আর্কাইভকবিতা

গুচ্ছকবিতা : হাসনাত শোয়েব

হলুদ-নীল গান

কোনও কোনও গান আমাদের শোনায় নিঃসঙ্গ আকাশের দিকে যাত্রার কথা। কোনও কোনও গান শুনতে শুনতে মনে হবে, কেউ আপনার ভেতর তৈরি করছে হাজার বছরের কবর। ছাইরঙা আকাশের অ্যাশ ফেলে আপনি কোনও একদিন চলে যাবেন সেই কবরের দিকে। মাটিতে নিজেকে মিশিয়ে দিতে দিতে গেয়ে উঠবেন—

‘Shut the eyes of the dead

Not to embarrass anyone

But farewell, Angelina

The sky is embarrassed

And I must be gone’

গাইতে গাইতে আপনি বুঝবেন, হাতে আসলে বেশি সময় নেই। আকাশ ক্রমশ পেছনের দিকে হাঁটছে। সন্ধ্যার আগেই পেরোতে হবে ওই হলুদ-নীল কার্নিভাল। আর অদ্ভুত একটা আকাশের নীচে জমা হচ্ছে আমাদের সব হেরে যাওয়া। জোয়ান, তুমি বরং হাত বাড়িয়ে দাও। আমি হাঁটতে চাই মহাপ্লাবনের দিন পর্যন্ত।

‘Cause I’m leaving’ on a jet plane

Don’t know when I’ll be back again

Oh babe, I hate to go

—John Denver

ডেনভার বাজছে। আর আমরা আকাশের দিকে চেয়ে আছি। সারি সারি নদী আমাদের স্বপ্নে আসে। তার পাশে শুয়ে আছে ধানক্ষেত অথবা পাইনবন। কনক বলল, পাইনবন শুনতে ভালো, এইটা রাখ। আমি কিছু বলি না। শুধু বলি, হুঁ! তারপর হু হু বিষণ্নতা আর বেথেলহেম চার্চ। চার্চের বিকেলগুলো বড্ড এলোমেলো। সেখানে কেউ একা একা ভায়োলিন বাজায়। আর তখন জামালখান নামের একটি শহরে অভিশপ্ত সন্ধ্যা নামে।

তুমি বললেই হবে। ‘তুমি’টা কে ? কেউ জানে না। তুমি মানে নাকি সেল্ফ। প্রতিটা তুমিই মূলত আলাদা আলাদা ‘আমি’। ব্রাদার ফ্ল্যাবিয়ান হয়তো সেই ‘তুমি’র সন্ধানে পথে নেমেছিলো। আর কুড়িয়ে পেয়েছিলো একগাছি সোনালি চুল। হায়! সেই চুলের প্রেমে ফ্ল্যাবিয়ানের ঠাঁই হয়েছিলো অ্যাসাইলামে। এখনও সেখানে প্রতি রোববারে সিস্টাররা গিটার নিয়ে বসে। ‘ফেয়ারওয়েল এঞ্জেলিনা’ অথবা ‘হ্যোয়ার ডু ইউ গো মাই লাভলি’ বাজে। আর আমরা ডাকবাক্স খুলে বের করে আনি গোলাপি খামের অনেকগুলো চিঠি। নাহ চিঠিতে কোনও নাম নেই। শুধু হু হু শূন্যতা।

একদিন পৃথিবীর সব প্রেমিকা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। একা একা নখের গায়ে ফুটাতাম শাদা ফুল। বেড়িবাঁধের ধারে বসে ভাবতাম কাঞ্চনজঙ্ঘার কথা। কেমন হয় সেসব বরফ ঢাকা পাহাড়, যার চিবুকের নিচে জমে থাকে কোনও পুরাতন কবরখানা। পাশেই উত্তাল বঙ্গোপসাগর। আরও কাছে পুরাতন নেভাল একাডেমি। রানওয়ে ছেড়ে ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর সর্বশেষ জেট প্লেন।

————————-

পৃথিবীর পেট উজাড় করে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এখন শীতকাল। এই ঋতু বড্ড আগ্রাসী। হৃৎপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। এমন শীত থামানোর কোনও উপায়ই আমার জানা নেই। এই সব শীত আমাকে আরও বিষাদগ্রস্ত করে তোলে। আমি শুষ্ক ত্বকের নিচে আড়াল করে ফেলি সব বিষণ্নতা। কারণ, পৃথিবীতে ভালো থাকা কিংবা না থাকা মানুষেরা একেবারেই আলাদা। ভালো থাকতে হলে আপনার প্রয়োজন একখণ্ড পাথর, যেটা আপনি যখন তখন যাকে তাকে ছুড়ে মারতে পারবেন। পৃথিবীতে যারা সঠিক নিশানায় পাথর ছুড়ে মারতে পারে, তারাই কেবল ভালো থাকতে পারে। আর একদল আছে যারা খারাপ থাকার ভান করে। তাদের দখলে কান্না। পৃথিবীর যে কোন কান্নায় তাই ভ্রম ও অস্পষ্ট। তার ঝরে যাওয়া আমাকে আক্রান্ত করে। কিন্তু আমি তাদের ঘৃণা করি। পৃথিবীর যে কোনও কান্নারত মানুষকে আমার পাথর ছুড়ে মারতে ইচ্ছে করে। যেহেতু আমি সুখী মানুষ নই, আমার তাই কোনও পাথরও নেই। আমি বসে বসে দেখি—পৃথিবীর যাবতীয় সুখী এবং অসুখী মানুষদের।

আর কতদূর ? এখানে হিপ্পি যুবতীদের প্রতিশোধের পাশে ম্যানগ্রোভ থাকার কথা ছিলো। উইলো ঝড়ের পর সেইসব পিয়ানোবাদকও ফিরে যাবে লাশকাটা ঘরে। কিছুই তো হলো না বন্ধু। কেবল ডায়ালের গায়ে ঘড়ির কাঁটা হয়ে ঘুরছি তুমি আর আমি। ওই দূরে, সমুদ্র পাড়ে দুলছে একাকী অশোক।

——————–

একটা দিনই প্রতিদিন ফিরে আসছে। সেই একই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি। যেন পৃথিবী থমকে আছে আরও বছর পাঁচেক আগে। নতুন কিছুই নেই। একই ভঙ্গিতে ঘুম, একই আসনে বসে খাওয়া আর একই জানালা দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখা। প্রতিটি বইও এখন একই কথা বলছে, প্রতিটা গানের সুরও এক। একটা দিন থেকে আলাদা করতে পারি না অন্য আরেকটা দিন, দৃশ্যগুলোও আর আলাদা নয়। এমনকি একটা বছর থেকেও আলাদা নয় আরেকটা বছর। একটা বিন্দুকে ঘিরেই যেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা বলছি।

বৃষ্টি নামে, এমন বৃষ্টিতে পৃথিবীর শীত শীত লাগে। ভেজা কাপড়ের গন্ধ আমাদের আক্রান্ত করে। আমরা রেইন কোট-গাম বুট ছুড়ে ফেলি। কান থেকে খুলে রাখি লিওনাদ কোহেন। একা একাই বৃষ্টি  দেখি, শিল কুড়িয়ে নিই। দূরে কোথাও ঝুম বৃষ্টিতে থরথর করে কাঁপে মিয়া কি মল্লার। এমন বৃষ্টিতে নানার রেডিওতে গেয়ে উঠতেন দেবব্রত বিশ্বাস। সেই গানে কান রেখে আমি শুনি, ইস্রাফিলের শিঙার ফুঁয়ে ক্ষণে ক্ষণে কাঁপছে পৃথিবীও। এসবের মধ্যে, আমার মনে পড়ে তোমার কথা। মনে পড়ে, গানের ওপারে দাঁড়িয়ে তুমিও একদিন বৃষ্টি দেখতে। দুই হাত মেলে বৃষ্টির হাত থেকে গাছগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে। বিদ্যুৎ চমকে দুই হাত দিয়ে আগলে রাখা গাছগুলোকে মনে হতো দেবশিশু। বারবার মনে হতো গাছগুলোও বুঝি দাঁত বের করে হাসছে। এসব দৃশ্য আমার ভালো লাগত। ঝড়-বৃষ্টির চেয়ে তাই আমার বিদ্যুতের চমকটাকেই এখনও বেশি ভালো লাগে।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button