আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : গোলাম কিবরিয়া পিনু

হৃদয়

হৃদয় না থাকলে

মস্তিষ্কের কাজ,

     মানুষের কোনও কাজে আসে না!

সেইখানে যে এতটা দুর্দশা

            সেখানে কি হৃদয় আছে ?

উদ্গীতিও উদ্গীর্ণ হলেও―

     উদীয়মান সূর্যের আলো

        জীর্ণঘরে পৌঁছে না,

             যদি বা হৃদয় না থাকে!

সুনীতিও তো পাহাড়ের হৃদয় থেকে

উৎসারিত হয়ে

       ঝরনার জলে রূপান্তরিত হয়!

স্পৃহা, আকাক্সক্ষা ও অভিরুচির সাথে

          হৃদয়ের যোগ না থাকলে,

প্রবৃত্তিকে নিয়ে মস্তিষ্ক

ভূকম্পবলয় সৃষ্টি করতে পারে,

   ঘরবাড়ি তখন টিকতে পারে না!

কারসাজি, ছলচাতুরি ও কূটকৌশলে

যতটুকু মস্তিষ্ক থাকে,

হৃদয় না থাকলে তা হয়ে ওঠে ভয়াবহ!

দায় ও কর্তব্য যেখানে উঁকি দেয়

সেখানটায় ঝুমকোজবা ফুটতে থাকে বলে,

বাগানের অন্যান্য ফুলেরাও খুশি হয়।

সততা ও কল্যাণ নন্দনকানন থেকে

         নন্দনের কাছে চলে আসে!

হৃদয় থাকে বলে অগ্নিকাণ্ড ছড়িয়ে পড়ে না―

হৃদয়ের জন্য মস্তিষ্কের প্রবেশদ্বার

         সবসময় খুলে রাখতে হয়!


উঁচু পর্বতের জল

তুমি তেমন একটা পাহাড় হও

      যে পাহাড়গুলো শীতকালে

           বরফ জমিয়ে রাখে!

সেই বরফ গলে জলধারা নেমে আসে

অন্য ঋতুতেÑগ্রীষ্মকালে-বসন্তকালে,

             না হলে নদী শুকিয়ে যেত,

চারণভূমিতে বীজবোনা ও ফলনের স্বপ্ন

                 ―বেঁচে থাকত না!

তুমিও তেমনি হও আমার জন্য―

আমি যেন তুরীয়ানন্দ ও প্রণয়তৃষ্ণায়,

সমুদ্রের জল বাষ্প হয়ে থাকা―বরফ হয়ে থাকা

         উঁচু পর্বতের জল পাই!

অগ্নিদগ্ধ ও মনভাঙার দিনে―

কাঁকুরে―পাথুরে মাটি ভিজিয়ে তুলতে পারি!


ইচ্ছেশক্তি

যিনি নিজের ভেতর বিপ্লব ঘটাতে পারলেন না

তিনি নিজে বিপ্লবী পোশাক পরে আছেন!

এঁটো খেয়ে ইতরামি হবে

                   বিপ্লব হবে না!

এঁটেল মাটিতে লাঙল চালাতে হলে

         পায়ে জোর লাগে,

বন্ধ দোর খুলতে হলে

      হাতে জোর লাগে!

নিজের বোতলে নিজেকে আটকে রেখে

নিজেকে মুক্ত করতে পারোনি,

     অন্যকে কীভাবে মুক্ত করবে ?

ইলিশ মাছ ধরতে হলে―

       পদ্মার ঢেউয়ের ভেতর থাকতে হয়,

অনুদাস হলে ইচ্ছেশক্তি―

হাত চুলকাতে চুলকাতে শেষ হয়ে যাবে!


নিজের কাছে

নিজের কাছে নিজে স্পষ্ট হও

ভেক ধরে নেক নজরে আর কত থাকবে ?

নিজের কাছে কতটুকু সৎ থাকো ?

কুক্কুটও ডাকে ভোরবেলায়

              শিয়ালের ডাক নকল করে!

ছিদ্রানুসন্ধানী হয়ে ওঠ―

        নিজের ছিদ্র দেখতে পারো না!

নিজের কাছে নিজে কতটুকু সৎ থাকো ?

আত্মপ্রতারণা প্রতারণার পরগনা বাড়িয়ে তুলছে!  

দেখো, বেলফুল ফুটে আছে

          বেলগাছ অস্পষ্ট হয়ে নেই! 

দেখো, সজনেফুল ফুটে আছে

          সজনেগাছ অস্পষ্ট হয়ে নেই!

দেখো, জুঁইফুল ফুটে আছে

          জুঁইগাছ অস্পষ্ট হয়ে নেই! 

তুমি যে কখন কী হয়ে ফুটে থাকো!

যার সঙ্গে রাতবেলায় এক বিছানায় ঘুমাও,

সে-ও সকালে উঠে তোমাকে চিনতে পারে না!


সুধাকর

ও সুধাকর!

     তোমার দ্যুতিতে

           আমিও স্পর্শকাতর!

পাথর হয়ে থাকতে পারি না পাহাড়ে! 

স্পেনে থাকলেও স্পৃহা জাগে

     হিমালয় পাদদেশে থাকলেও,

      এমন কি সুন্দরবনেও!

সবখানে তোমার প্রভা ও উদ্দীপন

আমিও তাতে পরিস্ফুট হয়ে থাকতে চাই!

তুষার ঝড় ও ঊর্ণা মেঘ

আমাকে কিছুই করতে পারে না

      বায়ুগতিবিদ্যা জানি আমিও!

সুখবেদনা মিশ্রিত এ-জীবনে

       সুখসাগরে বেশি সময় না ভাসলেও

সুখসাথী হয়ে আগামী সময়ে 

তোমার প্রভায় ময়ূখ হতে চাই,

             ময়ূরের পেখমমেলার আনন্দে!


নিজের ডার্কসাইট

নিজের ডার্কসাইট দেখি না!

      সেখানে ফেলি না কোনও আলো!

স্যাঁতসেঁতে জায়গায় আমার অনেকাংশ পড়ে আছে,

কালিঝুলিপূর্ণ! পরিষ্কারও করি না!

সেখানে গন্ধমুষিক হাঁটাহাঁটি করে!

নিজ হাতের ওপর থুতনি রেখে

           নিজের ডার্কসাইটে মেলি না চোখ!

আমিও তো ধিঙ্গি!

ধূর্তামি ও ফেরের ফন্দিতে

                আমিও ভুঁইফোঁড়!

শঠতা ও জুয়োচুরিতে করি কারসাজি!

নিজেরও ঘাড় মটকিয়ে রাখি মটকায়!

ডার্ক এনার্জিতে তা তলিয়ে যায়!

ব্লাকহোলে ঢোকার পরও

                 সংবেদ নেই!

দৃকশক্তি ব্যয় করি কীসে ?

বাদ্যযন্ত্র বাজাতে বাজাতে

কতটুকু দৃশ্যমান করি পর্বতের চূড়োয় নিজেকে!


রূপশালী

আমরা রাজবংশ থেকে

      রাক্ষসবংশে রূপান্তরিত হচ্ছি!

ওদের অংশী হতে

বংশী নদীতে সাঁতার কাটছি!

সাঁতার কাটতে কাটতে

          রূপসাগরে গিয়ে ডুব দিচ্ছি!

অতঃপর হচ্ছি রূপশালী

  নিজেকে আর চিনতে পারছিনে!

পালন করছি যে হিতব্রত

তাতে হিতাহিত জ্ঞান থাকছে না!

হিজলের বনে 

সৌন্দর্য উঁকি দেওয়ার বদলে

                 ―হচ্ছে বজ্রপাত!

তারপরও বনরক্ষাকর্তারা

            নদীরও কূলে কূলে,

রক্ষঃকুলে নেচেগেয়ে মশগুল!


দৃষ্টিসুধা

দৃষ্টিদ্বার খুলে

কতটুকু আমাকে দেখতে পেয়েছো ?

কীভাবে দৃষ্টিপাত করেছো ?

অরণ্যের ভেতর বৃষ্টিপাতের ভেতর

               কখনও দেখোনি!

 চৈত্রের গনগনে তাপেও

                 আমাকে দেখোনি!

শুধু ঘরের ভেতর দেখলে!

দৃষ্টিবন্দি হয়ে থাকতে থাকতে

আটকে রয়েছি তোমার দৃষ্টিবিন্দুতে!

এর মাঝেই কখন যে―

কুমারী থেকে পূর্ণবয়স্ক নারী হয়ে উঠলাম!

সেই একই দৃষ্টিভঙ্গিতে

দৃষ্টিবিভ্রম নিয়ে

       আমি সেই যুগ যুগ ধরে

স্থির প্রকৃতির অসহায় গাছ হয়ে থাকলাম

              ―তোমার অরণ্যে!

আমার প্রকৃতি উন্মোচিত হলো না

দিগন্তপ্রসারীও হলো না!

আমিও অভেদ হয়ে থাকলাম

           দৃষ্টিভেদ হলো না এখনও!

শুধু দৃষ্টিসুধা নিয়ে ক্ষুধা মেটালাম।


মহাপ্রাণ 

আগুন ও ধোঁয়া বিচ্ছিন্ন নয়―

           আমি এখন আগুনে নেই,

               ধোঁয়ার ভেতর!

আগুনের তরঙ্গ তসরুপ করে নিয়ে গেল কারা ?

আমি তাকিয়ে তাকিয়ে থাকলাম―

            অবশেষে অবশিষ্ট ধোঁয়ার ভেতর!

তক্ষশীলার ভেতর যে আগুন ছিল,

     সে-নগর ধ্বংস হওয়ার সাথে সাথে

       সেখানকার আগুনও লুপ্ত হলো!

আমি তো এখনও বেঁচে আছি

আমার আগুন কেন লুপ্ত হবে ?

হাত কচলালে আগুন তৈরি হয় না

বদ্বীপে বধির হয়ে থাকলেও আগুন তৈরি হয় না,

অনুগ্রহ নিয়ে যে আগুন জ¦লে

            তাতে শুধু খড়কুটা জ¦লে!

আমরা এখনও―

খড়কুটার আগুন নিয়ে চলছি যেন!

যে আগুন উদয়গিরির আগুন নয়―

     সে আগুনে তেতে ওঠা যায় না

           সে আগুনে তাতানো যায় না

                 সে আগুনে ঝলসানো যায় না!

শ্রেয়ত্ব আনতে হলে―অগ্নিকুণ্ড হতে হয়!

আগুনের আঁচ ও হলকা না থাকলে

       অগ্নিপ্রভা হওয়া যায় না!

            কলঙ্ক ও কালিমা মোছা যায় না!

খানিক আগুনে জুমচাষ হয় না

অরুণোদয় হয় না,

      দয়ার আগুনে মহাপ্রাণ জাগে না!


কূটনৈতিক মিশনের লোক নই 

ছলাকলা-কপটতা-ফন্দিফিকিরের

          পূর্বজ্ঞান দরকার নেই,

                   উত্তরজ্ঞানও!

সরলতা নিয়ে-সরল রাস্তায়

        যতটুকু চলা যায়,

            আমাদের সেটাই সৌন্দর্য!

পাখা লাগিয়ে উড়তে―

       পারঙ্গম না হলেও চলে,

আমি তো মুকুটধারী রাজা নই

সিংহাসন রক্ষা করতে হবে!

তোমার সাথে যে সম্পর্ক

           তা যত খোলতাই হবে,

ততই আলো ও রোদ এসে পড়বে উঠানে

চারাগাছগুলো হয়ে উঠবে তরতাজা।

তোমার সাথে চুক্তির কোনও বালাই নেই―

বিশ্বাস ও আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে আছি

              পাহাড় চূড়োয়!

ভূকম্পন টলাতে পারবে না―

ধুরন্ধর হলেই অন্দরমহল চুরমার হয়ে যাবে!

সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে

পা ফেলা ও কথা বলা তো কূটনৈতিক সম্পর্ক,

তোমার সাথে সে সম্পর্ক নয়!

              কৌশলে কৌশলে

শুধু স্বার্থ উদ্ধারের পর―তা নৌকা ভর্তি করে নিয়ে

নদী পার হতে পারব না!

দূত ও কূটনৈতিক মিশনের লোক নই―

রাগ, অভিমান ও সরলতা থাকবে আমাদের;

শুধু কূটনীতির কারণে ঠোঁটে হাসি রেখে

        দুঁদে হয়ে আরও খুদে হয়ে যাব কেন ?

————————

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button