অনুবাদ গল্পআর্কাইভ

অনুবাদ গল্প : কুকুরটি : মূল : জে এম কোয়েতজি

বাংলা অনুবাদ : সম্পদ বড়ুয়া

[জে এম কোয়েতজি : ঔপন্যাসিক, অনুবাদক, শিক্ষাবিদ জন ম্যাক্সওয়েল কোয়েতজির জন্ম ১৯৪০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউন শহরে। সেখানে তাঁর স্কুলজীবন কেটেছে। কেপটাউন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি আর গণিতশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন। অস্টিন-এর টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেনফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন।

তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস―In the Heart of the Country (1977), Waiting for the Barbarians (1980), Foe (1986), Disgrace (1999), The pole (1922)। তিনি আত্মজীবনীমূলক রচনাও লিখেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে তাঁর প্রচুর প্রবন্ধ আছে।

২০০৩ সালে কোয়েতজি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। তিনি ১৯৮৩ সালে এবং ১৯৯৯ সালে দুবার বুকার পুরস্কার লাভ করেন। ‘কুকুরটি’ তাঁর The Dog গল্পের বাংলা অনুবাদ।]

বাড়ির সদর দরজায় লেখা আছে ‘কুকুর থেকে সাবধান’। কুকুরটি নিশ্চয়ই বদ। যতবারই মেয়েটা ঐ সদর দরজা অতিক্রম করে, প্রাণিটা নিজে নিজেই দরজার কাছে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে; চিৎকার করে ওঠে এই বাসনা নিয়ে যদি ওকে ধরতে পারে তাহলে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। এটা একটা বড় আকৃতির কুকুর, ভয়ানক কুকুর―অনেকটা জার্মান শেফার্ড বা রটওয়েনার ধরনের প্রাণি (কুকুরের জাত সম্পর্কে মেয়েটা কমই জানে)। সে বুঝতে পারে কুকুরটার হলদে চোখ থেকে সবচেয়ে নিখাদ ঘৃণা তার ওপর ঠিকরে পড়ছে।

‘কুকুর থেকে সাবধান’ লেখা বাড়িটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলে―মেয়েটা সেই ঘৃণার বিষয়টি নিয়ে পূর্বাপর ভাবতে থাকে। সে জানে এটা প্রাণিটার কোনও ব্যক্তিগত আচরণ নয়, যে কেউ যখনই সদর দরজার কাছাকাছি আসবে, হেঁটে বা সাইকেলে পার হবে, তাকেই এমন আচরণের সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু এ ঘটনা তার এত গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে কেন ? এটা কি একটা বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো কোনও কিছুকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে স্যুইচ টিপে চালু করে দেওয়া আর ঐ বস্তুটা যদি পিছিয়ে এক কোনায় চলে যায় তাহলে সুইচ টিপে বন্ধ করার বিষয় ? কুকুরটা যখন আবার একাকী হয়ে যায় তখন এই ঘৃণার আকস্মিক বিস্ফোরণ কি প্রাণিটাকে ঝাঁকুনি দিতে থাকে ? কিংবা তার উন্মত্ততা কি হঠাৎ প্রশমিত হয়ে যায় ? ওটা কি আবার প্রশান্তির অবস্থানে ফিরে আসে ?

সপ্তাহের প্রতিটি কর্মদিবসে দুবার মেয়েটি সাইকেল চালিয়ে বাড়িটা অতিক্রম করে। যে হাসপাতালে সে কাজ করে সেখানে যায় এবং কাজের পালা শেষ হলে ফিরে আসে। যেহেতু তার এই গমনাগমন অনেকটা নির্ধারিত তাই কুকুরটাও জানে কখন সে আসবে। তাকে দূর থেকে দেখার আগেই সে সদর দরজার কাছে চলে আসে, প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে হাঁফাতে থাকে। বাড়িটা একটু আঁকা বাঁকা উঁচু জায়গায়, তাই সকালবেলায় মেয়েটাকে সাইকেল চালিয়ে একটু উপরে উঠতে হয় বলে যাত্রাটা একটু ধীর গতি পায়। আর বিকেলে, শোকরানাই বলতে হবে, সে দ্রুত সাইকেল নিয়ে চলে আসতে পারে। কুকুর-প্রজনন বা তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে সে কিছুই জানে না, তবে তার সঙ্গে প্রাণীটার মুখোমুখি হলে ওটা কী পরিমাণ পরিতৃপ্তি পায় সে সম্পর্কে তার ভালো ধারণা হয়ে গেছে। এ পরিতৃপ্তির অর্থ হচ্ছে মেয়েটার ওপর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রদর্শন আর সে যেন তাকে ভয় পায়।

যতটুকু লক্ষ করেছে তাতে মেয়েটার মনে হয়েছে কুকুরটা  পুরুষ প্রজাতির। সে যে একজন মহিলা―কুকুরটা সেটা জানে কিনা, কিংবা একজন মানুষ দুটো লিঙ্গের কোনও একটি যে হবে সেটা জন্তুটার চোখে ধরা পড়েছে কিনা, আবার কুকুরের মধ্যে যে নারী পুরুষ উভয় লিঙ্গ আছে সে কারণে প্রাণিটি একই সঙ্গে দু ধরনের সন্তুষ্টি অনুভব করছে কিনা অর্থাৎ একটা জন্তু আর একটা জন্তুর ওপর আধিপত্য বিস্তারে আনন্দ পায় কিনা অথবা একজন পুরুষ জন্তু একজন মহিলার ওপর ক্ষমতা প্রদর্শন করে কিনা এসব বিষয়ে মেয়েটির কোনও ধারণা নেই।

কুকুরটার প্রতি মেয়েটার তাচ্ছিল্য ভাব সত্ত্বেও এ প্রাণিটা কীভাবে জানল তাকে দেখে ও ভয় পাচ্ছে ? এর উত্তর হতে পারে―মেয়েটা ভয়ের ঘ্রাণ লুকাতে পারছে না বলে তা নিঃসরণ করছে। প্রতিবার যখনই কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে তার দিকে তেড়ে আসে, একটা কনকনে ঠান্ডা তার শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে চলে আর শরীর থেকে একটা রোমাঞ্চকর গন্ধ বেরিয়ে আসে যা কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে তুলে নেয়। সদর দরজার অন্য প্রান্তে থাকা কোনও মানবী থেকে ভয়ের এক ঝলক গন্ধ হাওয়া ভেসে এলে তা জন্তুটাকে ক্রোধের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যায়।

কুকুরটা জানে মেয়েটা তাকে দেখে ভয় পাচ্ছে। দিনে দু বার সে পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটা সারা পথে ভয়ে ভয়ে থাকে, এ ভয় সে লুকাতে পারে না। কুক্কুরী যেভাবে যৌনতার গন্ধ নিঃসরণ করে, মেয়েটা তেমনি এই ভয়ের ঘ্রাণটা উদ্গিরণ করতে থাকে।

অগাস্টিন নিয়ে পড়াশোনা করেছে মেয়েটা। অগাস্টিন বলেন, এটা পরিষ্কার যে আমরা একেবারে নিঃশেষ হয়ে গেছি। কারণ আমরা নিজেদের শরীরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। বিশেষ করে একজন মানুষ তার পুরুষত্বের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে অসমর্থ। অবাধ্য অঙ্গটি এমন সব আচরণ করে যেন ওটা নিজের খেয়ালখুশি মতো চলার ক্ষমতা রাখে; সম্ভবত এটা এমনও কাণ্ড করে বসে যেন মনে হয় বাইরের কোনও ইচ্ছাশক্তি ওটাকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

মেয়েটা পাহাড়ের পায়ের কাছে যখন পৌঁছে তখন সে অগাস্টিনের কথা ভাবতে থাকে। বাড়িটা এই পাহাড়ের ওপর। এ বাড়িতেই কুকুরটা থাকে। এবার কি মেয়েটা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে ? এবার কি তার সেই ইচ্ছাশক্তি থাকবে যার সাহায্যে ভয়ের সেই অপমানজনক ঘ্রাণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে ? প্রতিবারই সে কুকুরটির গলার গভীর ঘেউ ঘেউ শব্দ শুনতে পায় যা প্রচণ্ড ক্রোধ বা লালসাময় ক্রুদ্ধ অভিযোগের মতো মনে হয়; প্রতিবারই সে সদর দরজার সামনে তার শরীরের ধুপ ধুপ শব্দ টের পায়। এবার সে এর উত্তর খুঁজে পেয়েছে; না, আজ নয়।

চারদিকে বেষ্টনী দেওয়া একটা বাগানের ভেতর ‘কুকুর থেকে সাবধান’ লেখাটা রয়েছে যেখানের ঘাস ছাড়া অন্য কিছু জন্মায় না। একদিন মেয়েটা বাইসাইকেল থেকে নেমে ওটাকে বাড়ির দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখল; দরজায় কড়া নাড়ল, তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। তার থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে কুকুরটা পেছনের দিকে সরে গিয়ে বেষ্টনীর কাছে সজোরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তখন সকাল আটটা হবে। এ সময় লোকজনের দরজায় কড়া নাড়ার স্বাভাবিক সময় নয়। সে যাই হোক, একটু ফাঁক করে দরজাটা খুলল। ভেতরের মৃদু আলোয় মেয়েটা টের পেল একটা মুখ দেখা যাচ্ছে, একজন বয়স্ক মহিলার রোগা পাণ্ডুর মুখের মতো আর মাথায় শিথিল ধূসর চুল। ‘সুপ্রভাত’ মেয়েটি তার মোটামুটি চলনসই ফরাসি উচ্চারণে বলল, ‘আমি কি আপনার সঙ্গে একটুক্ষণ কথা বলতে পারি ?’

দরজাটা এবার আরও প্রশস্ত হয়ে খুলল। সে ভেতরে পা রাখল। হালকা আসবাবপত্রে ছড়ানো রুমে লাল কার্ডিগান পরা একজন বৃদ্ধ লোক টেবিলের সামনে একটা গোলাকার বাটি নিয়ে বসে আছে। মেয়েটা তাকে শুভেচ্ছা জানাল। লোকটা মাথা নাড়ল তবে আসন থেকে উঠল না।

‘এত সকালে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত,’ মেয়েটা বলে, ‘আমি দিনে দুবার সাইকেল চড়ে আপনাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করি এবং প্রতিবারই, আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন, আপনাদের কুকুরটা আমাকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য অপেক্ষা করে।’

চারদিকে সুনসান নীরবতা নেমে আসে।

‘কয়েক মাস ধরেই এটা চলছে। আমি অবাক হচ্ছি এটার একটা পরিবর্তনের এখনও কি সময় আসেনি ? আপনারা কি কুকুরটার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য তৈরি আছেন যাতে সে আমার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, সে বুঝতে পারে আমি কোনও শত্রু নই, অর্থাৎ আমার দ্বারা কোনও ক্ষতি হবে না।’

বৃদ্ধ দম্পতি নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল। ঘরের মধ্যে বাতাস আটকে আছে; মনে হচ্ছে অনেক দিন জানালা খোলা হয়নি।

‘এটা একটা ভালো কুকুর’ বৃদ্ধা মহিলা বলল, ‘এটা গার্ড ডগ’―পাহারাদার কুকুর।’

 মহিলার কথায় মেয়েটা বুঝে গেছে কুকুরটার ব্যাপারে তারা কোনও কিছু বলবে না, পাহারাদার কুকুরটার সঙ্গে কোনও পরিচয়ও করাবে না। কারণ মহিলার কাছে মেয়েটা শত্রু হিসেবে বিবেচিত হওয়াই ভালো, শত্রু হিসেবেই সে থাকুক।

‘প্রতিবার যখন আমি আপনাদের বাড়ি অতিক্রম করি, কুকুরটা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে’, মেয়েটা বলে, ‘আমার বলতে কোনও দ্বিধা নেই, আমাকে ঘৃণা করা প্রাণিটা তার দায়িত্ব হিসেবে দেখছে। কিন্তু আমার প্রতি তার এই ঘৃণা প্রদর্শনে আমি খুব মর্মাহত হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি, ভয়ে আতঙ্কিত হয়েছি। প্রতিবার এ বাড়ি পার হবার সময় এটা আমার জন্য একটা অপমানজনক অভিজ্ঞতা। এভাবে ভয় পেয়ে আতঙ্কিত হওয়াটা সত্যিই অপমানজনক ব্যাপার যা আমি প্রতিহত করতে পারছি না। এ ভীতিটাকে একেবারে বন্ধও করতে পারছি না।’

বৃদ্ধ দম্পতি তার দিকে নির্দয়ের মতো তাকিয়ে থাকে।

‘এটা একটা সাধারণ জনগণের চলার পথ,’ মেয়েটা বলতে থাকে, ‘আমার অধিকার আছে একটা সাধারণের চলাচলের রাস্তায় নির্ভীকভাবে চলাফেরা করতে, অপমানিত না হতে। আপনারা আপনাদের ক্ষমতা দিয়ে বিষয়টি সমাধান করতে পারেন।’

‘এটা আমাদের রাস্তা’, বৃদ্ধা মহিলা বলে, ‘আমরা এখানে আপনাকে আমন্ত্রণ জানাইনি। আপনি অন্য রাস্তা বেছে নিতে পারেন।’

এবার বৃদ্ধ লোকটা প্রথমবারের মতো কথা বলতে শুরু করে, ‘আপনি কে ? কোন অধিকারে আপনি এখানে এসেছেন আর বলছেন আমাদের কী কী করতে হবে ?’

মেয়েটা এ কথার উত্তর দেবার জন্য তৈরি ছিল, কিন্তু তার ইচ্ছে হয়নি। ‘যান’, লোকটা বলে, ‘যান, যান, যান।’

বুড়া লোকটার গায়ে পশমের কার্ডিগানের হাতাটা খুুলে যাচ্ছে যখন সে মেয়েটাকে চলে যাবার জন্য বার বার হাত নাড়ছিল, কফির বাটিতেও সেটার চিহ্নরেখা ফুটে উঠেছে। মেয়েটা বৃদ্ধের এহেন আচরণের বিরুদ্ধে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলার চিন্তা করেও শেষে বিরত থাকল। কোনও কথা না বলে সে ফিরে আসে, তার পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যায়। কুকুরটা সীমানার বেষ্টনীর পাশে নিজে নিজেই সজোরে লাফ-ঝাঁপ করতে থাকে। ‘একদিন’, কুকুরটা যেন বলছে, ‘এই বেষ্টনীটাই আমাকে পথ দেখাবে, একদিন আমি তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলব।’

মেয়েটা যতটুকু সম্ভব শান্ত হয়ে থাকে। সে কাঁপছে, যদিও সে অনুভব করছে ভয়ের তরঙ্গায়িত বোধ তার শরীর থেকে বাতাসে স্পন্দিত হচ্ছে, কুকুরটার সামনে এসে এবার সে মানবিক শব্দ উচ্চারণ করতে থাকে, ‘অভিশাপ দিচ্ছি, তুই নরকে যা।’ তারপর সে বাইসাইকেলে চড়ে উচুঁ পাহাড়ের দিকে চলে যায়।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button