আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : দিলারা হাফিজ

আই এম আ সিঙ্গেল মাদার

তোমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে বলছি,

অন্য কারুকে ছুঁইনি আমি,

সন্দেহের গুরু রাজা রামচন্দ্রের মতে

আমাকে অবিশ্বাস কোরো না প্লিজ!

একজন প্রার্থিত পুরুষকে খুঁজে পেতে

অপেক্ষা করেছি জনমে জনম—

মর্ত্যের উপলখণ্ড পেরিয়ে তোমাকে খুঁজে পাওয়া এত তো সহজ ছিলো না—২/১টি গাঁড়ল সমুখে পড়েছে বৈকি

সেসব মাড়িয়ে যখন আবার তোমাকে পেলাম

হৃদয়ের সিংহদ্বার খুলে গেলো আপনা আপনি!

প্রণয় নামক একটি শব্দের মধ্যে ঢুকে গেলাম দুজনেই

এক অলৌকিক রস-ব্যঞ্জনার ঘোর বর্ষায়..

অনাদি নেমে এলো আমার অনামিকার সবুজ পান্নায়…

মনে হলো পুরো পৃথিবীটা এবার  আমার একলার হলো

সূর্যের সৌরভ নিয়ে গর্ভে এলো সন্তান

তোমারই বীর্যজ্ঞানে আমি মা হলাম

বক্ষমন্ত্রে ও মাতৃত্বরসে আমি যখন টলটলায়মান

তুমি অন্যতে আসক্ত হলে…

আমি তবু নিঝুম নিশ্চুপ নিজের আত্মবিশ্বাসে :

নিশ্চয় বাৎসল্যরসের আকর্ষণে ফিরবে তুমি অচিরেই

কাজেই আমিও তোমার ফিরে আসার সময় মেপে

উড়াল সুতো ছেড়ে দিলাম—

কেবল স্বামী নও, আত্মার প্রেম তুমি, বন্ধুও তো বটে!

আমি দহনে গুনগুন করি, পান করি চিরতার রস..

আর কত!

একদিনও কাচের মতো ঝনঝন করে ভেঙে পড়িনি

তার সমুখে…

সারেগামার সপ্তকে বেজে উঠিনি কখনও।

কেননা আমার প্রেমের প্রতি অলওয়েজ আমি নমিত ও সমর্পিত সত্যে অপলক ছিলাম

সংসারধর্ম ও সত্যকে জেনেছি জ্ঞান ও ধ্যান…

তোমাকেও তাই!

কিন্তু আর কতদিন!

এই অপমান আর দুষ্টুচক্র ভাঙতেই  হলো একদিন।

আমার সন্তানের পিতার নাম কেউ জানতে চাইলে

নিজেকে মিথ্যে প্রবঞ্চনা ও সম্মানে ভাসাতে চাই না।

আর মুখ ফুটে বলি না যে,

তিনি প্রবাসে আছেন!

বরং আত্মবিশ্বাসী এক দরাজ কণ্ঠে আজ বলতে পারি

আই এম আ সিঙ্গেল মাদার!


মৃত্যুর আগে ঐ প্রেম

(কবি জালালউদ্দিন রুমি স্মরণে)

মৃত্যুর আগে ঐ প্রেম এসে

বলল : আমাকে রাখো :

আমি হেসে বললাম, ছিঃ—কী বলছো এসব তুমি ?

সে বলল : জানোই তো তুমি, আমি খুব ইনোসেন্ট!

হও ইনোসেন্ট, ইতিউতি কিছুতে যে, নেই আমি—

এখন আমি দয়াল-সাধিকা, ভক্তিরসে অধরা

তার কাছে যেতেই পুলসিরাতের পথ খুঁজছি…

সে বললো : আমি হলাম বিরহিনীর মায়া-সাঁকো,

আমাতেই ভর করে, যেতে হবে ঐ দূরের পথ—

দেখো না, শত সহস্র পথচারীর এ-পদচ্ছাপ

আমার হৃদয় তরঙ্গে বয়ে যাচ্ছে যে ঢেউ তুলে।

আমি বললাম—এখন আমার অনেক বয়স,

তোমাকে আমার জানি, নেই আর কোনও প্রয়োজন ?

দৃঢ় কণ্ঠে এবার বলল : তুমি অনিত্য, অনিতা

নশ্বর ও নাশশীল—সহজে ভঙ্গুর দেহলতা…

আমি না থাকলে, পৃথিবী উন্মাদ—কেউ নও তুমি।

আমি আছি বলে, সর্বভূতে উত্তাল—তুমিই হও

ঈশ্বর প্রণয়ে ছোঁয়া চিরন্তন ভাটিয়ালি গান ॥


সবুজ গলিয়ে

সবুজ গলিয়ে চোখের গোলক দুটো

ঢুকে গেল বনের গভীরে…..

পড়ন্ত সূর্যের গোধূলি আলো পিছু নিল তার,

খোল-করতালসহ বেজে ওঠে

মাটির খঞ্জনা,

নবীন পাতাদের কোলাহলে বাজে আনন্দ-করতালি।

শেকড়ের সঙ্গে দৌঁড়-ঝাঁপ, লম্ফ-ঝম্প শেষে

মেপল বীথির ঝরাপাতা মাড়িয়ে দিব্যি তারা

ঘুরে এল পাইন বনের এ মাথা ও মাথা,

কিছু কিছু শস্যের সীমানাপ্রাচীর নেই জেনে

আদিগন্ত সবুজেরা হেসে কুটিপাটি;

ধাবমান মায়াবি হরিণ দেখে

অবাক চোখে চেয়ে থাকে বুনো আপেলের দল।

সেদিনের সেসব শ্রুতি যেন লম্বা এক বনস্পতি

ভোঁ দৌঁড়ে মিলিয়ে গেল

সেণ্ট লরার আদুরে জলের সরোবরে…


সকালের স্বরবৃত্ত

তোমার সঙ্গে বিরোধ আমার লেগেই আছে—শুরু থেকে…

মনের মধ্যে খিটিমিটি,

জলতরঙ্গে কৃপাদৃষ্টি

চিত্রকল্পে কথার খড়গ

শ্বাসাঘাতে প্রণয়-যোগ!

তবু তুমি আষ্টেপৃষ্ঠে

বেঁধে রাখো সবার শেষে।

যখন তখন বাগড়া বাঁধাও সকাল-সাঁঝে

যাচ্ছেতাই ব্যবহারে তুমিও যে কী বাজে!

তোমার পায়ে সমর্পণে যখনই আমি ইচ্ছে রাখি

দূর আকাশে উড়িয়ে দাও অজুহাতের অযুত পাখি।

নিবেদনের আর্তি আমার যায় ভেসে যায় নিরবধি

তুমি ছাড়া শব্দদ্বীপে নেই যে আমার অন্য গতি।


তোমার জন্যে

তোমার জন্যে বিষণ্নকাল কাটাই আমি

এই পৃথিবীর অর্ধবেলা,

বাকি অর্ধ হাতিপাতি, চোখের মধ্যে খুঁজতে থাকি

তোমার হাঁটা-চলা

আজও আমি আশায় থাকি, ভালোবাসার হাত ছাড়ি না,

পা ছাড়ি না তাই

তুষার ক্ষেতে থোকা থোকা বরফ কুসুম উড়তে দেখে

সেদিক ফিরে চাই,

তোমার জন্যে বিষণ্নকাল কাটাই আমি

এই পৃথিবীর অর্ধবেলা,

সুরাপায়ী শব্দ খুঁজি, ছন্দ খুঁজি, পয়ারে পাই

চিত্রকল্পের খেলা

মাত্রাবৃত্তের চালে তুমি বেভুল বালক ভাসালে ফের

কালিদাসের ভেলা

প্রণয় তোমার হৃৎকমলে, শব্দ ক্ষুরধার, ছন্দে তুমি

নাচালে অবহেলা

কী বলব আর, তোমার কথা, খুঁজি আমি পথের রেখা

একলা আমি, এই অবেলা।

তোমার জন্যে বিষণ্নকাল কাটাই আমি

এই পৃথিবীর অর্ধবেলা,

বাকি অর্ধ হাতিপাতি, চোখের মধ্যে খুঁজতে থাকি

তোমার হাঁটা-চলা ॥


কেউ একজন

যখন আমি আর একদণ্ড

অপেক্ষা করব না,

জ্বলন্ত অগ্নি…

তখন বুঝবে তুমি

কেউ একজন ছিলো

তোমার সত্য ও সুন্দরকে পাহারা দিতে…

তোমার কোমল হৃদয়টি যেন ব্যথা না পায়,

শূন্যতার গভীর খাদে পিছলে না পড়ে যাও,

ভুল সুখ খুঁজে অযথা বিব্রত না হও…

কেউ একজন এসব চেয়েছিল তোমার জন্যে

সেই হাহাকারটুকু পড়ে থাক তবু

আমাদের সেতুপথ-জুড়ে।


সন্ধ্যা-মালতী

রূপবতী সন্ধ্যা নেমে এলে

সাঁজবাতি হয়ে ফুটে উঠত সে।

নাম তার সন্ধ্যামালতী

আদুরে ডাক সন্ধ্যামণি…

আজও প্রতি সন্ধ্যায় ভেসে ওঠে মালতীর মুখ।

দেউড়ি বেড়ার এক কোণে ছিলো তার ঘর

শিশুকালের একাকিত্বে সে ছিলো

আমারই প্রাণের বন্ধুগত প্রাণ

দখিনা দরোজায় বিহঙ্গ-কুসুম

রানি কালারের অহংকারী প্রেম।

যতগুলো সন্ধ্যা জীবনের টানেলে

ঢুকে পড়েছিল—তার সবগুলো

সন্ধ্যামালতীর রঙে সেজেগুজে

দাঁড়িয়েছিল প্রান্তবাসী স্টাইলে…

কখন আসবে উন্মুখ রাতের খদ্দের—

ভঙ্গিমাটি ছিলো ঠিক—এমনই

উষ্ণতা-বিধুর।


হারায় যদি কিছু

মানুষ মাত্রের কিছু না কিছু হারায়,

আট কুঠুরির নয় দরোজা তখন

ভেঙেচুরে বেজে ওঠে শরীর,

ইন্দ্রিয় জানান দেয়:

তোমারও হারিয়েছে কিছু—

যেন অদৃশ্য বোরাক!

তখন অচেনা মন হাহাকারে নিঃসম্বল

স্তব্ধ-বধির এক লয় বিচ্ছিন্ন রোদে

শুকাতে দেয় হৃদয়-কুচি…

সময় হারানো যুদ্ধ শেষে

মনে পড়ে যায়:

আমারও কি সময় খুব আছে বেশি ?


ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্যে এলিজি

বৃক্ষেরা বাকল ফুঁড়ে

অস্থির বেরিয়ে পড়ছে দলে দলে,

তারা সব যুদ্ধে যাবে,

ফিলিস্তিনি শিশুদের বাঁচাতে,

সময় ছেঁদন করছে রাতের

কাঠঠোকরা পাখি

কখন ভোর হবে—যুদ্ধে যাবে—

নদী ও জ্যোৎস্নার-তরুবীথি—সৈন্য-সামন্ত যত

বন্য ঘোড়া—সুন্দর বনের হিংস্র-চোখের বাঘ

যুদ্ধে যাবে তারাও

চিত্রল হরিণেরা সভা করছে গোলপাতার ছায়ায়

ভাবছে, তাদেরও কি  যাওয়া একান্ত জরুরি ?

শিশুদের কোমল বুকে এই রক্ত-বৃষ্টির নৃশংসতা

এই শক্তিশেল নিক্ষেপের গর্জন সত্যি অসহ্য প্রাণ।

যুদ্ধের বল্কল পরে পুরো মানবপ্রজাতি

খুঁজে ফেরে তার যুদ্ধংদেহি মনের দুর্বার শেকড়

কোথায় পালালো শেকড় ?

লাভে, লোভে ও মাৎসর্যে ?

কিংবা ন্যায় নীতির ব্রেকাপে এই উল্লম্ফন ?

এই গ্লোবাল ভিলেজে কিছুই পারম্পর্যহীন নয়

ভেদ-বুদ্ধির এই প্রযুক্তি সংসারে—

না সমাজ, না রাষ্ট্র, না ধর্ম, না বর্ম…

তাহলে কে কে যাবে এই ন্যায়যুদ্ধে—

ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার না হোয়াটস ?

কে হবে আগামীর সমরনেতা ?

———————-

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button