আর্কাইভকবিতা

কবিতা

আইউব সৈয়দ

সুয়াবিল এবং নাইচ্ছারঘাট

সুয়াবিলের তাবৎ সুষমা নীলিমার শিহরণে ঠিকরে বেরুচ্ছে―রূপময় গল্পে

মুখোমুখি হয়ে উপভোগ করে তুলছে দুই চোখের ল্যান্ডস্কেপ;

‘নাইচ্ছারঘাট’-এর নির্বাচিত খেয়ার সুরে আঞ্চলিক গান শুনিয়ে চারিদিকে

সৌরভ ছড়াচ্ছে―ওহ্ ডানে-বামে চিত্রকল্পে প্রকৃতিবালা জেগে ওঠে।

সুন্দরের আত্মা ছুঁয়ে আড়ষ্টতাহীন সামাজিক আলিঙ্গনে সম্ভাবনার

কথাই বলে।

উঁকি দেয় লোককথার ধ্বনিগুচ্ছ; অরণ্যচুম্বনে শাখা-প্রশাখাতে তৈরি করে

সহজ সরল উপযুক্ত স্বপ্নের বাসর―নির্ভয়ে কুড়াচ্ছে ঝিরিঝিরি ছায়ার

অকলঙ্কিত রোদের পূর্ণাঙ্গ আসর, নিয়ম অনুযায়ী অপঠিত রাখে না

উঁচু-নিচুর নির্জনতা।

ঘোরগ্রস্ত প্রতিশ্রুতি নিয়ে সর্বত্র ঘোরে সুয়াবিল; নিরানন্দে থাকে না যে

ধুলায় ধূসরিত সময়।


রানা জামান

সাহসের পাখিগুলো

সাহসের পাখিগুলো ফিঙ্গে ছিল

নিযুত বাজের থাবা জেনেও

এগিয়েছে সামনে জীবনের মায়া ছেড়ে

মুক্তির প্রত্যয়ে টান রেখে সিনা

জানে বারমুডা ত্রিভুজের ওধারে আছে

প্রশান্তির ফল্গুধারা আদিগন্ত

যার প্রত্যাশায় ঝরে গেল কত প্রাণ

দানবের চ্যালাদের পৈশাচিকতায়

বাজের থাবায় হতে পারে আরও বধ

আরও নৃশংসতা যা কল্পনার বাইরে

মাথা থেকে ধড় ছিন্ন, কিংবা রক্তনদী

বাড়তে পারে গণকবরের সংখ্যা

যূপকাষ্ঠে ঘাড় রেখে হয়েছে অমর

হাজার ছাড়িয়ে গেছে, কিংবা আরও বেশি

দমাতে পারেনি লাশের মিছিল

জয়ের দৃঢ়তা জুগিয়ে গেছে সাহস

ন্যায়ের বিপ্লব ব্যর্থ হয় না কখনও

আগস্টের পাঁচে ভেগে গেল স্বৈরাচার

নামের শকুন ফিঙ্গের সম্মিলিত থাবায়

দেশ ছেড়ে আরেক রাক্ষসের কোলে।


মুস্তফা হাবীব

মানুষ ও তার প্রকৃতি

সমুদ্রের জলস্তর পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম

মাছেদের মধ্যে কোনও ডানবাম নেই, নেই দলাদলি

জলের ভাগাভাগি নিয়ে কেউ কারও বুকে চালায় না গুলি,

তবে নিরাপদ নয়, মানুষের ভয়ে সর্বক্ষণ তটস্থ থাকে।

সুন্দরবনের বৃক্ষলতা ও বাতাসের ঘ্রাণ নিয়ে দেখলাম

বন্যেরা বনের সৌন্দর্য নষ্ট করে না

মনোতন্ত্রের বাহারি খেলায় কেউ খায় না কারও ভবিষ্যৎ,

তবে শিকারির ভয়ে বন্যেরা অবস্থান পাল্টায়।

মানুষের জনপদে জ্বলে মানুষের হিংসার অগ্নিফলক

মানুষই কেড়ে খায় মানুষের অধিকার―স্বাধীনতা

সুযোগ পেলে একজন দাঁড়ায় অন্যজনের বুকের ওপর

একজন কেড়ে নেয় অন্যজনের জীবন।

মানুষই ভাঙ্গে মানুষের শিরদাঁড়া, অস্থি পাঁজর

কৌশলে রোজ গুলিতে উড়ায় প্রতিপক্ষের মাথার খুলি,

তবু শুনি, আঠারো হাজার সৃষ্টির মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ!

আমি কিছুই বুঝি না এই জগৎসংসারের হালচাল

না বুঝি পৃথিবীর শিল্পকলা, না বুঝি সৃষ্টির দুর্বোধ্য ছলনা

আল্লাহ, এই অবোধ অধমকে ক্ষমা করো অপার মমতায়।


স ম তুহিন

মেঘ আমারও পোস্টকার্ড

এক হিম সাদা দিনে কাফকার শার্ট পরিয়ে দিতে চেয়েছিল একজন

একজন সরল জোছনায় সত্তর পরির একশ চল্লিশ পাখা

আমার পকেটে জমা রাখতে চেয়েছিল

‘স্ট্যাচু অব লিবার্টি’র মোহমায়ায় ভাসতে বলেছিল একজন

একজন ভোলগার পারে ভদকার নেশা ধরাতে চেয়েছিল

আমার ভেতরের পৃথিবীতে পৃথিবীর সবচে বড় দেয়াল এক অবাক আঠায়

                    আটকে দিতে চেয়েছিল একজন

পৃথিবীর বড় দেয়ালটার চেয়ে বড় একটা পাঁচিল আমার ভেতরে

আগে থেকেই রয়ে গেছে-

দেয়াল কি আর ঢোকে ?

নৌকো দোলে সূর্য ওঠে তারা জ্বলে আমার মনেÑ

কাকে দেখে ?

বলব তোকে খুব গোপনে উত্তর পেলে খুঁজে

এক স্যাম্পেন সকালে আমি স্যাম্পেন হয়েছিলাম

এখনও আমি স্যাম্পেন হয়েই আছি

আমি তো আমার মতো

দীর্ঘজীবী দীর্ঘকালের ভবঘুরে শার্টপরা এক কবি

করি চর্যার মোসাহেবিÑমেঘ আমারও পোস্টকার্ড

কে যেন জোর করে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় শব্দ সাজানোর খেলা


তানজিদা আক্তার

আকাশটা শুধু পুরনো হয় না

অনেক দিন হলো আকাশ দেখছি।

আকাশটা শুধু পুরনো হয় না।

যে পথ ধরে হাঁটছি দীর্ঘদিন

সে পথ পুরনো হয়ে গেছে।

এখন সে নতুন পথিকের কথা বলে।

কতদিন ধরে কৃষ্ণচূড়া গাছটি দেখছি―

দেখতে দেখতে ফুলগুলো পুরনো লাগে―

নিত্য দিনের অভ্যস্ততার মতো।

প্রতিদিন একটা কাঁঠাল কাঠের খাটে ঘুমোতে ঘুমোতে অভ্যেস হয়ে গেছে।

আর ব্যস্ত জীবন―

সে তো একটাই।

প্রতিদিনের কাজ আর

আনন্দ দেয় না।

দায়িত্বটাও যেন দায় হয়ে গেছে।

শুধু, প্রতিদিনের আকাশটা―

পুরনো হয় না।

এক পশলা বৃষ্টি আকাশের সব গ্লানি মুছে নতুন করে দেয়―

কান্না দিয়ে মুছে যাওয়া আমার কষ্টগুলোর মতো।


নিলয় রফিক

ছাত্রশিখা

মেধাবী বেকার চোখ, দিশেহারা উন্মুক্ত উদ্যানে

পিপাসার কর্মরথে ব্যর্থলিপি পিচ্ছিল সড়কে

হতাশায় ঘিরে ধরে স্বপ্নতরী মেঘাচ্ছন্ন পথ

জড়ো হয়ে দিচ্ছে ডাক, একবুক বায়ান্নে ভাবুক।

‘ক্লিওপেট্রা’, শব্দস্বর কোমল হৃদয়ে রক্ত খরা

প্রতিবাদে ছাত্রশিখা মুখরিত অন্দরমহলে

পড়ছে আকাশপথে সাউন্ড গ্রেনেড সারি সারি

নেটপাড়ায় বিচ্ছিন্ন, অন্ধকার স্বাধীন সতেজ।

জোড়া জোড়া ফুলগুলো রাজপথে নিথর শরীর

কান্নাভেজা রুদ্ধশ্বাস শকুনের ভয়ে অন্তখিল

কালাকানুন শহরে, জলপাই গাড়ির ছোটাছুটি

গুমের উৎসবে নৃত্য ইতিবৃত্তে রাত শেষে আলো।


আজম মাহমুদ

একটা দেবদারু গাছ

এইসব প্রার্থিত প্রাপ্তি কখনও কখনও খুব অপ্রাপ্তি মনে হয়। হঠাৎ করে সম্বিত ফিরে পাই, ভুল পথে বহুদূর চলে যাওয়া পথিকের মতো, আচমকা! এইসব বন্ধুর পথে সব পথিকই হয়তো ভুল করে। ফিরে আসার কষ্টময় চিন্তায় দীর্ঘ হয় শ্বাস। অথচ এই এক জীবনে ফিরে আসার কোনো পথ নেই। কল্পিত সুখনগরী যখন মনের ভেতর নরক বলে ধরে দেয়, শুধু তখনই মনে হয়―এই সব দিন-রাত্রি আমার জন্য নয়। আমার তো হওয়া উচিত ছিলো নীল পাহাড়ের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দেবদারু গাছ। কিন্তু দেখো, এক জীবনে কত কিছুই পাওয়া হলো না, কত কিছুই হওয়া গেল না!


ফজলুল হক তুহিন

রক্তমাখা জুলাই

যুগ চলে যায় আঁধার থাকে―

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে

মানুষ বাঁচে মানুষ মরে রক্ত ঝরে

দেও-দানো সব হল্লা করে―

হাউ মাউ খাউ

হাউ মাউ খাউ!

স্বপ্ন উধাও মানুষ উধাও―কেঁদে মরে নগর-গাঁও।

মায়ের ঘরে আহাজারি

রক্তখেকো অত্যাচারীর অট্টহাসি

পলাশ রঙে হৃদয় ভাঙে

কালবোশেখির শক্তি জমে আকাশ গাঙে

মৃত্যু ভুলে যুগের মিছিল এগিয়ে যায় বিজয় পথে

          কোটি বুকে ক্ষোভের বারুদ

জ্বালিয়ে দেয় আবু সাঈদ!

তিতুমীরের ভাই হয়ে সব

মতিউরের বোন হয়ে সব

অকাতরে জীবন দিয়ে হলো শহিদ

বুকের মাঝে রক্তনদী―তবু আসে পূর্ণ ঈদ!

দানো পালায় আঁধার পালায়

রক্তভেজা আসে জুলাই!

                   রক্তমাখা জুলাই!


সোহেল মাহবুব

দান

সন্ধ্যার চোখে তাকিয়ে দেখি চুমুর বৃত্তান্ত

বেওয়ারিশ ঠোঁটের খেলায় ভেসে বেড়ায় সরষে মেঘ

স্বপ্নের প্রফিটে ফাটে চাবির নকশা

উন্নয়নের খোলা তোশকে ঢুকে যায় অনিয়ন্ত্রিত ধোঁয়া…

প্রথম চুম্বনে যদি খুলে যায় মন খারাপের দুয়ার

তাহলে আর কে শুনতে পায় ঘুম পোড়ার গন্ধ?

সদর ঠোঁটে বাসি খাম-খেয়ালি না মানালেও

দেয়ালে টাঙ্গানো শীৎকারগুলি বেজে ওঠে ভীষণ

স্নায়বিক দৃশ্যপট থেকে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে নিঃশ্বাসের আয়ু

আর সুড়ঙ্গ ক্ষুধায় কাতরায় খুচরা সুখÑ

পোয়াতি থাপ্পড় খেয়ে সিন্দুক থেকে বেরিয়ে আসে জোছনা

কান্নারত চাঁদের কাজল কেন ভিজে যায় তোয়াক্কাহীন রোদে?

মোমের চমক চাইনি বলে বসন্তের অবসরে

মাটির ডালিম গাছের নিচে বানিয়েছি

ঝকমকে আঁতুরঘর আর তিলকশয্যা।

এখন বেলুনের গায়ে ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে তুমি

দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছ বিবাহিত স্পর্শের।

ক্ষুধার্ত পেয়ালায় ভানের রুমাল দিয়ে দানের কাজল আঁকো…

আমাকে কতটা পেছনে ফেললে তুমি আরও এগিয়ে যাবে ?


সাইয়্যিদ মঞ্জু

কাল

মানুষের সঙ্গ ছেড়ে মানুষ পালিয়ে যায়

নেকড়ে জীবনকাল অস্থির নগরে

বিরান অরণ্য খাঁখাঁ

পলায়িত পাখি ঘর বাঁধে পুস্তক পাতায়।

উষ্ণতায় তেতো বিস্তীর্ণ সমুদ্র গলাগলি

নদীর প্রবাহে

মাছের ঠিকানা খোঁজে হালদার মাঝি

ভেসে চলে নুনদরিয়ায়

অথচ কালের মাছ, ঘের জলে

ঠিক মানুষের মতো রোজ নাস্তা খায়।

———————–

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button