আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : ওবায়েদ আকাশ

বিনির্মাণ

আমাকে ডেকো না। যা কিছু শুকিয়ে গেছে রৌদ্রে, তার

সতর্ক দৃষ্টিতে খুঁজে নিয়েছি তোমাকে―

ভেতরে ভেতরে কিছু গরমিল তোমার প্রশান্ত সবুজ ফর্মুলা

ঐ অতীত থেকে লাফ দিয়ে গূঢ়ার্থ বিশ্বাস ভেঙে গেছে

এখন চাইলে প্রাজ্ঞ শিক্ষার্থী হয়েও মনস্ক বিজ্ঞানী হতে পারো না

এখন যা কিছু স্পর্শ করো অভিমানে লাল হয়ে যায়―

প্রতিটি বিকেলবেলা ঘাসে ঘাসে প্রবন্ধ রচনা করে

দীর্ঘশ^াস পাড়ি দিতে এসে যে শহর জলে ডুবে গেল

তুমি তার ভাঙা ঢেউ কুড়িয়ে-বাড়িয়ে কতটা মহৎ হতে পারো ?

আমাকে ডেকো না। নদীতীরে চৈতালি শস্যের দিকে

দৃষ্টি চলে যায়। কেউ নাকি মৃত ফসলের সুখে ভালবাসার নোঙর

বসিয়েছে। ভেবো না ওখানে ছিলাম বা থাকব কখনও

তোমার শুকনো হাত-পা দ ুহাতে ধরে বুঝি, তারও বহু আগে

আমারই হৃৎপিণ্ড ভেঙে একঝাঁক শালিখের বেঁচে থাকা

নিশ্চিত হয়েছে। আবার কুমার নদে ভাসা কঙ্কালের

সারাংশ পড়ে কিছু মাছ শিক্ষিত ও সদর্থ হয়েছে

আমাকে ডেকো না। প্রতিটি স্বর্ণ গোধূলি সাক্ষী

আমাদের কোনও অতীত ছিল না

আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোথাও কোনও ইশতেহার রচিত হয়নি

আমাকে ডেকো না। সুদূরে তাকাও। ঠিকরে বেরুচ্ছে রোদ

ও দুটি আমার হারিয়ে যাওয়া চোখ, তোমাকে দেখার স্পর্ধা


নয়া শতাব্দী

সুবাস্তিনা, গৌরবর্ণ, ত্রিভাষী, সুচ্ছায়া―

ব্যাকরণবিষয়ক তর্কে ডিলিট, অবিশ্বাস্য ইমেজারি, আদতে মঙ্গোলীয়

আমার সমস্ত দায়িত্ব বুঝে নিয়েছে

ভাঁজ খোলার আগেই জানাচ্ছে কার্বনসমেত তার হৃদয়স্থ―

শরীর থেকে সুলতানপুরের সমস্ত গন্ধ খুলে জানতে চাই

একুশ শতকের পর গ্রামবাংলার রূপ রূপান্তর!

সুবাস্তিনা, দশ তলায় ডবল ডেকার থেকে হাত তুলছে

তাকে সবাই ভাবছে, বজ্রনিরোধক সুখ, কালপুরুষ―

জানাচ্ছে, বৃক্ষের পরে বৃক্ষ সাজাতে গেলে কোমরে করাত লাগে

শতবর্ষী কাণ্ডের উন্মুক্ত স্তনের উষ্ণতা লাগে দরজার চৌকাঠে

এবং যেভাবে দশ তলায় গাছের পাতা ঝরছে, বর্ষায় জমির আল

ভেসে যাচ্ছে, কদমফুলের পাপড়িতে গড়াগড়ি খাচ্ছে শৈশব

কী আর বলি, ওখানে আমিও ছিলাম চল্লিশ বছর পিছনের

রিমোট কন্ট্রোলে―এভাবে সমস্ত ঋতু শরবতের মতো গিলে নিচ্ছে নীলাকাশ

সুবাস্তিনা, পিঠে কৈ মাছের ঝাঁক, কাতরাচ্ছে

পাললিক সম্ভাবনার স্বপ্নে সয়ে যাচ্ছে একান্ত ব্যথা

আজ সমস্ত রাত অন্তত পঁচিশ তলা উঁচুতে বিমানবন্দর

সাঁঝবাতি জ্বলে ওঠার আনন্দে নক্ষত্র ফুটিয়েছে প্রতিটি গ্রাম

প্লেন উঠছে নামছে, গঞ্জের হাটে বিকিকিনি হচ্ছে ইলিশ, ডেওয়াফলের ওম

একুশ শতক ফুরোবার আগেই সুবাস্তিনা সর্বোচ্চ ভবন লাফিয়ে মাটিতে পড়ে গেল

তার হাতের মুঠোয় পাকুড়-জঙ্গল, নদীমাতৃকতা, ধান-ফসলের অপার বাংলাদেশ

যে যার মতো কৈশোরে ফিরে জানাল―নয়া শতাব্দীর সরল সম্ভাবনা!


একটি পরাবাস্তব তর্কসভা

আমার শরীরে কোনও অক্সিজেন নাই

কী করে যে বেঁচে আছি―এই নিয়ে তুমুল তর্ক চলছে

এ থেকে রক্তপাত কিংবা হাতাহাতি মুক্ত করতে

কে যেন একটি প্রকাণ্ড বৃক্ষ বসিয়ে দিয়েছে মাঝ বরাবর

গাছটি একই সঙ্গে অক্সিজেন এবং ব্যক্তিগত শরীর বিকিয়ে

আপাত শান্ত রেখেছে বাড়ি

এদিকে সকলে দেখছে আমার নিথর শরীর

পালস দেখছে, চিমটি কাটছে, আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে শিশুরা

আমি প্রাণপণ অক্সিজেন পেতে গাছের দিকে ছুটছি

অথচ একটুও এগুতে পারছি না

হঠাৎ কেউ একজন আমাকে মৃত বলে ঘোষণা করায়

হাউমাউ করে কেঁদে উঠছি―অথচ আমার কোনও অভিব্যক্তি নেই

শব্দ নেই, নড়াচড়া নেই―

আমার বউ আমাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদছে

বাচ্চারা পাগলের মতো বাবা বাবা করে বিলাপ করছে

তাতে আমার বুক ফেটে কান্না বেরুতে চেয়েও বেরুতে পারছে না

অগত্যা হাসতে হাসতে ওদের মাথায় হাত বুলাতে গেলে

ওরা আমার হাতের স্পর্শ বুঝেও বুঝছে না

এদিকে আমার শরীরে অক্সিজেন আছে কি নাই বলে যারা তর্ক জুড়েছিল

তাদের কারও হাতে ব্যাগভর্তি টাকা, কারও হাতে লাঠিসোটা, দা-খুন্তি

এবার তারা নিজেরাই নিজেদের দেহে অক্সিজেন আছে কি নাই পরখ করতে

আমার মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে নিস্তব্ধ হয়ে―


কিংকর্তব্যবিমূঢ় আলো

সওদাগর, এখানে কতদিন থাকবার

অরিত্রর সামিয়ানা টাঙানো হয়েছে ?

ইষ্টানিষ্ট বুঝে উঠবার আগে প্লেনের ধাক্কায়

কেঁপে উঠছে প্রতিটি মঙ্গলবার

কবে যে মঙ্গল থেকে রক্ত ঝরেছিল

তাতেই আমরা পৃথিবীর কোথাও না কোথাও জখম হয়েছিল বলে

সাংসারিক ওলটপালট থেকে এখনও সুস্থির হতে পারি নাই

প্রতিদিন সুই দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরখ করছি

বুধ শুক্র শনি কিংবা সোম রবি বৃহস্পতি―

তাতে শরীরের আনাচেকানাচে, সংরক্ষিত ত্বকে

অনর্গল রক্তপাত ঘটেই চলেছে

অঙ্কিত জিহ্বার দিকে হেলে পড়েছে দেহকাণ্ডের বিবিধ অসুখ

সিঁড়িময় আল্পনার বাঁকে জীবনানন্দ ঘষতে ঘষতে ঘষতে

মধ্যরাতটা উপুড় করে বেঁচে থাকা শিখি

কালান্তরের হিসাব এক বহুজাগতিক ফর্মুলা

যতই ইশারা করো―সাড়া দিতে পারব না মহান

কিংকর্তব্যবিমূঢ় আলো, সওদাগর তোমাকে জিজ্ঞেস করছে―


ফেরা

যাচ্ছ বলেই আর ফিরবে না ভাবিনি এমন

আহত ফিরেছে কথা―

আয়ুরা কোথায় ? পোশাকে যাদের মোলায়েম ছিল সুর ?

ভেজানো ঘুমের দক্ষিণে-বাঁয়ে ঝিরিঝিরি ঢেউ!

কোনওদিন ঠোঁটে তুমি ছিলে তাই বুঝিনি কিছুই

এত প্রাণ বুকে বয়ে নিয়ে যারা দূরে চলে যায়

তারা কি ফেরে না ? তারাই উজায়, জানি

কমলা ট্রেনের নিচে

ব্যথারা ধূসর। দৃঢ়তা পেয়েছে মাটি

নদী ফিরে এলে―ফের জনপদে মুখর হাওয়া―

পোড়া ঘাস পিঠে শোণিত-জখমে জেগে ওঠে দেশ

নতুন প্রকারে―


গ্রহণ-ভাঙন

যেখানে দাঁড়িয়ে আছো, অনন্ত রক্তজবার গ্রহণ

গতকাল যারা মৌসুমি বাতাসে ঘুড়ি উড়াতে শিখেছে

একটু পরই তাদের জন্য লেফট-রাইট লেফট-রাইট

বরাবরই বাংলার শিক্ষক বলেছেন, মানবিক হও

এক্ষুনি পালাবে যারা―তাদের হারাবার প্রয়োজন নেই

তারা বংশের বাতিতে কতটুকু বঙ্কিমতা ছড়াল, তারও হিসেব ফুরিয়েছে

সমস্ত অনুনয় ফেলে কড়িকাঠের সাফল্য-ব্যর্থতায় সন্ধে পোহাবে

এইবার আমার সময় ক্রমশ নাটাই ছাড়ছে

আমার চারপাশ দিয়ে এত যে বিমর্ষ গ্রহণ, কী করে সইবে সকাল

ভ্রমণের আগে ও পরে গজানো সহস্র পায়ে গন্তব্য রচেছি কোথায় ?

ভাঙন ভাঙন ভাঙন… এই তো এখন প্রসিদ্ধ ভাষা মরুভূমির পাশে

তবু আমার ভাসছে সকল―ক্ষীণায়ু বুদ্বুদের ভেতর নাব্যের আকাল

বলেছিলে, নদী হয়ে বেড়াতে আসবে অভিধায়―

পাখিদের গল্পগুলো ডালে ডালে শুকিয়ে গেল, ঢেউগুলো অরণ্যে অচল


ত্রিভুজ কিংবা স্বপ্নে পাওয়া ভবিষ্যৎ

পাশা খেলায় হারজিত এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার

তবু শেকল পরা পা দেখলে পরাজিত জীবনের কথা মনে পড়ে

যখন ঘুম ভেঙে

গাছে ওঠার প্রস্তুতি নিয়ে দেখি বহু আগেই রোদ উঠে গেছে গাছে

ঘাসের শিশিরে পা ফেলতে গিয়ে বুঝি কুকুরের স্নেহ মাড়িয়ে গেছে শিশির

ছুতোরের গড়া কাঠের ত্রিভুজে গিয়ে বসি

সময়কে বিদ্ধ করে দেখি রক্তমজ্জায় আর কী কী পরাজয় লেখা আছে

আমার সামনে দিয়ে ছুটে যায় ট্রেন

কোনও কোনও নৌযান থেকে হারানো যাত্রীরা ট্রেনে ওঠার ব্যাকুল প্রত্যাশা করে

তবু জানে না জীবন থেকে ছিটকে পড়ে আটকে পড়েছে মরুভূমির দেশে

তাদের দিকে আরও কিছু ধারালো ত্রিভুজ বাড়িয়ে দিয়ে বলি

একবার নিজেকে একবার ঈশ^রকে ফালা ফালা করো

তারা যত্ন করে ত্রিভুজগুলো তুলে নিয়ে বহুদূর নিরুদ্দেশে যায়―

তাদের ব্যাগভর্তি সন্তানের কান্না, বুকভর্তি স্বজনের তিরস্কার নিয়ে

অন্য কোনও নদীতে ঘর বাঁধে

আবার ঘুম থেকে উঠি ভোরবেলা। দেখি, স্বপ্নে পাওয়া ভবিষ্যৎ নিয়ে

ছুটে চলেছি বড় রাস্তার দিকে। রাস্তার শরীরে হিংস্র যান, দুরন্ত গণমানুষ―

তাদের স্বপ্নের চারাগাছগুলো পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত রুয়ে দিতে

ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে এই প্রত্যুষে, কালো রাস্তায়


নিরালম্ব

আবার তোমার সঙ্গে দেখা

একান্ত সময় শালবনে মহুয়া মুখর

ঘোর অনটনে অন্ধ নির্বাসন ছিল

তুমি বললে, জ্বলছে

              শতাব্দীর ভেজা আলো

তোমার সঙ্গে আমার দেখা

ঠিকানা হারানো তুমি―শাশ্বত বিশ্বাস শুধু!

বলো তো কোথায়, কোন কূলে আছো ?

ঝলমলে রোদে, উজ্জ্বল গূঢ়ার্থ প্রেম

প্রতিশ্রুতি, একা ও কয়েকজন তারা

এইসব মুখর করেছে লোকালয়

তোমার সঙ্গে আমার দেখা

একেকটি লোকালয় থেকে একেকটি পাড়া

বিদ্যুচ্চমকের অধিক কোথাও কিছু নেই!


পেণ্ডুলাম

একবার তোমাকে খুঁজতে গিয়ে দেখি

তোমার তো মাথাভর্তি গাছ আর চুলের গড়ান ধরে

ভেসে যাওয়া সাম্পান থেকে জাগছে সময়―

আকাশের ওই পারে তুমি থাকো―

গলদা চিংড়ির মতো উন্মুক্ত উদরে রাখো

সকল ভালোবাসা

আমি গাছ থেকে নামতে নামতে বুঝি

ভ্রমণ টিকিটের অপর পৃষ্ঠায় তোমার মুখ কাশবনে ঢাকা

কী আয়াসে সাম্পান থেকে লাফিয়ে নামি স্রোতে!

আরও তলে ডুব দিয়ে ভাবি প্রাচীন প্রস্তর যুগ

এইবার মুঠো ভরে উঠে আসে মহার্ঘ অতীত!

———————–

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button