আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

প্রচ্ছদ রচনা : সংস্কৃতি ও সাহিত্য : সংস্কৃতির স্বরূপ : সুমন কুমার গাঁতাইত

মনুষ্যসভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে, মানবমনন চর্চার বিকাশ ঘটে চলছে নিরন্তর; সংস্কৃতি কী ও তার ব্যবহারের স্বরূপ কেমন তা নিয়ে বিভিন্ন একাডেমিক ডিসিপ্লিন অবিরত চর্চিত হয়ে চলছে। লেখক থেকে সমাজবিজ্ঞানী, দার্শনিক থেকে নৃতত্ত্ববিদ সব ক্ষেত্রের মননচর্চার পণ্ডিতেরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে সংস্কৃতিচর্চা’কে পূর্ণতা দান করে চলছেন। সংস্কৃতির ব্যাখ্যা হয়েছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে; যেমন বিখ্যাত আমেরিকান নৃ-বিজ্ঞানী Melville Jean Herskovits (1895-1963) সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে জানান―‘Culture is the man-made part of environment.’ (Man and his works : The Science of Cultural Anthropology, 1948)। তেমনি অধ্যাপক পবিত্র সরকার সংস্কৃতির ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন দুটি ভিন্ন স্তর থেকে। একটা হলো বস্তুগত স্তর অপরটি হলো অবস্তুগত স্তর। বস্তুগত স্তরের মধ্যে পড়ে―জীবনের অন্তর্গত সকল বিষয়-কর্ম-চর্চা-সাধনা ইত্যাদি, যা আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহারের বা মানুষের সামগ্রিক স্বাচ্ছন্দ্যের উপাদান সমূহ; অর্থাৎ যা কিনা মানুষের স্পর্শেন্দ্রিয় গ্রাহ্য বস্তু। আর অবস্তুগত সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে নাচ, গান, অভিনয় প্রভৃতি সমূহ। এখানে একটা সাধারণ সমস্যা হলো―অত্যন্ত সাধারণ জনগণ ধরে নেয় নাচ, গান, অভিনয়, আবৃত্তির মতো কয়েকটি বিনোদনমূলক কাজই হলো আমাদের সংস্কৃতি। সাধারণেরা জানে না একজন কৃষক যে পদ্ধতিতে কাজ করেন সেটাও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্তির মধ্যেই পড়ে। একজন কুমোরের হাত যখন গৃহস্থালির পণ্য তৈরি করে, তারপর ছোট ছোট নক্সাগুলি শিল্পকর্ম করে তখন সেটা আর শুধু ব্যবহারিক বস্তু থাকে না। অধ্যাপক সরকার বলতে চেয়েছেন সেই শিল্পকর্ম বস্তুগত সংস্কৃতিকে অতিক্রম করে অবস্তুগত সংস্কৃতিতে পরিণত হয়। এর সঙ্গে আর একটি সাধারণ সমস্যা হলো―অনেকেই সংস্কৃতি বলতে বোঝে―উচ্চ বৃত্তের উচ্চতর শ্রেণির জীবন-যাপন। জীবনকে যারা অর্থের প্রভাবে যথেচ্ছভাবে উপভোগ করতে পারে। তার ফলে আমরা আমাদের চারপাশের প্রকৃতিকে অস্বীকার করে ফেলি।

সাদা চোখে প্রকৃতির অভ্যন্তরে চোখ মেললে আমরা দেখব প্রকৃতিও আমাদের সংস্কৃতির আধার হয়ে উঠেছে। পশু-পাখিদের নিজস্ব ভাষা রয়েছে। শুধু ভাষার লিখিত রূপ থাকলেই সংস্কৃতি হবে তা নয়, তাহলে এখনও অনেক মানুষের মুখের ভাষার কোনও লিখিত রূপ নেই। অনেক আদিম অধিবাসী রয়েছে, যাদের সভ্য মানুষ-এর মতো পোশাক-আশাকও নেই। তারা পশু-পাখির মতো আদি অনন্তকাল থেকে নগ্ন সংস্কৃতিকেই বহন করে চলেছে। অর্থাৎ তারাও কোনও না কোনও সংস্কৃতির অংশ ও সেই সংস্কৃতির বাহক।

এইভাবে বিভিন্ন ধারায় ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির ধারাবাহিত হতে পারে। এক্ষেত্রে আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে―আমরা বাঙালিরা যে যার ধর্মীয় সংস্কৃতির বাইরেও সম্মিলিত জাতিগতভাবেও সংস্কৃতিকে বহন করি। যেমন পহেলা বৈশাখ বা ২১শে ফেব্রুয়ারি। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে ২৫শে বৈশাখ এবং ২২শে শ্রাবণ বা কাজী নজরুল ইসলামের ১১ই জ্যৈষ্ঠ ও ১২ ভাদ্র  ঘিরে জাতিগত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ নির্মাণ করি আমরা। যেখানে আপামর বাঙালি মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণে এই সময়গুলো বাঙালি জাতির সংস্কৃতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। ফলে আমরা বুঝতে পারছি সংস্কৃতি জিনিসটার মধ্যে একটা শাশ্বত সুন্দর, মঙ্গলময় ভাব আছে। যেটা সকলের জন্য ভালো করে, মানুষের মননকে আরাম দেয়।

কিন্তু এর বাইরেও সংস্কৃতির আর একটি দিক আছে, যেটাকে আমরা কথায় কথায় অপসংস্কৃতি বলে থাকি। অর্থাৎ সুন্দর, শুভ, মঙ্গলময় সংস্কৃতির বিপরীতে যা অবস্থান করে। বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানের আধুনিক সুবিধা নিয়ে অপসংস্কৃতির ধারক-বাহকরাও একটা জায়গা করে নিয়েছে। তারা মূলত আত্মগত বিষয়গুলোর বাইরে গিয়ে এমন কিছু ‘ফিউশন’ করছে নতুনত্বের নামে, যা অপসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যকে প্রকট করে। এর পিছনে সাহায্য করে ধনিক পুঁজিপতি সম্প্রদায়। এগুলো শুধু মৌলিক সংস্কৃতির একদম বিপরীতে অবস্থান করে তাই নয়, আদিম প্রাকৃতিক সংস্কৃতির সমূহ ক্ষয় সাধনও করে। এরাও নগ্ন হয়ে আদিম সংস্কৃতির সমগোত্রীয় দাবি করে নিজেদের, আসলে সেটা অশ্লীলতা ছাড়া কিছুই নয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সেটা অশ্লীলতার সীমা ছাড়ায়। এর দরুন বেশ কিছু মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যময় মানসিকতা ভুলে পুঁজিবাদের সংস্কৃতিকে আপন করে অপসংস্কৃতিকেই লোকপ্রিয় করে দেখাতে চায়। আমরা দীনতা দেখিয়ে লোভী হয়ে অসভ্যের মতো সেই অপসংস্কৃতির ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছি।

শুধু সাধারণ মানুষেরাই যে অপসংস্কৃতির বাহক তা নয়, দেশের একশ্রেণির নেতারাও এই ধরনের সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। তারা এই পপুলার কালচারকে ভোটে পরিণত করে নিজেদের ব্যক্তি সুবিধার জন্য অসংস্কৃতির বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে ওঠেন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতির জন্য রাজনেতারা কতটুকু বরাদ্দ করেন সেটা দেখলেই এর পিছনের সম্ভাবনাকে আমরা বুঝতে পারব। অসীম সাহা তাঁর ‘সংস্কৃতি রূপে-অরূপে’ গ্রন্থে মূল্যবান মন্তব্য করেছেন এই বিষয়ে :

‘আপনি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করবেন, দেশের অভ্যন্তরে অপরাধ দমন করবেন, শিল্প বিপ্লব করবেন, তার জন্যে সবার আগে চাই সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব দেয়া। সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব না দিলে সারাজীবন ধরে চেষ্টা করলেও কিছুতেই এ-দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারবেন না। আসলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছাড়া কোনও দেশ উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পেরেছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।’ (পৃষ্ঠা-১৬)

তাই আমরা প্রায় একপ্রকার নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি সাধারণ মানুষকে সভ্য, শিক্ষিত, রুচিশীল ও শৃঙ্খল মানার অভ্যস্ত করার জন্য সচেতন করে তোলা, তার সঙ্গে শুভ, সুন্দর, মঙ্গলের প্রতি আকৃষ্ট ও সহজাত ভালোবাসা থাকাই সংস্কৃতিবান মানুষের পরিচয়। তাই দেশের সরকারেরও উচিত দেশের-দশের উন্নতির জন্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে জরুরি ও বিশেষ যত্নবান হওয়ার।

সেই সঙ্গে এটাও ঠিক কোনও কিছুকে টিকে থাকতে হলে সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে প্রয়োজন ধারাবাহিক রূপান্তরের। তাই বলে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়ে সেই রূপান্তরের কথা বলা হচ্ছে না। সভ্যতা আর সংস্কৃতি কোনও রকমভাবে কৃত্রিমতায় বিশ্বাস করে না। অনুকরণ বা অনুসরণের যদি প্রয়োজন হয় সেটা নিজের মতো করেই করতে হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অন্ধ অনুসরণ করি। যে আত্মসচেতনতা সংস্কৃতি বা সভ্যতাকে বলবান করে সেইটা না থাকার ফলে অন্য সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ নিজের সংস্কৃতি বা সভ্যতাকে তো নষ্ট করেই, সেই সঙ্গে আমাদের নিজ শিক্ষা সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলে। তাই রূপান্তর ঘটাতে হলে সেটাও মৌলিকভাবে রূপান্তরিত করতে হবে। যেটা একটা আমাদের সংস্কৃতির মৌলিক উপাদান রূপে দেখা যেতে পারে। আমাদের সবক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার সংস্কৃতি কোনও রকম কৃত্রিমতা বা জড়তায় চলতে পারে না, সেটা সহজ এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে মানব পরম্পরার মধ্য দিয়ে রূপান্তরিত রূপে বাহিত হয়। আধুনিক শিক্ষা আমাদের সমকালীন করে গড়ে তুলেও সব সময় সভ্য করে তুলতে পারে না। তাই সমাজবিজ্ঞানী চিন্তাবিদরা বারে বারে নানা ভাবে বলেন―যার মধ্যে সংস্কৃতি নেই সে-ই অসভ্য। এটা একটা অত্যন্ত যৌক্তিক অভিধা। এখানে আর একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো সাধারণ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ সংস্কৃতিকেই বোঝে, অর্থাৎ যা দৃষ্টিগ্রাহ্য, যা শ্রুতিগ্রাহ্য বা যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য; এটাই বৃহত্তর সমাজের ভাবনার অসম্পূর্ণতা। এই প্রত্যক্ষ সংস্কৃতির রূপান্তরের প্রক্রিয়া খুব সহজে বোঝা যায় না। সেই জায়গাটা প্রকৃত শিক্ষা সচেতনতার মধ্য দিয়ে আমাদের বুঝতে হবে। তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার গোড়া থেকেই আমাদের সে প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।

এইবার রূপান্তর বলতে অনেকেই বোঝেন বাইরে থেকে আনা কোনও একটা বিষয়কে বলপূর্বক আদিম-প্রাচীন লোকসংস্কৃতির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া। কিন্তু এটা আমাদের বোঝা দরকার লোকসংস্কৃতিকে এইভাবে আধুনিক করা যায় না। এই সহজ বোধটুকুই আমরা অধিকাংশ সময় হারিয়ে ফেলি। আমরা মূলত পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির কিছু জিনিস, যেটা স্পষ্ট করে বললে বলা যায় চটকদার উপাদানগুলিকে অশ্লীলভাবে আমাদের মূল সংস্কৃতির প্রবহমান ধারায় বেনো জল হিসেবে চালিয়ে দিই। এর ফলে হলো দৃশ্য-দূষণ অথবা শব্দ-দূষণ। এই অপপ্রয়াস আমরা নিরন্তর চালিয়ে যাচ্ছি। আর এতে সহায়তা করে শহুরে কিছু চতুর―বেনিয়া সংস্কৃতিজীবী। যারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংস্কৃতির ধ্বজাবাহক হয়েছে। এই অপসংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্বরা নিজেদের পেনি লাভের জন্য সাংস্কৃতিক জগৎকে ড্রয়িংরুমের সংস্কৃতি করে ফেলেছে। তাঁরা সংস্কৃতির আধুনিকীকরণ করার নামে এক জগাখিচুড়ি সংস্কৃতি সরবরাহ করে চলেছে প্রতিনিয়ত। আর এদের সহায়তা করে চলছে একশ্রেণির বেনিয়া পুঁজিপতি ও অশিক্ষিত নেতারা। সংস্কৃতি মানুষের জীবনচর্যার একটি সুবিশাল প্রেক্ষাপট যাকে এককথায় ভাষার অবয়বে সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বরং আমাদের সবসময় চেষ্টা করতে হবে সংস্কৃতিকে বৃহত্তর বা বিশ্বজগতের অভ্যন্তরীণ প্রবাহের মধ্যে দেখতে। অর্থাৎ আমরা যা কিছু চোখের দেখা দেখি, তাকেই সংস্কৃতির আধার বলে ভুল করা চলবে না। সেটা করলে আমাদের ধারণা খণ্ডিত হয়ে পড়বে, আর বাস্তব ক্ষেত্রেও সংস্কৃতির সীমানা হয়ে পড়বে সীমিত পটভূমিকায় একটি কূপমণ্ডূকতার আধার। কিছু সুবিধাবাদী মানুষ যারা কিনা তথাকথিতভাবে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তাঁরা আমাদের পরিমণ্ডলে বাস করে অন্যায়ভাবে অপসংস্কৃতির পবন প্রবাহ করে আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির পরিবেশকে দূষিত করে চলছে নিজেদের কায়েমি স্বার্থে। তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে চলছে নগরের সংস্কৃতিকেই মূলধারার সংস্কৃতি বা মান্য সংস্কৃতির সিলমোহর লাগাতে। আসলে সংস্কৃতির এই বিভাজনটাই তো অপ্রয়োজনীয়। সংস্কৃতি-কারবারিদের এই রাজনীতি একেবারেই সুস্থ সংস্কৃতির জন্য কাম্য নয়। সমাজের তা সার্বিক ক্ষতিসাধন করে।

‘সংস্কৃতি বহমান নদীর মতো। নদীর নৈঃশব্দ্য ও তার চঞ্চল স্রোতের সঙ্গে যেমন সংস্কৃতির তুলনা চলে, তেমনি তার কল্লোলের দিকটাকেও সংস্কৃতির আবহের বাইরে রাখলে তা কখনও পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠতে পারে না। সংস্কৃতির ধারণের ক্ষমতা অসাধারণ। সে যেমন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল সুন্দরকে ধারণ করতে পারে, তেমনি পারে কুৎসিতকেও বুকে তুলে নিতে। সংস্কৃতির এই ধারণক্ষমতার সঙ্গে অন্য আর কিছুরই তুলনা চলে না।’ (পৃষ্ঠা, ৩৮, অসীম সাহা, সংস্কৃতি রূপে-অরূপে)

অর্থাৎ হাজার হাজার বছর ধরে সংস্কৃতি বহমান। যুগে যুগে তার নানা ক্ষতিসাধন হয়ত হয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়নি। নদীর বাঁকের মতো দিক বদল হয়েছে। কোনও নির্দিষ্ট একটা জাতির সংস্কৃতির ধ্বংস করতে হলে, সেই নির্দিষ্ট জাতিকেই সমূলে ধ্বংস করতে হবে। তাছাড়া সংস্কৃতির ক্ষতিসাধন কোনওভাবেই সম্ভব নয়। তাই পৃথিবীর যে প্রান্তে যে জাতি রয়েছে, তাদের নির্দিষ্ট সংস্কৃতিও থাকবে। আর জাতির আত্মপরিচয়ের যে সংস্কৃতি সেটা হলো সেই জাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিত লোকসংস্কৃতি। ধারাবাহিক জীবনকালের সঙ্গে আবহমানকাল সেই মৌলিক সংস্কৃতি জীবিত থাকে। তার মানে সংস্কৃতি সময়কে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। তাই সংস্কৃতিকে কোনও সময়েই পুরানো বলে বাতিল করা যায় না; সময়ের চাহিদা অনুসারে শিল্প-সংস্কৃতি-সভ্যতার পরিবর্তন হয়ে আমাদের সময়োপযোগী হয়ে ওঠে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।

তাহলে আমরা বুঝতে পারছি দুটি জিনিস―একটা হলো অপসংস্কৃতিকে চিহ্নিত করে তার প্রতিরোধ করা, আর অন্যটি হলো সুস্থ-সুন্দর-মঙ্গলময়- ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করা। এটা মনে রাখা দরকার দুটি ব্যাপারই কিন্তু একে অপরের পরিপূরক। একটাকে বাদ দিয়ে অপরটি করা যায় না। এর সঙ্গে আর একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলা যায়―যে কোনও প্রকার অপসংস্কৃতি বিরোধী আন্দোলন কিন্তু শুধুমাত্রই নেতিবাদী আন্দোলন বা প্রতিরোধ হতে পারে না। সেইরকম সুস্থ-সুন্দর সংস্কৃতির পক্ষে যে কর্মকাণ্ড সেটাও শুধু ইতিবাদী আন্দোলন নয়। দুটো ব্যাপারই এখানে পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটা এড়িয়ে আর একটাতে ভালো ফলাফল আশা করা যায় না। এক্ষেত্রে অনেক সুবিধাবাদী সংস্কৃতিজীবী ‘আর্ট ফর আর্টস সেক’ নামক সুপরিচিত বিতর্কের সুবিধা নিয়ে বলতে চায় নন্দনবাদ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে ‘ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য’ ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’ বা ‘চিন্তার স্বকীয়তা’য় কারও খবরদারি করা চলে না। এই প্রসঙ্গে নারায়ণ চৌধুরী তাঁর ‘অপসংস্কৃতির সমস্যা’বিষয়ক প্রবন্ধে সুন্দর যুক্তি দিয়েছেন―

“শিল্পীর স্বাধীনতা কিংবা ‘ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য’ কথাগুলি শুনতে ভাল কিন্তু এটা এঁদের খেয়াল হয় না যে, নিরঙ্কুশ ব্যক্তি-স্বাধীনতা কোন সমাজই বরদাস্ত করতে প্রস্তত নয়―তা সে সমাজ যতবড় পারমিসিভ সোসাইটিই হোক না কেন। সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অকল্যাণ সাধন করে যে বস্তুর চর্চা, তা শিল্পই হোক আর সাহিত্যই হোক আর অন্যবিধ কিছুই হোক, কোনমতেই গ্রাহ্য নয়। শিল্প যখন সুবিধাভোগী মুষ্টিমেয়ের খেয়াল পরিতৃপ্তির যন্ত্র হয়ে বহু মানুষের মঙ্গলামঙ্গলের প্রশ্নকে হেলা ভরে উপেক্ষা করে তখন সেই নিরষ্কুশ ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যধর্মী শিল্প স্পষ্টতই একটা মনুষ্যত্ববিরোধী, সভ্যতাবিরোধী প্রকরণ হয়ে ওঠে। এমন শিল্পকে কঠোর হস্তে দমন করলে অন্যায় হয় না, বরং বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে সেইটেই বিধেয়। সমাজের উপরে শিল্প নয়, শিল্পের উপরে সমাজ। অন্য দশটা কাজের মত শিল্পও সমাজের একটা দিক মাত্র―তার অংশও অধীন। সমাজের ঊর্ধ্বে শিল্পকে কোন মতেই স্থাপন করা চলে না।” (নারায়ণ চৌধুরী; সংস্কৃতি শিল্প ও সাহিত্য, মনোবাণী, জুলাই ১৯৮৫।)

নারায়ণ চৌধুরী যেখানে শুধু শিল্পের জিগির করেছেন সেখানে ‘শিল্প-সংস্কৃতিকে’ একজায়গায় রেখে বিবেচনা করলে যুক্তির সারবত্তা কমে যায় না।

সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি, সমাজমন এবং শ্লীলতা-অশ্লীলতা এই তিনটি বিষয় পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। স্থানভেদে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শ্লীলতা বা অশ্লীলতার মানদণ্ড বিভিন্ন। পশ্চিমা দেশে যা স্বাভাবিক আমাদের সমাজে তা সংস্কারে ঠেকে। নগ্নতার সংস্কৃতি ভিন্ন ভিন্ন দেশে বিভিন্ন রকম। যেমন ধরা যাক ব্রিটেনে লরেন্সের উপন্যাস লেডি চ্যাটারলি’জ লাভার বহুদিন নিষিদ্ধ ছিল, পরে যদিও সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল। নোবেল পুরস্কার প্রাপক ফরাসি লেখক আঁদ্রে জিদের লেখাও সম্পাদনা করে ছাপা হয় ইংরেজি ভাষায়। সমাজের রুচিসম্মত করে সম্পাদক সেখানে প্রকাশ করতে স্বচ্ছন্দবোধ করছেন। আমাদের দেশেও খ্যাতমান সাহিত্যিকরাও সাহিত্যে শ্লীল-অশ্লীলতা নিয়ে নানা বক্তব্য লিপিবদ্ধ করেছেন; কিন্তু বঙ্কিম, শরৎ, রবীন্দ্রনাথ বা তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সারা দুনিয়ায় খ্যাত সাহিত্যিকরা তাঁদের সাহিত্যে সমাজের রুচির বাইরে গিয়ে অশ্লীলতাকে সমর্থন করেননি। অথচ এ দেশের দেহবাদী সমর্থক সমালোচকরা বলেন, সংস্কারের অজুহাতে যে দেহকে আমরা দূরে ঠেলে রাখতে সচেষ্ট হই প্রাচীন সাহিত্যিকরা সেই দেহকেই তাঁদের সৃষ্ট রচনায় অসাধারণ উপস্থিতি দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে বেদের কিছু স্তোত্রাংশ, কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব’ [অবশ্য এস. এ. সাবনিস তাঁর Kalidasa; His Style and His Times গ্রন্থে কালিদাসকে এই রচনার দায় থেকে মুক্তি দিয়েছেন, এবং তিনি প্রমাণ করেছেন এটি একটি প্রক্ষিপ্ত অংশ], অমরুর ‘অমরুশতক’, বাৎসায়নের কামশাস্ত্র, বা বৈষ্ণবপদাবলীর রাধাকৃষ্ণের নানা বর্ণনার দৃশ্য। অথবা স্থাপত্যের দিকে তাকালে আমরা কোনারক বা খাজুরাহো মন্দিরের গাত্রদেশে অনবদ্য মিথুনমূর্তির ভাস্কর্য দেখতে পাই। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর he Continent of Circe গ্রন্থে `Anodzne’ অধ্যায়ে ভারতীয়দের ভোগলিপ্সু জাতি বলে দোষারোপ করেছেন এবং প্রমাণ স্বরূপ তিনি বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্য থেকে উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের বক্তব্য হলো―সংস্কৃত সাহিত্যে দেহমিলনের যে বর্ণনা অপূর্ব শিল্পসুষমায় আবৃত হয়ে পাঠকের সামনে হাজির হয় তাতে অনবদ্য সৌন্দর্য অনুভব পায় পাঠক, সেখানে দেহবাদের উগ্রতা, অশ্লীলতা, অসৌন্দর্য সজ্ঞানে পরিত্যাগ করা হয়। তাই বলা চলে নগ্ন দেহই যেমন সবচেয়ে সুন্দর চিত্র, সেই নগ্নতার প্রকাশভঙ্গিমা পাল্টে গেলে সেটাই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হতে পারে।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button