ভাষা-গবেষণা ধারাবাহিক : শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু : মানবর্দ্ধন পাল

পঞ্চম পর্ব
[প্রাচীন ভারতীয় আলংকারিকেরা শব্দকে ‘ব্রহ্ম’ জ্ঞান করেছেন―শব্দ যেন ঈশ্বরতুল্য। পাশ্চাত্যের মালার্মেসহ নন্দনতাত্ত্বিক কাব্য-সমালোচকদেরও বিশ্বাস, শব্দই কবিতা। যা-ই হোক, শব্দের মাহাত্ম্য বহুবর্ণিল ও বহুমাত্রিক। বাংলা ভাষার বৃহদায়তন অভিধানগুলোর পাতায় দৃষ্টি দিলেই তা প্রতিভাত হয়। আগুনের যেমন আছে অসংখ্য গুণ তেমনই ভাষার প্রায় প্রতিটি শব্দেরও আছে অজস্র অর্থের সম্ভার। কালস্রোতে ও জীবনের প্রয়োজনে জীবন্ত ভাষায় আসে নতুন শব্দ, তা বিবর্তিতও হয়। পুরোনো শব্দ অচল মুদ্রার মতো ব্যবহার-অযোগ্য হয়ে মণি-কাঞ্চনরূপে ঠাঁই নেয় অভিধানের সিন্দুকে।বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডার সমুদ্রসম―মধুসূদনের ভাষায় : ‘ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। বৈঠকি মেজাজে, সরস আড্ডার ভঙ্গিতে লেখা, এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’। ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক―সবকিছু মিলিয়ে শব্দের ভেতর ও বাইরের সৌন্দর্য-সৌগন্ধ এবং অন্তর্গত আনন্দধারার ছিটেফোঁটা ভাষিকরূপ এই ‘শব্দবিন্দু আনন্দসিন্ধু’ ধারাবাহিক।]
আম
আম আমাদের জাতীয় ফল নয় কিন্তু আমগাছ আমাদের জাতীয় বৃক্ষ। আমকে ফলের রাজা বলা হয়। কাঁঠাল জাতীয় ফলের মর্যাদা পেলেও পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, কাঁঠালের চেয়ে আমের প্রিয়তাই বেশি। হয়তো ভারত আগেই আমকে জাতীয় ফলের মর্যাদা দিয়েছিল বলে আমরা পারিনি। তাই আমগাছকে দিয়েছি জাতীয় বৃক্ষের সম্মান―যদিও আমড়া কাঠের ঢেঁকির মতো আমকাঠও অসার। তবে আমকাঠ অসার হলেও শুনেছি নতুন উদ্ভাবিত জাপানি ‘লালডিম’ আমের দাম নাকি প্রতিকেজি কয়েক হাজার টাকা এবং তা উৎপাদন হচ্ছে আমাদের দেশেও।
অন্য জাতির কথা জানি না তবে বাঙালি আবালবৃদ্ধবনিতার প্রিয় ফল আম। কচি টক আম থেকে সুপক্ব মিষ্টি আম, আমসত্ত্ব, আমশি, আমকুচি, আমদুধ―সবই বাঙালির প্রিয়। আপেল-আঙুরের মতো এটা কোনও বিদেশি ফল নয়। ভারতীয় উপমহাদেশেই এর আঁতুড়ঘর। তাই উদ্ভিদ-বিজ্ঞানের ভাষায় এর নাম―‘ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা’। সংস্কৃত শব্দ ‘আম্র’ থেকে বাংলা ভাষায় তদ্ভবরূপ আম। প্রাকৃত বাংলায় বলে ‘আম্বু’। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে আছে : ‘আম্বু জাম্বু মুকুলিত।’ (১৪৫০)। বাঙালি-হিন্দুদের পুজো-পার্বণ ও ব্রত-আচারের ঘটে শুভত্বের প্রতীক হিসেবে সিঁদুরচর্চিত পঞ্চপত্রিকার আমসড়া দেওয়ার রীতি আছে। এই প্রাচীনতম রীতিও ইঙ্গিত দেয়, আম ও আমগাছ আমাদেরই। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এই ফল কালক্রমে পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
স্বাদে-গন্ধে, রূপে-রসে, আকারে-প্রকারে আম বিচিত্র ও বহুরূপী। উদ্ভিদবিশারদেরা বলেন, আমের আছে পঁয়ত্রিশটি প্রজাতি। গুগল সার্চ ইঞ্জিনে খোঁজ নিলে যে-কেউ দেখতে পাবেন, সাড়ে তিনশয়ের বেশি জাতের আমের নাম। ভোক্তার কিছু চেনাজানা, পরিচিত―অধিকাংশই অজানা-অচেনা। কী বিচিত্র, মায়াময়, সুমধুর ও রসসিক্ত সেসব বাহারি নাম! সেগুলোর নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত স্মৃতি, কত ইতিহাস, কিংবদন্তি ও জনশ্রুতি। ফজলি বেগমের বাড়ির বৃহদাকার ও সুমধুর আম নাকি তারই নামে। ‘আমরুপালি’ থেকে না কি দ্রুত উচ্চারণে ‘আম্রপালি’। এই সুস্বাদু আম নাকি প্রাচীনকালের এক সুন্দরী নগর-বারবণিতার নামে। এক খঞ্জ বৃদ্ধের গাছে ছোট আকৃতির স্বাদু বিশেষ জাতের আমটি প্রথম জন্মেছিল বলে এর নাম হয়েছে ‘ল্যাংড়া’! নামের প্রতিবন্ধিত্বের মাঝেও-যে আছে কত রহস্য ও মাধুর্য তা ‘ল্যাংড়া’র মধ্যেই প্রতীয়মান! সেসব নামের সাতকাহন বা আমাবলির বর্ণনা-বিবরণ দেওয়া আমার এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমি তো আর আম্র-বিশেষজ্ঞ নই বরং আমি আমজনতারই অংশ। তবে বাজি ধরে বলতে পারি, আম না-খাওয়া বাঙালি যেমন নেই তেমনি পশ্চাৎদেশ দিয়ে ‘আম’ না-যাওয়া বাঙালিও নেই! আর জানা কথাটা বিরক্তিকর হলেও বলি : রবীন্দ্রনাথেরও প্রিয় ছিল আম, আমসত্ত্ব ও আমচুর। ‘আম্রচূর্ণ’ থেকে ‘আমচুর’―কাঁচা আমের শুকনো ফালি―আমশি। আর আমসত্ত্ব মানে পাকা আমের মণ্ড রোদে শুকিয়ে তৈরি করা অম্ল-মধুর চকোলেট-জাতীয় খাদ্য। ভোজনবিলাসী রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন―‘আমসত্ত্ব আমচুর; সের-দুই দুধ।’ (১৮৯৩)। আহা! কী রসনা সরসকরা বাক্য! অতীন্দ্রিয়ধারী হলেও তিনি ছিলেন ঘ্রাণ-পাগল! তাই তো বলেছেন―‘ফুলের গন্ধ বন্ধুর মতো জড়ায়ে ধরিছে গলে।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর দীর্ঘতম গানে গেয়েছেন―যা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত―‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে…।’
শব্দের শুরুতে ‘আম’ আছে কিন্তু সুমধুর আমের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই―এমন শব্দও আমাদের ভাষায় প্রচুর। ‘আময়’ সংস্কৃত শব্দ―মানে রোগ, অসুখ-বিসুখ। ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন―‘মহাশয়, আপনার কি আমাশয় ? আম যায় ?’ এসব রোগ-বিশেষ। এমন রোগ আমজ্বর, আমরক্ত, আমবাত। আমাশয় থেকে যে জ্বর তা-ই আমজ্বর এবং আনুষঙ্গিক ব্যাধি আমরক্ত, আমবাত। আম ও আমড়া এক নয়। টক ফল সংস্কৃত শব্দ ‘আম্রাতক’ থেকে আমড়া। কখনও আবার উচ্চারণ-শৈথিল্যে ‘আমড়া’ ও ‘আমরা’ একাকার হয়ে অর্থ-বিভ্রাটও ঘটায়। বিশেষ্য ও সর্বনামে জগাখিচুরি পাকিয়ে যায়! ঠিক এমনই বিভ্রাট ঘটায়, যখন বলি―‘আমপাড়া ছেলেটি আমপারা পড়তে পারে।’ ‘আমপাড়া’ মানে, যে আম পাড়তে পারে আর আরবি শব্দ ‘আমপারা’। ‘আমপারা-পড়া হামবড়া মোরা।’ (নজরুল, ১৯২৬)।
‘আমল’ ও ‘আমরুল’ শব্দেও আকাশ-পাতাল প্রভেদ। ‘আমন্ত্রণ’ ও ‘আমন’ শব্দের অর্থেও অনেক তফাৎ। ‘আমন’ এসেছে সংস্কৃত ‘হৈমন্ত’ থেকে। হৈমন্ত>হৈমন>আমন। হেমন্তকালে উৎপাদিত ফসল (ধান)। তাই ভারতচন্দ্রের লেখায় পাওয়া যায় : ‘আসু বোরো আমন রান্ধিলা ক্রমে ক্রমে।’ (১৭৬০)।
‘আমতা’ মানে আম পাকাতে তা দেওয়া নয়―আম থেকে জাত বা উৎপাদিত। এই অর্থে আমসত্ত্ব। আবার আমতা মানে ইতস্তত ভাব। ‘আমি-তা’ থেকে ‘আমতা’। অর্থাৎ আমিই দোষী―তা স্পষ্ট স্বীকার করতে অনিচ্ছা কিন্তু অস্বীকারেরও উপায় নেই―এমন ভাব। রাবীন্দ্রিক প্রয়োগে―‘মাফ তাকে চাইতেই হলো নতশিরে আমতা আমতা করে।’ (১৯৪০)। এসবের পার্থক্য না-জানলে ভাষাজ্ঞান ও শব্দবোধের সর্বস্বই হারাতে হয়। তখন আমও যায়, ছালাও যায়। তাই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন―‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন।’
আমের সর্বজনবোধ্য প্রথম ও প্রধান অর্থ ফল-বিশেষ। উচ্চারণমাত্রই তৃপ্তিদায়ক ও সুগন্ধযুক্ত ফলটি মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে। আমের দ্বিতীয় অর্থটি বিবমিষা জাগায়―যা মানবদেহের পশ্চাৎদেশ থেকে নির্গত দুর্গন্ধযুক্ত লালাভ পিচ্ছিল পদার্থ। রক্ত মলস্রাবের পীড়া। যখন ‘আমগন্ধ’ বলি তখন ভালোমন্দ দুই অর্থই বোঝায়―সুপক্ব আমের সুগন্ধ ও পিচ্ছিল মলের দুর্গন্ধ। দুটি অর্থই বিশেষ্যপদ হিসেবে ব্যবহৃত। আমের তৃতীয় অর্থ―সাধারণ। পদ হিসেবে বিশেষণ। শব্দটি আরবি। আমজনতা, আমদরবার, আমরাস্তা, আমমোক্তার―শব্দগুলো আমরা সাধারণ মানুষ এবং সাধারণের প্রবেশযোগ্য হিসেবেই ব্যবহার করি। আমের চতুর্থ অর্থটি আমাদের কম-জানা―কাঁচা। পদ হিসেবে বিশেষণ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখায় পাই : ‘আর্যজাতি এককালে ছিল আমমাংসভোজী।’ (১৯২৫)।
‘আম’ বাংলা ব্যাকরণে ক্রিয়া বিভক্তিরূপে সাধুভাষায় ব্যবহৃত হয়। কর্তৃবাচ্যে অতীতকালে উত্তমপুরুষে ‘আম’ বিভক্তিরূপে লক্ষ্যযোগ্য। যেমন : চলিল + আমি = চলিলাম, করিল + আমি = করিলাম, বলিল + আম = বলিলাম।
সুতরাং ভালোমন্দ মিলিয়ে ‘আম’ শব্দের অর্থ দাঁড়াচ্ছে : ফল বা বৃক্ষবিশেষ, কাঁচা বা অপক্ব, আমাশয় রোগ, সাধারণ, অজীর্ণ ও বাংলা ব্যাকরণে ক্রিয়া বিভক্তি।
একথা সবাই জানেন, সুমিষ্ট আমের জন্য বিখ্যাত আমাদের রাজশাহী অঞ্চল―চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ অঞ্চল। আম শব্দযুক্ত খ্যাত-অখ্যাত স্থানের নামও আছে―আমনগর, আমগ্রাম, আমতলী, আমুয়াকান্দা। কিন্তু বাংলার কলঙ্কিত রাজনৈতিক ইতিহাসের সাক্ষ্যধারী পলাশির আম্রকাননের যেন স্মরণ রাখি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের নন্দিত ও পবিত্র স্থান কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আমবাগানের কথা যেন স্বপ্নেও ভুলে না-যাই। ১৭৫৭ থেকে ১৯৭১। মাঝে প্রায় সোয়া দুইশ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাস। এই দুই আম্রকানন ও আমবাগান আমাদের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য অস্তমিত এবং উদয়ের ঐতিহাসিক সাক্ষ্য।
আনা
বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারে শত শত শব্দ পাওয়া যাবে যেসব শব্দ কেবল দ্ব্যর্থবোধক নয়; বহু অর্থ ও বিচিত্র ভাব প্রকাশে সক্ষম। উচ্চারণ প্রায় কাছাকাছি কিন্তু বানানের হেরফেরে অর্থ ভিন্ন হয় এমন শব্দ তো অসংখ্য। সমোচ্চারিত শব্দের অর্থ-পার্থক্য নিয়ে অভিধানও সংকলিত হয়েছে। কিন্তু বানানে ভেদহীন একটি শব্দের এত অর্থবৈচিত্র্য ও বহুধা-ভাবের প্রকাশ বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় এত আছে কিনা তা তুলনামূলক ভাষাবিজ্ঞানীর গবেষণার বিষয় হতে পারে।
বাংলা সাহিত্যে দুজন ‘ঈশ্বর’ আছেন―একজন বিদ্যাসাগর অন্যজন গুপ্তকবি। পাঠকদের কাছে তাঁদের পূর্ণ ও পরিচিত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। প্রথম ঈশ্বর বাংলা শৈল্পিক গদ্যরীতির নবরূপায়ন, বর্ণমালা পুনর্গঠন ও সংস্কার করেছেন। দ্বিতীয় ঈশ্বরকে বঙ্কিমচন্দ্র আখ্যা দিয়েছেন, দেশপ্রেমিক ও ঐতিহ্যনিষ্ঠ ‘খাঁটি বাঙ্গালী কবি’ বলে। এই নির্ভেজাল বাঙালিকবি ঈশ্বর গুপ্ত ওস্তাদ ছিলেন একটি বিশেষ শব্দকে বহুমাত্রিক অর্থে ব্যবহার করতে। তিনি নিজেকে নিয়েও ঠাট্টা করে বলেছেন : ‘কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত? ব্যাপ্ত চরাচর!/ যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।’ এখানে ‘ঈশ্বর’-এর দুটি অর্থ, ‘গুপ্ত’রও দুটি।
ঈশ্বর= সর্বশক্তিমান, কবির নাম।
গুপ্ত= লুক্কায়িত, হিন্দুদের পদবি।
ঈশ্বর গুপ্তের আরেকটি যমকে মিলে : ‘আনা দিয়ে আনা যায় কত আনারস?’ এখানে তিনটি ‘আনা’ তিন অর্থে প্রকাশিত। প্রথম ‘আনা’ টাকার ষোড়শ ভগ্নাংশ―ষোলো ভাগের এক ভাগ। ষাটের দশকের আগপর্যন্ত, যখন দশমিক মুদ্রা চালু হয়নি, আমরা যাকে বলতাম পয়সা, তখন চৌষট্টি পয়সায় এক টাকার হিসাব ছিল। চার পয়সায় হত এক আনা আর ষোলো আনায় এক টাকা। তখনও একশ পয়সায় একটাকার হিসেব চালু হয়নি। ষাটোর্ধ্ব বয়সিরা তা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি। আর ‘আনা’ শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে জহির রায়হানের গল্প নিয়ে পুরনো বাংলাদেশি ছায়াছবি ‘টাকা আনা পাই’-এর কথা! দ্বিতীয় ‘আনা’ ক্রিয়াপদ―আনয়ন করা। আর তৃতীয় ‘আনারস’―অমø-মধুর রসেভরা ফলবিশেষ। এই গুচ্ছ ফলটির জন্মভূমি দক্ষিণ আমেরিকা। আনারস শব্দটি পর্তুগিজ ভাষার আনানাস (অহধহঁং)-এর বাঙলায়ন। ফলটি সুপক্ব হলে প্রকৃতিগতভাবেই সরস―রসে একেবারে টইটম্বুর। কিন্তু রসিক ও রসনাবিলাসী বাঙালির নামের মধ্যে অতিরিক্ত ‘রস’ সংযোজন করে তাকে বানিয়েছে ‘আনারস’। ধন্য বাঙালির রসগ্রাহিতা এবং বাংলা ভাষার উচ্চারণের সরসতা!
এসব তো গেল ‘আনা’ নিয়ে সাধারণ কথাবার্তা। এর ভ্রাতৃপ্রতিম শব্দগুলোও―আন, আন (আনো), আনি, আনে, আনুন, আনুক, আনানো ইত্যাদি মূলত ক্রিয়াপদ। প্রাচীনকালের কাব্যে, বড়ু চণ্ডীদাস, মুকুন্দরাম, বিদ্যাপতি, মালাধর বসু সৈয়দ সুলতান, কবীন্দ্র পরমেশ্বর প্রমুখের রচনায় এসব শব্দ ভিন্ন রূপে পাওয়া যায়―আনয়ে, আনহ, আনিঅ, আনাআঁ, আনিঞাঁ, আনিবম ইত্যাদি। এসবের প্রচুর উদাহরণও সঞ্চয় করা যায়। তবে তা বিরক্তিকর হতে পারে বিধায় দুয়েকটি দিই :
★ ‘আনাইআঁ যানাইল সব গোআলিনী সহী।’ (বড়ু চণ্ডীদাস, ১৪৫০)।
★ ‘আমার নাম করিয়া অর্ন্ন আনহ মাগিয়া।’ (মালাধর বসু, ১৫০০)।
★ ‘চাহিলে আনিঞাঁ দেই দেঘরা ব্রাহ্মণে।’ (মুকুন্দরাম, ১৬০০)।
এসবই সংস্কৃত ‘নী’ ধাতু থেকে উৎপত্তি। তবে ‘আন’ এবং ‘আনি’―শব্দ দুটির ক্রিয়াপদ ছাড়াও ভিন্ন অর্থ ও প্রয়োগ আছে। তা আমরা এই পর্বের শেষে লক্ষ্য করব। এখন ‘আনা’ শব্দের অর্থবৈচিত্র্য জানা যাক।
★ আনা= মূল্যবান ধাতু বা স্বর্ণের ওজনের পরিমাপ। পুরনো মাপ অনুযায়ী ছয় রতিতে এক আনা ও ষোলো আনায় এক ভরি বা তোলা। আর আশি তোলায় এক সের। তাই শুভঙ্করের আর্যায় পাওয়া যায়, ‘মণেতে আড়াই সের আনার হিসাব।’
★ আনা= অংশ, ভাগ।
‘তিনি ষোলোআনা সম্পত্তির মালিক।’ (সম্পূর্ণ অংশ অর্থে)।
★ আনা= ফারসি প্রত্যয়বিশেষ। শব্দের শেষে যুক্ত হয়ে শব্দের অর্থান্তর ঘটায়। এই ‘আনা’ অনুকরণ, ব্যবহার, আচরণ অর্থে প্রয়োগ হয়। যেমন―বাবুয়ানা, বিবিয়ানা, গরিবানা, নবাবিয়ানা, মালিকানা ইত্যাদি।
★ আনা= অন্য, ভিন্ন। গ্রামবাংলায়, লোকসমাজে এই অর্থে ‘আনা’ শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। যেমন―‘আনা জনে আনা বলে প্রভুর দুয়ারে।’ (ময়মনসিংহ গীতিকা, ১৮৫০)।
★ আনা= বিনা, ব্যতীত, ভিন্ন, ছাড়া। যেমন―‘আনা উকিলে মোকদ্দমা হয় না।’ (জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস)।
★ আনা= আয়না, কাচ, দর্পণ।
‘লাথি মারি আনার কেবাড় ভাঙ্গিয়া ফেলিল।’ (ময়মনসিংহ গীতিকা ১৮৫০)।
★ আনা= সংস্কৃত ‘আগমন’। যেমন―আনাগোনা। ‘এ মোকামে কোই কামে আনা রকমারি।’ (আলালের ঘরের দুলাল, টেকচাঁদ ঠাকুর, ১৮৫৮)।
★ আনা= আনয়ন করা। ক্রিয়াপদ (√আন + আ)।
‘আনা’ শব্দটির মতো ‘আন’, ‘আন’ (আনো) এবং ‘আনি’ শব্দেরও একাধিক অর্থান্তর আছে। প্রধানত ক্রিয়া হিসেবে প্রয়োগ হলেও অন্যান্য পদ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।
যেমন :
★ আন= (মধ্যম পুরুষে তুচ্ছার্থে বা আদরার্থে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদ) আনয়ন কর, নিয়ে আয়। ‘আন তবে বীণা আন/সপ্তম সুরে বাঁধ তবে তান।’ (রবীন্দ্রনাথ, ১৮৯০)।
★ আন= (মধ্যম পুরুষে সাধারণ অর্থে ব্যবহৃত ক্রিয়াপদ) নিয়ে এসো। ‘আনো তব তাপহরা তিষাহরা সঙ্গসুধা।’ (রবীন্দ্রনাথ)। ‘আন মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা।’ (রবীন্দ্রনাথ)।
★ আন = (বিশেষণ) অন্য, অপর, ভিন্ন। ‘সখী, কেমনে বান্ধিব হিয়া/আমার বঁধুয়া আন বাড়ী যায় আমার আঙিনা দিয়া।’ (দ্বিজ চণ্ডীদাস, ১৬৫০)। ‘খেলিছ এবিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে।’ (নজরুল, ১৯৩০)। ‘আন অনুরাগে পিয়া আন দেশে গেলা।’ (বিদ্যাপতি, ১৪৬০)।
★ আন= অন্ন (বিশেষ্য)। ‘আন পানী নাহি খাও।’ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, ১৪৫০)।
‘আনি’ শব্দটির ব্যবহার আমরা সাধারণত ক্রিয়াপদ হিসেবেই জানি।
এটি উত্তম পুরুষে সাধারণ বর্তমান কালে ব্যবহৃত হয়। যেমন―‘তুমি বস, আমি আনি।’ আবার পদ্যে অসমাপিকা ক্রিয়া হিসেবেও প্রয়োগ হয় : ‘অপরুব কে বিহি আনি (এনে) মিলায়ল।’ (বিদ্যাপতি, ১৪৬০)। ‘আনা’ এবং ‘আনি’ এক অর্থেও বোঝায়―চার পয়সা বা টাকার ষোলো ভাগের এক ভাগ। তা সোনা-রুপার ওজনের মাপ হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তবে ‘আনি’ শব্দটির দুটি ভিন্ন অর্থও আছে―অপ্রচলিত না-হলেও বর্তমানে কম প্রচলিত। প্রাচীনকালের লেখকদের রচনায় এর প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় :
★ আনি= ব্যূহ, দুর্গ, সৈন্যসমাবেশ।
‘সাহেবের লাঠীয়ালেরা… আপন আপন সুবিধামত আনি বান্ধিয়া দাঁড়াইয়াছিল।’ (মীর মশাররফ, ১৮৮৫)।
★ আনি= কালি বা কালো দাগ।
‘কুচাগ্রেতে আনি পড়ে পেটে নড়ে ছেলে।’ (মানিকরাম, ১৭৮১)। রমণী গর্ভবতী হলে স্তনবৃত্ত ঘনকালো হয়―একথাই কবি বর্ণনা করেছেন। নারীর দেহঘড়ি সম্পর্কে শৈল্যবিদের মতো কবির প্রগাঢ় পর্যবেক্ষণ এবং তার শৈল্পিক প্রকাশ পাঠককে অভিভূত করে। তাতে আসন্ন মাতৃত্বের পুলক আছে কিন্তু অশ্লীলতা নেই।
এইসব আন, আনা, আনির বহুবিধ অর্থ ও বিচিত্র অর্থান্তর জানা না-থাকলে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের রসাস্বাদন পরিপূর্ণ হয় না। অবশ্য সাহিত্যপাঠ সবার জন্য জরুরি নয়। এসব না-জেনেই চলে সিংহভাগ মানুষের জীবন। তবে সুকুমার রায়ের ‘ষোল আনাই মিছে’ কবিতাটি তো স্মরণ রাখতেই হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনও খবর না-জেনে মাঝির জীবন ছিল বারো আনা বৃথা। কিন্তু নৌপথে ঝড়ের কবলে পড়ে সাঁতার না-জেনে বাবুর জীবন হয়েছিল ‘ষোল আনাই মিছে’। তেমনই আর যা-ই থাকুক বা না-থাকুক―জীবনে ষোলো আনা বাঙালিয়ানা না-থাকলেও আমাদের মানবজনমের ষোলোকলা পরিপূর্ণ হবে না।
অন্নকূট
‘অন্ন’ মানে ভাত আর ‘কূট’ মানে স্তূপ বা পাহাড়। তাই ‘অন্নকূট’-এর আভিধানিক অর্থ খাদ্যের স্তূপ বা ভাতের পাহাড়। যেদেশে দারিদ্র্য ও অভাব-অনটন প্রতিনিয়ত কড়া নাড়ে অধিকাংশ মানুষের দোরগোড়ায়, খাদ্যসংকট সাধারণের নিত্যসঙ্গী, সে-সমাজে ‘অন্নকূট’ শব্দটি বেমানান। সামন্তপ্রভু বা সামর্থ্যবানদের ঘরে অন্নের স্তূপ থাকলেও সাধারণের ঘরে ছিল অন্নাভাব ও দারিদ্র্য। তাই ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’―এই প্রার্থনা আমাদের আবহমান কালের। ‘টালত ঘর নাই নিতি আবেসী’―চর্যাপদে অনাহারক্লিষ্ট মানুষের এই হাহাকার তো মিথ্যা নয়! তাই পাহাড় সমান খাদ্যবস্তুর স্তূপের ধারণাটি আমাদের বিস্মিত ও লোলুপ করে তোলে।
তবে ‘অন্নকূট’ সংস্কৃত ভাষার ভারতীয় পুরাণ-সম্পর্কিত শব্দ। এর ভেতরে আছে মিথের মৌচাক। এটি মূলত সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের গিরিগোবর্ধন পুজোর মাধ্যমে প্রচুর পানাহারের উৎসব। খাদ্যের জন্য শস্য ও পানের জন্য দুধ প্রয়োজন।
কলকাতার ‘দে’জ’ থেকে প্রকাশিত সাংবাদিক মিলন দত্তের একটি বিখ্যাত বই বাঙালির খাদ্যকোষ। প্রাচীনকাল থেকে অদ্যাবধি বাঙালির যতধরনের খাবার ছিল বা আছে তার বর্ণানুক্রমিক বিবরণ তিনি বইটিতে দিয়েছেন। বড় বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক সেই অভিধান। অন্নকূটের পৌরাণিক তত্ত্ব ও মাহাত্ম্য যা-ই থাকুক―মিলন দত্ত অন্নকূট সম্পর্কে লিখেছেন : ‘অন্নকূট : পাহাড়ের মতো উঁচু করে অন্ন বা ভাত সাজিয়ে উৎসব। মূলত বৈষ্ণবদের উৎসব। বৈষ্ণবদের বিভিন্ন মন্দিরে বা আখড়ায় অন্নকূট উৎসব পালিত হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদে কাশীর অন্নপূর্ণা মন্দিরে ওই উৎসব পালিত হয়ে থাকে।… অন্নকূট মূলত গোবর্ধনপূজা। ওই উৎসবে অন্ন এবং গোবর দিয়ে গোবর্ধন পাহাড়ের প্রতীক তৈরি করে পুজো করা হয়। না, কেবল বাংলায় নয়, গোটা দেশেই হিন্দুরা এই উৎসব পালন করে থাকে।’ তাই চৈতন্য চরিতামৃতে আছে, ‘হেন মতে অন্নকূট করিল সাজন।’
[চলবে]★ তথ্যসূত্র : সিনহা প্রতিম, কলকাতা
সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ