আর্কাইভকবিতা

কবিতা

শংকর চক্রবর্তী

ভয়ের মতন

রাস্তার বিশাল ভয় স্বস্তি যে দেয় না বুঝে গেছ

ছল-প্ররোচনা নয়―নিশ্চিত ছিল না সত্যিই তবু

ভয়ের কুটোটি না নেড়েই

পেরিয়ে গিয়েছো দুটো নুনসাম্রাজ্যের সরু নড়বড়ে সাঁকো

নুন বাবুদের ঘরে একফালি বোঝাপড়া হতো ঘন ঘন―

শরৎকালীন ওই চাঁদপানা মুখ জানে কী সুন্দর শুতে হয়

                                                   নদীটির চরে

নয়ন-ভোলানো হাত-ঝাড়ু নিয়ে আজও বেশ তেজি

পাওনা মাশুল পেতে ছুটে চলে রাস্তায় রাস্তায়

ভরদুপুরের রোদও যদি না আগুন ছুড়ে দিলে

মুখ ঢেকে নিয়ো লজ্জা ভিজিয়ে এবার

                              নাকের নথটি খোলামেলা

ডালিমদানার মতো লোভ এসে চুপচাপ যেন কখনওই

না দাঁড়ায় জানালায় ঢোল বাজানোর আর্তনাদে।


হাসান হাফিজ

কেউ ছিল না, নাই

আনন্দ নয় বিষাদ খরিদ করি

অর্থকড়ি যা সমুদয় ছিল

খরচা করে নিঃস্ব বনে যাই

দৃশ্যত হই অবিমৃষ্য

                    একলা এবং

                   পরিত্যক্ত নাচার

ইচ্ছা তো নাই

উপেক্ষা ও তাচ্ছিল্যের

                        শিকার হতে

                       এই বিকারের

চাই অবসান

চাই

মরণ কেন দূরের গ্রহ

তার কান্ধে সওয়ার হওয়ার

আগাম সুযোগ নাই

আগাম জামিন পাওয়ার মতো

জীবন মানেই এবংপ্রকার

                  অস্থিতি আর আলো

                   ঘনায়মান মূর্ত আঁধার কালো

এই সমস্ত খরিদ করি খুচরা দামে

              সঞ্চয়ে নাই আলগা-উতল মন

তিনভুবনে কেউ কি আছে?

জরিপ করে জানতে পারি

উপসংহার টানতে পারি

ছিল না কেউ আত্মআপনজন!


ফারুক নওয়াজ

সন্ধ্যার বিষাদগাথা

সাঁঝশেষে কিছু পাখি ফেরে না কখনওই

পালকের স্মৃতি নিয়ে পড়ে থাকে শূন্য নীড়খানা

না-ফেরা পাখিদের শবযাত্রা বয়ে নিয়ে

নিশি-হাওয়া ছড়ায় কী বিষাদের মায়া!

গেঁয়োনদী কাঁদে একা ঘুম গেলে জলবিহগেরা

অশ্রু হয়ে টুবুটুবু ঘোলাঢেউ ছুঁয়ে যায় পাড়;

ধূসর মেঘের ভাঁজে দোল খায় ফাল্গুনের চাঁদ

নির্ঝরের স্মৃতি বুকে হাহাকার করে ওঠে

নিশীথের শুষ্ক পাহাড়।

বিষাদে বিষণ্নে ভরা পৃথিবীর সাঁঝের প্রকৃতি

মনে হয় হাওয়া বুঝি বয়ে আনে

আসন্ন শোকসভার আগাম খবর…


গোলাম কিবরিয়া পিনু

চন্দ্রাবলী  

চন্দ্রাবলী!

     তুমি কোন চাঁদের আলো ?

অক্ষিগোচরে আসার পরপরই

মালিন্য ও মলিনতা থাকে না

             ―আমারও!

আমি তো ছোট এক বাগানের

          নামগোত্রহীন মালি!

ফুলের সৌন্দর্যে

          আমিও নমনীয় হয়ে

আমার শ্রম ও কষ্ট ঢেলে দিই।

তোমার কান্তিময় মুখটা উঁকি দেয়

       বাগানের অন্ধকারে যখন,

তখন আমিসহ বাগানের ফুলগুলো

           রূপবান হয়ে উঠি! 

তোমার লাবণ্য ও সুষমা নিয়ে

আমাদের রংচটা জীবনটা

      খানিকটা হলেও

                  বর্ণময় হয়ে ওঠে! 

তোমার সখ্য দিনের বেলায় না পেলেও

গ্লানিমাখা দিনের শেষে

            রাতের বেলায়,

দুঃখললাটে সুন্দরতা মেখে দেয়!


মুস্তফা হাবীব

কবিতার মতো

সবাই বাঁচতে চায়, সাজতে চায়

কখনও নদীর মতো,

কখনও বসন্তের পাতা ও ফুলের মতো।

অতিমাত্রায় জাগতিক যারা

রাজপ্রাসাদ চায়, সবুজ মখমল মাড়িয়ে

আশপাশের মানুষ ছেড়ে

হাওয়ায় ভেসে ভেসে পেতে চায় স্বর্গীয় নীলিমা।

এতকিছু চাইনি,  চেয়েছি …

 পরিমিত বোধের বিচারে যারা খাঁটি মানুষ

তাদের অমিয় ভালোবাসা,

ভোরের বাতাসের মতো সুশীতল পথ;

         কবিতার মতো অনুপম জীবন―আঙিনা।


রওনক আফরোজ

এই শহর

আমারই শহরে আমি এক পরিযায়ী পাখি

পথের দুপাশে ধুলোঢাকা আধোচেনা গাছ,

নীল নীল উদ্বেল আকাশ; সেখানে ওড়ে সবুজ সবুজ ইচ্ছের ঘুড়ি।

ঝিরঝির সজনে ফুল, উচ্চকিত আমের মঞ্জরী।

এ শহরে আপন ইচ্ছেয় ওঠে বেখেয়ালি চাঁদ,

পথকুকুরের ডাকে খানখান ভেঙে যায় সেবক রাত।

চারিদিকে ছড়ানো বাতিল ইচ্ছে সব, স্মৃতি অগণন,

কত চেনা গলিঘুচি, মানুষ; সব অচেনা এখন।

এ শহরে সন্ধ্যা যেন প্রেমিকার পলাতক দৃষ্টি,

ব্যাকুল, খুঁজি তাকে নাগরিক আলোর মিনাবাজারে;

খোলা জানালায় নস্টালজিয়ার অবিরাম ঘণ্টা,

টানটান সেতারের তার কটি ছিঁড়ে যায় বারেবারে।

কতদিন হয়ে গেল এ শহরে;

কী হবেÑএই ভেবে খুঁজি না অস্পৃশ্য অতীত,

বারবার ফিরে আসা মেঘভাঙা রোদের ডাকে

ডেজা ভ্যুর ঘোরে ব্যস্ত বিভ্রান্ত থাকি,

তবু এই শহরের হাতে আমি পরিয়েছি রাখী।


স্বপন নাথ

স্মৃতির ছায়া

খেতখামারই আঁতুড়ঘর

উদ্বাস্তু নগরে, উন্নাসিক

খেতের কিনার ধরে হেঁটে যাই 

কাদামাটি আর ধুলোর মাখামাখি

স্বর-ব্যঞ্জন পাঠ, দিঘির কালোজলে

হৈচৈ কাল, শাপলাজলের শৈশবে

মনে পড়ে―পদ্মপাতায় ঝিলিমিল

নাগিণীকন্যার প্রেমকথা, আজও

পসরা নিয়ে চলে পদ্মাপুরাণ গানে

ধীরে মুছে যায় অনাহূত ঠোক্করে 

কখনও দোল খায় তাপদগ্ধ ঝুলনে;

জ্বলো অন্ত্যস্বরে, বলো―কেবলই মায়া

দহন জাগা দিঘি জলে চুম্বনের ছায়া।


মিজানুর রহমান কল্লোল

আসুন আমরা ক্রন্দন করি

(উৎসর্গ-ফিলিস্তিনি শিশুদের জন্য)

আসুন,আমরা বৃষ্টির জন্য ক্রন্দন করি

যে বৃষ্টি এখন আর পৃথিবীতে নামে না

আমরা ভালোবাসার জন্য ক্রন্দন করি

যে ভালোবাসাকে অপহরণ করা হয়েছে

সৃষ্টির শুরু থেকে

আমরা একজন শিক্ষকের জন্য ক্রন্দন করি

যে শিক্ষক আমাদের আলোর পথ

দেখাতেন সর্বদা।

একদা আমরা ক্রন্দন করেছিলাম গহিন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে একটা পথ আবিষ্কারের জন্য

আমরা ক্রন্দন করেছিলাম এক টুকরো রুটির জন্য

এবং একটা স্বাধীনতার জন্য

ক্রন্দন করেছিলাম আকাশের সমস্ত নীল একটা দোয়াতে ভরে দেওয়ালে রঙিন পোস্টার লেখার জন্য।

আসুন, আমরা জীবনের জন্য ক্রন্দন করি

অঙ্কুরিত বীজের জন্য ক্রন্দন করি

মৃত্যুকে মুছে ফেলার জন্য ক্রন্দন করি

আমরা একজন সৈনিকের জন্য ক্রন্দন করি।

আমরা তো জানি বড় অদ্ভুত সময়ে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে

আমাদের নারীদের হত্যা করা হয়েছে

হত্যা করা হয়েছে আমাদের স্বপ্ন এবং স্বপ্নের অধিক বাস্তবতাকে

আসুন, আমরা সবুজ এক গ্রহের জন্য ক্রন্দন করি

আমরা মানবতার জন্য ক্রন্দন করি

আমরা সাফল্যের জন্য ক্রন্দন করি।

মূলত এখন এমন এক সময় যখন হৃৎপিণ্ড ছাড়াই মানুষ মানুষের পরিচয় বহন করে

বৃক্ষের ডালে রোপণ করে হিংস্রতা আর খুনের বীজ

কারণে অকারণে মরে যায় আর জীবিত হয়

আর বেঁচে থাকে জীবন্মৃত হয়ে

এক অন্ধকার জগতে।

আসুন, আমরা এক প্রশস্ত নদীর জন্য ক্রন্দন করি

নিরপরাধ ফাঁসির আসামির মুক্তির দাবিতে ক্রন্দন করি

আমরা আমাদের স্বদেশের জন্য ক্রন্দন করি

বিপন্ন মানুষের জন্য ক্রন্দন করি

আমরা আমাদের স্ত্রী ও শিশুদের জন্য ক্রন্দন করি।


রবীন বসু

নিরাময় প্রয়োজন

উদ্ভট এই আবহে কুঁজো হয়ে বসে থাকি

আমার মেরুদণ্ড বাঁকা, হাড়ে ঘুণ ধরে গেছে

হৃদয়ে ক্ষত, পুঁজ জমে আছে ঢের…

তাহলে কি গ্যাংগ্রিন হয়ে গেল ? দুর্গন্ধযুক্ত

ব্যাকটেরিয়া বেড়ে গেছে! আমার মৃত্যু আসন্ন!

সন্ধ্যায় বাংলা কবিতা আমার ঘরে এল

কিছুটা পরিহাসের ভঙ্গিতে বলল, ‘কী ব্যাপার

কবিমশাই, আপনার তো আমার দশা!

হাঁটুভাঙা দ! এই যে সর্বাত্মক সংক্রমণ

শরীর মনে অসম্ভব খিঁচুনি, আশার আলো নেই

তাই এলাম, কিছুটা আলোচনা হোক!’

আমি চেয়ে আছি অসহায়! অ্যান্টিবায়োটিক

কাজ করছে না, টিস্যু পাতলা হচ্ছে ক্রমশ…

‘এবার আপনাকে অপারেশন করে নতুন টিস্যু

প্রতিস্থাপন করতে হবে! বেঁচে যেতে পারেন।’

যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে কবিতাকে বলি, ‘সে তো

অনেক টাকার ব্যাপার! ভালো সার্জেন চাই!’

‘সে দেখা যাবে। এখন তো চলুন―’ খুঁজে দেখি,

যদি কোনো মহানুভব সার্জেনের দেখা পাই!

                        আমাদের নিরাময় প্রয়োজন!


আদ্যনাথ ঘোষ

ঈশ্বরের বাগান

             ঈশ্বরের বাগানের চেনা পাঠ ভুলে

               ক্ষুধার পৃথিবী নিয়ে ধেয়ে চলা দীর্ণ পাখি;

জ্বলন্ত ধুপবাতির বিষণ্ন বুকে

                                             অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে

               নিয়তির তল ছুঁয়ে

               সেই দীর্ণ ক্ষুধাযুক্ত পাখি

বসে পড়ে উঠানের কোণে।

যেন এক বুক সন্দেহের ধোঁয়া তুলে

মানুষের ইতিহাস পাঠ না করেই

শায়িত মাঠের শেষ পোড়াদহে

উত্তর না জেনেই এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে

ভুলেরই কাঠগড়ায়।

আমি তাকে যাই ভাবি

ভীষণ অন্ধকারের ছেড়ে আসা ঘোরের ভেতর

কী এক বিষণ্ন ক্ষুধা পেয়ে ধেয়ে আসে

বুকের পাঁজর ছুঁয়ে

ফেলে আসা দিনের পুষে রাখা জখম।

কেউ কেউ ভুলে যায় সেইসব দীর্ঘশ^াস

কেউ আবার তুলেই রাখে না বলা আঘাত

প্রতিঘাতে দিয়ে যাবে ভেবে।

এত সব না বলা কথার ধূসর আকাশ

ফিরে আসে শীতার্ত শিশিরের

নির্ঘুম রাতের সাথে

ঈশ^রের বাগানের সেই সব চেনা পাঠ ভুলে

নিয়তির জখম ছেড়েই।


নিলয় রফিক

কালের শিরায়

আপেল মুখ নজরে, মাতাল তরঙ্গ পাড় ভাঙে

বাতাস ঘুমের ঘোরে ন্যায়ঘরে মিথ্যার ফুলকি

ছায়ার ভেতর তাপ পরিবেশ উত্তপ্ত আবর্ত

বিদ্যুতের অনাচারে বৃক্ষশোভা মোমের তরল।

কদমফুলে বৃষ্টির জপমালা স্মৃতিজলে গান

সুন্দর মুহূর্তে দৃষ্টি রুদ্রবাড়ি আঁধার নিঝুম

কালের শিরায় খুঁজে হারিকেন মোমের আগুন

বিদ্যুতের অনাচারে বৃক্ষশোভা মোমের তরল।

হাত বাড়ালেই পোড়ে! দুগ্ধবতী ওলানে অকাল

বেদনার দিনলিপি স্বর্গের কপাটে তীক্ষè তীর

অজ্ঞাত ঝড়ের চড়ে এলোমেলো গুহায় শরীর

জলপাই মুখোমুখি কাঁটাতারে সম্মুখে প্রস্তুত।


সৌম্য সালেক

বুনো মোষের সংবেদ

গজগামিনীর মতো তম্বুরাযুগল-হেন পাছা আর বর্তুল স্তনের ভার দোলাতে দোলাতে ঝোঁপ-কাটা ও করাল মাড়িয়ে সে ছুটছিল তৃষ্ণার জল-সন্ধানে―কোনও সন্নিহিত সরোবরে…

জল খুঁজে দিশাহীন পৌঁছে যায় গহন কান্তারে―যেখানে রাজ করেণুর বৃংহণ, শ্বাপদের নীল-শ্বাস আর সিংহের ভয়াল হুঙ্কার চলে নিশিদিন; সেই ঘন-বনলোকে পাওয়া গেল পূর্ণ জলের দিঘি এক।

সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই খাঁড়ির চারপাশে দেখতে পেল জলভোগী জন্তুরা সামন্ত সেনার মতো দাঁড়িয়ে এবং ওদের রক্তচোখে খেলা করছিল মাংসের মৌতাত যেন এখনি বজ্রছেদনে রত হবে বাঘিনীরা!

তৃষ্ণার আকুতি ও ভীতির সেই সঘন-সংকটে হাসি হাসি উল্লাসে জলে ডুবিয়ে দেয় দীঘল দেহটি! যদিও সে জানে, তারই ভেসে ওঠার অপেক্ষায় জান্তব নখর উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কতিপয় রক্তপায়ী খুনি!  


মাহফুজ রিপন

বৃক্ষের চোখে জল

কে যেন চোখে জল ধরে রাখে

আনচান বাড়ে ভেতর বাহিরে।

সোনালি ভোর আসে পাখির পালকে

মাঝরাত জেগে থাকে রূপালি চাঁদে।

তোমার বিহনে পুইশুর কাঁদে―

পাখিটা মরে গেছে বৃক্ষ নিধনে।

ঘুমে বিভোর যখন সকল জাতিকুল

গাছেরা মিলে যায় কাণ্ড থেকে ফুল।

গাছেরা আছে তাই পাখিরা আসে

বসত হারায় মানুষ জীবনে মরণে।

———————

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button