আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

সাধনি : হামিরউদ্দিন মিদ্যা

বিশেষ গল্পসংখ্যা ২০২২ : ভারতের গল্প

দাদু মারা যাওয়ার পর ঠাকুমাকে নিয়ে ভোগান্তির শেষ নেই। এতদিন ভালোই ছিল। নিজেই রান্নাবান্না করে খাচ্ছিল। কাপড়চোপড় কাচছিল। হঠাৎ একদিন রাতে বার-বসতে উঠে কলতলার শ্যাওলায় পা পিছলে পড়ে গেল। কোমরে খেঁচকি লেগে গেছে ঠাকুমার। উঠতে-বসতে ব্যথা লাগে। আছাড় খাওয়ার পর থেকেই একটার পর একটা সমস্যা এসে হাজির হচ্ছে।

আমাদের বাড়িগুলো যেখানে তৈরি হয়েছে, সেখানটায় আগে ছিল ধানিজমি। বছরে দুবার ধান ফলত। দামোদরের বুক থেকে বেরিয়ে আসা একটা ক্যানেল মাইলের পর মাইলজুড়ে এই এলাকার দুপাশের মাঠগুলো শস্য ঊর্বর করে তোলে। সেই বড় ক্যানেলেরই একটা শাখা পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। সেই জলের ওপর ভরসা করে পাড়ার ভেতরের জমিগুলোতেও ধান লাগাত দাদু। পরে ট্রলি ট্রলি মাটি ঢেলে মাঠ বুজিয়ে তৈরি হলো বসত ভিটে। পাড়ার এই অংশটা নতুন বাখুল নামে পরিচিত। দাদুর এতগুলো ছেলেপুলে, বিয়ে-শাদির পর তাদের থাকার ঘর তো লাগবেই।

দাদুর নিজের ভিটেমাটি এখনও টিকে আছে। তবে নতুন বাখুল থেকে বেশকিছুটা দূরে। আগেকার মানুষ ঠাকুমা। সারা জীবন গরু-মোষের মতো খেটেখুটে আগলে রেখেছে নিজের ঘর-সংসার। বয়স হয়ে গেলেও স্বভাবটা যায়নি।

বাঁশতলায় শুকনো পাতা পড়ল কি না, ছাগল দুটো পেটপুরে খেল কি না, হাঁস-মুরগিগুলো সব দরমায় ফিরল কি না―এসব করতেই দিন যায়। আর আছে দিনে দুতিনবার ঘর উঠান ঝাঁট দেওয়া। বাবা-কাকাদের কথা একদম কানে নেয় না। এমনকি আমার পিসি পিসেমশাই এসেও কত বুঝিয়েছে ঠাকুমাকে, যা করেছ করেছ। এখন বয়স হয়েছে। ছেলেপুলেরা নিজের নিজের ঘর-সংসার বুঝে নিয়েছে। তোমার এত দুনিয়ার প্রতি টান কেন! এখন খাও-দাও বিশ্রাম নাও। ধর্মকর্ম করো।

ঠাকুমা বলে, বসে থাকার লেগে দুনিয়ায় কি জন্মেছি! বসে থাকে কুঁড়েরা। ওপরওয়ালা দুটো হাত দিয়েছে। দুটো পা দিয়েছে। যতদিন না তিনি ডাক দিচ্ছেন ততদিন করে যাব।

তবে তাই করো। যেদিন পড়বে, সেদিন আমার কথাটা হাড়ে-হাড়ে টের পাবে। নাকে কাঁদলেও আর দেখতে আসবনি।

পিসের রাগে মুখ গম্ভীর। পিসিও ফোড়ন কাটতে ছাড়ে না, এতসব কার জন্য করছিস শুনি ?

ঠাকুমা জবাব দেয়, কার জন্য করছি ? সব কবরে নিয়ে যাবার জন্যে করছি গো! যখন মরণ হবেক, তখন সব আমার সাথে পুঁতে দিবি।

এমন জবাব পেয়ে পিসি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে―হ্যাঁ তাই করব। এবার খবর পেলেই আসব। তার আগে নয়।

দুচার কথা বলাবলি হতেই ঠাকুমার সঙ্গে পিসির মনোমালিন্য হয়ে যায়। রেগে টং হয়ে পিসি সেদিনেই চলে যায় বাপের বাড়ি থেকে। কিন্তু রাগ পুষে রাখে আর কতদিন! না এসে কি পিসি থাকতে পারে ? ঠাকুমার একটু রোগ-জ্বালার খবর শুনলেই সাত কাজ ফেলে দিয়ে পড়িমরি করে ছুটে আসে। যেমন ছুটে এসেছে কলতলায় আছাড় খাওয়ার খবর শুনে।

পাশের গ্রাম কুসুমডাঙার হলধর সাহা এই এলাকার খুব নামকরা ডাক্তার। বিশেষ করে কারও হাত-পা ভাঙলে, মচকে গেলে, হাড়ের খিল সরে গেলে ওঁর ডাক পড়ে। ঠাকুমার বেলাতেও বাদ পড়লেন না। সব দেখেশুনে কোমরে বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে গেলেন ডাক্তার। ওষুধ ইনজেকশন কিছুদিন চলল। সাত দিন বিছানা থেকে উঠতে পারেনি ঠাকুমা। মা-কাকিরা সেবা-শুশ্রুষা করতে নাজেহাল হয়ে গিয়েছে।

কয়েক দিন পর ডাক্তার এসে কোমরের বেল্ট খুলে দিয়ে গেলেন। তবে কাজ করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করে দিয়ে গিয়েছেন ঠাকুমাকে। এখনও মাস তিনেক বিছানায় রেস্ট নিতে বলেছেন।

দুই

ঠাকুমার শরীরের অবস্থা দেখে পিসি-পিসেমশাই আমার বাপ-কাকাদের নিয়ে সন্ধেবেলায় পরামর্শ করতে বসল। জমি-জায়গাগুলো তো দাদু মারা যাবার পরেই সব ভাগ-বাঁটোয়ারা হয়ে গিয়েছে। তবে আমন-বোরো চাষ মিলে বছরে দুবার বিঘাপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে ঠাকুমার হাতে তুলে দেয় বাপ-কাকারা। সেই টাকায় ঠাকুমা নিজের খরচখরচা, লাগভাগ মেটায়। এখন যেটা সমস্যা, সেটা হলো রান্না করে খাওয়ার।

পিসে বলল, জমি-জায়গা যে যতটুকু চাষ করছ করো। তোমাদের মা যতদিন বেঁচে আছে, টাকাটা সময়মতো দিয়ে যাবে। এখন খাওয়ার দায়িত্বও তোমাদেরই নিতে হবে। কদিন করে খাওয়ানোর পালা করবে বলো ?

মেজকাকা বলল, খেতে যখন দিব, তাইলে জমি চাষ করার জন্য টাকা নিয়ে কী করবে মা ?

পিসি বলল, শুধু খেতে পেলেই হয়ে যাবে ? নিজের কাছে কিছু থাকলে তো বুকে বল-ভরসা থাকবে। সময়ে-অসুময়ে টাকাটা কাজে লাগাতে পারবে। আর আমার বাপের যদি জমি-জায়গা না থাকত, তাইলে কি মাকে দেখতিস না তোরা ?

মেজকাকা কোনো জবাব দেয় না। মাথা নামিয়ে রাখে। ছোট কাকা বলল, জমি-জায়গার কথা এখানে আসছে কেন! যেভাবে চলছে চলুক। এখন মায়ের অবস্থা কাহিল। এই সময় নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি না করে কাজের কথা হোক।

বাবা বলল, লোকে শুনলে কী বলবে বল তো, আমাদের মা রান্না করে খায়!

পিসে বলল, সেজন্যেই তো বলছি তোমাদের। পালাবদল করো, দশ দিন করে খাওয়ানোর দায়িত্ব নাও তোমরা। সময়ে সময়ে খাবার পৌঁছে দিবে। কাপড়চোপড় কেচে দেওয়া, ঘর উঠোন ঝাঁট দেওয়া, সবই করে দিতে হবে।

পিসের ঠিক করে দেওয়া নিয়ম অনুযায়ীই চলতে লাগল সব। কিন্তু খাওয়া-পরা হলেই কি একটা মানুষের চলে যায় ? রাত্রে বাথরুম কে নিয়ে যাবে ? বুড়ি মানুষ, এই অবস্থায় ঠাকুমা কি একলা পারে! সঙ্গে একজনকে শুতে হবে কাছে। নিজের বিছানা ছেড়ে কে শুতে যাবে বুড়ির কাছে ?

ঠাকুমার ঘরটা মাটির। ওপর-নিচে দুকুঠুরি। অনেক বছরের পুরনো ঘর। দুবছর অন্তর অন্তর ঘরামি ক্ষেত্র পাল এসে নতুন বোরো চাষের লম্বা খড় দিয়ে ছাউনি বদলে যায়। মেঝেটা এত ঠাণ্ডা যে, গ্রীষ্মকালে একটা মাদুর বিছিয়ে শুলে ফ্যান চালানোর দরকার হয় না। শীতকালেই যা একটু কষ্ট!

মেজ কাকার মেয়ে গোলাপির পালা পড়ল ঠাকুমার কাছে শোওয়ার। মা-কাকিরা বোঝাল, এত বড় নাতনি থাকতে বুড়ি মানুষটা একলা শুবে! তুই কেন আছিস মা ?

গোলাপি বলল, বুড়ির কাছে আমি শুতে যেতে পারব না। ওই ঘরটা কেমন অন্ধকার কবরের মতো।

বালাইষাট! বালাইষাট! এ কী কথা গোলাপি! খেয়েদেয়ে যাবি। চোখ বুজে ঘুমাবি। কখনও যদি বার বসতে উঠায়, তখন শুধু টর্চটা জ্বেলে একটু নিয়ে যাবি। লক্ষ্মী মা আমার! কটা দিন যা। তারপর না হয়….

মা-কাকিমাদের কথাটা আর ফেলতে পারল না গোলাপি। মুখটা বেঁকিয়ে সম্মতি জানাল।

দুদিন পেরতে না পেরতেই গোলাপি জানাল, আমি আর শুতে যাব নাই বুড়ির কাছে।

কেন ? যাবি নাই কেন ?

ও মা রে মা! সারারাত ঘুমাতে দেয় না গো বুড়ি। যত রাজ্যের কথা আছে, সব মনে পড়বে রাতে। সারারাত চোখের পাতা এক করতে দেয় না। কানের গোড়ায় বকবক-বকবক করেই যাবে। আমি বলি, অনেক হয়েছে, এবার তুমি চুপ করে এট্টু ঘুমাও দিনি!আমার কথা কানে নিলে তো!

তুইও যেমন হয়েছিস খেপি! মুখে কাথা ঢাকা দিয়ে চুপ করে মরার মতো পড়ে থাকবি। হ্যাঁ, না―কিছুই সাড়া দিস না। তাইলেই দেখবি চুপ করে যাবে।

শুধু কি বকবক করে গো! মুতার রোগ আছে বুড়ির। সারারাতে আমাকে চার-পাঁচবার উঠতে হয়।

মেজোকাকি সব শুনে বলল, না বাপু! এতটুকুন মেয়ে আমার। এতসব উ পারবেতোকনি। তুরা বরং অন্য কাউকে শুতে  দে।

ছোট কাকা খুব রেগে গেল। বলল, এতই যদি শোওয়ার অসুবিধা, তাইলে যার ঘরে যখন খাওয়ার পালা পরবে, তখন তাদের ঘরেরই কাউকে শুতে যেতে হবে মায়ের কাছে।

মা আর ছোট কাকি ঝাঁঝিয়ে উঠল ছোটকাকার যুক্তি শুনে, এটা আবার কেমন কথা! শোওয়ার জন্যও পালা ? সবার ঘরে যদি শোওয়ার মানুষ না থাকে ?

কেন ? তোমরা কী করতে আছ ? কয়েক দিন করে শুতে যেতে পারবে না ?

বাবা বলল, এসব ঝামেলা বাদ দে দিনি ছোট। তার থেকে মাকে এই বাখুলে এনে রাখলে হয় না ? ধর যার ঘরে যখন খাওয়ার পালা চলল, তখন তার বাড়িতেই থাকল। তাইলে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

মেজকাকি বলল, ঠিকই বলেছ তুমি। শুধু তো শোওয়ার ব্যাপার নয়। ওধারে সারাদিন একলা পড়ে থাকে বুড়ি মানুষটা। কিছু হয়ে গেলে মুখে সামান্য পানি দেওয়ারও তো লোক নাই।

মা বলল, তা ঠিক। সারাদিন তো আর ওই ধারে গিয়ে বুড়ির কাছে বসে থাকতে পারবে না কেউ। সবার ঘর-সংসারের কাজ আছে। এধারেই আনা হোক বুড়িকে। সবসময় আমাদের চোখে চোখে থাকবে।

ব্যপারটা ঠাকুমাকে জানাতে গিয়েছিল বাবা। শুনেই আপত্তি জানিয়েছে ঠাকুমা।

আমি এই ঘর ছেড়ে কারও বাড়িতে যেতে পারব না। মন গেলে এখানেই খাবার দিয়ে যাবি, নাইলে নিজেই যেমন পারি চাট্টি রেঁধেবেড়ে খাব।

এ কী কথা বলছ মা! আমরা কি পর ? আমাদের ঘরে যেতে অসুবিধার কী আছে ? সারাদিন একা একা পড়ে থাকো। ওধারে গেলে তোমার অনেক সুবিধা হবে।

আমার সুবিধার দরকার নাই। সারাটা জেবন এখানে কাটালাম! আর তুদের বাপটা হঠাৎ চলে গেল বলে, আমিও ঘর ছাড়ব! তা কখনওই হবেকনি। যতদিন বাঁচব, এই ঘরেই থাকব। এই ভিটেমাটিতেই যেন আমার মরণ হয়।

এমন কথা আর কখনও মুখে আনো না মা। মরবে কেনে! আমরা যতদিন আছি, তুমার কোনো চিন্তা নাই। রাত্রে শুতে আসার সমস্যা, তাই সবাই বলছিল…

কাউকে শুতে আসতে হবেক নাই। আমি একলাই কষ্ট করে উঠব। এই ভিটেমাটি ছেড়ে কুথাও যে আমার ঘুম হবেক নাই রে। নাইলে কি যেতাম নি! মানুষটা মরে গেলেও এখনও তার পায়ের ধুলো মিশে আছে এই ভিটেতে। চোখ বুজে শুলেও মনে হয়, এখনও পাশে শুয়ে আছে। লিশ্বেস টানার শব্দ শুনতে পাই আমি।

বাবা আর কিছু বলেনি ঠাকুমাকে। সুড়সুড় করে বাড়ি চলে এল। কথাগুলো সবাইকে জানাতেই মা-কাকিরা হেসে লুটোপুটি। বুড়ির ভীমরতি ধরেচে গো! নাইলে অমন কথা কেউ বলে! নিশ্বাস টানার শব্দ! পায়ের ধুলো! বাপরে বাপ, কত টান! ও গোলাপি, তুই তো শুতে গেছিলি। তা কিছু শুনতে পেয়েছিলি রেতের বেলা ?

গোলাপি বলল, মশার গান ছাড়া আমি তো কিছুই শুনতে পাইনি!

থামবে তুমরা! এত মজা কীসের! ধমকে থামিয়ে দিল বাবা। তারপর ধীর গলায় বলল, বয়স হয়ে গেলে মানুষ বাচ্চা হয়ে যায়। মায়ের তাই হয়েছে। ওর কথা নিয়ে এত হাসাহাসি করলে চলবে! লোকজনের কানে এসব কথা গেলে কী ভাববে বলো তো!

তিন

একটানা দশদিন করে ঠাকুমার কাছে শুতে যেতে কেউ রাজি হলো না। ঠিক হলো, পালাবদলে দুদিন করে শুতে যাবে সবাই। প্রথমে আমার ছোট কাকির পালা পড়ল, তারপর গেল মা, পরে মেজকাকি। মেজকাকার এই সিদ্ধান্ত একদম পছন্দ হয়নি। এমনকি আমার বাবা, ছোট কাকাও ক্ষুব্ধ হয়েছে ঠাকুমার ওপর। সবার ইচ্ছা, ঠাকুমা আমাদের নতুন বাখুলে এসে থাকুক। তাহলে কাউকে আর সাত কাজ ফেলে দিয়ে বার বার ওই পুরনো বাখুলে যেতে হবে না। রাত্রে শুতে যাওয়ারও দরকার নেই।

সপ্তাহ-দুই পেরতে না পেরতেই আরও একটা বিপদ মাথার ওপর খাঁড়া হলো। ঠাকুমার প্রেশার হঠাৎ করে বেড়ে যাচ্ছে। একদিন দিনের বেলা উঠোনে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। ভাগ্যিস সে সময় পড়শি একজনের চোখে পড়েছিল, তাই রক্ষে!

খবরটা শোনার পর সবাই ছুটে গেল দেখতে।

বাবা বলল, আর কোনো কথা নয়। এত ঝুঁকি নিয়ে এধারে মাকে রাখা যাবে না।

ছোট কাকা, মা-কাকিরা সবাই সহমত জানাল বাবার কথায়। মা বলল, একধারে পড়ে থাকে বুড়ি মানুষটা। এখানে পাশাপাশি বাড়িও নাই। কিছু হয়ে গেলে কে দেখবে ? তার থেকে ধরে ধরে আমাদের বাখুলেই নিয়ে চলো। আমাদের বাড়িতে খাওয়ানোর পালা চলছিল। ঠাকুমাকে তাই প্রথমে আমাদের বাড়িতেই তোলা হলো। প্রতিবাদ করে কোনও কথা বলার মতো অবস্থায় থাকেনি ঠাকুমা।

সেবা-শুশ্রƒষা পেয়ে একটু সুস্থ হয়ে উঠল ঠাকুমা। গায়ে একটু বল ফিরে পেয়েছে। কিন্তু ওবাড়ি থেকে এখানে জোর করে নিয়ে আসায় সবার প্রতি খুব বিরক্ত। কথাবার্তা কারও সাথেই ভালোভাবে বলছে না। শুধু খাবার সময় হলে চুপচাপ খাচ্ছে। বাকি সময় মুখ গোঁজ করে বসে থাকে। মেজাজটাও হয়ে গিয়েছে রীতিমতো খিটখিটে।

ঠাকুমাকে নতুন বাখুলে আনা হলেও মা-কাকিদের পুরনো বাখুলে যাওয়া-আসার পাট চুকল না। বুড়ির দুটো ছাগল আছে, আর আছে কতকগুলো হাঁস-মুরগি। অবোলা জীব দুটো সারাদিন খুটিতে বাঁধা থাকবে, তা তো হয় না। ডালপালা, সবজির খোসা, এসব রোজ খেতে দিতে হয়। সকালে গিয়ে দরমার দরজা খুলে হাঁস-মুরগিগুলো ছেড়ে দিতে হয়। সারাদিন চরে সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফেরে তখন আবার গিয়ে খাবার খাইয়ে দরমায় ভরে দিয়ে আসতে হয়।

কদিন পেরতে না পেরতেই ঠাকুমা বলল, এবার আমাকে ওধারে নিয়ে চল।

মা বলল, কেন ? এখানে অসুবিধা কী হচ্ছে ?

আমার অসুবিধা তুরা দেখতে পাবি নাই।

খাচ্ছ-দাচ্ছ, ভালই তো আছ!

ভালো থাকা কি একেই বলে ? মনের সুখটা তুরা দেখবি নাই ? আমার যে কতগুলো পোষ্য আছে তাদের কথা একবারও ভাবিস ? কখনও ভেবে দেখেছিস, আমাকে দেখতে না পেয়ে হাঁস-মুরগিগুলোর কী অবস্থা হয়! ওরা জানে সকাল হলেই একটা বুড়ি ঘুম থেকে উঠে দরমা থেকে বের করে কুড়ো-ভাত মিশিয়ে খেতে দিবেক ওদের। পুকুরে চরে পেট না ভরলে রোদের বেলাতেও ফিরে আসে কুনু কুনু দিন। প্যাঁক-প্যাঁক করে ভুখ লাগার কথা জানায়। তখন উনুনশাল থেকে ছুটে গিয়ে ওদের খেতে দিই। এখনও তো ওরা রোজ দরমার কাছে আসে, এত ডেকেও যখন দেখে, বুড়ি মানুষটা আর খাবার লিয়ে আসছে নাই, তখন খালি পেটেই দুখ্যু করে ফিরে যায় পুকুরে।

মা চোখ গোল গোল করে ঠাকুমার দিকে তাকাল। আমাদের বাড়িতে ঠাকুমা থাকলেও রোজ কাকা-কাকিরাও আসে। পাশে বসে। কোনও দিন পা-হাত টিপে দেয়। সেজ কাকি খুব মুখচটা। সোজা কথা মুখের ওপর স্পষ্ট বলে দিল―তা তুমাকে হাঁস-মুরগি পালতে কে বলেছে মা ? যখন দেহে বল ছিল তখন না হয় করেছ। এখন আবার ওসবের কী দরকার! হাত খরচার টাকা বলো, কাউকে দিতে মন গেলে বলো―সবই তো পাচ্ছ। এতগুলো জমির টাকা ছেলেরা হাতে তুলে দিচ্ছে, তাও তুমার খায়েশ মিটেনি ?

মা বলল, সামনের বুধবারের হাটে সব নিয়ে যাওয়া করাব তুমার ছেলেকে। ছাগল দুটো রেখে লাভ নাই। আজ আমার ঘরে আছ, আমি দেখভাল করছি, আবার অন্য ছেলেদের বাড়িতে উঠবে, তখন তুমার সাথে সাথে হাঁস-মুরগি-ছাগল ওসব নিয়ে কে এত ঝামেলা পোহাবে ?

ঠাকুমা বলল, খবরদার! ওসব বেচার কথা একদম মুখে আনবি নাই। যদি টাকার দরকার, তো আমাকে বেচে দে।

মা-কাকিরা মুখে হাত দিয়ে বসে পড়ল, ছিঃ ছিঃ মা! এতটা পর ভাবো আমাদের!

পর আমি ভাবি নাই। আমাকে তুরা সবাই পর করে দিচ্ছিস। কী কুক্ষণেই না বেঁচে আছি! মানুষটার সঙ্গে কেনে যে আমারও মরণ হলো নাই!

মা বলল, পরের কী দেখলে ? তুমাকে খাওয়া-পরার খোটা কুনুদিন দিয়েছে কেউ ? জবাব দাও।

ঠাকুমা মুখ গম্ভীর করে বসে রইল খানিকক্ষণ। একটু পর বলল―ঘরে একটা কুকুর-বিড়াল পুষলে তাকেও তো দুমুঠো সবাই দেয়।

তুমি নিজেকে একটা পশুর সঙ্গে তুলনা করছ ? লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে। ঠিক আছে তুমি যখন চাও না, হাঁস-মুরগি, ছাগল কিছুই বেচা হবে না। তবে একটা কথা জানিয়ে দিই, সারাদিন তো আর পোষ্যগুলোর পিছু পিছু ঘুরতে পারবে না কেউ। আর দিনে পাঁচবার করে পুরনো বাখুলে যাবারও সময় নাই কারও। কাল দরমায় পাশে রঙা সাড়ি হাঁসটা ফিরে আসে নাই। বোধহয় পুকুরপাড় থেকে শিয়ালে তুলে নিয়ে গিয়েছে। শুনে মন খারাপ হবেতো, তাই তোমাকে বলিনি। এইভাবে আগলে-আগলে কদিন রাখতে পারব, জানি না।

শেয়ালে হাঁস খেয়ে নিয়েছে শুনে ঠাকুমা হায় হায় করে উঠল। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নাকে কাঁদল। কাপড়ের খুটে চোখের জল মুছল। সারাদিন মুখে কিছু খাবার তুলল না।

সন্ধেবেলা বাবা কাজ থেকে ফিরে শুনল সব কথা। শুনতেই মাথা গরম হয়ে গেল। তখনই ছোট কাকাকে সঙ্গে নিয়ে হাঁস-মুরগিগুলো আনতে গেল পুরনো বাখুল থেকে। দরমা থেকে হাঁস-মুরগিগুলো সব একে একে বের করে পাগুলো সুতো দিয়ে বাঁধা হলো। ছোট কাকাদের দরমাটা অনেক বড়। একসঙ্গে আশি-নব্বইটা হাঁস-মুরগি থাকার মতো জায়গা আছে। কয়েক দিন পায়ে দড়ি বেঁধে রেখে দিলে নতুন দরমাটাকে ওরা চিনে নেবে। অভ্যস্ত হয়ে পড়বে নতুন পরিবেশের সঙ্গে। তারপর চরতে ছেড়ে দিলেও সন্ধেবেলা মনে করে ঠিক নতুন দরমাতেই ফিরে আসবে। এই পদ্ধতি মা-কাকিরা বলে সাধনি করা। গ্রামের কারও বাড়ি থেকে হাঁস-মুরগি কিনলে এভাবেই পোষ মানিয়ে নেয়।

হাঁস-মুরগি ছাড়া ছাগল দুটোও আনা হলো। ওগুলো রাখব আমাদের গোয়ালঘরে। বেশি গরু তো নেই এখন। একটা দুধেল গাই, আর তার বাছুর ছানা। গরু-বাছুরের এক পাশে ছাগল দুটোর ঠিক জায়গা হয়ে যাবে।

চার

পোষ্যগুলো নিয়ে আর কোনও সমস্যা রইল না। হাঁস-মুরগিগুলো ছোট কাকাদের দরমাতেই থাকে। ঠাকুমার যাদের ঘরে যখন খাওয়ার পালা পড়ে তখন তারা দেখভাল করে। ভিজে ভাত বাড়লে দরমার কাছে নামানো ডাবাতে ঢেলে দিয়ে যায়। মাঠে-ঘাটে যে যখন যায়, ছাগল দুটোর জন্য দু-চার মুঠো ঘাস, দুটো বট-অশ্বত্থের ডালপালা মনে করে নিয়ে আসে।

ঠাকুমাকে দেখলে এখন মনে হবে নতুন ব্যবস্থায় একটু হলেও খুশি হয়েছে। সেই হারিয়ে যাওয়া হাঁসটির প্রতি শোক অনেকটাই কেটে গিয়েছে। লাঠি ধরে একটু-আধটু হাঁটাহাঁটিও করে। তাহলে কি পুরনো বাখুল থেকে এখানে আসার পর হাঁস-মুরগির মতো ঠাকুমাও সাধনি হয়ে গেল ?

প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার আগে হাঁস-মুরগিগুলোর বাড়ি ফেরার সময় হলে, ঠাকুমা লাঠি ঠুক ঠুক করে ছোট কাকাদের বাড়ি চলে যায়। দরমার কাছে দাঁড়িয়ে এক দুই তিন… করে গুনে গুনে রাখে। আবার সকালে ছাড়ার সময় হলেও চলে যায় ডিম রাখার ঝাঁজিটা নিয়ে। গুনে গুনে ডিমগুলো কুড়িয়ে আনে। ঠাকুমার কীর্তিকলাপ দেখে মা-কাকিরা আড়ালে হাসাহাসি করে। কিন্তু সামনে কিছু বলার সাহস পায় না। বললেই যদি রে-রে করে ওঠে!

ছাগলগুলোর কাছেও মাঝে মধ্যে বসে থাকে ঠাকুমা। গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়। আপন মনেই কথা বলে।

সেদিন দুপুরবেলা আমাদের ঘরের দাওয়ায় তালাই বিছিয়ে শুয়ে আছে ঠাকুমা। বাবা তখনও কাজ থেকে ফেরেনি। মা ভাতঘুম দিচ্ছে মেঝেতে। এমন সময় একটা কালো রঙের কুকুর ছুটে এসে ঠাকুমার কাছ থেকে কিছুটা দূরে পা গেদে বসল। জীহ্বা বের করে হাঁসফাঁস করছে কুকুরটা। খুব জব্দ লাগছে। দেখলেই অনুমান করা যায়, যেন কতদিন পেটপুরে খায়নি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে কান্নার মতো একটা করুণ ক্ষীণ আওয়াজ। কুকুরটিকে মাঝেমধ্যে ঠাকুমাদের বাড়িতেই দেখেছি। খাবার সময় হাজির হলে, ঠাকুমা পাতে দুমুঠো ভাত রেখে দিত। এঁটোঝেঁটো বাড়লেও কুকুরটিকে দিত। আশ্চর্যের কথা, ঠাকুমা আমাদের বাড়িতে আছে সেটা জানল কীভাবে ? কেউ তো ওকে এখানে আনেনি। এমনকি, যেদিন ঠাকুমাকে এধারে আনা হলো, সেই সময় কুকুরটা ঠাকুমার বাড়িতে ছিল না। থাকলে বোধহয় ঠাকুমার পিছু পিছুই চলে আসত আমাদের বাড়িতে। কুকুরটার কথা কারও একবার মনেও পড়েনি। তাহলে কি ঠাকুমাকে দেখতে না পেয়ে হন্যে হয়ে প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি খুঁজে বেড়িয়েছে ? আজ সন্ধান পেয়ে গেছে তার বুড়ি মনিব!

বাইরে বেরতে গিয়েও সিঁড়ির দরজার কাছে থমকে দাঁড়ালাম। দেখলাম, কুকুরটার মুখের আওয়াজ শুনে ঠাকুমা ধড়ফড় করে উঠে বসল। তারপর অবাক হয়ে তাকাল কুকুরটার দিকে। তাকাতেই ঠাকুমার মুখচোখ কেমন যেন বদলে গেল। ঠাকুমাকে দেখে কুকুরটারও যেন মায়া হলো। অবোলা পশুটি দুটি নির্লিপ্ত চোখ দিয়েই হাজার হাজার প্রশ্ন তিরের মতো ছুড়ে মারছে ঠাকুমার দিকে।

ঠাকুমা আর নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। চোখ দিয়ে গড়গড় করে নেমে এল নোনা জলের ধারা। ঠাকুমাকে কাঁদতে দেখে কুকুরটার চোখগুলোও কেমন যেন ছল ছল করে উঠল।

নিমেষেই কোমরে হাত দিয়ে, লাঠিটা ধরে, কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল ঠাকুমা। এদিক-সেদিক তাকাতেই উঠানে পড়ে থাকা হাঁস-মুরগিকে খেতে দেওয়ার পুরনো থালাটা চোখে পড়ল। ঠাকুমা হেঁট হয়ে থালাটা হাতে তুলে নিল, তারপর চুপিসারে ঢুকে পড়ল হেঁশেল ঘরে।

একটু পরেই কানে এল, হেঁশেল ঘরের ভেতর থেকে হাঁড়ির ঢাকনা খোলার ঠুংঠাং শব্দ।

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button