
ক্যাম্প ফায়ারের স্মৃতি
সন্ধ্যার আলো-আঁধারি ঠোঁটে ঝুলে আছে তৃতীয়ার চাঁদ
মন টানে, রঙিন সুতোয় গেঁথে নিই তোমার সহাস্য মুখ
যেন আজ বিজুলির ছটা―চমকে চমকে জাগে অপহৃত
যৌবনের দিন! প্রিয় প্রাণ ধরা দিতে চায় নতুন বন্ধনে;
ও গোলাপ, যৌবন উন্মুক্ত করো―প্রেমের আলোর মতো
ফুটুক সকাল! গা করি না নিন্দামন্দ; পিপাসার্ত ঠোঁট
ভিজুক, ভিজুক তবে বন্দনার উষ্ণ স্রোতে…তারাজ্বলা
রাত… বনের গভীরে আঁকে ক্যাম্প ফায়ারের স্মৃতি!
বুনো গন্ধে শাল-পিয়ালের বন লেখে রাতের উদ্ধৃতি!
প্রিয়ংবদা, পাঠ করো, যত সব দেহের বিন্যাস আর তীব্র
আলোড়ন! এই তবে নৃত্যকলা, এই তবে যৌবনের রং
এই তবে পুণ্যস্মৃতিগন্ধমাখা প্রণয়কাহিনি―খুলে যায়
পাঠে পাঠে পাতায় পাতায় যত সব অভিব্যক্তিবাদ
সন্ধ্যার আলো-আঁধারি ঠোঁটে ঝুলে আছে তৃতীয়ার চাঁদ

যে যায় সে যায়
যে যায় সে যায়, ফেরে না কখনও, কোনওকালে!
এই যে উঠছে রোদ, ভেঙে পড়ছে মেঘের মিনার
ছায়ানৃত্যে সময় গড়ায়…কী অদ্ভুত মায়াবি
সময়! অথচ এখানে, এই পৃথিবীতে কথা ছিল
ঝাঁকে ঝাঁকে উড়বে পায়রা; প্রজাপতি পাখা মেলে
পুষ্পশরে গেঁথে নেবে হৃদয়কুসুম; জোনাকিরা
আলো জ্বেলে দেখাবে দূরের পথ, যতদূর চোখ
যায় ততদূর সুনীল আকাশ, আমাদের প্রিয়
প্রেমঘর; মাঝে মাঝে ভুল স্বপ্নে জেগে উঠি!
নিদ্রার ওপারে কারা তবে তাড়া করে সশস্ত্র
হুঙ্কারে ? এই পৃথিবীর কাছে আমার অশেষ ঋণ;
আমি তো শব্দের জাদুঅলা, দু হাতে ওড়াই রুমাল
শান্তির; তবু কেন পা জড়ায় অদৃশ্য জালে!
যে যায় সে যায়, ফেরে না কখনও, কোনওকালে!

শ্রাবণ মেঘের গান
ভুল স্বপ্নে জেগে উঠি বারবার―তবে মিথ্যেকে করি না আর ভয়
ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয়ে লিখে যাই প্রতিদিন বিমূঢ় বিস্ময়! তীর ভাঙে
জল থইথই! ধসে পড়ে সভ্যতার টিকি; সত্য বলে কি না
ডেকে ওঠে দেয়ালের টিকটিকি! মাথা তুলে তাকাতেই লেজ
ফেলে মুহূর্তে উধাও! এরকম দৃশ্যপট দেখে দেখে কেটে যায়
মানবজীবন―যতিচিহ্নহীন! অন্ধকার, বড় বেশি সন্দেহপ্রবণ
কারা তবে খেলা করে ঘরের আড়ালে ? হাঁটে খুব পায়ে পায়ে!
সবুজ-বৃত্তান্ত জেনে মাপে পথ মন-মহাজনÑঘাটে বাঁধা তরি
‘উঠে বসো, নিয়ে যাই বনের গহিনে’; নদীঅন্তঃপ্রাণ ডুব দেয়
ভাবের নদীতে; সাঁতারের জল ঠেলে তীর খোঁজে মৎস্যকুমারী!
যৌবনের রং দেখে বুকে তুলে নিতে চায় সব প্রণত পুরুষ
ঝিরিঝিরি শ্রাবণের বৃষ্টি; গমকে গমকে কাক্সক্ষা বেড়ে ওঠে
‘এসো আজ বুক বাঁধি; সোনালি ফসলে ভরে তুলি প্রিয় ঘরময়’
ভুল স্বপ্নে জেগে উঠি বারবার―তবে মিথ্যেকে করি না আর ভয়

হেমন্তে শীতের কবিতা
হেমন্তে শীতের কবিতাটা যদি লিখি, পড়বে তো ?
শীত মানেই তোমাকে দেখা : পার্পেল রঙের
কার্ডিগানে ঢেকে রেখেছো শরীরী বিভা;
কথার উষ্ণতা যেন ভোরের সোনালি আলো!
হেমন্তের মাঠ থেকে যে ডাকে ইশারা-ভাষায়
তাকে ঠিক ঠিক বলেছি তোমার গল্প; অল্পতেই
তুমি ঘেমেনেয়ে কী যে একাকার হতে! তোমাকে
ছুঁলেই মেঘে-বিদ্যুতে জ্বলে উঠতে ওষ্ঠরেখা!
ঝাউবনে লেখা হতো প্রত্নপ্রেম পাতায় পাতায়…
মনে আছে নদীটার কথা ? জলস্রোতে ভেসে যেতে
যেতে কী অদ্ভুত ডুবসাঁতার… হংসমিথুন যেন
হেমন্তে শীতের কবিতাটা পড়ে নিয়ো, সময়ের
ফেরে যদি আর দেখা না হয় কখনও প্রেমের দিগন্ত!
হেমন্তে শীতের কবিতাটা যদি লিখি, পড়বে তো ?

একটি সাধারণ রূপকথা
এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার দু রানি। বড় রানির পাঁচ কন্যা আর ছোট রানির সাত কন্যা ও এক রাজকুমার। সময়ে-অসময়ে রাজার ঘরে ডাক পড়ে ছোট রানির। এ নিয়ে বড় রানির দুঃখের অন্ত নেই। বড় রানি ভাবে : রাজা মহাশয় আমাদের এত অবহেলা না করে দূরে কোথাও নির্বাসন দিলেই পারেন কিংবা আমাদের অস্বীকার করুন। ছোট রানি অর্থাৎ রাজকুমারের মা বলে কথা! অহংকারে তার পা মাটিতে পড়ে না। কথায় কথায় মেজাজ দেখান। ছোটর গোসলের পানি সময়মতো না হলে রাজবাড়িতে ঘটে যায় লংকাকাণ্ড। ছোট রানির ভোজন, সে এক এলাহি ব্যাপার। তিন রকমের মাংস, পাঁচ রকমের মাছ আর মিহি চালের ভাত না হলে তার চলেই না। খাবারের পরপরই চাই দশ রকমের তাজা ফলফলাদি। ছোটর এই বাড়তি যত্নআত্তিতে রাজমহলেও চাপা অসন্তোষ। রাজার এই একচোখা নীতিতে প্রজারাও ক্ষুব্ধ। বড় রানির সঙ্গে প্রজাদের আপাত কোনও তফাত নেই। প্রজাদেরও দিন কাটে নানা দুঃখ-কষ্টে। প্রজারা বিদ্রোহের কথা ভাবে। কিন্তু রাজার রক্তচক্ষু ওদের শাসায়। বড় রানিরও সাহস নেই প্রতিবাদের―কখন আবার শূলে চড়ায়! রাজপথে সৈন্য-সামন্তের কড়া টহল। দিন দিন বাড়ছে এই স্বেচ্ছাচারী রাজার সাম্রাজ্য। বাড়ছে প্রজা আর বড় রানির কষ্টও…
বড় রানি স্বপ্ন দেখে : তার মহলেও আসা-যাওয়া শুরু করেছেন রাজা মহাশয়। নিচ্ছেন খোঁজখবর। কদর বাড়ছে কন্যাদেরও। দীর্ঘ খরাকাল কেটে যাচ্ছে। আকাশে চলছে মেঘ-বৃষ্টির খেলা। প্রজাদের গোলা ভরে উঠছে সোনালি ধানে। আর শুকনো নদীগুলো খলবল করছে পানিতে। জলতরঙ্গে অজস্র মাছের দাপাদাপি। রাজা নেমে এসেছেন রাজপথে। প্রজাদের সঙ্গে মেলাচ্ছেন বুক। আর খোশগল্পে ভীষণ মত্ত দু রানি। হাসতে হাসতে একে অন্যের গায়ে লুটিয়ে পড়ছেন। জীবন যেন সত্যি এক পালতোলা নৌকো …ভাসছে… দুলছে… উড়ছে…
বড় রানি ছোট রানি রাজা মহাশয় আর প্রজাদের এই সাধারণ গল্প বারবার ঘুরেফিরে আসে…

রক্তাক্ত ফিলিস্তিন
মুহুর্মুহু পড়ছে বোমা! অন্ধকারে ছলকে উঠছে গগনভেদী আলো!
থমথমে রাত! জ্বলছে শহর! জগৎবাসী―হৃদয় এবার জ্বালো!
মরছে শিশু, নারী-পুরুষ, খাবার-পানি কিচ্ছুটি নেই!
রাফা ক্রসিং বন্ধ রেখে মারছে মানুষ অনাহারে, রক্তখেকো
দখলদাররা, দখলদারি বছর বছর, যখন-তখন হত্যাযজ্ঞ
দয়ামায়া একটুও নেই! কে দেখাবে দয়ামায়া ? অস্ত্র পাঠায়
জগৎমোড়ল―জোগায় সাহস সঙ্গীরাও; হুঙ্কার দেয় হানাদারের
পক্ষে থেকে! ‘গাজা এবার শেষ করে দাও! গাজাবাসী বাড় বেড়েছে!
গুঁড়িয়ে দাও বাড়িঘর সব! হাসপাতালে হামলা চালাও!
ফিলিস্তিনে মানুষ তো নেই, আছে কেবল কীটপতঙ্গ!
হামলা চালাও মুহুর্মুহু, বোমা ফেলো যত্রতত্র, বাদ যাবে না
মসজিদ-গির্জা, শরণার্থী ক্যাম্পগুলোও! শেষ করে দাও!’
নিন্দা জানায় জাতিসংঘ, শান্তিকামী মানুষেরা; নেই পরোয়া
খুনিচক্রের! ‘দখল করো পশ্চিম তীর―পূর্ব জেরুজালেম;
গাজা এখন স্বাধীনভূমি ইহুদিদের! কেড়ে নেব দক্ষিণ গাজার
খান ইউনিস, আছে যত ফিলিস্তিনি আবাসভূমি!’ কী ঘোষণা!
দখলদারের বুক কাঁপে না! আগুন জ্বালায়, ছোড়ে বোমা!
লাশ ধরে না হাসপাতালে! তাঁবু টেনে লাশ রাখা হয়!
লাশ রাখা হয় আইসক্রিমের কাভার্ডভ্যানে! কী বিপর্যয়
মানবতার! বন্ধ করো গণহত্যা! বিশ্ববিবেক, দাও, সাড়া দাও!
—————–
সচিত্রকরণ : রজত