
কবন্ধ সময়
আমার শ্যামল সবুজ ছুঁয়েছে কালো―
ধোঁয়া আর নীল আকাশে ঈগল ডানা!
কিছুতেই এই আগ্রাসনের কালো থাবা মানবো না।
চাই প্রতিবাদ কঠিন কণ্ঠের দীপ্র উদ্দীপনা।
দলে দলে হেঁটে যাচ্ছে কেবল কবন্ধ মানুষেরা
তাদের কাছেই বুদ্ধি ভিক্ষা করছে অন্ধ সময় এখন! প্রতিবাদী আজ যখন আকাশ-বাতাস এবং ইতিহাস
বাংলার
তখন হাঁটছে পিঁপড়ের গতি বোবাকালা লোকগুলো!
এই কি আমার তিরিশ লক্ষ বীরের বাংলাদেশ ?
এই কি বাংলা কবিতার দ্রোহী শৈল্পিক উদ্যান ?
যেখানে সময় কথা বলছে না, নির্বাক অসহায়―পঙ্গপালেরা উজাড় করবে দেশের শস্যমাঠ!
কেউ দেখবে না, কেউ শুনবে না! এমনই অন্ধ সময় এখন ?
কে বাঁচাবে তবে প্রগতি মশাল এবং সোনার বাংলা আমার!
— — —
চাওনি যদিও
স্বপ্নের উড়াল ডানা সহসাই ভেঙে যাবে বিপন্ন বাতাসে―
কখনও ভাবনি তুমি!
রৌদ্র ঝলসিত দিনে কী করে হঠাৎ মøান-ধূসর আকাশ!
অকস্মাৎ ঘন কালো কুয়াশায় ঢেকে যাবে উন্মুক্ত প্রান্তর!
সব প্রতিশ্রুতি যেন মাটির পুতুল, ভেঙে গুঁড়ো
স্বপ্নচূড়া থেকে তুমি অনিচ্ছুক বাস্তবের কঠিন কংক্রিটে!
ক্রুর হাসি হাসে আজ বিরুদ্ধ সময়
শঙ্কাবিদ্ধ, ধরে আছ তবু সেই উজ্জ্বল দিনের প্রতিশ্রুতি!
হঠাৎ ফুরালো দিন, যেন ভর দুপুরেই নির্মম গোধূলি!
বিপন্নতা ঢেকে দিচ্ছে আলো-সম্ভাবনা।
কী আশায় বসে আছ এমন নির্মম দুঃসময়ে,
কার পথ চেয়ে!
নৈঃশব্দ্যের এই ঘোর তমসা পেরিয়ে যাও মানুষের কাছে
সেখানেই আলো। পাতা ঝরে তীব্র শীতে,
বসন্তে আবার সে-ই পত্রপুষ্পময়
মানুষ দুর্যোগ পার হয়ে যায় সংযমের শক্তি সঙ্গী করে।
আগামীর জন্য থাক আমাদেরও অস্থিমজ্জাময় সেই সাধ
হয়তো প্রত্যয়ী এই সবুজ নিসর্গ থেকে পেয়ে যেতে পারো
সেই সূর্য-সম্ভাবনা : মানুষের কাছে চলো,
প্রকৃতির কাছে।
— — —
শেকড়-কথা
তুমি ভুলে গেছো আপন শেকড়-কথা!
ইতিহাস আর ভূগোলের সীমা ছেড়ে
নতুন ঠিকানা যতই খোঁজো না কেন
কী করে মুছবে ? সত্তা পরম্পরা।
বাস্তব যদি না-ই মেনে নিতে পারো
পরাবাস্তব আঁকবে কী করে তবে ?
শিকড়ে যদি না স্থিত থাকে গাছপালা
পত্রালি আর আলো-ছায়া তার থাকে!
অনার্য তুমি আর্যের বেশ ধরে
বেশ মেতে আছো পশ্চিমা মজমাতে
উল্লম্ফনে খুঁজছ নতুন সুর
অথচ রক্তে ভাটিয়ালি সুর ধরা!
এই ভুল ভেঙে মাইকেলও ফিরেছেন
ফিরবে তুমিও, তবে খুব দীনহীন!
— — —
পুরনো কবর
পুরনো কবর যেন বিখ্যাত লোকের
দেখো কী চরম অবহেলা নিয়ে পড়ে আছে
সাড়াশব্দহীন!
বিখ্যাত জীবিতকালে স্তুতিবাক্যে মুগ্ধ সারাক্ষণ!
অথচ কবর তার…
ঘটে যাচ্ছে কত কাণ্ড চারপাশে প্রতিদিন কত কোলাহল!
পঞ্চাশ বছর পরে আর
বলি না নবীন রাষ্ট্র, সুবর্ণ আলোয় উদ্ভাসিত!
মুক্তিযুদ্ধজয়ী সেই মিছিলের মুখ আমি কোথায় এখন!
নিসর্গ হননে মত্ত সভ্যতার আস্ফালনে
এই যে সোনার বাংলা কাঁপে!
আমি তার ব্যথিত দর্শক―
আমার কবর ওরা রচনা করেছে সেই মূর্খ আস্ফালনে, অক্ষম প্রতিভা জ্যান্ত শায়িত কবরে!
দুর্বৃত্তরা বসে আছে অমর আসনে!
রাষ্ট্র জুড়ে প্রেতনৃত্য―নিরীহ দর্শক শুধু দেখি,
নির্বিকার ? নাকি মৃতচোখে বসে কালো জম-মাছি!
চারদিকে অস্থিরতা চরম গুঞ্জন যেন বিশাল হাটের,
বহুদূর থেকে ভেসে আসে সেই আর্তনাদ ভয়াল কোরাস!
কোথাও দেখি না সেই রক্তাপ্লুত যুবকেরা সম্মিলিত ক্রোধে
মৃত্যু-ভীতিহীন পথে দুঃসময়ে অন্ধকার কোথাও তাড়াতে!
স্বার্থে আত্মমগ্ন দেশে কোথায় মুজিব-সেনা ভাইয়েরা আমার
একাত্তর যেন আজ সুতাছেঁড়া ঘুড়ি শুধু শূন্যে গোত্তা খাওয়া।
— — —
কল্পনা
ইঁদুর ও বিড়ালের আহা কী যে সখ্য
ঝগড়া-বিবাদ নেই―শান্তিই লক্ষ্য!
হাড়ি থেকে ভাজা মাছ তুলে এনে দুজনে
ভাগ করে শান্তিতে খায় যেন সুজনে!
ইঁদুরের ছানা খেলে বিড়ালের কোলেতে!
আহা কী যে মিলমিশ যেন মাছে-ঝোলেতে
সুস্বাদু মিশে আছে ওরা একই ভাণ্ডে!
এমন ভাবতে চাই সারাটা ব্রহ্মাণ্ডে।
দেখি শুধু শান্তিই, আহা কী প্রশান্তি
ভালোবেসে ও মানুষ যদি তুই জানতি
সাপ আর বেজিকেও রেখে একই গর্তে
শান্তিতে থাকা যেত ভালোবাসা-শর্তে!
— — —
অন্ধকারের নিচেই
মানুষের চোখে ফুটুক সবুজ মুছে যাক ধূসরতা অবিশ্বাসের কুয়াশা ছিন্ন করে
ফুটুক আবার সেই বিশ্বাস, সেই সূর্যের আলো
সূর্যমুখীর প্রতীক যেখানে স্বপ্নের কথা বলে।
বিহ্বলতায় ভাঙছে পাঁজর, আবেগ তুচ্ছ করে
বস্তুবাদের উগ্রতা আজ পণ্যের হাট করছে শাসন
মানুষের মনে দুর্যোগ যেন ভাঙছে কেবল খরস্রোতা ঢেউ
পরিত্রাণের আসবে না কেউ।
তুমিই তোমার ত্রাতা হয়ে যাও তবে।
মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছে হাজার হাজার তরুণ একাত্তরের ভয়াবহ সেই দুঃসময়ের ছবি চোখে আনো
কীভাবে মানুষ বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছে এবং
এনেছে বিজয় মানবিকতার, মহামুক্তির!
দীর্ঘশ্বাসে দীর্ণ কোরো না নিজেকে মানব!
মানবে-দানবের যুদ্ধ হয়েছে বারবার এই পৃথিবীর বুকে
রক্তে তোমার আলোর মুদ্রা ঢেউ তুলে যাক সেই প্রেরণায়
কান পেতে শোনো সশস্ত্র সেই সময়ের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত।
জলের ভেতরে ভাসমান তুমি, তৃষ্ণা তবু তো ছাড়ছে না পিছু!
হাহাকার তবু না থাক তোমার,
অন্ধকারের নিচেই সোনালি রোদের সকাল।
— — —
আনন্দের গ্লানি
সেই তৃষ্ণা সিদ্ধ নয়, তবু জেগেছিল, যেন জেনেশুনে বিষ
জীবনে একবারই সেই অজ্ঞাতে করেছি পান নিষিদ্ধ হেমলক!
অবিনাশী সেই স্মৃতি মৃত্যুর অধিক তীব্র দংশনে এখনও অহর্নিশ
অনিচ্ছুক পান করি সেই বিষ, মৃত্যু কই? যন্ত্রণাই গিলি ঢক ঢক।
রাত্রির পৃথিবী ছিল ঘুমের অতলে ডুবে হিম
সারা রাত ঘরময় পায়চারি করে তৃষ্ণা বিনিদ্র সৌরভ
আদম ও ইভ কবে নিষিদ্ধ গন্ধমে মুগ্ধ তৃষ্ণায় আদিম
সে স্মৃতি কি টেনেছিল আমাদেরও মনে মনে নৈঃশব্দ্যে নীরব!
যেন পান করে কোন চরম নেশার বস্তু হুঁশ জ্ঞানহীন
নিষিদ্ধ সাগরে ঝাঁপ দিয়ে হলো স্বেচ্ছামৃত্যু সমাধি-সলিল।
সেই দুঃস্বপ্নের মত ভয় ও আনন্দ ভোলা যায় কোনওদিন!
তৃষ্ণার আগুনে পোড়ে রাত্রির জ্যোৎস্নাসহ নীরব নিখিল।
কে কাকে করব দায়ী! সেই লজ্জা বয়ে আমরণ
নীরব দহনে পুড়ে যেতে হবে দীর্ঘ পথ আত্ম-গ্লানিময়
তাকাতে পারিনি আর ওই সৌন্দর্যের দিকে, লজ্জায় মরণ
হয়েছে মৃত্যুর আগে, আজও কাটে নাই সেই ভয়!
দুটি প্রাণি ছাড়া সেই ঝড়ের রাতের সাক্ষ্য ছিল না তা জানি
আদম ও ইভ যেন বয়ে যাচ্ছে আজও সেই আনন্দের গ্লানি।
— — —
না জেনে না বুঝে
অপার কষ্টের কাছে সমর্পিত হয়েছো জীবন
বোঝা না-বোঝার এক ঘোরের ভিতর দিয়ে
যেখানে এসেছো, সে তো দয়ামায়াহীন এক রুক্ষ জনপদ!
মানুষ নিজেই বুঝি এভাবে রচনা করে আত্মঘাতী বিষ!
সেই বিষে নীল হয়ে যখন বিপন্ন প্রাণবায়ু
পেছনে তাকিয়ে দেখে মর্মর পাথর যেন আশ্চর্য উজ্জ্বল ভুলগুলি,
সংশোধন করা আর যায় না তখন।
পবিত্র অশ্রুর মতো এক ফোঁটা জল
কপোল গড়িয়ে আসে ঠোঁটের কিনারে,
স্মৃতির ভিতরে আসে অদ্ভুত দিনের গন্ধ, যেন
ঝরাফুল কোনওদিন উদ্যানে যাবে না ফিরে আর!
নিয়তিতাড়িত বলে লোকে
আমি দেখি দিব্যচোখে মানুষেরই অজ্ঞতার নির্মম শৃঙ্খল
কেড়ে নেয় আনন্দের যত উপাচার স্বাধীনতা,
স্বেচ্ছায় দুঃখের খাঁচা বুনে যায় পরাধীনতার।
সুস্বাদু মাছেরও কাঁটা তুচ্ছ খুব, ডাস্টবিনেই ঠাঁই
সেই মাছ তুমি আজ উচ্ছিষ্ট কাটার সমাহার!
— — —
গোলাপেরও কাঁটা থাকে
গোলাপেরও কাটা থাকে, তবু সৌরভের তীব্র
আকর্ষণ সেই লাল―শিল্পের ভুবনে যাকে ডাকে
সে-ই শুধু বোঝে কেন মধুর যন্ত্রণা নিতে সাপুড়িয়া খোঁজে
নীল ফণা-ফণীমনসার বন!
সারাটা জীবন এই কাঁটার যন্ত্রণা খোঁজে বিনিময়হীন
রবীন্দ্র-দর্শনে মগ্ন কবির হৃদয় চায় নীল
যন্ত্রণার বিনিময়ে মানবিক ভালোবাসা, তৃপ্তির জোয়ার!
দর্পণে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নার্সিসাস-আক্রান্ত স্বয়ং!
অথচ তৃষ্ণায় দীর্ণ রক্তাক্ত হৃদয় তার জল
কোথাও পায় না আর কোথায় বিশ্বাস!
এইভাবে বিশ্বাসের বিপরীতে চলে যায় নিজেরই অজান্তে!
স্নায়ুর তরঙ্গে ভাসে বিশ্বাসের শব্দমালা তীব্র অনুরাগে।
কে জানে রহস্য এর ? শিল্প জানে আর জানে রক্তাক্ত মননও।
ভালোবাসা বৈরী স্রোতে চিরদিন কবিতার উজানেই চলে।
লোবান নিজে পোড়ে, গন্ধ নয় অনুরক্ত শৈল্পিক হৃদয়।
বাসন্তী রাতের হাওয়া ছড়ায় লোবান আর শাদা পুষ্পঘ্রাণ।
শানবাঁধা ঘাটে জলে বিম্বিত স্তনের লাবণ্যে ভরাচাঁদ
পূর্ণিমার ঢেউ যেন সৌন্দর্যের বাতাসে হাপুস!
জানি এই চিরসত্য শিল্পেই পূর্ণতা পায় অপূর্ণের প্রাণ!
না হয় আপনিও সেই শিল্পের সাধনমন্ত্রে উজ্জীবিত বোধে
ইথাকা গন্তব্য জেনে সঙ্গী করে নিলেন আমাকে সেই চিরতৃষ্ণা-জলে!
— — —
আসছো তা হলে তুমি!
এই নির্দয় শহরে তুমি নেই। যেন তুমি হারানো কৈশোর!
হারিয়ে ফেলার পরে এখনও কাটেনি দুঃখঘোর।
আশ্চর্য সুন্দর শান্ত গ্রামের প্রতিমা তুমি মমতার সবুজ পত্রালি
আসছো আবার, তাই আনন্দ হৃদয়জুড়ে দিচ্ছে করতালি!
আসছো সবুজ নিয়ে,আসছো মধুরতম কৈশোরকে নিয়ে
আবার স্বপ্নের মতো স্বপ্নকে সাজিয়ে, দিও পুতুলের বিয়ে।
বিষণ্ন শীতের শেষে যেন তুমি পুষ্পময়ী বসন্তের রানি!
আসছো আবার ফিরে মুছে দিতে পাতাঝরা দগ্ধদিন-গ্লানি।
বর্ষার অঝোর ধারা ঝরবে চৈত্রের ফাটা খরাদগ্ধ মাঠে
আবার উর্বর পলি শস্যময়ী হবে মাঠ―কৃষকের দিন কাটে
কেবল তোমারই প্রতীক্ষায়।
তুমিই প্রকৃতি, যেন পরম তৃপ্তির গান,
রবীন্দ্রনাথের মতো বাহির গভীর করে ভিতরকে দিয়ে গেছে টান!
দূর পথিকের কানে কাক্সিক্ষত গানের সুধা ঢেলে
আসছো স্বপ্নের চেয়ে উজ্জ্বল জোৎস্নার চাঁদ সম্ভাবনা জ্বেলে ?
ভেসে যাবে চরাচর জ্যোৎস্নার প্লাবনে এক স্বর্গীয় আবহে
আসছো বসন্ত হয়ে ? না হলে দখিন হাওয়া কেন বুকে বহে!
তুমিই আসছো ? নাকি আমিই তোমার দিকে দ্রুত যাচ্ছি চলে ?
প্রতীক্ষার মোম দেখো বুকের ভেতরে কী যে দ্রুত লয়ে গলে!
— — —
সচিত্রকরণ : রজত