অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প : ছারপোকাগণ

মূল : অ্যালেকজান্ডার শারিপ্রভ

বাংলা অনুবাদ : রঞ্জনা ব্যানার্জী

[আলেকজান্ডার শারিপ্রভ ১৯৫৭ সনে রাশিয়ার উত্তরের ঐতিহাসিক শহর ‘ভেলিকি উস্ট্যুগ’-এ জন্মগ্রহণ করেন। ভøাদিমিরের পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক  হওয়ার পরে শারিপ্রভ একই শহরেই গোলাবারুদ তৈরির এক কারখানায় চাকুরি নেন। এই সময়ে তাঁর লেখালেখিও সমান উদ্যমেই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য দীর্ঘদিন তাঁর লেখা কোনও প্রকাশকেরই আনুকূল্য পায়নি। বারবার প্রত্যাখ্যানের পরে অবশেষে রাশিয়ার বিখ্যাত ম্যাগাজিন সোলোতে তিনি লেখা পাঠান এবং তাঁর ব্যতিক্রমী লেখাগুলো এই ম্যাগাজিনই সর্বপ্রথম কদর করে। তাঁর গল্প মস্কো ভিত্তিক ইয়োনস্ত ম্যাগাজিনেও জায়গা করে নেয়। আলেকজান্ডার শারিপ্রভের লেখা দ্য মাদার অফ কখ্ (The Mother Of Koch) এবং রেড আন্ডারপ্যান্টস (Red Underpants)  শিরোনামের দু খানি উপন্যাস এখনও প্রকাশের অপেক্ষায়।]

এ কটা ছারপোকা তোষকের ওপর হন্যে হয়ে ছুটছিল। ধূসর সেই তোষকের গা জুড়ে সবুজ ডোরাকাটা এবং তার পরে ছুটন্ত লাল ধনুক-পায়ের এই ছারপোকাটির নাম প্রোকোপিচ।   

প্রোকোপিচ, রোজকার মতোই আজও সেই কালো দাগটার ধার ঘেঁষে বাম দিকে মোড় নিয়ে, উঁচু ঢিবির মতো জায়গাটায় চড়েছিল। এরপর নিচে নামতে গিয়েই অপর ছারপোকাটার গায়ে প্রায় পড়ে আর কি! এই দ্বিতীয়জনের নাম সিডর কুইজমিচ।    

‘আরে ঠিক আছে প্রোকোপিচ। কিন্তু তোমায় ফিরতে হবে যে! কেউ নেই এদিকে। আমাদের খাদ্যবাহক আজ খাদ্য সরবরাহ করছেন না’, সিডর জানাল।   

আঁতকে উঠল প্রোকোপিচ, ‘কী ?!’

‘মিথ্যে বললে আমার যেন নরকবাস হয়’, বুকে ক্রুশ এঁকে দিব্যি কাটলো কুইজমিচ। ‘বেড়ার ওধারে সবাই জড়ো হয়েছে। চলো দেখে আসি কী ভাবছে অন্যেরা’। 

দুশ্চিন্তাগ্রস্ত প্রোকোপিচ মাথা নিচু করে কুইজমিচের পেছন পেছন চলছিল। পথে ভাসিয়া গুবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওদের।

‘কী ব্যাপার বলো তো, আমাদের রেশন নাকি বন্ধ হয়ে গেছে ?’, উদ্বিগ্ন ভাসিয়া জানতে চাইল।

প্রোকোপিচ নিজের মনেই বিড়বিড় করল, ‘গোল্লায় যাক সব’।  

‘ব্যাপারটা খানিকটা তেমনই ভাসিয়া’, কুইজমিচ উত্তর দিল, ‘বেলাগ্রুদভকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে তার বিছানাতে ঘুমাচ্ছিল না আজ’।  

অতঃপর ওরা তিনজন মাথার ওপরে বিষন্নতার মেঘ ভাসিয়ে ছারপোকাদের সভাস্থলের উদ্দেশ্যে পা চালিয়েছিল।

বেড়ার ওপারে তখন ছারপোকাদের হল্লা, ধোঁয়া, সব মিলে সে এক হুলস্থুল অবস্থা! সমস্ত জায়গা জুড়ে পায়ের ছাপের অগুন্তি রেখা এবং সিগারেটের খোসায় ছেয়ে আছে।   

ওদের দেখতে পেয়েই মিশা চুচিন হাত বাড়ালো, ‘আরে বসো বসো প্রোকোপিচ, একটা সিগারেট নাও,’। মিশা এমনভাবে হাঁটুমুড়ে পাছা ঝুলিয়ে দুলেদুলে ধোঁয়া ছাড়ছিল, মনে হচ্ছিল যেন ‘প্রকৃতির ডাক’ উদ্যাপন করছে সে।

‘কী ঘটছে বলো তো’, উদ্বিগ্ন প্রোকোপিচ হাত ছড়িয়ে জানতে চাইল।   

‘আমিই বলছি’, রোগাপটকা ইভান বুরাকভ চোখ পিটপিটিয়ে শুরু করল, ‘হয়েছে কি আজকে সবচে আগে আমিই বেরিয়েছিলাম। বিছানা ফাঁকা দেখে ভেবেছিলাম ছুঁচোটা বোধহয় ঘুমায়নি এখনও, দেখতে পেলেই টিপে মারবে। কিন্তু ঝুঁকি তো নিতেই হবে। তাছাড়া আমিও বেড়াল পায়ে শব্দ লুকিয়ে হাঁটতে জানি। চারপাশে যাকে বলে পিনপতন নীরবতা। সেই নরম জায়গাটা, যেখানে স্প্রিং থাকে, সেইখানে কান পাতলাম। আশ্চর্য কোনও ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ নেই! কী একটা ছ্যাড়াব্যাড়া জীবন আমাদের! মাদারচোত, নিশ্চিত কোথাও ঘাপটি মেরে আছে! তাও ঝুঁকিটা নেবার সিদ্ধান্ত নিলাম। হামা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। চোখ-নাক বন্ধ করে দিলাম ছুট! যদিও পেছনে কিছু ক্যাঁচক্যাঁচ করছিল না, তাও প্রমাদ গুনছিলাম। আমি জানি ওর কারসাজি, ধরো তুমি অবিরাম জপতে জপতে ভাবছো এ যাত্রায় বুঝি রক্ষা পেলে, ঠিক তখুনি ও খপ করে তুলোয় চেপে ধরে তোমায় জ্যান্ত আগুনে পুড়িয়ে মারবে। এটাই নতুন ফন্দি ওর; তুলো দিয়ে টিপে ধরা। সেই আতঙ্কেই বেদম ছুটছিলাম। মাথা নিচু করে তোষকের ফাঁকফোকরে নিজেকে লুকোচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, আরে! তোষকের কিনারে ওর গোড়ালি জোড়া দেখলাম না তো! তার মানে ও নেই ওখানে। এই নিয়ে আমার খানিক কুসংস্কার আছে। দেখো, ও বিছানায় শুলেই তোষকের কিনারে কালো সুতোয় সেলাই করা জায়গাটা আছে না, ঠিক সেইখানে ওর গোড়ালি জিরোবেই। আমি ফের ফিরলাম। খুঁটিয়ে দেখলাম; যা ভেবেছি ঠিক তাই, ওর পায়ের পাতাজোড়া নেই সেখানে!’

‘হায় যিশু!’ প্রোকোপিচ হাহাকার করে উঠল।      

‘সত্যি! ব্যাপারটা আমার মগজেও ঘাই দিয়েছিল। সেই কারণে নিজেকে আর আড়াল করিনি। যতদূর চোখ যায় সবখানে খুঁজেছি। তোষকের খাঁজে, আনাচ-কানাচে, পুরো বিছানার কাঠামোর চারধার―কিস্সু বাদ রাখিনি। জীবনবাজি রেখেই বলছি, কোত্থাও নেই বেলগ্রুদভ। এমনকি ওর সেই ড্রেসডেন ড্রাম, সেটাও বাদ দিই নি। বেয়ে উঠেছি। ভাবা যায় ? হাঁপ ধরে গেছে আমার! আর তখনই মিশার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল―’

‘এই যে সিমন!’ মিশা চুচিনের কান নেই এইদিকে, হাত বাড়িয়ে নতুন একজনকে স্বাগত জানাতে ব্যস্ত সে, ‘আরে একটা সিগারেট নাও। পা তুলে আরাম করে বোসো’।    

‘না না, একটা সিদ্ধান্তে আসুন আপনারা। এরপর কী করার আছে, কী করবো আমরা সেটা বলুন!’, অল্পবয়েসী ছারপোকাটা তড়বড়িয়ে বলল।  

‘আমার স্থির বিশ্বাস ও বিছানার নিচেই আছে’, সালভা পেন গোমড়ামুখে রায় দিল। বেড়ার গায়ে এক কাঁধ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ও শুনছিল সব। আনকোরা সবুজ টুপিটা মাথার চারধারে অবিরাম ঘোরাচ্ছিলো; একবার পেছন থেকে সামনে, পরক্ষণেই সামনে থেকে সামনে।

‘সে তো অবশ্যই। কোথাও না কোথাও তো ঘাপটি মেরেই আছে,’ গা চুলকাতে চুলকাতে সায় দিল প্রোকোপিচ। ‘আচ্ছা ও কি প্যান্ট ছেড়েছিল ?’ 

‘কী বলছো প্রোকোপিচ! আমরা কীভাবে জানবো ?’ চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপছে ইভান বুরোকভের। ‘ও বাতি নিভিয়েছিল, আমরা সবাই দেখেছি এবং ও ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করেছিল, তাও দেখেছি আমরা। কিন্তু প্যান্ট ছেড়েছিল কিনা তা কীভাবে জানব ?’ 

‘এই বিষয়টাও আমাদের খেয়াল করা উচিত ছিল,’ প্রোকোপিচ মাথা দোলালো।

‘ও ওর বিছানার তলাতেই সেঁধিয়েছে, আর কোথাও নয়’, স্লাভা পেন ফের টুপি ঘোরাতে ঘোরাতে জোর দিল।

‘তবে আমরা এখানে খামাখা বসে আছি কী করতে ? এখানে বসে থাকার তো কোনও মানে নেই, না ?,’ ছোকরা ছারপোকাটার এবার আর তর সইছে না, ‘চলো যাই ওর খোঁজে’।  

‘শোনো বাবা, দেখে মনে হচ্ছে তুমিই আমাদের মধ্যে দ্রুততম’, প্রোকোপিচ যুক্তি টানলো, ‘তুমিই বরং দেখে এসো! এই নাক বরাবর গেলেই পেয়ে যাবে কাঠামোটা আর ওটার গা বেয়ে উঠলেই সটান বিছানায়! যাও ছুট লাগাও!’

‘ঠিক আছে, কিন্তু এমনি এমনি তো এ কাজ হবে না। কিছু একটা ফুঁকতে দাও, তবেই যাচ্ছি’। 

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অন্যেরা ওর হাতে দু-দুটি সিগারেট দিল। ছোকরা অসীম দ্রুততায় তার একটা নিজের কানের পেছনে গুঁজে অন্যটি ঠোঁটের ফাঁকে আঁটকালো এবং উল্কার গতিতে হাওয়া হয়ে গেল। দূর থেকে কেবল ওর প্যান্টের আবছা আভাস দেখা যাচ্ছিল।      

‘বাপরে বাপ,’ প্রোকোপিচ বসতে বসতে দম ছাড়ল, ‘ও কে ?’।

‘পাম্পকিনের ছেলে’, জানালো মিশা চুচিন। 

‘মনে হয় না ওকে আমি চিনি,’

‘অবশ্যই চেনো। ও পাম্পকিনের ছেলে। গত বছর ওর বউকে সুপারফসফেট দিয়ে খুন করা হয়েছিল’।

‘পাম্পকিনের বউকে ?’

‘না না পাম্পকিনের বউ নয়। কলিয়ার বউকে। ঐ যে যাকে আমরা ‘লাল ওয়ান্ডা’ বলে ডাকতাম। চড়া গলা, বিশাল পাছাবতী। গারিবল্ডি!’ 

‘ও হো বুঝেছি, ও আফোনিয়া পাম্পকিনের ছেলে কলিয়া’।

‘ঠিক তাই’ 

‘বাব্বা কেমন ব্যায়ামবীরের মতো শরীর পাকিয়েছে!’

‘হুম’

‘আমি যখন সেই ৯৭ নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে থাকতাম―’ স্লাভা পেন ফের  শুরু করল।

‘সেখানে তো একটা পরিবারও থাকতো তাই না’―প্রোকোপিচ দ্রুত মূল বিষয়ে আসতে চাইল।   

‘ঠিক―তো যখন ওখানে ছিলাম, ওরা মাঝেমধ্যেই বিছানার নিচে সেঁধিয়ে ঘুমাতো যেন ওদের খুঁজে না পাই। কিংবা দেরাজের ভেতরে। আরে দাঁড়াও দাঁড়াও’,  জরুরি কিছু মনে পড়ে গেল যেন স্লাভার। ‘বিছানার নিচে যদি ওকে পাওয়া না যায় তবে ও নির্ঘাত দেরাজের ভেতরে লুকিয়ে আছে’।

‘এই যে দেরাজপোকাগণ! শুনতে পাচ্ছেন ? দেরাজবাসীদের কেউ আছেন এখানে ?’ প্রকোপিচ গলা উঁচু করে হাঁক দেয়।

‘এমনভাবে বলছো যেন ওরা থাকলেই স্বেচ্ছায় বেরিয়ে আসবে। ঠিক আছে তবে বসে থাকো এবং অপেক্ষা করো,’ স্লাভা পেন বিরক্তি লুকাল না। ‘আমি নিশ্চিত; সে দেরাজেই আছে’।

‘হবে হয়তো। কোথাও যখন নেই তখন সেখানে থাকার সম্ভাবনা বাদ দেওয়া যায় না,’ প্রোকোপিচ গা চুলকাতে চুলকাতে শান্তভাবে ব্যাখ্যা দিল। এই দেরাজের ভেতর খোঁজার জন্যে ওকে আবার কত ক্রোশ যে ছুটতে হবে তা ভাবতেই ওর মেজাজের পারা চড়ে যাচ্ছে! 

‘না এই লোক একটা ছুঁচোই’, সমবেত ছারপোকাদের ওপর চোখ বুলিয়ে রায় দিল ইভান বুরাকভ। ‘আর এই পৃথিবী চিরকাল এই সমস্ত ছুঁচোদের সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে চলেছে। এরা আমাদের প্যাঁচে ফেলবার জন্যে করতে পারে না হেন কাজ নাই!’

‘দাঁড়াও!’ মিশা চুচিন ওর ভ্রূর ওপর হাত ছুঁয়ে দৃষ্টির তীক্ষèতা বাড়ালো, ‘তোমাদের এই তর্কাতর্কির অবসান করছি শিগগিরই। হুম, ঐ তো আমি একজন দেরাজপোকাকে দেখতে পাচ্ছি!’ গলা চড়িয়ে হাঁক দিল মিশা চুচিন, ‘আরে ওহে কাজলাভস্কি! শেষ পর্যন্ত ঘুম ভাঙলো ? ইদিকে এসো। বসো। একটা সিগারেট খাও’। 

সবাই দেখল বেড়ার কাছেই ঘুরঘুর করছে পাগলা কিসিমের এক ছারপোকা। মিশার ডাক শুনে দুই কব্জি দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে তাকালো সে। মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, জামাকাপড় অবিন্যস্ত কিন্তু গলায় তার পরিপাটি টাই বাঁধা। লাজুক গলায় সে সকলকে সম্ভাষণ জানিয়ে জুতো দিয়ে অবিরাম মাটি খোঁচাতে লাগল।

‘দেখো কাণ্ড! আবার টাই ঝুলিয়েছে গলায়,’ মিশা চুচিন গলা নামিয়ে টিপ্পনী কাটলো। ‘মনে হচ্ছে আজকের অনুষ্ঠানের সঞ্চালক তিনি!,শালা!’, এরপর গলা চড়িয়ে ফের জানতে চাইল, ‘তো জনাব কাজলাভস্কি আজ ঠিক কীসের উদযাপন করছেন আপনি ? জুয়াতে বড় দাও জিতেছেন ?’

‘মানে ? ওহ! না না ওসব কিছু নয়―এই আর কি, সব সময়ের মত,’ বিব্রত কাজলাভস্কি হাত নেড়ে সহজ হতে চাইল এবং সকলের মুখের দিকে তীব্র দৃষ্টি বুলিয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল।

‘তার মানে সে তোমার ওখানেও নেই ?’

‘কী ?―’, কাজলাভস্কি কথা না বাড়িয়ে পেছনে সরে গেল।  

‘মাদারচোত’, বিভ্রান্ত মিশা মেজাজ সামলাতে পারল না এবং গাল দেওয়ার জন্যে মুখ খুলতেই ওর মুখের সিগারেট খসে পড়লো নিচে। 

দীর্ঘক্ষণ সবকিছু কেমন নিঝুম হয়ে রইলো। এই গহিন নীরবতায় কেবল মিশা চুচিনের খসে পড়া সিগারেট অদ্ভুত আওয়াজ তুলে ফুলকি ফোটাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন সিগারেট নয় কাঠের ছিলকা জ্বলছে―হায়, ওদের এই ছারজীবনও এমনই প্রহসনে ভরা।  

‘কিছু একটা সমস্যা হয়েছে,’ অবশেষে নীরবতা ভাঙলো প্রকোপিচ, ‘কলিয়া এখনও ফিরল না!’

‘ঐ তো কলিয়া!’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেছনে পাহারায় থাকা ছারপোকাদের একজন জানান দিল। 

‘ভাইয়েরা আমার,’ তরুণ কলিয়ার গলায় খুশি উপচে পড়ছে, ‘দারুণ সুখবর! বেলাগ্রুদভ বিছানার নিচে নেই!’

‘ধুত্তোরি’! প্রোকোপিচ সজোরে হাঁটু চাপড়ালো এবং হতাশায় এক থোক থুথু ছুঁড়ে দিল মাটিতে। আবারও সেই অনিশ্চয়তা। সেই একই দুশ্চিন্তা!

‘আরে শোনো!’ কলিয়া চেঁচিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছিল। ওর ঘামে ভেজা, ধুলোমাখা মুখটি প্রাণপণে উঁচুতে তুলে সমবেত ছারপোকাদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারবে না কী ঘটেছে!’ এইটুকু বলেই ও অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সবাই অবাক হয়ে দেখলো কলিয়া নিজেই নিজেকে জড়িয়ে হাসতে হাসতে প্রায় দুই ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে! বিহ্বলতা কাটিয়ে এবার ক্ষেপে গেল ছারপোকারা, ‘আশ্চর্য! এত  হাসির কী হলো! আচ্ছা ফাজিল তো!’ হাসি সামলে এবার কলিয়া রীতিমতো চেঁচিয়ে জানালো, ‘ঈশ্বরের দোহাই আমি নিজের চোখে দেখেছি। চিড়িয়াটা ঘরের ছাদে বসে আছে! ভাবতে পারো ?’ 

কী বলছে কলিয়া! ছারপোকাদের গুঞ্জন তীব্র হলো। প্রোকোপিচ ওর গা চুলকানো শেষ করে একপাশে দাঁড়িয়ে কলিয়াকে গভীর মনোযোগ দিয়ে নিরীক্ষণ করছিল। হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল ওর চোখেমুখে, সঙ্গে সঙ্গে জোরে ধমকে উঠল, ‘এই ছেলে কী বলছো এসব! ও ছাদে বসতে গেলেই তো নিচে পড়ে যাবে।’  

সমবেত ছারপোকাদের গুঞ্জন থেমে গেল তৎক্ষণাৎ।  

‘উফ্!’, মিশা চুচিন মাথা ঝাঁকিয়ে হাতের সিগারেটটা দূরে ছুঁড়ে এগিয়ে এল, ‘কেন বোঝো না, কিছু মানুষের মেধা আমাদের বোধের অতীত!’

‘ইনি কিছু মানুষ নন মিশা, ইনি বেলাগ্রুদভ’, প্রোকোপিচ রাগে ফেটে পড়লো, ‘তুমি যখন পেট টিমটিম করে রক্ত চোষো তখন থাকতে পারো অমন সিলিঙে ঝুলে ? টুপ করে খসে পড়ো না ? কারণ কী ? কারণ হলো  অভিকর্ষ। এই অভিকর্ষ ব্যাপারটা তোমাকে অমন অনায়াসে উল্টো হয়ে ঝুলে চলতে দেয় না। আর বেলাগ্রুদভ তো মানুষ নয়, চর্বির বস্তা। বিছানাতে শুলেই ওর ভারে বিছানা ঝুলে প্রায় মেঝেতে লেগে যায় আর সে কিনা মাথা নিচে ঠ্যাঙ উপরে তুলে বসে আছে! ইয়ার্কি ?’

‘তো ? কী করতে চাও তোমরা’, কলিয়ার খুশি উবে গেছে। রাগে ফুঁসছিল ও। ওর চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে যেন, ‘অ্যাঁ ? বলো কী করতে চাও ?’ তেড়েফুঁড়ে ফের সামনে এগুতে গিয়েই ওর পা ফাঁসলো জ্বলন্ত সিগারেটের খোসায়। তাতেও ওর কথায় ছেদ পড়ল না। ছ্যাঁকা খাওয়া পাটা এক হাতে আলগে অন্য পায়ে লাফাতে লাফাতে চেঁচিয়ে যাচ্ছিল কলিয়া, ‘এ্যাঁ ? বলো! তোমাদের যখন এতই সন্দেহ তবে চলো আমার সঙ্গে। নিজের চোখেই দেখে এসো, আমি ঠিক কি ভুল ?’

‘ঠিক আছে, চলো’, গম্ভীর প্রোকোপিচ উঠে দাঁড়াল। ওর দেখাদেখি অন্য ছারপোকারাও বিনাবাক্যে ল্যাংচানো কলিয়ার পিছু নিল। 

‘আমি আসলেই ব্যাপারটার একটা সুষ্ঠু সমাধান চাই, প্রোকোপিচ’, ভাসিয়া গুবা ওর বিশাল জুতো জোড়ায় আওয়াজ তুলে চলছিল, ‘যদি ওকে পাওয়া না যায় তবে আজ আমাকে নিজের বাড়ির রাস্তাই ভুলে যেতে হবে। বউ এবং পাঁচ পাঁচটা বাচ্চা! আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছো ?’ ‘হুম। বড়ই কঠিন পরিস্থিতি,’ প্রোকোপিচও গতি না থামিয়েই সায় দিল। পকেটে হাত পুরে অসীম দ্রুততায় ছুটছিল সেও। ছারপোকাদের শত শত পায়ের চাপে এক অদ্ভুত গমগম আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছিল চারপাশে। যেন পৃথিবী কাঁপিয়ে যুদ্ধে চলেছে ছারপোকার দল! উত্তেজনায় এ ওর গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে, ও তার পা মাড়িয়ে দিচ্ছে, সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! তারটার কাছে পৌঁছুতেই চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা দেখা দিল। আবছা আলোয় বিভ্রম হলো মিশা চুচিনেরও; পা ফসকে খিস্তি তুলতে তুলতেই অধোমুখে পড়ে গেল নিচে!  

‘আমরা এসে গেছি,’ প্রোকোপিচ বিষন্ন গলায় ঘোষণা দিল।

‘ঈশ্বরের দিব্যি করে বলছি, আমি এক বর্ণও মিথ্যে বলিনি,’ কৈফিয়ত দিতে শুরু করেছিল কলিয়া। একই সঙ্গে রাগান্বিত এবং সন্ত্রস্ত লাগছিল ওকে। কিন্তু ছারপোকাদের তুমুল গর্জনে ওর কোনও কথাই শোনা যাচ্ছিল না।

বিক্ষুব্ধ ছারপোকারা পশুর পালের মতোই ধুলো উড়িয়ে ছুটছিল। কিন্তু অকুস্থলে পৌঁছানো মাত্রই আশ্চর্যজনকভাবে ওদের গতি রহিত হলো; যেন কেউ পেছন থেকে রাশ টেনে জোর করে থামিয়ে দিয়েছে ওদের! যেন এক অদৃশ্য নীরবতার চাদর নিমেষে সমস্ত শব্দ শুষে নিয়েছে।

ঠিক তখনই কলিয়া পাম্পকিন, মল্লবীরের মতো গড়িয়ে সকলের সামনে চলে এল। বিশ্রীভাবে খোঁড়াচ্ছিলো সে। এবং সেভাবেই সামনে পেছনে অবিরাম মাথা ঝাঁকিয়ে পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু করল―‘দেখো এবার। নিজের চোখেই দেখো। যদিও আক্ষরিক অর্থে সাধারণ মানুষ যেভাবে বসে থাকে ঠিক সেইভাবে বসে নেই ও। বরং বলা যেতে পারে ছাদে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইয়ে মানে তুমি যদি  অভিকর্ষের ব্যাপারটা টেনে আনো আর কি। খেয়াল কর, ওর মাথা কিন্তু প্রকৃত অর্থে নিচেই ঝোলানো! মানে ও নিজের মাথা দড়ি দিয়ে সিলিঙে বেঁধেছে!’    

সমবেত ছারপোকারা হতবাক হয়ে এই অদ্ভুত দৃশ্য অবলোকন করতে লাগল। ঘটনার কোনও মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না ওরা।

‘থামো। সবাই অতি উত্তেজিত হয়ে গেছো!’ কুইজমিচ বিরক্তিভরে এই ঘটনার ব্যাখ্যায় এগিয়ে এল, ‘ভেবে দেখো আমাদের এই অভিকর্ষের জ্ঞান এখন কোনদিকে যাচ্ছে ?’

‘ওর ঝোলানো মাথায়, আর কোথায় ?’

‘তাহলে এবার ভাবো, তোমার নিজের অভিকর্ষ যদি মাথা সিধে রাখে, তবে ওর অভিকর্ষ মাথা নিচে ঝোলাবে এটা কীভাবে সম্ভব ?’

‘ইয়ে, সিলিঙে চড়লে অভিকর্ষ মাথাকে নিচেই ঝোলাবে’।

‘থামো। আবার তাড়াহুড়ো করছো। মাথা ঠান্ডা করো। আমরা এই সিদ্ধান্তে কীভাবে এলাম ?’

‘কীভাবে ?  ইয়ে প্রোকোপিচ―দড়িটা, বললো―এই দড়িটা ছিঁড়ল না যে!’

‘দড়িটা,’ প্রোকোপিচ মনে মনে কথা গোছাতে লাগল। ছারজনতার কাছে নিজের অভিজ্ঞতার মান রাখতে মানানসই কিছু একটা বলতেই হবে ওকে, ‘হুম, দড়িটা ছিঁড়েনি কারণ এই দড়ি ব্রিটিশদের তৈরি’। 

‘ওহ হো তাই তো বলি, ব্রিটিশ―’

‘তোমার তারিফ করতেই হয় প্রকোপিচ’, ইভান বুরোকভ প্রশস্তি গাইলো। ‘কিন্তু থামো। তাও তো মিলছে না। আমরা এখানে এলাম কীভাবে, এক সেকেন্ড দাঁড়াও―’

ছারপোকারা ব্রিটিশ দড়ির ব্যাখ্যার পরে আর কিছু শুনতে নারাজ। একে অন্যকে মাড়িয়ে সঙটার গা বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে সবাই। প্রোকোপিচ একপাশে সরে ওদের যাওয়ার পথ করে দিল। সবাই ওকে পেরিয়ে চলে গেলে ও দ্রুত চোখ বোলালো চারপাশে এবং ত্বরিতগতিতে উলটো ঘুরে বাড়ির পথে হন্যে হয়ে ছুটতে লাগল।

‘হায় যিশু!’ এতটা পথ ছুটে চলতে গিয়ে ওর লাল রঙে বেগুনি ছোপ ধরে গেছে। বাড়িতে পা দিয়েই নিজেকেই গাল দিচ্ছিলো প্রোকোপিচ,  ‘কুকুরের মত খাটলাম এতক্ষণ। উফ্, কী ভয়ানক গর্দভ আমি! ভাগ্যিস চলে এসেছি। আর কিছুক্ষণ থাকলেই রফা হয়ে যেতো আজ। ষণ্ডাগুলোকে পেরিয়ে জীবনেও বাড়ি ফিরতে পারতাম না’।  

‘শুনছো’, দরাম করে দরজা বন্ধ করেই বউকে ডাকলো প্রোকোপিচ। কিন্তু কথা শেষ না করেই বউকে পেরিয়ে ঠান্ডা জলের হাতাটা টানল,  ঢক ঢক করে বেশ খানিকটা জল গলায় চালান দিয়ে, এরপরে দম ছেড়ে বলল, ‘তোমার বাক্স-প্যাটরা, সব গুছিয়ে নাও। এই ডেরা ছেড়ে দিচ্ছি আমরা’। 

‘এত্তা ছোত্ত মাকড়তা 

জলের গায়ে চড়ল

বিত্তি এল গড়িয়ে

মাকড়তাতা মরল’,

ওর গুল্লুগুল্লু বাচ্চাটা আধো বোলে মেঝেতে খেলনা টানতে টানতে ছড়া কেটে খেলছিল একমনে।   

বিষন্ন প্রোকোপিচ সেইদিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল, ‘কী একটা জীবন!’  

অতঃপর হাত ঘুরিয়ে হাতার বাকি জল টেবিলের তলায় সজোরে ছিটিয়ে দিল। 

 লেখক : অনুবাদক

কানাডা থেকে

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত   

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button