় প্রতি ছত্রে।’
(যুগস্রষ্টা নজরুল, পৃ. ২৪)।
বিংশ শতাব্দীর তিরিশ দশকের কল্লোল যুগের অন্যতম কবি অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রসঙ্গত লিখেছেন :
“নৃপেনের মতো আমিও ফার্ষ্ট ইয়ারের ছাত্র। সপ্তাহান্তে বিকালবেলা আরও অনেকের সঙ্গে জগুবাবুর বাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, হকার কতক্ষণে ধূমকেতুর বান্ডিল নিয়ে আসে। হুড়াহুড়ি কাড়াকাড়ি পড়ে যায় কাগজের জন্যে। কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে ডুবিয়ে লেখা সেই সব সম্পাদকীয় প্রবন্ধ। সঙ্গে ‘ত্রিশূলের’ আলোচনা।… সে কী কথা, কী দাহ! একবার পড়ে বা শুধু একজনকে পড়িয়ে শান্ত করবার মত সেভাষা নয়। যেমন গদ্য তেমনি কবিতা। সব ভাঙার গান, প্রলয়-বিলয়ের মঙ্গলাচরণ।”
(কল্লোলযুগ, পৃ.২৭)।
নজরুল ছিলেন বন্ধুবৎসল―তাঁর বন্ধুভাগ্যও ছিল সুপ্রসন্ন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু ও সহচর। তিনি ধূমকেতুর বিপুল পাঠকপ্রিয়তা সম্পর্কে লিখেছেন :
‘ঘণ্টা দু’য়ের মধ্যে দু’হাজার কাগজ উঠে গেল। হকারের দল এসে হাজির হল ছাপাখানার বত্রিশ নম্বরে, আরও কাগজ চাই। চার-পাঁচ হাজার ছেপে দিলেও তারা তখনই তা নিয়ে যেতে রাজী।…
বিক্রীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলে, কাগজ বেরুবার আগেই হকার দাম দিয়ে যায়। কাগজ বেরুবার ক্ষণটুকু মোড়ে মোড়ে তরুণের দল জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকে―হকার কতক্ষণে নিয়ে আসে ধূমকেতুর বাণ্ডিল। তারপর হুড়োহুড়ি কাড়াকাড়িতে কয়েক মিনিটের মধ্যে তা নিঃশেষ হয়ে যায়। এক কপি কাগজ নিয়ে চায়ের দোকানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গরম গরম বক্তৃতা চলে। ছাত্র হস্টেলে, রোয়াকে, বৈঠকখানায়, তারপর দিন পর্যন্ত একমাত্র আলোচ্য বিষয় থাকে ধূমকেতু।’
(ধূমকেতুর কবি নজরুল, সূফী জুলফিকার হায়দার সম্পাদিত নজরুল-প্রতিভা-পরিচয়, পৃ. ৪২৮)।
প্রখ্যাত নজরুল-গবেষক ড. সুশীলকুমার গুপ্ত লিখেছেন :
“সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানের অচলায়তনকে ভেঙেচুরে নতুন যুগচেতনায় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করার পবিত্র সংকল্প নিয়ে ধূমকেতুর সারথিরূপে মূর্তবিদ্রোহ নজরুল আবির্ভূত হন। সম্পাদকীয় প্রবন্ধের পৃষ্ঠার শীর্ষে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাণী, নজরুলের অগ্নিগর্ভ প্রবন্ধ, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ওরফে ‘ত্রিশূলে’র রাজনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা প্রভৃতি নিয়ে যেদিন ধূমকেতু উদিত হয়, সেদিন সারা শহরে যে তুমুল উত্তেজনা দেখা দেয়, তা অভাবনীয়।”
(নজরুল-চরিতমানস, পৃ. ২৯৪-২৯৫)।
পাঁচ
কেন উদয়কালেই ধূমকেতুর এমন পাঠকপ্রিয়তা এবং জনচিত্ত জয় ? কেনই বা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার নজরুলের ধূমকেতুর বিরুদ্ধে খড়গহস্ত ধারণ করেছিল ? এর কারণ হিসেবে আমরা জেনেছি, ব্রিটিশ-শাসনের সমালোচনা, ব্রিটিশ-বিরোধিতা এবং ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে সশস্ত্র আন্দোলনে অনুপ্রেরণা দান। ধূমকেতুর অগ্নিগর্ভ সম্পাদকীয়, লাভাময় রাজনৈতিক প্রবন্ধ, স্ফুলিঙ্গগর্ভী কবিতা বিপ্লবীদের প্রেরণাদানের পাশাপাশি ইংরেজ শাসকশ্রেণিকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। এর নিদর্শন প্রথম সংখ্যাতেই দৃশ্যমান। নজরুল ইসলাম ধূমকেতুর সূচনা সংখ্যাতে পত্রিকার আদর্শ-উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানিয়েছেন :
“‘মাভৈঃ’ বাণীর ভরসা নিয়ে ‘জয় প্রলয়ঙ্কর’ বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হল। আমার কর্ণধার আমি। আমার যাত্রা শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি―নমস্কার করছি আমার সত্যকে।… দেশের যারা শত্রু, দেশের যা কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে ধূমকেতু হবে আগুনের সম্মার্জনী।… ধূমকেতু কোনও সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মনুষ্যধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোনওখানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করা এর অন্যতম উদ্দেশ্য।”
সগর্বে সহজ সত্যের এমন সুস্পষ্ট উচ্চারণ নির্ভয়ে করেছিলেন তিনি।
প্রথম বর্ষ ত্রয়োদশ সংখ্যায় (১৩ অক্টোবর, ১৯২২) ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে তিনি লেখেন :
‘সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না। কেন না ওকথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না।… পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল কিছু নিয়ম-কানুন, বাঁধন-শৃঙ্খলা-মানা-নিষেধের বিরুদ্ধে।’
অকুতোভয় এমন বিদ্রোহব্যঞ্জক বক্তব্য ধূমকেতুর প্রতি সংখ্যায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে থাকত। দেশের যৌবনদীপ্ত মানুষের মনে এমন আগুনঝরা দুঃসাহসী রচনা স্বাধীনতার চেতনা প্রবলভাবে উদ্দীপিত করেছিল। তৎকালীন অনুশীলন ও যুগান্তর দলের বিপ্লবীরা এই উদ্দীপনায় নতুন করে উজ্জীবিত হয়েছিল।
ছয়
ধূমকেতুর জ্বালাময় সংবাদ, অগ্নিগর্ভ সম্পাদকীয়, দাবানলদাহী প্রবন্ধ ও স্ফুলিঙ্গগর্ভী কবিতার জন্য ব্রিটিশ সরকারের টনক নড়ে―তারা নজরুলকে দমনের পথ খুঁজতে থাকে। এরই মধ্যে পূজা সংখ্যার (২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২) ধূমকেতুতে নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। তাতে কবি লেখেন :
‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।
দেবশিশুদের মারছে চাবুক, বীরযুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি,
ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?’
ঊনআশি পঙ্ক্তির এই সুদীর্ঘ কবিতাটি কাল হয়ে দাঁড়ায় ধূমকেতু-সারথি ও তাঁর পত্রিকার। ফলে ব্রিটিশ সরকার নজরুলের বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা দায়ের করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে এবং পত্রিকার সেই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে। পুলিশ পত্রিকার অফিস ও প্রেসে খানাতল্লাশি এবং সম্পাদককে খোঁজাখুঁজি করে। নজরুল তখন ফেরারি হয়ে আত্মগোপনে। কবিকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২, কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এসব সংবাদ বাসন্তী, আনন্দবাজারসহ সেকালের প্রায় সব পত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। বাসন্তী পত্রিকায় লেখা হয় :
“ধূমকেতু কাগজখানি রাজদ্রোহে অভিযুক্ত হইয়াছে। ইহাতে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ও ‘বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ’ নিবন্ধ দুইটিই তাহার কারণ। মামলা ২০ নভেম্বর হইবে।… ধূমকেতু কেন্দ্র পুলিশ কর্তৃক খানাতল্লাসী হইয়াছিল।” ২৮ নভেম্বর ১৯২২, আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘ধূমকেতুর মামলা’ শীর্ষক খবরে লেখা হয় : ‘ধূমকেতুর ভূতপূর্ব সারথি ২৩শে নভেম্বর দুপুরবেলা কুমিল্লায় গ্রেফতার হন। সেই দিনই চাটগাঁ মেলে চাপিয়ে ২৪শে সন্ধেবেলা কলকাতায় আনা হয়েছে।’
কবির বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলার বিচার হয় কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহোর আদালতে। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার রায় দেওয়া হয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-এ ধারায় তাঁর এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এই সংবাদও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ফলাও করে প্রকাশ করে।
সম্পাদক নজরুলের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি, পত্রিকা অফিসে তল্লাশি, ছাপাখানায় ফাইলপত্র জব্দ ও কর্মকর্তাদের আত্মগোপনের ফলে ধূমকেতু চরম সংকটে পড়ে। সারথি নজরুল আত্মগোপনের আগে ৩ নভেম্বর ১৯২২ পর্যন্ত বিশটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন। ১২ নভেম্বর (১৯২২) থেকে পরবর্তী কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয় অমরেশ কাঞ্জিলালের সম্পাদনায়। ২৭ জানুয়ারি (১৯২৩) নজরুল সংখ্যা হিসেবে ধূমকেতু শেষবার প্রকাশিত হয়। তবে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ‘ধূমকেতুর কবি নজরুল’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন : ‘নজরুলের জেল হওয়ার পর দু’সপ্তাহ কাগজ বন্ধ থাকে, তারপর বীরেন সেনগুপ্তের সম্পাদনায় পাক্ষিক হিসাবে দুটো সংখ্যা বেরিয়ে ধূমকেতু বন্ধ হয়ে যায়।’ (সূফী জুলফিকার হায়দার সম্পাদিত নজরুল-প্রতিভা-পরিচয়, পৃ. ৪৩১)।
নজরুলের জীবন ও কীর্তি এখনও পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত হয়নি। আছে দ্বিধা, জটিলতা ও তথ্যবিভ্রাট। ধূমকেতুর শেষ সংখ্যার তারিখ ও সম্পাদনার বিষয়টিও তেমনই বিভ্রাটপূর্ণ। নিশ্চয়ই তা নজরুল-গবেষকবৃন্দ সুনির্দিষ্ট করবেন।
ধূমকেতু প্রকাশের শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে কত কাগজের অপমৃত্যু হয়েছে―মুছে গেছে নামনিশানা। তবে স্বল্পায়ু এই পত্রিকাটি কেবল বাংলার সংবাদপত্রের ইতিহাসে নয়; ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে বিদ্রোহ-ব্যঞ্জক চেতনা এবং বিপ্লবোদ্দীপক রচনাশৈলীর জন্য অমর হয়ে আছে। কেননা, ধূমকেতু প্রকাশের কালবিচারে স্বল্পায়ু হলেও চেতনায় চিরজীবী।
লেখক : প্রাবন্ধিক, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক