আর্কাইভকবিতা

কবিতা

হাসান হাফিজ

কালো কফি-৫

কফি তো কালোই হবে। হয়।

মৃত্যু যে রকম।

কিছুটা বিস্বাদও বটে। সুমিষ্ট সে নয়।

চুমুুকে সায়াহ্নতৃষা, পিছলানোর ভয়।

জীবন, তাহলে তুমি পিচ্ছিলতা

অতিরেক অন্য কিছু নও—

অনেক হয়েছে বাছা, এইবার চুপেচাপে

সাবালক হও।

কফিতে ওষ্ঠের ছোঁয়া অধিষ্ঠান

যে রকমটা নারীর হৃদয়

জীবন-মৃত্যুর দ্বন্দ্ব দোলাচলে

কখন হারিয়ে ফেলি

মাথা তোলে সুপ্তি ও সংশয়।


রেহমান সিদ্দিক

ভুল হয়ে যায়

অনেক কিছুই ভুল হয়ে যায়

অঙ্ক খাতায় ভীষণ রকম কাটাকুটি

যা লিখি তাই ভুলে ভরা

আর কতকাল থাকব বলো কান ধরে এই বেঞ্চের ওপর ঠায় দাঁড়িয়ে

অনেক কিছুই ভাবছি বেশি

অনেক কিছু একদমই না

ভাবতে হবে, ভাবতে হবে

এই দেখো না, গত রাতে ওষুধ খেতেই ভুলে গেলাম

তাই তো দেখি আজকে আমার ঘুরছে মাথা

না কি আমি অনন্তকাল ভুলের ঘোরে ঘুরছি কেবল ?

ক্ষমা করো আদিম মানব পূর্বপুরুষ রক্তধারা

সাগর মাটি আলো বাতাস সূর্য এবং চন্দ্র তারা

ষড়ঋতু ফসলি-সাল হালের বলদ লাঙল-জোয়াল

কালের বৃক্ষ ডালের কোকিল ময়না টিয়ে ক্ষমা করো

ঋণের বোঝা বইতে আমি আর পারি না, আর পারি না

আজকাল আমার অনেক কিছুই ভুল হয়ে যায়

ভুল হয়ে যায়, ভুল হয়ে যায়, ভুল হয়ে যায়


মঈনউদ্দিন মুনশী

সূর্যকন্যা 

(পূর্ণ গ্রহণের সময়)

ঈশ্বর সূর্যকন্যাকে ধরে আছে তাঁর গোড়ালিতে 

তাঁকে ঝুলিয়ে রেখেছে মেঘে 

সে মৃগ শিশুর মত

তাঁর মুঠোয় মোচড়ানো

টান করে বাঁধা, পেঁচানো ঘন গাছের সাথে।  

সূর্যকন্যা আমার কাছে এসেছে অরণ্য থেকে।  

যখন সে পড়ে যাচ্ছিল তাঁকে ধরেছিলাম

দেবদারুর সারির ভিতর থেকে

বিষণ্ন জ¦রাক্রান্ত করতলে।  

গোধূলি স্থিরীকৃত, যেন কুয়াশা আমাদের গোড়ালির চারপাশে

ঈশ্বর ছুড়ে দিলে আমি তাঁকে ধরলাম

একটা দরজা খুলে গেলো অরণ্যের ছাদে

সে সহজেই এটা একপাশে ঠেলে দিল

তাঁর সুডৌল বাহু এবং পিঙ্গল কুঞ্চিত কুন্তল

এখনও মেঘে ভেজা

দরজা তরঙ্গায়িত, যেন বাতাসে দুলছে একটা তামাটে তেরপল, 

সে ঘোরাফেরা করল সেখানে এক মুহূর্ত

যখন তাঁর ডানা দুর্বল হয়ে পড়ে গেল

আমি প্রিয় সম্বোধনে তাঁকে ধরলাম

আমরা দাঁড়িয়ে এখন

অন্ধকার ঢেকে আছে আমাদের চিবুক অবধি

তাঁকে কাঁধে বসিয়ে

আমি জলের মধ্যে হাঁটছি অরণ্য রাত্রির ভিতরে

নক্ষত্র আলোয় দৃষ্টি রেখে।


কুমকুম দত্ত

নিঃসঙ্গ জার্নাল

এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। এবার যেতে চাই

ফিরতি কোনও ট্রেনে। সবুজের গ্রাম, নদীতে

ছিপছিপে নৌকা।

কাশবন ধারে, ছুটোছুটি রঙিন প্রজাপতি।

আজকাল আমার ভিতর নিঃসঙ্গ এক

মানুষের পরম বসবাস।

মানুষের ভেতর কি অন্য মানুষ থাকে ?

দখিনের খোলা জানালা। জোস্নায় অবগাহন শেষে

পূর্ণিমা রাত অঝোর। এরকম ভরা পূর্ণিমায়

বুকের বোতাম খুলে আসে কেউ পাশে দাঁড়িয়ে!

বরফমাখা শরীর। নিঃসঙ্গ পাথুরে দুটি চোখ।

চোখের সমুদ্রে ভাসমান এক অসমাপ্ত কবিতা…


লুৎফুল হোসেন

বেহতার কথা

আগুনের ব্যবসাটাই মোক্ষম

জ্বালাও পোড়াও ছাই ভস্ম ওড়াও

জলের উঠানে ছৈয়ের নিচেও আগুন

ম্যাচকাঠি কয়লা আর সইলতেয় দ্যাও

লকলকা শিখার নাচন ধুন্ধুমার ফাগুন

জ্বালাইতে সুখ যদি পোড়াইতে সঙ্গমানন্দ

য্যান সুখের ঠেলায় লহমায় লহমায় খুন

অসুখের লোবান সেও জ্বলছে—তয় নিরিবিলি

সুখের খ্যাতা তাই আগুনদা পোড়াইতে ভাল্লাগে

দাউ দাউ পুইড়া গেলে জ্বলন্তচিডায় সুখ বেশি জাগে

আমারে ছাই করতে পরানের সুখ তোমার

কলকলাইয়া ধুমার পাহাড় স্বর্গের আসমান

আগুনের হাউসে সয়লাব হয়া যায় সাত

জনমের সাধ আহ্লাদ—তার সুতীব্র শীৎকার

জানান দেয় কত সাধের সুখে আমি আছি ভাসমান


রনজু রাইম

বনদেবী

তন্নতন্ন করে খুঁজেছে তোমাকে মন

আজ সারাদিন লতাগুল্মের গহিনে

পাতার আড়ালে বর্ণচোরা প্রেম চিনে

নেব ঠিক, পড়া আছে বিভূতিভূষণ।

বলধা গার্ডেনে আজ প্রকৃতিবিলাস

রবীন্দ্রনাথের পদচ্ছাপ ফুটে আছে

সৃজনে মুদ্রণে, ক্যামেলিয়া আজও বাঁচে

কথারা কি জানে বৃক্ষদের পরিহাস।

ভূতনাগ ছুড়ে কটুগন্ধের বল্লম

গাছেদের কাছে কবিতারা পায় দম।


আনোয়ার কামাল

রিসেট বাটন

গত রাতে আমি আমার রিসেট বাটনে চাপ দিয়েছি

তোমার সব স্মৃতি আমার হার্ডডিক্স থেকে মুছে দিতে

তোমার হাতের স্পর্শ, টোলপড়া গাল, গোপন তিল

আমাদের লেপ্টে থাকা চুম্বনগুলো মুছে দিতে চাই।

তোমার বৃষ্টিভেজা শরীরের গন্ধ, ঠোঁটের লিপিস্টিক

এমন কি শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে লেগে থাকা হ্যাভোক

পারফিউমের মাদকতা—

সব… সব… সবকিছু মুছে ফেলতে চাই।

গত রাতে আমি রিসেট বাটনে চাপ দিয়েছি

তোমার আমার অতীত সবকিছু মুছে ফেলতে চেয়েছি—

ওমা! একি কিছুই মুছে ফেলতে পারিনি—

সেই হাতে হাত ধরা—ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা

চুম্বনের রেশ, হ্যাভকের মদিরতা—

শরীরের সুবাস এখনও ছড়িয়ে আছে।

বারবার রিসেট বাটনে চাপ দিয়েছি—

শত চেষ্টা করেও মুছে ফেলতে পারিনি

আমাদের ভালোবাসার স্মৃতির সেলুলয়েডে

রঙিন চিত্রগুলো—জ¦লজ¦লে আলো ছড়িয়ে

আরও উজ্জ্বল হয়েছে।

মুছে ফেলতে পারিনি—

একটুও মুছে ফেলা যায়নি।


শামীম রফিক

ব্যর্থতা

ভালোবাসবার জন্য যে রকম নিষ্ঠুর যুক্তি থাকতে হয় বা যে রকম স্বার্থপর থাকতে হয় স্বপ্নে ও সাধনায়-তোমার সে রকম ছিল কি-না তাতে আজ দ্বিধান্বিত। বিচিত্র কথায় তুমি বিচিত্রভাবে পাল্টে যেতে। ফেরাতে ফেরাতে আমি বড্ড ক্লান্ত ও বিমর্ষ। তাই মাটিকে মননে মিশিয়ে সৃষ্টি করতে হয় গৌড়বর্ণ সময়। ছোপ ছোপ করে ওঠে জল, বেদনার শরাবে কাটাই আনত সময়।

তবু ধ্বংস হয়েছে বলে-মনের শেকড় পুড়ি আমি চোখের বিশ্বস্ত আগুনে। কবি বলেই, ক্ষণে ক্ষণে জন্মায় উড়বার ডানা, অত্যাসন্ন স্বপ্নের মতো মগজের অন্তরালে মগজ-বেহুঁশ ফণিমনসা, আর বপন করি ধৈর্য্যরে ফসল। আবদ্ধতা থেকে নিষ্কৃতি নেই জেনেও, প্রত্যাখ্যান করি প্রত্যহ বিরহের মদদ-স্বপ্ন ও ভুলের বেতালে, ডানার সাথে বাড়তে থাকে প্রতিনিয়ত বেড়ে ওঠা নিঃসঙ্গতাগুলো-তারাও ভেংচি কাটে।

তুমি গণিতের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে প্রাত্যহিক জ্যোৎস্নাকেই আলিঙ্গন করো। তাতে যদিও ফিরে আসে পৃথিবীর সকাল দুপুর রাত। আর দুপুরের সুনসান নীরবতা পেরিয়ে দূরে কোথাও কোকিলের ডাক, কখনও ঘুঘু, মাছরাঙা, কখনও বা কাঠঠোকরা দাপিয়ে বেড়ায়। সামনে দিয়েই ক্রমাগত দৌঁড়ে বেড়ায় চঞ্চল কাঠবেড়ালি। অক্ষয় তবু স্মৃতি।

ভালোবাসার লোভে প্রত্যাখ্যাত ভালোবাসা তোমাকে দিয়েই অপ্রস্তুত হয়ে যাই। স্বীকৃতিহীন ভালোবাসার সকল উৎসব ম্লান হলে তারা কেবলি অর্থহীন হয়ে পড়ে। বার বার প্রবোধের ভুলগুলো-ভুলই থেকে যায়। সময় উর্বর হলেও আয়োজনগুলো ফিকে হয়ে যায় নিঃসঙ্গতায়। যাবার সময় হলে যেতে হবে, এ বুঝেও অনন্ততার আড়ালে ঢাকতে হয় মুখোশের রঙ আর অভিজ্ঞতার বেতাল মোড়াল।


সোহেল মাহবুব

শূন্যের নাচঘর

নাচঘরে রসনার নামে ভিজে যায় পায়ের আলতা।

এখানে গাঢ় রঙ ছিল সাদা সন্ধ্যার

এখানে উত্তপ্ত জলে সংসার সাজাত চড়ুই

এখন এখানে হরিণ মাংসের ঘ্রাণ শোঁকে…

স্ববিরোধী মিথ্যায় অমরত্ব পেতে চায় নাচের মুদ্রা

নূপুর ঝরে পড়ে পাথরে লুকানো দুপুর, চোখে জাগে রক্ত

সামান্য ওমে মাথা পাতার পর খিলখিলিয়ে হাসে তাজা রোদ্দুর।

ঠোঁটের বিছানায় সুস্পষ্ট কান্নার ইচ্ছারা দোলা দেয়

আহত ইন্দ্রিয়গুলো প্রথম স্মৃতির দিকে ধাপ দিতে চায়

কাঁটাতারের চরিত্রগুলো ঘিরে রেখেছে ঘুঙুরের চারপাশ

ছদ্মবেশে জড়ানো জটিল জীবন…

মুখোশ খুলে মাংসের দলাগুলো নেতিয়ে পড়ে

নাচঘরের বারান্দায়, ওঝা চলে গেছে ঝাড়বাতির আড়ালে।

কে জানত নর্তকী শতাব্দীর চকচকে ছুরির উপর রসনার আসর বসাবে?


মনসুর আহমেদ

নিষিদ্ধ কথাগুলো শব্দহীন

চোখের ভেতরের নিষিদ্ধ কথাগুলো

শব্দহীন স্রোতে ভেসে যায়

তোমার দিকে চেয়ে থাকা

শুধুই এক লুকানো বাসনা।

ঠোঁটে আগুন জ্বলে

যেন সেই অপ্রকাশিত অভিব্যক্তি

জ্বলে ওঠা আকাক্সক্ষার অগ্নিকণা

যা ছুঁতে চায় এক অনির্বচনীয় স্বপ্নকে।

চোখের ভাষা বোঝো না তুমি

কিন্তু শিহরণ জাগে বুকের গভীরে

নিষিদ্ধ কথাগুলো সুরের মতো বেজে ওঠে

নীরবতাই তখন আমাদের একমাত্র বাঁচার পথ।

তবু সেই আগুনের জ্বালা

অপ্রকাশিত কথার জ্যোতি হয়ে থাকে

চোখে চোখে হারিয়ে যাও

তোমার আর আমার অব্যক্ত যন্ত্রণায়।


ঋজু রেজওয়ান

শরতের দীর্ঘশ্বাস

হে, প্রকৃতি—ফুলেরও দীর্ঘশ্বাস

যেখানে-ই বাঁক নেয়, সেখানে-ই

আত্মা খোলে তার

শারদবিস্তারি মন;

মনের… পাপড়িগুলোয় মোড়ানো

নীরব মহিমা শরতে ফোঁটা দেয়!

যখন আমরা— প্রবেশক পৃথিবীকে

বুঝতে পারি না! তখনও অবিশ্বাসে

ছেড়ে যাচ্ছি না তো

ক্লাসিক জীবন!

সবাই সরলা সময়সীমার মধ্যেই—

জন্মগ্রহণ করছি—বিসর্জন মূলে।

এই শারদ প্রভাত—প্রতি অক্টেভ

লাল পাতা হয়ে নাচছে… ভেতরে

রিদমের নোটগুলি;

মনকে মনে করায়

ফোটানোকাশ; আর, ডাকপিওনের

অবসর স্টাম্পেরও প্রতিকলাধ্বনি।

গ্রীষ্মের উষ্ণতা—ও শীতের রোদ্দুর

যে হাওয়ায় চাঁদোয়ার ফিনিক্সরাত—

জেগে থাকে; তার

উষ্ণ প্রেমপত্রে

ক্ষণস্থায়ী চুম্বনের দিকে কার দীর্ঘস্থায়ী

অবিরাম প্রতিশ্রুত শরতের দীর্ঘশ্বাস ?

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button