ইংরেজি অনুবাদগল্প

গল্প : পূর্ণপুরুষ : ঝর্না দাশ পুরকায়স্থ

দুধ-কাঁসার মতো ঝকঝকে রোদে কাঁচা সকালটা ভরে আছে। মাসটা শ্রাবণ, ভরা বর্ষা। রোদমাখা লোভনীয় এই সকাল জরিনার বুকের ভেতরটা ভরিয়ে তোলে।

চা-নাশতার পাট সবে শেষ হয়েছে। রেজাউল অফিসে চলে গেছেন। রুবেল স্কুলে, ঠাণ্ডা লেগেছে বলে স্কুলে যায়নি গিনি।

স্কুলে মেয়ে যায়নি, ঠিক আছেÑবিছানায় শুয়ে বিশ্রাম নিলেই হতো। তা নয়, ভাবতে গিয়ে মনে মনে বিরক্ত হয় সে। আজকালকার ছেলেমেয়েরা কি তাই কখনও করে। ঐ তো মেয়ে, কানে এয়ারফোন সেঁটে বসে আছে। সামনে কম্পিউটার, মাউসের ওপর হাত রেখে মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে গিনি।

এ সময় ব্যালকনিতে বসে আয়েশ করে চায়ে চুমুক দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে ওর। তা কি হবার জো আছে ? সংসারে গৃহিণীর উনকোটি কাজ। সিনেমার স্লেইডের মতো একটার পর একটা কাজ এসে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে।

সংসারের খুব প্রয়োজনীয় ও খুঁটিনাটি জিনিসপত্র কিনতে এবার যেতে হবে শপিংমলে। কেনাকাটা করতে তো বেশি সময় লাগে না। ভালোভাবে এক্সপায়ার ডেট দেখে ট্রলিতে তুলে নেয়া। এরপর টাকা মিটিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসা।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে রোদে ঝাঁঝ মিশেছে। আগের সেই ভালো লাগা আর নেই জরির। ভেতরে ভেতরে বিরক্তি বাড়তে থাকে রেজাউলের কথা মনে করে। সংসারের কাজকর্মে কোনওদিন তার এতটুকু সাহায্য পাওয়া যায় না। অফিস নিয়েই তো তিনি সদাব্যস্ত। 

কর্মক্ষেত্রে সে নিবেদিত প্রাণ এক মানুষ। কলুর বলদের মতো কাজ করে যায় শুধু। তার ক্লান্তি নেই,  বিশ্রাম নেই। কলিগরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে সারা অফিসে চরকিবাজি করে বেড়ায়। কাকে ডিঙিয়ে কে প্রমোশন পাবে, বিগ বসের প্রিয়ভাজন হবেÑএসব নিয়ে সারাক্ষণ নীরব প্রতিযোগিতা চলে। নানা ফন্দি-ফিকির-ছলচাতুরি করতে করতে অদৃশ্য এক সিঁড়ি বেয়ে ওরা উপরে উঠে যায়।

রেজাউল যে তিমিরে সেই তিমিরে পড়ে থাকেন, অফিস কলিগ, ফিরোজ যার সাথে পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে, মাঝে মধ্যেই রেজাকে বলেন, তুমি তো বসের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে বসে আছ।

 বসের কাছে ?

ঐ হলো, অফিসের কাজে তো মনপ্রাণ ঢেলে বসে আছ।

রেজাউল এমনি এক মানুষ ফিরোজ সাহেবের কথারও কোনও প্রতিবাদ করতে পারেন না। এমনই সহজ-সরল ও নিষ্ঠাবাদী।

জরি, অ্যাই জরিÑবাব্বাঃ কানে শুনতে পাস না নাকি ?

সামনে হুস করে লাল রঙের জি-করোলা সামনে এসে থামে।

গাড়ির গ্লাস নামিয়ে হাসিমুখে কেউ বলে, এই যে জরি, চিনতে পাচ্ছিস ? আমি রে, নাজি-নাজি-নাজিফাÑ

জরিনার দুহাতে ভারী ব্যাগ, মুখে পরিশ্রমের বিনবিনে ঘাম। গাড়ির ভেতরে বসা মীনে করা মুখে মহিলাটি মিটিমটি হাসছে।

আরে নাজিফা, নাজিÑতাই না ?

নাজিফা বলে, চিনতে পেরেছিস তাহলে ? উঠে আয়, আমি তোকে নামিয়ে দেব।

না না, তা হয় না। এই তো সিদ্ধেশ্বরীতে থাকি, খুব কাছে। বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে জরিনা।

কী হতো নাজিফার সঙ্গে দেখা না হলে ? দুহাতের ব্যাগের ভারে প্রায় নুইয়ে পড়ছে সে। সুবেশা নাজিফা এসির আরামদায়ক ঠাণ্ডায় বসে আছে।

নাজিফাও নাছোড়বান্দা।

তাহলে কথা দে, আসছে শুক্রবারে ঠিক চারটেয় আসবি, কয়েকজন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে। আসবি তো ? প্রমিস, এই নে কার্ড, ইস্কাটন গার্ডেন রোডে থাকি।

লাল রঙে দুচোখ ধাঁধিয়ে কারটি চলে যায় জরিনার সামনে দিয়ে। প্রাক দুপুরের রোদের ঝাঁঝ শুধু ছুঁয়ে যেতে থাকে ওকে।

এতদিন নিজের পরিচিত বৃত্তের ঘেরাটোপে ধূলিকণার মতো ছোট ছোট দুঃখ ছাড়া সে ছিল সুখী রমণী। নাজিফার বাড়িতে গিয়ে ঢলে পড়া এক বিকেল আর মনোরম সন্ধেটুকু বুকের ভেতরের দীনতা উস্কে দিয়েছে।

মনে মনে ভাবতে থাকে জরিনাÑকী হতো পুরনো ক্লাসমেট নাজিফার সঙ্গে দেখা না হলে ? বিব্রতকর সেই পরিস্থিতি থেকে বের হতে চেয়েছিল গেট-টুগেদারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে।

সেই সন্ধে ছিল ভীষণ মায়াময়। সিদ্ধেশ্বরী থেকে ইস্কাটন গার্ডেন রোড তেমন কিছু দূরে নয়। কার্ডে লেখা ছিল বাড়ির নাম্বর, খুজে পেতে তেমন অসুবিধে হয়নি।

সোনার তরীÑআহা বাড়ির নামটি কী চমৎকার!

লিফটে উঠে এক পলকে চলে গেল আট তলায়। আড়াই হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। চমৎকার করে সাজানো। পেলমেট থেকে দুলছে তেল পিছলে পড়া মহার্ঘ পরদাÑচারপাশে তাকিয়ে জরিনার চোখের পলক আর পড়ে না। নিশ্চয়ই ইন্টেরিয়র ডেকোরেটর নিখুঁতভাবে সাজিয়ে তুলেছে কামরাগুলো। ড্রয়িংরুম লাগোয়া বিশাল ব্যালকনিটি রেয়ার অর্কিডে ভরে আছে।

 সেই মহকুমা শহরের তিনজন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্মৃতিমাখা সেই শহরের পুরানো কথা বলতে বলতে শুনতে শুনতে প্রজাপতির মতো পাখনা মেলে উড়ে গেল সময়।

নাজিফার কিচেন দেখে জুড়িয়ে যায়, দুচোখ রূপার মতো ঝকঝক করছে ঢাউস সিংক। ক্রকারিজ তুলে রাখার বিশেষ কেবিনেট। রেয়ার কালেকশনে সাজানো ড্রয়িংরুম।

এলেবেলে গল্পগুজব করে অনেকটা সময় চলে গেল তারপর তৃপ্তি করে খেল স্বাদু খাবার। নদীর তিরিতিরি স্রোতের মতো সময় বয়ে গেল, টেরই পেল না জরিনা। তবে বিকেল থেকে সন্ধ্যা ও রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত নাজিফার বাসায় আনন্দ উৎসবে সময় কাটিয়ে মনে হলোÑজীবনের প্যাটার্ন এখন অনেক বদলে গেছে। এ যেন এক অন্য পৃথিবী।

 ঠিক হলো স্কুলের সহপাঠী সোমা ওর বাড়ি বনানীতে যাবার সময় জরিকে নামিয়ে দেবে সিদ্ধেশ্বরীতে। গলির মুখে নামিয়ে দিয়ে বললÑ সোমা, ভেতরে গেলে গাড়ি ঘোরাতে অসুবিধে হবে রে, এখানেই নামিয়ে দিই।Ñকেমন ?

ড্রাইভারও সায় দিলÑহ্যাঁ ম্যাডাম।

মোটেও গলি নয় এটি। সকাল থেকে রিকশা, সিএনজির সাথে বড় বড় কারও এ রাস্তায় সারাদিন যাওয়া-আসা করে। কানাগলি তো নয়ই বরং রাস্তা বলা যায়। বেশ খানিকটা দূরে কি করে নামিয়ে দিতে পারল সোমা ? ছোটবেলায় এক স্কুলে পড়া বন্ধু অমন করল কি করে ? নিজেকে বড় দীনহীন আর অসম্মানিত মনে হতে থাকে। আত্মামর্যাদায় বড় ঘা লাগল জরিনার, সেতারের সূক্ষè তারের মতো চোখের কোলে অশ্রুর রেখা স্ট্রিট লাইটের আলোয় চিকচিক করতে থাকে।

আনন্দের বদলে বড় বেদনা নিয়ে ফিরে এল বাড়িতে।

বাড়ি ফিরতেই রুবেল আর গিনি হামলে পড়ে।

বলো আম্মু, তোমার ক্লাসমেটদের গল্প বলো। একটুও বাদ দেবে না কিন্তু।

কী বলবে ছেলেমেয়েকে ? বলবে, জীবন তাকে হারিয়ে, দিয়েছে। পরাজয়ের অপার গ্লানি মেখে সে ফিরে এসেছে চির পরিচিত নিজস্ব চৌহদ্দিতে ? এও কি বলা যায় ?

ভিক্টরি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে সবাই জয়ের কথা বলতে চায়। পরাজয়ের কাজল তো কেউ সারা শরীরে মাখতে চায় না। রেজাউল বললেন, সন্ধেটা কেমন কাটল বলো।

হিমশীতল গলায় জরিনা বলে, সেসব তোমার না শোনাই ভালো।

প্লেটে ভাত বাড়তে বাড়তে গিনি বলে, আব্বু বলেছে, তুমি এলে ও বাড়ির গল্প শুনব। গল্প শুনে শুনে খাওয়া হবে।

স্বাভাব-বিরুদ্ধ গম্ভীর স্বরে জরিনা বলে, ওদের গল্প শুনে তোমার আব্বুর দারকার নেই, তিনি হলেন অন্য জগতের মানুষ।

রুবেল মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, অন্য জগতের ? তার মানে ?

ছেলের দিকে তাকিয়ে জরিনা বলে, মানে তোমার আব্বু এক্সেপশনাল।

স্বামী আর ছেলেমেয়ে বুঝে নিল মায়ের মেজাজ ভয়াবহ এবং গুরুতর।

সেই রাত থেকে মনে মনে বদলে যেতে থাকে জরিনা। মৌরী দানার মতো স্বরচিত কিছু ভাবনা কুরে কুরে খেতে থাকে তাকে।

 কেন সে রাস্তায় দেখা হওয়া নাজিফার আমন্ত্রণ সহজেই কবুল করে নিল ? অনেক কিছু অজুহাত দিতে পারত সে, এমনও বলতে পারত সামনেই রুবেল-গিনির পরীক্ষা, আমি বাড়িতে না থাকলে একদম পড়াশোনা করে না ওরা।

নিজের উপরে রাগ হতে থাকে ওর। সঠিক সময়ে মগজে বুদ্ধিটুকু আসে না। বোকাদের অমনই হয়।

নিজের পরিচিত বৃত্তে আর দশজন মানুষের মতো সে সুখীই ছিল। নাজিফার বাড়িতে না গেলে উচ্চবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্তের ফারাকটুকু সে উপলব্ধি করতে পারত না।

মরাল গ্রীবা ঘুরিয়ে সোমার বলাÑগলির মুখে তুই নেমে যাবি নাজি, নয়তো গাড়ি ঘোরাতে প্রবলেম হবে।

সঙ্গে সঙ্গে অনুগত ড্রাইভারের উচ্চারণ, জি ম্যাডামÑকথাগুলো বর্শার ফলার মতো জরির বুকের ভেতরটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে। অদৃশ্য এক অপমানের ঝাঁঝ শরীরে অসহ্য জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে।

ওদের সাথে যোগাযোগ রাখলে অপমান আর অসম্মানের ধূলিকণা গায়ে মেখে পথ চলতে হবে। একটি ছায়াচ্ছন্ন মধুর বিকেল ও মায়াময় সন্ধ্যা কিছু স্বরচিত প্রশ্নের জন্ম দিয়ে গেছে জরিনার বুকের ভেতরে।

বিয়ের পর এতগুলো বছর কি করেছি আমি ? শুধু ঝুড়িভর্তি সবজি রান্না আর গামলা ভর্তি মাছ-মাংস রেঁধে তৃপ্ত করলাম স্বামী আর সন্তানদের ?

ক্লাসের প্রথম মেয়েটি কি করে এতদিন নিজের অস্তিত্ব ভুলে রইল। একটুও ভাবল না, সময় নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাচ্ছে। একটা কিছু করে পৃথিবীতে ছাপ রেখে যাও। কিশোরী ও তরুণী বয়েসের ভাবনাটি বেমালুম কোথায় যেন ফেরারি হয়ে গেল।

স্বামী না হয় আলাভোলা, সাত-পাঁচে না থাকা একটি মানুষ। অতি সাধারণভাবে জীবন বয়ে গেলেই হলো।

কিন্তু জরিনার মতো চৌকস মেয়ে কেন একই বৃত্তে দাঁড়িয়ে রইল ?

তাইতো সংসারটি এমনই আটপৌরে হয়ে রইল। ক্রিস্টালের বাসনপত্র, রকমারি সার্ভিং ডিস, ওভেনপ্রুফ ক্রকারিজ কিছুই সেভাবে কেনা হলো না। মুক্ত বাজারের দৌলতে ঝাঁ চকচকে শপিং সেন্টারে সখের জিনিস যে মাঝে মধ্যে কেনাকাটা করতে ইচ্ছে করেনিÑতা নয়।

হ্যাঁ, জরিনার জন্য এগুলো প্রয়োজনীয় নয়, সখের জিনিস। মনে মনে ভেবেছে যদি এখন বাড়তি খরচ করি তার সংসারের খরচে টান পড়বে। হিসেব-নিকেশের জমা-খরচের খাতাটি ওর কাছে ভীষণ জরুরি।

সত্যি, মানুষ কেমন বদলে যায়।

স্কুল-কলেজে ভীষণ চৌকস ছিল পড়াশোনায়। আব্বা ছিলেন সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ। মেয়েকে গানের ওস্তাদের কাছে নিয়ম করে তালিমের জন্য নিয়ে গেছেন। এছাড়া চার বছরের কোর্স করেছে গানের ওপর। যত্ন করে মেয়েকে তৈরি করেছেন মা-বাবা।

ইমন-বেহাগ-ভৈরবী আর দরবারি রাগের বৃত্ত থেকে কী করে যেন আটপৌরে গৃহিণী হয়ে গেল সে। হারমোনিয়ামের সাদা-কালো রিডে পড়ে আছে এখন অজস্র ধূলিকণা। এতে আঙুল ছোঁয়াবার সময় কোথায় ওর ? নতুন গান তোলা কিংবা রেওয়াজ করার  ইচ্ছেটা একেবারেই মরে গেছে।

এখনও চল্লিশের কোঠায় পা রাখেনি এর মাঝেই তারুণ্যের কমনীয় সৌন্দর্য-লাবণ্য উধাও হয়ে গেছে।

কিশোর বয়েসে একবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল আকাশে ওড়ার। এয়ার হোস্টেস হওয়ার স্বপ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। কবিতার পঙ্ক্তিটি মগজে খুব ঘুরত।

‘আমরা যদি না জাগি মা

কেমনে সকাল হবে’Ñ

আমরা যদি একটু জেগে উঠি অন্যরাও তো আম্মুÑপথের দিশা পাবে।

আম্মা কাছে নেই, কুমিল্লা শহরের বাগিচাগাঁও বাড়িতে মা। তারপরও তাকে সম্বোধন করে মনের কথাগুলো বলে যায় জরিনা।

আমার নীলুমামু, যে আম্মুর ছোটভাইÑকী চমৎকার ছবি আঁকতেন। ছোটবেলা দেখেছি তার তুলির টানে অপূর্ব হয়ে উঠত ছবিগুলো। আমি বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম তুমি তার বোন হয়ে একেবারে অন্যরকম হলে কেন আম্মুÑ ?

নীলুমামু শোনাতেন চিত্রশিল্পী গঁগার গল্প।

তিনি স্পিরিচুয়াল হোমল্যান্ডের কথা ভাবতেন। প্যারিসের চোখ ধাঁধানো শহর তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। আধ্যাত্মিক হোমল্যান্ডের টানে চলে গেছিলেন সবুজ রঙ ব্রিটানি দ্বীপে। মনে হয়েছিল, এই তো তার স্বপ্নের ভুবন। এরপরও অজানা এক অতৃপ্তি তাকে তাড়িয়ে নিয়ে ফিরেছে বহু জায়গায়।

নীলুমামুর মুখে গঁগার গল্প শুনে জরিনার সেই বয়সে ছুটে বেড়াবার বড় সাধ জেগেছিল। কিন্তু কই, স্বপ্নপূরণ তো হলো না। দেশ-দেশান্তরে ছুটে যাবার সাধ অপূর্ণই রয়ে গেল। এয়ার হোস্টেস হবার স্বপ্ন মনের মাঝে মরে গেল একদিন।

বড়রা বললেন, মাটিতে রিকশা-কার-সিএনজি চলে তাই কত অ্যাক্সিডেন্ট হয়, প্লেন চলে আকাশ পথে, বিপদ-আপদ হলে তো এক্কেবারে ধপাস। ওসব ভাবনা মাথা থেকে বের করে দাও জরি।

এরপরও গাইগুঁই করেছিল জরিনা। আকাশ-পথে তো কোনও যানবাহন থাকে না যে টক্কর খাবে। ভেবে দ্যাখো তো আকাশের রাস্তা অনেক নিরাপদ।

কিশোরী মেয়ের কথার কি-ই দাম থাকে অভিভাবকদের কাছে। বয়সটাই স্বপ্ন দেখার। ইচ্ছেপূরণ আর হলো না।

সুসানও হতে চেয়েছিল একবার, সুসান উইন্ডিব্যাক বড়চাচু বললেন, এমনধারা নাম কখনও শুনিনি বাপু, কোথা থেকে যে নাম জোগাড় করিস।

কেউ জিজ্ঞেস করলÑ‘সুসান ? মেয়েটি আবার কে ? বাঙালি না বিদেশি ?

আম্মু রাগ করে বলেন, পারিসও বাপু জরি।

মন ভেঙে গেছিল সেই বয়সে।

আরে বাবা, তোমরা নাম শোননি বলে তো মিথ্যে হয়ে যাবে না সুসান। ও হলো ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি মাছ ধরেন, প্রজাপতি আর ফড়িঙের পেছনে ছুটতে খুব পছন্দ করেন।

আব্বু-আম্মুর কাছে জবানবন্দি দিতে গিয়ে সে সময় সারা শরীর রোমঞ্চিত হয়ে উঠেছিল জরির।

আমি সাংবাদিক হতে চাই আব্বু। প্লেনে চড়তে দেবে না ঠিক আছে, অ্যাটলিস্ট জার্নালিস্ট তো হই।

তরিবৎ করে রান্না করা ছোট মাছের চচ্চড়ি খুন্তি দিয়ে নাড়তে গিয়ে আম্মু বলেন, এখানে ওখানে ছুটোছুটি সুসানের মতো ?  না বাবা না, মেয়ে হয়ে জন্মেছ, মনে থাকে যেন।

সবকিছুতে বারণ আর মানা।

মনে মনে সেদিন উচ্চারণ করেছিল, আমিও সুসানের মতো মুক্তজীবন চাই। সুসান উইন্ডিব্যাংক দিনের পর দিন বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়িয়েছেন, জীবজন্তুদের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলোর নিখুঁত বর্ণনা দিতে পেরেছেন তার লেখায়।

তিমিদের খবরও সুসান দিয়েছেন তার ‘ওয়াইল্ড সেক্স’ বইতে। জরি তো প্রথমে খুব হেসেছিল এই কথা জেনে, তিমিরা নাকি গান গাইতে পারে। শুধু হেসেছে জরি তাই নয়, রোমাঞ্চিতও হয়েছে। আহা! কী অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার তিমিদের পরমানন্দে শিরশির করে উঠেছিল ওর সারা শরীর, রোজার সঙ্গে প্রথম মিলনের পর তেমনই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছিল ওর শরীর।

কইÑসুসান হতে সে পারল ? মুক্তজীবন পেয়েছে সে ? পায়নি। মনস্তত্ত্ববিদ ও শিশুসাহিত্যিকেরা বলেন, শিশু-কিশোররা যা  করে আনন্দ পাবে তা-ই করবে।

ধ্যাৎ, ওসব শুধু বইয়েই লেখা থাকে।

আব্বু-আম্মু ছাড়াও আত্মীয়-স্বজনেরা কিশোরী থেকে তারুণ্যে পা রাখলেই দীক্ষা দিতে থাকেনÑঅ্যাডজাস্টমেন্ট করতে শেখো মা, পরের ঘরে গেলে শুধু মানিয়ে নিতেই হবে। মেয়েদের সবচেয়ে বড় গুণ হলো অ্যাডাপটাবিলিটি।

মেনে নাও, সব মেনে নাও জরিনা।

পুরুষ মানুষদের একটু-অধটু স্খলন ঘটে, ওসব তোমাকে ওভারলুক করতে হবে।

মেয়েদের শিক্ষা দিতে এমনই উন্মুখ হয়ে থাকেন বড়রা।

ভাবতে গিয়ে পুরনো দিনগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়।

আব্বু কাঁচা বাজার থেকে আসতেন সাত সকলে, পেটফোলা চটের ব্যাগ আছড়ে ফেলতেন রসুই ঘরের মেঝেতে।

হাঁক দিতেন, কই গেলে গো জরির মা, দ্যাখ কী পাকা রুই এনেছি, আলু-ফুলকপি-টম্যাটো দিয়ে জুত করে রাঁধো তো ধনেপাতা আর চোরা কাঁচালংকাও দিও।

অমনি বশংবদ মা কালিঝুলি মাখা রান্নাঘরে এসে ঢুকলেন।

খাবার টেবিলে আব্বু রান্নার একটু তারিফ করলে মোমবাতির ফোটার মতো গলে গলে পড়তেন আম্মু।

ধন্য মেয়ে-জনমÑভেতরে ভেতরে ক্রোধে ফেটে পড়ত জরিনা। মনে মনে বলত, খাদ্যরসিক আব্বুর সাথে থাকতে থাকতে তুমি একজন পাকা রাঁধুনি হয়ে উঠেছ আম্মু। আর কিছু নয়।

কিন্তু আমি তো অমন জীবন চাইনি আম্মু, অন্যরকম জীবন চেয়েছেলাম। যে জীবনে থ্রিল থাকবে। স্বামীর ঘরনি হয়ে, সন্তান লালনপালন করে জীবন বইয়ে দেওয়াÑতেমন জীবন আমি কক্ষনো চাইনি আম্মু।

হ্যাঁÑস্বপ্নবিলাসী ছিল জরিনা, লাল-নীল-গোলাপি-হলুদ স্বপ্নের মাঝে একসময় ডুবে থাকতে ভালোবাসত। কিন্তু কী হলো ?

রেজাউলের সাথে ঘরকন্নায় মেতে থেকে আজ সে নিজেই হয়ে উঠেছে আটপৌরে এক গৃহিণী।

হবেই তো, জীবনসঙ্গী যদি অমন হয়, যার কোনও স্বপ্ন নেই, আকাক্সক্ষা নেই, আত্মসম্মানবোধ নেই, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেইÑসে মানুষের সাথে জীবন কাটলে এমন হওয়াই তো স্বাভাবিক।

দাদি বলতেন, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে, জরিনার জীবনেও তাই ঘটেছে।

এয়ারহোস্টেস হবার স্বপ্ন প্রথমেই ভেঙে গিয়েছিল, হতে পারল না সুসান উইন্ডিব্যাংকের মতো ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকÑচিরাচরিত নিয়ম মেনে হয়ে উঠল সে মধ্যবিত্ত সংসারের গৃহিণী। আধুনিক যুগে যাদের বলা হয়Ñহোমমেকার।

অবুঝ মেয়ের মতো উত্তাল অভিমান জাগে বুকের ভেতরে, কী করেছি এতদিন ? শীতের রকমারি সবজি দিয়ে পাঁচমিশালি সুস্বাদু তরকারি রেঁধেছি। টিভি আর ইউটিউব থেকে রান্নার রেসিপি নিয়ে নতুন আইটেম রেঁধেছি স্বামী-পুত্র-কন্যার জন্য, এই করে জীবনের মূল্যবান সময় কাটিয়ে দিলাম আর কিছু নয় ? উচ্চতা-আকাক্সক্ষা সব জালাঞ্জলি দিয়ে দিলাম ?

কী বোকা আমি!

বছরে এক-দুবার সিঙ্গাপুর, টরেন্টো নয়তো আমেরিকা-কানাডায় বেড়াতে যায় চেনা মানুষেরা।

শুধু নাজিফা-সোমারা কেন, রেজার অফিসের কলিগরা কিংবা চেনাজানা মানুষরা প্রায়ই এদিক-ওদিক আউটিংয়ে যান, একঘেঁয়ে দিন-রাত কাটাতে কাটাতে হাঁফিয়ে ওঠে ওরা। সবাই দূরে না যেতে পারলেও তামাবিল, শ্রীমঙ্গল চা-বাগান কিংবা মাধবকুণ্ড ঘুরে আসে। সেই স্বল্প সময়টুকুও আজও পর্যন্ত রেজাউল তার অফিস টাইম থেকে বের করতে পারেনি। ক্যাজুয়েল লিভ ফুরিয়ে যায় আসুখের কারণে কিন্তু আর্ন লিভ ? ছেলেমেয়ে দুটিকে সঙ্গে নিয়ে গেলে ওরাও তো এনজয় করতে পারে।

জরিনার নাভিমূল হতে উত্থিত হতে থাকে ব্যথার নিঃশ্বাস এয়ার হোস্টেস হয়ে দেশ-বিদেশে ঘুরতে পারিনি জার্নালিস্ট সুসান উইন্ডিব্যাংকের মতো হতে পারেনি, গগাঁর মতো সেই সবুজ রঙের ব্রিটানি দ্বীপ দেখার স্বপ্নপূরণ হয়নি। কিন্তু চলমান এই যুগের সাথে ছন্দ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে তো পারতাম। রেজার মতো পথসঙ্গী হলে কি আর জীবনে সফলতা আসে ? ব্যথার নিঃশ্বাস বাতাসে পাক খেতে থাকে। মানুষটা সেলফি তুলতে জানে না। এখনও মায়ের তোরঙ্গে পুরানো শাড়ির ভাঁজে রাখা নেপথোলিনের গন্ধ, মায়ের মাখা কান্তা সেন্টেরে শিশি আর তিব্বত স্নোর গল্প করতে ভালোবাসেÑএখনকার যুগের আর দশটা মানুষের মতো সে নয়। একেবারেই অন্যরকম। অনেকটাই ইনট্রোভার্ট।

কেউ অন্যায় করলে রেজাউল প্রতিবাদ করেন না। মেনে নাও, সব মেনে নাও। প্রায়ই বলেন, রেগে যাও কেন জরি ? ওসব ওভারলুক করতে হয়।

এতদিন তো এমন ভালো কখনও মনে আসেনি। নাজিফার বাড়িতে একটি বিকেল ও সন্ধ্যা কটিয়ে এসে জরিনা উপলব্ধি করেÑ জীবনের চাকা গড়িয়ে জরিনাকে পেছনে ফেলে অনেকদূর চলে গেছে। সে ছুঁতেও পারবে না এই নবজীবনকে।

সংসার আগের মতোই চলে। সকাল হয়, রুবেল-গিনি স্কুলে যায়। বুয়া বাসন মাজে, ঘর মোছে। জরিনা রান্না চাড়িয়ে দেয়। সবই আগের মতো চলছে। রেজাউল অফিসে যায়, ফিরে আসে নিজের বাড়িতে। নাশতা খেয়ে চায়ে চুমুক দেয়। শুধু তিনি অনুভব করেন, জরি আর আগের মতো নেই। রোবটের মতো তার চলাফেরা, কোথাও যেন প্রাণ নেই। সংসারে আগের মতো ছন্দ নেই।

এই প্রাণহীন সংসারের ভাবনাটাই হঠাৎ করে তাকে উজ্জীবিত করে তোলে। তীক্ষè বর্ষার ফলার মতো জরির মুখ থেকে হঠাৎ শোনা ‘সাড়ে মানুষ’ শব্দটি তাকে শরীর ও মনে আহত করে তোলে, ‘সাড়ে মানুষ’ মানে অর্ধেক মানুষ, তিনি পূর্ণ মানুষ নন। সত্যিই আমি তাই কি জরি ?  

 অফিস কলিগরাও তাকে বিদ্রুপ আর ইয়ার্কিতে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। সবই বোঝেন তিনি, ভাবেন এসব নিয়ে উচ্চবাচ্য করে কী লাভ ?

এতদিন এসব গা সহা ছিল। কলিগরা তাকে বলবেই আর তিনি তা সয়ে যাবেনÑএ যেন এক অলিখিত নিয়ম। ওদের সঙ্গে কী কথা বলব ? কথায় কথা বাড়েÑএ ছিল রেজাউলের মনোভাব।

নতুন ছেলেমেয়েরা যারা এসেছে, কী স্মার্ট ওরা। ব্ল্যাক কফি কিংবা লেমন টি’র অর্ডার দেয়, স্যান্ডউইচ মুখে দেয়। পিয়নরা তড়িঘড়ি করে ওদের হুকুম তামিল করে। ওদের কথাবার্তা যেন নির্দেশের মতো।

রেজাউলের চেহারায় একটা ভীরু ভীরু ভাব রয়েছে, সন্ত্রস্ত থাকেন সবসময়। এই বুঝি কাজে ভুল হয়ে গেল। বস্য়ের কিউবিকলে এক্ষুনি হয়তো ডাক পড়বে তার সারাক্ষণ এই অহেতুক ভাবনা তাকে কুরে কুরে খায়, তাই হয়তো হালকা বিষণ্নতার প্রলেপের ছোঁয়া জড়িয়ে থাকে তার চেহারায়।

সহকর্মী ফিরোজ প্রায়ই সহমর্মী হয়ে বলেন তুমি বড্ড জের্নাস্। নিজেকে বদলাও। দিন পাল্টে গেছে।

এ কথা বলছ কেন ?

তুমি বড় বিনোভোলেন্ট, এত সদাশয় হলে কি চলে ? রেজাউল স্বপক্ষে জবাব দিয়েছিল, বস যদি বলেন চিঠিটা টাইপ করে দিতে কিংবা বদলির এই অর্ডারের কপি তৈরি করতেÑতাহলে কি আমি না করতে পারি ?

ফিরোজ বলেছেন, অফিসে কি আর লোক নেই? ফজলুল, জিনাত ওরা তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ায়। ওরা পাঁচটার পরে আর অফিসে থাকে না। তুমি কেন সড়ে আটটা নয়টা পর্যন্ত কম্পিউটারের সামনে বসে থাকো ? তোমার ছেলেমেয়ে রয়েছে, ভাবি আছে, সংসারে তোমার প্রয়োজন আছে। আমার কথাগুলো ভেবে দেখ রেজা। কথা থামিয়ে ফিরোজ হেসে উঠেন।

তোমাকে বোঝাতে গিয়ে ছোটখাটো একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললাম রেজা ভাবেনÑতাইতো। সব ক্ষোভ তার বুকের ভেতর ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে উঠতে থাকে। যুগের সাথে তাকেও পাল্টাতে হবে।

তার ভেতর থেকে সোনালি কেশর নাড়িয়ে ক্রুদ্ধ সিংহের মতো গর্জন করে উঠে অন্য এক মানুষ।

তুমি জাগো রেজাউল, তুমি উত্থিত হও। স্ত্রী সন্তান পরিবৃত নিজের সংসারের দিকে তাকাও। নিজের ন্যায্য অধিকার আদায় করতে রুখে দাঁড়াতে হয়, প্রতিবাদ করতে হয়। তুমি ঊর্ধ্বশির হও। গর্জন করে ওঠো।

ঝাঁকড়া চুলো ইয়াং ছেলে গালিব বলে, ব্যালেন্স শিটে নাকি গণ্ডগোল পাকিয়েছেন, যান কারেকশান করে দিয়ে আসুন। যান বিগ বস ডেকেছেন। পিয়ন এসে দুপুরে ঘুরে গেছে।

মুখ-মুচকে হাসছে আন্যরাও।

সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি, একসময় গালিবের মুখের দিকে এসে স্থির হয় চোখ। চিকেন স্যান্ডউইচে কামড় দিয়ে খুব রেলিশ করে খাচ্ছে সে। বারবার রুটি-তরকারি খাওয়া মানুষটি আজ গর্জন করে ওঠেনÑচোপ।

ওরা তো অন্য গ্রহের বাসিন্দা নয় তবে কেন আমি ওদের সামনে অবনত হয়ে থাকি ? আমি সাড়ে মানুষ বলে ? বুকের ভেতর তীব্র জ্বলুনি হতে থাকে তার।

দুই অক্ষরের একটি শব্দে সবাই থমকে গেল, দু-চার জন যারা বিদ্রুপ আর রসিকতা করে আনন্দ পেত ওরা হতবাক হয়ে গেল।

রেজার উরু-হাঁটু আর পায়ের পাতায় যেন আজ ভর করেছে হারকিলিউসের মতো অফুরন্ত শক্তি। গটগট করে জিএমের চেম্বারে গিয়ে ঢোকেন।

অভ্যাসমত বস সিরাজ আহমদ তৈরি হয়েই ছিলেন। টেবিলে রাখা ফাইল ছুঁড়ে ফেলে দেন কার্পেটের ওপর।

তুলুন, ফাইলগুলো তুলুন বলছি। আই সে, পিক আপ।

নাহ। পিয়নকে ডাকুন সে তুলে দেবে। আর ভুলের কথা বলছেন ? ফাইলটি তো আরও দুটো টেবিল ঘুরে এসেছে, তারা নোট দিয়েছেন, সিগনেচারও আছে ওদের। আমার ওপর রাগ করেছেন কেন স্যার ?

এ কি তার কণ্ঠস্বর ? গলায় যেন তার সমুদ্রের সফেদ গর্জন। তবে যে জরিনা একদিন বলেছিল, জানোÑঅন্যায়ের প্রতিবাদ না করতে করতে মানুষ একসময় মিইয়ে যায়।

কই, তিনি তো মিইয়ে যাননি। আলৌকিক এক আনন্দে জিএমকে হতবাক করে দিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসেন রেজাউল।

নীরব সবাই। শুধু ফিরোজ অন্তরঙ্গ এই সহকর্মীর পিঠ চাপড়ে বলেন, ব্রেভো ব্রাদার ব্রেভো।

অপূর্ব এক মানসিক শক্তি তাকে যেন জাগিয়ে তুলে নতুন করে। কী করে তিনি বসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এত কথা বলতে পারলেন ?

ফাইল দেখে দেখেই জীবন কেটে গেল স্যার। কম্পিউটারের সামনে বসে শুধু চিঠিই ড্রাফট করলাম। বলুন তো স্যারÑকোনও ট্রেনিংয়ে কি আমি চান্স পেয়েছি ? বিদেশে কোনও কনফারেন্সে যেতে পারিনি। কলুর বলদের মতো শুধু কাজই করে গেলাম।

অভাবনীয় এই ঘটনা ঘটে গেল। ফিরোজ ভাবলেন কোনও অ্যাকশন হয়তো নেয়া হবে অফিস থেকে। কিন্তু কিছুই হলো না, ব্যাপারটি ধামাচাপা পড়ে গেল। কারণ রেজাউল যা বলছেন, তার একটি কথাও তো মিথ্যা নয়।

হ্যাঁÑরেজা সৎ, কর্মঠ ও দক্ষ অফিসার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সব হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। অফিসিয়াল চিঠি ড্রাফট করার ক্ষমতা তার অসাধারণ।

মানুষটি দিনের পর দিন কলিগদের কাছ থেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ উপহার পেয়েছেন, বসের কাছ থেকে ধমক খাওয়াকে তিনি অঙ্গের ভূষণ করেই নিয়েছিলেন। এই আলাভোলা আর গোবেচারা মানুষটির হঠাৎ জেগে ওঠায় মনে মনে খুশিই হয়েছেন ফিরোজ।

রেজাউলের হাত ধরে বলেন, চলো ক্যান্টিনে যাই। আজকের দিনটাকে সেলিব্রেট করা যাক।

সত্যিই সেলিব্রেশান হলো। দিনের আলো নিভে ফিকে সন্ধ্যা নেমে আসেনি, সেই সময়ে বাড়ি ফিরে এলেন রেজাউল।

মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে জরিনা। যাক, এতদিনে তাহলে চৈতন্য হলো। ফিরোজ সাহেবের ফোন থেকে আজকের ব্যাপারটি জেনেছে সে। নিজের ভালো-মন্দ না বুঝলে জটিল এ যুগে পথচলা তো সহজ নয়। অভাবনীয় হলেও ব্যাপারটি সত্যি।

বেশ কাটল কটা দিন। নিশ্চিন্তে, নিরুদ্বেগে। সন্ধ্যাবেলা রুবেল-গিনির পড়ার টেবিলের পাশে চেয়ার টেনে বসেন। ইংরেজি বই নিয়ে বসে ওরা আব্বুর কাছে। জটিল অঙ্কও বুঝিয়ে দেন, রেজাউল।

নাজিফার বাড়ির মন কেমন করা সন্ধ্যাটি কোথায় যেন হারিয়ে যায়। নিজের সংসার আর পারিবার নিয়ে নিমগ্ন হয়ে যায় জরিনা। জীবনে পরিপূর্ণ  সুখ পায় না অনেকেই যা পেয়েছে জরিনা তাতেই তো এতদিন মগ্ন হয়ে থেকেছে। রেজা অন্তত, সংসারের দিকে মনোযোগ দিয়েছে, এই বা কম কি ?

আপন মনে ভাবে জরিনা, প্রকৃতির ঋতুবদলের মতো মানুষের স্বভাবেরও বুঝি পরিবর্তন হয়।

অন্যদিনের মতো বিকেল নামল। তারপর সন্ধ্যা এল কিন্তু রেজাউল অফিস থেকে ফিরলেন না।

ছেলেমেয়ে পড়ছে, সময় কাটেছে না শুধু জরিনার। এখন অনেক আগেই অফিস থেকে ফিরে আসেন। আজ হলোটা কী ? ব্যালকনি থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে জরিনা। নটা বাজে এখনও তো এল না। মোবাইলে ট্রাই করেছে দু-তিনবার। সুইচ অফ।

অভ্যাস-বশে রাতের খাবার তৈরি করে সে। বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করে। বিপদ-আপদ হয়নি তো। ভাবনায় ভাবনায় গোটা শরীর অসাড় হয়ে আসে।

পৌনে এগারোটা বাজলে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, তোর আব্বুর ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন রে ?

রুবেল হালকা গলায় বলে, ভাবছ কেন আম্মু ? এই কদিন একটু অনিয়ম করেছে, আবার হয়তো নিজস্ব ফর্মে ফিরে গেছে।

বাজে কথা বলিস না তো।

গিনি হেসে বলে, বস হয়তো আব্বুকে বলেছে আপনার মতো ফ্লাওয়ারি ইংলিশ কেউ লিখতে পারে না, চিঠিটা ধরুন রাতেই কাজটা সেরে রাখুন, ফার্স্ট আওয়ারে ডেসপাস হবে।

কী করে যে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা এত নির্বিকার থাকে। জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে জরিনার। পথের দিকে তাকিয়ে থাকে স্বামীর আসার প্রতীক্ষায়।

হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে গিনি।

এই যে আব্বু আসছে। হাতে অফিসের ফাইল নাকি ?

যা-ই থাকুক, মানুষটি তো ফিরে এসেছে। সোয়া এগারোটা বাজে। হাতমুখ ধুয়ে, জামাকাপড় ছেড়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসেন।

উচ্ছ্বসিত গলা রেজাউলেরÑব্যাগ থেকে খাবার প্যাকেটগুলো বের করো। তোমরা খাওনি তো!

জরিনা বলেÑএমন দুশ্চিন্তায় ফেলেছ, এমন অবস্থায় কেউ খেতে পারে ?

তাও ঠিক।

গিনি টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে। ম-ম গন্ধে ভরে উঠেছে ডাইনিং স্পেস।

খুশিতে লাফিয়ে ওঠে রুবেলÑওয়াও।

ছেলেমেয়ে অন লাইনে অর্ডার দিয়ে খাবার এনে খায় কিন্তু আব্বু কখনওই তো আনেনি। তাই আজ দারুণ মজা।

মোরগ পোলাও, রেশমি কাবাব, গার্লিক নান, গ্রিলড চিকেন।

আজ আমাদের ক্যান্ডেল লাইট ডিনারÑবলে মোমবাতি এনে সাজাতে থাকে গিনি আটপৌরে টেবিলটি।

একরাশ আনন্দে ভরে যায় বাড়ি।

খেতে খেতে রুবেল বলে, তুমি বসো আম্মু একসাথে খাই। গিনি বলে, আব্বু একটু একটু করে চেঞ্জ হচ্ছে। ফ্যানটাসটিক ব্যাপার রেজাউল খেতে খেতে বলেন, মাইনের টাকা তো পেয়েছি, ইনক্রিমেন্টও হাতে এল, তোর আম্মু রোজই রান্নাবান্না করে রাঁধতে রাঁধতে জীবনটা ওর শেষ হয়ে গেল। আজকের রাত একটু অন্যভাবে কাটুক।

আমার কথা ভাবে ও ? কি শুনছে জরিনা ? রুবেল বলে, খাবার এনেছ ভালো কথা, ফিরতে এত দেরি হলো কেন! গিনি বলে তুই গোয়েন্দাগিরি করছিন ভাইয়া ? আব্বুর কি একটু ঘোরাফেরা করতে ইচ্ছে করে না ? জরিনা ভাবে এই যে পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে!

গিনি-রুবেলের খুশির অন্ত নেই।

জরিনা বলল, যাও এবার ঘুমোতে যাও, অনেক রাত হয়েছে। গিনি আদুরে গলায় রেজাকে বলে, আমরা মাঝে মাঝেই কিন্তু আজকের মতো ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার করব আব্বু।

খাবার দাবার সব ফ্রিজে তুলে রেখে ঘরে যখন এল জরিনা তখন রাত প্রায় পৌনে একটা।

রেজা বলল, আমার ফোলিও ব্যাগটা নিয়ে এস তো জরি।

ব্যাগ থেকে বেরোয় সুদৃশ্য একটি প্যাকেট।

এ আবার কী ?

দেখো তো পছন্দ হয় কি না? তোমার গিফট। শাড়িটা হাতে ধরে জরিনা শুনতে থাকে রেজাউলের কথা।

একাউন্টস সেকশানের রুমানা, শাহিন, ইউসুফ ওদের একটা গ্রুপ আছে, প্রায়ই কেনাকাটা করতে যায়। আমি যাব বলতেই বলল, চলুন স্যার, ভাবির জন্য দেখেশুনে শাড়ি কিনবেন।

জানো, প্রথম গোলাম বেইলি রোড়ে। শাড়ির ভাঁজ খুলে দেখতে দেখতে শাহিন বলল, আজ বেনারসি পল্লিতে যাওয়া যাক। আমি তো কোনওদিন কোথাও যাইনি, জানিও না কিছু। জিজ্ঞেস করলামÑকোথায় ?

শাহিন বলল, মোহাম্মদপুরে স্যার। আপনার তো জানার কথা নয়, কখনও তো কেনাকাটা করতে দেখিনি, ভাবি নিশ্চয়ই সব দিক ম্যানেজ করে নেন।

রেজার কথাগুলো দূরাগত ধ্বনিও মতো বাজতে থাকে জরিনার কানে। হাতের শাড়িটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে সে। প্রায় দেড় যুগ আগে হলুদ রঙ বেনারসির জন্য আবদার করেছিল স্বামীর কাছে।

কী অপূর্ব শাড়িটির রঙ।

ডিমের কুসুমের মতো ? চকচকে সোনার মতো ? কাঁচা হলুদের মতো ?

এই মধ্যবয়সে রোমাঞ্চিত হতে থাকে জরিনা।

শরৎ কিংবা হেমন্ত ঋতুতে বৃষ্টি নামলে যেমন অকাল বর্ষণ বলে, তেমনই কি আজ এই রুখুসুখু ঘরে আকাল বর্ষণের মতো নেমেছে ভালোবাসার বৃষ্টি ?

ওর কবেকার ছোট্ট আবদার তাও মনে রেখেছে সাদাসিধে মানুষটা। এই গিফট, এ তো বহুমূল্য রত্নের মতো।

সংসারের তাপে সেঁকা শরীরে শিহরন জাগে জরিনার। চোখ ভিজে ওঠে অশ্রুতে।

ঝাপসা চোখে দেখতে থাকে পূর্ণপুরুষটিকে।

 সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button