আর্কাইভগল্প

গল্পের স্বর : রাতের ভূত : মাহবুব ময়ূখ রিশাদ

শহরে এত দালান, এত আলো ভূতদের আর বেঁচে থাকার সুযোগ কই ? এই চিন্তার ওপরে কলকাতায় একটা সিনেমাও হয়েছিল। তবে ঢাকা শহরের বাস্তবতায় রাতে যে ভূত নেমে আসে সেটা অনেকেই জেনেও না জানার ভান করে। যেমন জানত ইকবাল কিন্তু সত্যি যে সে ভূতের দেখা পাবে সেটা সে দূরতম স্বপ্নেও ভাবেনি।

ইকবালের মতো হাজার হাজার বৈশিষ্ট্যহীন মানুষ আমাদের চারপাশে ঘোরাফেরা করে। একটা চাকরি, বেতন তেমন বেশি না, থাকার খরচ, খাবার খরচ দিতেই যার হাত ফাঁকা হয়ে যায়। প্রেমিকা চোখ রাঙ্গায়, তাগাদা দেয়, বিয়ের কথা বলে আর সেই কথা শুনে ইকবাল বা ইকবালের মতো ছেলেরা একটা বোকাবোকা হাসি দেয়।

ইকবাল যাকে ভালোবাসে তার নাম প্রিয়তা। সবার মতো সেও ভাবে প্রিয়তাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকা প্রায় অসম্ভব, প্রিয়তাই তার সমস্ত জীবন।

প্রিয়তা এসে বলল, আমি আর বিয়েটা আটকে রাখতে পারব না। ওরা দু’জন বসেছিল ধানমন্ডি লেকের পাশে। প্রচুর মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, কেউ দৌড়াচ্ছে, এদিকে যে দুটো জীবন ভেঙে যাচ্ছে সেদিকে কারও কোনও খেয়াল নেই। এমনিতেও এই শহরে কারও দিকে কারও তাকানোর সময় নেই। ওরা যে প্রায় এখানে বসে, সিগারেট খায় দু’জন মিলে, কে আর খেয়াল করে ?

অনেক কষ্টে নিজের রাগ, চোখের পানি আটকে ইকবাল বলল, আমাকে দুইটা দিন সময় দাও। আমি বিয়ের ব্যবস্থা করি।

এতটুকু শুনেই প্রিয়তার অন্ধকার মুখে আলো ফুটল। আশপাশটা তার কাছে আরও সুন্দর হয়ে ধরা দিল। দেখতে দেখতে চার বছরের স¤পর্ক। ইকবাল এত ভালো একটা ছেলে! কোনওদিন ঝগড়া পর্যন্ত হতে দেয় না। যা কথা কাটাকাটি হয়, এই বিয়ে নিয়েই। এমন একটা ছেলেকে যে নিশ্চিন্তে বিয়ে করে ফেলা যায়, অর্থনৈতিক ঝামেলা থাকার পরও সেটা প্রিয়তা জানে। যদিও প্রিয়তার বাসা থেকে কিংবা বন্ধুরা ভিন্ন কথা বলে। ভিন্ন না ঠিক, পুরানো কথা। ঐ যে বলে না, অভাব থাকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়, সেই কথা। প্রিয়তা তাদের বলে, জানালাটা ঠিকঠাকভাবে আটকে রাখতে পারলেই হলো। এতটুকু কাজ সে করতে পারবে।

দুই

রাত কয়টা হবে ঠিকমতো খেয়াল করেনি ইকবাল। হয়তো বারটা, নয়তো একটা। এর বেশি নয়। রাত একটার বেশি কখনও জেগে থাকতে পারে না ইকবাল। দরজায় নক পড়ল। এত রাতে কে কবে দরজায় নক করেছিল মনে করতে পারে না। খানিকটা অবাক হয়। নিচের কলাপসিবল গেট আটকে দেওয়া হয় আরও অনেক আগেই। তাহলে কারা এল ?

বাসায় আজ কেউ নেই। বাবা-মা বাড়িতে গেছে, ছোট বোনসহ। ওরা কি ফিরে এল ? তা হবার কথা নয়। দরজায় নকটা অনেক বেশি মোলায়েম। যেন কেউ আদর করে ডাকছে। বোন হলে ধাক্কা দিয়ে ভেঙ্গে ফেলতে চাইত এতক্ষণে। বাবা হলে বেল কেন ঠিক করাচ্ছে না ইকবাল, এই নিয়ে গজগজ করত। বাইরে থেকে সেই কথা শোনা যেত।

কিছুটা দ্বিধা নিয়ে দরজা খুলে ইকবাল দেখল দাঁড়িয়ে পাঁচ থেকে ছয়জন। একদম সামনে যিনি দাঁড়ানো উচ্চতায় তার সমান, পরিপাটি করে কাটা চুল, ক্লিন শেভ। দেখে মনে হচ্ছে কোন থ্রিলার উপন্যাস থেকে উঠে আসা চরিত্র।

তিনি বললেন, আপনি নিশ্চয়ই ইকবাল। আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে।

মানুষ বিস্মিত হলে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে। ইকবাল কথাটা শুনে যে মহাকাশ থেকে একেবারে পৃথিবীর কেন্দ্রে গিয়ে উপস্থিত হলো। বলল, আমাকে যেতে হবে ? কোথায় যেতে হবে ? কেন যেতে হবে ?

লোকটি খুব শীতলভাবে হাসল। বলল, এই প্রশ্নগুলো আপনার ফেসবুকে লেখার আগে নিজেকে করা উচিত ছিল না ?

ইকবাল ভাবছিল, প্রিয়তাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে, এই কথাটা কোনওভাবে কেউ জেনে গেছে দেখে তাকে ধরতে এসেছে। এভাবে যে রাতের বেলা মানুষকে ধরে নিয়ে যায়, এই কথা তো তার জানা। কিন্তু ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জন্য, যে স্ট্যাটাসে সর্বসাকুল্যে বিশ-বাইশটা লাইকও পড়ে না, সেই কথার জন্য তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে কেউ, এই কথা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি।

দেশে নির্বাচনের নামে যে ছেলেখেলা হচ্ছে সেটা নিয়ে লিখেছিল ইকবাল। বিরোধী দলের নির্বাচনে আসার কোনও সুযোগ নেই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই, সরকার পক্ষ নিজেরাই দু’গ্রুপে ভাগ হয়ে খেলনা নির্বাচন করছে। এটুকুই তো লিখেছিল। এটুকু লেখার জন্য তাকে ধরে নিয়ে যেতে পারে ? মনে করতে চেষ্টা করে আর কোনওদিন কিছু লিখেছিল কিনা। ভেবে যা পায় তাও ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট মনে হয় না। আবার এটাও তার মাথায়, যদি সত্যি অনেক কিছুই লিখে থাকে তারপরও কি ধরে নিয়ে যাওয়া ঠিক বলে প্রমাণ হয় কিনা ? তাও তো নয়।

ঢোক গিলে ইকবাল বলল, আমি যা লিখেছিলাম তার জন্য ধরে নিয়ে যাওয়াটা অপ্রয়োজনীয়। আপনাদের এটার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকার কথা।

লোকটা একই রকম করে হাসল। বলল, আমাদের কাজ এটাই। আপনাকে পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হলো। মৃত্যুর আগে পাঁচ মিনিট সময় পেলে ঠিক কী করা যেতে পারে, সেটা আগে কখনও ভেবে না রাখায় দ্বিধায় পড়ে যায় ইকবাল। যেহেতু খুব সাধারণ মানুষ হিসেবে পুরো জীবন কাটিয়েছে সেহেতু মা-বাবাকে জানাবে নাকি প্রিয়তাকে জানাবে সেটা সিদ্ধান্ত নিতেই তার পাঁচ মিনিট পার হয়ে যায়।

এরপর তাকে আর সময় দেওয়া হয় না। বাসা থেকে নিচে নেমে দেখে জনমানব শূন্য রাস্তায় একটা সাদা মাইক্রো দানবের মতো দাঁড়িয়ে আছে, যেন এই মুহূর্তেই গিলে ফেলবে তাকে। গিলে ফেললও। গাড়িতে ওঠার পর বেঁধে ফেলা হলো হাত, বন্ধ করে দেওয়া হলো চোখ। ইকবাল কাউকেই কিছু জানাতে পারল না।

তিন

যে ঘরে তাকে রাখা হলো, ঘরটা যে দৃশ্যত কোনও থানার ঘর নয়, এটা দেখেই বুঝতে পেরেছে ইকবাল। এটাই কি তবে সেই গোপন টর্চার সেল ? আয়নাঘর ? ছোট একটা ঘরে একটা বিছানা পাতা কেবল। এত ক্ষীণ আলো যে দেয়ালটাও বোঝা যাচ্ছে না ভালো করে। বাথরুমের কি ব্যবস্থা আছে ?

ইকবালকে এমনভাবে ধাক্কা দিয়ে ফেলা হলো যেন সে কোনও মানুষ নয়। বিছানায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। আর সঙ্গে সঙ্গে ইকবালের মনে হলো সমস্ত স্মৃতি সে হারিয়ে ফেলছে। একটু পর সত্যি সত্যি আর কিছুই মনে করতে পারল না। এখানে সে কেন এসেছে, সে কে, এই প্রশ্নের উত্তরগুলো গিলে ফেলল অন্ধকার।

তাই যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে আরেকটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো এবং বারবার জানতে চাওয়া হলো, সে কা’দের হয়ে কাজ করছে তার কোনও উত্তর সে দিতে পারে নাই। স্মৃতি না হারালেও দিতে পারত না। কারণ কোনও কিছুর সঙ্গে তার স¤পর্ক নেই।

কিছুদিন পর এমন হলো ইকবাল তার বাকশক্তিও হারিয়ে ফেলল। তাকে অবশ্য শারীরিকভাবে টর্চার করা হয়নি। কিন্তু আশপাশ থেকে রাতের বেলা এত জান্তব গোঙ্গানি শোনা যেত যে ইকবালের মনে হতো যদি কানেও শুনতে না পেত খুব ভালো হতো। মাত্র অল্প কয়েক দিনের ভেতরেই ইকবাল এমন মানুষে পরিণত হলো, যার কোনও স্মৃতি নেই, যার কোনও শব্দ নেই, যার কোনও বাক্য নেই। এমনকি যে প্রিয়তাকে ছাড়া সে বাঁচবে না বলে ভেবেছিল, সেই প্রিয়তার কোনও স্মৃতিও সে মনে করতে পারছিল না।

এভাবে বেশ কিছুদিন থাকার পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাসিনা রেজিমের পতনের পর আয়নাঘর থেকে যখন মানুষ বের হতে শুরু করল, ইকবালও বের হলো। ইকবালকে কে উদ্ধার করল, সে ঠিক বলতে পারবে না।

দীর্ঘদিন পর আলোতে এসে ইকবালের মনে হলো সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। ফলত মুক্তির পর স্মৃতি হারানো মানুষের সঙ্গে সে একজন দৃষ্টিহীন মানুষে পরিণত হলো। ছোটবোনের হাত ধরে হাসপাতালে যেতে যেতে সে জানতে পারল, প্রিয়তার বিয়ে হয়ে গেছে এক মাস, সে প্রিয়তাকে চিনতে পারল না। হাসপাতালে যাওয়ার পর সে জানতে পারল, তার মা মারা গেছেন কয়েক দিন হলো। ইকবালের কোনও ভাবান্তর হলো না। 

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button