
‘চোখটা এতো পোড়ায় কেন
ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও
সমুদ্র কী তোমার ছেলে
আদর দিয়ে চোখে মাখাও’
কিংবা
‘আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে
আমাকেও সাথে নিও,
নেবে তো আমায়, বলো নেবে তো আমায় ?’
সমুদ্র নিয়ে এমন হাজারো গান কবিতা শুনতে শুনতে বড় হচ্ছি। আমার জীবনে প্রথম সমুদ্রের স্পর্শ পাই পতেঙ্গা সৈকতে। সময়টা ২০০৬। এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম চট্টগ্রাম। তারপর জীবনের অনেক গল্প জমা হলো সেখানে। সে গল্প অন্য কোথাও লিখব অন্য কোনওদিন। ময়মনসিংহের জনৈক রিকশাওয়ালা ভাইয়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম সাগরপাড়ে। এর আগে বাংলা সিনেমা ও নাটকের দৃশ্যে সমুদ্র দেখেছি। সরাসরি সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে রংপুরের প্রত্যন্ত এক গাঁয়ের ছেলেটা সেদিন বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়েছিল আড়াই মিনিট। তারপর স্পিডবোটে ঘুরে সমুদ্রজলের সঙ্গে শিহরণের লুকোচুরি খেলেছিল সে। এরপরে কারণে অকারণে বিভিন্ন সময়ে কক্সবাজার, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটায় গিয়েছি বহুবার। সেন্টমার্টিনের ছেঁড়াদ্বীপে পূর্ণিমা সন্ধ্যায় তো লীন হয়েছিলাম জ্যোৎস্না আর সমুদ্রস্রোতের সঙ্গম দেখে। আমার পর্যটকদল আমাকে পঞ্চান্নবার ফোন করেছে, ফোন বেজেছেও সজোরে। অথচ আমি টের পাইনি। অতঃপর ওরা হাঁপাতে হাঁপাতে কেয়াবনের ঝোপের কিনারায় আমাকে আবিষ্কার করে। তারপরে সে আর এক ইতিহাস। সমুদ্রকে কখনই পুরনো মনে হয়নি আমার। একঘেয়েমি কিংবা বিরক্তিকর তো নয়ই, বরং সমুদ্র আমাকে বারবার আশ্রয় দিয়েছে, কাছে ডেকেছে, উজাড় করা স্নেহের কোল পেতে বুকে টেনেছে অকৃত্রিম ভালোবাসায়।
কবি শিহাব শাহরিয়ার সম্পাদিত বৈঠার সমুদ্র সংখ্যা পড়তে পড়তে সমুদ্র নিয়ে বুকের কোটরে জমিয়ে রাখা গল্পগুলো যেন হুড়মুড় করে বের হয়ে আসতে চাইছে। বৈঠা নামের এই পত্রিকাটি ইতোমধ্যেই বাংলা সাহিত্য সমুদ্রের চলমান যাত্রায় একটি সুগন্ধি ফুলের দ্বীপ হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। বৈঠা লোকনন্দন বিষয়ক একটি ছোটকাগজ। ২০০৫ সালে বিষয়ভিত্তিক এই কাগজটির প্রথম সংখ্যা বের হয়। প্রথম সংখ্যার বিষয় ছিল জ্যোৎস্না। মানুষ প্রকৃতিকে হারিয়ে ফেলছে। নিসর্গের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে নতুন প্রজন্ম প্রকৃতির কাছে যাচ্ছে না। এই চিন্তা থেকেই প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে মানুষকে একটুখানি উস্কে দিতেই সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ার বৈঠা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথম সংখ্যার দুই বছর পর ২০০৭ সালে আরও একটি সংখ্যা বের হয়। বিষয় ছিল বৃষ্টি। নগরজীবনে বৃষ্টিকে আমরা যেভাবে দেখি সেখানে বৃষ্টির অকৃত্রিম বুনোরূপ চোখে পড়ে না। বাঙালি জীবনে বর্ষার প্রভাব যথেষ্ট বৈচিত্র্যময় এবং আকর্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় ঋতু ছিল বর্ষাকাল। বৃষ্টি একদিকে যেমন মনকে রোমান্টিক করে তোলে, অন্যদিকে নিম্নবিত্তের জীবনে অতি বৃষ্টি এক অভিশাপ। বৃষ্টির কারণে শ্রমজীবী মানুষের রুটি রোজগার ও জীবনযাত্রায় অবর্ণনীয় কষ্টের সৃষ্টি হয়। বৃষ্টি সংখ্যায় এই দুই বিষয়কেই বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। জ্যোৎস্না সংখ্যায় লেখক ছিলেন প্রায় ৬৭ জন এবং বৃষ্টি সংখ্যায় লেখক ছিলেন প্রায় ১০০ জন। ২০১৩ সালে বৈঠার তৃতীয় সংখ্যাটি প্রকাশ পায়। এটির ছিল গ্রাম। শহর-নির্ভর এই পুঁজিবাদী পৃথিবীতে গ্রাম হারিয়ে যাচ্ছে। সেই হারানো গ্রামকে নিয়ে গ্রামের নানা বিষয় নিয়ে লেখা গ্রাম সংখ্যাটি একটি সমৃদ্ধ সংখ্যা হিসেবে পাঠকমহলে সমাদৃত হয়। এর প্রায় ১০ বছর পরে প্রকাশ পেলো সমুদ্র সংখ্যা। সমুদ্র কি ? মানুষকে সমুদ্র কেন টানে ? সমুদ্রের বিশালতা, সমুদ্রের ঝড়, মানুষের মৃত্যু, সমুদ্রের নীল জল, সমুদ্রের ঢেউ, সমুদ্রে সূর্যাস্ত এবং সমুদ্রের নানা বিষয় আমাদেরকে গভীরভাবে টানে। এই যে সমুদ্র, সমুদ্রের নানামাত্রিক দিক সবকিছ্ইু সুনিপুণ বিশ্লেষণে তুলে ধরেছেন সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ার।
একটি বিষয় খুব খেয়াল করলে দেখবেন, বাংলা সাহিত্যের এই সময়ে সম্পাদনার জায়গাটা খুবই নড়বড়ে অবস্থায় সংগ্রাম করছে। সম্পাদনার নামে বেশিরভাগ গ্রন্থ বা পত্রিকা শুধুই সংকলন বা সংগ্রহরূপে করে প্রকাশ করা হচ্ছে। সেই জায়গা থেকে সম্পাদককে খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেননা তারা কেবলই সংকলক বা সংগ্রাহক বটে, কোনওভাবেই সম্পাদক নন। সেই জায়গা থেকে বৈঠা পত্রিকাটি কেমন সেটি পাঠকই বিচার করবেন। কবি শিহাব শাহরিয়ারের মস্তিষ্কজাত এই নান্দনিক ভাবনাটি আমাকে মুগ্ধ করেছে। সমুদ্র সংখ্যা পড়ে তার জ্যোৎস্না, বৃষ্টি ও গ্রাম সংখ্যা পড়ার ইচ্ছেটা তীব্রতর হচ্ছে। প্রায় ৬৮ জন লেখক, কবি, আবৃত্তিশিল্পী, চিন্তক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক ও স্বয়ং সম্পাদকের লেখা পত্রিকাটির সমুদ্র সংখাটিকে একটি সমৃদ্ধ ভাবনাঘররূপে গড়ে তুলেছে। যে ভাবনাঘরে ঢুকলে সমুদ্রকে নানা আঙ্গিকে নানা রূপে আবিষ্কার করতে পারবে পাঠকহৃদয়। পত্রিকাটির প্রায় সকল লেখাই আমাকে স্পর্শ করেছে গভীরভাবে। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় পড়লে মনে হবে এটি উঁচু-জ্ঞানের প্রদর্শনী নয়; বরং এটিও এক ধরনের ভ্রমণ। লেখক-পাঠকের যৌথভ্রমণ। লেখকের সঙ্গে সঙ্গে যেন আমিও ঘুরে বেড়াচ্ছি বিশ^জুড়ে সাগর-সমুদ্রের পাড়ে পাড়ে। সম্পাদক নিজেই যখন গভীর বোধের কবি; তখন তার সম্পাদিত প্রকাশনাটিও কবিতার মতোই নান্দনিক হবে এটাই স্বাভাবিক। এখানেও সেটাই ঘটেছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত ৪৫৬ পৃষ্ঠার পত্রিকাটিতে সমুদ্র অভিজ্ঞতার পাশাপাশি গল্প, কবিতা, সমুদ্র সম্পর্কিত বিশ্লেষণধর্মী লেখা এবং বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকতগুলোর বর্ণনা অত্যন্ত পরিমিত নান্দনিতকতায় সাজানো আছে সবিস্তার। যারা সমুদ্র ভালোবাসেন তাদের জন্য মাঝেমধ্যেই হারিয়ে যাওয়ার একটি মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে এই সংখাটি।
সমুদ্র সংখায় ১৭টি পর্বে সূচিপত্রটিও সুন্দর করে সাজানো। পর্ব: ০১ : সমুদ্র ও সৈকত। পর্ব: ০২ : সমুদ্র কি ও কেন ? পর্ব: ০৩ : আমাদের উপসাগর। পর্ব: ০৪: বঙ্গোপসাগর: আমাদের দ্বীপসমূহ। পর্ব: ০৫ : বঙ্গোপসাগর: কূলে সন্দ্বীপ ও নিঝুম দ্বীপ। পর্ব: ০৬ : সমুদ্র পাড়ের জীবন। পর্ব: ০৭ : সমুদ্র দেখার অনুভূতি। পর্ব: ০৮ : সমুদ্র ও বিবিধ ভাবনা। পর্ব: ০৯ : সমুদ্র নাবিক ও জলের জীবন। পর্ব: ১০ : সমুদ্র পাঠ ও বাংলা সাহিত্য। পর্ব: ১১ : বাংলা কবিতায় সমুদ্র। পর্ব: ১২ : বাংলা গল্পে সমুদ্র। পর্ব: ১৩ : বাংলা নাটক ও গানে সমুদ্র। পর্ব: ১৪ : সমুদ্র ও ঝড়। পর্ব: ১৫ : সমুদ্র ও মৃত্যু। পর্ব: ১৬ : সমুদ্র নিয়ে সাক্ষাৎকার। পর্ব: ১৭ : বঙ্গোপসাগর: সীমানা ও সম্পদ। প্রায় ৬৮টি জন লেখক লিখেছেন এই সংখ্যায়।
কয়েকজনের কিছু কথা তুলে ধরলাম। যেমন, আবুল মোমেন লিখেছেন :
‘প্রায় সব ধর্মগ্রন্থেই সমুদ্রের প্রসঙ্গ আছে। কুরআনে সমুদ্র নিয়ে যে মূল বক্তব্য তাতে আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষ্যের মিল পাওয়া যায়। সুরা ফুরকানে আছে―তিনিই দুটি সাগর সৃষ্টি করেছেন। একটির পানি সুমিষ্ট ও সুপেয় আর অপরটির পানি লবণাক্ত ও বিস্বাদ, বুক জ্বালা করে। দুয়ের মধ্যে তিনি রেখে দিয়েছেন এক ব্যবধান, এক অনতিক্রম্য বাধা’। সুরা ফাতিনেও অনুরূপ বক্তব্য রয়েছে। (দ্রষ্টব্য: কোরানসূত্র পৃ. ৬২৫-মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান)
কোরানে সমুদ্রের কথা আরও কয়েকটি সুরায় রয়েছে। লোহিত সাগর পাড়ি দিয়ে মিশর ত্যাগের ঘটনায় সমুদ্রের দুভাগ হয়ে ভ্রষ্টদের হাত থেকে ভালোদের রক্ষার বিবরণী সবার জানা। তবে ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তালমুদে সৃষ্টির পরে তৃতীয় দিনে এই গ্রহ পানিতে সয়লাপ হওয়ার কথা মেলে। তৃতীয় দিনে সমস্ত পৃথিবী সমভূমির মত চ্যাপ্টা, আর হু হু করে পানি এসে তার উপরিভাগ ভরে ফেলল যখন সর্বশক্তিমানের উচ্চারণ এল: খবঃ ঃযব ধিঃবৎ নব মধঃযবৎবফ ঃড়মবঃযবৎ (এবহ.১.৯)। তখন নানা স্থানে পাহাড়গুলো মাথা তুলেছে, উপত্যকাগুলো পানিতে ভরে গেছে আর তাকে স্রষ্টা বললেন সমুদ্র (ংবধং)। আর তার পরে জলে ও স্থলে সৃষ্টি হল প্রাণিকূল। তাদের বংশ বৃদ্ধির কথাও এল, এল মানুষের খাবারের কথাও। বাইবেলেও একাধিক জায়গায় সমুদ্রের প্রসঙ্গ এসেছে এবং বারবার এ সূত্রে স্রষ্টার শ্রেষ্ঠত্ব ও সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণের কথা এসেছে।
হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে সমুদ্রের বিস্তারিত বিবরণী মেলে। কোনটিতে সোমরস, কোনওটিতে ঘি, কোনওটি পূর্ণ দইয়ে, কোনওটি দুধে, কোনওটি কেবল মিষ্টি পানির সাগর। বেদে, পুরাণে, মহাভারতে এ ধরনের বর্ণনা ফিরে ফিরে এসেছে। মহাকাব্যেও সমুদ্রের প্রসঙ্গ এবং নায়কের সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা পাই। হোমারের ইলিয়াডের মূলে (রোমান ভাষায় ইউলিসিস) ইথাকায় প্রত্যাবর্তনের বিস্তৃত সমুদ্রযাত্রার বর্ণনা। এ মহাকাব্যে সমুদ্রও একটি চরিত্র এক মহানায়কের জীবনপথে সফরে তার বিজয়ের আনন্দ এবং ব্যর্থতার গ্লানি ফুটে উঠেছে এরই প্রেক্ষাপটে। ওডিসিয়ুস নিজের ভুলে সমুদ্রাধিপতি পসিডনের ক্রোধের শিকার হন। খেয়ালের বশে তিনি হত্যা করেছিলেন পসিডন-পুত্র পলিফেমাসকে। তাঁর তিক্তমধুর অভিজ্ঞার জেরে এই কাব্যে সমুদ্রকে বারবার বর্ণনা করা হয়েছে। রিহব-ফধৎশ ংবধ সমুদ্রের দানব একচক্ষু সাইক্লোপসদের কথা আছে, বা আছে জাদু ডাইনি বা সার্সির কথা আরব্য রজনীতে সিন্দাবাদের কাহিনিতে নায়কের সমুদ্রযাত্রার বিচিত্র ঘটনাবলিতে নানা ইতিবাচক-নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা জানা যায়। রামায়ণের কথা। আগেই আমরা বলেছি। পরবর্তীকালের সাহিত্যও সমুদ্রকে ছাড়েনি। এই বিপুল তরঙ্গক্ষুব্ধ জলরাশি দেখার পরে সংবেদনশীল মন সাড়া না দিয়ে পারে না। তাই যুগে যুগে সাহিত্যে, বিশেষভাবে কবিতায়, সমুদ্রের বিষয় হয়ে ওঠা যেন এক স্বাভাবিক ব্যাপার। এ যেন উৎসে ফিরে যাওয়া, বারে বারে জলধির কাছে নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া। মিল্টনের লুসিডাসে যেমন তেমনি শেক্সপিয়রের টেম্পেস্ট-এ সমুদ্র হাজির। নাটকটির মূল মঞ্চ সমুদ্রগামী জাহাজ, আর নাটকের সূচনা হয় তুমুল এক ঝড়ের দৃশ্য দিয়ে। সমুদ্রের অনুষঙ্গ নিয়ে টেম্পেস্ট জুড়ে আছে নানা শেক্সপিয়রীয় কাব্যশক্তির ছটা :
‘ঐধফ ও নববহ ধহু মড়ফ ড়ভ ঢ়ড়বিৎ, ও ড়িঁষফ
ঐধাব ংঁহশ ঃযব ংবধ রিঃযরহ ঃযব বধৎঃয ড়ৎ বৎব
ওঃ ংযড়ঁষফ ঃযব মড়ড়ফ ংযরঢ় ংড় যধাব ংধিষষড়’িফ ধহফ
ঞযব ভৎধঁমযঃরহম ংড়ঁষং রিঃযরহ যবৎ.’
হরিশংকর জলদাস বলেছেন, ‘তখন নৌকার চারদিকে বড় বড় ঢেউয়ের তাণ্ডব। পর্বতসমান ঢেউ নৌকার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে আর শক্ত কৌশলী হাতে আগাটি সেই ঢেউয়ের মাথায় চড়িয়ে দিচ্ছে ঈশান। আক্রোশে ফুঁসতে ফুঁসতে সেই ঢেউ নৌকাকে ঝাপটা দিয়ে পেছনে গলে যাচ্ছে। করাল হা করে বাতাস এগিয়ে আসছে হু হু করে। ঘন কালো মেঘ নেমে এসেছে অনেক নিচে। মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কাছে দূরে বজ্রপাত হচ্ছে। যেন মহাদেব মহাপ্রলয়ে নেমে রুদ্ররোষে হুংকার দিচ্ছেন।…ঢেউয়ের সঙ্গে ঢেউয়ের বাড়ি লেগে জলতল ফেনাময়। জলকণাগুলো ঘন আস্তরণ সৃষ্টি করেছে গোটা সমুদ্রজুড়ে। …বাতাস, ঢেউ, জলকণা, মেঘের গর্জন, বৃষ্টির ছাঁট মিলেমিশে এক ভয়জাগানিয়া পরিবেশ তৈরি হলো সমুদ্রবুকে। সমুদ্র শুধু আমাকে রুদ্র-ভয়ংকরের অভিজ্ঞতা দেয়নি, ধবল জ্যোৎস্না আর অতল নীলজল দেখার সুযোগও করে দিয়েছে। শীতকালে বঙ্গোপসাগর হয়ে যায় সৌম্য ঋষির মতন। ঢেউ নেই, কল্লোল নেই। তীর ছুঁই ছুঁই তখন তার নীলজল। তীর ধরে ধরে নীলজলের ছলাৎ ছলাৎ পায়ে মৃদু অগ্রগমন। দিগন্তজুড়ে বালিয়াড়ি। জলের ধার ঘেষে অগণন লাল কাঁকড়ার এধারে ওধারে দৌড়াদৌড়ি। কাঁকড়ার দুটো শুঁড় যেন মৃদু আলোর দুটো বাল্ব। কাছে গেলেই ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ গর্তে ঢুকে পড়া। ইচ্ছে হলো তো দলবেঁধে নীলজলে অবগাহন। শীতের সময় মাছ মারতে যাবার আলাদা একটা আনন্দ আছে। আষাঢ় থেকে কার্তিক পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর যেন মাছ মারুয়াদের প্রবল প্রতিপক্ষ। কোন ক্রমেই এই সময়ে সমুদ্রকে বাগে আনা যায় না। শুধু ভাঙে―পালের মাস্তুল, নৌকার আগা, হালের দাঁড়। শুধু কেড়ে নেয়―জাল, নৌকা, জীবন। হরবাঁশির বাপ, জয়ন্তের মেয়ের জামাই, মধুরাম, মঙ্গলচরণ―এদের জীবন কেড়ে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে না সমুদ্র, আরও গ্রাস করার জন্য ফুঁসতে থাকে। অগ্রহায়ণ এলে বঙ্গোপসাগরের সকল ফোঁসফোঁসানির অবসান ঘটে। বুকভরা নীলজল নিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে আর দক্ষিণ থেকে উত্তরে চলতে থাকা শুধু। ওই নীলজলের তলায় তখন প্রচুর মাছ―চিক্কা ইচা, লইট্যা, ছুরি, রূপচাদা আর চেঁউয়া মাছ। কূল―আঁধার করা দূরত্বে জেলেরা তখন তাদের বিহিন্দিজাল পাতে। সারি সারি। নানা বহাদ্দার আর পাউন্যা নাইয়া ওই সব সারি জালে শক্তপোক্ত রশি বেঁধে ঘাইয়ে থাকে।
‘গভীর রাতে মাছ তোলার সময় হয়। ওই সময় কূল থেকে দাঁড় বেয়ে এসে নিজেদের জালের হদিস পাওয়া সম্ভব নয়। তাই জেলেরা জালে লম্বা রশি বেঁধে পুরো জোয়ারের সময়টা জাললগ্ন হয়ে থাকে। একে বলে ঘাইয়ে থাকা। ওই রকম ঘাইয়ে থাকাকালে অগ্রহায়ণের এক নিশুতি রাতে ধবল জ্যোৎস্নার সঙ্গে আমার দেখা। ফকফকা জ্যোৎস্নাও যে মানুষকে ঘোরে ফেলে দেয়, তা আমি বুঝেছি ওই রাতে। শনশন করে নৌকার দুপাশ দিয়ে জল ধাবমান। জলতল নখের পিঠের মতন সমতল। দু-চারটা অচেনা মাছ জলের ওপরে একটু ক’রে লাফিয়ে উঠে জলে ডুবে যাচ্ছে আবার। নৌকার কাঁইকের ওপর সঙ্গে চারজন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি জেগে আছি। নৌকার পশ্চাৎ দিকের ছোট খোপে শরীরটাকে আটকে দিয়ে বিপুল জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে আছি আমি। দক্ষিণ দিকের তীর ঘেঁষে পূর্ণচাঁদ। পূর্ণিমাই হবে সে রাতে। নইলে এত জ্যোৎস্নায় আকাশ-সমুদ্র ভেসে যাবে কেন ? রুপালি চাঁদের পাগল-করা আলো নীলজলের রঙটাই পাল্টে দিয়েছে। আমি একবার জল দেখি, আরবার চাঁদ।
‘আমি হাত বাড়িয়ে জ্যোৎস্নামাখা জল ছুঁই, আর জ্যোৎস্না ছুঁয়ে থাকে আমাকে। আমার মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে সেই সময় কোনও একটা আওয়াজ বেরিয়ে এসেছিল। নইলে কেন যুধিষ্ঠির আথালিপাথালি বিছানায় উঠে বসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল কী অইয়ে, অ-বাছা, তোঁয়ার কী অইয়ে ? আমি একটু লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, ‘কিছু না বাবা।’ নিচ্চয় কিছু একান অইয়ে বাছা। ভয় নো পাইও। এই সমত সাগর কত কিছু হাঁড়ি বেড়ায়।’ বাবা বলেছিল। আমি জবাব দিইনি। বাবা আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। তখন আমি এমএ পাস দিয়ে ফেলেছি। অধ্যাপনাও করছি চট্টগ্রামের সরকারি সিটি কলেজে। সাতশত পঞ্চাশ টাকা বেতন। ওই টাকা দিয়ে এগারো জনের নিত্যদিনের হাঁ বন্ধ করা যায় না। ভাইয়েরা ছোট ছোট। দু-চারজন স্কুলে পড়ছে। পরিজনের দুমুঠো অন্ন জোগাড় করার জন্য তাই আমার জ্যোৎস্নারাতে বজ্র নিনাদিত ঝড়ো রজনীতে মাছমারার অভিযান। খুব ছোটবেলা থেকে বঙ্গোপসাগরকে ভালোবাসতে শিখেছি আমি। বঙ্গোপসাগর আমাদের পরিবারের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছে, শান্তি কেড়ে নিয়েছে, বারবার বেঁচে থাকার প্রধান উপকরণ নৌকা আর বিহিন্দিজালও গ্রাস করতে কখনও দ্বিধা করেনি সে। তারপরও কেন জানি সমুদ্রকেই ভালোবেসেছি। সমুদ্র আমার অস্তিত্ব, আমার বিকাশ-বিস্তারের উর্বর ক্ষেত্র।’
ফারুক তাহের লিখলেন সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া একটি শার্টের কাহিনি―’৯১ এর সেই ভয়াল রাতের প্রতিটি মুহূর্ত কেটেছে আমার মৃত্যু চিন্তায়। আর দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমার মা-বাবা, ভাই-বোনদের নিয়ে। আমি তো তাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে শেষ দেখা করে এসেছিলাম। আমার যদি সেমিপাকা ঘরে আশ্রয় নিয়ে এ অবস্থা হয়, বেড়ার ঘরে এবং সমুদ্রের আরও কাছে থেকে তাদের কী অবস্থা হলো তা নিয়েই ছিলাম মহাদুশ্চিন্তায়। আমার ধারণা ছিল, তাদের কেউই হয়তো আর বেঁচে নেই। তারা হয়তো ঘরেই পানিবন্দি অবস্থায় ছিল এবং জোয়ারের তীব্র স্রোতে হয়তো তাদের সবাইকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তা ভেবে ভেবে কান্না করছিলাম আর আল্লাহকে ডাকছিলাম। আমি যখন ছাদে প্রচণ্ড শীতে অনবরত কাঁপছিলাম। তখন আমার অদূরে আরও দু’তিনজন লোক একইভাবে কাঁপছিল আর কান্না করে করে আল্লাহকে ডাকছিল এই মহাবিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য। আমি অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করতে পারছিলাম না, তারা কে বা কোন বাড়ির। আমি ভয়ে-আতঙ্কে ছিলাম বটে, কিন্তু হুঁশ হারাইনি এক মুহূর্তের জন্যও। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ঢেউয়ের ঝাপটা এসে যদি আমাকে ছাদ থেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তখন আমি তো গায়ে শার্ট রেখে বেশিক্ষণ সাঁতরাতে পারব না। পরনের লুঙ্গি না হয় ওই পরিস্থিতিতে দ্রুতই খুলে দিতে পারব, কিন্তু শার্ট ? গায়ে শার্ট থাকলে তো আমার শরীর ভারী হয়ে থাকবে। এই চিন্তা থেকে আমি শার্টের সবগুলি বোতাম খুলে দিলাম, যেন ছাদ থেকে সমুদ্রের এই মাতাল জোয়ারে পড়ে গেলে সাঁতরাতে পারি সহজে। কিন্তু শেষ রাতে জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ারের তাণ্ডব নেতিয়ে আসলে ভোরে আমি নিজেকে আবিষ্কার করলাম খালি গায়ে পরনে শুধু একটি লুঙ্গি পরিহিত এক শীর্ণকায় কিশোর হিসেবে। জোয়ারের ঝাপটা কোন ফাঁকে আমার শার্টটি গা থেকে খুলে নিয়ে গেছে তার কিচ্ছু জানি না।
‘ঘূর্ণিঝড়ের মাসখানেক পর আমার সেই শার্ট আমার এক সহোদর দেখতে পেলো পার্শ্ববর্তী বাড়ির এক ছেলের গায়ে। তার নাম আমির। আমির আমাদের পাড়াতো সম্পর্কে চাচা হলেও সে ছিল আমার ক্লাসমেট। প্রাইমারিতে আমরা একই স্কুলে একসঙ্গে পড়েছি। শার্টটি যে আমার সে কথাও নাকি তাকে বলে দিল আমার সেই সহোদর। কিন্তু তখন পরিস্থিতি এমনই যে, তুচ্ছ এই শার্ট কেন, এক বাড়ির লোক আরেক বাড়ির কারও আলমিরার জিনিস-পত্তর ও সোনা-চাঁন্দির মতো দামি কিছু পেয়ে থাকলেও ফেরত দেয়নি কেউ। সময়ের ওই লণ্ডভণ্ড পরিস্থিতিতে যে যা পাচ্ছে সেটা তার হয়ে যাচ্ছে। অপেক্ষাকৃত ভালো মানুষদের মুখ থেকে আমরা শুনেছিলাম, ঘূর্ণিঝড়ের পর যারা বেঁচে ছিল তাদের দিল থেকে নাকি ‘রহমত ওঠে গেছে, আদর্শ ও ঈমান ওঠে গেছে।’ কিন্তু অবাক করা কাণ্ড ঘটালো আমির। একদিন আমির নাকি আমার সেই শার্টটি ফেরত দিয়ে গেছে! হারিয়ে যাওয়া সেই শার্টটি আমি ফিরে পেলাম। সেটা আরও বহুদিন আমি পরেছি। একটা সময়ে এসে সেটা আমি আর পরিধান করলাম না। যত্ন করে রেখে দিলাম প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। শার্টটি অনেক দিন ছিল মায়ের ট্রাঙ্কের ভেতর। পরে সেটা কোথায় আবার হারিয়ে গেলো আর পেলাম না। শার্টটি আসলে আমারও ছিল না। সেটা ছিল আমার মেজ ভাইয়ের। তার গায়ে যখন ছোট হচ্ছিল শার্টটি, তখন সেটি আপনা আপনিতেই আমার দখলে চলে আসে।’
বৈঠার সমুদ্র সংখ্যাটিতে নবীন প্রবীণ সবাই লিখেছেন। এক সময় আমরা দেখতাম মীজানুর রহমানের সম্পাদনায় ত্রৈমাসিক নদী সংখ্যা, পক্ষী সংখ্যা, গণিত সংখ্যা, শামসুর রাহমান সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। যেগুলো আজও পাঠক হৃদয়ে গেঁথে আছে। আমার মনে হয় বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয় কিংবা বিভিন্ন গবেষণায় এই সংখ্যাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজে লাগতে পারে। সমুদ্র নিয়ে কবিতা, সমুদ্র নিয়ে প্রবন্ধ, সমুদ্র নিয়ে গল্প, সমুদ্র নিয়ে নাটক সমুদ্র সংখ্যাটিকে এক অনন্য নান্দনিকতার সোপানে এনে দাঁড় করিয়েছে। বৈঠার নিয়মিত এই শিল্পভ্রমণটিকে মনে করি, জ্যোৎস্না রাতে বৃষ্টিতে ভিজে গ্রামের মেঠোপথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে এ যেন সমুদ্রের কোল-সৈকতে এসে দাঁড়ানো। এর পরে বৈঠা কোনদিকে তার তরী ছোটাবে―পাহাড়ে ? নাকি―অরণ্যে ? সেটা সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ারই ভালো বলতে পারবেন। বৈঠার সকল সংখ্যা পাঠক মননে নিয়মিত বসবাস করুক চলমান ও অনাগত সময়ের বাঁকে বাঁকে। শেষ বাক্যে এসে শুধুই অভিনন্দন হে কবি ও সম্পাদক শিহাব শাহরিয়ার। বৈঠা চলুক, বৈঠা বলুক, বৈঠা হয়ে উঠুক সময়ের প্রতিধ্বনি।
লেখক : প্রাবন্ধিক