ধূমকেতু : জনসত্তায় বীররস সঞ্চারের মাধ্যম এবং অতঃপর… : আমিনুল ইসলাম

প্রচ্ছদ রচনা : নজরুলের ধূমকেতু আঁধারে অগ্নিসেতু
বাঙালি বীরের জাতি―এটা খুব বেশিদিন আগের কথা নয় অথবা এভাবেও বলা যেতে পারে, রাষ্ট্রীয় বিবেচনায় বাঙালির বীরসত্তার জাগরণ সাম্প্রতিককালের। জলবায়ু, আবহাওয়া, পলিসমৃদ্ধ নরম মৃত্তিকা, দেঁআশ মাটির অতুলনীয় উর্বরতা, কৃষিকাজের সহজতা প্রভৃতি বাঙালিকে আপন ভূগোলে ও উঠানে আত্মতৃপ্ত জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে রেখেছিল যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী। জনসংখ্যার অনুপাতে উর্বর কৃষিজমি ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। আর মাটি এতটাই উর্বর যে পাখির চঞ্চু থেকে বীজ পড়ামাত্রই তা বৃক্ষ হয়ে ওঠে যত্নহীন খোলা প্রান্তরে। এত সহজ কৃষিকাজ। বছরে একটা ফসল হলেই সারা বছর চলে। দুপুরে ভাত খেয়ে ভাতঘুম। বর্ষাকালে কাজকাম নেই। অতএব আষাঢ়ে গল্প। সুযোগ পেলে সামন্তবাদী পরকীয়া প্রেম। হয়তো পৃথিবীতে অন্য কোনও জাতি দুপুরে পেটভরে খেয়ে ঢেঁকুর তুলে ঘুমাতে যেতে চায় না। পৃথিবীতে অন্য কোনও জাতির মানুষ বসতে দিলে শুতে চায় না। বহুদিন যাবৎ এমনটাই ছিল বাঙালির জীবনযাপন। কী দরকার তার রাজ্যজয়ের! কী প্রয়োজন তার হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার! কিন্তু প্রকৃতি মাঝে মাঝে বিরূপ হতে ভুল করেনি। এসেছে খরা, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মহামারি। তখন বাঙালি বিধাতার আশীর্বাদ প্রার্থনায় কাতর হয়েছে। কখনও-বা দেবতার কাছে সন্তানের জন্য দুধভাতের দাবি জানিয়েছে। বাঙালি উচ্চতায় অনেক জাতির চেয়ে খাটো কিন্তু তাদের অনেকেই পেটমোটা হতে পিছিয়ে ছিল না। আর তেল মেখে গায়ের ত্বক চকচকে রাখা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। রবীন্দ্রনাথ এই বাঙালিকে সঠিকভাবে শনাক্ত করে বলেছিলেন :
‘ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো,
পোষ-মানা এ প্রাণ
বোতাম-আঁটা জামার নীচে
শান্তিতে শয়ান।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি,
মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্টগতি,
গৃহের প্রতি টান―
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
নিদ্রারসে-ভরা,
মাথায় ছোটো বহরে বড়ো
বাঙালিসন্তান।
… …. ….
দাস্যসুখে হাস্যমুখ,
বিনীত জোড়কর
প্রভুর পদে সোহাগ-মদে
দোদুল কলেবর!
(‘দুরন্ত আশা’, মানসী)
বাঙালির এই গৃহসুখপ্রিয়তা, আলসেমিপনা, ভাতঘুমপ্রীতি অর্থাৎ অতি আয়েশের জীবন তাকে প্রকারান্তরে অভিযানবিমুখ ও স্বভাবভীরু করে রেখেছিল। সন্দেহ নেই যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করেই তাকে টিকে থাকতে হয়েছে। সে মাঝে মাঝে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝির হোসেন মিয়া-কুবের হয়ে নতুন দ্বীপ ও চরের সন্ধানে দুঃসাহসী অভিযানে নেমেছে। কিন্তু মূলধারায় সে থেকে গিয়েছিল অলস, ভীরু ও অভিযানবিমুখ। সে কারণে যখন রবার্ট ক্লাইভরা গুটিকয়েক মানুষ মুর্শিদাবাদের নবাবকে পরাস্ত করে শহর প্রদক্ষিণ করেছে তখন হাজার হাজার মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখেছে : ‘আমার বলার কিছু ছিল না!’ বলা হয়, তারা সেদিন একটা করে ঢিল ছুড়ে মারলেও ক্লাইভের দল নিঃশেষে খতম হয়ে যেত। কিন্তু আপন গৃহকোণে আত্মসুখে তৃপ্ত বাঙালির সেই দূরদর্শিতা ছিল না, তার দেহমনে সেই প্রেরণা ছিল না।
অবশ্য পরবর্তীকালে নূরুলদীন, দয়াল, হাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর, ফকির মজনু শাহ, ক্ষুদিরাম প্রমুখ বীর বাঙালির আবির্ভাব ঘটেছে। এমন প্রেক্ষাপটে ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদক হয়ে যুদ্ধফেরত হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নি-আবির্ভাব। কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ধূমকেতু ছিল একটি অর্ধ-সাপ্তাহিক পত্রিকা, যা ১৩২৯ বঙ্গাব্দের ২৬ শ্রাবণ; ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট প্রথম প্রকাশিত হয়। শুরুতে ফুলস্কেপ কাগজের চার পৃষ্ঠায় মুদ্রিত হতো এবং পরে আট পৃষ্ঠায়। পত্রিকাটির সর্বশেষ সংস্করণ ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে প্রকাশিত হয়েছিল। ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা ‘ধূমকেতু’ প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার যাত্রারম্ভকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রেরিত বাণীতে লিখেছিলেন :
‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,
আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন।
অলক্ষণের তিলক-রেখা
রাতের ভালে হোক-না লেখা―
জাগিয়ে দে রে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন।’
ধূমকেতু পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে রবীন্দ্রনাথের এই আশীর্বাণী লেখা থাকত। ধূমকেতু পত্রিকার ধরন কেমন ছিল তা সে সময় প্রকাশিত খবর, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ইত্যাদি পাঠ করলেই পরিষ্কারভাবে বুঝা যায়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কাজী নজরুল ইসলামের ‘ধূমকেতু’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল ধূমকেতুতে। সেটির প্রথম দু-লাইন এমন : ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু/এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!’ বিপ্লব মানেই অন্যায় অবিচার দুঃশাসন কুসংস্কার পরাধীনতা ইতাদি দূরীকরণের সংগ্রাম― যুগপৎ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সশস্ত্র। আর এমন সংগ্রাম করার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান, বুদ্ধি, অসম সাহস ও নেতৃত্বদানের অনন্য ক্ষমতা। সেজন্য দরকার আত্মশক্তিতে আস্থা তথা আত্মবিশ্বাস। যুগবাহিত বাঙালির তেমন যোগ্যতা ছিল না বললেই চলে যা আমরা উপরে দেখেছি আলোচনায় এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতায়। রবীন্দ্রনাথ পূর্বোল্লিখিত ‘দুরন্ত আশা’ কবিতাতেই অলস ও সুখবিলাসী বাঙালি হওয়ার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বেদুঈন হওয়ার আকাক্সক্ষা পোষণ ও প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন!/চরণতলে বিশাল মরু/দিগন্তে বিলীন।/ছুটেছে ঘোড়া, উড়ছে বালি,/জীবনস্রোত আকাশে ঢালি/হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি/চলেছি নিশিদিন। বর্শা হাতে, ভর্সা প্রাণে,/সদাই নিরুদ্দেশ,/মরুর ঝড় যেমন বহে/সকল বাধাহীন।’
কাজী নজরুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লিখেছিলেন বাঙালির সকল অলসতা, জড়তা, ভীরুতা ও দাস্যসুখপ্রিয় মানসিকতা দূরীকরণে প্রেরণা ও প্ররোচনা জাগাতে ও জোগাতে। তখন থেকে বাঙালির মানসিক শৃঙ্খল মুক্তির উদ্বোধন : ‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!’ এভাবে বাঙালি সহসা তার স্বরূপ আবিষ্কার ও উন্মোচন করে ঘোষণা দিয়েছিল ‘বল বীর―বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’ এবং ‘আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস/ আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।’ ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রথমে ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। মাসিক প্রবাসী পত্রিকায় কবিতাটি মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায়, মাসিক সাধনা নামক পত্রিকায় বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যায় এবং ধূমকেতু পত্রিকায় ১৯২২ সালের ২২ আগস্ট ছাপা হয়। কারও কারও মতে কবিতাটি বিজলীতে প্রকাশেরও আগে মোসলেম ভারত নামক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ধূমকেতু পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক দুই-ই ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি ধূমকেতু অফিসটিকে প্রাণপ্রাচুর্য, আনন্দ-উচ্ছলতা ও বৈপ্লবিক মনমানসিকতা গড়ে তোলার বুদ্ধিবৃত্তিক সপ্রাণ কারখানায় পরিণত করেছিলেন। ধূমকেতু সে সময়ের জনসত্তায় বীররস সঞ্চারের দায়িত্ব নিয়েছিল এবং সেই দায়িত্ব সাফল্যে সঙ্গে পালন করেছিল। সেই বীররসের প্রধান উপাদান ছিল আপসহীন সত্যপ্রিয়তা ও নিñিদ্র সত্যনিষ্ঠা। একজন প্রকৃত বীর কখনও কোনও অবস্থাতেই মিথ্যা কথা বলে না। মিথ্যাচার হচ্ছে দুর্বল, ভীরু ও কাপুরুষের সম্বল। বীররসের সঞ্চার মানে সত্যনিষ্ঠতার চেতনার সঞ্চার। ধূমকেতুর উচ্ছল প্রাঙ্গণ ঘিরে কাজী নজরুল ইসলাম নিজেই ছিলেন সকল কাজের কাজী―সকলের মধ্যমণি। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর লেখা এবং উপস্থিতি উভয়ের দ্বারা ধূমকেতু অফিস ও পত্রিকাকে ভয়হীন দুরন্ত জীবনের মুক্ত উঠানে উন্নীত করেছিলেন। তিনি তাঁর আর দশজন সহকর্মীর কাছে অনুপম ‘আইডল’ ছিলেন। যারা সহযাত্রী হয়ে তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন, তারা এতটুকওু ঠকেননি কোনওদিনও। এ প্রসঙ্গে নজরুল সাহচর্যধন্য খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন লিখেছেন :
‘ধূমকেতু যেদিন প্রকাশিত হলো, কোলকাতার কলেজ স্কোয়ারের মোড়ে দেখেছি সেদিন কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছিল। সারাদেশের মনের কথা টেনে বের করে নজরুল যেন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন কাগজের পাতায়, প্রতি ছত্রে।’
অল্প সময়ের মধ্যে এমন জনপ্রিয় কবিও দেখা যায়নি, এমন জনপ্রিয় কাগজও। বাঙলাদেশে ধূমকেতুর আবির্ভাব অপ্রত্যাশিত, স্বল্পায়ু কিন্তু অবিস্মরণীয়। এর অফিস ছিল কোলকাতা মেডিকেল কলেজের পূর্বদিকেÑ৭নং প্রতাপ চাটুর্যে লেনে। সেখানে সন্ধ্যার পরে বসত যত ‘লক্ষ্মীছাড়ার আড্ডা’। সেখানে কী যে হতো, আর কী হতো না, তা যাঁরা না দেখেছেন, তাঁদের বলে বোঝানো যাবে না।
‘ধূমকেতুর ধূমায়িত আস্তানায় সকল লক্ষ্মীছাড়ার মধ্যমণি হয়ে বসেছেন নজরুল। সে কি উদ্দামতা, সে কি প্রাণচাঞ্চল্য, উচ্ছ্বসিত হাসির হুল্লোড়! সে হাসিতে ছাদের কড়িকাঠ বুঝি র্থ র্থ করে কাঁপত। কাঁপত দেয়াল, কাঁপত পাশের বাড়ির নিরীহ মানুষগুলোর বুক।
গান গাইছেন নজরুল :
‘মোরা সব লক্ষ্মীছাড়ার দল।
মোরা সব লক্ষ্মীছাড়ার দল।’
‘চলছে পান-জর্দা আর চা খাওয়ার ছড়াছড়ি! একদিন তো তিনি বন্ধুদের সঙ্গে বাজী ধরে নিজের উচ্ছৃঙ্খলতা আর উদ্দামতা প্রমাণের জন্য মেডিকেল কলেজের কোনও ছাত্রের কাছ থেকে চেয়ে আনলেন একটা মড়ার খুলি। আর খেয়ে ফেললেন তাতে করে চা!
‘এই আসরে নিয়মিত যেতেন জনাব মঈন-উদ্-দীন হোসায়ন, পবিত্র গাংগুলী, নৃপেন চ্যাটার্জী এবং আরও অনেকে। আমি মাত্র দু-একবার উপস্থিত ছিলাম নীরব দর্শক হিসেবে।
মড়ার খুলিতে চা খাওয়ার ঘটনা আমি নিজে দেখিনি। পরিচয় গাঢ় হওয়ার পর কবি আমাকে বলেছেন―স্পষ্ট মনে আছে।
‘ধূমকেতুর আড্ডায় নজরুলকে দেখে মনে হতো, সারা শহরে এই একটি-ই যেন জীবন্ত মানুষ। এমন লা-পরোয়া মানুষ বুঝি আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।’
(যুগ-স্রষ্টা নজরুল, খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন)
বাঙালির ভীরুতা ও অলসতা দূর করে তাকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান ও স্বাধীনতাপ্রিয় মানসিকতার অধিকারী হতে কাজী নজরুল ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার অনন্য মাধ্যম ছিল ধূমকেতু। এই পত্রিকায় জ্বালাময়ী ভাষায় রচিত প্রবন্ধ, উপসম্পাদকীয়, কবিতা ইত্যাদি প্রকাশিত হতো। শুরুতেই ‘আমার পথ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় গদ্যেই ঘুণে ধরা পুরাতনকে ধ্বংসের মধ্য দিয়ে নতুন সৃষ্টির কথা বলা হয়েছিল :
“মাভৈঃ বাণীর ভরসা নিয়ে ‘জয় প্রলয়ঙ্কর’ বলে ধূমকেতুকে রথ করে আমার আজ নতুন পথে যাত্রা শুরু হলো। আমার কর্ণধার আমি। আমায় পথ দেখাবে আমার সত্য। আমার যাত্রা-শুরুর আগে আমি সালাম জানাচ্ছি―নমস্কার ক’রছি আমার সত্যকে। যে-পথ আমার সত্যের বিরোধী, সে পথ ছাড়া আর কোন পথই আমার বিপথ নয়! রাজভয়Ñলোকভয় কোনও ভয়ই আমায় বিপথে নিয়ে যাবে না। আমি যদি সত্যি ক’রে আমার সত্যকে চিনে থাকি, আমার অন্তরে মিথ্যার ভয় না থাকে, তা হ’লে বাইরের কোন ভয়ই আমার কিছু ক’রতে পারবে না। যার ভিতরে ভয়, সে-ই বাইরে ভয় পায়। আমার বিশ্বাস, যে নিজকে চেনে, তার আর কাউকে চিনতে বাকি থাকে না। অতএব যে মিথ্যাকে চেনে, সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার মনে মিথ্যা সে-ই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে, সে আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না―অর্থাৎ তাকে কেউ ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না। এই যে নিজেকে চেনা, আপনার সত্যকে আপনার গুরু, পথপ্রদর্শক, কাণ্ডারী ব’লে জানা, এটা দম্ভ নয়, অহংকার নয়। এটা আত্মকে চেনার সহজ স্বীকারোক্তি। আর যদিই এটাকে কেউ ভুল করে অহঙ্কার ব’লে মনে করেন, তবু এটা মন্দের ভালো―অর্থাৎ মিথ্যা বিনয়ের চেয়ে অনেক বেশি ভালো।”
দেখা যাচ্ছে পরাধীন ভারতের শিক্ষাবঞ্চিত এবং নানাবিধ কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে বদ্ধ মানুষের মধ্যে আত্মশক্তির উদ্বোধন ঘটাতে ধূমকেতু শুরুতেই পথনির্দেশনা প্রদান করেছিল। নজরুল যতই আবেগপ্রবণ হন না কেন তাঁর দূরদর্শিতায় ঘাটতি ছিল না এতটুকু। ধর্মীয় বিভেদের আশ্রয় নিয়ে ব্রিটিশ সরকার ও তার চেলাচামুণ্ডারা যেন ধূমকেতুর যাত্রাপথকে বিতর্কিত করে দিতে না পারে, সেজন্য একই সম্পাদকীয়ের শেষাংশে পরিষ্কার অক্ষরে বলা হয়েছিল :
“এ-ধূমকেতু ঝগড়া-বিবাদ আনবে না, তবে প্রলয় যদিই আনে, তা হ’লে সেটার জন্য দায়ী ধূমকেতুর দেবতা,―সারথি নয়। এ-দেশের নাডিতে-নাড়িতে অস্থি-মজ্জায় যে পচন ধ’রেছে, তাতে এর একেবারে ধ্বংস না হ’লে নতুন জাত গ’ড়ে উঠবে না। যার ভিত্তি প’চে গেছে, তাকে একদম উপড়ে ফেলে নতুন ক’রে ভিত্তি না গাঁথলে তার ওপর ইমারত যতবার খাড়া করা যাবে, ততবারই তা পড়ে যাবে। প্রলয় আনার যে দুর্দম অসম-সাহসিকতা, ধূমকেতু যদি তা না আনতে পারে, তবে তাতে অমঙ্গলের চেয়ে মঙ্গলই আনবে বেশি।
‘দেশের যারা শত্রু, দেশের যা-কিছু মিথ্যা, ভণ্ডামি, মেকি তা সব দূর করতে প্রয়োজনে ধূমকেতু হ’বে আগুনের সম্মার্জনা! ধূমকেতুর এমন কোনও গুরু বা এমন বিধাতা কেউ নেই যার খাতিরে সে সত্যকে অস্বীকার ক’রে কারও মিথ্যা বা ভণ্ডামিকে প্রশ্রয় দেবে। ধূমকেতু সে দাসত্ব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। ধূমকেতু কোনও দিনই কারুর বাণীকে বেদবাক্য বলে মেনে নেবে না যদি তার সত্যতা প্রাণে তার সাড়া না দেয়। না বুঝে বোঝার ভণ্ডামি ক’রে পাঁচ জনের শ্রদ্ধা আর প্রশংসা পাওয়ার লোভ ধুমকেতু কোনওদিনই ক’রবে না।
সম্পাদকীয় প্রবন্ধের শেষাংশে আরও বলা হয়েছিল : “ধূমকেতু কোনও সাম্প্রদায়িক কাগজ নয়। মানুষ-ধর্মই সবচেয়ে বড় ধর্ম। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অন্তরায় বা ফাঁকি কোন্ খানে তা দেখিয়ে দিয়ে এর গলদ দূর করাই এর অন্যতম উদ্দেশ্য। মানুষে মানুষে যেখানে প্রাণের মিল, আদত সত্যের মিল, সেখানে ধর্মের বৈষম্য, কোনও হিংসার দুশমনীর ভাব আনে না। যার নিজের ধর্মে বিশ্বাস আছে, যে নিজের ধর্মের সত্যকে চিনেছে, সে কখনও অন্য ধর্মকে ঘৃণা ক’রতে পারে না।
ধূূমকেতুতে প্রকাশিত সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো পরবর্তীকালে যুগবাণী এবং দুর্দিনের যাত্রী নাম দিয়ে পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছিল এবং রাজরোষে পড়ে সেসব বাজেয়াপ্ত হয়েছিল বলে খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন তাঁর বিখ্যাত যুগ-স্রষ্টা নজরুল বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ধূমকেতুতে প্রকাশিত সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলোর মধ্যে ছিল ‘আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল’, তুবড়ি বাঁশির ডাক’, ‘মোরা স্বাধীন, মোরা সবাই রাজা’, ‘স্বাগত’, ‘মেয় ভূখা হুঁ’, ‘পথিক! তুমি পথ হারাইয়াছ?’, ‘ধূমকেতু’র পথ’, ‘মোহররম’, ‘আমার ধর্ম’, ‘মুশকিল’, ‘নিশান-বরদার’, ‘তোমার পণ কি’, ‘কামাল’, ‘ধূমকেতুর আদি-উদয় স্মৃতি’, ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’, ‘বিষবাণী’ প্রভৃতি। নজরুল জীবনীকার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষায় ধূমকেতুর সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো ছিল ‘কালির বদলে রক্তে ডুবিয়ে লেখা’। সেসব লেখা পড়ে তৎকালীন কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা ভয়ভীতি দ্বিধা-সংকোচ ঝেড়ে ফেলে জেগে উঠেছিল দেশপ্রেমে। ধূমকেতুতে প্রকাশিত লেখাসমূহের অগ্নিগর্ভ ভাষা এবং ঝড় তোলা যুক্তি―অশিক্ষা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, পরাধীনতায় বসবাসের অভ্যাস এসব কিছুকে ঝেটিয়ে দূর করতে উজ্জীবিত ও উদ্দীপিত করে তুলেছিল তাদের।
ধূমকেতুতে প্রকাশিত সম্পাদকীয় প্রবন্ধগুলো সকল শ্রেণির মানুষকে জাগিয়ে তোলার মতো শব্দে, বাক্যে ও ভাষায় রচিত হয়েছিল। অনেক সময়ই সেসব উন্নাসিক ভদ্রলোকদের পরিশীলিত ভাষা থেকে অনেকখানি আলাদা ছিল। সর্বসাধারণকে উদ্দীপ্ত করে তোলার জন্য ওই ধরনের ভাষার প্রয়োজন ছিল, সেটা নজরুল ভালো করেই বুঝেছিলেন। সম্পাদকীয় প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং বিষয়বস্তুর ধরন অনুসারে ভাষা ব্যবহারে নজরুল অব্যর্থ দূরদর্শিতা ও অনন্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি তাঁর ‘মোরা সবাই স্বাধীন, মোরা সবাই রাজা’ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছিলেন :
“একবার শির উঁচু ক’রে বল দেখি বীর, ‘মোরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা!’ দেখবে অমনি তোমার পূর্ব-পুরুষের রক্ত-মজ্জা-অস্থি দিয়ে গড়া রক্ত-দেউল তাসের ঘরের মতো টুটে পড়েছে, তোমার চোখের সাত-পুরু-করে বাঁধা পর্দা খুলে গেছে, তিমির রাত্রি দিক-চক্রবালের আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছে। তোমার হাতে-পায়ে গর্দানে বাঁধা শিকলে প্রচণ্ড মোচড় দিয়ে বল দেখি বীর―‘মোরা সবাই স্বাধীন, সবাই রাজা!’ দেখবে অমনি তোমার সকল শিকল, সকল বাঁধন টুটে খান খান হয়ে গেছে।
“স্বরাজ মানে কী ? স্বরাজ মানে, নিজেই রাজা বা সবাই রাজা; আমি কারুর অধীন নই, আমরা কারুর সিংহাসন বা পতাকাতলে আসীন নই। এই বাণী যদি বুক ফুলিয়ে কোনও ভয়কে পরোয়া না ক’রে মুক্তকণ্ঠে বলতে পার, তবেই তোমরা স্বরাজ লাভ করবে, স্বাধীন হবে, নিজেকে নিজের রাজা করতে পারবে; নৈলে নয়।
“কিন্তু আসল প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘আমার রাজা আমি’―বাণী বলবার সাহস আছে কোন্ বিদ্রোহীর ? তার সোজা উত্তর―যে বীর কারুর অধীন নয়, বাইরে-ভিতরে যে কারুর দাস নয়, সম্পূর্ণ উদার, মুক্ত! যার এমন কোনও গুরু বা বিধাতা নেই যাকে ভয় বা ভক্তি ক’রে সে নিজের সত্যকে ফাঁকি দেয়, শুধু সে-ই সত্য স্বাধীন, মুক্ত স্বাধীন। এই অহম্-জ্ঞান আত্মজ্ঞান―অহঙ্কার নয়, এ হচ্ছে আপনার ওপর অটল বিরাট বিশ্বাস। এই আত্মবিশ্বাস না থাকলে, মানুষ কাপুরুষ হয়ে যায়, ক্লীবত্ব প্রাপ্ত হয়। পরকে ভক্তি ক’রে বিশ্বাস ক’রে শিক্ষা হয় পরাবলম্বন, আর পরাবলম্বন মানেই দাসত্ব। এই মনের পরাবলম্বন বা গোলামিই আমাদের চির-গোলাম করে রেখেছে।”
এই ভাষা পরিশীলিত ও উচ্চমার্গীয় বা প্রমিত বলা যায়। কারণ বিষয়টি বুঝিয়ে বলার জন্য এমন ভাষার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার মূল প্রশ্নটি এড়িয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সাম্প্রদায়িক লাভের চেষ্টায় ব্রিটিশরাজের সঙ্গে দেনদরবার করতে গোপনে তৎপর ছিল, তখন ধূমকেতু বজ্রকণ্ঠে পরিষ্কার ভাষায় পূর্ণ ও প্রকৃত স্বাধীনতার দাবি জানিয়ে লিখেছিল ‘ধূমকেতুর পথ’ যেখানে বলা হয় :
সর্বপ্রথম, ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়।
স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথি এক এক রকম ক’রে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশির অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনও বিদেশির মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ-দেশে মোড়লী ক’রে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদেরে পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগরপাড়ে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনও। আমাদেরো এই প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।
“পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়ম-কানুন বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।
“আর এই বিদ্রোহ করতে হলে―সকলের আগে আপনাকে চিনতে হ’বে। বুক ফুলিয়ে বলতে হবে,―আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ!”
কিন্তু রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্থবহ হয় না যদি না তাতে সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তি ঘটে। রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্রক্ষমতা চিরদিনই উপরতলার একটি শ্রেণির মানুষের হাতে কুক্ষিগত থাকে। জনগণের ক্ষমতায়ন ছাড়াই রাষ্ট্রীয় পটপরিবর্তনে ক্ষমতার হাতবদল হয় মাত্র, দেশের সাধারণ মানুষের কোনও লাভ হয় না। ধূমকেতু এবং তার কর্ণধার কাজী নজরুল ইসলাম বিষয়টি তখনই ষোলোআনাই বুঝেছিলেন। সেজন্য তিনি রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে জনগণের সামাজিক কুসংস্কার, অদৃষ্টবাদ, ধর্মীয় গোঁড়ামি, জাতিভেদ প্রথার শেকল, অশিক্ষার অন্ধকার প্রভৃতি থেকে মুক্তির দাবি জানিয়েছিলেন। আলোকিত সামাজিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এসব হচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের কাজ। তিনি সাধারণ জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়নের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ধূমকেতুতে তিনি ‘মুশকিল’ শিরোনামের সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লিখেছিলেন :
“দেশের কাজ পল্লীগঠন করতে হবে। মূক মৌনমুখে মুক্তির কলরব জাগিয়ে তুলতে হবে। সকল প্রকার মিথ্যা অত্যাচারের বিরুদ্ধে যাতে জনসাধারণ অকুণ্ঠচিত্তে পরিপূর্ণ বিদ্রোহ করতে পারে, তার ব্যবস্থা চাই, আর তা না হলে শুধু ভদ্রলোকের জটলাতে স্বরাজের পাকা বুনিয়াদের প্রতিষ্ঠা হবে না―এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার জন্য চাই―এই অগণিত জনসাধারণ যাতে পূর্ণ অধিকার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সজাগ হয়, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল রকম অবিচার কদাচারের বিরুদ্ধে, অন্তরে ভগবত্তার স্পর্শ ও অনন্ত শক্তি অনুভব করে, মাথা খাড়া করে দাঁড়াবার মত বল পায় সেইজন্য চেষ্টা ও আন্দোলন করা। এই ছত্রভঙ্গ ছিন্নভিন্ন বিবাদ-ক্ষিপ্ত বিরাট জনশক্তিকে সঙ্ঘবদ্ধ ও চালিত না করতে পারলে অত্যাচারীর দম্ভকে স্তম্ভিত করা যাবে না। আজ সেই সাধক ও সিদ্ধ নেতা কোথায়, যিনি এই দীনহীন জীর্ণ মলিন আচণ্ডাল ভারত সন্তানের বিষণ্ন মুখে হাসির ও তেজের আলো ফুটিয়ে তুলবেন―বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? তাই বলছিলাম মুশকিল!”
কাজী নজরুল ইসলামের ধূমকেতু একের পর এক অগ্নিঝরা ভাষায় ব্রিটিশবিরোধী এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তির পক্ষে সংবাদ পরিবেশন এবং সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশ করতে থাকে। জেগে ওঠে পরাধীন ভারতের বিশেষত বাঙালি তরুণ সমাজ। ভাবিয়ে তোলে ব্রিটিশরাজকে। পুলিশের হানা, হুমকি কোনও কিছুকেই ভয় করেনি ধূমকেতু। সূচনা দিনের সম্পাদকীয় ঘোষণার প্রতি শতভাগ বিশ্বস্ত থেকে রাজনৈতিক সত্যনিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্তি, জনসচেতনতা সৃষ্টি, শিক্ষার সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে অভিমত প্রদান করে যায়। কাজী নজরুল ইসলাম ধূমকেতুর সম্পাদকীয় হিসেবে লেখেন বৃটিশরাজের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। এই কবিতা ব্রিটিশরাজকে উৎকণ্ঠিত করে ও ক্ষেপিয়ে তোলে। কবির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হয়, বিচারে তাঁর এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ধূমকেতুর প্রকাশনা।
ধূমকেতু কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত একটি দ্বি-সাপ্তাহিক পত্রিকা যা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট। পত্রিকাটি চার পৃষ্ঠার বিন্যাসে শুরু হয়েছিল, সেটি পরে আট পৃষ্ঠায় বিস্তৃত হয়। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও পত্রিকাটির প্রকাশনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে এবং সেই সঙ্গে পত্রিকাটির বিলুপ্তি ঘটে চিরদিনের মতো। পত্রিকাটি বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশ করেছিল। ১৯২২ সালের আগস্ট মাসে মহরম সংখ্যা, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সালের আগমনী সংখ্যা, ২২ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সালের পূজা সংখ্যা, ২০ অক্টোবর ১৯২২ সালের দীপাবলী সংখ্যা এবং ২৭ ডিসেম্বর ১৯২২ সালের কংগ্রেস সংখ্যাসহ পত্রিকাটির বেশ কয়েকটি বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনা করেন নজরুল। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’, ‘ধূমকেতু’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতা এবং সাড়া জাগানো গদ্য ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ ধূমকেতুতে প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিও সেখানে পুনমুদ্রিত হয়েছিল। নজরুল যখন জেলে ছিলেন, তখন বীরেন সেনগুপ্ত ও অমরেশ কাঞ্জিলাল পত্রিকাটি দক্ষতার সঙ্গে সম্পাদনা করেছিলেন।
মাত্র সাত মাস স্থায়ী একটি ক্ষণজীবী পত্রিকা মহাপরাক্রশালী ব্রিটিশরাজের সিংহাসনে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া তৎকালীন ভারতীয় সমাজে বিরাজমান কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, সামাজিক কুপ্রথা, অন্ধবিশ্বাস, জনগণের ‘দাস্যসুখে হাস্যমুখ’ থাকার মানসিকতা ইত্যাদির ভিত ধরেও নাড়া দিয়েছিল কালবৈশাখী ঝড়ের শক্তিতে। ধূমকেতুর আহ্বানে স্বাধীনতাকামী ও মুক্তমনা মানুষজন সাড়া দিয়েছিল ব্যাপকভাবে। ধূমকেতু জন্মগতভাবে অকুতোভয় নজরুলকেও পুরোপুরি এবং সারা জীবনের জন্য আপসহীন সত্যপ্রিয়তা ও বিপ্লবী মানসিকতায় পুষ্ট করে তুলেছিল যা তাঁর পরবর্তীকালে রচিত কবিতায়, গানে ও অভিভাষণে সোনার ফসল ফলাতে সহায়তা করেছিল। কলকাতার এলবার্ট হলে ১৯২৯ সালে আয়োজিত কবিসংবর্ধনায় সভাপতির ভাষণে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছিলেন :
‘আমরা আগামী সংগ্রামে কবি নজরুলের সঙ্গীত কণ্ঠে ধারণ করিয়া শ্রীমান সুভাষের মতো তরুণ নেতাদের অনুসরণ করব। ফরাসী বিপ্লবের সময়কার কথা একখানি বইতে সেদিন পড়েছিলাম। তাহাতে লেখা দেখিলাম সে সময় প্রত্যেক মানুষ অতি মানুষে পরিণত হইয়াছিলেন। আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের কবিতাপাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতি মানুষে পরিণত হইবে।’
কাজী নজরুল ইসলামের এমন অতিমানুষ তৈরি করার সৃজনশীল ভূমিকার পেছনে ধূমকেতু পত্রিকার তাৎক্ষণিক প্রত্যক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদি পরোক্ষ প্রভাব কাজ করেছিল।
ধূমকেতুর এমন অতুলনীয় ও নজিরবিহীন সাফল্যের পেছনে কাজ করেছিল পত্রিকাটির কর্ণধার ও সম্পাদক নজরুলের আপসহীন সত্যপ্রিয়তা, উদার মানবতাবোধ, নিখাদ স্বদেশপ্রেম, সত্য উপস্থাপনে নির্মোহ বস্তুনিষ্ঠতা ও সৎসাহস, হালনাগাদ গভীর জ্ঞান, সকল অবস্থায় রাষ্ট্রীয় ভয়ভীতি, জেলজুলুমের কাছে নতিস্বীকার না করার মন এবং বৈষয়িক লোভ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকার মহাপুরুষসুলভ শক্তি। তার সঙ্গে ছিল সময়ের চাহিদা অনুসারে সংবাদ ও সম্পাদকীয়ের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং তা যথাযথভাবে উপস্থাপনে জুতসই ভাষার ওপর ষোলোআনা দখল। আর তাঁর সঙ্গী-সহযাত্রী তথা সৃজনশীল দলবলও ছিল একই আদর্শে ও সাহসকিতায় উদ্বুদ্ধ ও নিবেদিতপ্রাণ। এক কথায় ধূমকেতু এবং তার সম্পাদক-সাংবাদিকরা সেই সময়ের পাঠক, শিক্ষিতজন এবং বিশেষত তরুণ শ্রেণির মন জয় করতে এবং বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছিলেন। ধূমকেতুর মূল শক্তি ছিল নির্মোহ সত্যনিষ্ঠতা এবং হীন লোভ-ভয়কে দূরে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা। স্বদেশপ্রেম তার পুঁজি হলেও সে কখনও মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে দখলদার বৃটিশরাজকে অন্যায্যভাবে দোষারোপ করেনি। ব্রিটিশরাজ যেসব অন্যায়-অবিচার -নিপীড়ন চালিয়েছিল, ধূমকেতু সেসব থেকে জনগণকে মুক্ত করার পক্ষে অগ্নিঝরা ভাষায় অভিমত প্রকাশ, জনমত গঠন ও দাবি উপস্থাপন করেছিল। ধূমকেতুতে ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক রক্তে আগুন লাগানো ভয়ংকর-সুন্দর কবিতা প্রকাশের দায়ে নজরুলের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা হয়―বিচারে তাঁর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ধূমকেতু সম্পাদক কবি কাজী নজরুল যে লিখিত বক্তব্য দিয়েছিলেন সেখানেও নির্মোহ সত্যবাদিতা ও প্রচণ্ড সৎসাহসের স্বাক্ষর ছিল। ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ নামে খ্যাত সেই বক্তব্য আরও কয়েকটি পত্রিকাসহ ধূমকেতুতেও প্রকাশিত হয়েছিল। সেই বক্তব্যের একাংশে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি নাই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছি।’ একই লেখায় তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি পরম আত্মবিশ্বাসী। তাই যা অন্যায় বলে বুঝেছি, তাকে অন্যায় বলেছি, অত্যাচারকে অত্যাচার বলেছি, মিথ্যাকে মিথ্যা বলেছি,―কাহারো তোষামোদ করি নাই, প্রশংসার এবং প্রসাদের লোভে কাহারো পিছনে পোঁ ধরি নাই,―আমি শুধু রাজার অন্যায়ের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করি নাই, সমাজের, জাতির, দেশের বিরুদ্ধে আমার সত্য-তরবারির তীব্র আক্রমণ সমান বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে,―তার জন্য ঘরে-বাইরের বিদ্রƒপ, অপমান, লাঞ্ছনা, আঘাত আমার উপর অপর্যাপ্ত পরিমাণে বর্ষিত হয়েছে, কিন্তু কোনও কিছুর ভয়েই সত্যকে, আপন ভগবানকে হীন করি নাই, লোভের বশবর্তী হয়ে আত্ম-উপলব্ধিকে বিক্রয় করি নাই… আমি অন্ধ-বিশ্বাসে, লোভের লাভে, রাজভয় বা লোকভয়ে মিথ্যাকে স্বীকার করতে পারি না।’
ধূমকেতু কেবল ব্রিটিশদের অত্যাচারের কথা এবং ব্রিটিশরাজের হাত থেকে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার কথা বলেই ক্ষান্ত ছিল না। ধূমকেতু ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরে বিরাজমান মুষ্টিমেয় ধনী কর্তৃক কোটি কোটি সাধারণ মানুষকে শোষণ এবং জাতপাতের দোহাই দিয়ে কথিত নিম্নশ্রেণির মানুষকে পদদলিত করে রাখার বিরুদ্ধে সোচ্চারকণ্ঠ ছিল। অর্থাৎ দেশের অভ্যন্তরে স্বজাতির মানুষ দ্বারা স্বজাতিকে শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সমাজের বিবেককে জাগিয়ে তোলা এবং গণমানুষের মাঝে সক্রিয় সচেতনতার জোয়ার আনয়নও ছিল ধূমকেতুর উদ্দেশ্য ও কাজ। ধূমকেতু ‘লাঞ্ছিত’ শিরোনামের প্রবন্ধে বলেছিল : ‘দিনদিন চুরি-ডাকাতি বৃদ্ধি পাইতেছে। লক্ষ লোকের অন্ন সংস্থানের সর্বনাশ করিয়া চারি পাঁচশত লোক ধনী হইলেন এবং বিলাস ব্যসনে অর্থব্যয় করিলেন। উকিল দেখিতেছে মক্কেলের কত খাওয়া যায়। মহাজন দেখিতেছে দেনাদারের ভিটে মাটিটুকু কি করিয়া নেওয়া যাইতে পারে, ভদ্রলোক ভাবিতেছে ঢং দেখাইয়া কত বোকা ঠকানো যাইতে পারা যায়। কেউ বা বুদ্ধি বিক্রয় করিতেছেন, কেউ বা দেশনীতির মেলা খুলিয়া বসিয়া আছেন। পরের ভাবনা ভাবিবার তিল মাত্র সময় নাই। এই যে সারাদিন এত ব্যস্ততা সে শুধু কি করিয়া দুর্বলকে পেষণ করিয়া আর একটু বড় সঞ্চয় করা যায় তাহার চেষ্টার নিমিত্ত।
‘ভারতবর্ষের শতকরা সত্তর জন চাষী। তারা আজ অহরহ পরিশ্রম করিয়া দু’বেলা খাবার অন্ন যোগাড় করিতে পারে না। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা অসদুপায়েও স্ত্রীপুত্রের মুখে ভাত তুলিয়া দিতে পারে না। রোগ লইয়া দুর্ভিক্ষ ঘরে ঘরে মহাজনের মত ঘুরিয়া বেড়াইতেছে এদিকে উচ্চজাতি মৃত্যুকালেও নিম্নজাতিকে এক ধাপ উপরে উঠিতে দিবে না। জমিদারের জমি নিলামে, তবু সে প্রজার হাত ধরিবে না। বাবুরা ছোটলোকদের এখনও দূরে রাখিতেছেন। এ দেশি বড়লোকেরা ধর্ম সমাজ এমনকি রাজনীতি ক্ষেত্রেও আভিজাত্য ও কালচারের গর্বটুকু ভুলিতে পারিতেছে না। সমস্ত জাতিটা যেন মরণের দিকে ছুটিয়া চলিয়াছে।’
দেখা যাচ্ছে ধূমকেতু একদিকে বিদেশি ইংরেজ শাসকদের অত্যাচারের হাত থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছিল, তেমনি ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরে বিরাজমান সামন্তবাদী শোষণ ও জাতপাতভিত্তিক নিপীড়ন থেকেও নিষ্পেষিত সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বাঁচানোর পক্ষে জনমত গড়ে তোলার কাজ করেছিল। শ্রেণিচেতনা ও শ্রেণিশোষণ বিষয়ে মানুষকে সচেতন ও সক্রিয়ভাবে মানবিক করে তোলা ছিল ধূমকেতুর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও কর্মতৎপরতার ক্ষেত্র। কিন্তু ধূমকেতু পরবর্তীকালের সংবাদপত্রের ভূমিকা কেমন ? পাকিস্তান আমলে দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা আওয়ামী লীগের মুখপত্রের মতো থাকলেও মোটামুটি একটা গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে পেরেছিল। উনিশশো একাত্তর সালের পরপর দৈনিক গণকণ্ঠ সৎসাহসের সঙ্গে বলিষ্ঠ কণ্ঠে সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর ব্যর্থতা, অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন এবং খাদ্যাভাবসহ জনগণের বহুমাত্রিক দুর্ভোগের কথা তুলে ধরেছিল। গণকণ্ঠ অনেকটাই নজরুলের ধূমকেতুর মতো ছিল। উদাহরণস্বরূপ সেই সময়ে (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪) গণকণ্ঠে প্রকাশিত কবি অসীম সাহার উপসম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘একজন পুরনো রাজা : একজন নতুন রাজা’ পাঠ করলে মনে হয় ধূমকেতুতে লেখা নজরুলের কোনও উপসম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়ছি। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, তারপর থেকে দিনদিন অধিকাংশ সংবাদপত্র নিরপেক্ষ নির্মোহ সত্যপথ ছেড়ে দিয়ে পক্ষপাতদুষ্টতায় আক্রান্ত হতে থাকে এবং দিনদিন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক শক্তির দলীয় মুখপত্রে পর্যবসিত হয়ে যায়। তারা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দ্বারা ব্যাংক রিজার্ভসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট, গণতন্ত্র হত্যা, অর্থপাচার, গুম, খুন, রাষ্ট্রের স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপের প্রতি অব্যাহতভাবে অন্ধ-সমর্থন কিংবা মৌন সমর্থন দিয়ে যেতে থাকে। সিংহভাগ সংবাদপত্র ও অন্যান্য মিডিয়ার মালিক মূলত ধনী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিগণ হওয়ায় এসব মিডিয়া সমাজের সংখ্যার দিক থেকে সংখ্যালঘু ধনিকশ্রেণির কায়েমি স্বার্থের পক্ষে কাজ করে এসেছে। এখানে সুনীতি, বিবেক, মানবতাবোধ, সমাজের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতি ন্যূনতম দায়বদ্ধতা ইত্যাদির ছিটেফোঁটাও থাকেনি। ফলে মানুষ সংবাদপত্রসহ সমগ্র মিডিয়ার ওপর আস্থা হারাতে থেকেছে। কথা চালু হয়েছে যে, আগে মানুষ মিথ্যা কথা বলত আর মিডিয়া সত্য উদঘাটন করত আর এখন মিডিয়া মিথ্যা কথা বলে আর জনসাধারণ সত্য খুঁজে বের করে। এটা হচ্ছে নজরুলের ধূমকেতুর আদর্শের শতভাগ বিপরীত অবস্থা। সারা বিশ্বের মিডিয়াও মূলধারায় অনেক দিন ধরে পক্ষপাতদুষ্টতায় দূষিত ও দোষী হয়ে আছে। উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হয়ে আল জাজিরার মতো কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া নিরপেক্ষভাবে যথাসম্ভব সত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু সিএনএন, ফক্স নিউজ, বিবিসি, রয়টার্স ইত্যাদিসহ আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত মিডিয়াগুলো উপসাগরীয় যুদ্ধ, ইজরাইলি আগ্রাসন, ইরাক-লিবিয়ার ওপর অন্যায় আক্রমণ এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সাদ্দাম-গাদ্দাফিকে হত্যাকরণ প্রভৃতি ঘটনায় ভয়ংকরভাবে পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশন করে এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা আওয়ামী সরকারের পতন হওয়ায় প্রতিবেশী দেশের অর্ধশতাধিক মিডিয়া বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে এসেছে। তারা বানোয়াট ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করে অপপ্রচার চালিয়েছে। বিষয়টি বিবিসি এবং রিউমার স্ক্যানারেও ধরা পড়েছে। মিডিয়ার ভূমিকা এমনটা হওয়ার কথা নয়। এসব করে মিডিয়া নিজেদেরও ক্ষতি করেছে এবং করে যাচ্ছে। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আজ মিডিয়া নিয়ে শ্লেষাত্মক কবিতা রচিত হচ্ছে :
‘চুরিবিদ্যা বড়বিদ্যা―এটা আজ অতীতের শ্লোক
মলে মলে সিসিটিভি―বর্ডারেও ওয়াচ টাওয়ার
শূন্যে ঝোলে উপগ্রহ―আকাশে পাতালে তার চোখ
কোথায় চুরির রাত! রাতদিন নিউজ আওয়ার!
সাগরে ডাকাতি কত―লুটপাট প্রবাল ঝিনুক
তার চেয়ে মূল্যবান তরল সোনার গোডাউন
লুণ্ঠিত মাটির নিচে সোনাদানা হীরক সিন্দুক
বিবিসি ও সিএনএন হাতে? তবে করে যাও খুন!
স্বাধীনতা, সংগ্রাম, জঙ্গী, খুনী, লড়াই বাঁচার
ইত্যাকার শব্দগুলো পেয়ে গেছে নতুন তর্জমা
কী হবে কলেজে গিয়ে? অভিধান? মূল্য কিবা তার!
ক্ষমতার দশমুখ, সে নিয়েছে সব অর্থ জমা।
চোরের জননী কাঁদে―দ্যাখো তার খালি চুলো-হাঁড়ি
কিন্তু যার প্রেস-টিভি, তাকে তুমি ঠেকাবে কী দিয়া?
তাই তো মিডিয়া নিয়ে বিশ্বব্যাপী এত কাড়াকাড়ি,
গফুর বলদ পোষে,―জমিদার পালিছে মিডিয়া।’
উপরের কবিতার মধ্যেই মিডিয়ার অধঃপতনের আরেকটি কারণ চিহ্নিত হয়েছে, সেটা হচ্ছে : মালিকানার ধরন। ধূমকেতুর মালিকানা, সম্পাদনা, পরিচালনা সবই ছিল মূলত কাজী নজরুল ইসলাম এবং তাঁর আদর্শের অনুসারীদের হাতে। তাঁরা ছিলেন খাঁটি সাংবাদিক। খাঁটি দেশপ্রেমিক মানুষ। তারা ছিলেন দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ আলোকিত কর্মী। তারা কোনও ব্যক্তিগত বৈষয়িক লাভের লোভ, রাষ্ট্রীয় জেলজুলুমের ভয় কিংবা কোনও গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর কাছে হার মানেননি। তাদের কোনও রাজনৈতিক প্রভু কিংবা মিডিয়া-গডফাদার ছিল না। কিন্তু এখনকার অধিকাংশ সংবাদপত্রের মালিক ব্যবসায়ী-শিল্পপতিগণ, কোথাও কোথাও কালো টাকার মালিকও। এ ধরনের সংবাদপত্র মূলত মালিকের স্বার্থে ও ইচ্ছার অনুকূলে পরিচালিত হয়। আর মালিকগণের বড়ো অংশটাই ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত থাকেন। স্বার্থের সঙ্গে স্বার্থের গোপন বিবাহ ঘটে। এসবের পক্ষে যেমন ধূমকেতুর অনুসারী হওয়া অসম্ভব, তেমনি এসব পত্রিকার সম্পাদকদের পক্ষেও নজরুল, বীরেন সেনগুপ্ত বা অমরেশ কাঞ্জিলাল হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু যদি ধূমকেতুর সত্যনিষ্ঠতার আদর্শ কমবেশি অনুসরণ করা হতো, তাহলে সাংবাদিকতার নীতি-আদর্শের পরিপন্থি এসব ব্যাপার ঘটতো না। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় কবিদের সৃষ্টির বিশ্বাসযোগ্যতা ও সমাজে সেসবের প্রভাব সম্পর্কে বলেছেন : ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি,/ঘটে যা তা সব সত্য নহে। কবি, তব মনোভূমি/রামের জনমস্থান, অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ সেটা কেবল কবির কল্পনাজাত কবিতার স্বীকৃতি দানের নির্দোষ আনুকূল্য বা প্রতীকী সার্টিফিকেট মাত্র। সংবাদপত্রের কাজ কল্পনাজাত কবিতার মতো নয়। সংবাদসহ অন্যান্য মিডিয়ার কাজ বাস্তবে সংঘটিত ঘটনার পক্ষপাতহীন সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনা। নজরুলের ধূমকেতু বাস্তব ঘটনাবলির পক্ষপাতহীন উপস্থাপনার কাজটিই করেছিল সাফল্যের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যক্রমে আজ রবীন্দ্রনাথ-বর্ণিত কল্পনাভিত্তিক কবিতার স্থান দখলে নিয়েছে অধিকাংশ মিডিয়া। তারা ন্যারেটিভ বা বয়ান বানায়, পরিকল্পনার রংচং মিশিয়ে সেসব পরিবেশন করে। অধিকাংশ মানুষ সেটাকেই সত্য বলে জানতে প্ররোচিত বোধ করেন এবং তাই হয়। অতঃপর একসময় তারা জানতে পারেন, ওসব ছিল ভুয়া ও বানোয়াট সংবাদ-বয়ান। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে যায়। উল্লেখ্য, সকল মিডিয়া একই চরিত্রের হয় না। সব সাংবাদিকও একই মন মানসিকতার অধিকারী হন না। এত ডামাডোলের মধ্যেও দায়িত্বশীল কিছু সংবাদপত্র আছে, অনেক সৎ, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক সাংবাদিক আছেন। আমি শুধু নজরুল সম্পাদিত ধূমকেতু আর তৎপরবর্তী সময়ের সংবাদপত্রের মধ্যে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য তুলে ধরতে কিছু অপ্রিয় সত্য তুলে ধরেছি।
উপরেই উল্লেখ করেছি যে, বীররস মানেই সত্যপ্রিয়তার চেতনা। একজন বীর কখনও মিথ্যাচার করে না। সে কখনও অন্যায়ের কাছে―হীন ব্যক্তিলোভের কাছে―অন্যায়কারী শক্তির কাছে নতি স্বীকার করে না। সে সমাজের ধনী ও ক্ষমতাবান লোকের হাতের পুতুল হয়ে যায় না। সে নিয়োজিত কর্মচারী হলেও মালিকের অন্যায় সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা মেনে নিতে পারে না। শ্রেণিবিভাজিত সমাজের অসংগতি, শোষণ ও অবিচারের চিত্র তুলে ধরতে পিছপা হয় না। মিথ্যাচারিতা হচ্ছে অধম কাপুরুষের অস্ত্র। সাংবাদিকতা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি পেশা। প্রকৃতপক্ষে একজন সত্যিকারের সাংবাদিকের কাজ হচ্ছে সৎসাহসের কাজ―রক্তমাংসের মানুষ হয়েও সাংবাদিকের ভীরু কাপুরুষ হলে চলে না, তাকে বীর হতে হয়। এমন প্রেক্ষাপটে কাজী নজরুল ইসলামের ধূমকেতু বর্তমান সময়ের সাংবাদিকদের জন্য অবশ্যপাঠ্য হওয়া প্রয়োজন। সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ সিলেবাসে ধূমকেতু সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার সহকারে অন্তর্ভুক্ত থাকা আবশ্যক।
তথ্যসূত্র :
১। খান মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন : যুগ-স্রষ্টা নজরুল, হাতেখড়ি, ঢাকা, হাতেখড়ি প্রথম প্রকাশ ২০১৮।
২। কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের প্রবন্ধ-সমগ্র, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, দ্বিতীয় সংস্করণ সপ্তম মুদ্রণ ২০১৬।
৩। কাজী নজরুল ইসলাম : নজরুলের কবিতা সমগ্র, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ, প্রথম মুদ্রণ ২০১৫।
৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : রবীন্দ্ররচনাবলী প্রথম খণ্ড, সালমা বুক ডিপো, ঢাকা, প্রকাশকাল ১৪১৭ বঙ্গাব্দ।
৫। মহিউদ্দিন আহমদ : চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ, ঐতিহ্য, ঢাকা, প্রকাশকাল ২০২৩।
৬। ফারুক আহমেদ : বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম, উদার আকাশ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ ভারত; প্রকাশকাল ২০২২।
৭। আমিনুল ইসলাম : পরদেশী মেঘ, বর্ণধারা, ঢাকা, প্রকাশকাল ২০২৪।
৮। উইকিপিডিয়া।
লেখক : প্রাবন্ধিক