আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : ফারুক মাহমুদ

হৃদয়ে রহো

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আমি তোমার মনে পড়ছি

এর থেকে ভালো কথা আপাতত নেই

আমার মনের মধ্যে তুমি এসে আসনটি পেতে

                                              স্থায়ী হয়ে থাকো

 দুজনের মন থেকে পালানোর যত পথ আছে

                                  ইচ্ছাকৃত ভুলে যেতে চাই

স্মৃতি আমাদের শান্তি দেবে

                            অন্নবস্ত্রবাসস্থান দেবে…

—————

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো)

কথা―এরাও যথেষ্ট বিদ্বেষ-প্রবণ!

কে কাকে পেছনে ফেলে পৌঁছে যাবে ব্যক্তিবিশেষের

প্রকাশভঙ্গির কাছে―এই নিয়ে কত প্রস্ত ঝড়!

আপনার পুণ্যপাশে বসে

বৃষ্টির উল্টাপৃষ্ঠার রোদ যেন―আমি কথা বলে যাচ্ছি

এদের কোনওটি কিন্তু আমার ‘মনের কথা’ নয়

যা যে কথা বলার জন্য অনেক প্রতীক্ষা আমি জমিয়ে রেখেছি

সবাই হয়েছে আজ অসফল প্রণয়ের ছাই…

মুহূর্তটা যেন―

নিজেই নিজের মধ্যে বন্ধ হয়ে থাকা

এই দুঃখ লাঘবের একটি পথ পাওয়া গেল

আপনার কাছে-ভিতে আমার হয়ে কটি ফুল যদি

             হেসে চেয়ে থাকে, খুব অযাচিত হবে ?

অপ্রয়োজনে, জলস্থানে আকাশের ছায়া নেমে আসে

এরা কিন্তু দুই হৃদয়ের

                           সাফল্য ও দূরত্বটা বোঝে!

—————–

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

অব্যাহত স্রোতরেখা ছিলে

                          হৃদয়ের সব জলাশয়ে

দেখি, এখন দুর্লভ পথ

ইচ্ছাস্থানে পৌঁছানোর মানচিত্রটি

                           চিরকাল ঝাপসা থেকে যায়

চাই―যার কাছে যেতে চাই

চাই―যাকে কাছে পেতে চাই

ইহজন্মে তাকে আর পাবে না হৃদয়

তুমি তোমার কাজের সাক্ষী

চাক্ষুষ দেখার প্রাপ্তি ধন্বন্তরি বটে

শুশ্রূষার সাফল্যের মতো

তোমার স্মৃতির পুঞ্জ জেগে আছে কবিতার শব্দকণিকায়

——————

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো) 

সান ইসিদ্রোর দিনগুলো…!  পরিণাম কী! ভেবে দেখিনি

কবি, তোমার কি মনে আছে, আমাদের ঘুমের ভেতর

কত শত জেগে থাকা ছিল! জাগরণে ছিল কত

অশেষ ঘুমের প্রীতি! পরাজয় মানে না হৃদয়

থোকা থোকা রাত্রিইচ্ছা, দিবাইচ্ছা শুধু…

যা পাচ্ছি, না-পাওয়াগুলো আত্মভুলে হবে না অতীত

* আমাকে উৎসর্গ-করা বইটির নাম

 জানার আগ্রহ নিয়ে চোখ পেতে আছি

———————

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

স্তূপের ভেতর থেকে হঠাৎ বেরোনো প্রিয় বই

অদূর অজানা থেকে বাতাসের কাঁধে হাত রেখে

চলে আসা সৌরভের মতো

                           মনে এসেছে তোমার কথা

পৃথিবীর সব রং ফিকে হয়ে এলে

আমার বিমর্ষ মনে জেগে থাকে অন্য এক হৃদয়-প্রহর

বিজয়া, ভিন্নমনস্কতার কোনো ফাঁকে

তোমার মনে কি উঁকি দেয়

রিও দিল প্লাতা নদী, ওর ধার-ঘেঁষা

সেই বাড়িটির কথা! আমাদের সঙ্গে ও-ও কিন্তু

রপ্ত করেছিল রাত্রিসুধাপান, কবিতার বিপুল আমোদ

এসেছিল কত কত অমূল্য প্রদান

কী-যে কেমন বোকামি ছিল

একের পেছনে এক গ্রহণের অমূলক দ্বিধা

তবু ভাগ্য, সেই-সব না-নেওয়ার হাহাকারগুলো

                                আদ্যোপান্ত মনে রেখে আছি

* বড় সাধ ছিল―

 তোমাকে উৎসর্গ করা ‘পূরবী’ কাব্যটি

                                    হাতে হাতে দেব

—————–

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো)

আনন্দ ও বেদনা থাকে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানে

আনন্দ এ জন্য―তুমি আছো এক পলকের দূরে

বেদনা এ জন্য―আমাদের এ অদূরত্বটি তুমি

                                     সামান্যও মাথায় রাখোনি

আমি আত্মসুখী। তোমাকে দেব বলে যা

                                      আকাক্সক্ষা করেছি― আমার সঞ্চয়ে তা-ই রয়েছে প্রচুর

আমি বেদনার্ত―আমার এ প্রীতিঅর্ঘ্য

                       তোমার কোনো কাজে আসেনি

তবু আমি দীর্ঘ উচ্ছ্বসিত―

দূরবর্তী অনুবাদে নয়

আমাকে তুমি পাঠ করেছো

                          শতভাগ মূল-অনুরাগে

——————

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো)

তুমি সান ইসিদ্রো ছেড়েছো

                          তা-ও বছর পনেরো হবে

কত ঘণ্টার সমষ্টি হলে পনেরো বছর হয়!

আমার ধারণা দৃঢ়―পনেরো বছর হলো এক ঘণ্টা থেকে

কয়েক মিনিট কম। সেই সব স্পর্শছায়া এখনও অঝোর

জলে জন্মানো পাথর―তার বুকে যে শুষ্কতা থাকে―

এর নাম স্মৃতি। মিরালরিওর পর্যাপ্ত দিন

পেয়েছে গানের স্ফূর্তি, কবিতার বিশুদ্ধ ভ্রমণ

তোমাকে থাকতে দেখা―সেই বাড়ি―আমার কী দায়

বোবা অন্ধ সিঁড়িসুদ্ধ বাড়িটিকে বুকে তুলে রাখা!?

কে কার কতটা হই, জানা হলো আগুনের ঘ্রাণে!

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

একটা উৎফুল্ল খাতা। ডুবে থাকো। আমার অবশ্য

কোনও অসময় নেই―পৃষ্ঠা থেকে পৃষ্ঠা

দেখি, লেখালেখি যত―

               বেশি হচ্ছে কলমের অবাধ আঁচড়

ভুল পায়ে চলে আসা কবিতার শব্দ ও চরণ

সহজে বাতিল করা। স্থানে স্থানে কালির স্তবক

কল্পনার নানামুখ, সরীসৃপ, পাখি

ইতিহাস-পূর্ব-সময়ের

            কী যেন, কীসের যেন অচেনা আদল

কলম বিমুগ্ধ হলে অমনস্ক আঁকিবুকিগুলো

                             নিজে নিজে ছবি হয়ে ওঠে

——————-

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

তোমার ঠাট্টার শেষ নেই―

অনুচিত শব্দ আর চিন্তাচ্যুত বাক্যগুলো কেটে

আমি-যে ছবির সত্য হাসিয়ে বেড়াই

শেষে-না-আবার ভুলে যাই

                           কবিতার বিশুদ্ধ ভ্রমণ!

কেন সেটি হব ?!

আমি যা কবিতা আঁকি

আমি যা ছবিশ্রী লিখি

           ওরা এক-হৃদয়ের উৎসারিত আলো

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো)

তুমি আমার আকাশ। আমি গাছের সামান্য শাখা

রবিকে সন্ধান করি, আলো খুঁজি, ‘আলো, আরও আলো’

রবির সান্নিধ্য ছাড়া বৃক্ষের কোনও প্রাণ থাকে না

বৃক্ষ যদি না-থাকল, রবিরশ্মি হবে মূল্যহীন

তোমার সকল বাক্য দীপ্ত থাকে মনোসরোবরে

আকাশের ছায়া পড়ে, হেসে থাকে শত শতদল

তোমার কবিতা পড়ি। একে শুধু পাঠ বলি কেন!

মনে হয়, আমি আছি―শব্দ-ছন্দে, উপমার মাঝে

আমার হৃদয়পাত্রে ভালোবাসা জমা হতে থাকে

কত প্রেম পেলে তবে তৃষ্ণাটির অবসান হবে ?

তোমার ঔদাস্যগুলো, যখন তুমি লেখার ঘোরে

দেখি, আছে, জেগে আছে মুগ্ধ দুটি প্রেমের হৃদয়

——————–

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

তোমার সান্নিধ্য থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছি

বিচ্ছেদ দাঁড়িয়ে থাকে, তবু আমি মনোনয়নের

ছায়া-ছায়া আলো ফেলে দেখে নিচ্ছি বিষণ্ন উজ্জ্বল

প্রিয় বিজয়ার মুখ। সান ইসিদ্রোর দিনগুলো…

ভ্রমণে আনন্দ খুঁজি। পাই বটে নানা উপশম

মানুষ, প্রকৃতি পড়ি। নতুন যে অভিজ্ঞতা হয়

সঞ্চয়ে রাখতে, কারও সাহচর্য খুব প্রয়োজন

ল্যাটিন আমেরিকাকে দেখেছি তোমার অবয়বে

বাহ্যিকতা মুখ্য নয়। যদি হৃদয়ে হৃদয় মেশে

লুপ্ত হয় ভাষা-ব্যবধান। সন্নিকটে, অন্ধকারে

ডুবে থাকা গ্রহ নও, তুমি দূরের তারার মতো

আলোমুখ, মুগ্ধকর, জ্বলে আছো আমার আকাশে

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

খ্যাতি হচ্ছে উঁচু কোনও দেওয়ালের মতো

একপাশে প্রশংসার বহুবিধ ক্লান্ত কোলাহল

অন্যপাশে একাকিত্ব ন্যস্ত থাকে জোর পাহারায়

বলা যায়, আমি সেই দেশ, যার ভূগর্ভে রয়েছে

মূল্যবান কয়লার খনি, আছে হীরে-সম্ভাবনা

লোভাতুর যারা, বনশ্রীকে পরিয়েছে রক্তরজ্জুফাঁস

আমার লেখার মূল্য ঈর্ষণীয় চড়া। তবু দেখি

ব্যক্তিমূল্য ঢেকে যাচ্ছে প্রশংসার এঁদো আস্তরণে

এর থেকে মুক্তি তবে পাওয়া যাবে কোন সাধনায়!

একাকিত্ব দূরে যাবে প্রেম যদি কছে চলে আসে

মরুপথিকের তৃষ্ণা। পেয়ে গেছি জলের সন্ধান

আমার কী সাধ্য আছে সেই জল ঠোঁটে তুলে নিই!

শোনো জল, তুমি এসো, খুলে যাবে দ্বিধার আগল

——————-

(রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো)

আমার আবেগ আজ পশমের মাদুরের মতো

শৈত্যের আক্রোশ থেকে রক্ষা করি কবির চরণ

যতনে ছড়িয়ে দিই উত্তাপের চিহ্ন-সমারোহ

আশা করে থাকি―যদি পেয়ে যাই মুগ্ধ উদ্বোধন

আজন্ম কবিকে চিনি, না-দেখার মুগ্ধতা এখন

আরও বেশি মুগ্ধকর, দেখি তাকে সকল থাকায়

‘বিদেশ-বাসিনী’ আমি। কবি তবু সুরের মালায়

আমাকেই জড়ালেন। হৃদয়ের ছায়ার ভিতর

বসিয়ে, বসিয়ে রেখে লিখেছেন কবিতা ও গান

আত্মার আনন্দ আজ হেসে থাকা পদ্ম-সরোবর

মানুষ যতটা আসে, তারও আগে প্রেম চলে আসে

রঙের অনেক রঙে জেগে থাকে খুব অনায়াসে

মনের ভ্রমণ দীর্ঘ। না-দেখায় অবিরত দেখা

অমল প্রাণের শক্তি স্থায়ী সত্য―হর্ম্যপুণ্যরেখা

(ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

পূর্বাহ্নে দেখেছি তাকে কোন দেশে! কোন বেশে যেন!!

মন যাকে দেখে, তার কোনও

                           দেশ কাল সীমান্ত থাকে না

কেবল বোধের উৎস, ‘স্বপন চারিণী’

অপরাহ্নে যার সঙ্গে দেখা

মানুষী সে। বুঝিলাম―দুটি জন্ম জন্ম নিয়েছিল

একদিন, হতে হতে হয়ে যাবে হৃদয়ের সমুদয় প্রীতি

——————-

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button