আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : মোহন রায়হান

ইশতেহার

আমি কী লিখব বল ? বললে দেশের কথা

হই দেশদ্রোহী।

ভাবলে প্রেমের কথা

আমি হই নগ্ন কামুক।

আমি তো দালাল নই

নই মোসাহেব

আমি এক প্রেমিক বিপ্লবী

ফাঁসি দেবে দাও ।

— — —

ভোর স্বপ্ন

এ-রকম ভোরস্বপ্ন তোমাকেও উষ্ণ উন্মাদিনী করে তোলে ?

টানটান নদীর জলের মতো উচ্ছিত জোয়ারে

ফুলে ফুলে দুলে দুলে ওঠে শরীরের প্রতিটি লোহিত কণা ?

ঘূর্ণির মতন পা থেকে মাথা পর্যন্ত পাক দিয়ে ওঠে

ভূমিকম্পের মতন কেঁপে কেঁপে ওঠে নাভীমূল

বন-কাঁপানো ভয়ংকর গর্জনে সহসা গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠে রক্ত-পিপাসু বাঘ!

বিশ্বাস করো, ঘুমাবার আগে বা তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্যেও একবার

ভাবিনি তোমার মুখ; এমন কি সারারাত অন্যান্য টুকরা

টুকরা স্বপ্নে বহুবার ভেঙ্গে গেছে ঘুম অথচ অনিকেত ভোরে

কবিতার অসহ্য সুন্দর দৃশ্যকাব্যের মতন অপূর্ব নগ্ন উদ্ভাসে

আমার লোমশ বুকে মুখ ঘসে তুমি বললে―

‘কতদিন আকণ্ঠ তৃষ্ণায় চৈত্রের মাটির মতন চৌচির হয়ে আছি

আজ আমি চাই আষাঢ়ের বর্ষণের মতন সম্পূর্ণ তোমাকে’

অঝোর বৃষ্টির মতন চুম্বনে ভরে দিলে সমস্ত শরীর

গভীর আলিঙ্গনে তুলে নিলে যেন এভারেস্ট চূড়ায়।

মৌমাছি উড়ে যাওয়া মধুচাকে মুখ ডুবিয়ে দিতেই

সুমসৃণ হাঁটু ভাঁজ করে খুলে দিলে পৃথিবীর স্বর্গদ্বার

আজন্ম আতপ্ত আমূল তৃষ্ণার্ত আমার জিহ্বা তোমার

কোমল-কস্তুরি স্পর্শের অদ্ভুত শিহরণে তুমি কঁকিয়ে ওঠার

সঙ্গে সঙ্গে কী নিষ্ঠুর জল্লাদের মতন কে যেন ভেঙ্গে দিল আমার

এ-যাবতকালের শ্রেষ্ঠতম মধুস্বপ্ন!

এ-রকম স্বপ্নভঙ্গের চেয়ে মৃত্যুই কি কাম্য নয়

কী রকম কষ্ট-যন্ত্রণার এই জাগরণ তুমি কি বুঝবে কোনওদিন ?

লোকে বলে, ভোরস্বপ্ন বৃথা যায় না কখনও, ভোরস্বপ্ন নিরানব্বইভাগ ফলে

আমার প্রার্থনা আজ থেকে―যেন মাত্র একভাগ অসম্ভাবনা পূর্ণ করে

হে আমার স্বপ্নেশ্বরী, তুমি আমার ভোরস্বপ্ন বাস্তবায়িত করো!

— — —

ভেতরে যাব

আমি তোমার ভেতরে যাব

ভেতরমুখি তুমি তোমার

দরজা খোলো।

পাষাণময়ী আর রেখো না

দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে

এবার তোমার কপাট খোলো

এমন প্রেমিক আর পাবে কি

এই অবেলায় ?

আমি তোমার ভেতরে যাব

উষ্ণতাময় উৎস ভূমি

দেখব তোমার অন্তরীক্ষ।

দাঁড়িয়ে আছি অনন্তকাল

লাল দরজায় কাতর প্রেমিক

আর পারি না সইতে খেলা

এবার আমি ভাঙব আগল।

আমি তোমার ভেতরে যাব…

— — —

কথা দেওয়া

কথা দিচ্ছি

আমি আর কোনও রক্তপাতে যাব না

যদি আমার হৃদয়ে না ঝরে রক্ত।

কথা দিচ্ছি

আমি আর কোন মিছিলেই যাব না

যদি মিছিলের সব দাবি মেনে নেয়া হয়।

কথা দিচ্ছি

আমি আর কারও প্রেমিক হব না

যদি তুমি মুছে দিতে পার কষ্টগুলো।

— — —

মুক্তিযুদ্ধ

হল্ট! অমাবস্যার অন্ধকার

থমকে দাঁড়াল যুবক

      এক

          দুই

              তিন

ব্রিজের নিচ থেকে উঠে আসে

একজন রাজাকার

     একজন আলবদর

        একজন খানসেনা

বেয়নেট উঁচিয়ে ঘিরে ফেলল যুবককে

টর্চের তীব্র আলো ছুঁড়ে দেখে নিল

নিটোল নিষ্প্রভ যুবকের মুখ

হো… হো… হেসে ওঠে

শালে মুক্তি!

হ্যান্ডস আপ!

অমাবস্যার অন্ধকার চিরে

গর্জে ওঠে আর একটি কণ্ঠ।

দুই হাত

উপরে চোখ বন্ধ

শেষ মন্ত্র জপ করে

     রাজাকার

         আলবদর

             খানসেনা

থর থর থর

কাঁপতে থাকে তিনজোড়া পা

থর থর থর

যেন কাঁপছে পাকিস্তান।

সহসা কোমর থেকে বের করা

লুকানো অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠে যুবক―

বেজন্মা পাকিস্তানি কুত্তা।

— — —

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button