আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : শামস আল মমীন

একজনকে চিনি

ছেলেমেয়ে ভেবেচিন্তে ঠিক করে

গাছটা কেটে ফেলবে। বাড়ির ছাদে ঝরা পাতাগুলো

পানি নিষ্কাশনে বাধা দেয়, ওরা মনে করে তাই। আমি

প্রায়শ জানালা দিয়ে দেখি কয়েকটা চড়ুই পাখি, একজোড়া ঘুঘু, আর

একটা কাঠবিড়ালি ডালে ডালে পাতার ফাঁকে নেচে গেয়ে

মাতোয়ারা। ওদের কথা ভেবে মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবু

এই সিদ্ধান্তে আমি নীরব থাকি। কারণ আসছে দিনে

ওরাই তো জানান দিবে কোন পথে মঙ্গল আমাদের।

আমি চাই ওদের ভাবনাগুলোও দাঁড়াতে শিখুক।

পরদিন, ডালপালা ও সবুজ পাতাদের পি+ষে তুষ বানাবার

দানবাকার যন্ত্রসহ কর্মীরা হাজির। তিনজন

পুরুষ ও একজন সাহসী নারী। সবার সাথে

সেও ডালপালা বয়ে নিয়ে যায়… মনে মনে ভাবি,

পাখিগুলো কি অভিমান করে চলে যাবে আমার সীমানা ছেড়ে।

মেয়েটির ইংরেজি শুনে বুঝি

আমার মতো ভিনদেশি সেও। এবং কৌতূহলে জানতে চাই,

কেথায় ছিল শৈশব তার ? সগর্বে বলল সে, ‘আমি এলসালভাদরিয়ান।’

তাকে বলি, সিনিওরিতা, তোমার দেশের একজনকে আমি চিনি,

নাম ‘রোকে ডালটন’। হঠাৎ

হাসিতে খুশিতে মুখখানি তার আরও জ্যোৎস্নাময় হয়ে ওঠে।


মাছে ভাতে বাঙ্গালি

বন্ধু আমার, মাঝে মধ্যে হাওয়া বদলাইতে আসে

দূরের শহর নিউ ইয়র্কে; আমারও তো মন চায়,

ভালো-মন্দ খোঁজখবর করি তার। এক সন্ধ্যায়-রেস্তোরাঁয়

গলদা চিংড়ি আর বিফ-স্টেক খেতে খেতে

আমাদের অভাবী দিনগুলোর কথা বলি, আর

কোনও সুখ সংবাদে খুশিতে ঝকমক করে উঠি!

সোফায় হেলান দিয়ে গল্পে গল্পে আমরা প্রায় মাঝরাতে… হঠাৎ

দোস্ত আমারে কয়, ‘রাত তো অনেক হইলো রে―

আমরা ভাত খাব না ?’

ঘুম ঘুম চোখে আমি ফের রান্নাঘরের দিকে যাই।

———————————

বাঙালি মন-১

দোস্ত আমার নতুন আইছে শহরে

তাও প্রায় বছর ছয় সাত;

মাঝে মাঝে তার মনের কথা কইতে আসে―

খুব সহজেই সে

কালো রে কালো আর সাদারে সাদা

কইতে পারে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে কয়

আসছে মাসে নতুন বাড়িতে উঠতেছি।

জানিস, এলাকাটা খুউব ভালো―

                        একটাও কালো মানুষ নাই।

হাসতে হাসতে আমি কই, দোস্ত―

তাইলে তো তুই হবি ওই মহল্লার

                            প্রথম কালো।


কেউ কিছু বলছে না

বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার খবর কাগজে পড়ে

যারা অল্প অল্প কিছু জানে

ওরা কিছু বলছে না;

যারা সব কিছু জানে

ওরাও কিছু বলছে না, তবে

চোখ কান খোলা রাখি…

জগদীশ, তপন বৈদ্য,

পরিমল ও গোবিন্দ

আমাদের এক ক্লাস সিনিয়র শ্রাবন্তী দি

ওরাও আসছে।

অনেকেই তাড়াহুড়া করে ফেসবুক দেখে,

টিভির খবর দেখে

খবরের কাগজ দেখে, কিন্তু কিছুতেই

মন ভরে না…

যারা এসব দেখে দেখে ক্লান্ত তারাও উদ্বিগ্ন।

দুর্গা ছিন্নমস্তা―

আখিয়া নদীর মতো শান্ত, সর্বশান্ত রীতা রানি কয়,

‘হামার বাড়িত আগুন নাগেয়া দিলে কাঁয়’।

ফয়সাল, আনিস ও আফজাল, এবং

কয়েকজন বি এ পরীক্ষার্থী

ওরাও আসছে।

মানুষেরা বেদনাক্রান্ত।

লন্ডন থেকে কবিতা লিখেছেন শামীম আজাদ

ফিলাডেলফিয়া থেকে কবি বদরুজ্জামান আলমগীর

সাকিরা পারভীন রাত একটার লাইভে সম্প্রীতির সুর ছড়িয়ে দিচ্ছেন

হারমোনিয়াম বাজিয়ে; আর

যারা আজীবন ঘাসফড়িং আর নীলাকাশ দেখে

কবিতা লিখেছেন ওরাও বিব্রত খুব, ওরাও

দুর্দিনে একটা কবিতা লিখতে চায়, কিন্তু হায়!

মানুষেরা বেদনাক্রান্ত।

যারা অল্প অল্প কিছু জানে

ওরা কিছু বলছে না;

যাদের ক্ষমতা অনেক

ওরাও কিছু বলছে না

দূর থেকে কিছু লোক কিছু করতে না পারার বেদনায় স্তম্ভিত।

একরাতে এলোমেলো হয়ে গেল এতগুলো সংসার;

কিন্তু আমি জানি, ভোরবেলা কুয়াশা ভেঙে কিষানিরা ফের

মাঠে যাবে, সন্ধ্যায়

মন্দিরে মন্দিরে শঙ্খ বাজবে,

কমল ও কামাল

প্রসাদ হাতে বেরিয়ে আসবে পূজামণ্ডপ থেকে;

মাঝিপাড়ার জেলে উপিনচন্দ্র দাস

গলায় সুর তুলে গাইবে আবার―

                              জীবনের গান।


এই শহরে যেমন আছি

ভাসান চরে রোহিঙ্গা বসতি,

পরী মনির প্রেম-পিরিতি, বর্ণ-ধর্ম কিম্বা

ট্রাম্পের যত খামখেয়ালি,

যা মনে চায় লিখতেই পারি…।

একটা কাঠবিড়ালি আমার ব্যাকইয়ার্ডে বসে

পাতা চিবায়। আহা রে কাঠবিড়ালি! কপালে তোর

কোনওদিন জোটে নাই চিকেন মাসালা কিম্বা

রেড ওয়াইন…

আজকাল প্রাণের ভিতর

শুধু পদ্মা নয়, মেঘনা নয়, হাডসনও ভিড় করে।

মাঝে মাঝে বড় বেদনায় ভারী হয়ে আসে মন। বেশিদিন

হয় নাই, লেট নাইট কফি শেষে

লং আইল্যান্ড থিকা ফিরতেছি…

নিউ ইয়র্ক পুলিশ চোখ ধাঁধাঁনো বাত্তি জ্বালায়া আমারে কয়,

‘ক্যান আই সি ইয়র আইডি, স্যার ?’ 

চুইংগাম চিবাইতে চিবাইতে মুখটারে বাংলার পাঁচ কইরা কইলো,

‘ডোন্ট ওয়ান্ট টু সি ইউ এরাউন্ড।’

হার্লেম রেনেসাঁ পড়াইতে গিয়া… স্যারে (তখন মনে মনে তাঁরে কালা স্যার কইতাম)

গল্পের ছলে এইরকম বহুত গল্প শোনাইছিলেন…

তার মর্মকথা তখন বুঝি নাই।

আজকাল রাস্তায় রাস্তায় মিছিল দেখি

আফ্রিকান, লাতিনো, এশিয়ান, মাঝে মাঝে শাদারাও

স্লোগান দেয়

‘ব্লাক লাইভস ম্যাটার’

মনে হয়, আমি নীলক্ষেতে খাড়াইয়া

সূর্য সেন আর মহসিন হলের পোলাপানগোর রক্তের গরম দেখতাছি।

অরা ঘরে ঘরে উঁচা গলায় গানবাজনা করে, য্যানো,

দরজা-জানলা ভাইঙ্গা অগো মনের সব যন্ত্রণা

বাইর হইয়া আইতেছে…

আমাকে দেখে দূর থেকে ঝাড়ি দেয় এক কাউলা বেটায়,

‘গেট লস্ট ম্যান…’

হেগো গাইল শুনতে শুনতে কানে তুলা দিছি…

মাঝে মাঝে, মহল্লার দোকানে এটা ওটা কিনি―

আমারে দেখলেই অরা গাইল পারে,

‘গো ব্যাক টু ইয়র কান্ট্রি, পেন্দেহো…’

মায়ে কয়, ‘এক কান দিয়া শুনবি আর এক কান দিয়া বাইর কইরা দিবি;

এর চেয়ে ভালো কিছু আমাগো কপালে নাই।’

বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিনের কথাগুলো ভুলে যেতে চাই, ইচ্ছা করেই,

মন ভালো করা গানগুলো গুন গুন করি; মাঝরাতে

দু-একটা শুকনা পাতা খসে পড়ে

আর ঢিলেঢালা নল থেকে সারা রাত পানি পড়ে

                                         টুপটাপ টুপটাপ…

কিছুই ভুলি না আমি, যেমন করে ভুলতে পারি না

ওই সব চোখের নির্দয় চেয়ে থাকা।

————————-

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button