
শব্দ ও অনুভব
গভীর রাতে গভীর বেদনায় শব্দগুলো জাগে
নাড়ির শব্দ অতিক্রম করে ধ্যানে বসে
শ্বাসের ধ্বনি শরীর সীমান্ত ছাড়ে
বিড়বিড় করে কী যেন বলে!
সমুদ্র তলদেশ ছেড়ে পর্বত শিখর অবধি
প্রলম্বিত শব্দসব টাঙানো আছে
ব্যক্ত করে আলোছায়া বোধির জ্যোৎস্না
আমার অনুভব তোমার প্রকোষ্ঠে উচ্চারণ!
জীবনের বাঁকে বাঁকে বাঁশির অসংখ্য রন্ধ্র
কারও ফুঁতে সুর ওঠে কারও কারও কসরত
স্থবিরতা মনে হয়, আসলে অপেক্ষা…
কখনও নক্ষত্রজ্যোতি কখনও পরিণতি পতন!
উত্তরাধিকারে ভাসানো শব্দ রক্তকণা কোষে
কৃতজ্ঞতায় মনে জাগে গভীর নির্জনে টাঙানো ছবি
সময়ের জলে ভেসে এসে দাঁড়ালে, প্রশ্রয় চাহনি
বর্ণমালা বুকে নিয়ে হামাগুড়ি দিতে ঘুম ভাঙে
গভীর রাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়!
শব্দ-অনুভব জড়িয়ে ঘুমায় আমার বিছানায়…

গোঁয়ার রোদ
অবসরকালীন ছুটিতে যাব, তাপ দ্বীপ হতে দূরে;
জানি না বদ্বীপের কোন প্রান্তে আছে শান্ত সবুজ মায়া!
আগন্তুক রোদ গায়ে এসে ঝলসে দেয় বোধ
শীতের মায়াবি রোদ জাদুঘরের দেয়ালে ঝুলন্ত ছবি…
গতিচক্রে ঋতু বদলে যায়, সবই চলে চরম নিয়মে
নগরযাপন যেন ‘ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে’!
যারা সপ্তাহের রুটিনে বাঁধা, গোঁয়ার রোদের সাক্ষী
তৃষ্ণার্ত মরুর বুকে ফোস্কা পড়া পায়ে তৃণ খোঁজে
মরীচিকা! এ কোন পোড়াকপালে আগুনের আঁচ?
পোড়াকালে বুঝি পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয় শরীরের হাড়!
রোদের প্রাবল্যেও যারা সোনালুর আভা নিয়ে ভাবে
তারা ঘর হতে বের হয়, তারা দেখে পার্থিব পরাগায়ন…

ভুল
(কবীর সুমনকে)
নির্ভুল নিয়তি নিয়ে জন্মায়নি, ভুলে ভরা ভুলে করা
আবার জন্ম হলে আবার ভুল হবে আবার অস্বস্তি
ভুল আর বিশৃঙ্খলা নিয়ে আছি, আশা করি থাকব
বন বিশৃঙ্খল বৃক্ষ নিয়ে সৌন্দর্য প্রকাশ করে
আমিও ভুলে ভরা বিশৃঙ্খলায় ভরপুর যাপন নিয়ে আছি
হাততালির লোভে বারংবার ভুল করি, বেঁচে থাকব আরও
না বলতে না পারার দায়ে ভুলের পাতকুয়ায় পড়ে যাই
ডুবি, কেউ তুলতে আসে না, ডুবে ডুবে জল খাই
কৈফিয়তের জবাব দিতে দিতে কথা বানাই
ভুল করে মাঝে মাঝে সত্যি বলি, কপটতা স্পষ্ট!
নাভিমূল থেকে উঠে আসা শব্দে বিশ্বাসে বলি
এখনও ভালো আছি, হারিয়ে যাইনি!

পাথরের ক্ষত
প্রত্যেক পাহাড়ের নিচে একটা নদী বা ঝোরা থাকে
নদীতে পাথর থাকে
পাথরে বসে কেউ গল্প করে;
যারা গোসল করতে আসে তারাও বসে, সাবান মাখে গায়ে,
কেউ কাপড় কাচে
কখনও বন্যায় পাথর সরে গেলে আড্ডাও সরে যায়
জলের গভীরতা বুঝতে অনেকেই ডুব দিয়ে জল মাপে
কেউ রাফটিং করে জলে, কেউ পেইন্টিং করে পাড়ে
এভাবে জল ও পাহাড়; জল বােেড় পাহাড়ের ক্ষত নিয়ে
এভাবে মানুষ ও জল; অনেকের খবর নাই বিগত কিছুদিন
জল বহমান, অপসৃত নাম কখনও স্মরণে আসে
বাঘমতী কিংবা মাতামুহুরী আমার বুকে মিশে ক্রমাগত ঢেউ….

মায়ের পরিধিজুড়ে মায়া
মা আমার আনন্দে হাসে না কতদিন
মা আমার বেদনায় কাঁদে না কতদিন!
মা আমার বিনামারা গ্রামে শুয়ে আছে বহুদিন
মাটির সঙ্গে মূলের সঙ্গে কথা কয় সারাদিন!
গোরস্থানে চিহ্নিত বৃক্ষতলে মাকে রেখে এসেছি
জুলাই মাসের সন্ধ্যা, আমার নয়নজলে মাখা মাটি
আমরা বিদায় দিলেও মাটির আলিঙ্গন অটুট
ধরে রাখতে পারিনি, মাটি পারে; রেখেছে যত্নে
মায়ের শরীরে লেপ্টে থাকা স্মৃতিগুলো বাতিঘর
কান্না বদলে দেয়, হাসি উজ্জ্বল করা জড়াজড়ি
মহাসমুদ্রের অতল স্নেহে ছানাপোনা বৃত্তাবদ্ধ
মায়ার পরিধি জুড়ে ভরসা, আশা, বসন্ত বাতাস
সকালে পায়চারি শেষ করে বিদায় না বলেও চলে যায়
আফসোস জমা হয়, বেদনাপাহাড়, বুকে ভার
ছেড়ে আসা ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে যতটুকু তফাৎ
মাঝখানের আলোটুকু মায়ের হাসি, নির্মল প্রশান্তি
হিসাব মীমাংসাহীন কত খণ্ডে বিখণ্ডিত মায়ের শরীর!
অখণ্ড মমতা নিয়ে সমহারে বিতরণ করে মনোযোগ
কোনও দ্বিধা নেই সিধা বলে দেয় মা কলিজার ধন
অপত্য স্নেহের বিভা মাইলফলক এগিয়ে দেয় পথ

ভ্রমণপাঠ
ভ্রমণে পড়ব বলে ব্যাগে নিই বই
বই মানে এতদিনের অপঠিত পছন্দের বাছাই
মনে আশা জমা সময়ে পড়তে পড়তে যাব
আর সম প্রক্রিয়ায় ফিরব পথে
এবার হয়তো সমাপ্ত হবে আরাধ্য পাঠ…
ওজনও বেড়েছে ব্যাগে, তবু বই থাকে
কাঁধে চাপ পড়ে, ভার বহন করি
বইয়ের ভ্রমণ হয়, খোলা হয় না বই
সমস্ত ভ্রমণ শেষে অবশেষে
প্যাকেটের বই সযত্নে ফেরত আসে প্রযত্নে
ভ্রমণপথে কতজনকে দেখেছি নিবদ্ধ চোখের পাঠ
আমার হয়নি, যারা পারে তাদের জানাই প্রণতি…

ভালোবাসায় কি ভুল হয়?
ভালোবাসা ছাড়া এক মুহূর্ত কাটে না আমার
ভিক্ষুকও বলা যায় ভালোবাসার
পথে কিংবা অচিন ঠিকানায় হাত পাতি
দাও কিছু; তোমার হৃদয়ে জমানো বিত্ত
আকুল মন নিয়ে ভালোবাসার ভ্রমণে
তোমরা বলতে পারো মুসাফির আমি
ঘুরি ফিরি বাজার বন্দর নগর উপশহর
যেখানে উষ্ণতা পাই জড়াই শরীরে
দীর্ঘ একটা শ্বাস নিই, তাকাই চারদিকে
নজরে নজর টানে যে-জন, তারে ছাড়ি না
পিছনে ছায়া হই মায়ার কাঙাল মনে
পলক পড়তেই মনে হয় আহ্নিক গতির হিসাব
দীর্ঘ পরিভ্রমণে পথ থেকে পথে
সুষম সময় থেকে বিষম অকালে
তাপে চাপে হৃদয়ের উষ্ণতা জিইয়ে রেখেছি
শেষ মাইলফলকে তোমার দেখা হবে ভেবে
আমার শেষ আলিঙ্গনে জড়াব ভালোবাসার স্তূপ
প্রগাঢ় প্রেমের রঙ ফিকে হওয়ার আগে
সমস্ত বসন্ত নিয়ে তোমার সামনে হাত জোড় করি
ভিক্ষার হাত পাত্রে যখন পড়বে তোমার প্রদেয়
সেই সময় রোমঞ্চিত মন, নাড়ির উচ্চ কম্পন
আমাকে উড়ায় পাখির পালকে, আত্মার আনন্দ কোষে
‘ভালোবেসে সখি নিভৃত যতনে আমার নামটি লিখো’…
ভালোবাসায় কি ভুল হয় ?
বিশুদ্ধ মনের পাতন তোমার পাটাতনে
জানার আগ্রহ থাকে, তুমিও কি চঞ্চল হও অদম্য আহ্বানে ?
অপরাধী নই, আরাধনা করি, অদেখায় অভাব অনুভব
গভীরতা বুঝে নিতে পারো কিনা ভাবো,
আমার চোখের জলে তোমার কাজল মুছে যাবে কিনা ভেবে দেখো!
ভালবাসার শব্দগুচ্ছ, অনুচ্চারিত অনুভব ইথারে জমা থাক
অসময়ে পড়ে দেখো আমি ছিলাম, এখনও আছি
মায়া ভিক্ষে করি; পাই-হারাই-খুঁজি আবার
ভালোবাসা নাকি অন্ধ করে চোখ, নিষ্কম্প নয়ন!
আমিও তোমার আভায় অনুরক্ত অন্ধ!
এখনও ভালোবাসা পেলে প্রস্তরীভূত হব তোমার অনন্য আশ্রয়ে…
——
সচিত্রকরণ : রজত