অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প : সার্কাসিয়ার নেকড়ে

মূল : ড্যানিয়েল ম্যাসন

বাংলা অনুবাদ : অমর মিত্র

[ড্যানিয়েল ম্যাসন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তাঁর গ্রন্থ এ রেজিস্ট্রি অফ মাই প্যাসেজ আপন দ্য আর্থ ২০২১ সালের পুলিৎজার পুরস্কারের ফাইনালিস্ট। ক্যালিফোর্নিয়া বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তাঁর গ্রন্থ বিশ্বের ২৮টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি গুগেনহেইম ফেলোশিপ পেয়েছেন। জয়েস ক্যারোল ওটস পুরস্কার পেয়েছেন উপন্যাসের জন্য। এই গল্পটি ২০২২ সালে ছোটগল্পের জন্য ও’ হেনরি পুরস্কার পেয়েছে। ও’ হেনরি প্রাইজ স্টোরি, ২০২২ সংকলন থেকে অনূদিত।]

স্ত্রী ও পরিবারের সকলকে নিয়ে বুড়া লোকটি এক বাড়িতে বাস করেও, তার স্ত্রীকে স্ত্রী বলে যেন চিনত না, পুত্রকেও পুত্র বলে জানত না, বালকটিকে তাও জানত না। সেইনি নামে যে মহিলা থাকত সেই বাড়িতে তাদের দেখাশুনো করতে, তাকে প্রত্যেক সকালে একটি কথা জিজ্ঞসা করত, সে কোথা থেকে এসেছে বা তার বাড়ি কোথায় ছিল ? মেয়েটি জবাব দিত, সে টোঙ্গা দ্বীপ রাষ্ট্রে জন্মেছিল। তা শুনে বুড়া লোকটি বলত সে এক সময় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে এক যুদ্ধ জাহাজে চিকিৎসক হিসেবে নিযুক্ত ছিল, সে ওই সময়ে কিছুদিন টোঙ্গায় ছিল, সে টোঙ্গার কথা পরিষ্কার মনে করতে পারে আর একজন মার্কিন সেবিকার সূত্রেই। সেই নার্স, রিটা ছিল সেরা সুন্দরী, বলতে গেলে চলচ্চিত্রের নায়িকা যেমন হয়, তেমনি। বুড়া যখন এইসব কথা সেইনিকে বলত, আড়াল থেকে তার বুড়ি বউ সব শুনত নিশ্চুপে। প্রায় সব দিনই রিটার কথা ছিল বুড়ার অনেক গল্পের একটি, যা সেইনিকে প্রায় প্রতিদিনই বলত। সে এই নার্স সম্পর্কে খুব বেশি কথা জানত না বোঝা যেত, সে বলত, যুদ্ধের সময়ে তাদের দেখা হয়েছিল, তার পরের বছরগুলোতেও তার সঙ্গে আবার দেখা হওয়ার কথা মনে হতো তার। কিন্তু তা হয়নি। বুড়া কল্পনা করত, যদি তা হতো, তাহলে কী হতে পারত ?

বুড়া বলত, হয়তো হতে পারত দেখা, দেখা যে হবেই না, তাই বা কে বলতে পারে। বুড়ার এই কথায় সেইনি হাসত এবং বলত, সে নিশ্চয়ই ওই নার্সের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করেছে এক সময়, কী করেছে তা সে-ই জানে। বুড়া বলত, আসলে সে একজন কারডিওলজিস্ট ছিল।

যখন রিটার কথা প্রথম বলেছিল বুড়া, তার বুড়ি বউ সেইনিকে একধারে টেনে নিয়ে বলে, বুড়ার এই গল্প নিশ্চয়ই তার আর একটা বিভ্রান্তি। বুড়া কোনওদিনই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে কাজ করেনি, যদিও ভিয়েতনাম যুদ্ধের শেষে সে জাপানে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। জাপানে তারা স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গেই ছিল। সে বুঝতেই পারছে না রিটার গল্পটা এল কোথা থেকে, রিটা কে ? সেইনি বুড়ার কথা যেমন ধৈর্য সহকারে শোনে, বুড়ির কথাও তেমন ধৈর্য নিয়ে শুনল। এই সময়গুলোয় যখন তার মনে হয় সত্য এবং বিভ্রম, এর কোনওটার পক্ষ নিতে হবে তাকে, সে বিভ্রম, ফ্যান্টাসিকেই বেছে নিত মনে মনে। সে বুড়া এবং তার বউয়ের সঙ্গে মাত্র এক বছর কাজ করেছিল। তার নিজস্ব জ্ঞানে চিকিৎসার এমন ব্যবস্থা ছিল যা দিয়ে সে বিস্মৃতিপরায়ণ রোগীর চিকিৎসা করতে পারত। টোঙ্গা থেকে বুড়ার পরিবারে আসার এক সপ্তাহের ভিতরে সে নিজের মতো করে তাদের দেখতে থাকে। সে জানত কাদের মনের অতি গভীর স্তরে তার আনুগত্য রাখতে হবে।

বাড়িটি ছিল ওয়ালনাট ক্রিক রাস্তায়, যাকে বুড়া বলত পুরান ওয়ালনাট ক্রিক। বুড়া এইটা বলত বাড়িটিকে আলাদা করে নেওয়ার জন্য। এই রাস্তায় পরপর দীর্ঘ সব ওয়ালনাট গাছ সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই পথে একটি অ্যাপ্রিকট, আপেলের বাগান ছিল। এবং এখান থেকে দেখা যেত মাউন্ট ডিয়াবলো শৈলমালা। বাগান থেকে একটি পথ নেমে গেছে ওক এবং লরেল গাছের ছায়াস্নিগ্ধ শান্ত এক উপত্যকায়। সেখান থেকে পথটি গেছে সরকারি এক সংরক্ষিত অরণ্যের সীমানা অবধি। একে ঘিরে একটি অঞ্চল গড়ে উঠেছিল, কিন্তু এই উপত্যকা নিজের মতো শান্ত ছিল।

‘আমার বাড়ির পেছনের উঠান পৃথিবীতে সব চেয়ে বড়। এত বড় আর নেই।’ বুড়া এই কথা বলতে ভালোবাসত। শেষ যেবার সে পাহাড়ের শীর্ষে উঠেছিল, তা প্রায় বারো বছর আগে হবে। সেদিনটি ছিল তার ষাট বছরের জন্মদিন, তারও পর সে তার দৈহিক শক্তি, এই স্মৃতি নিয়ে অতিবাহিত করছে এতটা সময়। সে তার বউ অথবা সেইনিকে নিয়ে উপত্যকাতে এখনও হেঁটে আসতে পারে। পাহাড়ের চূড়া অবধি তার বাড়ি থেকে ১৩ মাইলের মতো হবে। সে মাঝে মাঝে সেইনিকে বলে, এই অঞ্চলের আদিম জনজাতিরা মনে করত পাহাড়-চূড়াটি সৃষ্টির কেন্দ্র এবং পাহাড় ঘিরে নিসর্গ যেহেতু সমতলভূমি, তুমি সেখানে দাঁড়িয়ে সব কিছুই দেখতে পাবে, সিয়েরা নেভাদা পর্বত অবধি তোমার দৃষ্টি চলে যাবে।

পরে বুড়ার বউয়ের মনে হয়েছিল এই কথার উত্তরে কিছু বলে। অথবা তার মনে হয়েছিল বলে, বুড়া এই কথা প্রথম বলল না। পর্বতের উচ্চতা নিয়ে কথা নয়, আসল কথা হলো পর্বত এবং নিসর্গের নিঃসঙ্গতা। দীর্ঘ এক নিঃসঙ্গতার দিকেই যেন চোখ যায়। কিন্তু এটি একটি অতি সাধারণ কথা, সেইনির মনে হয়েছিল, এই কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। সে চুপ করে থাকায় বুড়ি একটু বিব্রত বোধ করছিল মনে হয়। সে চুপ করেই ছিল। বুড়ি বলে যাচ্ছিল, সে তার স্বামীর সঙ্গে সেখানে অনেকবার গেছে, মধ্যবর্তী উপত্যকা থেকে দূরের পর্বতমালার তুষারাচ্ছন্ন শাদা রেখা মাটির পৃথিবী এবং আকাশের ভিতরে এক বিন্দু অশ্রুর মতো মনে হয়।

বাড়ির যে যার থাকার জায়গার একটু অদলবদল করা হলো তাড়াতাড়ি। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের ভেতরেই তা হলো। মহামারি এসে গেছে। সেইনি বুড়ার পুত্র বা পৌত্রকে আগে দেখেনি। মার্চের শেষের দিকে এক মঙ্গলবারে তারা সান ফ্রান্সিস্কো থেকে এল। পুত্র বাড়িতে আসত খুবই কম। বুড়া বাবার স্মৃতিশক্তি যখন প্রায় অন্তর্হিত হলো পুত্রের আসতে ইচ্ছে হতো না। বাবাকে সে এমন দেখতে চায়নি। বুড়া সেইনিকে বলে, তার ছেলে খুব ব্যস্ত, তাই আসতে পারে না। বুড়া বলে, তার পুত্র যৌবনকালে বড় ক্রীড়াবিদ ছিল, বেসবল খেলোয়াড়। সেইনি তাকে খেলার মাঠে দেখলেও দেখতে পারে। বুড়ি এই কথায় হাসল, সেইনিকে বলল, তার পুত্র বরং অতি সাধারণ, মধ্যমেধার, কিন্তু সে তার বাবাকে খুব ভালোবাসে, এবং আসে না বাবার স্মৃতিহীনতার জন্যই। বুড়ি এই কথা বলল যখন সেইনি বুঝল, বুড়ি নিজে কথাটা তৈরি করেছে নিজের জন্যই।

নিজের পুত্র সম্পর্কে নিজের কথা বলে বুড়ি বলল, নাতিকে নিয়ে সে আসছে তাদের সঙ্গে থাকতে। তার পুত্র তার স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে যখন মহামারি ছড়িয়ে পড়ল। মহামারি ছড়িয়ে পড়ার এক সপ্তাহ বাদে সেই দম্পতি বুঝতে পারল এই রকম ঘনিষ্ঠ এবং গৃহান্তরীণ জীবন সহ্যাতীত। সুতরাং বুড়ির ছেলে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাস করতে এল। সঙ্গে নিয়ে এল তার বালক পুত্রকে। বালকের মনের ভিতরে অনেক জটিলতা তৈরি হয়েছে এই সময়ে। সব সময় সে অন্যের মনোযোগ চায়। এবং সকলেই স্বীকার করবে যে সে সান ফ্রান্সিস্কো অ্যাপার্টমেন্টে তার বন্ধু, তার স্কুল এবং খেলার মাঠ ছাড়া থাকতে পারছিল না। সেইনি সবটা বুঝতে পারছিল। বুড়ির সমস্ত কথা শুনে এটুকু বুঝতে পারছিল বুড়ি সবটা বলেনি। বলেনি বালকের মা কেন তাকে ছেড়ে থাকার পক্ষে মত দিল। এসব বুঝেও সেইনি কোনও প্রশ্ন করল না, কৌতূহল দেখাল না। বহু দিন আগে সে আবিষ্কার করেছিল, সে তার চিকিৎসাধীন পরিবারের সম্পর্কে সব কিছুই জানবে, কিন্তু তার জন্য সময় দিতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে শান্ত হয়ে।

সুতরাং ওক এবং লরেল গাছের উপত্যকার সীমানার বাড়িটিতে পাঁচজন বাস করতে লাগল। মহামারি আসার আগে সেইনি প্রতি সপ্তাহে তার রেডউডের বাড়ি ফিরত নিজের স্বামী ও কনিষ্ঠা কন্যার কাছে। তার আরও দুই মেয়ে আছে। তাদের একজন হলো নার্স, অন্যজন একটি সুপার মার্কেটে কাজ করে। একটি পুত্রও আছে। সে সকলের ছোট। এখন সেই বালক পুত্র কত বড় হয়ে গেছে। তার এখন আঠাশ বছর বয়স, ছ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। সে সান ফ্রানসিসকো জেনারেলে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে। যখন মহামারি ছড়াতে শুরু করল, বুড়ি সেইনিকে নিজের কাছে ডেকে খোঁজ নিল তার পরিবার সম্পর্কে। সেখানকার অবস্থা কী এই মহামারিতে ? বুড়ি আরও জিজ্ঞাসা করল, যাদের সঙ্গে সে দেখা করতে যায়, সেই যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কি না। সেইনি ভাবছিল তার ছোট মেয়ের বন্ধুদের কথা। ভাবছিল তার অন্য সন্তানদের কাজ নিয়ে। সুতরাং সম্ভব ছিল না। সে তাই বুড়া-বুড়ির সঙ্গে থাকতে এল বটে এবং অপরাহ্ন হলেই তার পরিবারের জন্য সময় দেয়। ফোনে কথা বলে। কিন্তু যখন তার ভিতরের শূন্যতা, একাকিত্ব বেড়ে যায়, সপ্তাহের সেই একদিন সে তার গাড়ি নিয়ে অরণ্যপথ দিয়ে, বিস্তীর্ণ তৃণভূমি, দ্বিস্তর সুড়ঙ্গ পথ, আকাবাঁকা মহাসড়ক―দীর্ঘ উপসাগরীয় সেতু―পার হয়ে চলতে চলতে এক ঘণ্টার যাত্রা শেষ অবধি দু’ ঘণ্ঠায় দাঁড়াত। সে তার বোনের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে প্রথমে গাড়ি দাঁড় করাত, তারপর নিজের বাড়ি। গল্প করা চলতেই থাকত। যে ব্লকে তারা থাকত, সেখানে বাড়িগুলি গায়ে গায়ে। কিশোরীরা একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে বাড়ির সামনে ঘুরত। তার বোনেরা তাকে কৌতুকের স্বরে জিজ্ঞাসা করত মহামারিতে সে কেমন আছে ঐ অরণ্যাঞ্চলে ? কিন্তু সেইনি তার বন্ধুদের ভিতর একমাত্র যে সকলের থেকে তফাতে থাকত কেননা, তখন কাছাকাছি আসতে কেউই চাইত না, কাছাকাছি এসে তাদের ঘরে অসুখটি নিয়ে যেতে।

বুড়া-বুড়ির ছেলে আসার আগে, সেইনি উপরতলায় বুড়ার ঘরের পাশের ঘরে ঘুমোত। বুড়া তার রাত্রিকালীন চলাফেরা এবং নানারকম বিভ্রান্তির কারণে তার বুড়ির সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমোত না। সেইনির ঘরটি আয়তনে বেশ বড়, সেই ঘর থেকে পিছনের উঠোন বা বাগান খুব ভালো দেখা যেত। সেই বাগানে ডুমুর গাছ পুঁতেছিল বুড়া-বুড়ি। সেখান থেকে অনেক দূরের শৈলমালার দিকে তারা একদিন হেঁটেছিল। সেইনির এই ঘর অনেক আগে বুড়ার ছেলের ছিল। সেইনির আচমকা মনে হলো বুড়ার ছেলে এসে নিজের ঘরটি নিয়ে নিতে পারে। কিন্তু বুড়ার ছেলে রান্নাশালের কাছে একটি অতিথিদের জন্য নির্দিষ্ট অপেক্ষাকৃত ছোট ঘর পছন্দ করল। সে ল্যাপটপের সামনে বসেই তার দিন কাটিয়ে দিত। এইটি পরিষ্কার যে বুড়ার ছেলের বিবাহ বিচ্ছেদের কারণে যে রাগ, যে হিংস্রতার জন্ম হয়েছিল, যখন সে কাজ করছিল না সেই সময়ের শান্ত ভাব তা থেকে অনেক দূরে। ছেলেটি এই মহামারিতে কাজ করত না। সে বাড়ির বাইরে নিচের রাস্তায় হাঁটত তার মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে, যুক্তি সাজাতে সাজাতে, তর্ক করতে করতে। একদিক দিয়ে ভালো যে সে তার বাবার থেকে তফাতে থাকত, সেইনি তেমনই মনে করত। এক সময়ের জন্যও বুড়া এই নতুন অতিথিদের ধর্তব্যের মধ্যেই আনত না। বুড়া স্বজ্ঞাতভাবে বুঝতে পারে তাদের নিয়ে তার ভিতরে এক ধরনের বিরক্তিভাব আছে, এই বিরক্তি থেকেই তার ভিতরে নানারকম বিভ্রান্তি জন্মায়। ফলে সে ভীত হয়ে থাকত। যখন নৈশাহারে পুত্র তাদের সঙ্গে যোগ দিত, সে তার বাবার বিভ্রান্তি সংশোধন করতে গিয়ে ব্যর্থ হতো। সে দেখলেও দেখতে চাইত না বুড়া বাবার মুখে খাবার লেগে আছে, বাবা এক নাগাড়ে কারডিওলজি নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে, অথবা বহুবার বলা গল্প বলেই যাচ্ছে, বলেই যাচ্ছে। বলছে সে যখন চিকিৎসাবিদ্যার ছাত্র ছিল, তখন থেকে এখনকার সময়ে কত বদল না হয়েছে। বুড়া এবং বালক যাতে ভয় না পায়, বাড়ির অন্যরা মহামারির কথা উচ্চারণ করত না, ফলে বুড়া অনায়াসে অন্যের শোনার অনুপযুক্ত গল্পগুলি বলেই যেত। অন্যরা এর ফলে কিছু ভাবতেও পারত না ডিনার টেবিলে বসে। সকলের ভিতর একমাত্র বালকটিই বুড়ার কথা মোহাচ্ছন্ন হয়ে শুনত।

এই বিষয়ে সেইনির উপলব্ধি ছিল যে, বালকটি তার ঠাকুরদাকে আগে দ্যাখেনি, সে বাড়িতে আসার পর বুড়া অপেক্ষা করত যেন এমন কারও জন্য যে তাকে গর্বিত করবে এই পরিবারের অন্তর্নিহিত গৌরবের কারণেই। সেইনি বুঝতে পারত যে কেউ বুড়ার একই কথা আট বার শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়বেই। কথা তো সেই একই, কীভাবে ইন্থোভেন উদ্ভাবিত প্রথম ইকো কারডিওগ্রাম (ইকেজি) করা হয়েছিল। একটি ছোট গাড়ির আয়তনের বসার জায়গায় জলে ভরা পাত্রে রোগী বসত তার তিন অঙ্গ প্রসারিত করে। বলত সে স্টানফোর্ড শহরে কেমনভাবে একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হয়ে মার্কিন দেশে প্রথম হৃদযন্ত্র সংস্থাপন করেছিলেন যিনি সেই সার্জেন চিকিৎসক শামওয়ের সমস্ত কার্যপ্রণালী নিরীক্ষণ করেছিল। বুড়া আরও বলত, ইকো কারডিওগ্রাম আধুনিক হওয়ার আগে বুকের বাম দিকের উপর নিজের করতল রেখে কীভাবে পরিমাপ করতে পারত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হৃদয়ের নিলয়। বুড়া এইসব বলেই যেত প্রতিদিন। তার শ্রোতা―সেই পৌত্র বালক তিন সেকেন্ডের জন্যও স্থির হয়ে বসত না কোনও জিনিশ দখল না করে, অথবা তার রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে কিছু অনর্থক কথা বলত যতক্ষণ না অন্যেরা তার উপর বিরক্ত হয়ে উঠছে। বালক সব সময় উচ্চৈঃস্বরে কথা বলত। দ্রুত কথা বলত। সকলের কথার উপরে কথা বলে পরিবেশ নষ্ট করে দিত। অথচ বালক তার ঠাকুরদার গল্পে যেন বন্দিও হয়ে যেত। ভালোবাসত একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। বালকের এই একই কথা শুনতে চাওয়ার আবদারের মতোই বুড়ার পুত্রও টোঙ্গায় তার বাল্যকালের গল্পগুলি বলতে বলত তার বাবাকে। কোনও কোনও সময় বুড়ার গল্পের ভিতরেই বালকটি নিজের জানা একটা গল্প বলতে আরম্ভ করত। সেই গল্পগুলি হতো তার নিজের কিন্ডেল-এ পড়া কল্পবিজ্ঞান ও জাদুর বিচিত্র সব গল্প যার ভিতরে থাকত সেই সব কাহিনির অপরিচিত সব অদ্ভুত চরিত্রের নাম, প্রযুক্তির নানা কথা যা সম্পূর্ণই অজানা ছিল সেইনির কাছে, সেইনির মনে হতো সবই কারডিওলজির ইতিহাস। বুড়া তার নাতির কথা শুনতে শুনতে কোনও প্রশ্ন করত না, কিন্তু মাঝে মাঝে বলে উঠত, ‘ঠিক কথা,’ কিংবা ‘অমুকটা কী ছিল।’

সুতরাং তাদের নৈশাহার দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে উঠত দুই ব্যক্তির ভিতরে কথার আদান-প্রদানেই যেন। আর বাড়ির বাকি তিনজন যারা স্টোভ বা মিশ্রণযন্ত্র ব্যবহার করত নিশ্চিন্তে, যারা খবরের কাগজ পড়ত, যারা জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত বুঝত তারা বুড়া আর বালকের কথা শুনতে শুনতে শান্ত হয়ে তাদের আহার শেষ করত।

রাতে যখন বুড়া তার ঘরে গভীর ঘুমে ডুবে যেত, বুড়ি তার বিছানায় শুয়ে একটি উপন্যাসের ভিতর প্রবেশ করত, শেষবারের মতো সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে সেইনি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে তার বোনকে ফোনে বলত বুড়া আর তার নাতির কথাবার্তা যেমন হতো, তা। সাধারণত সেইনি তার কর্মক্ষেত্রের কথা বোনকে বলত না, কিন্তু বালকটি সম্পর্কে তার উদ্বেগ কথাটি বলতে বাধ্য করত। এই সময় তারা আলোচনা করত যে স্কুল বসন্তের বাকি সময়টা বন্ধই থাকবে, এবং এমন কি সামনের হেমন্তকালেও খুলবে বলে মনে হয় না। সে উদ্বিগ্ন ছিল একটি বালক একা একা কীভাবে দিন কাটাবে, বড় হবে ? সেই আখরোট গাছের সারি দেওয়া রাস্তার ধারে কিছু পরিবার বাস করত, তাদের বাড়িতে শিশুরা ছিল। যখন বুড়ার সঙ্গে সেইনি ঐ রাস্তায় হাঁটতে বেরোত, দেখত বাচ্চারা তাদের বাড়ির উঠানে খেলা করছে। কোনও কোনও দিন বালকটির বাবা তার ছেলেকে নিয়ে বেরোত। ক্যাচ প্রাকটিস করাত। কিন্তু বালকের এই খেলায় ছিল তীব্র অনীহা। সে প্রতিটি ক্যাচ ফেলে দিত। সেই ক্যাচ ধরতে ব্যর্থ হয়ে সে যখন বল খুঁজতে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ার পার হয়ে বুনো ড্যাফোডিলের ঝোপ, সাপের গর্তের কাছে চলে যেত, তার বাবা মোবাইল ফোন বের করে কথা বলতে আরম্ভ করত। আন্তরজালের জুম প্রযুক্তির মাধ্যমে স্কুলের ক্লাস হতো সেই সময়, জুমে ক্লাস করার সময় যখন তাকে বাচ্চাটাকে জীবন সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞসা করা হতো, সে অতি উৎসাহের সঙ্গে উচ্চকণ্ঠে কারডিওলজির ইতিহাস বলতে আরম্ভ করত। তা শুনতে শুনতে সেইনির বয়সী তার শিক্ষিকা সোফায় বসে পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখত বিচিত্র সেই ছাত্রকে। ঈষৎ পুলকিতও হতো। সেই শিক্ষিকার বেড়ালগুলি তার পিছন থেকে ভয়ানক ভাবে তাকিয়ে থাকত। কিন্তু সাধারণত, বালক কম্পিউটারে ডাউনলোড করা মহাকাশ যানের একটি গ্রাফিক ছবি কম্পিউটারের পর্দার পশ্চাৎদৃশ্য হিসেবে ব্যবহার করত জুমে ক্লাস করার সময়। অথবা সে নিচু হয়ে তার কিন্ডেলে কিছু পড়ত। পড়তে পড়তে মহাজাগতিক পৃথিবীই যেন ভুলে যেত। অন্য সময় তার ঠাকুমা তার সঙ্গে বসত। চেষ্টা করত তাকে পড়াতে। অথবা তার সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু যখনই ঠাকুমা তার কাছে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠত, সে সোফার মাথায় চেপে বসত এবং পাক খেত, ডিগবাজি খেত। এইসব করতে করতে হঠাৎ তার মনে হতো বরফ তৈরির যন্ত্র থেকে কিছু বরফ বের করে আনে। একটি গ্লাস বরফে ভরতি করে ফেলত প্রায় উন্মত্তের মতো, তার ফলে কিছু বরফের কিউব মেঝেয় পড়ে গড়িয়ে যেত।

সেইনিই ভেবেছিল বুড়াকে নিয়ে হাঁটতে বেরোনোর সময়, তার নাতিকেও সঙ্গে নেওয়ার কথা। এবং তখন তার মধ্যম কন্যাটির ফোন আসার সময়। প্রতিদিন বিকেলে ফোনের ভিতর দিয়ে তার আর্তনাদ শুনতে হতো সেইনিকে। সেই ফোন এলে সেইনি ওদের ছেড়ে দিয়ে নিজে আলাদা হয়ে যেত মেয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এই মধ্যম কন্যাটি ছিল ডায়ালিসিস নার্স। কিন্তু যখন মহামারি ছড়িয়ে পড়তে লাগল তাকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জরুরি বিভাগে। এখন, প্রায় সব দিন সে তার মাকে বলে, সে আর নিতে পারছে না, সহ্য করতে পারছে না এত মৃত্যু। সে নিতে পারছে না প্রত্যেক দিন নিরাময়ে আসা ব্যক্তির পরিবারের হুমকি। তাদের হাসপাতালের ভিতর ঢুকতে দেওয়া হতো না তাদের, তাতেই এই ক্রোধ। সে নিতে পারছে না প্রতিদিন হাসপাতালে তার কাপড়চোপড়, তার চুল, তার গায়ের চামড়া বিষাক্ত ভাইরাসে ভরে থাকে। তা থেকে তার স্বামী, তার সন্তানেরা সংক্রামিত হতে পারে। সেই রাস্তা ছিল দীর্ঘ এবং বেশির ভাগটাই নির্জন। সেইনি মেয়ের কথা শুনতে শুনতে সামনে হাঁটতে থাকা বুড়া এবং তার নাতির দিকে নজর রাখত। মেয়ের অনর্গল কথায় সে কোনও উত্তর দিত না। উত্তর ছিল না তার কাছে। সেইনির মেয়ে তা জানত। আরও জানত সে যদি কোনও পরামর্শ চায় সে তার বাবাকে ডাকতে বলবে। মেয়ে বলবে, এইটি চরম অবাস্তব। সেইনির মেয়ে বলেই যায় তার কথা, বলেই যায়। সেইনি এইসব গালিগালাজ পছন্দ করে না। সে চুপ করেই থাকে। কয়েক দিন সহ্য করার পর তার মেয়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, এসব একেবারে অবাস্তব। এমন চলতে পারে না।

রাস্তায় তারা মাঝে মাঝে মুখে মাস্ক পরিহিত কুকুর নিয়ে বেড়াতে বেরোনো ব্যক্তিদের দেখতে পেত। দেখতে পেত বড় বড় গাড়ি। সেইনি এই সময় নিজেকে অপরাধী মনে করত বুড়া এবং তার নাতিকে আগে আগে ছেড়ে পিছনে থাকার জন্য। দুজনে একসঙ্গে হেঁটে যেত। সেইনি বুঝতে পারত না বুড়ার দায়িত্ব সে তার নাতির উপর দিয়েছে, না নাতির দায়িত্ব তার ঠাকুরদার উপর দিয়েছে সে ? তার কাছ থেকে কে কার দায়িত্ব নিয়ে বেরিয়েছে ? কিন্তু তার কাছে এইটি পরিষ্কার ছিল যে বালকের বাবার তিরস্কার, বুড়ির বিরক্তির থেকে মুক্ত হয়ে তারা উভয়েই খুব খুশি ছিল পরস্পরের উপস্থিতিতে। তারা এক অদ্ভুত জুড়ি তৈরি করেছিল উভয়ে মিলে। বুড়া ছিল মজবুত স্বাস্থ্যের, তার বুক ছিল চওড়া, ঘন এবং ধূসর ভ্রƒ। বুড়ার পরনে থাকত নির্ভাজ শার্ট। সেইনি প্রত্যেক সকালেই শার্ট পছন্দ করে গুছিয়ে রাখত। সেইনি বুড়ার জন্য একটি পুরোনো পদ্ধতি প্রয়োগ করত এইভাবে, যেন তার রোগী লোকটি অনুভব করে কোনও এক উৎসবের জন্যই সে বেরোচ্ছে। ঠিক যেভাবে প্রত্যেক দিন তাদের দাড়ি কামিয়ে চুল আঁচড়ে দেওয়া হয়, তেমনিভাবেই পোশাক নির্বাচন করা হয়।

বালকটির মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। সে সাতটি টি শার্ট নিয়ে এসেছিল সানফ্রান্সিস্কো থেকে। সেগুলির বুকে হয় হ্যারি পটারের ছবি, না হয় স্টার ওয়ারের কোনও চরিত্র। এক মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও বুড়া জানত না সেই ছটফটে, দুরন্ত, অবিরাম কৌতূহলী বালকটি তার পৌত্র। অথবা বালকটিও জানত না তারা যে বিষয়ে গতকাল কথা বলেছে, আজ তা মনে আছে কিনা বুড়া মানুষটির।

বৃদ্ধ স্নান এবং পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়ে নানা রকম বিপত্তি সৃষ্টি করলেও এমনিতে সটান ছিল ভ্রমণের দুটি লাঠি নিয়ে বেরিয়ে। তবু সেইনি আশঙ্কায় থাকত বৃদ্ধের নাতি যেভাবে স্কিপিং করত, স্কিপিং করতে করতে তার ঠাকুরদাকে পাক দিত, সে বুড়ার উপরে না পড়ে যায় টাল সামলাতে না-পেরে। কিন্তু এই ঘটনা কখনও ঘটেনি। যা ঘটেছিল তা হলো, বালকটি একদিন রাস্তার উপরে নিচু হয়ে বসে একটি চ্যাপটা হয়ে যাওয়া কাঠবিড়ালিকে পর্যবেক্ষণের সময় বালকটির গা ঘেঁষে, তাকে ছুঁয়ে একটি গাড়ি চলে যায়। কথাটি সেইনি কাউকে বলেনি, কিন্তু সেই দিনের পর সে ওদের নিয়ে অন্য পথে বেরোতে থাকে। তাদের পিছনের উঠানের সরু পথ যেটি উপত্যকার দিকে নেমে গেছে, সেই পথে নিয়ে যেতে থাকে। অবশ্য এই পথে সে একটু কম স্বস্তিতে থাকে। সে দেখতে পেত কখনও কখনও বন্য জন্তুরা বন থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং তুর্কি শকুনেরা উপরের আকাশে ডানা কাঁপিয়ে পাক খাচ্ছে। কিন্তু বৃদ্ধর স্বাভাবিকতা নিয়ে সে অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিল। সে ভেবেছিল এক্ষেত্রে সে নির্ভর করতে পারে প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, এবং অভ্যাসের উপর। সে নিজেকে মনে করাল যে বৃদ্ধ জানে সে যতদিন বাঁচবে শৈলমালা তার চেয়েও দূরবর্তী, ততদিনেও পৌঁছানো যাবে না সেখানে। এক সময় বুড়া তাকে একটি গল্প বলেছিল। গল্প ছিল তার বাল্যকালের। একটি কালো অতি বৃহৎ নেকড়ে সার্কাসিয়ার স্কুল থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। অন্য বাচ্চারা দাঁড়িয়ে তা দেখেছিল। পরে বুড়ি রান্নাশালে এসে সেইনিকে বলে এই গল্পটিও বুড়ার বানানো। বুড়ার জন্ম হয়েছিল কুইন্স নিউ ইয়র্কে। তার অনুমান ছিল গল্পটি হয়তো বুড়া তার বাবার কাছ থেকে পেয়েছে। যিনি কিনা মধ্য এশিয়ার অনেক জায়গা পার হয়ে একটি ঘেটোতে অন্তরীণ হয়ে ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সেই আশ্রয়টি ছিল একটি শ্রমশিবির।

সেইনি জিজ্ঞাসা করেছিল, ছেলেটা বেঁচে গিয়েছিল কি ?

সেই ছেলেটা ?

হ্যাঁ, গল্পের সেই ছেলেটা।

ওহ। বুড়ি একটু থেমে সেইনির দিকে এমন চোখে তাকিয়ে থাকল, যা আগে সেইনি দ্যাখেনি। বুড়ি বলল, তুমি নিশ্চয়ই জানো আমি কখনই কিছু জিজ্ঞাসা করি না ওঁকে, আসলে আমি নিশ্চিত ছিলাম না যে সে একটা ছেলে কিনা, বুড়া কাহিনির সবটাই নিজে তৈরি করেছে।

মে মাস চলে গেল। আখরোট গাছেরা পাতায় পাতায় ভরে গেল। পিছনের উঠানের গাছে সবুজ ডুমুর ভর্তি হয়ে গেল। উপত্যকায় ক্যালিফোর্নিয়া পোস্ত ফুল ফুটে উঠল, ফুলের শাদা রঙ তাকে মনে করিয়ে দিল টোঙ্গাতে সে সকালে ফোটা ফুল সংগ্রহ করত। মর্নিং গ্লোরিজ। তারপর ঘন করে বেগুনি রঙের এক ফুল ফুটত, তার নাম সে জানে না। দিনের তাপমাত্রা বাড়তে লাগল। উষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল দিনগুলি। আর গ্রীষ্মের উষ্ণতায় তার হাঁপানি বেড়ে গেল। তার মনে হতে লাগল, নিজের একটু থামা দরকার। লম্বা বিশ্রাম চাই। লম্বা বিশ্রাম সে নিতে লাগল একটি বেঞ্চে যার পিছনে নিচু হয়ে নেমে এসেছিল লরেল গাছের ডাল। বেঞ্চটি হলুদ কাপড়ের টুকরায় মোড়া ছিল। তা ছিল সতর্কতামূলক চিহ্ন। সেই সতর্কতা তার কাছে ভালোই মনে হয়েছিল। সে তার মেয়ের কথা নিশ্চিন্তে শুনতে পাচ্ছিল সেখানে বসে। তখন তার সামনে দিয়ে বুড়া আর তার নাতি কথা বলতে বলতে উপত্যকার ঢাল ধরে নেমে যাচ্ছিল। সেখান থেকে দশ-পনেরো মিনিট হবে সেই সংরক্ষিত বনের বন্ধ প্রবেশ পথ। তারপর ফিরে আসতে হবে। তখনই সে তার কম্বলটি পেতে ফেলল বেঞ্চের উপর। জুতা খুলে ফেলে পায়ে একটু ম্যাসাজ করতে লাগল। সামনের জমির ঘাসের ভিতর উগ্র, শক্ত রোঁয়ায় ভরা শুঁয়োপোকারা মন্থর গতিতে চলছিল, কালো রঙের রোমশ গলার ছোট ছোট পাখিরা তাকে এসে দেখে যাচ্ছিল। একজোড়া ছত্রাক শক্ত মাটি ফাটিয়ে উঠে আসছিল। তারা ক্রমশ মাথা তুলছিল। উত্তাপে কুঁকড়ে যাচ্ছিল। একটু দূরে বালকটি উচ্চকণ্ঠে কথা বলে যাচ্ছিল, বা গান গাইছিল, সে শুনতে পাচ্ছিল তা। কিন্তু তার ধারেকাছে কেউ ছিল না যে তাকে উপদেশ বা নির্দেশ দিতে পারে। বুড়া, তার বুড়ি বউ, নাবালক নাতি, বুড়ার ছেলে, তার নিজের স্বামী অথবা কন্যাদের নিয়ে যদি তাকে ভাবতে না হতো, তাহলে সে সুখী হতে পারত। সেইনি এমনি ভাবছিল।

যখন বৃদ্ধ এবং তার নাতি, বালকটি ফিরে আসত, সে দেখতে পেত তারা যে কথা বলতে বলতে গিয়েছিল, একেবারে সেই কথা বলতে বলতেই তারা ফিরছে। কখনও কখনও তারা তাদের কথাবার্তায় এতই মশগুল থাকত কিংবা তারা তাদের নিজস্ব নিজস্ব সমান্তরাল জগতে এতই মগ্ন হয়ে পড়ত, লক্ষ্যই করত না সেইনি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তখন তাকে দ্রুত এগিয়ে তাদের ধরতে হতো। বাড়ি ফিরে বৃদ্ধ ছোট একটা ঘুমে ডুবে যেত। বালকটি তার কিন্ডেলের ভিতরে ডুবে যেত। এবং নৈশাহারের পর তারা আবার বেরিয়ে পড়ত। প্রত্যেক দিনই আগের দিনের মতো সব কিছু ঘটত। সেই সময় কাটানোর গণিতবিদ ইন্থোভেন, বিজ্ঞানী শামওয়ে এবং জাদু কাহিনি নিয়ে কথা চলতে থাকত যতদিন না জুনের সেই সন্ধ্যা আসে যেদিন সেইনি লরেল গাছের নিচে শুয়ে পড়ল একা একা, অনেক পাখপাখালির কল-কাকলির ভিতরে। এবং যেভাবে হোক সেই অপরাহ্নবেলায় শুষ্ক এবং সোনালি উষ্ণতার ভিতরে সে ঘুমিয়ে পড়ল।

একটি কাঠবিড়ালির ছোটাছুটি এবং উপত্যকার দিক থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় সে জেগে উঠল। প্রথমে সে বুঝতে পারছিল না সে কোথায়, কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থেকে লরেল গাছ এবং আলো কমে আসা আকাশ দেখে মনে করতে পারল সে কোথায় এবং কেন। এইটা প্রথম নয় যে সে সেখানে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু এই ঘুমটি ছিল গভীর গভীরতম এবং দীর্ঘ। সে স্বপ্নে টোঙ্গাতে ফিরে গিয়েছিল বৃদ্ধ এবং বালককে নিয়ে। তারা সমুদ্রস্নানে ডুবছিল আর উঠছিল। সে সমুদ্র সৈকত থেকে তাদের দেখছিল। এই স্বপ্নের ভিতরে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। আসলে তার সব স্বপ্নই ছিল অন্যদের পরিচর্যা সংক্রান্ত, তারা হয়তো কোনও বিপদের ভিতর পড়েছে, সে তাদের রক্ষা করতে চাইছে, কিন্তু তার পা সরছে না। সে কাউকে ডাকতে চাইছে, পারছে না। কিন্তু এই স্বপ্নটি ছিল সুন্দর। তারা ফুলে ওঠা সামুদ্রিক ফেনার ভিতরে ভাসছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে সেইনি তাদের কাছে পৌঁছতে চাইল, তার ঘুম ভেঙে গেল। সে বসেছিল। সন্ধ্যা নেমে আসছিল। পাখির ডাক থেমে গেছে। তার দৃষ্টি বাঁক থেকে ঘুরে ওক গাছের পিছনে রাস্তা মিলিয়ে যাওয়া অবধি চলে গেল। এই পথটায় কেউ ছিল না। জুতায় পা গলিয়ে সে দাঁড়িয়ে পড়ল। কম্বল গুটিয়ে নিল। সে ভাবল, তারা নিশ্চয়ই তাকে পার হয়ে গেছে যেমনটি হয়ে থাকে। এবং এই রকম ভাবতেই তার মনে বেঁহুশ এবং বিচিত্র চিন্তা এল, সে যদি আরও তাড়াতাড়ি উঠে পড়তে পারত। কিন্তু এই ভাবনার কোনও কারণ ছিল না। উদ্বেগের কিছুই ছিল না, সে নিজেকেই নিজে বলল। কিন্তু উদ্বেগে তখন তার বুক ভার হয়ে দমবন্ধ হয়ে এল। সে তার ব্যাগ হাতড়ে ইনহেলার খুঁজতে লাগল। তখনই তার মনে পড়ল অতিমারির জন্য তার প্রেসক্রিপশন মতো ফার্মেসি অনেক কিছুই তাকে সরবরাহ করতে পারেনি। ইনহেলার ভর্তি হয়নি।

বাড়িটি ছিল মাত্র দশ মিনিটের হাঁটা পথ। কিন্তু তার শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় তাকে দুবার দাঁড়াতে হয় পথে। অবশেষে বাড়ির পিছনের উঠানে সে পৌঁছায়, তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। সে বাড়িতে ঢুকে বুঝল তারা ফেরেনি। বাড়ির ভিতরটা ছিল খুব শান্ত। বৃদ্ধের হাঁটার লাঠি দুটি সিঁড়ির ধারে রাখা নেই। বাড়ি ফিরলে সেখানেই সাধারণত লাঠি দুটি রাখা থাকে। বালকের বাবা ল্যাপটপের সামনে বসেছিল। বৃদ্ধা উপর তলায় কম্পিউটার থেকে পাওয়া দুটি আলাদা বুক ক্লাব নিয়ে কথা বলছিল কারও সঙ্গে। কিন্তু সেইনি যখন উঠল উপরতলায় সে শুনতে পেল বৃদ্ধা তার স্বামীকে নিয়েই কথা বলে যাচ্ছে মোবাইল ফোনে। সেইনির মনে হলো তার কথায় বিঘ্ন ঘটিয়ে সাহায্য চায়। কিন্তু সে এও জানত তার কথায় কয়েক মুহূর্তের বিঘ্ন ঘটবে মাত্র। আর তার এও মনে হলো সাহায্য চাওয়ার অর্থই হলো কাজে গাফিলতি স্বীকার করে নেওয়া। এর মানে হলো এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া। এই বাড়িই তো তাকে আশ্রয় দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের উঠানে এল। উঠানের সামনের রাস্তা একেবারেই খালি। নির্জন। কুকুরসঙ্গী মাস্ক পরিহিত পথচারীরা নেই। প্রতিবেশীদের বাড়িগুলি যেন পরিত্যক্তের মতো লাগছিল। এতই নিঝুম। তার পকেটে ফোন বাজল। সে ধরতে ইতস্তত করছিল, যে ব্যক্তি ফোন করেছে সে যদি তার এই বিপত্তি নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু যখন সে ফোনটার দিকে তাকায়, সে বুঝল এ শুধু তার অনর্থক ভাবনা। তখন ছিলই ফোন বাজার সময়। বহুদিন আগে যখন আই ফোন ব্যবহার করতে শিখছিল, সে ফোনে একটি কৌতুককর কিছু গেয়েছিল আর তার মধ্যম কন্যা তা এই মোবাইলে নিজের ছবির সঙ্গে জুড়ে ভরে দিয়েছিল। সে তা রেখে দিয়েছিল কিছুটা অমনোযোগের কারণে, কিছুটা নিজের তৃপ্তিতে।

ফোনটি হাতে ধরে, সে ঘুরে উঠানে ফিরে এল, তারপর সেই পথের দিকে গেল। পাহাড়চূড়া দেখতে পাচ্ছিল সে। সে এবার দ্রুত হাঁটতে থাকে। উপত্যকায় নেমে যায়। একটু থামে। সম্ভাবনাগুলি তার মনে জেগে উঠতে থাকে। নতুন তুষারপাতের উপর নেকড়েদের থাবার ছাপ, দেহগুলি দুমড়ে মুচড়ে কুঁকড়ে গেছে আকাশ এবং মাটির মধ্যবর্তী স্থলে। একটি জাদুর বাক্স খুলে যাচ্ছে। পৃথিবী দূরের শৈলশৃঙ্গের কক্ষপথে ধীরে ধীরে ঘুরছে। অনেক দূরে তার কন্যা আবার হেসে উঠল। পাহাড়্ থেকে একটি বাতাস বয়ে এল গাছগাছালি এবং উপত্যকার উপর। তার ফুসফুস এতক্ষণে স্বাভাবিক হলো। সে চলতে আরম্ভ করল।

 লেখক : কথাশিল্পী

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button