আর্কাইভগল্প

গল্প : সময়ের দাবি : পিওনা আফরোজ

হাসপাতালের করিডোরে দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছিল নাজনিন আর জয়ার কাছের কয়েকজন। নতুন একটি মুখের দেখা পাবার অপেক্ষায়। নরম তুলতুলে হাতে হাত রেখে, কচি কচি আঙুলগুলো ছুঁয়ে যাবার অপেক্ষায়। অবশেষে যখন সকল অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেই আনন্দঘন মুহূর্তটির সম্মুখীন হলো সকলে, তখন সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল নাজনিন। তাঁর জীবন জুড়ে যে অমানিশা ঘিরে ছিল এতদিন, একমাত্র মেয়ে জয়ার সন্তানের আগমনে তা যেন মুহূর্তেই ঘুচে গেল।

কিন্তু বাচ্চার বয়স যত বাড়তে থাকে, ততই একটা ভাবনা ক্রমশ জয়াকে উদ্বেলিত করে তোলে। বাচ্চা নিয়ে চাকরিটা কন্টিনিউ করতে পারব তো! কীভাবে সব সামলাব ? এই একই ভাবনা দিনরাত মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে জয়ার।

বিয়ের প্রায় সাত বছর পর তার কোলজুড়ে এসেছে ছেলে নাবিল। নিজের ক্যারিয়ারকে খানিকটা গুছিয়ে নেওয়ার পরই মা হবে এমনটাই পরিকল্পনা ছিল, বিবাহিত জীবনের শুরু থেকেই। সেই ক্যারিয়ারের চলমান গতিতে সে কোনওভাবেই ছেদ পড়তে দিতে চায় না। কিংবা কোনও অজুহাতে বা সন্তানের দোহাই দিয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা সে ভাবতেও পারে না। 

বাসার কাছেই তার মা থাকে। একাই। মাকে জয়া অনেকবার বলেছে একসঙ্গে থাকতে কিন্তু মা কোনওভাবেই রাজি হয় না। এদিকে মেটার্নিটি লিভের সময়ও প্রায় শেষ হয়ে আসছে। ছুটি যতই ফুরিয়ে আসছে, জয়ার উদ্বিগ্নতাও ততই বাড়তে থাকে। সেই উদ্বিগ্নতা থেকে সে মাকে ফোন করে জানতে চায়, মা, আপনে তো কিছু কইলেন না। আমার তো অফিসে জয়েন করার সময় হইয়া আইছে। বাবুটার যদি একটা ব্যবস্থা না করতে পারি, তাইলে অফিস করমু ক্যামনে ?

ক্যান, তোরে তো আমি কইছিই তুই অফিস যাওনের সময় বাবুরে আমার কাছে দিয়া যাবি, সারাদিন ও আমার কাছেই থাকব। আর অফিস শেষ কইরা বাসায় যাওনের সময় ওরে নিয়া যাবি।

আচ্ছা, আপনের আমগো লগে থাকতে সমস্যা কী ? কন তো দেখি মা ? ওইখানে একলা একলা পইড়া থাকেন, কী খান না খান, কিছুই জানি না। আমাগো লগে থাকলে তো আমিও একটু শান্তি পাই।

কিন্তু নাজনিনের ওই একই কথা, মারে, আমি তোগো বাড়তি বোঝা হইতে চাই না। তুই সুখে -শান্তিতে সংসার কইরা দিন পার করতে পারলেই আমি খুশি আছি। আমার লাইগা ভাবিস না।

মা-মেয়ের ফোনালাপ চলাকালেই জয়ার কানে তার বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। আর তখনি ফোনটা রেখে সদ্য ঘুম থেকে জেগে যাওয়া বাচ্চার ডাইপার চেক করে।

এরই মধ্যে একটানা ডোরবেল বাজতে থাকে।

সে জানে এইভাবে বেল বাজায় সজীব। তাই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দ্রুত দরজা খুলে দেয় জয়া।

কি হইছে ? বাবু কানতেছে ক্যান ? ঘরে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা সোফার উপর রেখে সজীব স্বাভাবিকভাবেই জানতে চায় জয়ার কাছে।

জয়া ঝাঁজ দেখায়। ডায়াপার চেইঞ্জের সময় হইলেই তো কাঁদে। জানোই তো।

হুম, বলে সজীব।

কথা বলতে বলতে জয়া শোবার ঘরে বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করাতে বসে। সজীব কাপড় চেইঞ্জ করে, হাত মুখ ধুয়ে এসে বসে তার পাশে। মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে দ্যাখে জয়ার উন্মুক্ত বুক। জয়া লজ্জা পেয়ে বলে নির্লজ্জ! বুকটা ওড়না দিয়ে ঢেকে নেয়।

নির্লজ্জের কী আছে ? আমার বউকে আমি দেখবো না ?

না, দেখবা না।

সজীব তখন দৃষ্টি ফিরিয়ে ছেলে নাবিলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জানতে চাইল―আম্মার সঙ্গে কথা হইছে ? কী বলছে উনি ?

ওই একই কথা। আসব না। একলা থাকব।

জয়ার উত্তরে খানিকটা হতাশ হয় সজীব। বলে, একসঙ্গে থাকতে না চাইলে কী আর করার! আম্মার বাসা তো কাছেই। অফিস যাবার সময় বাবুরে রাইখা যাবা আর ফেরার পথে বাবুরে নিয়ে আসবা।

এছাড়া তো আর কোনও উপায় নাই।

কিছুদিন পরে জয়া নিয়মিত অফিসে যাওয়া শুরু করে। ছেলে নাবিল নানির কাছেই থাকে। নানিও তার একা থাকার ক্ষণগুলো নাতির সঙ্গে ভাগ করে নেয়। হাসি-কান্না আর গল্পে মুখর হয়ে ওঠে একাকী নাজনিনের সময়গুলো। একা একা নিজের রান্নাবান্না, ঘর-দোরের কাজ সামলে নাতিকে রাখতে খানিকটা কষ্ট হলেও জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে যেন একটু প্রশান্তি খুঁজে পায় সে। নাতির নিষ্পাপ মুখের হাসিতে তাঁর মুখেও হাসি ফুটে ওঠে। নাতি একটু কেঁদে উঠলেই হাতের কাজ ফেলে রেখে তার কাছে ছুটে যায়। ক্ষয়ে যাওয়া কোমরে, পিঠে ব্যথা নিয়েও সারাবেলা নাতির দেখাশোনা করে। 

কিন্তু দিন বদলের নিয়মে প্রকৃতিতে যখন বর্ষাকাল এল, তখনি ঘটে যত বিপত্তি। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে নাজনিন ঘরবন্দি হয়ে পড়ে। এমনকি এবারে ঈদের দিনের মতো আনন্দের দিনটিতে   একমাত্র নাতি নাবিলের সঙ্গেও দেখা হয়নি। হবে কী করে, বৃষ্টির সময় একটানা ঘরের পানি সেঁচতে হয়। ভাঙ্গাচোরা যেটুকু বাক্সপেটরা আছে সেগুলো ঘরের কোথায় রাখলে ভিজবে না, এ নিয়ে চিন্তা করতে হয়। সিমেন্ট-বালি খসে যাওয়া ভাঙ্গা মেঝে থেকে বৈদ্যুতিক সকেট সামান্য উপরে থাকায় তা নিয়েও  দুশ্চিন্তার আর শেষ নেই। একবার পানি জমে বেড়ে গিয়ে তা যদি সকেটের ভিতরে ঢুকে যায়, তবেই তো ঘটবে দুর্ঘটনা! তাই পানি যেন বেড়ে না যায় সেজন্য পানি সেঁচতে সেঁচতে নাজনিনের হাতের আঙুল, আঙুলের নখগুলোর পাশে মাংস ফুলে, সাদা হয়ে পচে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিছুক্ষণ পানি না সেঁচলে ঘরে রাখা চকিটাও যে ডুবে যাবে। তখন সমস্ত দিনের ক্লান্তির পর একটু শুয়ে, বসে যে রাতটা পার করবে সেই জায়গাটাও তাঁর আর থাকবে না।

মেয়ে জয়া অবশ্য মাকে বলেছিল তার কাছে গিয়ে থাকতে। অন্তত বর্ষার সময়টাতে। কিন্তু নাজনিন রাজি হয়নি। কেননা মেয়ের কাছে গিয়ে যদি একনাগাড়ে থাকে তবে তো ঘরের সব জিনিসপত্র পানির ভিতরে থেকে পঁচে যাবে।

অন্যদিকে স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে নাতি থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে এই আশঙ্কা থেকে সকালে জয়া অফিস যাবার আগে নাজনিন তার বাসায় যায় আবার জয়া অফিস থেকে ফিরলে তবেই নাজনিন নিজের ঘরে ফিরে। সমস্ত দিন কেটে যায় মেয়ের বাসাতেই। তাছাড়া কোমর আর হাঁটুর ব্যথা নিয়ে চারতলায় সিঁড়ি ভেঙে উঠানামাও খুবই কষ্টকর!

এত কষ্টের পরও একসঙ্গে থাকতে না চাওয়ার পিছনে নাজনিনের ব্যক্তিগত আত্মসম্মানবোধ ছাড়াও  কিছু অন্তর্গত দুঃখও রয়েছে। যা তার মনে সুচের মতো কেবলি খোঁচা দেয়। রক্তাক্ত করে সময়ে অসময়ে। সে উপলব্ধি করেছিল, নিজের যখন অন্যকে দেবার মতো কিছুই থাকে না, তখন অন্যের জন্য হৃদয়ে সঞ্চিত মায়া-মমতাও অর্থহীন। তাই নিজের আত্মসম্মানকে বিসর্জন দেবার চেয়ে দুঃখ-দুর্দশার সঙ্গে দিনযাপন করাই শ্রেয় বলে মনে করে সে। আর এই জন্য কাউকে সে দায়ী করে না। ভাগ্যই তার প্রতিকূলে ছিল জীবনভর। তাই তো বরাবরই ছিল প্রবঞ্চিত, দারিদ্র্যপীড়িত, বিক্ষত।

একদিন এক রাতে মায়ের কাছ থেকে নাবিলকে আনতে যায় জয়া। তখন নাজনিনের প্রতিবেশী মনিরা জয়ার সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে বলে, বুঝছো জয়া আপা, খালার ম্যালা কষ্ট অইয়া যায়। একদিকে বাচ্চা রাখতে হয় আবার অন্যদিকে ঘরের পানি সেঁচতে হয়, হেরপর আবার তার নিজের খাওন-দাওনের লাইগাও টুকটাক কামকাইজ করতে হয়। বেচারির বুড়া শরীরে ম্যালা কষ্ট হয়! যদি পারো, ঘরে পানি ঢুকে না এমন একটা বাসা লইয়া দাও তারে।

আপা, আম্মারে তো বলছি আমার সঙ্গে থাকতে। তাইলেই তো আর এত কষ্ট হয় না। মায়ের ঘরের তেঁতুল বিচি রঙের কাঠের নড়বড়ে খাটের ওপর বসে কথাগুলো বলে জয়া। তার সেই কথায় যেন মিশে ছিল কিছুটা আক্ষেপ আর কিছুটা মায়া।

হ, তোমার মায় কইছে আমারে। কিন্তু আপা, ওইহানে একলা একলা বাচ্চাটারে হে ক্যামনে সামলাইব, কও। তোমগো তো ফ্ল্যাট বাড়ি। বাসায় তো আর কেউ নাই। এইহানে দেহনা, স্কুলঘরের মতো লম্বা একখান টিনশেড বাড়ি। তার মধ্যে ঘর আছে কত্তডি! আশেপাশের ঘরের মানুষেরা মাঝে মধ্যে আইসা কোলে নিলেও খালায় তার রান্ধন-খাওনের কামটা করতে পারে। আর দিনের বেলা তো পোলাপাইন স্কুলে যাওন আসনের সময় আর বিকালে মার্বেল কিংবা কুতকুত খেলতে আইলেও পিচ্ছিটারে কোলে নিয়া আদর করে। তহন খালার ইকটু হইলেও সুবিধা হয়।

তা বুঝি আপা।

কথা বলতে বলতে মনিরার চোখ পড়ে নাজনিনের দিকে। তাকে পান চিবোতে দেখে মনিরা বলে, খালা তুমি দেহি একলাই পান চিবাইতেছ, আমারে এক খিলি দেও দেখি।

নাজনিন বুকের সঙ্গে মিশিয়ে রাখা নাতিটাকে একটু আলগা করে কোলের ওপর রেখে মনিরার জন্য জর্দা, সুপারি দিয়ে পান বানিয়ে তার হাতে দেয়। মুখের ভিতর পানটা পুরে দিতে দিতে মনিরা জয়াকে বলে, তুমি তো বাচ্চা রাখনের লাইগা ন্যানি না কি কয় হেগোরে রাখবার চাইছিলা।

মনিরার দিকে তাকিয়ে জয়া কেমন অপ্রতিভ হয়ে ওঠে। কাঁধ থেকে তার খোলা চুলগুলো পিঠের দিকে সরিয়ে দিতে দিতে বলে, হুম। চাইছিলাম। কিন্তু আম্মা মানা করল। কইল, রাখার দরকার নাই। হে-ই বাবুরে রাখব।

হ, হ, জানি বলে মনিরা ফিক করে ঘরের জানালা দিয়ে পানের রস ফেলে বলে, তই কই কি, হেগোরে রাখলে তো বেতন দিতে হইত, হইত না ? ওই টাকাটা দিয়া খালারে একটা ভালা বাসা লইয়া দাও। তাইলে হের খাটনিও কিছুটা কমব আর নিশ্চিন্তে তোমার বাচ্চাটাও রাখতে পারব।

আপনে কি কইতেছেন, আমার বাচ্চারে রাখার লাইগা মায়েরে টাকা দিতে হইব ? খানিকটা বিরক্তির স্বরে বলে জয়া।

জয়া বিরক্ত হয়েছে বুঝে মনিরা তৎক্ষণাৎ বলে উঠে, না না আপা, আমি তোমারে এইডা বুঝাইতে চাই নাই। তুমি আমারে ভুল বুঝতাছ।

তখনি নাজনিন কপাল কুঁচকে, তীব্র ঝাঁঝালো গলায় মনিরার দিকে তাকিয়ে বলে, তুই এইসব কি কইতাছস ? আমি কি তোরে কইছি আমার কষ্ট হয়, কইছিলাম ? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে নাজনিন মনিরার কাছে জানতে চায়। মনিরা ক্রোধের সম্মুখেও নিজেকে সামলে নিয়ে নির্বাক বসে থাকে। কিন্তু নাজনিন পুনরায় মনিরার দিকে তাকিয়ে হাতের ইশারায় আর মুখে বলে, ওঠ তো ওঠ। যা, তুই এহন তোর ঘরে যা।

প্রতিবেশী মনিরা ঘর থেকে বেরুনোর পরপরই জয়াও কিছু না বলেই মায়ের কোল থেকে তার বাচ্চাকে একরকম কেড়ে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। নাতিকে প্রতিদিন বিদায় দেবার সময় নাজনিন আদর-জড়ানো নানা নামে ডাকে, নাতির কপালে, গালে চুমু খায়। কিন্তু আজ সেসবের কোনও সুযোগই জয়া তার মাকে দেয়নি। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নাজনিন অবাক, হতবিহ্বল আর নিশ্চুপ থেকে  মেয়ে এবং নাতির চলে যাওয়া দ্যাখে।  

জয়া বাসায় ঢুকেই বাচ্চাকে খাটে শুইয়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলে, দুনিয়ার সবখানেই গিভ অ্যান্ড টেক। তাই বলে কি মা-ও তার মেয়ের সঙ্গে এমন করব। মা আবার এমন হয় না কি ?  আম্মা না বললে তো আর মনিরা নিজ থেকে এসব বলে নাই। আমার ছেলে রাখে, দ্যাখে, সেইজন্য তারে আমার ভালো বাসায় রাখতে হইব, আবার বয়সের ছুতায় সংসারের কাজ করতে পারে না বইলা তার জন্য আলাদা কাজের লোক দিতে হইব। এত কিছু করতে গেলে তো দেখতেছি, আমি যা বেতন পাই তার পুরাটাই আম্মার হাতে তুইলা দিতে হইব।

সজীব রাতে বাসায় ফিরলে তাকে জানায়, তুমি তাড়াতাড়ি বাবুরে রাখার একটা ব্যবস্থা করো।

কেন ? কী হইছে ?

দরকার আছে দেইখাই তো বলতেছি।

জয়ার উত্তরে সজীব ধারণা করে, হয়তো কোনও বিষয়ে মা-মেয়ের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। তাই বিষয়টি এড়িয়ে যাবে ভেবেই সেই রাতে সজীব এই নিয়ে আর কোনও কথা বলেনি।

পরদিন সকালে নাজনিন জয়ার আসার অপেক্ষায় থেকে থেকে যখন দেখল সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে তখন সে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। ভাবে, কী হলো, মেয়েটা কেন আজ এল না ? নাতি বা মেয়ের শরীর-টরির খারাপ হলো না তো ?  না কি গতকাল মনিরার কথায় রাগ করেই আজ আর আসেনি। এমন নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে মেয়েকে ফোন করে নাজনিন। আসেনি কেন জানতে চাইলে, মেয়ে তাকে জানায় আজ সে অফিসে যায়নি।

কেন রে, শরীর খারাপ তোর ? নাবিলটা ভালো আছে তো ? বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায় নাজনিন।

হ্যাঁ। শরীর ভালো। নাবিলও ভালো আছে।

ও, তুই ছুটি নিছিস ? সজীবও বাসায়, না ?

হ্যাঁ আম্মা, ছুটি নিছি, কিন্তু সজীব অফিসে গেছে। অভিমানের স্বরে জানায় জয়া।

নাজনিন মেয়ের অভিমান বুঝে গলাটা খানিক খাদে নিয়ে নরম স্বরে বলে, তুই আসলি না তো, তাই চিন্তা করতেছিলাম। ভাবলাম, কি হইল…

নাজনিনের কথা শেষ হবার আগেই জয়া বলে, কিছু হয় নাই মা। আমি অফিসের কাজ করতেছি। এখন রাখি।

মেয়ের সঙ্গে কথা শেষ করে নাজনিন বিষণ্ন মনে কপালে হাত রেখে শুয়ে থাকে বিছানায়। চোখ দুটো বন্ধ। দেখে মনে হয়, গভীর কোনও ভাবনায় ডুবে গেছে। এভাবে দুপুর পেরিয়ে বিকেলও যায় যায়। মনিরা এসে বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে জানতে চায়, খালা, তোমার শরীর কি আইজ বেশি খারাপ ? কতক্ষণ ধইরা দেখতাছি শুইয়া রইছ। খাইছ কিছু ? রান্ধাবাড়াও তো করতে দেখলাম না। আমাগো ঘর থেইকা ভাত কয়টা আইনা দেই ? খাইয়া লও।

না রে। আমার কিছু ভালো লাগতেছে না। নাতিটা আইজ আসে নাই তো! কেমন খালি খালি লাগতেছে সবকিছু!

ক্যান, আসে নাই ক্যান তোমার নাতি ?

আইবো ক্যামনে ? তুই তো কাইল ভেজাল লাগাইয়া দিছস।

কী কও তুমি খালা ? আপা এই নিয়া তোমারে কিছু কইছে ? নাজনিনের কাছে জানতে চেয়ে ঘরের দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে এক দলা থুথু বাইরে ফেলে মনিরা।

না। তা কয় নাই।

তাইলে তুমি হুদাই এইডা নিয়া ক্যান টেনশন করতাছ ? হুনো খালা, জয়া আপা আমার কতায় কিছু মনে করবার মতো মানুষই না।

তুই চিনস ওরে ? ও কিসে কী মনে করব আর কিসে করব না, তুই জানস ? আমি ওরে পেটে ধরছি। আমি জানি। শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে নাজনিন।

আইচ্ছা করলে করছে। খারাপ কিছু তো কই নাই। এইসব কতা বাদ দাও তো। তুমি এহন ওইঠ্যা খাইয়া লও বলে হাত ধরে উঠাতে গিয়ে অবাক হয়। বলে, এ কি খালা, তোমার গায়ে তো অনেক জ্বর। আমি এহনি জয়া  আপারে ফোন দিতাছি। 

আহা! তুই কাউরে ফোন টোন দিস না তো। ঠিক হইয়া যাইব সব।

কিন্তু নাজনিনের কোনও কথা শুনে না মনিরা। সে জয়াকে ফোন দেয়।

ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করতেই মনিরার কানে ভেসে আসে, গাড়ির হর্নের আওয়াজ, মানুষের কোলাহল। কথা স্পষ্টভাবে শুনতে সে ঘর থেকে বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে জানতে চায়, তুমি কই জয়া আপা ?

আমি রাস্তায়।

কই যাইতেছ ?

বাবুরে রাখার একটা জায়গা খুঁজতে বাইর হইছি। দেখি কিছু একটা ব্যবস্থা করতে পারি কি না ? ওরে রাখতে তো আম্মার অনেক কষ্ট হইয়া যায়। আর উনার এতো চাহিদাও পূরণ করা সম্ভব না।

কিসের চাহিদার কথা কইতাছ তুমি ?

কত্ত চাহিদা! উনারে ভালো বাসায় রাখতে হইব। একলা বাচ্চা সামলাইতে কষ্ট হয়, সেইজন্য আলাদা কাজের লোক রাখতে হইব। তার ওষুধপত্র, বাজার খরচ এত কিছু আমি ক্যামনে সামলাব ? এইরকম হইলে তো আমার বেতনের পুরা টাকাটাই ওনার হাতে তুইলা দিতে হইব। তাইলে আমার আর কাম কইরা কী লাভ ?

কী কও এইসব ? খালা তো তোমার কাছে কিছু চায় নাই। সরকারি চাইল-ডাইল, তেল যা পারি, তা তো আমিই আইনা দেই। খালায় মেশিনের কাম কইরা যা পায় তা বাসা ভাড়া দেয়। তুমি যখন যা পারো দাও না দিলেও হে চায় না। ওষুধ ফুরাইলে অসুখে ভোগে, তবু কাউরে কিছু কয় না। টানা কথাগুলো বলে একটু থেমে মনিরা আবার বলে, শুনো জয়া আপা, খালার কষ্ট দেইখা ওইদিন কথাডি আমিই তোমারে কইছি। বৃষ্টির সময় হের ঘরটাতে পানি উইঠ্যা থাকে। সারারাত বেচারি মানুষের গুয়ের মুতের পানির মধ্যে পইড়া রয়। ওইরকম ময়লা পানি ঘরে থাকলে খাইতেও পারে না, বাথরুমেও যাইতে পারে না। আগেতো পানি সেচতে পারলে সেঁচতো, শরীরে না কুলাইলে শুইয়া পড়ত। অহন তো তোমার বাচ্চাটা নোংরা পানির মধ্যে থাকলে অসুস্থ হইয়া যাইব ভাইবা হের শরীরে না কুলাইলেও একদিকে পানি সেঁচে আবার অন্যদিকে বাচ্চাটারে সামলায়। বাচ্চারে খাওয়ানো, গোসল করানো, ঘুম পাড়ানো সবই তো খালার একলাই করা লাগে। বুড়া মানুষ, দেইখ্যা মায়া লাগে।

আপা, আমি তো কইছি আম্মারে আমার লগে থাকতে। সে যদি না থাকে, আমার দ্বারা তো দুইভাগে খরচ চালানো সম্ভব না।

আচ্ছা, এসব কথা বাদ দাও। শোনো আপা, আইজকা সকাল থেইকা গায়ে ম্যালা জ্বর লইয়া খালায় না খাইয়া পইড়া রইছে। তাও তোমারে ফোন দিতে মানা করতাছিল। হের কথা না শুইনা আমিই তোমারে ফোন দিছি।

কখন থেইকা জ্বর ?

তা তো কইতে পারুম না। কয়দিন ধইরাই তো শুনতাছি শরীর ভাল না। জ্বর আসে আর যায়।

আচ্ছা আপা, আমি তো এখন বাসা থেইকা অনেক দূরে। আপনে একটু আম্মারে দেইখা রাইখেন। আর ওষুধ লাগলে মোড়ের দোকান থেইকা নিয়া খাইতে কইয়েন। আমি ফিরবার পথে আসুমনি।

এদিকে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাজনিনের শারীরিক কষ্টও বাড়তে থাকে। শরীর বেশ দুর্বল। কোমরের ব্যথাটাও বেড়েছে। সঙ্গে জ্বর তো রয়েছেই। দুপুরে মনিরা এসে জোর করে যতটুকু খাইয়ে দিয়ে গেছে, তারপর আর কোনও খাবার খায়নি। জ্বরের ঘোরেও বারবার মোবাইলটা হাতে নিয়ে দ্যাখে নাজনিন, কেউ ফোন করেছে কি না! আবার মাঝে মাঝে সময় দ্যাখে, রাত কত হলো ? ভাবে, এই বুঝি মেয়ে এল, এই বুঝি মা বলে মেয়ে ঘরে ঢুকল। অপেক্ষায় থেকে থেকে ঘড়িতে যখন দ্যাখে রাত দশটা বাজে, নাজনিন তখন ধরেই নিয়েছে, আজ আর মেয়ে আসবে না।

তার ধারণা সত্যি হয়েছে। মেয়ে আসেনি। সেদিন বাসায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায় জয়ার। তবে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে না পারলেও ফোন করে খোঁজখবর নিয়েছে। সকালে যেন ডাক্তারের কাছে যায় মাকে সে পরামর্শও দিয়েছে।

তারপরও মেয়ের কথা শুনে নাজনিনের মনে হয়, তখনও অভিমান ঘিরে রয়েছে জয়ার মনের চারপাশ। নাজনিন এই অভিমানের কারণ জানে। কিন্তু এই অভিমান ঘোচানোর ইচ্ছে হয় না। তার অবয়ব জুড়ে তখন অতীত স্মৃতিচারণার অস্ফুট আভা। এই একাকী জীবনে মেয়েটাই তো তার একমাত্র সম্বল। স্বামীকে হারানোর পর মেয়েটাকে নিয়েই তো জীবনের দীর্ঘ পথ সে একাই অতিক্রম করেছে। সেই জীবনের পথটা মসৃণ ছিল না। খেয়ে না খেয়ে এমনকি মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছিল সে। জীবনের কঠিন দুরবস্থার সম্মুখীন হয়েও গ্রামে গিয়ে বাবা-মায়ের কাছেও ওঠেনি। যদি মাঝপথে মেয়ের পড়ালেখাটা বন্ধ হয়ে যায়, সেই ভয়ে।  চেয়েছিল, মেয়েটি শিক্ষিত হোক, স্বাবলম্বী হোক। বিপদে যেন শিক্ষাই তার সম্পদ হয়ে রয়। যেটা তার ছিল না। আর তাই তো জীবনের এই দুর্বিষহ পরিণতি আজ তার সঙ্গী। ব্যথা, বেদনায় জর্জরিত জীবনে আজ আর কারও অকারণ অভিমান ভাঙাতে মন সায় দেয় না।

এমন নানা ভাবনা ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় নাজনিন। আবার যখন ভোরের শরীর জুড়ে অস্ফুট অন্ধকার, জানালায় ঝোলানো পর্দা কাঁপছিল হাওয়ায়, নিস্তেজ হলদেটে আলো ঘরের সামনের খোলা জায়গায় আর বাড়িঘরের উপর এসে পড়েছে, ঠিক সেই সময় জয়ার মোবাইল ফোনে বেশ কয়েকবার ফোন করে নাজনিন। জয়াকে না পেয়ে প্রতিবেশী মনিরার নাম্বারেও  একাধিকবার ফোন করে সে। কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করেনি। কেননা তখনও সবাই ঘুমের ঘোরেই বিভোর হয়েছিল।

ঘুম ভাঙ্গার পর জয়া তাঁর মাকে কল-ব্যাক করে জানে, মায়ের শরীর খুব খারাপ। খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই এসে দ্যাখে মা কথা বলতে পারছে না। শ্বাস টেনে তুলতে কষ্ট হচ্ছে। তাঁর গলার কাছের রগ বারবার ফুলে উঠছে। মায়ের এই অবস্থা দেখে দ্রুত হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যায় জয়া।

ডাক্তার ব্লাড প্রেসার চেক করে দেখেন স্বাভাবিকের তুলনায় প্রেসার অনেক বেশি। পাশাপাশি আরও কিছু পরীক্ষা করে দ্রুত কিছু ইনজেকশন আর ওষুধ সেবনের পর নাজনিনের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল হয়। কিন্তু ডাক্তার জানান, এখনি তাকে কোনওভাবেই বিপদমুক্ত বলা যাবে না। আর তাই, রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

জয়া দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়―মাকে যদি হাসপাতালে রাখতে হয়, তাহলে মায়ের কাছে কে থাকবে ? বিভিন্ন রোগের জীবাণু, নোংরা পরিবেশ, অসহ্য রকমের দুর্গন্ধ―এর মধ্যে বাবুকে নিয়ে এখানে থাকা কোনও ভাবেই সম্ভব না। এমনিতেই এসি ছাড়া বাচ্চাটার খুব কষ্ট হয়। এসব ছাড়াও টাকা পয়সার ব্যাপার তো আছেই। হাসপাতালে ভর্তি থাকলে কত টাকা বিল আসবে, কে জানে ? যদিও হাসপাতালটি সেবার তুলনায় নামমাত্র টাকা নেয়। তারপরও দুশ্চিন্তা তো হয়! ফোনে সবকিছু সজীবকে জানিয়ে তার কাছে পরামর্শ চাইলে সজীব বলে, দেখো, তুমি যা ভালো মনে করো, তাই করো। ভালো না লাগলে, মাকে বাসায় নিয়া আসো।

জয়াও স্বামীর সঙ্গে কথা শেষ করে ডাক্তারকে জানায়, মাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাই।

দেখুন, আমি মতামত জানিয়েছি, এখন আপনি যদি রোগীকে অ্যাডমিট করাতে না চান সেটা তো আপনার ইচ্ছে। কথা শেষ করে উত্তরের অপেক্ষায় জয়ার দিকে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকেন কর্তব্যরত ডাক্তার।

কিন্তু জয়া তখন নিশ্চুপ, দৃষ্টি নত, মেঝের দিকে।

ডাক্তার তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সামনেই টেবিলে রাখা কাগজে কিছু একটা লিখছেন আর বললেন, ঠিক আছে। আপনি রোগী নিয়ে যেতে পারবেন, আমি লিখে দিচ্ছি।

নাজনিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে ডাক্তার আর তার মেয়ের সব কথা শুনেছে। কিন্তু নাজনিন নিশ্চুপ। জীবন-মৃত্যুর সংশয় যেখানে সেখানেও কত শান্ত, কত স্থির সে! তাছাড়া কীইবা করার আছে তার। হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মতো কোনও সঞ্চিত অর্থ তো নেই তার কাছে। যেখানে অর্থ নেই, সেখানে কথারাও হারিয়ে যায় টুকরো কাগজের মতো বাতাসে বাতাসে।

মাকে নিয়ে ইমার্জেন্সির গেইট পেরিয়ে এসে হাসপাতালের ডিসপেন্সারি থেকে সদ্য প্রেসক্রাইব করা ওষুধগুলো বুঝে নেয় জয়া। ডিসপেন্সারির কাজ শেষে ওয়ার্ডবয় হুইল চেয়ারে বসা নাজনিনকে নিয়ে হাসপাতালের মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জয়াও গেইটের বাইরে পায়চারি করছে উবার আসার অপেক্ষায়। তখন দিনের শেষে নতুন আরেকটি সন্ধ্যা নামার ক্ষণ হয়ে এল প্রায়। এমন সময়  নাজনিনের পুনরায় শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তৎক্ষণাৎ হুইল চেয়ারটি উল্টোদিকে ঘুরিয়ে নাজনিনকে ইমার্জেন্সিতে নিয়ে আসে সঙ্গে থাকা ওয়ার্ডবয়। এবার ডাক্তার সাহেব নাজনিনকে দেখে কারও কোনও কথা না শুনেই রোগীকে ভর্তি করে নেন।

ধীরে ধীরে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত বাড়তে থাকে। ছোট্ট নাবিলকে কোলে নিয়ে মায়ের বেডের সামনে এসে দাঁড়াল জয়া। মায়ের মাথার কাছে। বিছানায় এলিয়ে পড়া ষাটোর্ধ্ব কুঁচকে যাওয়া হাতের মুঠোয় কিছু টাকা দিয়ে নরম স্বরে বলে, মা, আমার তো বাসায় যাইতে হবে। বাবুরে নিয়া এখানে থাকা সম্ভব না। বুয়া বাসায় গিয়া আমারে না পাইলে চইলা যাইব। আজকের রান্না করা হইব না। আর সজীব তো বাইরের খাবার খাইতে পারে না।

সব কথা শুনে নাজনিন ফ্যালফ্যাল চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, কিছুক্ষণ ছোট্ট নাবিলের দিকে। কেমন এক বিষাদের অন্তঃস্রোতে নাজনিনের বুক লাফিয়ে ওঠে অকস্মাৎ। তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকা মুখগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে সিলিঙের বৈদ্যুতিক পাখাটির দিকে তাকায়। পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া ডাক্তার, নার্সদের কথোপকথনের শব্দ কানে ভেসে আসে। কখনও কখনও আশেপাশের রোগীদের গোঙানির আওয়াজ। তখনও থেমে থেমে নাজনিনের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। নাকে অক্সিজেন লাগানো। নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে নাতির ছোট্ট কোমল হাতটা একটু ছুঁয়ে দেয় নাজনিন। যাবার বেলায় মেয়েকে হাতের ইশারায় বিদায় দেয়। কিন্তু কোনও কথা বলে না। যেন সময়ের এসব দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া কোনও উপায়ই নেই। কারও কারও জীবনের সময়গুলো হয়তো মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার মধ্যেই ঘুরপাক খেতে থাকে। এ যেন বিষাদময় বাস্তবতা!

আর তাই অসুস্থ অবস্থায়ও তার পাশে যে আজ কেউ নেই, এমন কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয়। নাজনিন ভাবে, জয়ার না হয় ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে থাকতে অসুবিধা হতো কিন্তু তার স্বামী তো পারতো একটা রাত হাসপাতালে কাটাতে। একটু পাশে থাকতে। এই ভাবনা তাকে আরও বেশি যন্ত্রণাকাতর করে তোলে। আবার ভাবে, ওদের তো কত কাজ! আমাকে নিয়ে বসে থাকলে চলবে কী করে! সকাল হলেই তো ব্যস্ততার পুনরাবৃত্তি! দৈনন্দিন রুটিনে বাঁধা হুড়াহুড়ি। সারারাত হাসপাতালে থেকে সকালে অফিস করাটা কষ্টকর! এমন বহুভাবে ভেবে মনকে স্থির করে নাজনিন। ধীরে ধীরে রাত ফুরিয়ে সকাল হয়, সকাল গড়িয়ে দুপুর কিন্তু তখনও জয়া হাসপাতালে আসে না।

দুপুরের দিকে মনিরা এসে নাজনিনের কাছে জানতে চায়, রাইতে তোমার কাছে জয়া আপা আছিল খালা ?

নাজনিন মনিরার কথার উত্তর না দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে থাকে।

মনিরা আবার জিজ্ঞেস করে, আপা আইজকা কোন সময় আইব ?

জানি না। বেশ দুর্বল স্বরে বলে নাজনিন।

আমি ফোন দিছিলাম, কইলো, বাবুরে ডে-কেয়ারে রাইখা অফিসে যাইব। হাসপাতালে কহন আইব হেই কথা তো কিছু কইল না।

কথা শুনে নাজনিনের মুখ গাঢ় বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। হতবাক হয়ে মনিরাকে বলে, কী কস তুই এসব ? পোলাটারে আমার কাছ থেইকা নিয়া কই রাখব ? জন্মের পর থেইকা ওতো আমার কাছেই থাকে। ওরে ছাড়া আমি থাকমু ক্যামনে। ক্যামনে বাঁচুম ?

মনিরা এক মুহূর্তের জন্য নাজনিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো তার চোখ উপচে উঠেছে অশ্রুবিন্দুতে। সে ছলছল চোখে মনিরাকে অনুরোধের স্বরে বলে,

ওরে বোঝা, বল, আমার ভালো ঘর, টাকা-পয়সা, ওষুধ-পথ্য কিছুই লাগব না। তুই শুধু আমার নাতিটারে আমারে দিতে ক। ওরে ছাড়া আমি থাকতে পারুম না। ওরে আমারে দিতে ক। আমার আর কিচ্ছু চাই না। কিচ্ছু না…।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button