আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

সোঁদালের ফুল : সাদিক হোসেন

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : ভারতের গল্প

মৃতেরা ফিরে ফিরে আসে।

হ্যারিকেন জ্বললে লম্বা ছায়া। আর না জ্বললে থলথলে আঁধার। সেই আঁধারে শুয়ে থাকে প্রকাণ্ড বারান্দা। গল্পে যেহেতু সন-তারিখের ঠিক ছিল না, তাই বারান্দাটাই আমার কাছে হয়ে উঠেছিল কালক্ষেপ। যেন পুরোনো মানুষেরা ঐখানে জড়ো হয়েছে। উবু হয়ে বসে আছে। তাদের জন্য রাতের খাবার জোগাড় করছিল দাদি…

মৃতেরা ফিরে ফিরে আসে।

ভূতের মতো নয়। বাবা-কাকা-জ্যাঠার মতো। এমনিই আসে। আলাপ করতে চায়। হয়ত অন্যমনস্কভাবে আপনি হাঁটছেন, আচমকা দেখা হয়ে গেল ব্যক্তিটার সঙ্গে!

সিরাজদাকে আমি সেভাবেই দেখেছি।

সকালবেলা দোকান খুলে মার্কেটে হাঁটছিলাম। এই সময় খরিদ্দার কম থাকে। ফলে মিনিট দশেক পায়চারি করে নেওয়া যায়। হঠাৎ দেখি সিরাজদা ঐ দূরে দাঁড়িয়ে। ঠিক আগের মতোই। তবে খানিকটা কুঁজো হয়েছেন যেন। হাতের পলিব্যাগটাকে সামলে নাকে নস্যি গুঁজে এগিয়ে এলেন।

বললাম, আপনি ?

এই এলাম গো। কতদিন এইদিকে আসিনি। তোমার খবর কী ? আর লেখাপত্তর পাঠাওনা কেন ?

সিরাজদা ‘কবিতা কবিতা’ নামের একখানা লিটিল ম্যাগাজিন প্রকাশ করতেন। বছরে চারটে সংখ্যা। প্রতিটি সংখ্যা দুই ফর্মার। এলাকার লোকজনদের লেখাই ছাপানো হত তাতে। সেইখানেই আমার প্রথম কবিতাটা বেরিয়েছিল।

হেসে বললাম, চা খাবেন ?

চা ? তা খাওয়াই যায়।

চা চুমুক দিয়ে সিরাজদা দোকানটাকে দেখছিলেন। তারপর আবার সেই মুচকি হাসি, গেছিলাম পপুলার আর্টপ্রেসে। গিয়ে দেখি বন্ধ। ওটা কি বন্ধই হয়ে গেছে ?

আপনি চলে যাবার পর প্রেসটা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রেস চালাবার লোক কোথায় এখানে ? তবে খাতা-পেন্সিলের দোকানটা এখনও খোলে।

কিন্তু গিয়ে তো দেখলাম বন্ধ।

কাকুর বয়েস হয়েছে তো। মাঝেমাঝেই বন্ধ থাকে।

হ্যাঁ, তা অনেকদিন হয়েও গেল।

ইতোমধ্যে একজন ওড়না কিনতে এসে গেছে। তাকে দেখে সিরাজদা উঠতে গিয়েও বসে পড়লেন, তুমি না চাকরি করতে ? দোকানটা কবে খুললে ?

খরিদ্দার সুতির ওড়নার খোঁজ করছিল। তাও গোলাপি রঙের। আমার কাছে গোলাপি রঙেরটা নেই। ফিকে লাল রঙের একটা রয়েছে। সেইটা দেখাতে দেখাতে বললাম, এই তো মাস ছয়েক হলো।

ও। তা ভালোই করেছ। নিজের কিছু একটা থাকা ভালো। এবার রুমালে গোঁফ মুছে বললেন, এখন আসি গো। তুমি ব্যস্ত রয়েছ। আর একদিন আসব’খন। লেখা পাঠাতে ভুলো না কিন্তু। পত্রিকাটা বার করতে হবে তো।

রঙ পছন্দ হলো না খরিদ্দারের। আমি আবার ওড়নাগুলো গুছিয়ে তুলে রাখছিলাম। সিরাজদা কিন্তু তখনো যাননি। তাকিয়ে দেখি ব্যর্থ দোকানির দিকে চেয়ে তিনি কেমন সফল সম্পাদকের মতো করে হাসছেন।

মৃতেরা ফিরে ফিরে আসে। অনেকসময় তাদের চেনাও যায় না। হয়তো ভিড় বাসে আপনার পাশেই দাঁড়িয়েছে। আপনি সহযাত্রীটির সঙ্গে কথাও বললেন। কিন্তু চিনতে পারলেন না। বেশ কয়েকদিন পর, গোসল করতে গিয়ে মনে পড়ল―আরে, আমি তো ওকে চিনতাম! চন্দনদা। অফিস থেকে ফেরার পথে ট্রেনে কাটা পড়েছিল একদিন!

মৃতেরা এমনি―দেখা দিয়ে চলে যায়। তাদের মধ্যে অনেকে আবার স্মৃতির ভারে ন্যুব্জ হয়ে থাকে। ট্রেনে-কাটা মানুষেরা আধখানা পা ঝুলিয়ে বসে থাকে মগডালে।

মগডালের কাহিনি আমি আব্বার কাছ থেকে শুনেছিলাম। তখন আব্বার বয়েস বেশ কম―ছয় কিংবা সাত হবে। মা মরা ছেলে। বেশির ভাগ সময় নানির বাড়িতে থাকতে হয় তাই। সেই সময়, কোনও এক রাতে, তার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে সে নিশুতির ডাক শোনে।

নিশুতির ডাক কেমন ?

প্রতিবার গল্পটি শুনবার সময় আমি এমনি বেয়াদপি করে ফেলতাম। কিন্তু আব্বা সেই দিকে খেয়াল দিত না। গল্পটা যত এগোত, আমি দেখতে পেতাম,  তার মুখমণ্ডলে এক প্রকাণ্ড বারান্দা উঠে আসছে। থলথলে আঁধার। কিংবা হ্যারিকেনের আলো। সেই আলোয় কবেকার মরা মানুষেরা, পুরোনো মানুষেরা চলাফেরা করছে, খাচ্ছে, সংসারের প্রয়োজনীয় কথালাপ চালিয়ে নিচ্ছে অনায়াসে।

ওদিকে ছয় বছরের বাচ্চাটি বিছানায় উঠে বসেছে তখন। তার সামনে জানালা। জানলার ওপারে মস্ত একটা গাছ। সেই গাছের মগডালে বসে রয়েছে নবদম্পতি!

আলতা মাখা পা ? বালক বিস্মিত।

নববধূর আলতা মাখা কচি পা কল্পনা করতে কার না ভালো লাগে ? যদি তার আগে আবার কালবৈশাখী হয়ে গিয়ে থাকে ?

ধরা যাক, সন্ধ্যের কালবৈশাখীর পর ঝিরঝিরে বৃষ্টিটাও থেমে গিয়েছে। এখন শুধু ক্লান্ত পাতাগুলো থেকে টিপটিপ করে জলের ফোঁটা পড়ছে। বাগান ছন্নছাড়া।  ভেঙে পড়া পাখির বাসায় ইঁদুরেরা হামলা চালিয়েছে। আর ঠিক এসবের মধ্যিখানে, একটি মা মরা ছেলে, ঘুম থেকে উঠে দেখছে, তার বাবা ও মা কোনো একটি গাছের মগডালে নবদম্পতির সাজে পা ঝুলিয়ে বসেছে। খুনসুটি করছে। সরষে রঙের আলো এসে পড়েছে তাদের শরীরে। তারা রস ও রতিতে বিভোর। এতই বিভোর যে তাদের ক্রিয়া মসলিনের মতো গাছের ডালপালায় বিঁধে গিয়ে বারবার ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। তবু সন্তানের দিকে তাদের খেয়াল নেই।

নিশুতি ডাক এমনি, যে শুনেছে সে জানে, এই ডাক অমোঘ। গারো পাহাড়ের হাতিরা একবার এই ডাক শুনেছিল।

ঘন ও গভীর, তখনও মানুষের পা পড়েনি সেখানে―হাতিরা যখন এলো―চাঁদনি রাত, নৃত্যপটিয়সী বিধবার সাদা থান যেন বৃক্ষদের মাথায় অবিন্যস্ত―ঘোমটা নয়, সেখানে লাজ ছিল না কারও, তবু হাওয়া দিলে সরে যাচ্ছিল আড়াল।

অথচ আড়াল পেতেই তো এসেছিল হাতিরা। গম্ভীর অন্তরালে নিজেদের ঢেকে নিতে চাইছিল তারা। বৃক্ষের গায়ে গা ঘষে ঘষে, নিরালা সঙ্গমে উপগত হয়েছিল। তাদের শীৎকার ধাক্কা খেয়ে ফিরে এসেছিল গারো পাহাড়ের গায়ে। যেমন শিখরে শিখরে ধাক্কা খায় ভোরবেলা।

ভোরবেলা শিখর দেখেছি। সেবার উত্তরবঙ্গে। আগুনের মতো জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু কঠিন। ঐ দেখা দুপলক মাত্র। তারপরেই কারখানার ধোঁয়ার মতো মেঘ উড়ে এল।

বরঞ্চ আমাদের আগুন, যা কিছু জ্বলে, সন্ধ্যের দিকে, এই শহরে। তখন অফিস শেষে ঘরে ফেরার পথে আমাদের ভোরবেলা। আমরা সন্ধ্যেবেলা পাখিদের কিচিরমিচির শুনি, দুধওয়ালাদের সাইকেল দেখি, দু-একবার তো খবরের কাগজও বিলি করতে দেখেছি―এই শহরে।

আমাদের সন্ধ্যেগুলো ভোরের মতো নরম ছিল। বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায়। এই নিয়ে অতনু কয়েকটি কবিতা লিখেছে। আমি কিছু লিখিনি। অবশ্য ওর একটি কবিতার সিরিজ, দাবি করা যায়, তৈরি হয়েছে এসব সন্ধ্যে থেকে।

তবু কবিতার ঢঙগুলো পেরিয়ে সেইসব সন্ধ্যের হদিস পাওয়া সহজ ব্যাপার না। সেখানে চিনে রেস্তোরাঁর গল্প উঠে আসে। রাসবিহারীর চায়ের আড্ডা আচমকা যেন পৃথুলা রমণী। কিংবা একবার বার থেকে বেরিয়ে খেয়াল করিনি আমরা এক অন্য শহরে ঢুকে পড়েছি। খেয়াল যখন এল, রাত অনেক, বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে গিয়ে দেখা হয়ে গেল অরিন্দমের সঙ্গে। সে বাসা বদল করেছে। বলল, চলে আয় একদিন। জোরসে আড্ডা দেওয়া যাবে। তোর আগের নম্বরটাই আছে তো ? একদিন ফোন করে নেব।

তাকে কাটানো মুশকিল। একেবারে নাছোড় বলা যায়। তবু প্লাটফর্মে পৌঁছে বোঝা গেল ট্রেন আসেনি। হাতে মিনিট পাঁচেক সময়। মাঝখানে চা খাওয়া হলো।

একবার বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিলাম আমরা। একবার বাসে ঝুলতে ঝুলতে আর ফেরা হলো না। একবার লেকের মধ্যে দেখেছিলাম সে কী প্রচণ্ড এক মাছ! লেজের ঝাপটায় অবলীলায় ঢেউ তুলছে।

আর একবার ফুটপাতে মাথাগুঁজে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম একজন নেশাড়ুকে। তার গাল দিয়ে গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল।

সন্ধ্যেগুলো, গ্রীষ্মকালে, আমের মুকুলের গন্ধে ভরপুর হয়ে থাকত। আমরা শহরের সেইসব বারান্দার দিকে তাকাতাম যেখানে কোনওদিন দাঁড়ানো হবে না। একজন বুড়ো টিভি চালিয়ে বই পড়ে। জানালা দিয়ে তার ঝিমুনি দেখা যায়। একজন ফলবিক্রেতা ট্যাপারি নিয়ে বসেছে। বইয়ের দোকানে পরিচয় হলো একজন গায়কের সঙ্গে। সে গুনগুন করে অতুলপ্রসাদের গান গাইল। আমাকে বলল, একসময় রেডিওতে গাইতাম।

এখন ?

তার কী হাসি। বলল, ছোটবেলাটা দিল্লিতে কেটেছিল। তখনও সব অন্যরকম ছিল।

কেমন ছিল ?

সে তুমি আমার থেকে ভালোই জানো।

তাও আপনি বলুন।

কী বলব ভায়া। ছাড়ো ওসব। তা তোমার বন্ধু এখনও এল না কেন ?

অতনু তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। জ্যামে আটকে গিয়েছে হয়তো। এদিকে বাংলার লৌকিক দেবতাদের নিয়ে একটি সংখ্যা বেরিয়েছে। সেখানে গাজিবাবার ছবিতে চোখ আটকে গেল। এখন পৌষ মাস। এই সময় গাজিবাবার পুজো হয়। নিশ্চয় হচ্ছে কোথাও। শহরে, সন্ধেবেলায়, তাই ছেলেরা-মেয়েরা হাত ধরে সরোবরে নেমে যায়।

বাড়ি ফিরে শুনলাম বিউটির বাচ্চা হয়েছে।

তিন ঘণ্টায় বাচ্চাটার নাম রাখা হয়নি। তাকে শোয়ানো হয়েছে বারান্দায়। মাথার কাছে ধূপ জ্বলছে। গায়ে পাতলা চাদর। মরা মানুষের গায়ে মাছি বসে। মাছি তাড়াবার জন্য একখানা টেবিল ফ্যান ফুল স্পিডে চালিয়ে রাখা হয়েছে। তাতে গায়ের চাদর মাঝে মাঝেই সরে সরে যায়। আচমকা সেদিকে চোখ পড়লে, মনে হবে, এই বুঝি নবজাতকটি লাথি মেরে চাদরটা সরাল।

পৃথিবীতে যার আয়ু কম, তার প্রতি মানুষের দুঃখও কম। একমাত্র গোঙানির শব্দ পাওয়া যায় বিউটির কাছ থেকে। বাকিরা ব্যস্ত কত দ্রুত বাচ্চাটিকে গোর দেওয়া যেতে পারে। বাধ সেধেছে বাচ্চাটির বাপ। কোনও কাজে সে আটকে পড়েছিল। ফিরতে প্রায় রাত ১১টা হলো। তখন কেইবা গোরস্থানে যায়। ঠিক হলো সকালে কাজটি সম্পন্ন করা হবে।

তার আগে পুকুরে শাপলা ফুল ফুটল। শাপলার বীজ বড় সুস্বাদু। মাঝরাতে দেখি একজন বালক পুকুর পারে বসে রয়েছে। তার মা পুকুরে নেমেছে। কোমর অব্দি। বাপ সাঁতার কেটে বীজ সংগ্রহ করতে গেছে। অন্ধকারে পুরুষটি দেখা যাচ্ছে না। তবে জলের শব্দে বোঝা যায় সে কতদূর গিয়েছে।

মাঝে মাঝে জোনাকি উড়ছিল। মাঝে মাঝে নরম মাটিতে গিঁথে থাকা গেঁড়ি-গুগলিরা দোল খাচ্ছিল―এমনও ভাবা হয়েছিল―আব্বা তার মায়ের রতিপ্রিয়তাকে, এভাবে, রসনা দিয়ে অদলবদল করতে চেয়েছিল।

লাশের কাছে একজনকে জেগে থাকতে হয়। সেই দায়িত্ব নিয়েছিল সগির মামা। জানাজার সময় তিনি ঠিক আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। তখন কথা হয়নি। জানাজার পর, যখন সবাই ধীরেসুস্থে গোরস্থানের দিকে যাচ্ছি, সগীর মামা বললেন, ক্ষণজন্ম!

হুম।

হে আল্লা, এমন ক্ষণজন্ম যেন সকলেই পায়।

আমি চমকে উঠি তাঁর কথা শুনে। তিনি আর কোনো কথা বললেন না। কবর দেবার পর আমরা একটা চায়ের দোকানে ঢুকেছিলাম। সেইখানে দেখি সিরাজদাও বসে রয়েছেন।

সিরাজদা জিজ্ঞেস করলেন, কার বাচ্চা গো ?

গফুর ভায়ের।

ওহ। তিনি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সগীর মামা বললেন, একখানা গল্প শোনো। বুজুর্গ হযরত আতায়ে ছালামি সবসময় আল্লাহের ভয়ে ভীত থাকতেন। তিনি কখনও আল্লা পাকের নিকট জান্নাত কামনা করতেন না। শুধু বলতেন, হায় আল্লা! তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। অসুস্থ অবস্থায় লোকেরা তাঁকে জিজ্ঞেস করল, আপনার মনে কোনও বাসনা থাকলে বলুন। উত্তরে তিনি বললেন, আমার কোনও বাসনা নাই। ভয়ে আমার মন আচ্ছন্ন।

গোরস্থানে গেলে সকলেই একটু-আধটু ভাবুক হয়ে ওঠে। তাও সগির মামা হঠাৎ কেন এই গল্পটা বলছেন বোঝা গেল না। সিরাজদা মুচকি হাসছিলেন। তাঁকে সগির মামা থামিয়ে দিলেও তিনি রাগ করেননি। ইতোমধ্যে চা এসে গিয়েছে। চা-এ চুমুক দিয়ে সগির মামা আবার বললেন, তিনি চল্লিশ বছর আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাননি। তাঁর মুখে এক মুহূর্তের জন্যও হাসি ছিল না। চল্লিশ বছর পর একদিন আকাশের দিকে তাকাবার সাথে সাথে তিনি ভয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। তাঁর পেটের অন্ত্র ফেটে গেল। তাঁর নিয়ম ছিল রাতের কোনও একসময়ে তিনি দেহের বিভিন্ন অঙ্গ হাতিয়ে দেখতেন যে গুনাহের কারণে তাঁর বিকৃতি ঘটেছে কী না। ঝড় তুফান শুরু হলে, আকাশে বিদ্যুৎ চমকালে তিনি নিজেকেই বলতেন, আমার কারণেই এই গজব এসেছে। আমার এন্তেকাল হলে মানুষ এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবে।

গল্পটা শেষ করে গভীর শ্বাস ছাড়লেন সগির মামা। সিরাজদা বুঝতে পারছিলেন না এখন হাসবেন, না গম্ভীর থাকবেন। চায়ের দাম মিটিয়ে যখন উঠছি, সগির মামা বললেন, ক্ষণজন্ম!

বিকেলের দিকে বৃষ্টি হলো। চালতা গাছের মাথায় ডাহুক পাখিরা উড়ল। তাদের ডাক, বৃষ্টির কারণে ভিজে গিয়েছে।

দাদির একটা বালিশ ছিল। তুলোর নয়; সোঁদালের ফুল রোদে শুকিয়ে খোলে ভরে নিয়েছিল। তন্দ্রা গেলে সেই সোঁদালের ফুল-বীজ জ্যান্ত হয়ে উঠত। তন্দ্রার মধ্যে শিকড় চারিয়ে ঝটপট গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। মাথার উপর জমে উঠত ঘনছায়া।

ছায়া এত ঘন যে মাথা ভারী হয়ে যেত। গায়ে ঢিমঢিমে জ্বর। ঘুম থেকে উঠবার পর সারা বিছানা ফুলে ভরে উঠলেও তিনি তার সুঘ্রাণ নিতে পারতেন না।

দাদির কথা আব্বার বিশেষ মনে ছিল না। তবে বালিশটা থেকে গিয়েছিল। এমনকি ৫২’র দাঙ্গার পর সপরিবারে যখন পূর্ব-পাকিস্তানে পারি দিয়েছিল, বালিশটাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল।

সেই জলযাত্রার দীর্ঘ বর্ণনা আমি শুনেছি। শুধু আব্বার কাছ থেকে নয়। শ্রেয়সীর বাবার কাছ থেকেও। তখন আর কাকুর বয়স কত ? বড়জোর ৮-১০ হবে। দেশভাগের সময়, সম্পূর্ণ একা, ভেসে এসেছিল এই পারে।

যেন মোহনার ঘোলা জল পাক খায়, ঢেউ ওঠে, যেন নদীতে ভেসে যায় চিকেনের হাড়―আর এদিকে অভুক্ত বালক সেইদিকে তাকিয়ে ভাবছে কলকাতা কত বড় মহানগর।

যেন ঘোলা জল; অতল, যেন জলযান চলেছে নিরুদ্দেশে―যেন মাঝে মাঝে পাড়ের যতটুকু দেখা যায়―তা তো পরিচিত, তাও ঐ গাঁয়ে, ঐখানে তাণ্ডব চলেছিল―যেন ঘন ছায়া আরও ঘন হয়ে আসে, মাথার ভেতর জলযান দোলে, দুলতেই থাকে আর শামুখ-খোল পাখি বিকেলের দিকে পড়ন্ত আলোয় ডানা মেলে উড়ে যায়।

দীর্ঘ জলযাত্রা শেষে, মাটিতে পা দিলে মনে হয়, মাটি বুঝি দুলছে। নতুন দেশ এভাবে দুলে উঠেছিল। একদিকে কলকাতা আর একদিকে খুলনা, বরিশাল।

মৃতেরা ফিরে ফিরে আসে। ভূতের মতো নয়। বাবা-কাকা-জ্যাঠার মতো। ফলে আমিও জলযাত্রা শেষে আব্বার হাত ধরে উবু হয়ে বসে পড়ি। আব্বার বয়েস হয়েছে। মুখের চামড়া কালো, কুঞ্চিত হয়েছে। তার হাতে একখানা ঠোঙা। তাতে শুকনো মুড়ি।

আব্বা বলল, তোর দাদাজি এখুনি এসবে। এলে একসাথে চলে যাব।

কোথায় যাব তা যেন নির্দিষ্ট। তাই আর জিজ্ঞেস করা হয় না। তবে জেটিতে অসংখ্য মানুষের ভিড়। তারা ছুটছে। কাঁধে ব্যাগ, পোটলা, একজন ঝাঁকিতে মুরগিছানা নিয়েছে, একজন পোষা ছাগলের কান ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কে যেন আঁচলে ঢেকে সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে আনছিল। মাঝখানে চোখ জুড়িয়ে গেছিল। তারপর থেকে আর বাচ্চাটির সন্ধান পায়নি। আহা! হাত থেকে পড়ে গিয়েছে জলে ? মা আছাড় খাচ্ছে পাটাতনে। বাপ দাঁড়িয়ে আছে নিঃস্ব মানুষের মতো। একবস্তা চাল এনেছিল জসিম। বস্তা কীভাবে ফেঁসে গিয়েছে। এখন সে যেদিকে যায়, চালের দানা তার পিছু ছাড়ে না।

দাদাজি একা এলেন না। মহল্লার বেশ কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমি এঁদের প্রত্যেককে চিনিনা। দাদাজি পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই হলেন নুরুদ্দিন―তোমার পচা কাকার বাপ, কই গো আহমেদ ভাই গেলে কোথায় ? আরে আমার খালাম্মাটা কই ?

জেটি থেকে খানিক দূরে একটা ফাঁকা মতো জায়গা। সেখানে আমরা সকলে গোল হয়ে বসলাম। প্রত্যেকের হাতে একটা করে ঠোঙা। তাতে শুকনো মুড়ি। দাদাজি কোথা থেকে কাঁচা লঙ্কা এনেছেন। সেইটা আবার ধবধবে সাদা। তবে কামড় দিলেই চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। এমন ঝাল।

কাছে-দূরে সোঁদালের গাছ। স্তবকে স্তবকে সোনা-হলুদ ফুল ফুটে আছে। পাড়ে কয়েকটা ডিঙি নৌকো বাঁধা। আকাশে হাল্কা মেঘ। চারদিক ছায়া ছায়া যেন।

আব্বা জিজ্ঞেস করল, যাব কোথায় ?

দাদাজি আরেকবার জেটির দিকে তাকালেন। সেখানে তখনও লোকজনের ভিড়। শিশুকন্যা হারানো মায়ের কান্না বুঝি শোনা গেল।

দাদাজি বললেন, গৈলা গ্রামে। সেখানে বন্দোবস্ত পাকা করে রেখেছি।

যাব কীভাবে ?

দাদাজি হাসলেন। উত্তর দিলেন না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মাঝখানে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েছিল। আমাদের জামাকাপড় ভিজে গিয়েছে। একজন বৃদ্ধ এসে আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন।

গৈলা গ্রামে পৌঁছতে সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছিল। বৃষ্টি হওয়ায় মাটির রাস্তায় কাদা। কাদার উপর স্পষ্ট দেখা গিয়েছিল ঢোঁড়া সাপের দাগ।

আমরা ভয় পাইনি। বৃদ্ধের হাতে ল্যাম্ফ জ্বলছিল।

বাড়িটা মন্ত্রের মতো পুরোনো। আশপাশ আগাছায় ভর্তি। দরজার পাল্লা অর্ধেক ভাঙা।

আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন গৃহকর্ত্রী। তিনি নিজের পরিচয় দিলেন। বললেন, অনেকদূর থেকে এসেছি, তাই যেন খানিক বিশ্রাম নিয়ে নিই।

ঘরটি মণীন্দ্রবাবুর। তাঁকে তখনও দেখা পাইনি। শুনেছি তাঁর বয়স অনেক। শতবর্ষের মানুষ তিনি। তবে একেবারেই সচল। এখনও নিজ হাতে সবকিছু সামলাতে পারেন।

ঘরে ইলেক্ট্রিসিটি নেই। হ্যারিকেন জ্বলছিল। যেখানে আলো পৌঁছায়নি, সেখানে থলথলে আঁধার। বারান্দায় একখানা দোলনা ছিল―সরষে রঙের আলোয় দেখেছিলাম।

রাত দশটায় আমরা আবার হলঘরে ফিরে এসেছিলাম। মণীন্দ্রবাবু আমাদের হালহকিকত জানছিলেন। দাদাজির সঙ্গে তাঁর যে আগে থেকেই পরিচয় ছিল―বোঝা গেল।

গৃহকর্ত্রীর নাম দেবারতি। আমি সারারাত তাঁর কোলে মাথা রেখে শুয়েছিলাম। মাথার উপর ছায়া ঘনিয়ে এসেছিল। দেশান্তরের ক্লান্তি ধুয়ে যাচ্ছিল।

ভোরবেলা যখন ঘুম ভাঙল দেখি বিছানায় একা। রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছিল। এত ভোরে রান্নাঘরে কারা ?

জানালার কাচ ভাঙা। ভেতরটায় উঁকি দিতে অসুবিধে হলো না। আব্বা হামানদিস্তেতে মশলা কুটছে। দাদাজি চাল ধুচ্ছিলেন। যেন কোনও বিবাহের সকাল। মণীন্দ্রবাবুকে দেখা পেলাম না। বাইরের আগাছাগুলোতে হাওয়া লেগেছে। সেইখানে দাঁড়িয়েছিলেন গৃহকর্ত্রী। তাঁর আঁচল উড়ছিল।

মৃতেরা ফিরে ফিরে আসে। আমাদের সন্ধেগুলো ভোরের মতো নরম হয়ে ওঠে তখন।

হয়তো বৃষ্টি পড়ছে তুমুল। হয়তো আমি আর অতনু রাস্তায় ফেঁসে গিয়েছি। আর বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছাট মেখে নিচ্ছে আমাদের মেয়েরা!

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button