আর্কাইভভাষা গবেষণা

ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক : শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : মানবর্দ্ধন পাল

পনেরতম পর্ব

[প্রাচীন ভারতীয় আলঙ্কারিকেরা শব্দকে ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ, তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরনো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মণি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।

বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিক রূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]

তা

নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু দোলে ভালে

তাতা থৈথৈ অতাতা থৈথৈ তাতা থৈথৈ।

                             ―রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

একটি ব্যঞ্জন ও একটি স্বরধ্বনি―দুটি বর্ণের সংযোগে তা একটি ছোট্ট শব্দ। একাক্ষরিক―বলা যায়, শব্দকণা। নিতান্ত সহজ-সরল একটি শব্দ। শিশুরা সাধারণত প-বর্গের ওষ্ঠ্য ধ্বনির (মামা, বাবা, পাপা) পরেই ত-বর্গের দন্ত্যধ্বনির উচ্চারণ (তা তা, তাই-তাই) করতে শেখে। বানান ও উচ্চারণে সহজ হলেও এই শব্দটির অর্থের অন্তরে আছে ব্যাপক বৈচিত্র্য এবং রহস্যময়তা। রবীন্দ্রনাথের এই গানে তা শব্দটি পরপর দুবার প্রযুক্ত হয়েছে। তাই ব্যাকরণমতে এটি দ্বিরুক্ত শব্দ, দ্বিত্বশব্দ বা শব্দদ্বৈত। যেমন শনশন, ঝরঝর, টিপটিপ, তেমনই। যে-নামেই বলি-না-কেন, দ্বিরুক্ত শব্দের মধ্যেও আবার প্রকারভেদ আছে―শব্দের দ্বিরুক্তি এবং পদের দ্বিরুক্তি। বিভক্তি যুক্ত থাকলে তাকে আমরা বলি পদের দ্বিরুক্তি। যেমন, জনে-জনে, মনে-মনে, ফুলে-ফুলে।

ব্যাকরণবিদরা উৎস অনুসারে দ্বিরুক্ত শব্দগুলোকে নানাভাবে ভাগ করেছেন :

* প্রকৃতি-সঞ্জাত দ্বিরুক্ত : কুলকুল (জলপ্রবাহের শব্দ), ঝরঝর (বৃষ্টির শব্দ), কড়কড় (বজ্রপাতের শব্দ) ইত্যাদি

* প্রাণিজগৎ-সঞ্জাত দ্বিরুক্ত : ঘেউঘেউ (কুকুরের ডাক), হাম্বাহাম্বা (গরুর ডাক), কা-কা (কাকের ডাক) ইত্যাদি।

* বস্তুজগৎ-সঞ্জাত দ্বিরুক্ত : ঢংঢং (ঘণ্টার ধ্বনি), ক্রিংক্রিং (সাইকেল বা রিকশার বেলের শব্দ), কু-ঝিকঝিক (চলন্ত ট্রেনের শব্দ) ইত্যাদি।

* মনুষ্যসৃষ্ট শব্দ : ওঁয়াওঁয়া (নবজাত শিশুর কান্নার শব্দ), ভেউভেউ (বয়স্ক মানুষের কান্নার শব্দ), হাপুসহুপুস (খাওয়ার শব্দ) ইত্যাদি।

* অনুভূতি-সঞ্জাত শব্দ : টনটন (ফোঁড়া বা মাথা ব্যথার অনুভূতি), চিনচিন (পেট বা মাথা ব্যথার মৃদু অনুভূতি), ঘিনঘিন (অস্বস্তির অনুভূতি), ঠাঠা বা খাঁখাঁ (রোদের তীব্রতা বা শূন্যতার অনুভূতি) ইত্যাদি।

শৈশবে পড়া সুকুমার রায়ের হনহন পনপন শীর্ষক শিশুতোষ ছড়াটি এই দ্বিরুক্ত শব্দের সেরা উদাহরণ। তখন ছন্দ ও অন্ত্যমিলের দোলায় সেটি আমরা কণ্ঠস্থ করেছি কিন্তু সেই ছড়াটি যে দ্বিরুক্তি শব্দের বিচিত্র প্রকাশক তা তখন কেউ অনুধাবন করতে পারিনি! শিশুতোষ ছড়া হলেও এই পরিণত বয়সে আবার সেটি পড়ে নেওয়া যাক :

চলে হনহন ছোটে পনপন

ঘোরে বনবন কাজে ঠনঠন

বায়ু শনশন শীতে কনকন

কাশি খনখন ফোঁড়া টনটন

মাছি ভনভন থালা ঝনঝন।

   (হ য ব র ল, সুকুমার রায়)

এবার তা শব্দটির বিচিত্র অর্থ ও অর্থান্তরের দিকে নজর দেওয়া যাক। অভিধানে শব্দটির অর্থভিন্নতার ছয়টি ভুক্তি লক্ষ করা যায়। এগুলো নিম্নরূপ :

১) তা―বিশেষ্য পদ। সংস্কৃত তাপ থেকে এর উৎপত্তি। তাপ > তাব (প্রাকৃত) > তা। তাপ দেওয়া, গরম করা, উষ্ণতা সঞ্চার, ডিমে তা দিয়ে বাচ্চা ফোটানো ইত্যাদি অর্থে তা ব্যবহৃত হয়। যেমন : ডাহুক ডাহুকী নাচে ডিমে দিয়া তা। (শ্রীধর্মমঙ্গল, ঘনরাম চক্রবর্তী, ১৩০৮, পাখির পাখা ও পেটের নিচে রেখে ডিম ফোটানোর তাপ)। সেইখানেই নিজের ডিমে সদাই দেন তা। (রবীন্দ্রনাথ)। জ্বরের তায় পানি পিওন। (শরীরের তাপমাত্রা, চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রবাদ)।

২) তা―বিশেষ্য পদ। সংস্কৃত তার থেকে। তারের পাক বা মোচড়ে ব্যবহৃত হয়। এই অর্থে আধুনিক বাংলা ভাষায় শব্দটির প্রয়োগ না-থাকলেও মধ্যযুগে হতো। তাই কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যে পাই : গোঁফে দেয় তার। (অন্নদামঙ্গল) গোঁফে তা দিয়া কয় গভীর গর্জনে। (শ্রীধর্মমঙ্গল, মাণিক গাঙ্গুলী, গোঁফ পাকানো অর্থে)। রুষিয়া শার্দুল ঘন তা দেয় গোঁফে। (ঘনরাম চক্রবর্তী, গোঁফের প্রান্তভাগ পাকিয়ে তারের মতো সরু করা বা গোঁফের পরিপাটি করা।

৩) তা―পদে বিশেষ্য। তারিখ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ (তা, তাং, তাঃ)। যেমন : তা, ১০ই মাঘ, তাং ১২ই চৈত্র, তা ২রা এপ্রিল।

৪) তা―বিশেষ্য পদ। ফারসি শব্দ। অর্থ : খণ্ড, ফর্দ, খান, টা, অংশ। এক তা, দুই তা, পাঁচ তা কাগজ (ংযববঃ)। চব্বিশ তায়ে এক দিস্তা। বিশ দিস্তা বা পাঁচশ তায়ে এক রিম।

৫) তা―সর্বনাম পদ। সংস্কৃত তদ্ > প্রাকৃত তা। এই তা সর্বনামটি মৈথিলী ও প্রাকৃত পৈঙ্গল ভাষায়ও লক্ষ করা যায়। অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রমোহন ও হরিচরণ তেমনটি জানিয়েছেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্য থেকে উদাহরণ সংগ্রহ করলে দেখা যাবে, এই তা সর্বনামটি কখনও ব্যক্তিবাচক আবার কখনও বস্তুবাচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে সর্বসাধারণ নামপুরুষে এই সর্বনামের ব্যবহার অধিক। আঞ্চলিক ভাষায় এটি তুচ্ছার্থক সর্বনাম হিসেবেও প্রয়োগ হয়েছে। শব্দটিতে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে (তাঁ) সম্মানার্থেও প্রয়োগ হয়। তাই তা-এর অর্থ : তাহা, সেই ব্যক্তি, সে-সমস্ত, সেসব, তাছাড়া, তাকে, তার ইত্যাদি। এগুলোর কয়েকটি উদাহরণ প্রাচীন সাহিত্য থেকে চয়ন করা যায় :

* পুলকে ভরল সব গা/ ঝাঁপরে বসন দিয়া তা। (নবদ্বীপ পরিক্রমা, ১৩১৬)।

* এক বাক্যতা নাহি, তাতে স্বামী নাহি মানি। (চৈতন্য চরিতামৃত)।

* একে মনসা তাতে ধুনার গন্ধ। (প্রবচন)।

* তোর মৃদু রায়, কামশরে তায়, চিত্ত কৈল চমকিত। (কবিকঙ্কণ, চণ্ডী)।

* তা সঞে করত হে টেরি। (বিদ্যাপতি)।

* ক্ষুধার কালে কে তারারে দিবরে ভাত পানি। (পূর্ববঙ্গ গীতিকা)। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এখনও সর্বনামের বহুবচনে তাদের অর্থে তারারে ব্যবহৃত হয়।

প্রাকৃত বাংলায় এই তা-এর অন্য রূপগুলো বিভক্তিভেদে এরকম : তোঁ, তোঁহে, তেহোঁ, তাএ, তাক, তেএঁ, তকত, তাহাক ইত্যাদি। সর্বজনবিদিত যে, এগুলোর প্রয়োগ আধুনিক বাংলা ভাষায় এখন আর নেই।

* তা―অব্যয় পদ। কথার মাত্রা বা বাক্যালংকার হিসেবে এই অব্যয় পদটি একালে কথোপকথনের ভাষায় ব্যবহার হয়। বিশেষত উপন্যাস ও নাটকের সংলাপে বাক্যালংকার হিসেবে এই তা অব্যয়ের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কিন্তু, তথাপি, তবু, তাছাড়া ইত্যাদি অর্থে তা অব্যয়টি সংলাপে বাক্যালংকার হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায়। যেমন :

* তা, হ্যাঁ গা শচীপতি! তুমি চোখ বুজিয়ে রয়েছ কেন ? (শৈলবালা)।

* কদিন ডেকে পাঠাচ্চি তা তোর আর বার হয় না! (নীলদর্পণ)।

* তা যাক গিয়ে―আমরা আদার বেপারী জাহাজের ব্যাপারে কাজ কি ? (বঙ্কিমচন্দ্র)।

কালপরিক্রমায় রূপান্তর এবং অনেক ক্ষেত্রে বিলুপ্ত হওয়া শব্দের স্বভাব। মুখের ভাষার প্রতিনিয়ত ব্যবহার থেকে যে-শব্দ দূরে চলে যায় সেই শব্দই মুমূর্ষু হয় এবং তার অপমৃত্যু ঘটে। সেসবের আশ্রয় হয় অভিধানে।  ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও অভিধানে সেই রূপান্তরিত, কোমায় আশ্রিত ও বিলুপ্ত শব্দের ইতিহাস পাওয়া যায়। কিন্তু যেসব শব্দ মানুষের মুখের ভাষায় সর্বদা সচল তা টিকে থাকে কালান্তরে ও প্রজন্মান্তরে। আমাদের আলোচ্য তা শব্দটি তেমনই, যা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদের কাল থেকে এখনও অবিকৃতরূপে সুপ্রচলিত। এবার কালানুক্রমে চর্যাপদ থেকে একাল পর্যন্ত তা সর্বনাম প্রয়োগের কয়েকটি উদাহরণ চয়িত হলো :

* তা দেখি কাহ্ন বিমন ভইলা। (৭ নং চর্যাপদ, আনু, ১২০০ খ্রি.)।

* তা সহ্মার হৃদয়  হরিআঁ নিল আহ্মে। ( শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ১৪৫০ খ্রি,)।

* সজাহ আনল সখি আমি তাতে মরি। (মালাধর বসু, ১৫০০ খ্রি.)।

* সর্ব্বাঙ্গে প্রস্বেদ ছুটে তাতে রক্তোদ্গম। (কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ১৫৮০ খ্রি.)।

* বেগে হোতা ধায় তাড়্যা ধরে তায়। (মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ১৬০০ খ্রি.)।

* ওমা স্থানের মধ্যে অভয় চরণ তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি। (রামপ্রসাদ, ১৭৮০ খ্রি.)।

* তাঅ নেবে তুলি পদ্ম হইএ আকুতি। (মানিকরাম, ১৭৮১ খ্রি.)।

* স্বামীর খুনের ছোপ-দেওয়া, তায় ডগডগে আনকোরা। (নজরুল ইসলাম, ১৯২২ খ্রি.)।

* তায় বাইরে তো ঘুটঘুটে অন্ধকার। (বিভূতিভূষণ, ১৯৩৩ খ্রি.)।

এ পর্বের প্রারম্ভে উল্লিখিত রবীন্দ্রনাথের গানের চরণের তাতা থৈথৈ ধ্বন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দের প্রয়োগ। আমরা সে-সম্পর্কে লেখার শুরুতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেই গানেই কবির আরেকটি চরণ : নিতি নৃত্যে কে-যে নাচে তাতা থৈথৈ। (১৯১০)। নজরুলের গানেও পাই : তাতা থইথই খল খল খল নাচে। (১৯২২)। রবীন্দ্র-নজরুলের প্রায় সমকালে ছড়াসাহিত্যে ধ্বন্যাত্মক শব্দ-প্রয়োগে কৃতিত্বের অধিকারী সুকুমার রায়। তবে রবীন্দ্রনাথই বাংলা ভাষায় ধন্যাত্মক দ্বিরুক্ত শব্দের বৈশিষ্ট্য এবং প্রকাশ-বৈচিত্র্যের স্বরূপ প্রথম চিহ্নিত করেছেন। তাঁর শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে ধ্বন্যাত্মক শব্দ নামে একটি প্রবন্ধ আছে। সেটি তিনি শুরু করেছেন এভাবে : বাংলা ভাষায় বর্ণনাসূচক বিশেষ একশ্রেণির শব্দ বিশেষণ ও ক্রিয়ার বিশেষণ রূপে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হইয়া থাকে, তাহারা অভিধানের মধ্যে স্থান পায় নাই। অথচ সে-সকল শব্দ ভাষা হইতে বাদ দিলে বঙ্গভাষার বর্ণনাশক্তি নিতান্তই পঙ্গু হইয়া পড়ে। (রবীন্দ্র-রচনাবলী, ষষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ৬৫১, ঐতিহ্য সংস্করণ)।

তন্ত্র

আমি তন্ত্রমন্ত্র কিছুই জানিনে, মা।

জানি আমার অনেক আছে দোষ

তবু মাগো তোমায় ভালোবাসি,

আমি নয়ন মুদেও দেখতে সদাই পাই

তোমারই ওই ভুবনমোহন হাসি।

                    ―রামপ্রসাদ সেন

সবাই জানেন, সংবিধানমতে আমাদের দেশের নাম―গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। বাহাত্তরের সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি : গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতা। আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও সংবিধানের অনেক স্থানে তন্ত্র শব্দটি আছে। আধুনিক সমাজজীবন এককথায় তন্ত্রময়। পৃথিবীর দেশে দেশে, নানা সমাজে কত ধরনের তন্ত্র যে চালু আছে তা লিখে শেষ করা যাবে না। বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে সর্বাধিক প্রচলিত গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ছাড়াও আছে―ধনতন্ত্র, মানবতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, রাজতন্ত্র, সামরিকতন্ত্র, জমিদারতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, শাসনতন্ত্র আরও কত কী! এসব তন্ত্র রাজনীতি, সমাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিষয়-আশয়। মতবাদ, দর্শন, নীতি, আদর্শ ইত্যাদি অর্থে সেখানে তন্ত্র শব্দটি ব্যবহৃত। সরকার ও রাষ্ট্র-পরিচালনার ধরনের ওপর এসব তন্ত্রের চরিত্র বা স্বরূপ নির্ণিত হয়। এত সব তন্ত্রের বাইরে স্বতন্ত্র। ইদানীং আবার স্বতন্ত্রর জয়জয়কার! তা আমরা লক্ষ করেছি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। স্বতন্ত্র শব্দের অর্থ নিজের নীতি-আদর্শ এবং মত পথ বোঝালেও তা এখন মূলত প্রচল স্রোতে গা-ভাসানোই! এছাড়া প্রাচীন ভারতীয় দর্শন ও বিভিন্ন শাস্ত্রে বহুবিধ তন্ত্রের কথা আছে। যেমন―বস্তুতন্ত্র, জড়তন্ত্র, শক্তিতন্ত্র, শৈবতন্ত্র, বৈষ্ণবতন্ত্র, বীণাতন্ত্র, নায়তন্ত্র, সাংখ্যতন্ত্র কপিলাতন্ত্র, পূর্বতন্ত্র, উত্তরতন্ত্র ইত্যাদি। এবার তন্ত্র শব্দটির ব্যুৎপত্তি ও বিচিত্রবিধ অর্থের গভীরে চোখ ফেরানো যাক।

তন্ত্র শব্দটির বুৎপত্তি বা গঠন তন্ (বিস্তার করা) + ত্র। এটি বিশেষ্য পদ। এর সাধারণ অর্থ, উপাসনার বিধিবিষয়ক শাস্ত্র―যে শাস্ত্রে সাধনার প্রণালী বা পদ্ধতি বর্ণিত থাকে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনমতে, তন্ত্র হলো, শিবশক্তির পূজাবিধায়ক শাস্ত্র। তবে বিভিন্ন শাস্ত্রে ১৯২টি তন্ত্রের উল্লেখ আছে। কৃষ্ণানন্দ নামের জনৈক সংস্কৃত পণ্ডিত সেগুলো সংগ্রহ করে তন্ত্রসার নামে একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। এই তন্ত্রগুলোর আবার অসংখ্য উপতন্ত্রও আছে। তথ্যসূত্রসহ সেগুলোর বিবরণ পাওয়া যায় নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর পুরাণকোষ তৃতীয় খণ্ডে। সেসব তত্ত্বকথা সাধারণের পক্ষে বুঝে-ওঠা দায়! তবে সহজ কথায় যে কোনও শাস্ত্র বা জ্ঞানের বিষয়ই তন্ত্র। তাই নৃসিংহপ্রসাদ লিখেছেন, তন্ ধাতুর অর্থ বিস্তার করা। এইজন্য তন্ত্র শব্দের ব্যাখ্যা করে বলা হয়―এই শাস্ত্রের দ্বারা জ্ঞান বিস্তারিত হয়, তাই একে তন্ত্র বলা হয়…। (পুরাণকোষ, তৃতীয় খণ্ড)।

জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের বাঙ্গালা ভাষার অভিধান-এ তন্ত্র শব্দটির ২৮টি এবং হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষে ৩৫টি প্রধান অর্থ আছে। বিকল্প অর্থ আছে আরও শতাধিক! সেসব উল্লেখ করলে স্নায়ুবিক বিভ্রমের আশংকা সমধিক। তবে সর্বনাশে কিঞ্চিৎ রক্ষা যে, সেগুলোর সিংহভাগের প্রয়োগ আধুনিক বাংলা ভাষায় নেই। তাই বাংলা একাডেমির আধুনিক বাংলা অভিধানে তন্ত্রের অপ্রচলিত অর্থ বাদ দিয়ে কেবল ১২টি দেওয়া হয়েছে। এগুলো নিম্নরূপ : ১. উপাসনা বিধি-সংক্রান্ত শাস্ত্র ২. বেদের শাখাবিশেষ ৩. রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি ৪. শাস্ত্র ৫. কোনও বিশেষ মতবাদ ৬. ঝাড়ফুঁক ৭. পন্থা ৮. সিদ্ধান্ত ৯. অধ্যায় ১০. তাঁত ১১. পশুর অন্ত্র ১২. তার ( ধাতুনির্মিত সুতা)।

এবার আমাদের সাহিত্যের রথি-মহারথিদের রচনায় প্রাপ্ত তন্ত্র শব্দের ভিন্নার্থক প্রয়োগ-বৈচিত্র্য লক্ষ করি।

* অতি সুদ্ধ রূপ সেই মূল তন্ত্র বেড়ি। (তৎসম শব্দ, বিশেষ্য পদ, শাস্ত্র অর্থে, মালাধর বসু, ১৫০০ শতক আনু)।

* তন্ত্রবায়ে সব হৈলা আনন্দে বিহ্বল। (তৎসম শব্দ, বিশেষ্য পদ, সুতা অর্থে, বৃন্দাবন দাস, ১৫৮০ আনু)।

* বিচারিআ নানা তন্ত্র লইব রামের মন্ত্র। (ঐ, মন্ত্রবিদ্যা অর্থে, মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, ১৬০০ শতক, আনু)।

* তন্ত্রকারেরা কহেন, কলিযুগে বেদোক্ত সন্ন্যাসাশ্রম নিষিদ্ধ। (তৎসম শব্দ, বিশেষ্য পদ, তন্ত্রের ভাষ্যকার অর্থে, অক্ষয়কুমার দত্ত, ১৮৫০)।

* তন্ত্র শাস্ত্রে বাঙ্গালা বর্ণমালার বিশেষ বর্ণন আছে। (তৎসম, বিশেষ্য পদ, সনাতনী শাস্ত্রবিশেষ অর্থে বঙ্গদর্শন, ১৮৭২)।

* বরঞ্চ তন্ত্রবাদিনী বা তন্ত্রীকুশলা বলা যেতে পারে।

(তৎসম, বিশেষণ পদ, স্ত্রীলিঙ্গার্থে তারের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে দক্ষ অর্থে, রবীন্দ্রনাথ, ১৮৮৫)।

* গুরু তুমি তন্ত্রের তন্ত্রী। (তৎসম, বিশেষ্য পদ, শাস্ত্রবিশারদ অর্থে, লালন সাঁই, ১৮৯০)।

* আধুনিক ভাবের তন্ত্রধারক ছিল। (তৎসম, বিশেষণ পদ, মূল চেতনা ধারণকারী অর্থে, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, ১৯৫০)।

* বাজায় হৃদয়বীণার তন্ত্র। (তৎসম, বিশেষ্য পদ, ধাতুনির্মিত তার অর্থে, রবীন্দ্রনাথ, ১৯১২)।

* আমার প্রতি তন্ত্রী, গ্রন্থি মেদ মজ্জা। (ঐ, ধমনী-শিরা অর্থে, নজরুল ইসলাম, ১৯২৬)।

কীর্তিমান বাঙালি লেখকদের রচনায় তন্ত্রী শব্দের এমন বৈচিত্র্যময় প্রয়োগের নিদর্শন লক্ষ করা যায়।

এ পর্বের শীর্ষে বাংলা কালীকীর্তন ও শ্যামাসংগীতের অন্যতম দিকপাল রামপ্রসাদ সেনের গানের যে অংশবিশেষ উদ্ধৃত হয়েছে তাতে তন্ত্রের সঙ্গে মন্ত্র শব্দটি যুক্ত হয়েছে। তন্ত্রমন্ত্র সমাসবদ্ধ যমজ শব্দ এবং তা দ্বন্দ্ব সমাসের অন্তর্গত। এই জোড়া শব্দটির আছে নানাবিধ অর্থ। সাধারণভাবে এর অর্থ বিভিন্ন রকম মন্ত্র। কিন্তু পুরাণমতে একক মন্ত্র শব্দের অর্থ : সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বেদ থেকে উদ্ধৃত কতিপয় নাম সংবলিত শ্লোক। অথবা উপাসনা বা পূজার্চনার জন্য সুনির্দিষ্ট বাক্য বা পদকে মন্ত্র বলা হয়। অন্যভাবে বলা যায়, মন্ত্র হলো, হিন্দুবিশ্বাসে ত্রাণকারী শব্দপুঞ্জ বা বাক্যাবলি। তাছাড়া জাদুবিদ্যা, ভেলকিবাজি, বশীকরণ, ঝাড়ফুঁক, দৈববিদ্যা ইত্যাদির শ্লোককেও মন্ত্র বলা হয়। শাক্তভক্ত রামপ্রসাদ সেই গানে শাস্ত্রবিদ্যায় নিজের অজ্ঞতা ও দীনতার কথা আরাধ্যার কাছে প্রকাশ করেছেন। জপতপের মাধ্যমে ঈশ্বর-সাধনা অত্যন্ত কঠিন। তা যে কোনও ধর্মের মহাপুরুষের জীবনসাধনায় লক্ষ করা যায়। সেই সাধনার মত ও পথ ভিন্ন হলেও স্বরূপ কখনও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তাই প্রবাদ আছে, মন্ত্রের সাধন, নয় শরীর পাতন। তন্ত্রসাধনা যারা করেন তাদের বলা হয় তান্ত্রিক (তন্ত্র + ইক)। আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসে ভয়াবহ ও রোমহর্ষক এক তান্ত্রিক কাপালিকের পরিচয় পাই। সে নরবলি দিয়ে সেই ছিন্নমস্তক শবদেহের ওপর বসে শক্তির উপাসনা করে। বঙ্কিমবর্ণিত সেই কাপালিকের কথা স্মরণ হলে পাঠকমাত্রেরই মনে ভীতি, বিবমিষা ও ঘৃণা জাগে।

[চলবে]

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button