
মেটের হাটের বুক চিরে পোড়া ইটের যে রাস্তাটা সোজা পুবদিকে যেতে যেতে আচমকাই ঈষৎ দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে সেই রাস্তা থেকে ডান হাতে বেরিয়ে গেছে আরও সরু একটা রাস্তা। না, ঠিক রাস্তা নয়, পায়ে হাঁটা গলিপথ বলা যায় তাকে। নিছকই শব্দটা গাঁ গেরামে ব্যবহার করে না, তাই। তো সেই পায়ে হাঁটা সরু পথ আমবাগান, বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে কলাঝাড়, কাঁঠাল, নারকেলগাছের পাশ কাটিয়ে নির্বিষ হেলে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ঢুকে গেছে পাড়ার মধ্যে। পাড়াটার নামও অবশ্য একটা আছে। বিশ্বাসপাড়া’। তা এ পাড়ায় যে কেবল বিশ্বাসদেরই বাস―এমনটা নয়। পাড়ার অর্ধেক বিশ্বাস হলেও বাকি অর্ধেক রায়, মণ্ডল, দত্ত, বাইন। আরও অন্য পদবিরও দুএকঘর খুঁজলে পাওয়া যায়। তা এ পাড়ার বলতে গেলে একেবারে শেষ মাথায় ঘর সুধনের। তার দক্ষিণে ভূষণ রায়ের আমবাগান। তারপরে কলাখেত। তারও পরে খানিক উঁচু ডাঙা জমি। সেই জমিটাই ক্রমশ ঢালু হতে হতে নেমে গেছে সালকী বিলের পেটে। এখন ভরা ভাদর। বিলের গায়ে ভরা যৌবন। বর্ষা শেষ হয়েও হয়নি। আকাশটা যখন তখন তার হা মুখ উপুড় করে দেয়। এই তো কাল রাতেও যেমন দিল। শুধুই কি কাল ? আজ সারাদিন যেভাবে নামলো তাতে কে বলবে এটা শরৎকাল। একটা সময় ছিল যখন শরৎ এল তো বর্ষা শেষ। মেঘ-টেঘ আচমকা সরে গিয়ে ফর্সা হয়ে আসত আকাশ। বৃষ্টির আর নাম গন্ধটি থাকত না। এখন সে দিনকাল গেছে। ভাদ্র-আশ্বিনেও যেন ভরা বর্ষা। কখন নামবে, কখন থামবে বলে কে। তা বলতে পারে না সুধনও। সে জল জঙ্গলের মানুষ। বর্ষা এল তো সালকী বিলই তার বাড়িঘর। আর তা চলে ফাল্গুনের শেষ পর্যন্ত। এই সময়টুকুতে সালকী বিল কেবল মাছমারুয়াদের বাড়িঘর। আশপাশের গাঁগুলোর মাছমারুয়ারা দিন-রাত মাছ ধরতে পড়ে থাকে। লম্বা লম্বা বাঁশের খুঁটির ওপর তারা টঙ বানায়। টঙের ওপর কুঁড়ে। সেই কুঁড়েয় তাদের দিন কাটে। রাত কাটে। বাড়িতে বৌ, ছেলে, মেয়ে পথ চেয়ে বসে থাকে তাদের। কখন তারা ফিরবে। কখন আবার কাছে পাবে কাছের মানুষটাকে।
সুধনও একজন মাছমারুয়া। তবে তার জন্যে কেউ পথ চেয়ে বসে থাকে না। না, কথাটা ঠিক নয়। একজন অবশ্য থাকে। সে সুধনের মা বিন্তিবালা। বিন্তিবালার বয়স হয়েছে। ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া শরীরে বার্ধক্যের আঁচ। হাঁটতে চলতে কোঁকায় বুড়ি। আর গালমন্দ করে। কারও নাম ধরে কিছু বলে না বটে, তবে যে জানে সে ঠিকই বুঝে যায়। সুধন বেরিয়ে গেলে সারা বাড়িতে বুড়ি একা। ব্যাকাটে শরীর নিয়ে সে বাড়িঘর সামলায়। উঠোন ঝাঁটায়। কলতলায় নিয়ে গিয়ে এঁটো বাসনপত্র মাজে। হাঁস-মুরগির খাঁচায় দোর দেয়। রান্নাবান্না করে। তারপর একসময় মেটো দাওয়ায় ছেঁড়াফাটা খেজুর পাতার মাদুরটা পেতে বসে সুধনের পথ চেয়ে থাকে। এই জগৎসংসারে আপনজন বলতে তার ওই একজনই―সুধন। বাপ মরা ছেলেটাকে কোলে কাঁখে করে মানুষ করেছে একা বিন্তিবালা। সখ করে একটা বিয়েও দিয়েছিল ছেলের। অথচ―
বুড়ি বারবারই সুধনকে বলে, ‘সুধো, বাপ আমার, আমার কথাডা শোন। আরেট্টা বে কর। আর যে পারি নে।’
তা সুধন বুড়ির কথা কানেই দেয় না। বলে, ‘বে তো এট্টা করলাম। তা লাভ কী হলো ?’
বুড়ি মাথা ঝাঁকায়। বলে, ‘ওরে লাভ-লোসকানের কথা না রে। কথা হলো সোংসারের। বৌ না থাকলি কি সোংসার হয় ?’
সুধন এ কথার উত্তর দেয় না। সে তখন আকাশ দ্যাখে। আকাশের মেঘ দ্যাখে। উড়াল দেওয়া পাখি দ্যাখে। আর যেন শেফালির মুখটাও দ্যাখে।
হ্যাঁ, মাঝেমধ্যেই আকাশের গায়ে ভেসে থাকা ফালি মেঘের গায়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে শেফালির মুখ। সেই ঠোঁট। সেই চোখ। সেই হাসি। ওই হাসি দেখেই তো শেফালিকে মনে ধরেছিল তার। নারান ঘটককে একপাশে ডেকে নিয়ে বলেছিল, ‘মেইয়ে আমার পছন্দ খুড়ো। কোনও দেনাপাওনা চাই নে। কেবল মেইয়ে চাই। তুমি ব্যবস্থা করো।’
তা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল ঘটক। মেয়ের বাপকে ডেকে বলেছিল, ‘ছোট্ট সোংসার। এক বুড়ি মা আর ছেল্যে। মেইয়ে তুমার সুখিই থাকপে।’
মেয়ের বাপ হরিহর মিস্ত্রী। সামান্য অমত করেছিল প্রথম প্রথম, ‘কিন্তুক ছেল্যে যে ভূতির মতন কালা। তায় আবার ছটাক জমিও নাই মাঠে। প্যাট চলবে কেমুন কইরে ?’
‘কী যে কথা কও। জমি ? জমি দে কী হবে ? বাড়ির পাশে কত বড় বিল। সারা বচ্ছর জলে মাছে সুমান। খালি ধরো আর বেচো। ছেল্যের গায় গতরেও কিছু কম নাই। গতর খাটালি ট্যাকার অভাব ?’
শেষমেষ বিয়েটা হয়েই গিয়েছিল সুধনের। বাপ-মায়ের একমাত্র মেয়ে। সুধনও একা। মিলেছিল বেশ। সুখ যেন উপচে পড়ছিল সংসারে। দিনরাত মাছ ধরতো সুধন। বৌ সামলাতো বাড়িঘর। সে ছাগল পুষতো। হাঁস-মুরগি পুষতো। উঠান ঝাঁটাতো। রান্না করত। বাড়িঘর লেপে পুছে পরিষ্কার রাখত।
এক-একদিন ঘরের দাওয়ায় পাশাপাশি বসে আকাশ দেখতে দেখতে সুধন বলত, ‘বড় ভাগ্য কইরে তুমারে পাইছি।’
আকাশের দিক থেকে চোখ নামিয়ে সুধনের দিকে তাকাতো শেফালি, ‘তাই ?’
হ।
তুমি আমারে খুব ভালোবাসো, না ?
বাসি তো।
সারাক্ষণ তাহলি একা একা বিলি গে থাও ক্যামনে ?
না থেক্যে কী করব কও ? প্যাটের চিন্তে বড় চিন্তে। আগে তো তারে সামলাতি হবে। তারপর―
তখন হয়তো শেষ বিকেলের মরে আসা আলো আকাশের গা বেয়ে নেমে আসছে সুধনের বাড়ির উঠোনে। উঠানজুড়ে তখন হিমসাগর আমগাছের ছায়ার দখল। ঝিঁঝিঁ ডাকতে শুরু করেছে। খাঁচার চারপাশে ঘুর ঘুর করছে হাঁস-মুরগির ঝাঁক। ছাগলগুলো আনা হয়ে গেছে আগেই। উঠান ঝাঁটানোও শেষ। এখন কেবল তুলসিতলায় প্রদীপ জ্বালার অপেক্ষা।
ফের একবার আকাশের দিকে তাকাতো শেফালি। সেই আকাশ জুড়ে তখন দিন শেষের স্পষ্ট ইশারা। একটু পরেই কালো আঁধারের আড়ালে হারিয়ে যাবে আকাশ। ভেসে উঠবে তারাদের ঝাঁক। এক হাতে চার্জার টর্চ অন্য হাতে আ্যনামেলের হাঁড়ি ঝুলিয়ে বেরিয়ে যাবে সুধন। তারপর শেফালির চারপাশে কেবলই নিঃসঙ্গতা। কেবলই একাকিত্ব।
তবু দিনগুলো ভালোই কাটছিল সুধনের। সে মাছ ধরত। সেই মাছ নিয়ে সে যেত মেটের বাজারে। তা বেচে কিনে আনত চাল, ডাল, তেল, নুন, আটা।
সুধনের সুখ দেখে হিংসেও করত কেউ কেউ। বলত, ‘কি রে সুধন, বেশ তো আছিস।’
পাশ থেকে কেউ বলত, ‘ঘরে অমন সুন্দরী বৌ থাকলি সবাই ভালো থায়ে। আমাগের সুন্দরী বৌও নাই, ভালোও থায়ি নে।’
দাঁত বের করে হাসতো সুধন। বলতো, ‘কী যে কথা কস না তুরা। তোগের ঘরেও তো― ’
না, কথাটা শেষ করত না সুধন। বলা যায় শেষ করতে পারত না। তার আগেই কেউ বলে ফেলত, ‘থাক, থাক, আর কস নে।’
এসব কথা আজকাল বড় বেশি করে মনে পড়ে সুধনের। তার একলা থাকার সুযোগ নিয়ে বার বার ফিরে আসে তারা। এসে সুধনকে খোঁচায়। রক্তাক্ত করে। সুধন তখন আকাশ দ্যাখে। বুকের ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাসটাকে টেনে এনে বাইরে বের করে দেয়। তাতে বুকটা হালকা হয় কিনা সে বোঝে না। কিন্তু একটু যেন ভালোলাগা অনুভব করে তখন।
আজও এমনটাই হয়েছিল। সন্ধেটা তখন সবেই উতরেছে। হাওয়ায় তখনও মিশে আছে হালকা একটা ধুনোর গন্ধ। উলু-শাঁখের আওয়াজ অবশ্য থেমে গেছে। তবে একটানা ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের ডাকে চারপাশ মুখর। বিকেলে বেশ একচোট বৃষ্টি হয়ে গেছে। চারপাশে জল, কাদা। ঝিঁঝিঁ, ব্যাঙের ডাক। মশার গুনগুন। পুবের দিক থেকে হালকা একটা হাওয়াও বইছিল। যার গায়ে ছিল জলজ একটা গন্ধ। সালকী বিলের বুক ছুঁয়ে বয়ে আসছিল হাওয়াটা।
মেটো দাওয়ায় আধ ছেঁড়া খেজুর পাতার মাদুরে বসে পিঠটাকে বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বাইরেটাকে দেখছিল সুধন। কৃষ্ণপক্ষের রাত। আঠালো একটা আঁধারে মাখামাখি চারপাশ। উঠোনের ওপাশের হিমসাগর আমের গাছটাকেও তেমন চোখে পড়ে না। তবে তার পাতায় জমা জল ‘টুপ টুপ’ শব্দে ঝরে পড়া বেশ টের পাওয়া যাচ্ছিলো। সেই গাছের পাশ দিয়ে আরও একটু দূরের কচুবনটার দিকে তাকিয়ে আরও একবার স্পষ্টই যেন দেখতে পেয়েছিল শেফালির মুখটা। এমন বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় সকাল সকাল রান্নাবান্না সেরে এসে দাওয়ায় সুধনের পাশেই বসত সে। তারপর কত সোহাগের কথা। কত স্বপ্ন বুনন।
বৌয়ের কথাটা মনে পড়ে বুকের ভেতরে হঠাৎই একটা তোলপাড় উঠেছিল সুধনের। আড়চোখে একবার তাকিয়েছিল রান্নাঘরটার দিকে। ঠিক রান্নাঘর নয়। শোওয়ার ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছোট একখানি একচালা। কেরোসিনের কুপি জ্বেলে রান্না বসিয়েছে বিন্তিবালা। বয়েস হয়েছে বুড়ির। এত সব ঝক্কি তার গতরে সয় না। তবু দায়ে পড়ে সওয়াতে হয়। কাঠের উনুনে আধভেজা শুকনো আমের ডাল ঠেলতে ঠেলতে তার চোখেমুখে স্পষ্ট হয়ে উঠছে অসহায়ত্বের ছাপ। তা দেখেও একটা কষ্ট কোথায় যেন ঠেলা মেরে উঠেছিল। মনে হয়েছিল না, বিয়েটা এবার করেই নেবে সুধন। তাতে মা অন্তত সুখ পাবে।
ভাবতে গিয়েই শেফালির মুখটা ফের একবার মনে পড়ে গিয়েছিল সুধনের। ওই মুখের দিকে তাকিয়েই একদিন জগৎ দেখতো সুধন। মনে হতো পৃথিবীর সব রূপ যেন ওখানেই মিশে আছে। কী করে ভুলে যাবে সেই মুখটাকে ?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিড়ি ধরিয়েছিল সুধন। পেটে ধোঁয়া পড়তেই বাস্তবে ফিরে এসেছিল। মনে পড়ে গিয়েছিল বিলে যাওয়ার কথা। সালকী বিলের বুক ছাপিয়ে জল উঠে এসেছে ডাঙায়। সারি সারি আমনের খেত সেখানে। বিকেলে যখন ঘুনি পেতেছিল সুধন জল তখনও বিঘৎ ছাড়ায়নি। মরালী খালের সোঁতা সেই সব ধানখেতের ভেতর দিয়ে বইছিল। জায়গায় জায়গায় আল কেটে ঘুনি বসিয়েছিল সুধন। না, কেবল ঘুনি নয়। আটলও পেতেছে খান দশেক। যা বৃষ্টি নেমেছে সারাদিন আর যেভাবে সোঁতা বইছে তাতে মাছ আজ ভালোই পড়বে।
দাওয়ার একপাশে গুছিয়ে রাখা হাঁড়িটার দিকে আড়চোখে তাকিয়েছিল সুধন। কত বছরের সঙ্গী অ্যানামেলের হাঁড়িটা। ওই হাঁড়িতে করেই মাছ ধরে আনে সে। আবার ওই হাঁড়িতে করেই সেই মাছ নিয়ে যায় বাজারে। শেফালির হাতের কত ছোঁয়া মিশে আছে হাঁড়িটার গায়ে। কাছে নাক নিয়ে বুক ভরে শ্বাস টানলে আজও ঠিক তার গায়ের গন্ধ পাওয়া যাবে।
বসেই ছিল সুধন। সন্ধে উতরে রাত গাঢ় হচ্ছিল একটু একটু করে। আঠালো আঁধারের মাঝে ফিরে আসছিল চোখ সওয়া একটা ভাব। তবে আকাশের মেঘ ফের যেন গাঢ় হতে শুরু করেছিল। আর পুব-দক্ষিণের দিক থেকে বয়ে আসা হাওয়াটাও হয়ে উঠছিল আরও একটু জোরালো। আরও একটু হিমেল। চারপাশে একটা আঁশটে গন্ধ টের পাচ্ছিলো সুধন। এই গন্ধটা তাকে বড় টানে। টেনে আনে সালকী বিলের বুকে।
আজও ঠিক তেমনি করেই গন্ধটা টেনে এনেছে সুধনকে। সে এখন সালকী বিলে খোলা আকাশের নিচে এক মাথা আঁধারকে সঙ্গে নিয়ে মাছ ধরছে। না, ঠিক ধরছে না, ধরা মাছ হাঁড়িতে নামাচ্ছে। বিকেলে সে বাইশটা ঘুনি, খান দশেক আটল আর পনেরো গাছি জাল পেতে রেখেছিল। জলের সোঁতা বেয়ে বিল থেকে মাছ উঠছে সার দিয়ে। আর চলতে চলতে কখন তারা ঢুকে পড়ছে ঘুনি, আটলের মধ্যে। জালের ফাঁসে মাথা গলিয়ে দিয়ে কেউ কেউ আবার আধমরা হয়ে পড়ে আছে। ঘুনি, আটল ঝেড়ে সে সব মাছ হাঁড়িতে তুলছে সুধন। জালের কাছে যাবে সব শেষে। কারণ সেগুলো আরও একটু বেশি জলে পাতা।
মাথার ওপরে বড় একখানি আকাশ। তবে তার সবটাই এখন মেঘ আর আঁধারে ঢাকা। চাঁদ কিংবা তারাদের অস্তিত্ব কোথাও নেই। থেকে থেকে এক দুফোটা বৃষ্টিও পড়ছে। চারপাশে জলপোকাদের বিচিত্র ডাকাডাকি। কান পেতে খানিক সেগুলো শুনলো সুধন। তারপর ফের মন দিল ঘুনি ঝাড়ায়।
বেজায় মাছ পড়েছে ঘুনিতে। খলসে, পুঁটি, চুঁচড়ো, চাঁদা, ছোট বেলে, ট্যাংরা। আরও কত রকমের মাছ। আঁধারে যদিও ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না সুধন তবু বেজায় খুশি আজ সে। এমন মাছ পড়লে কদিনেই বেশকিছু টাকা জমবে হাতে। আর তাহলে মায়ের কথামতো―
বিয়ের কথা মনে পড়তেই মনটা ফের কেমন হয়ে গেল। শেফালির মুখটা মনে পড়ে গেল সুধনের। ওই মুখের দিকে এখন অন্য একজন মানুষ―
একঢেলা কষ্ট বুকের ভেতর ঠেলে উঠলে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালো সুধন। আর তক্ষুনি খানিক তফাতে অস্তিত্ব টের পেল তার। তার মানে রাতচরা সেই মেছোবকটার। সে নিত্যদিন এমন রাতে সালকী বিলে সঙ্গ দেয় সুধনকে। আসলে সে বক নয়। তবে বকের মতই দেখতে। আর এরা দিনে নয়, রাতে মাছ ধরে খায় আর সারাদিন ঘুমোয়। গাঁ-গেরামের লোকেরা এদের বলে ‘রাতচরা মেছোবক’। সুধনও তাই বলে। তবে একটা অন্য নামও আছে পাখিটার। ‘অক’ পাখি। কিন্তু সুধন বলে ‘রাতচরা মেছোবক’। বকটা কখন এসেছে কিছু টের পায়নি সুধন। হয়তো সুধনের আগেই এসেছে। এতক্ষণে আচমকা তার ঈষৎ ডানা ঝাপটানোর আওয়াজে সুধন তার উপস্থিতি টের পেল। ঘাড় উঁচু করে দেখার চেষ্টা করল তাকে। একরাশ কালো আঁধার ছাড়া চোখে পড়ল না কিছুই।
এমন ভরা ভাদর রাতে সালকী বিলের বুকে এমন একাকী থাকতে ভালো লাগে না কারওরই। তবে সুধনের ব্যাপার আলাদা। তার দিনও যা, রাতও তাই। বলতে গেলে সে তো একলাই মানুষ। বৌ যতদিন ছিল তখন একটু কেমন কেমন লাগত। এখন আর লাগে না। বরং সালকী বিলের খোলা বুক, জলজ গন্ধ, জলা ঘাস-আগাছা, আকাশের তারা, চাঁদ, ফালি মেঘ―এদের সঙ্গে থাকতে বেশ লাগে তার। একরাশ নৈঃশব্দ্যের মাঝেও কত কথা শুনতে পায় সে। আকাশ কথা বলে। চাঁদ-তারারা কথা বলে। কথা বলে ঘাস-আগাছা, ফালি মেঘ, রাতের আঁধার, জলজ গন্ধরাও। আর বিচিত্র সব জলপোকাদের বিচিত্র সব কথা তো আছেই। সব কথা শুনতে পায় সুধন। সমস্যা কি একা সুধনের ? না, ওদেরও কত সমস্যা। কত অভাব অভিযোগ।
সুধন কেবল শোনে। বলে না কিছুই। সে বলে কেবল ‘রাতচরা মেছোবক’টার সঙ্গেই। কারণ এই একজনই সুধনকে বোঝে। সুধনের কষ্টটা ভাগ করে নেয়। আজও সে এতক্ষণে মুখ খুললো তাই, ‘কহন আলে ?’
ওপাশে ক্ষণিক নীরবতা। তারপর উত্তর এল, ‘সে কী আর অহনের কথা। তুমি তহন আসোও নাই।’
তাই ?
বাড়িৎ তুমার এত কী কাজ, কও তো ?
কী করব কও ? চাড্ডি খাইয়ে আসতি হবে তো।
তাই তো। তাই তো।
এটুকু বলেই থেমে গেল ‘রাতচরা মেছোবক’। মাথার ওপরে আকাশটা আরও বেশি যেন কালো হয়ে এসেছে। সালকী বিলের বুকজুড়ে বইতে থাকা পুবালি হাওয়ায় আসন্ন বৃষ্টির ইশারা। ‘আসুক। আরও জোরে আসুক। ভাসায়ে দিক সালকী বিলির বুক। তার গভ্ভে জম্ম নিক কোটি কোটি মাছ। তারা আসুক আমার ঘুনি, আটলের মধ্যি।’ ভাবলো সুধন। ভাবতে গিয়ে ‘রাতচরা মেছোবক’- এর সঙ্গে কথা বলতে ভুলেই গিয়েছিল সে। এতক্ষণে সে কথা মনে পড়তেই ফের গলা তুললো, ‘তা তুমার কি মন খারাপ ?’
ওপাশে যেন দীর্ঘশ্বাস পতনের শব্দ হল। ‘রাতচরা মেছোবক’ উত্তর দিল, ‘সে আর নতুন কি। মন তো আমার সারাক্ষণই খারাপ।’
ক্যান ?
তুমি তো সপই জানো।
তাই তো। তাই তো। তা মন অবশ্যি আমারও খারাপ।
আমরা দুইজন কত দুর্ভাগা কও। ঘর আছে, ঘরনী নাই। জেবন আছে, সোংসার নাই।
আমারডা না হয় বেশি ট্যাকার লোভে পলায়ে গেছে। কিন্তুক তুমার ?
বেশি রূপ। বেশি মাছ।
আচমকা ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। জলজ গন্ধটা তীব্র হয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। মুহূর্তে ভিজে গেল সুধনের গায়ের জামা। পরনের লুঙি। ভিজে চুল থেকে নাক, চোখ গড়িয়ে নামতে লাগলো জলের ধারা। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে পাল্লা দিশে বেড়ে গেল জলপোকাদের ডাকাডাকি। ‘রাতচরা মেছোবক’ টা কিছু বললো কি ? শুনতে পেল না সুধন। তার কেমন শীত শীত লাগছে। মাথায় টোকাটা নিয়ে এলে বেশ হতো।
কোমরে হাত দিল সুধন। লুঙির গিঁটে রাখা দেশলাইটা এরই মধ্যে ভিজে নেতিয়ে গেছে। একটা টাকা পুরোপুরি গেল। নতুন দেশলাই।বিকেলেই সনাতনের দোকান থেকে কেনা। তবু ভালো বিড়িগুলো বেঁচে যাবে। প্যাকেট চ্যুইয়ে জল ঢুকবে না তাতে।
বিড়ির কথা ভাবতে গিয়ে বড্ডো ধোঁয়ার তেষ্টা পেয়ে গেল তার। কিন্তু উপায় নেই। যতক্ষণ বাড়ি না যাচ্ছে বিড়ি না খেয়েই থাকতে হবে তার। অগত্যা দাঁড়িয়ে না থেকে ঘুনি ঝাড়ায় মন দিল সে।
খানিক পরেই অবশ্য বৃষ্টিটা কমে এল। ততক্ষণে সুধনের ঘুনি ঝাড়া শেষ। এবারে আটল ধরতে হবে। জলের মধ্যে ছপ ছপ আওয়াজ তুলে পাশের আলে গিয়ে দাঁড়াল একবার। ‘রাতচরা মেছোবক’টার থেকে দূরত্ব এখন তার অনেকটাই কম, তবু একটু জোরেই গলা চড়ালো সে, ‘আছ নেকি ?’
রাতচরা মেছোবক উত্তর দিল, ‘আছি তো।’
সুধন বলল, ‘কেমুন এট্টা বিষ্টি হইয়ে গেল দ্যাহো তো। ভিজে চাপুর চুপুর হইয়ে গেলাম।’
তাতে কি ?
যদি জ্বর টর আসে।
তুমি হল্যে জলের মানুষ। মাছমারুয়া। তুমার আমার জ্বর কী ?
তাই তো। তাই তো।
বলতে বলতেই একবার আকাশের দিকে তাকালো সুধন। সেখানে মেঘ ঈষৎ পাতলা হতে শুরু করেছে। একটা ফর্সাটে ভাব চারপাশে ফুটে উঠছে তাই। সালকী বিলের বুক জুড়ে বইতে থাকা হাওয়ায় জলজ গন্ধের মাখামাখি। বুক ভরে শ্বাস টানলো সুধন। ওপাশ থেকে ‘রাতচরা মেছোবক’ ডাকলো, ‘শোনছো ?’
সুধন উত্তর দিল, শুনি তো। কও
অনেক দিন ধইরে তুমারে এট্টা কথা কবো ভাবি। তা সাহস পাই নে।
ভয় কী ? কও।
কদ্দিন আর একা একা থাকপা ? ইবার এট্টা বে করো। ফের এট্টা সোংসার হোক তুমার।
আর তুমি ?
আমি হলাম উড়াল পক্ষী। আমার আবার সোংসার কী ?
কিন্তুক―
না গো মাছমারুয়া, নতুন কইরে আর সোংসারের মায়ায় জড়াতি চাই নে। কদিনির বা জেবন আমার। আজ আছি, কাল নাই। কিন্তুক তুমার সামনে অনেক সুমায়। অনেক পথ চলতি হবে তুমার। একজন সঙ্গী না থাকলি অ্যাতোখানি পথ―
তাই তো। তাই তো।
আমি কী খারাপ কিছু কলাম ?
না গো, কথা তুমি মন্দ কও নাই। আসলে তুমার মতো কইরে ভাবি নেই তো কুনোদিন।
ইবার তাহলি―
কিছু একটা বললো ‘রাতচরা মেছোবক’। তা আর শুনতে পেল না সুধন। তার আগেই একটা অন্য রকমের ভাবনা এসে ঘিরে ধরল তাকে। দুই চোখে ভেসে উঠল না দেখা নতুন একজন মেয়েমানুষের মুখ। আলতা রাঙা পা। কপালজোড়া সিঁদুর টিপ। লালপেড়ে শাড়ি। আরও ভেসে উঠল নতুন করে সেজে ওঠা তার বাড়িঘর। তার সংসার। নিকানো উঠোন। মাটির দাওয়া। তুলসিতলায় জ্বলে ওঠা সাঁঝপ্রদীপ।
ভীষণ রকমের একটা ভালোলাগার ঘোর তাকে জড়িয়ে ধরতে সুধন ডাকলো, ‘শোনছো ?’
কোনও সাড়া এল না।
সুধন ফের ডাকলো, ‘শোনছো ?’
তবু সাড়া নেই
ফের ডাকলো সুধন।
ফের একবার।
না, এতটুকু মন খারাপি হলো না সুধনের। কারণ সে জানে ‘রাতচরা মেছোবক’ বলে কেউ আসলে কোনওদিন ছিলই না।
সচিত্রকরণ : রজত