
শৈশব সিরিজ ও উত্তরাধিকার
কৈয়ের উৎসব
টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি
আকাশে মুহুর্মুহু ডাকছে মেঘ
ঠাকুমার ওম নিয়ে শুয়ে মজে আছি
রাক্ষস আর খোক্ষসের গল্পে।
কাকামণি ডেকে বললেন, মাথলা মাথায় দিয়ে
দিঘির কাছারটা ঘুরে দেখে আয়
মাছেদের হুল্লোড়ের দিন আজ।
আমি ঠাকুমার ওম আর রূপকথায় বুঁদ।
হঠাৎই মনে পড়ল, ইশ রে…
আজ তো মাছেদের হুল্লোড়ের দিন!
অতঃপর দে দৌড়…
মেঘেদের ডাক পেয়ে পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে
কানকোতে ভর করে তুমুল আনন্দে
উজিয়ে উঠছে ঝাঁকে ঝাঁকে কৈ!
আমি কৈইয়ের উৎসবে হারিয়ে গিয়ে
কাকামণিকে ডাকতে ভুলে যাই!

বাবার ‘ফনিক্স’ সাইকেল
বাবার ‘ফনিক্স’ সাইকেলের ক্যারিয়ারে বসে মামাবাড়ি যাই!
সঙ্গে যাচ্ছে শৈশবের একরাশ কৌতূহল।
শ্রাবণের বানের তোড়ে ভেসে গেছে জামবিল
ডুবে গেছে বনগ্রাম থেকে দিঘারকান্দার মধ্যকার পথ।
জামবিলের মাঝখানে মাথা উঁচু করে
সদম্ভে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান আমলের
টিএইচ খান নির্মিত পরিত্যক্ত একলা কালভার্ট।
জলমগ্ন বাঁশের সাঁকো পার হয়ে মামাবাড়ি যাই।
বাবার এক কাঁধে ‘ফনিক্স সাইকেল’ অন্য কাঁধে আমি।
শ্রাবণের বানের তোড়ে কাঁপছে সাঁকোর নড়বড়ে বাঁশ
আমাকে জাগিয়ে রাখতে প্রাণপণে সাঁকোর হাতল ধরে
আকণ্ঠ ডুবে যাচ্ছেন বাবা!

স্বপ্ন
সীমাদের কুঁড়েঘরে আগুন লেগেছে!
ঝলসে গেছে সীমার কিশোরী শরীর
কলাপাতায় আবৃত হয়ে কাঠের তক্তায় শুয়ে আছে অগ্নিদগ্ধ সীমা
মরাল বাঁশের ভারবাঁশের দুই প্রান্তে দুই ভাইয়ের কাঁধ
দড়ির শিকায় ঝুলছে তক্তার আপাত শয্যা
বোনকে নিয়ে সদর হাসপাতালে যাচ্ছে তপন ও স্বপন।
শমেশ মাস্টারের রাস্তালাগোয়া বাহিরবাড়িতে কিছুক্ষণের যাত্রাবিরতি
মুহূর্তের জন্য সীমাসহ ভারবাঁশ কাঁধ থেকে নামে
আমি সীমাকে এক পলক দেখতে প্রাণপণে দৌড়ে দৌড়ে যাই…
আমার পথ আর ফুরায় না।
সীমার পাশে স্মিত মুখে বসে আছেন
ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা প্রয়াত শশী মাস্টার।
অন্য পাশে হাত দায়ে বেতি তোলায় নিমগ্ন
আমাদের প্রয়াত বড়বাপ-দীনেশ সরকার।
জীবন-মৃত্যুর সীমা অতিক্রম করা দুজন মানুষ
আমার পথ রোধ করে কেমন নির্লিপ্ত…
বড়বাপ তাঁর তারের ডাঁটিওয়ালা গোল ফ্রেমের ঘোলা চশমায়
আমার দিকে তাকাতেই এবংবিধ দৃশ্যেরা আচমকা অদৃশ্য হয়ে যায়।
আমি আর সীমাকে দেখতে পাই না।
সদর হাসপাতালের দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে
আমি একলা বিছানায় ঘেমে নেয়ে উঠি।

উত্তরাধিকার
সংসারে নিজেকে একজন আগন্তুক ছাড়া বেশি কিছু মনে হয়নি আমার
এক একর ধানীজমি, ছোট্ট পুকুর, গাছপালা ঘেরা উঠান
পূর্বপুরুষের স্মৃতিচিহ্নময় টিনের চৌচালা ঘর
দক্ষিণে বেদখল হয়ে যাওয়া শীর্ণ পুনই বিল
-এই আমার শৈশব, আমার উত্তরাধিকার।
অ্যাজমায় জর্জরিত অন্ধপ্রায় বাবা
আমাকে স্পর্শ করে বারবার শোনাতে চেয়েছেন তাঁর অতীত যৌবনগাথা
আমি অনেকটা কাছে গিয়েও তাঁর দুঃখভারাক্রান্ত মনে ঢুকতে পারিনি
চোখে রুমাল বেঁধে বাবার অস্পষ্ট পৃথিবীতে
ভ্রমণ করতে গিয়ে বারবার শিউরে উঠেছি
নিজেকে বুঝিয়েছি-জীবন যার যার
অন্য জীবনের ভার বইবার যোগ্যতা থাকে না সবার।
আমার অন্য আমি আমাকে শাসায়-
মাটি আর সম্পদের মতো তোমাকেও বইতে হবে
বয়সের সময়ের উত্তরাধিকার
তুমিও বারবার ছুঁতে চাইবে আত্মজের যৌবনদীপ্ত উজ্জ্বল দিন
আর তোমার জর্জরিত জীর্ণ-শীর্ণ অস্পষ্ট দিন বাবার মতোই
আঠালো চোখের জলে ঝাপসা হয়ে রবে
তুমিও পরম প্রস্থানের অধীর অপেক্ষায় কাতরাবে রুগ্ণ বিছানায়।
——————
সচিত্রকরণ : রজত