আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

স্মরণসভার ভ্রান্ত পুণ্য : মামুন হুসাইন

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : বাংলাদেশের গল্প

আপনার হাতের আংটি কি পাথরে তৈরি ?

—শমসের চশমার উল্টো দিকের রক্ত-অশ্রু-ছায়া ফ্লানেলের টুকরা দিয়ে পরিষ্কার করার ফাঁকে নিজেকে প্রশ্ন করে : আপনি কি একজন চালিয়াৎ প্রকৃতির মানুষ ? কিছুটা ঠিক। আপনি কি স্পষ্ট ও খোলামেলা ধরনের ?

—কিছুটা ঠিক। আপনি কবিতা না লিখেই স্রেফ হুজুগে কবি হয়েছেন ?

—কিছুটা ঠিক।

আপনি কি যথার্থই শক্তিশালী ?

—কিছুটা ঠিক।

শমসের চশমা, হাতঘড়ি ও কলম থেকে ক্রমাগত নৈঃশব্দ ও অনুতাপ ঝরে পড়তে দেখে, একবিংশ শতাব্দীর কোনও এক শীতল-ভেজা-মন্থর ডিসেম্বরে—যখন সে দুর্বোধ্য স্থাপত্যের মতো তার সদ্যমৃত কনিষ্ঠের হীম শীতল শরীর ছুঁয়ে বসে আছে একবুক অন্ধকারে। এই বসে থাকার নিপুণ ক্লান্তি তারপর আঘাতে-অভিমানে-ভালোবাসায় নিমজ্জিত হওয়ার কৌশল নির্মাণ করায়—কনিষ্ঠের শিথিল দেহ ক্রমশ মাটির ভেতর অথবা হৃদয়ের ওপর বিশাল আঁধার-জ্যোৎস্না হয়ে আড়াআড়ি শুয়ে পড়ে। অনুতপ্ত ঘাতকের মতো আমরা অপর ভ্রাতৃসম্প্রদায় কবরের অন্ধকার ছুঁয়ে, কবরের স্যাঁতসেঁতে মাটি ছুঁয়ে, মুখ ফিরিয়ে বসে থাকি নিজেদের সঙ্গে কথা না বলে।

গত ডিসেম্বরের শেষ বৃহস্পতিবার আমাদের কনিষ্ঠ, মাটির স্তব্ধ-ম্রিয়মান আঁধারে শায়িত হলে, আমরা যদিওবা এই প্রকার নির্বাক হই —কিন্ত মা হয়ে পড়েন স্পর্শাতীত দুর্বোধ্য, ভীত-বিহ্বল ও মর্মান্তিক। তার ঝাঁপবদ্ধ আত্মা নিষ্করুণ লাবণ্যে অতি গভীর রাতে জেগে উঠে অশ্রুপাত করে। কনিষ্ঠের হামাগুড়ি দেয়া শিশুপুত্রকে চুলের স্রোতে ডুবিয়ে মৃত পুত্রের ঘ্রাণ আঁচ করার চেষ্টা হয় একবার। মা যেনবা চৌকাঠের ওপারে দীর্ঘকাল দাঁড়িয়ে অথবা হাঁটেন নিশব্দে। অযুর ঠাণ্ডা জল ছুঁয়ে ঝরে পড়া ঈষৎ কান্নাময় প্রার্থনা ক্রমশ তাকে আরও শ্লথ ও মন্থর প্রাণীতে রূপান্তরিত করে। শমসের, হাসান ও কালাম—এই তিন জীবিত আত্মজ তার কাছে পৌঁছলে কখনও তিনি বাহু নেড়ে শুয়ে পড়েন, অন্ধকার পান করেন এবং দেয়ালমুখো হয়ে ফোঁপাতে শুরু করেন। কান্না থেমে গেলে এখানে অন্ধকার ছাড়া অন্য কোনও শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না; কখনও প্রার্থনায় দুহাত তুলে মা নতজানু হয়ে প্রথমে নম্রসুরে এবং পরে বেদম হেঁচকি তুলে ফাঁসি-দেয়া মাঠের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ঈশ^রের সঙ্গে ছওয়াল-জবাবে লিপ্ত হন। ঐ প্রার্থনাজুড়ে মৃত আত্মাদের স্বপ্ন, ঘুম, শরীর ও দীর্ঘ অবসরের দিন-রাত্রি ভেসে উঠলে প্রার্থনার স্তোত্র ক্রমাগত হয় ভুল ও মূঢ়। অথবা মায়ের কথা এবং আমাদের কথা অপরাপর কথার বিপক্ষে ঝরে গিয়ে প্রতিভাহীন মৃত্যুর আপ্রাণ-কালো দূরে বিক্ষুব্ধ হয়।

আমাদের অন্তরীক্ষে তখন স্থাপিত হয় আরও হাজার মুখের চিন্তা, ঘূর্ণন ও ক্ষয়। সারাক্ষণ জমে থাকা কথা আমাদের অপরাপর কথার বিপক্ষে ঝরে যায়; আর আমরা সহোদরের পূর্ব নির্ধারিত স্থির মুখ খোঁজার জন্য কবরের ছিদ্র ও ফাটলে চোখ রেখে—আমাদের গর্জন-মুখর সমস্ত অনুতাপ ও বৃষ্টির দৃশ্যপট আহার করি নৈঃশব্দে।

হামাগুড়ি দিয়ে এ-ঘর ও-ঘর বাবাকে খুঁজে বেড়ানো—মৃত ভাইয়ের এই শিশুপুত্রের না-আঁচড়ানো চুলে হাত রেখে, কখনও আমরা তার বাবার নিকনেম প্রতিস্থাপন করার সুযোগ খুঁজি। এই বাড়ির সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্রের কাতর ছায়া এবং স্বপ্নে—ভ্রাতৃবৃন্দ অপেক্ষমান-দুর্বোধ্য যন্ত্রণার ঘ্রাণ পায় কখনও। কখনও আমরা একত্রে কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিই, আর আবারও পরাজিত হই—দৃষ্টিশক্তি ধ্বংস হয়ে যাওয়া মা, পুরনো বালিশে শায়িত হয়ে দুঃখের ঋণ শোধ করার জন্য খণ্ড খণ্ড মূঢ় অনুতাপের শরীর আরও বিচূর্ণ করে চলেছেন অনমনীয় প্রতিজ্ঞায়। মৃত ভ্রাতার না আঁচড়ানো চুলের পুত্রকে অতঃপর—প্রখর আস্বাদ করার জন্য, নাকি মৃত পুত্রের শরীর-চোখ ও সাদা বুক পরখ করার জন্য—দিগন্তব্যাপী নির্মাণ করে চলেন রুগ্ণ বোবা গানের ওপর আরও অধিক রুগ্ণ বোবা গান।

আমাদের বাড়িঘর এই বোবা গানের ভেতর ডুবে গিয়ে ক্রমশ নির্মাণ করে অন্য এক দুর্জ্ঞেয় আঁধার অথবা নির্মিত হয় জটিল বিন্যাসের এক নিঃসঙ্গতা। আমরা দেখি : একটি মাকড়সা আরেকটি মাকড়সার পিছু নেয়। আমাদের যৌথ পরিবারের সবাই যেনবা ক্লান্ত এবং শরীরের হাড়গুলো ভেঙে পড়ার মতো। আমাদের চোখে ঈর্ষা, অসহায়তা এবং কপট ভয়। আমরা শোক-পরবর্তী অনুষ্ঠানাদির জন্য হই অধিক ছলনাময়, চতুর ও বুদ্ধিমান। আমাদের শিশুরা দাবার ছকে চাল দেখার প্রতিপক্ষ সেজে ঠোঁটে প্রৌঢ়ের হাসি ছড়িয়ে তাকায়।

কনিষ্ঠ ভ্রাতার পরিপক্ক-নিশ্চিত মৃত্যুদৃশ্য দেখতে-দেখতে অতঃপর আমাদের কান্নাসমুহ হয় উজ্জ্বল, সাবধানী ও অপরাধী। স্বপ্নের ভেতর কেউ ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠে। আমাদের নিশ^াস হয় আরও মূর্ত এবং তেজস্ক্রিয়। মা অথবা আমাদের একমাত্র ভগ্নী মাথা ঠুকরে, উল্টোদিকের বাড়ির ছাদে লাল ঝুঁটির কবুতর দেখার সফলতা খুঁজতে বসে। মায়ের আঁধার মুখে দূর-বাদুড়ের ছায়া পড়ে, মৃত্যুদিবসের সন্ধ্যা হয় আরও ফ্যাকাসে ও রক্তহীন। অথবা আমরা ভাবি—আমাদের মায়েদের গর্ভে কোনওদিন যেনবা আলো ছিল না, ছিল কেবল শোকের অন্ধকার। কে জানে—দূর বাগান-বাড়ির স্তব্ধতায় আমরা কতিপয় সহোদর-সহোদরা—এই অন্ধকার সুড়ঙ্গ পাড়ি দিয়েই হয়তো ভূমিষ্ঠ হই। আমাদের মাথার ভেতর এবং চোখের সুড়ঙ্গের ভেতর কেবল আন্দাজ করি শোকের অন্ধকার ও অপ্রতিভ সংকোচ। মা যত্ন করে ছেলের সর্দি মুছিয়ে দেয়। হাউজকোটহীন মা লাউ, হলুদ এবং নুনের গন্ধমাখা শাড়ির ভেতর আমাদের মুখ জড়িয়ে ধরে এবং আমাদের ঘাম ও ঘুমের মৃদু রস শুষে নেয়।

এবার কনিষ্ঠ ভ্রাতার মৃতদেহ কিংবা মৃত্যুর লৌহ-ঘুম ছুঁয়ে মা নির্মাণ করেন এক অদ্ভুত দ্যুতিময় শূন্যোদান। আর কোনও গত্যন্তর নেই—এই ভঙ্গিতে আমরা দেরাজ, টেলিফোন ও জানালা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমাদের রেলিং জুড়ে মৃত সহোদরের ঘ্রাণ, শৈশব ও সমুদ্রের অতল। তোমাদের মনে পড়বে : জিভ বের করে আগুনে সাপের হাঁ দেখানোর খেলা ছিল আমাদের কালে। দূর মাঠ থেকে ভেসে আসা আগুন দেখার খেলাও, আমাদের গন্ধ পেয়ে লোভী হয়ে উঠত। ফুলের রং ধারণ করা কোনও জীব কিংবা মেয়ে সেইসব কালে আমাদের স্বপ্ন দেখাত : আমরা প্রজাপতির মতো কোথাও বিরাজ করি অথবা প্রজাপতির শরীর আলাদা করে স্বপ্নে মানুষ হিসেবে অবস্থান করি। আমাদের আকাশে মেঘ হয়, বিষ্টি হয়, বিষ্টি-মেঘের আঁকিবুঁকি হয়, ভয়ের সংক্রমণ হয় এবং আমাদের শৈশব-কৈশোর হয় অস্পষ্ট-আবছায়া দিগন্ত খুলে রাখা অন্তহীন দরজা। অকাল প্রয়াত অনুজ, যার কাছে সঞ্চয় ছিল আমাদের পিছুটান, ছায়া চিত্র ও অমীমাংসিত ছেঁড়া কথা—এবার আমাদের বিমূঢ়তা ধাবিত হয় সেই দিকে। দেখি স্কুল ঘর দাঁড়িয়ে, আর আমি জানালায় উঁকি দিয়ে আমাদের ডেস্ক দেখছি। একটু লম্বা পা ফেলে যাওয়ার জন্য বাড়ির পথ হতো ছোট। আমরা রাস্তায় অথবা দেয়ালে ছবি আঁকতাম। বলে লাথি দিতে দিতে রাস্তা পাড়ি দিতাম। কোথাও কোনও পুরনো গ্যারেজে বই রেখে আবার খেলতাম সারা দুপুর-বিকাল। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে চার আনা-আট আনার কুলফি মালাই কিনেছি, এখন সেখানে শিশু কল্যাণ কেন্দ্র। আমি হাঁটছি আর বাবাকে দেখছি, দোকান শেষ করে বাগানের ভেতর। বোনকে দেখছি, যার সাথে আমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। উর্দু ভাষী বন্ধুকে বল খেলার দলে নেই, আবার ঝগড়াও করি। আমাদের এক বন্ধু রেলওয়ে গার্ডের চাকরি নিয়ে পতাকা উড়াতে-উড়াতে নিঃশেষ হয়। একজন একই ক্লাসে থাকে দুইবার এবং স্কুল পরিত্যাগ করে নিশব্দে। একজনের ছিল তোতলামির সমস্যা, একজনের ক্লেফট লিপ, একজনের ছিল রক্তের অসুখ—মাঝে মাঝেই রক্ত নেয়ার জন্য স্কুল কামাই হতো।

বন্ধুদের মুখ, এভাবে বেসুরো গলায় গান শোনায়, দেয়াল ঘেঁসে লুকায় অথবা দূর পৃথিবীতে সমাহিত হয়। জগত-সংসারের সকল মায়ের ফুঁপানি এবার ধীরে ধীরে বেগবান হয়। অকাল প্রয়াত কনিষ্ঠের চোখে মৃত্যুর লৌহ ঘুম দেখতে দেখতে মা বিস্তৃত হয় আশ্রয়ের খোঁজে। অনুভব হয়—মা তার ঘরবাড়ি, উঠান এবং পাখির খাঁচার শূন্যতায় রচনা করছে লুকানো গল্প এবং তির্যক-স্বচ্ছ ধারাভাষ্য। দুপুরের সাদা ক্রমাগত উদাসীন আলো এবং বিকেল-সন্ধ্যায় ছোপ ছোপ অন্ধকারে মায়ের পরিপাশর্^ এবং মুখচ্ছবি—খুঁজতে বসে অনন্ত দিনের ভুল পাঠক্রম। মা ভাবেন : শিশুরা বড় হয় অথবা হঠাৎই মৃত্যুবরণ করে, আর শিশুর শূন্যতায় সকল বাসনা, সুখ ও ইচ্ছে তাৎক্ষণিক নিশ্চিহ্ন হয়। তারপর মায়েদের আবার সন্তান হয়, মায়েরা নিষ্ফলা হয়, হয়তো মায়েদের আরও অধিক সন্তান হয়, সন্তানসমূহের কিয়দংশ মৃত্যুবরণ করে দ্রুত কিম্বা কিয়ৎকাল পরে। কখনও এমন হয়—জন্মের অব্যবহিত পরে অথবা সপ্তাহ শেষে, মাস শেষে মৃত্যুবরণ করল নবজাত শিশুটি—কিন্তু এই মৃত্যুশোক অন্য মানুষের তুলনায় কিছুমাত্র কম নয়। শিশুর মৃত্যু একক মানুষের মৃত্যুই বটে। শিশু-অভ্যর্থনায়, বাবা-মায়ের আয়োজন এত ব্যাপক থাকে যে—শিশুর মৃত্যু তাদের কাছে একটি অংশের মৃত্যুই বটে। স্মরণ হয়—তোমাদের এবং আমাদের মহল্লায় এই প্রকার মৃত্যুদৃশ্য নির্মাণ হয় অবিরত। হয়তো শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয় কন্যা রূপে। মা তার ভেজা চুল ছুঁয়ে চুমু খায় এবং কথা বলে। মা ক্লান্তিতে ঘুমায়; আর সদ্য নীল হয়ে যুদ্ধ করতে করতে আঠাশ ঘণ্টার কন্যা স্পেশাল কেয়ার বেবি ইউনিটে ঘুমিয়ে পড়ে চিরকালের মতো। এই মায়ের অথবা আমাদের অপর প্রতিবেশী মায়ের একটি শিশু, অনেককাল আগে, গর্ভের ভেতর নিশ্চুপ হয়ে পড়লে জানা গেল তার হৃৎস্পন্দন সুদূর নিমগ্ন ও বিপর্যস্ত। নার্স মনিটর বদল করে করে হৃৎকম্পনের তত্ত্ব তালাশ করে—‘শিশুরা মাঝে মাঝে এত অদ্ভুত ভঙ্গিতে গর্ভে থাকে যে, হার্টবিট খুঁজে পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে।’ আমরা খুশি হই, আশাবাদী হই; ডাক্তার এলো এবং ডাক্তার-নার্স বিস্তর আয়োজনে অবশেষে বিসর্জনের ছবি নিশ্চিত করে—বেবি ওয়াজ ডেড, ইন্ট্রাইউটেরাল ডেথ … : আমার ভেতরের অনুভূতি আপনাকে বোঝাতে পারব না। ভয়, কিম্ভুত প্রহসন অথবা নিগূঢ় সংকেত বার্তা—আমাকে একটি মৃত শিশু প্রসব করতে হবে। মধ্যরাতে আমার শিশুটি এল—নিখুঁত, পাঁচ পাউন্ড চার আউন্সের নিখুঁত অপরূপ ছোট্ট বালক, যেন সে ঘুমিয়ে আছে নিবিড়।

 আমাদের মায়েরা সংক্ষেপে, বলা যায়—এই প্রকার প্রাচীন বাক্যবন্ধে তাদের অমীমাংসিত প্রশ্ন, মুহ্যমান স্বগতোক্তি ও সম্মিলিত ধ্বংসস্তূপ ঘোষণা করে। আর বেঁচে থাকা অপর সন্তানের চিবুক ছুঁয়ে, চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে—কখনও ফের মৃত শিশুর মুখ ভেবে ভুলক্রমে ফোঁপাতে ফোঁপাতে নির্মাণ করে শিশুর শৈশব, শিশুর নির্জন বিষাদ কাহিনি এবং ব্যক্তিগত স্বপ্নের সম্প্রসারণ। স্বপ্ন ও স্বপ্নের সংশয় জমা হতে হতে কখনও মায়েরা আবার সন্তানসম্ভবা হয়; নতুন কন্যা বাঁচে পনেরো ঘণ্টা—মায়ের জরায়ু হয় বিস্ফোরিত এবং বাধ্যতামূলক শল্যচিকিৎসায় তিনি হন চিরকালের জরায়ুমুক্ত। মহল্লায় অপর মা জানতে পারল গর্ভের কন্যা, তখন অ্যানেনসেফালিক, অতএব প্রেগনেন্সি টার্মিনেট করতে হবে। লোকেরা জিজ্ঞেস করে—ভূমিষ্ঠের পর যখন দেখলেন তখন শিশুটি কি পরিমাণ অপুষ্ট এবং অঙ্গহীন ছিল ? মা থমকে তাকায় গভীর ব্যাপক মøান প্রেম ছড়িয়ে—অপর মানুষের কৌতুক, মর্কুটে-বাকল ও বক্তব্যহীন মনপ্রাণ তাকে করে আদিগন্ত বিমূঢ়।

 কে না জানে—সকল শিশু মৃত্যুই মাকে করে ক্রমাগত প্রৌঢ়, উদাসীন, অভিমানী ও পর্যটন বিমুখ। মায়েরা পাথর হয়। গাছের পাতার মতো বিবিধ শব্দরাজি তার ঘর এবং উঠোন জুড়ে অথবা বয়ে চলে নিরবধি—মৃত শিশু এসে নিভন্ত চুল্লির পাশে নিভৃতে দাঁড়ায় আর তার শৈশব টুকরা টুকরা হয়। মা দেখে উঠান জুড়ে পাতার পাহাড়। আর তার ভেতর শিশুর জয়োল্লাস, জ্যোৎস্না ও অকৃপণ নিমন্ত্রণ; শিশু অস্পষ্ট হাসি বিনিময় করে। খানিকটা ভয়-ক্রোধ। নিপল থেকে মুখ তুলে কখনও কখনও অন্যত্র তাকায়। লুকানো জিনিস খুঁজে পেতে আবিষ্কার করে আর হঠাৎই একদিন শিক্ষানবিশি পায়ে হাঁটতে বেরোয়। ঘাসের চপেটাঘাতে শিশির পায়ে হাঁটে এবং টলমল পায়ে ঠিকরে গিয়ে আবার হাঁটে অথবা জামা মলিন করে। জঙ্গলের ভেতর ঈশ^রের মতো ঘর তৈরি করে এবং মুহূর্তে দৌড়াতে শুরু করে। শিশু লাফিয়ে বেড়ায়, ইট-পাথর ছুঁড়ে দেয়, আর খেলনা মোটরটা-ঘোড়াটা পা দিয়ে দিয়ে নিয়ে চলে ঈশ^রের তৈরি জঙ্গলের দিকে। মা পুরনো বাড়ি বদল করে; আর দেখে শিশু সিঁড়ি ভাঙতে সক্ষম, শিশু এক্ষণে ট্রাইসাইকেল চালক এবং ছুঁড়ে দেয়া বল আঁকড়াতে সক্ষম। শিশু সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছে—মা এইসব দৃশ্যপট দেখে দিন-রাত্রের দুঃখ-সুখে এলোচুল শুকাতে শুকাতে। দেয়ালের চুনকামে শিশুর চিত্রমালা—তাও দেখার জগত বটে মায়ের। মা শিশুর আঁকাবাঁকা ছবির ভেতর দেখতে পায়—শিশু এবার দৌড়ে নামছে, সদ্য সে বাই সাইকেল আয়ত্ত করেছে, দূর থেকে বল ছুঁড়তে পারে, শূন্যে লাফ দিতে পারে, আর তার দৌড়ের গতি হয়েছে প্রতি সেকেণ্ডে আঠার ফিট। দৌড়াতে-দৌড়াতে শিশু দেয়ালে দাগ দেয়, সুখস্মৃতি নির্মাণ করে এবং তছনছ করে আঁতুড়ঘর ও কাঁথাকানি; শিশু এইভাবে—এই পরম্পরায় ধীরে ধীরে তৈরি হয়—ঘরের গুমোট অগোছালো জীবন থেকে পালিয়ে একবার দুবার অসংখ্যবার আধা ভেজা কাঠ পুড়িয়ে সরু ঘাসের ওপর চড়ুইভাতি খেলে। কোথাও দাঁড়িয়ে জোছনা চুমুক দেয়, টিনশেডে বৃষ্টির শব্দ গণনা করে। কার্পাসের তুলা আর শিমুলের তুলার তফাত করার জন্য নিমতলার ধুনকারের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে। মাংসপোড়ার বিষণ্ন গন্ধের ভেতর দেবব্রত-অখিল বন্ধু শুনতে শুনতে মনের ভেতরের পাহাড় ডিঙিয়ে চলে যায় স্বেচ্ছাচারী ইচ্ছের কাছে সমর্পিত হওয়ার আশায়। এই শিশু অথবা আমাদের অকাল প্রয়াত সহোদরের হৃদয়ে একদিন—নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন নির্মাণ হয়। পুঁজি, প্রগতি ও সমাজ—তিনটি শব্দ দিয়ে সে ছবি আঁকে, ছিঁড়ে ফেলে; আর বিবিধ অপরাধ-গ্লানিতে হয় ছন্নছাড়া ও আলুথালু। এলোমেলো হাওয়ার কুহক এবং প্রগাঢ় রোদ্দুর কখনও তাকে নিমজ্জিত করে উপদ্রুত ঘাসের ভেতর; ঘাসের উজ্জ্বল সবুজগন্ধে সে যেনবা একবার কমরেড-লিডারের পাশে নিজেকে আবিষ্কৃত করে। … জনযুদ্ধের জয় দীর্ঘজীবী হোক, জোতদারের মুণ্ডু নিয়ে ফুটবল খেলা চলছে চলবে, লালপিকিং লাল সেলাম … শুয়ে শুয়ে কথা হয়—এই আন্দোলন বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না ? মরে গেলে মরে যাব। বাবুদা এত জীবন যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করতে গেলে জীবনহানি বেশি হবে, দেরি করলে জীবনহানি কম হবে। … নড়াইলের সরোজ দত্তকে চিনতেন আপনি ? দেখেছি। সরোজ দত্ত কীভাবে হত্যা হন ? … সঠিক জানি না। শুনেছি মহানায়ক উত্তমকুমার মর্নিং ওয়াকের সময় তাকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেন এবং চুড়ান্ত সাক্ষ্য দেয়ার ভয়ে গৃহপলায়ন করেন।

 একবার শুনেছিলাম—সরোজ দত্তের মা রাত দুটোয় কান্নাকাটি করে ছেলেকে শপথ করিয়ে ছিলেন বিয়ের জন্য। আবার এ কথাও শোনা গিয়েছিল, এই পুত্রই বাবার দাহকালে শ্মশানের দেয়ালে পোড়া কাঠের টুকরাতে কিছু একটা লিখেছিলেন চার লাইনের।

বড় হয়ে উঠা শিশুর দঙ্গল এবং আমাদের অকাল মৃত সহোদর, অনেকদিন বাদে মানুষের বিবাহ ও সংসার ধর্মের এই প্রকার ছিন্ন-বিছিন্ন স্থানীয় সংবাদ কখনও উড়ে যেতে দেখে। কোথাও পোড়াপাতার গন্ধ এবং নিমফল খুঁটে আনা কাকের একরত্তি আভিজাত্য। বুড়ো শিশু, যুবক এবং অকাল প্রয়াত সহোদরবৃন্দ বুকের ভেতর ভীষণ গর্ত খুঁড়ে এসব বিষয়বস্তু সঞ্চয় করতে করতে সমসাময়িক হয়। ছাদে এবং তারে ভেজা-কাপড় উড়ে যাওয়ার কপট বেদনা ক্রমশ উদোম হয় আর তারা ধীরে ধীরে দেশান্তরী হয়। অপর লোকের জ্ঞানগর্ভ ছেঁদো কথা তখন হয় সৌখিনতা, স্বতন্ত্ররহিত এবং মৃদু আস্ফালন। যুবকেরা বহুদূর জঙ্গলে-পাহাড়ে হেঁটে বেড়ায়। যুবকেরা সকলে প্রত্যেকে একা হয়ে শৈশব-কৈশোরের প্রিয় জঙ্গলে সাদা জবা খুঁজতে বেরোয়। যুবকেরা বিষণ্ন আঙ্গিনায় নতুন জামা পরে বাঁশি তুলে নেয় হাতে এবং পাখির মত দুটি ঠোঁট দিয়ে সংসারের খেলাধুলা করে। সংসারে মানুষ আলুথালু হয়, রাষ্ট্রসীমানা দেখে, বিশুদ্ধ সভ্য হয়, সুশিক্ষিত চাষা হয় … আর হয় ক্রমশ জীবন্মৃত, তীক্ষè তরবারি, বিষ্ফোরক প্রতিধ্বনি এবং বই পুস্তকে ঠাসা অর্ধচেতন এক অসুস্থ-সুজন।

 আর আমার অসুস্থ সহোদর-আমাদের অকাল মৃত সহোদর, তখন মৃত পিরিচে বিপুল ওষুধ সঞ্চয় করে—যেনবা আমাদের গলির শহর ডুবছে; আর এই হতচকিত বিহ্বলতায় পুরনো নতুন দুঃখের সাম্রাজ্যকে যত্নে বসতে দেয় বিছানার কিনার ঘেঁষে। অসুখের সম্মোহনে একটি সুখী বেড়াল ও গিরগিটি দৌড়ে পালায়। সুখী বেড়াল কখনও ঘাস খায়; আমরা ঘাস উপড়ানোর সময় কিছু ঘাস আঙুলের ফাঁকে, আর কিছুটা মুঠোয় তুলে আনি। মৃত্যুর পঙ্ক্তিতে অপেক্ষমান সহোদর জানালা গলিয়ে দেখে—এবার ফসল হয়েছে বেশ। তখনও সে বুঝতে পারেনি—অল্প সময়ের মধ্যে এই বাড়ি, দূরের পায়ে চলা পথ এবং পাতা আড়াল হয়ে, হবে বাকহীন ও নগণ্য। আমার অকাল প্রয়াত সহোদর কখনও কী নিশব্দে ছবি আঁকতে শুরু করে ?

—আমাদের অনুমান সঠিক হয় অথবা পাতার আড়ালে শান্ত-স্থির ভঙ্গিতে সম্ভাবনাময় হয় এবং ওষুধের গন্ধ লেপ্টে থাকা কমলার মতো পরিত্রাণময় যন্ত্রণার ছবি হয়ে রোগীর শিয়রে স্থির হয়। সে হয়তো ছবি আঁকে—জীবনের ছায়া, মোহ এবং সংকেতে রং ডুবিয়ে; ছবি মন্ত্রের মতো স্থির হয় অথবা অনভ্যস্ততায় দখল করে রোগীর চাদর এবং ওষুধে দাগ লেগে থাকা কাপ পিরিচ। চোখের ভেতর, মস্তিষ্কের ভেতর রং ডুবিয়ে, কলম ডুবিয়ে—সে হয়তো মাকে, আমাকে, বোনকে ও নিজেকে চিঠি লেখে অথবা চৈত্রের ঘূর্ণনে নির্মাণ করে সম্পর্ক বিষয়ক সুন্দর-সন্ত্রস্ত-অন্ধকার। পিয়ন প্রাপকহীন চিঠি সঞ্চয় করে—সহোদরের অনুপস্থিতিতে মরচে পড়া তালা লাগানো ঘরে চিঠি এসে ফেরত যাওয়ার উপক্রম হলে আমরা পিয়নকে বশীভূত করে চিঠির অক্ষর সাজাতে বসি। রাত দুপুরে বিষ্টি হয়। আমরা ছাতার নিচে ছড়িয়ে বসি—কী হয় জীবনে লিখে ? —লেখায় ধুলোবালি পড়ে, চোরকাঁটা বেঁধে। আমরা বাক্য-শব্দের মনোরম হাতছানিতে ভিখারি হই, গলায় অক্ষরের ফাঁস পড়ি আর মৃত্যুময় বেঁচে থাকা শেষমেষ। চিঠির ভেতর আমার সহোদর কী এইসব বাক্য রচনা করে কখনও ?

—মেয়েরা ধানের শীষ কুড়াচ্ছে, এই ছবি মা এবং বোনের জন্য … এভাবেই চলে যেতে চাই। ছবি ছাড়া আমি ভালো কথা বলতে পারি না কেন ?

—মাঝে মাঝে আমি হতাশায় অবসন্ন হই। বড় শহরের জীবনে তোমার এবং আমার কি চিরকালই যথেষ্ট ঔদাস্য ছিল না ?

—বাবা-মা, তুমি কি বলবে, ছবি আঁকিয়ে সন্তানদের তেমন ভালোবাসে না ?

—সবসময় নিজের ভাবকে যথার্থ প্রকাশ করা সহজ নয়। আমি চেয়েছিলাম রঙের গান গাইতে … একটা স্টাডি করছি—একগুচ্ছ বুনোলতা, গমের শিষ আর নানা ধরনের পাতা। একটা বই লেখা বা একটি ছবি আঁকা প্রায় সন্তান হওয়ার মতোই; একজন শিল্পীকে ঠিক মুচির মতই পরিশ্রম করতে হয়, আর সেটাই তার করা উচিৎ … রঙের বাজনদার হওয়ার চেয়ে মুচি হওয়া ভালো। … এভাইে চলে যেতে চাই। …

ধুলোবালি পড়া চিঠির শেষ বাক্য আমরা আবার পাঠ করি—এভাবেই চলে যেতে চাই! … এই বাক্যরাশি আমাদের দুচোখে জ¦রের অনুভূতি ছড়ায়। বৃষ্টি ভেজা ভূতের মত কেউ হাতছানি দেয়—কী হয় শেষ পর্যন্ত জীবনে লিখে ?

—আমাদের সমর্পণ, উপবাস ও একাকিত্ব ঘুমের আলস্যে কেবল চিৎকার ছড়ায়। গলাবুক জলে ডুবিয়ে শরীর-ধমনি চৌচির করি এই মৃত্যুময় বেঁচে থাকার ভীষণ সমর্পণ ও অবিশ^াস্য অনিবার্যতা। শুকনো হয়ে আসা পাতা মাড়িয়ে মা এবার মায়াহীন সন্ন্যাস জীবনের অংশ হিসেবে বেঁচে থাকার ভীষণ সমর্পণ উদযাপন করার পথ খুঁজতে নামে। পুত্রশোক তাকে নিয়ে যায় মরচে পড়া ঘরের অধিক পুরনো ডাকবাক্সের কাছে। মায়েরা বিপুল দুঃখ দেখার জন্য প্রাচীন খেলাঘর খুলে ফেলে—শৈশব-কৈশোরের কত প্রকার খেলনা! কত প্রকার নিষ্ক্রিয় প্রয়াস এবং সখ্য হয় এক জীবনে!

মা ম্লান মুখের বাতির পাশে চুল এলো করে আকাশের দিকে চোখের জল নিক্ষেপ করে; মাছের আঁশটে গন্ধ এবং শ্যাওলার গন্ধ ভেসে বেড়ায়—আমি কি তবে মৃত্যু প্রসব করে গেছি অনন্ত বছর-মাস! মৃত্যু প্রসব করতে করতে তোমাকে অন্ধকারে আনি। আমার শরীরের রক্ত মাংসজুড়ে তোমার মৃত্যু-জলরেখা, কবে প্রসব করেছিলাম বাছা—ভেবে ভেবে আমি ভ্রান্ত পুণ্যের কৌতুক অনুভব করি। কখনও বাতাস ভারী হয় এবং পুরনো হৃদয় থেকে পুরনো ধুলা উড়ে বেড়ায় মৌসুমী বাতাসে। পুকুরের ভেতর শব্দ হয়, পুকুরের পাশে ম্লান মেছোবক মৃদু চমকায়। আমি চমকাই অতিকায় দুঃস্বপ্নে। তোমার দুঃখী মুখচ্ছবি মনে রেখে আমার প্রৌঢ়তা নিন্দিত হয়—আর বেশিদিন বাঁচতে চাই না! আমাদের শোকার্ত দিন-শোকার্ত রাত নীরব হয়, উজ্জ্বল হয় এবং বিচ্ছুরিত হয় চতুর্দিকে। তোমার বোনা গাছ এখন অতি জীবিত—জলবৃষ্টি আসার পরেও এর গভীর ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়া অতি সহজ। নিয়ম করে প্রতিটি ডালে পাখি আসে প্রতিটি দুঃখ বর্ণনার জন্য। ভেবে দেখি—আমার শান্ত পথ চলায় ছিল কেবল করুণ বিষণ্নতা, লাঞ্ছনা ও অনবধান। মায়েদের ভয় যায় না সহজে; স্তরে স্তরে দুঃখ এবং সামাজিক ত্রাস এসে হয় নিষ্ঠুর ও ক্রুর। তোমার স্মৃতি চূর্ণ করতে করতে মত্যভূমির সীমানা ছুঁয়ে ফেলি। তোমার মৃত ডুবো বিষণ্ন মুখোশ আমাকে আটকে দেয় চারিধারে। তোমার মৃত মুখ হয় চঞ্চল ও নির্ভীক। প্রতিদিন তোমার মুখের স্বপ্ন মৃত চাদর সরিয়ে ক্লান্ত পুকুরটিতে ডুবে যায়। আমি অনাবশ্যক একাগ্রতায় তোমার চুল স্পর্শ করি। মায়েদের বুকের ভেতর নিঃসঙ্গ অন্ধকার কেন এত ভয়াল হয়, নিষ্ঠ হয় এবং নির্লিপ্ত হয়—এর উেেন্মাচন খুব সহজ ঘটনা নয়। মায়েদের আত্মা চায়—বদল হতে হতে আরও গভীরে ডুবে যাই। সন্ধ্যায় দূরগামী ট্রেনের শব্দ স্থায়ী হয় এবং ভ্রƒকুটি ছড়ায়। মা দেখে, মৃত পুত্রের মরচেধরা তালার চাবি বিষ্টিতে ভিজে চলেছে। মা ভাবে, এখানে বিষ্টি পড়ে বারোমাস—আমাদের শোবার ঘরটি কোথায় যেন ?

—চাঁদের ভেতর, আকাশের ভেতর পুত্রের নতুন চালাঘর খুঁজে ফিরি। দুপুরের মেঘে ঢাকা বিস্তৃত আকাশ—সেখানেও তোমাকে দেখার জন্য লোক ডাকি। সন্ধ্যা হয়, বৃষ্টি হয়, রোদ হয়, স্মৃতির গুঞ্জন হয়, পেট্রোলের গন্ধ আসে; আর মনে পড়ে পুত্রের কথা। মা আপ্রাণ চেষ্টায় স্মৃতিসমূহ করে অকাট্য নির্ভুল। মায়ের দুঃখ হয় নির্ভুল—আর মৃত-পুত্রের সন্তান বারবার গা ঘেঁষে দাঁড়ায়।

 এই দৃশ্যে আমার এবং অপর সহোদরদের হৃদয় জুড়ে বৃষ্টি নামে, টলোমলো নৌকা ভাসে। অনুভব হয়—তীব্র ব্যাপক বৃষ্টি আমাদের স্বপ্ন-মেশা দিন জুড়ে। গল্পরাজ্যের সেই সোনার খাঁচার পাখি কোথায় থাকে ? —বারান্দায় তালমিছরি ছড়িয়ে বিষ পিঁপড়ে ডাকি। গন্ধ গোকুলের চলাফেরা খুঁজি। বাদুড় উড়ে বেড়ানো ভাঙাবাড়ির খিলান দেখি, কাঠের ঘোড়া দেখি, আর দু-চারটি শৈশবের লাটিম। ভাঙা অস্পষ্ট খেলনা আমাদের হাত হয়ে, মৃত সহোদরের হাত হয়ে অনন্ত তৃষায় নিখোঁজ হয় এবং আমাদের হৃদয় করে প্লাবিত। আমাদের কিয়দংশ হয় বিপদসঙ্কুল, কিয়দংশ হয় স্থাণু আর কিয়দংশ হয় ভাড়া বাড়ির অদ্ভুত আঁধারে ঠাসা জীবন নামক কূটতর্ক-কৌতুক-সন্দেহ। আমাদের অন্তর হয় মাকড়সার জাল। এই জালে আটকায় পোকা, ঝিনুক, নদীতীর, খেলার মাঠ, সার্কাস, গোলপোস্ট এবং ধুনকারের দোকান। আমার এবং মৃত সহোদরের মন ও আত্মা শুয়ে থাকে কাঠবিড়ালির পাশে। সন্ধ্যাবেলায় পাতার ফিসফিস শব্দে ডুবো হাঁসের ছায়া ভাসে। আমরা বলি—এসবই আত্মজীবনের বাঁধাঘর। অথবা তৎক্ষণাৎ বদল করে বলি—এসবই মৃত্যুর স্বতন্ত্র দেশ। সহোদরের পুরনো বই, কমরেডবৃন্দের ধূসর ছবি, দেশব্রতী পত্রিকা, বন্দুকের নলই উৎস … ইত্যাদির ভেতর আবার নির্মাণ হয় অবিরাম সন্ধ্যা, অবিরাম কথা কাটাকাটি আর অবিরাম মায়ার ক্রন্দন। কার দুঃখ বৃহত্তর ? ক্ষীণ প্রতিযোগিতা হয়—মায়ের না আমাদের ?

—কে জানে, বহু মানুষের হয়তো আমাদের চেয়েও আরো তীব্র দুঃখ আছে, হতাশ^াস আছে। পাতার শব্দে জেগে উঠতে উঠতে, পাতার পতনে হই আবার মেঘাবৃত। চিৎকার না করার প্রতিজ্ঞায় বসে থাকি অবিশ^াসী-অভিমানে। কেউ জিজ্ঞেস করে—শুনলাম তোমার ভাই মারা গেছে। আমাদের বোকাটে মফস্সল শহরে আলো অন্ধকার মিশে আছে তখন। জবাব না দিয়ে কুয়োর জলে কাঁপতে থাকা চাঁদের দিকে খুব ঝুঁকে দাঁড়াই—গলায় চোরাগোপ্তা জল আর বুকভাঙা সমর্পণ—বুকের ভেতর ফিসফিস গোঙানি : বাবা-মায়ের মৃত্যুতে আমাদের অতীত হারায় জানো তো! তোমার শিশুর মৃত্যুতে হারায় ভবিষ্যৎ, আর তোমার ভাইবোনের মৃত্যুতে হত্যা হয় অতীত ও ভবিষ্যৎ! আমরা একদা ছিলাম ভূতের নাচে বিভোর, সহসা বাড়ি ফিরতে চাইনি। এখন কী যেন নেই। ঘুমের দরজা ঠেলে আমার-আমাদের ঘুমের ভেতর অনুজ এসে কড়া নাড়ে। মরচে পড়া তালা খুলে সবাই অনুজের নথিপত্র দেখে—মৃত অনুজের অবশিষ্ট পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পাদনের এটাই স্বতঃসিদ্ধ রীতি! ঘরের ভেতর-আলমারির ভেতর সবিস্ময় আঁধার, বেঁচে থাকার নির্জন-নিষিদ্ধ গতিবিধি আর প্রাচীন শীত-সন্ধ্যার মতো নিরুত্তর ও কোলাহল। আমাদের অনেক মুখোশ, মুখোশের সমান্তরালে আরও অনেক মুখোশ ধ্বংসস্তূপ দেখার ব্যঞ্জনায় সরব হয়—কোনও গোপন উইল-ডিড ছিল কি ?

—ইনসিওরেন্স পলিসি, মর্টগেজ, ক্রেডিটকার্ড, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, স্টক, বন্ড, ট্যাক্স রিটার্ন, লোন পেপার, লিগ্যাল পেপার, ম্যারেজ সার্টিফিকেট, বার্থ সার্টিফিকেট ইত্যাদির দঙ্গলে সমগ্র জীবন যেন আছড়ে পড়ে দিগন্ত অবধি। দেখি খেরোখাতার আনাচে-কানাচে মৃত অনুজের ছোট ছোট প্রতিজ্ঞা—ব্যবসা-ঘরসংসারে আরও অধিক মনোনিবেশ করতে হবে। নাজিরপুরে ভেসে ওঠা জমি উদ্ধারে কাউকে বলব। দোকান ভাঙা পড়লে সংসারের খরচ এবং কর্মচারির বেতন-ভাতা অগ্রীম সংগ্রহ করতে হবে। আর বেঁচে থাকাটা সহজ করার জন্য ছোট ছোট আনন্দের উৎস খুঁজতে হবে : একদিন হয়তো আলমারি গোছাতে বসলাম। বন্ধুর কাছ থেকে আনা কমফোর্টারটি ফেরত দিতে যাব একদিন। মুমূর্ষু-প্রাচীন কমরেডদের ডেঞ্চার দেখতে যাব তাদের ঈষৎ ভেঙে যাওয়া জলশূন্য-কাপের ভেতর। কোনওদিন দু-একছত্র কবিতা মুখস্ত করা যায়। শিশুদের পেন্সিল বাড়াব সার্পনার দিয়ে একদিন। তারপর দিন বদল করে করে যাওয়া যায় অদ্ভুত কোনও জায়গায় পিকনিকের জন্য, ফুটকর্ন এড়ানোর জন্য মোজা পরব খানিকটা পুরু, শিশুকালের পছন্দসই বিস্কিট খাব, যৌক্তিক ক্রোধ প্রকাশ করব, ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশ দেখব। বইয়ের দোকানে বেস্ট সেলার খুঁজব। কাউকে কিছু না বলে ওরসে যাব মানিকগঞ্জ, আর দেখব সন্ধ্যার পর লাইব্রেরিতে বসে থাকা মানুষজনের চোখ মুখ। অতএব … বেঁচে থাকা জিন্দাবাদ…! কী হয়, বেঁচে থাকার ডায়েরিতে, এবার কোলবালিশ সরিয়ে সত্যি নয় স্বপ্ন—নয় এই প্রকার জন্মকথা আমরাও কখনও কখনও রচনা করতে বসি। ইঁদুরের গর্তে পা দি, ইঁদুর-দৌড় দৌড়াই, মিথ্যার পাহাড় গড়ি: ‘শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা’ বলে—চিৎকার করি, অন্ধকার ট্রেনে চড়ি, আর ঘুমের ভেতর-স্বপ্নের ভেতর বৃষ্টিভেজা চেয়ারে ফুঁপিয়ে উঠি। চশমা থেকে জল ঝরিয়ে বিছানায় বসি। মৃত অনুজের স্বপ্নরাশি গ্রহ হয়ে-তারা হয়ে ছিটকে আসে। আকাশে সামান্য মেঘ কিন্তু তাতেই বৃষ্টিপাত কম নয়—বৃষ্টির অনেক গন্ধ এবং বৃষ্টির অনেক শব্দের ভেতর মন হয় আমাদের ঘরবাড়ি ও হৃদয়; আর শরীর হয় ঠাণ্ডা, স্যাঁতসেঁতে ও ঘুমন্ত। মৃত সহোদরের আশু কল্যাণ কামনায় আমাদের মনোবিকলনের কলকব্জা, আমাদের অভিনয়, আমাদের সংলাপ—এবার বেসুরো হয়, অশ্লীল হয়, অস্পষ্ট হয় এবং সীমাবদ্ধ জলে-সীমিত সবুজে হয় অমীমাংসিত এবং আরও গভীর স্থবির। দূর পৃথিবীর রাতগুলো-দিনগুলো এভাবে ভারী হয়ে আসে। ভূতেরা পাশর্^ চরিত্র সহ্য করে না, জেনেও আমরা ভূতের নাচে বিভোর হই। কী যেন নেই, কিছুই করার নেই। কে হারিয়ে যায়—এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। কী এক নিগূঢ় সংকেত বার্তায় আমরা সংসারে নির্বিকার ঝুলকালি মাখি আর পরিপাটি ছায়াছন্ন বেডরুমের স্বপ্ন খুঁজি। এক অপ্রাসঙ্গিক ধারাক্রমে এক খোঁড়া মানুষ ক্রাচে হাঁটার শব্দের ভেতর চাঁদের ক্ষয়কে সমাহিত করে এবং অস্থিরতায় আরও অধিক চূর্ণ হয়।

পুরনো চাঁদ আমাদের স্বপ্নে স্বপ্নে স্মৃতির সঙ্গে কথোপকথন নির্মাণ করে তখন আরও তীব্র গভীর; আর আমাদের ক্লান্তি, ক্রোধ ও অপমান কেবল চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামে। লাল কাকাতুয়া কিনে দেয়ার একটি ফন্দি হয়েছিল, তোমার মনে আছে ?

—মৃত সহোদরের প্রতিপক্ষ হয়ে নিরবছিন্ন ফিসফাস করি। দূর পৃথিবী থেকে তির্যক এক আলো এসে পড়েছিল আমাদের পৃথিবীতে, তোমার মনে পড়ে ?

—আমাদের পৃথিবীতে ছিল হারানো বেড়ালের ছায়া, আকাশের দিকে উড়ে যাওয়া বাইসাইকেল, অধিক রাতে সিনেমা-ফেরত মানুষের স্ফূর্তি গান, পিঁপড়ের সারি, রোগা সাঁকো, দাম্পত্যে অসুখী পুরুষের নির্ঘুম সিগ্রেট প্রজ্জ্বলন, শূন্য মাঠের নাড়াপোড়া গন্ধ, লোকেন বোসের জার্নাল মুখস্ত করা বন্ধু সকল, টিলার ওপরে সেই বাড়ি, ব্যাপটিস্ট গির্জার বন্ধ দরজা, বালুভর্তি ডুবুডুবু ট্রলার, বিস্কুটের প্রশ্রয়-আদর প্রাপ্ত ব্যক্তিগত বিশ^স্ত কুকুর সম্প্রদায়, চুলের ভেতর উকুন খোঁজা মেয়েদের হাস্য-তামাশা, পরিত্যক্ত রেল লাইন ধরে দৌড়ে যাওয়া বৃষ্টিময় আনন্দ, আর ছিল ধ্যাড়ে ইঁদুর—ভাত তরকারি উল্টে দেয়া ইঁদুর এবং দরদালানের ফাঁকে লুকনো তক্ষক। তোমার মনে পড়ে ? কুমির চাষ পদ্ধতি নামের একটি বই আমরা স্টেশনের বুকস্টল থেকে কিনি। তারপর কানে গোঁজা পেন্সিলের কাঠমিস্ত্রিকে মনে পড়ে ?

—সার্কাস দেখে ফেরার পথে আমরা কাঠমিস্ত্রির পেন্সিল প্রতিস্থাপনের প্রতিভায় ভীষণ মজা পাই। আর সারা সন্ধ্যা আমরা খেলি চোর-পুলিশ। আমরা কি সেদিন সুখী হয়েছিলাম ?

—কালাম স্যার ক্লাসে প্রায় প্রায় আওড়াতেন—বহুদিন বেদনায় বহুদিন অন্ধকারে হয় হৃদয়ের উদ্ঘাটন … জলের ওপর ভাসতে ভাসতে অর্ধেক জীবন খরচ হয়ে গেল…!

মাকে সহসা আমাদের এই সম্মিলিত ধ্বংসস্তূপের কথা বলা হয় না। মা পাতার ভীড়ে শীত-সন্ধ্যার মতো নিজেকে ঘরের ভেতর নিরুত্তর করে। মায়ের পরিপাশর্^, মুখোচ্ছবি ক্রমাগত উদাসীন হয় এবং দুঃখ বিনিময় করে। মাকে কী এসব বলা উচিত ? —আমার প্রয়াত অনুজ রেজাউল করিমের মৃত্যু ঘোষিত হলে আমার শ^াস নেয়ার শক্তি কমে যায়। শুনতে পাই, ভাইয়ের-বোনের মৃত্যু—চারপাশের মানুষ বিশেষ কোনও শোক বলে বিবেচনা করে না। কিন্তু সেই দিন থেকেই ঘরে, ঘরের বাইরে রাতে ঘুমুতে যাওয়ার মুহূর্তেই আমার তীব্র শ^াসকষ্ট শুরু হয়; যেন শ^াস গ্রহণ করছি কিন্তু ভুলে গেছি বায়ু ত্যাগের পদ্ধতি, আমার বুক ব্যথা করে কখনও। মাথা শূন্য, তীব্র অবসন্নতা আর দুর্বলতা। চোখে জল জমে। আমি স্বচ্ছ চিন্তা করতে পারি না। আমার কথায় অস্পষ্টতা, আমাদের বাড়ি এখন বড্ড বেদনাময়। অতি প্রত্যুষে ঘুম ভাঙার পর আমি তার স্পষ্ট কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। আমি আমাদের দীর্ঘ কথোপকথনের যাবজ্জীবন-নির্বাসনের কথা ভাবি। মাকে নিশ্চয় এই অশ্রুময় চিৎকারের কথা বলা হয় না। মা পৃথিবীর খাঁচায় পুড়ে যাওয়া ফুসফুস থেকে কেবল দীর্ঘশ^াস ছড়ায়। আমার মায়ের গর্ভে ছিল জীবনের আলো, নাকি কেবলই প্রাচীন শোকের অন্ধকার। মায়েরা ছিন্ন ভিন্ন হয় নিঃশব্দে এবং আপাদমস্তক নিজেকে পোড়ায়। মাকে আমাদের দূর পৃথিবী থেকে সচল-সমৃদ্ধ বন্ধুবর্গ উপদেশ পাঠায়—কীভাবে শোককে কুনির্শ করতে হয়, … অথবা শোককে পরিণত করতে হয় শক্তিতে! সেইসব চতুর-বুদ্ধিমান-ঈষৎচতুর মানুষেরা কখনও টেক্সট করেন, লিংক পাঠান। তাদের জ্ঞানের প্রতিভা আমাদের মোবাইল স্ক্রিনে নীলচে আলো ফেলে। ভীষণ আচ্ছন্নতায় সংগোপনে ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের হাড়গোড় আলাদা করি। আর ডুবুডুবু ভারসাম্য খুঁজি—বন্ধুবর্গের পরামর্শপত্র পৃথুল হয় ক্রমশ শোক প্রকাশ করুন, অবদমন নয়। যদি শক্তিতে কুলোয়, আপনি শান্ত-নির্জন স্থানে পৌঁছন, যেন নিজের সঙ্গে কথা বলা যায়। শোকের জার্নাল নির্মাণ করুন—প্রতিরাতে ঘুমুনোর আগে ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে আপনার না বলা কথাগুলো লিখুন। যদি খুব অবশ বোধ করেন, তবে সিদ্ধান্ত জ্ঞাপনকারী সকল সম্মিলন এড়িয়ে চলুন। ভায়ের মৃত্যুর পর সবচেয়ে তীব্র আবেগটি চিহ্নিত করুন, আর আবেগের অংশটি অনুমোদন দিন নিজের কাছে। যদি শারীরিকভাবে খারাপ বোধ করেন তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। নির্ভরযোগ্য কাউকে শোকের কথাগুলো বলুন অথবা চিঠিতে লিখুন। ভাইবোন ইতোপূর্বে মৃত্যুবরণ করেছে—এমন কাউকে খুঁজে পরস্পর কথা বলুন। যেসব বিষয়, যেসব ঘটনা আপনাকে তার অনুপস্থিতির জন্য আক্রান্ত করেছে সবচেয়ে তীব্র, তা চিহ্নিত করুন ভবিষ্যৎ-শোক প্রকাশের জন্য। এমন কেউ ছিল, যার সঙ্গে আপনার পূর্ব সম্পর্ক ছিল শিথিল—এখন তা পুনর্নির্মাণ করা যায়। অন্তত তিনজন বন্ধু খুঁজুন—যেখানে আপনি স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারেন। খুব দ্রুত দশ মিনিট তার কয়েকটি বিশেষ স্মৃতি লিপিবদ্ধ করুন। ‘কেন’ শব্দ দিয়ে যেসব বাক্যবন্ধ তৈরি হয়েছে—যেমন কেন সে মৃত্যুবরণ করল, কেন সে অসুস্থ হলো … , এই প্রকার প্রশ্নোত্তর নির্দিষ্ট করুন। যদি তার মৃত্যু হয় আকস্মিক—চোখ বুজে তার শেষ মুহূর্তগুলো কল্পনা করুন, তখন সে কি করছিল। সেদিন আবহাওয়া কেমন ছিল, কাছে থাকলে তুমি কোন কথাটা বলতে। তুমি একটি দুটি সামগ্রী—যেমন তার জ্যাকেট, ছবি, কলম … কাছে রাখতে পারো। খুব নির্জন জায়গা খুঁজে তুমি দীর্ঘ সময় কান্না করতে পার। প্রতিদিন অন্তত এক ঘণ্টা সলিচ্যুড দরকার। আগামী মৃত্যুবার্ষিকীতে তুমি কি করতে চাইছ ভেবে বার কর। তীব্র অপরাধবোধ হলে কাউকে কথাটা বলো। ভায়ের নামে উঠোনে, ঘরের সামনে একটি বৃক্ষ রোপণ কর। কোনও একজন শিশুকে উপহার দাও। সম্ভব হলে নিজের জন্য সুগন্ধি মোম এবং এসেনসিয়াল ওয়েল নিতে পার। ছবি আঁকতে পার—তোমার কোনও শৈল্পিক ক্ষমতা ছাড়াই রং, ব্রাস, ক্যানভাসে আঁকিবুঁকি করা যায়। লম্বা হাইকিং ট্রেইলে যাওয়া যায়। ওর স্মৃতিরক্ষার্থে কী করা যায়—অপর ভাই-বোনেরা এ নিয়ে ব্রেনস্টর্ম করুন। আপনার ভাই কী ভালোবাসতেন, তার খোঁজ নিন। আপনার ভাইয়ের অসমাপ্ত কাজে হাত দিন। ওয়ালেট অথবা পার্সে মৃত অনুজের ছবি রাখুন—কখনও ওর ছবির দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। কখনও সম্ভব হলে অনুজের পছন্দের খাবার তৈরি করুন সবার জন্য। যদি সম্ভব হয় অনুজের কবরে ফুল ছড়িয়ে আসুন। আর আগামীতে হঠাৎ অপর কোনও বন্ধুর অনুজ বা অগ্রজ মৃত হলে—আপনার অভিজ্ঞতাগুলো ধীরে ধীরে জানানোর সুযোগ নিন। …

বলতে কী, এইসব দীর্ঘ-অতল পরামর্শপত্র আমরা কদাচিৎ অনুসরণ করি—ফলে আমাদের অন্তগর্ত বিবমিষা এবং ফিসফিস বাক্যবন্ধ হয় অপ্রকাশিত, মৌন ও স্থগিত। আমাদের অভিজ্ঞান হয়—হয়তো এভাবেই আমরা চলে যেতে চাই, হয়তো এভাবেই চলে যেতে হয় … । মৃত অনুজের সার-সার বন্ধ দরজায় তীব্র শব্দ হয় অথবা নির্মাণ হয় নিগূঢ় সংকেত বার্তা। কে হারিয়ে যায়, কে পেরিয়ে যেতে পারে চাঁদের ক্ষয়প্রাপ্তি! মানুষের কাছাকাছি শিশুর দঙ্গল এসে লুকোচুরি খেলে। মুখ গুঁজে থাকে জ্যান্ত মানুষ, আর টিকেট কেটে যাদুঘরে যায় প্রাচীনতম মানুষের ফসিল দেখতে। আমাদের পাড়ার যে লোকটি একা দাঁড়িয়ে থাকত, কখনও সে কাঁদে—একা বেঁচে থাকতে থাকতে কাঁদে প্রায়শ। আমাদের ধারণায় মানুষ হয়তো একাই বাঁচে, ভিড়ের মাঝখানে বাঁচে এবং মৃত্যু আছে বলেই বেঁচে থাকে অনাগত শিশুর তৃষায়। অনেকদিন পর জানতে পারি, আমার অনুপস্থিতিতে যখন শরীর হীম-শীতল এবং নিশ্চেতন—কয়েকটি দৃশ্যমান ব্যবহৃত জিনিস ছাড়া ঘরে-বাইরে, ও আত্মীয় পরিমণ্ডলে আমার জন্য বরাদ্দ শোক এখন বিশেষ আয়ুষ্মান নয়! অথচ সারাজীবন ভাবনায় ছিল—যেন নিজেকে ছাড়িয়ে মৃত্যুর পরেও নিজস্ব গৃহে, নিজস্ব ছাতা মাথায় আরও বহুদূর হেঁটে যেতে পারি। দেখি—আমাদের স্মৃতিরাজ্য শান্ত-স্থির-পবিত্রতায় বিষণ্নসুখ ছড়িয়ে গল্প করছে—কী যে সুন্দর দেখালো তোমাকে মৃত্যুর দুদিন আগেও!

আমরা দেখি আমাদের সম্মিলিত ধ্বংস্তূপ, দলিল দস্তাবেজের গুমোট আঁধার আর লেবু ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিঝুম মেয়েটিকে বলি —সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখন বাড়ি যাও।

ঢাকা থেকে

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button