আর্কাইভকবিতা

কবিতার স্বর

মোহন রায়হান

ক্ষমা নেই

ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই, খুনিদের ক্ষমা নেই, যে যেখানেই লুকিয়ে থাকুক

পাহাড়ে-জঙ্গলে-আকাশে-পাতালে-মঙ্গলগ্রহে

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যে কোনও প্রান্তে, খুঁজে আনো, ফাঁসি দাও, ওদের একমাত্র পুরস্কার মৃত্যুদণ্ড!

ওরা মায়ের কোলের শিশুসন্তান, স্কুলের পথের নিরীহ বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী, স্পর্ধিত উদ্দামতায় বেড়ে ওঠা তরুণ-তরুণী, খেটে খাওয়া দিনমজুর, শ্রমজীবী সহজ-সরল অদলীয় মানুষকে পাখির মতোন গুলি করে হত্যা করেছে! ওদের কোনও ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই,  মৃত্যু, হ্যাঁ, মৃত্যুই ওদের একমাত্র ক্ষমা।

গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, শহরে-নগরে চা-খানা, মুদি দোকানে, দেয়ালে-দেয়ালে, যানবাহনে সর্বত্র সেঁটে দাও ওইসব ঘৃণিত ভয়ানক বক্স-জেলিফিসের ছবি

জল, স্থল, আকাশ কোনও পথে যেন ওরা পালিয়ে যেতে না পারে।

তোরা এখন কোথায় ? চোর, ঘুষখোর, মহা দুর্নীতিবাজ, শি হুয়াং, ক্যালিগুলা, উ জেতিয়ানা, চিয়াং কাই, চেঙ্গিস, হালাকু, ফেরাউন, নমরুদ, জার, হিটলার, মুসোলিনি, বাতিস্তার প্রেতাত্মা জালিম ? তোরা কোথায় ? কোথায় সেই সব দর্পিত, স্বেচ্ছাচারী, নৃশংস মানুষ নামের কলঙ্ক তোরা কোথায় ? বেরিয়ে আয়, দেখি তোদের কত বড় বুকের পাটা ?

অবৈধ ক্ষমতার মসনদে বসে আমার করের টাকায় কেনা অস্ত্র তাক করেছিলি আমারই বুকের দিকে ? আমারই অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রক্ষমতা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে আমারই সত্য উচ্চারণের জিহ্বা কেটে নিতে, আমারই প্রতিবাদের ভাষা সৃষ্টির কলমকে চেয়েছিলি স্তব্ধ করে দিতে! আজ তোরা কোথায় ? কোন শীতল গুহায় লুকিয়ে আছিস সেই সব বেজন্মা-জারজেরা ?

কোথায় ? কোথায় তোরা ? হিম্মত থাকে তো আয়, বেরিয়ে আয়, লেজ গুটিয়ে পালানো তাইপেনেরা।

ভোট আর ভাতের অধিকারহারা প্রবঞ্চিত কৃষক, কারখানার শ্রমিক, পথের রিক্সাওয়ালা, ফুটপাথের সবজি বিক্রেতা, নগরের জঞ্জাল পরিষ্কারকারী নারীরা তোদের খুঁজছে, তোদের বাহাদুরী, দম্ভ, চাঁদাবাজি, নিপীড়নের নিষ্ঠুরতার হিসাব বুঝে নিতে।

তোরা কোথায় ? ক্ষমতার পুরিষ চাটা সারমেয়, সুবিধাভোগী, দালাল, কাপুরুষ, দলদাস, চুতিয়া কবিরা ?

বছরের পর বছর দুঃশাসনের স্টিমরোলার চালিয়ে যাওয়া, ‘আয়নাঘরে’ মধ্যযুগীয় বর্বরতায় অমানবিক নিষ্ঠুরতম অত্যাচারে গুমখুন, জবাই করে হত্যা, লুটপাটের রামরাজত্বের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলন দমনে পৃথিবীর নজিরবিহীন হিংস্রতার প্রতিবাদে, জুলাই বিপ্লবের শহিদদের স্মরণে, তোদের নিবীর্য কলম থেকে একটি দাড়ি, কমা, সেমিকলনও তো বেরিয়ে এল না কবি ভেকধারী ভণ্ড, প্রতারক, মিথ্যাবাদী, চোগলখোরেরা! বল কোথায় ? কোথায় তোদের কবিসত্তা, মানবিকতা, সৃষ্টিশীলতা ?

স্বৈরতন্ত্রের নির্লজ্জ গুণগানে পঞ্চমুখ, নাচে-গানে ভরপুর বসন্তের কোকিল, শিল্পী শব্দটিকে অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ করা সেই সব কুলাঙ্গারেরা কোথায় ? কোথায় আজ তারা ? হন্তারক-রক্তাক্ত ফ্যাসিবাদের প্রকাশ্য মদদদাতা, অর্থগৃধ্নু, জাতির সঙ্গে চরম মশকরা করা অঙ্গভঙ্গবাজী সেই সব নট-নটিরা কোথায় ? সংস্কৃতিকে লুটপাটের ভাগাড় বানানো আনজুমানে মফিদুলের সে সব মতলববাজ ইবলিশেরা আজ কোথায় ?

বন্দুকের নল আর রক্তের গহিন তল থেকে বেরিয়ে আসা প্রিয়তম স্বাধীনতাকে যারা করেছে ভূলুণ্ঠিত সেই সব দুঃশাসক, খুনি, লুটেরা, নির্যাতক, ফ্যাসিস্ট, সন্ত্রাসীদের আজ খুঁজে বের করতেই হবে, আইনের নির্মোহ প্রয়োগে ওদের ইতিহাস নির্ধারিত অবধারিত শাস্তি পেতেই হবে, পেতেই হবে, অপরাজনীতির উন্মাদ মাফিয়াডন, গণদুশমনদের কোনও ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই…


মাহমুদ কামাল

দরপতন

শেয়ার বাজারের সকল মৃত্যুর

ঘটেছে দরপতন

কমে গেছে জীবনের দাম

আমি কিছু জীবনের

শেয়ার কিনেছিলাম

সজীব সকালেই হঠাৎ সন্ধ্যা

তারপর দরপতন

আমার জীবনগুলো

খুব কম দামে কিনে নিলো

রাষ্ট্রীয় দানব সংস্থা

এই আনন্দ-সময়ে

আমার জীবনগুলো

আমি কি ফিরে পাবো?


রেজাউদ্দিন স্টালিন

অনন্ত শ্রাবণ

পৃথিবীর প্রথম বৃষ্টিধারা দশ লক্ষ বছর ধরে আবার ঝরুক

সৃষ্টির সাড়ে তিনশ বছর পর অবিশ্রান্ত হোক

রক্তের পাহাড় ধুয়ে দিতে

দশ হাজার বছর পর

পুনরাবৃত্তি হবে

স্বচ্ছ শুদ্ধতম জলধারা জীবাণুবিহীন তৃণহীন অ্যামিবারহিত

অমার্জিত দূষিত কলুষ হিংস্র

হত্যার বিরুদ্ধে অসীম প্লাবনক্ষম জলধারা প্রাণান্ত হোক

এবং মানবের অগ্নিগর্ভ বিমূর্ত স্তোস্ত্র

সমূহ শূন্যতা আর অন্ত্রের রিক্ত চিৎকার

হৃদয়ের ভগ্ন হাহাকার

মননবৃক্ষের ঝরে যাওয়া পাতা

জলধারা জন্মদিক সহস্র জলধি

যেন ভূমিষ্ঠ না হয় শিশু

আকাশের তারা হাত না বুলায় তার শিরোদেশে

সমুদ্র চড়ে না বসে কাঁধে

জমিন জল পশুপাখি

উঠে না বসে নূহের চিন্তায়

মানুষ ঊর্ধ্বে থাক

আদম অবতরণের স্থান মাটি শূন্য হোক

হাওয়া হোক বাতাসে বিলীন

আর এ জগৎ প্রাণ-অপ্রাণের সীমান্ত

এত রক্ত এত মৃত্যু জননীর এত অশ্রুজল

বৃথা গেলে পৃথিবী হোক প্রাণশূন্য

অনন্ত শ্রাবণ


শাহীন রেজা

‘মুগ্ধ’র জন্য এলিজি

আমার সেজখালা মৃত্যুর আগে পাকা পেঁপে খেতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওই সময়ে লাকসামে কর্মরত খালুজান শত চেষ্টাতেও তা জোগাড় করতে পারেননি আর এ সংবাদে মানসিকভাবে আহত আমার নানি আমৃত্যু পাকা পেঁপে খাওয়া থেকে বিরত ছিলেন

‘মুগ্ধ’ আমার রক্তের কেউ নয়

অথচ ইউটিউবে দেখা ওর নিষ্পাপ মুখ আমাকে সন্তানের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল

টিয়ার শেল আর তীব্র ধোঁয়ার মধ্যে

চোখ মুছতে মুছতে ‘পানি লাগবে পানি লাগবে’ বলে ছুটতে থাকা ছেলেটি

প্রচণ্ড বুলেটে হঠাৎ লুটিয়ে পড়লে মনে হলো

‘মুগ্ধ’ নয় লুটিয়ে পড়ল আমার বাংলাদেশ—

প্যাকেট থেকে ছড়িয়ে পড়া পানির বোতলগুলো ভিজে উঠলে রক্তে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু নয় যেন ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে গেল একঝাক তীব্র বুলেট

এরপর আমি আর ঘুমুতে পারি না

আমার রাত জুড়ে শুধু ক্ষোভ শুধু ঘৃণা

পানির গ্লাস হাতে নিলেই তাতে ভেসে ওঠে ‘মুগ্ধ’র মুখ; রক্তের তীব্র ধারা

আমার ‘মুগ্ধ’ এখন শহিদ;

সালাম রফিক বরকতের পাশে ওর নাম

ওদের মিছিলে জ্বলজ্বল ফারহান, মাহমুদ, সাঈদ, রাসেল, হোসেন, ইয়ামিন, রুদ্র, তরুয়া, মোস্তফা, জাকির—

আমি কতো আর উচ্চারণ করব

কত নাম কত নাম—

আমার নানি মৃত্যু পর্যন্ত বিরত ছিলেন পাকা পেঁপে খাওয়া থেকে

আমিও কি দূরে থাকব পানি পান থেকে;

আমৃত্যু, আর অন্ধকারে আঁকতে থাকব ঘাতকের নাম নিঃসীম ঘৃণায়।


সৌমিত বসু

ভেসে ওঠা আগুন জীবন

আবু সাঈদ কী করে মারা গেল

আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি

কিন্তু ইয়ামিন এবং দীপ্ত দে

ঠিক কীভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেল,

তা বেশির ভাগেরই অজানা।

একটা গ্রহণ লাগা দেশের ছাদে দাঁড়িয়ে

তারা চিনতে চেয়েছিল

মুদ্রার কোন পিঠ সঠিক

কোন পথ দিয়ে গেলে তারা সহজেই

আলো জ্বালিয়ে দিতে পারবে

দেশের মানচিত্রে।

সামান্য বড় হয়ে তারা জেনেছে

বৈষম্য আর সাম্যের কাঁধে হাত রেখে

হাঁটছে তাদের জন্মভূমি ,

ওই বয়সেই তারা কীভাবে জানতো

এভাবে বহুদূর পেরোনো সম্ভব নয়।

আপ্রাণ চেষ্টা করে দু হাত ছড়িয়ে দিয়ে

দেশের এই চলা তারা থামাতে চেয়েছিল।

আমরা হেসে তাদের পেটে

কতগুলো কার্তুজ ভরে দিয়েছি।

বেঁচে থাকলে তারা কী বা হতো

চালচুলোহীন বেকার কিংবা

বড়জোর কেরানি পর্যন্ত,

কিন্তু তাদের মৃত্যু অবধি হেঁটে যাওয়া

আমাদের কারও পক্ষে থামানো সম্ভব হতো না।

সবার অজান্তে কীভাবে আজ তারা

তোরণ হয়ে যাচ্ছে

আজ অনায়াসে তারা

সহপাঠীদের এক লাফে পেরিয়ে

চলে যাচ্ছে অনন্তের দিকে।

প্রতিবেশীদের ভেতর নাকি সামান্য ঈর্ষা থাকে

থাকে অন্যকে অতিক্রম করে যাওয়ার দৌড়

আমি প্রতিবেশী হয়ে তোমার জন্য

প্রতিদিন সকালে ফুল তুলে রাখি,

কোনও এক রাতে তোমরা

চুপিসারে এসে দেখে যেও।


কাজী জহিরুল ইসলাম

শহীদ আবু সাঈদ

তার প্রসারিত দুই বাহু ছিল একটি উড়ন্ত পায়রার মতো,

বুকে তার অসীম সাহস,

ভালোবাসার বারুদে ঠাসা ছিল সেই বুক,

কী বন্ধু কী অচেনা নিন্দুক

সকলের জন্যে ছিল অবারিত ভালোবাসা,

সে ছিল একটি উজ্জ্বল প্রত্যাশা,

একটি নতুন সকালের স্বপ্ন।

তার ডান হাতে ছিল একটি প্রতীকী লাঠি,

এই অন্ধ সমাজের হাতে

উদ্দীপ্ত যুবক তুলে দিতে চেয়েছিল ছোট্ট এক ন্যায়দণ্ড।

তেইশ বসন্তে বেড়ে ওঠা ওর দীর্ঘ ঋজু দেহ

পুলিশের গুলিতে তখনও লুটিয়ে পড়েনি,

অনড় দাঁড়িয়ে আছে ভূমি থেকে বর্ষার আকাশ অবধি ব্যাপ্তি নিয়ে

নতুন প্রজন্মের এক বাংলাদেশ

উদ্বেল দু হাত প্রসারিত জল্লাদের প্রতি, একটি নতুন সকালের যাত্রী হতে ডেকেছিল তাকে,

যে অনিন্দ্য ভোরের রক্তিম সূর্য আর কিছুক্ষণ পর

তারই বক্ষ ফুঁড়ে উঠে আসবে আকাশে,

জল্লাদ পুলিশ তখনও বোঝেনি

ক্রমাগত গুলি ছুড়ছে সে বাংলাদেশের বুক লক্ষ করে,

রংপুরের মাটিতে, কংক্রিটের ফুটপাথে

ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ল নতুন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহিদ,

আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ আবু সাঈদ।


মোস্তাক রহমান

কথা বলবে ভ্রুনস্থ শিশুরাও

ওঁদের নিহত বোলো না, ওঁরা জীবিত

বেহেস্তের সবুজ পাখিরা, শুধু ঘুমিয়ে গেছে।

আহাদ, জামান, সোহেল

সব অলৌকিক পাখি। রিয়া, মঈদ, আবীর,

ফাহিম, প্রতুল কত-শত আগুনের পাখি আমাদের।

কী তাচ্ছিল্য! ওদের রক্তে আপনি

স্নান করেছেন; নিকৃষ্ট হিড়িম্বা, হিন্দার বোন। 

আপনি কোনওদিন কেঁদেছেন, মানুষের জন্য ?

মানুষের দেখা পেয়েছেন ? বুকের ভেতরে শুধু অনার্দ্র কনক্রিট ?

বিধ্বস্ত নর্দমার জন্য কাঁদলেন,

অপ্রাণ পাথর নোংরা টয়লেটের জন্যও।

আপনি এদেরই ঈশ্বর ? প্রার্থনায় দুঃশলা, রক্তলোলুপ।

খুব ছোট কিংশুক কুড়ি। রিয়া, আহাদ

মঈদ; ওঁদেরও এত ভয়! মানুষেই ভয় আপনার ?

নিশ্চিত থাকুন; মাত্র ক বছর পর

ওরা হবে বিপ্লব: শহিদ সাঈদ। 

আপনার মুক্তি নেই। মাত্র কটা দিন পর বধির স্থাপনাও কথা বলবে

ভ্রƒনস্থ শিশুরাও হবে মুগ্ধ, মঈদ।

নিশ্চিত থাকুন। আপনার মুক্তি নেই।


কামরুজ্জামান

শ্রদ্ধা সম্মান

নতুন একটা সকাল আনব বলে চলে আসি

মিছিলে মিছিলে তারুণ্যে উজ্জ্বল সৌর দীপ্তিময়

শহিদ মিনারে, প্রতীকে আবু সাঈদের লাল রক্ত

কথা কয় লক্ষ কোটি কণ্ঠে কণ্ঠে ঝরায় আগুন…

পানি পানি কার লাগে ভাই পানি বলে মৃত্যুজয়ে

স্তব্ধ করে দিয়ে বোধ মুগ্ধ হয়ে গ্যাছে মুক্তির সাহস

আমাদের ঘরে ঘরে যুগ যুগান্তরে বীরগাথা

এত রক্ত এত প্রাণ দেশ ভালোবেসে যারা করে দান

স্বাধীন স্বদেশে সূর্য প্রভাতে শহিদ স্মরণে শ্রদ্ধা সম্মান।


টোকন ঠাকুর

বুলেট বুলেট

বুলেট,   তুমি কি দিতে চাও রুখে ?

বুলেট,   তুমি বাংলা ভাষা বোঝো ?

বুলেট,   তোমার গন্তব্য কার বুকে ?

বুলেট,   তোমার কিসের নেশা, খোঁজো ?

বুলেট,   তুমি কি দিয়েছ জ্বেলে ?

আবু সাঈদের বুকটা ক্যানভাস!

বুলেট,   তুমি কার হাত থেকে এলে ?

মাটির ওপর রক্ত নিজেই লিখবে ইতিহাস

জুলাই ২৪


আদিত্য নজরুল

বিচলিত সময়

বুকের বাঁ পাশে

হাত দিয়ে দেখি কেবল খাঁ খাঁ করছে…

বিপ্লব না হয়

ছড়িয়ে পড়ছে

মাতৃভূমি’র আনাচে কানাচে…

ভালোবাসা

তুমি কই গেলে ?

স্বচ্ছ রেশমের

নীলাভ নাইটি পরা নববধূর মতোই

লাজভয়ে ভালোবাসা বলল

বিপ্লবের ভেতরেই

ভালোবাসা সুপ্ত থাকে—


শরাফত হোসেন

মুগ্ধ

‘পানির আরেক নাম জীবন’ শুনেছি কতবার

আজ সেই পানি নিল কেড়ে ‘মুগ্ধ’র নিষ্ঠ জীবন

ধূসর ধোঁয়া কাঁদানে-গ্যাসের জ্বালায় জেরবার

যখন সে,―ছুটে যায় কমাতে তৃষিতের বেদন!

ছাত্ররা ন্যায্য দাবির পক্ষে তখন যে পিপাসার্ত

স্লোগানে, ‘পানি লাগবে পানি’ বলে দীপ্ত পায়ে ‘মুগ্ধ’

এগিয়ে যায়, ―পিপাসা মেটাতে দেবে এটুকু স্বার্থ

যখন সকলে দেখে নিরস্ত্র ছাত্র-পুলিশে যুদ্ধ!

হঠাৎ থমকে যায় মুগ্ধ, তার কপাল গুলিতে বিদ্ধ

হয়, ―পানির বোতল হাতে পতিত সে রাজপথে,―

চোখে স্বপ্নের জীবন, রক্ত-জলে মিশে হয় সিদ্ধ

আরও, জয়ের প্রত্যাশা তীব্র জ্বলে অন্তিম শপথে!

প্রতিটি রক্তের ফোঁটা তার মুক্তির বিমুগ্ধ মুখ

বিজয়ের আশা ভরে রাখে মুগ্ধর সাহসী বুক!


আবু সাঈদ

নতুন একটি ভোরের প্রত্যাশায়

বৃষ্টিভেজা ভোর দেখেছি অনেক

রক্তভেজা ভোর দেখিনি

সারা রাত নির্ঘুম কেটেছে

নির্বাক—আর্তনাদের চিৎকার শুনে

বিষণ্ন মনে বিস্মিত হয়েছি।

ওরা ‘মুক্তিযোদ্ধা’ নামে আর কতকাল ক্ষত করবে

আর কতকাল শব্দটাকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষান্ত হবে।

‘শামসুজ্জোহা স্যার’ হতে চেয়েছিল ‘আবু সাঈদ’

হতে পেরেছে—অন্যায়, বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে।

সহস্রবার চোখের পাতায় ভেসে উঠে

বুক পেতে দেওয়া বীরত্বগাথার—সে-ই ছবি।

প্রশ্ন জাগে—

এ দেশ কি স্বাধীন হয়েছিল

এমন হরিলুট করার লক্ষ্যে

লাখো শহিদ কি রক্ত দিয়েছিল

এই নির্লজ্জ পেটোয়া বাহিনীর জন্য।

জাগো ভাই জাগো

এ দেশটাকে আবার মুক্ত করো।

প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে—আমাদের সমাজ

আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের অর্থনীতি

আমাদের শিক্ষাপ্রবৃত্তি।

অভিভাবকহীন একটি রাষ্ট্রযন্ত্র

দিনের পর দিন চলে

চাটুকারদের পদধূলি।

রাজসভা বসে তৈলমর্দনসভা

কী নির্লজ্জতা, কী বেহায়ায় আলোচনা

এসব কী—

কখনও, কোনওকালে

কেউ মেনে নিয়েছিল কিংবা মেনে নেবে।

জাগো ভাই জাগো

বায়ান্নর মতো জাগো

একাত্তরের মতো গর্জে ওঠে

এই দেশটাকে মুক্ত করো।

আর একটিও গুলি নয়

আর একটিবারও লাঠিচার্জ নয়

অনেক হয়েছে, অনেক রক্ত ঝরেছে

আর কোনও রক্ত নয়।

জানি—আমরা এখনও পারিনি

আমাদের পূর্বপুরুষের রক্তের ঋণ শোধ করতে

পারিনি—তাদের কৃতজ্ঞতা ভরে স্মরণ করতে

পারিনি—যে জন্য তারা ছুটেছিল

               রক্তান্ত বিছানায়।

আমরা ভুলে গেছি—কী নিপীড়ন, কী নির্মম

                           একাত্তরের হত্যাকাণ্ড

আমরা ভুলে গেছি—আমাদের বৈষম্য

আমরা ভুলে গেছি—আমাদের অধিকার।

আমরা ব্যর্থ হয়েছি—আমাদের প্রজন্মের কাছে

জানাতে পারিনি আমাদের পূর্বপুরুষের বীরত্বকথা

জানাতে পারিনি তাদের সংগ্রাম কিংবা স্বপ্নের কথা।

জাগো ভাই জাগো

আরেকটি নতুন ভোরের অপেক্ষায়

আমাদের যত ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে

নতুন করে জাগো।


আকিব শিকদার

একজন কেউ ছিল

ক্ষীণ দুর্বল কণ্ঠ; শুধায় না কেউ―‘ক্লান্তি লাগল নাকি ?’

রক্তবর্ণ চক্ষু; বলে না কেউ―‘অসুখ বাধল কি গো!’

ফ্যাকাশে মুখ; চায় না জানতে কেউ―‘পকেট বুঝি খালি ?’

হারিয়ে গেল, ছায়ার মতো যে জন ছিল সাথে

মিছিল শেষে ঘরে ফেরা অজুত জনতার স্রোতে।

কাঠ চৌচির জ্বর; আসে না কেউ জল ন্যাকড়া হাতে

মাথাব্যথায় মরি; বলে না কেউ―‘কপাল চাপড়ে দেব ?’

কঠিন পীড়ায় প্রলাপ বকি; বসে না কেউ শয্যাকোণে

হারিয়ে গেল, ছায়ার মতো যে জন ছিল পাশে

দূর আকাশের রামধনু আকাশেই গেল মিশে।

নিঝুম রাতে নির্ঘুম; দেয় না তো কেউ হাত বুলিয়ে চুলে

আঙুল কাটে যদি; ছেঁড়ে না কেউ নিজের আঁচলখানি

পিছু ডাকি যবে; তাকায় না কেউ ভালোবাসার চোখে

হারিয়ে গেল, ছায়ার মতো যে জন ছিল নির্ভুল

ধুলার ধসে ধূসর হলো রঙিন রঙ্গা সব ফুল।


ইমরান মাহফুজ

সাদা গোলাপে রক্তের দাগ

কোথাও কেউ ভালো নেই—

মাছের সভায় মাছির হামলা।

সাদা গোলাপে রক্তের দাগ

নদীর স্রোতে হাহাকার, ট্রিগারে নারী অন্ধকার

বিভক্ত পাখিদের অনুভূতি—নির্মম জুলাইয়ে অনুভোতা।

হে অন্ধ বিচারক,

আপনি কি মুখোমুখি হন আয়নার

স্বপ্ন সন্তানের চোখে ভাসে মুগ্ধ সাঈদ ?

খরতাপে ঘর, তৃষ্ণার্ত মন—কাছাকাছি ফুল

কীভাবে বউ নেন ঘাতকের শিশ্ন বুলেট ?

রাজ ঘাতকের মৃত্যু মৃত্যু খেলায়

জীবন ভুলে গেছে বেঁচে থাকার পাসওয়ার্ড

কপালপোড়া মা শুয়ে থাকেন ক্ষমাহীন কেদারায়।

অভিমানী বাবা নির্বাসনে, পাথর বুকে দাঁড়িয়ে ঘুমায়!

খুনির দেশে ঘুমেও ভয়। মানুষ মরে গেলে

লাশের ইতিহাসে আগুন কথা বলার থাকে—

(আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গুলি না করার নির্দেশনা খারিজ করেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও এস এম মাসুদ হোসাইন, ৪ আগস্ট ২০২৪)


আজিজুল হক

এখন শুধু উল্লাস

এই জ্বলন্ত নগরের পাশেই বসে আছি,

এক উদ্ধত হাওয়া বইছে চারিদিক

আমি চাই আমার গলার মৃদু স্বরগুলো

মেঘের বজ্রধ্বনি হয়ে উঠুক,

দু হাতের ওপর ভর করে বেয়ে উঠুক ন্যায়ের দেবতা

আমি চাই আজন্মকাল ধরে

সবার কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে হাতে হাত লাগিয়ে

এক সাথে চলতে,

শরীরে জ্বলছে এখন অগ্নিসুতোর কণা

তাম্রমুদ্রার মতো শালিক দেহ পুড়ছে আগুনে—

মাথার ওপর চাঁদ খসছে বুলেটে

আর নয়, এখন শুধু আনন্দ উল্লাস…


আইনাল হক

বন্দিশিবির থেকে

চিন্তাগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে শীতনিদ্রায়

তারপর কেটে যায় শতাব্দীর পর শতাব্দী;

আর কত আন্দোলন দানা বাঁধলে,

রাজপথ রঞ্জিত হলে

মায়ের বুক খালি হলে

তোমার সুখনিদ্রা ভাঙবে, বলো ?

স্বার্থপরতার বেড়াজালে যে চিন্তাদের অন্তঃবাস

তাদের ছুটি আশু প্রয়োজন

সমতার সংগ্রামে বন্দিশিবির থেকে ডানা মেলে

মুক্তচিন্তার স্বাধীনতার এখনই শ্রেষ্ঠ সময়।


মনসুর আহমেদ

কণ্ঠরোধ

বাংলার আকাশে কালো মেঘ

জমিনে ঝরছে রক্ত বৃষ্টি

রাইফেল তাক করিয়ে যে পুলিশ গুলি ছুঁড়ছে

সেও সন্তানের বাবা, এক পাষাণ্ড পিতা।

পিচঢালা কালো পথে দাঁড়িয়ে

আমি বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলতে এসেছি—

আমি রংপুরের আবু সাঈদ;

আমার বুকের জমিন—

গণতন্ত্র আর মানচিত্রের চেয়েও সুদীর্ঘ।

রক্তে রঞ্জিত কালো টিশার্টে

আমার অধিকারের কথা লিখা আছে

যে বুলেটে আমার মায়ের বুকে হাহাকার জমেছে,

বোনের চোখে অশ্রু—

সেই বুলেট আমার বাবার ঘামের দামে কেনা!

শৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে যে মানুষগুলো লাশ হয়ে বাড়ি ফিরল

তাদেরও একেকজন মা আছে, আছেন বাবাও।

আমারই বাংলায় যখন দালাল চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে—

লাশের মিছিল করতে করতে

আমার থুতি চেপে ধরে

মুখে তারকাঁটা বসানোর চেষ্টা করে—

এই বুঝি আমার স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিবে!

হাতকড়া পরিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে

এই আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন!

রিমান্ডের নামে চোখ বেঁধে

যে শরীরটা থেঁতলে দিয়েছেন—

একজন মা দুধে ভাতে আমাকে বড় করেছেন।

আমি জন্মেছি কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়

যেখানে নেই আপোষের কোনও চিহ্ন।

দুমড়েমুচড়ে যে অধিকারের কথা বলে

সেই আমি আমার মা’কে বিদ্রোহের কথা বলে এসেছি।

———————

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button