আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : বদরুজ্জামান আলমগীর

নিউ ইয়র্ক মেটাফোর

তড়িঘড়ি ভুল বাসে উঠে পড়েছে লোকটা,

সে ঠিক চেনাজানা আর পাঁচ দশটি লোক বুঝি নয়

ইচ্ছেমতো চাবি ঘোরায় হাওয়ায়, অলীক দক্ষিণায়

কাঠফাটা রোদ্দুরে সে যাবে বলে অবেলার ধুলায়

চড়ে বসে পালতোলা নৌকোয়, যদি যেতে চায়

হাওরে জলাশয়ে মেঘ মেশানো সাবেকি শিশুপাড়ায়

দিব্যি সে উঠে বসে ভটভটি স্কুটারে, রিক্সায়।

যেখানেই বনৌষধি ওলটকমল স্মৃতি সত্তা ভবিষ্য মোহর

শেষাবধি মাথা তোলে উন্মাতাল টুইন টাওয়ার

যাবার তো কথা ছিল পাতাঝরা মানিকগঞ্জে

প্যারিস, টোকিও, বেইজিং না হয় ঢাকা, বা কলকাতায়।

কিন্তু যেখানেই নামে সে ওখানেই নিউ ইয়র্ক

নাকি নিউ ইয়র্ক হয়ে পড়েছে কোনও অজানা মোহনায়

মানুষের বাড়ি বাড়ি যাবার ডাকপিয়ন এক!

কবিতার বারামখানায় কী তুমি খোঁজো আজ

নিরালোকের দিব্য পরানে রাধার ঘাটে সন্ধ্যাখোঁটা পাখি ?

কুয়াশা ঝাপটায় সিলভিয়া প্লাথ, বেদনার ডাটাবেইজে

একলা বেতফলের মোড়ে জীবনানন্দ ঢাকা কী কলকাতায়,

বস্ত্র নেয় যার চিকন কালায়, নৈর্ব্যক্তিক নিউ ইয়র্কের

নৃত্যবতী লীলাতীর্থ ময়ূর ও তার অগ্নিকেশর মায়ায়।


বসন্তবাহার

নিসর্গে বসন্ত আসতে আচমকা বৃষ্টির ছাঁট লাগে

অভিজ্ঞানে স্ফুরণ আনতে চোখের জল পড়ে ভাগে।

কে কড়া নাড়ে, এতটা বেপরোয়া দিব্যি অচেনা ?

হুড়কো খুলে দেখি রাষ্ট্র নামের নির্নিমেষ এক সেনা।

রাত্রির পাটে দেখাই জামার নিচে জ্বলে ধুলার জমাট

ভিক্ষু শমন হিমালয় থেকে ডেকেছে সন্ন্যাসীর হাট।

নদী পরিপূর্ণ গঙ্গা পার্বতীর নীল পায়ে পায়ে ঘোরে

বিসমিল্লাহ খান সানাই বাজায় মেঘমল্লার সম্ভারে।

পিচঢালা পথের আবাহনে তার ঝরকা কাটা সঙ্কটে

কালের মন্দিরা সময়ের নির্বিকারে বসন্ত হয়ে ফোটে।

হাতের তালুতে জমেছে দেখো ইতিহাসের শুচিবাই

অন্তরালের ঘরে এসো বধূ গো বোলো না যাই, যাই।


ঋতুবিদ্যা

শেষপর্যন্ত যা চেয়েছিলাম তা পেয়েছি আমি

দেখতে চেয়েছিলাম তুমি কথার ঝাড়বাতি হয়েছ,

নীরবতার লেপামোছা মাঝঘর হয়ে রবো আমি,

আর শিকড় ছড়ানো গাছ এক―যুগ যুগ দাঁড়িয়ে থাকব পায়ের ওপর, কেবল মাথার চুল করবে শনশন।

ঋতুবিদ্যার অছিলায় যা-ই ভাবি, বিধি লেখেন বাম―

আমি গৃহস্থ নিম্নমধ্যবিত্ত শাকপাতা ছেলে,

আমার কেন ঘোড়ারোগ―শিউরে উঠে কেন শুনব

ট্রেনের চাকার নিচে চাবুকের হিসহিস―

ছলকে ওঠা আগুনের রবিনহুড, দস্যু ফুলন দেবী ?

এভাবেই সব ফলিত বিদ্যা বিফলে যায় আমার

যখনই দেখি তোমার দেহ ভেঙে তোলা হলো

একশোটি এক্স-রের প্লেইট।

আর তুমি মোরগঝুঁটির মতো কেঁপে কেঁপে মরণকুটো

ধান ভানলে ছিটকে বেরোয় খয়েরি চালের নুড়ি

আগুন ভানলে শঙ্কিত মৃত্তিকায় মুখ তোলে জলের কুঁড়ি।


পুনর্জন্ম

যেসব কথার কোনও উজির নাজির মাথামুণ্ডু নাই

আজকাল আমি সেই সব কথা বিশ্বাস করি,

তাদের কথা আমি এলেমে তুলি―যারা হরহামেশাই

বানিয়ে কথা বলে―যারা বলে আমি আমার আগের

তিন জন্মের কথা মনে করতে পারি। তোমাকে আবার দেখবার আশায় বেবাক আবোলতাবোলে হাট করে বসি, দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা টলে রাত অবধি বসে থাকি, উঠি না―বসেই থাকি।

পুনর্জন্মের এই সব তালিবালি বিজ্ঞানের সাথে মিশ খায়

কী-না তা তলিয়ে দেখার কোনও গরজ আমার নাই।

বিড়ালের চোখের দিকে দেখি, সেদিন চিড়িয়াখানায়

তীব্র বাঘের কপালের মসৃণতা মনে হয় হাত দিয়ে দেখি―মনে হয়, এ বাঘ নয়―আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইটি বুঝি!

আমি সরে যাচ্ছি, পড়ে যাচ্ছি পথের তরিকা থেকে

ঝুঁকে পড়ছি চিত্রনায়িকা সারিকার দিকে। পয়ার মিলাতেই সারিকা নামটি বললাম, সিনেমা দুনিয়ায় সারিকা বলে কেউ আছে কী-না আমার আদতেই জানা নাই।

ধরো আমি একটা শিশু হয়ে যাই―আচার প্রথা ধ্যান জ্ঞান

কোন কিছুই জানা নাই আমার, দুধের সরের ওপর

কালো মাছি উড়ে এসে বসি, তারেও কৃষ্ণ নামে ডাকা যায়―

আমি তার কিছুই জানি না, পুনর্জন্মের কিচ্ছাকাহিনির মতো এক লাফে আমার সামনে এসে পড়ো, আমি যে খালি একজন শিশু, তোমার ব্রজপাড়ায় পথ হারিয়ে তোমাকে ফের দেখার আশায় তিন সন্ধ্যার মুখে রইয়া রইয়া পথ চেয়ে থাকি―লোকে বলে তুমি নাকি চলে গ্যাছো সাত তবক আসমানের ওপারে হাওয়ার ধাঁচে, সিদরাতুল মুনতাহা গাছের পাতা কম্পনের কাছে।


নাকফুল

প্রতিদিন ঘুম ভেঙেই কম করে হলেও

একটা মৃত্যুসংবাদ পাই আমি,

অথবা মৃত্যসংবাদের কথা শুনেই

ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠি।

আমরা যেমন গুড মর্নিং কথাটা বলতাম

নয়তো বলতাম সুপ্রভাত―

ওই চলটা বুঝি উঠে গ্যাছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে

ঘাটের মড়ার কথা বলতেও

কেমন একটা উৎসব উৎসব ভাব এসেছে,

যেমন ম্যারেড কথাটার চেয়ে ডিভোর্সি

স্ট্যাটাসের জেল্লা হয়েছে অনেক বেশি।

নতুন জন্মেছে কেউ―কথাটা কেমন ঝুঁকিপূর্ণ,

কেউ সরেছে―জিনিসটাই বরং স্বস্তিদায়ক।

মৃত্যুসংবাদের চাকচিক্য দিয়েই

প্রতিটা দিন শুরু হয় আজকাল―

আজও তার অন্যথা, ব্যতিক্রম হয়নি,

মৃত্যুসংবাদই কালের অলঙ্কার, বিজয় নিশান।

ইন্তেকাল সত্যিই বিমর্ষ নয় আর

বরং উপহারের বাকশ যেমন একটি সুশোভন

ফিতায় মোড়ানো থাকে―আমাদের প্রতি সকালে

মৃত্যুসংবাদও তেমনি মনোরম ফিতায়

মোড়ানো উপঢৌকন এক,

চলো মন, নাকফুল খুলে রঙের হাটে যাই।


ডোনাল্ড ট্রাম্প

এ আর নতুন করে বলার তেমন দরকার পড়ে না

রাক্ষস সাম্রাজ্যবাদী পুঁজির যে বাসনকোসন

তার বিচারেও সে বিনাবক্যে পরিত্যাজ্য

কিন্তু এই দানবেরও মহৎ গুণ আছে।

মহৎ গুণ কোত্থেকে এল―এ কি তার কুলীন সুশীল

পারিবারিক শিক্ষা, কোন ধরনের ধ্যান জ্ঞান ?

তা কিন্তু নয়, সোজাসাপটা জালিম―জালিম এক।

জো বাইডেনই বা কী এমন হাবাং ?

জালিম পাষাণ হবার গুণ কী―গুণ হলো

রাজনীতি নিয়ে এত পলিটিক্স তার জানা নাই,

এগুলো নিয়ে তার মাথাব্যথাও নাই।

যা তার পেটে আসে, তাই আসে গলায়, তাই তার মুখে।

যেমন তার একটা কথা আমার কাছে রীতিমতো বেদবাক্য : আমি প্রেসিডেন্ট, কথা সত্য―কিন্তু আমাকে

তোমাদের আসমানি দৈববাণীর আমদানিকারক মনে করার কোনও কারণ নাই,

সত্য কথাটি বলি শোনো―আমি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট,

আমি একজন চিয়ার লিডার; মাঠে খেলা হচ্ছে―

আমি মাঠের সাইডে রংচঙা ড্রেসে নাচি, নর্তন কুর্দন করি।

কোয়ার্টার ব্যাক বলটা মারে, ওয়াইড রিসিভার ধরে

টাইট এন্ড শুয়রের শক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে―স্কোর চাই, কারও না কারও স্কোর করতেই হবে।

আমি মাঠের বাইরে চিৎকার করি, নাচি, অঙ্গভঙ্গি করি

চিৎকার করে মুষ্টি পাকাই―আমি যে চিয়ার লিডার।


গুম

এভাবেই শব্দ, শব্দের মর্মার্থ আমূল বদলে যায়।

তোমার পালান বদল হবার পর থেকে

ইচ্ছায়, কী অনিচ্ছায় শব্দের ভার ও মহিমা

বদলে গ্যাছে আমূল, শব্দের দয়ামায়া

আত্মীয় অনাত্মীয়তা বেমালুম পালটে গ্যাছে।

মুক্ত হাওয়ায় ঘুরে বেড়ানোকেই এতদিন

নিশিকল, স্বাধীনতার আকর বলে জেনে এসেছি―

গুম খুন, হাজতবাসকেই জেনেছি জীবনের নাল্লত।

কিন্তু তোমার বদলে যাওয়া আমাদের ভাষাকেই

কবন্ধ করে দিয়েছে, ভাষার সিঁথি থেকে

মুছে গ্যাছে সিঁদুর, হাত থেকে পড়ে গ্যাছে সোনার বালা

আর আমি হয়ে পড়েছি ভূমিহীন রাস্তার ছেলে।

ধরে নিচ্ছি―আমাকে ছুড়ে ফেলার ভেতর দিয়ে

আমাকে তোমার প্রত্যাখ্যানের গরিমায় তোমার

জিৎ হয়েছে, তুমি নাচের মুদ্রায় যে-ই নিজেকে

পরিপ্রেক্ষিতের কাছে আলোর তকমায় মেলে ধরছ,

তুমি যাকে আলোকবর্তিকার সমান্তরালে স্ফুরণ আর গৌরব ভেবে কালের পাড়ঘাটায় বসে তালিয়া বাজাও,

মৌলে তুমি বিচ্ছুরণের নামে কাদা থিকথিকে হয়ে গ্যাছো

আসলে তুমি আলো ঝলকানির ভিতর গুম হয়ে গ্যাছো।

——————-

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button